১৩ এপ্রি, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা

1 কমেন্টস্

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা


দেখতে দেখতে আরও একটা বছরের হাসি-কান্না,সুখ-দুঃখ, মিলন-বিরহকে স্মৃতির খাতায় জমা করে দিয়ে নতুন বছর এসে হাজির, আপনার আমার ঘরের দোরগোড়ায়, বাতাসে নবীন আনন্দের সুর ছড়িয়ে। – নবীন সূর্য্যের কিরণ প্রতিভাত হোক আপনার আমার সকলের জীবনে। প্রথম সংখ্যার ‘প্রেরণা অনলাইন’ প্রকাশের শুভলগ্নে আপনাদের সবাইকে জানাই নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

আমরা একবিংশ শতকের লোক, যান্ত্রিক নগরজীবনের সাথে তাল মিলিয়ে কাটে আমাদের দিন, আমাদের রাত, আমাদের সময়। আজ সবার মুখে একই কথা, “হাতে যে একদম সময় নেই।“ লোক-লৌকিকতার সময় নেই, পরিজনের সাথে দু’দন্ড কথা বলার সময় নেই, শখ পূরণের সময় নেই, শিল্প চর্চা, কাব্য চর্চা, সাহিত্য চর্চা, যে সেখানে অবহেলিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবুও কেউ কেউ তারই মাঝে মনের ভাব কলমের আঁচড়ে, অক্ষরের সুষম বিন্যাসে সাদা কাগজের বুকে এঁকে যান, এভাবেই সৃষ্টি হয় কখনো কবিতা, কখনো গল্প, বা আত্মকাহিনী, নিবন্ধ,প্রবন্ধ, উপন্যাস, ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের রচনা।অনেকে লিখতে না পারলেও মনের খিদে মেটান চোখের বাতায়নপথে। সাহিত্য পত্রিকার নানারকম বাংলা ই-ম্যাগজিন, ব্লগ, ব্লগাজিন,ওয়েবজিন,ওয়েব ম্যাগ, বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, অর্কূট কমিউনিটি ও অন্যান্য মাধ্যমগুলি এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে।তথাকথিত লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্য পত্রিকাগুলির তুলনায় এই ই-মাধ্যমটিও কম জনপ্রিয় নয়, সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে ‘প্রেরণা অনলাইন’, প্রেরণা গ্রুপের ওয়েব ম্যাগ, ব্রতী হয়েছে নিরলস সাহিত্যসেবায়।

প্রেরণা অনলাইনকে এগিয়ে নিয়ে চলুন, সঙ্গ দিন, পথ দেখান। ‘প্রেরণা অনলাইন’ পড়ুন, পড়ান। একে অনুপ্রানিত হতে, পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হতে সাহায্য করুন। আগামী দিনগুলি আপনজনসহ আপনাদের শুভ হোক, মঙ্গলময়ীর কাছে এই প্রার্থনাই রইলো।


ধন্যবাদান্তে
সম্পাদকমন্ডলী, প্রেরণা অনলাইন

ছোটগল্প - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য

5 কমেন্টস্
ডিগ্রী
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য


তুমি থামত হে, তারক ! যত্তসব ফ্যাদরা প্যাঁচাল পাড় সবসময় – ক্ষেতু বাগচী গর্জে উঠলেন ।

চন্দন ডাক্তার গলার স্টেথোটা খুলে বলল- তারকদাকে আবার আক্রমণ কেন, ক্ষেতুদা?

তারক মোত্তির উত্তর দিলেন – তুমি কল থেকে ফেরার আগে, ক্ষেতুদা বলছিলেন- ভারতের অর্থনীতির বেশ্যায়ন হয়েছে। আমি খালি বলেছি- শব্দটার উচ্চারণ হবে, বিশ্বায়ন । তাতেই , ক্ষেতুদা ফায়ার ।

কবি বদরী সান্যাল মিনমিন করে বললেন- উচ্চারণের বিধি আছে নাকি ?

আলবৎ আছে, ফোনেটিক্স একটা সাবজেক্ট বাই ইটসেল্ফ – তারক মোত্তিরের জবাব ।

থামো হে ! “উরুশ্চারণ” কথাটা তো ফটিক দাই বলে গেছেন । ক্ষেতুদা আরও ক্ষেপে চুর ।

ফটিক দা কে ? তারক বাবুর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা ।

- আমাদের রাজুদা, মানে রাজশেখর বসুর ডাক নাম । তারক, তুমি তো বাংলা পড়াতে ! এটা জানো না ?

- অ ! রাজশেখর বসুর ডাকনাম যে ফটিক, সেটা জানতাম ! তবে, আপনি এমনভাবে বললেন, যেন আপনার কতকালের চেনা; পাড়ার ফটিক দা !

- তুমি সেদিনের ছোকরা, তোমার জানা নেই । ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল !

সত্য কম্পুর একটা বেমক্কা কাশি ঠিক এই সময়ে । ক্ষেতু বাগচী বললেন- বিষম খেলে নাকি হে সত্য ?

- না না ! গলায় একটা মশকুইটো ঢুকসে । তাই এই কাফ্ ।

- তুমি কি মশা খাও নাকি ?

- নো নো চ্যার । ঢুইক্যা গেলে, খাবার মনে কইর‌্যা ইট করি

- কানমলা,গলাধাক্কা,চিমটি,গাট্টা...এগুলোও তো খাবার জিনিষ....খাবে ?

- আমার হেড অত ষ্ট্রং না স্যার ! পেটও না ।

- কে বলেছে ? ভালো খাবার না পেলে তুমি বাড়ী মাথায় তোলো, আবার বলছ তোমার মাথা আর পেট শক্ত নয় ?

- হুম ‍! ফটিক দা কি বলতেন জান ?

- কি ?

- মাননীয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকগণ

এবং আর সবাই যাঁদের এপাড়ায় বাস,

মন দিয়ে শুনুন আমার অভিভাষণ,

আজ আমাদের আলোচ্য-Eat more grass ।

- এটা তিনি বলেছিলেন ?

- লিখেছিলেন, বুঝলে হে ! তোমাদের মত ছাগলদের জন্য লিখেছিলেন ।

- উনি তো কেমিস্ট্রিতে এম .এস. সি তাই না ক্ষেতুদা ? ডাঃ চন্দন ভাদুড়ীর জিজ্ঞাসা !

- হ্যাঁ ! তবে এম.এ. । রাজশেখরের পড়াশোনা- দ্বারভাঙ্গা স্কুল, পাটনা কলেজ । এম. এ – রসায়নে, তখন এম এস সি ছিল না । প্রথম হলেন, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ।

- বাপরে !

- আজকালকার লোকেদের মত কোনো ঘ্যাম ছিল না ! এই তারক মোত্তিরের যেমন ঘ্যাম ! ব্যাটা, বাংলায় এম. এ । একটা বাস দুর্ঘটনা হলে, যে কটা লোক আহত হয়, তার এইটটি পার সেন্ট বাংলায় এম.এ । ও আবার আমায় উচ্চারণ শেখাতে এসেছে ! ফুঃ !

- দেখুন, ক্ষেতুদা ! আমি কিন্তু আপনাকে সাবধান করছি । আমাকে বারবার এরকম হ্যাটা করবেন না ! বাংলায় এম.এ করেছেন- এরকম জ্ঞানী- গুণী জন প্রচুর!

- তা ঠিকই বলেছ হে ! আমার পি এইচ ডি করা আছে অঙ্কে । তোমার থেকে আমার ডিগ্রি অনেক বেশী ! তোমাকে হ্যাটা করে, আমার প্রেস্টিজ নষ্ট হচ্ছে ।

- পাবলিক হেলথ ডিগ্রী ?

- চোপ চন্দন ! আমি ডক্টরেট !

- ও ! ঠিক ঠিক ।

নাটু লাহিড়ী ঢুকে বললেন – গর্মী হো ইয়া বরসাত/ ক্ষেতুদা, তারকদাকো সাথ ! আজ আবার কি হলো ?

- ডিগ্রী নিয়ে ওয়ার্ড হত্যাছে । সাথে পুণ্দে,টিকস্ । সত্য কম্পুর জবাব !

- পুণ্দেটিকস্ ?

- ওটা ফোনেটিক্স ! তবে, ক্ষেতুদা যেভাবে আমাকে হ্যাটা করছেন, তাতে পুণ্দেটিকস্ টাই ঠিক । সত্য, কথায় কথায় ইংরেজি বলে বটে; তবে আজ একেবার ঠিক বলেছে । - তারক মোত্তিরের গলা অভিমানে গম্ভীর ।

- অ ! তা আমারও একটা এইরকম অভিজ্ঞতা আছে । ডিগ্রীর পিষ্টিজ ।

- কিরকম ?

- বলবো ? ক্ষেতুদা কি পারমিশন দেবেন ?

- বল হে । আজ আমার মুড নেই ! তুমিই বল ! আমি বললে তো সবার গলায় আবার মশা ঢোকে ।

- দিস, হোয়াট আফনে স্ফিক ক্ষেতু চ্যার ? মশকুইটো এনটার করেছিল তো মাইন গলায় । ওই ফ ছিল আইটক্যা, ফইটক্যার সময় । আফনে ক্যান আ্যংগ্রি ?

- ছাড়ান দাও সত্য ! বল হে নাটু ! – ক্ষেতু বাগচী এবারে উদার ।

- তাহলে শুরু করি ?

- হ্যাঁ, হ্যাঁ , শুরু করুন – সবাই সম্মতি দিলেন ।

ফ্যাকসারু আর আকালু- দুই বন্ধু । তাদের আর এক বন্ধু, সরু ! সরু এদের মধ্যে গ্র্যাজুয়েট । ফ্যাকসারু আর আকালু ম্যাট্রিকের ওপরে আর যেতে পারে নি । সরু, তাই এদের একটু এড়িয়েই চলে ।

এলাকার বিধায়ক স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক । এই তিনজনকেই তিনি তাঁর স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র দিলেন ।

ফ্যাকসারু আর আকালু পেলো প্রাথমিক শিক্ষকের পদ । সরু হলো সহকারী শিক্ষক, উঁচু ক্লাসে পড়ানোর জন্য ।

একদিন সরু স্কুলে আসার পথে দেখতে পেল- ফ্যাকসারু আর আকালু সাইকেল দুটো আমগাছে ঠেসান দিয়ে রেখে, চিৎকার করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করেই চলেছে ।

সরু, অন্য রাস্তা ধরে জোরে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে ঢুকেই সটান প্রধান শিক্ষকের ঘরে । হাঁপাতে, হাঁপাতে বর্ণনা দিল ফ্যাকসারু আর আকালুর ঝগড়ার বিবরণ প্রধান শিক্ষককে।

চুপ করে শুনে তিনি বললেন – তোমার সহকর্মীদের ঝগড়া থামানো তোমার উচিত ছিল । এলাকার লোকেরা এইসব দেখছে । তার একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে ছাত্র আর অভিভাবকদের মধ্যে ।

সরু গম্ভীর ভাবে বলল- কি যে বলেন, স্যার ! আমি হলাম গিয়ে গ্র্যাজুয়েট আর ওরা হল গিয়ে ম্যাট্রিক পাশ । আমি ওদের অনেক ওপরে ! ওদের ঝগড়া থামাবো আমি ? আমার প্রেষ্টিজ নেই ?

শেষ করে তিনি ক্ষেতুদার মুখের দিকে তাকালেন ।

ক্ষেতু বাগচী কোনো কথা না বলে, আড্ডা থেকে ওয়াক আউট করলেন ।

ছোটগল্প - অমলেন্দু চন্দ

1 কমেন্টস্
অথ অরুন্ধতী কথা
অমলেন্দু চন্দ্


স্পেসের সীমানায় পৌছতে চেয়ে সাগরবাবু ঠিক করতে পারলেন না আকাশ সসীম না অসীম, অনন্ত না শান্ত, আইনস্টাইনের ভাষায় পসিটিভ না নেগেটিভ, অঙ্কের ভাষায় প্যারাবোলা না হাইপারবোলা। আইনস্টাইন নিরুত্তর, সত্যেন বাবুও একেবারে চুপ, স্পেসের কারভেচার যখন শেষতক মাপাই গেলনা, তখন শেষমেশ ওম ভুর্ভুবস্বহ তত্স্ববিতুর বরেন্যীয়ম...নিয়ে মাতলেন, সেইন্ট পলস এর গির্জায় হিম্ন গেয়ে কাঁদলেন, তিপু সুলতান মসজিদের চাতালে শুক্রবার দুপুরের রোদে জ্বলতে জ্বলতে মাথায় khimar বেঁধে আকাশের দিকে দু হাত তুলে ভিজলেন প্রাণের আহ্লাদে মাইকে তখন নামাজের সুর তরঙ্গায়িত| দক্ষিণেশ্বরের নাটমন্দিরের দালানে অমাবস্যার রাত্তিরে একা বসে গুণ গুণ করে গাইলেন - মরণ রে তুঁহু মম।

সে রাত্তিরে নাকি এক রক্ত বস্ত্র পরিহিতা ভৈরবীও তাঁর ত্রিশূল হাতে সারারাত গঙ্গার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম - সাগরবাবু, কিরকম লাগছিল? কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে উত্তর এসেছিল - মরণ যেন বড় কাছাকাছি এসে বসেছিল রাতভর, মরণ রে.... বুঝেছিলাম, সাগরবাবু রামকৃষ্ণে মিশেছিলেন সে রাতে। ওই নাটমন্দিরের দালানেই তো রামকৃষ্ণ ভৈরবী সাধনা আর পূজা করেছিলেন সবার চোখের সামনে, আর সাগরবাবুকে দেখেছে সে রাতে শুধু গঙ্গার আকাশ আর ভৈরবীর চওড়া চাহনি। সাগরবাবু সুদর্শন। সাগরবাবু বিত্তবান, পিতৃপুরুষের ছেড়ে যাওয়া মাছের ভেড়ি আর ট্রাকের ব্যাবসা। তাঁর ঢাকাই জামদানি বা মসৃণ টাঙ্গাইলে অভ্যস্তা স্ত্রী উল্টো পাল্টা কিছু নিয়ে না মাতলেই হল এই ভাবেন আর শান্তিতে থাকেন।

তাঁর এক দেবর নাকি ওরকম সন্ধান টন্ধানে মেতে শেষতক দক্ষিন মেরু টেরু না কোথায় যেন ঠেক খেয়ে গিয়ে আজকাল সেখানকার কোকাট পল্লিতে শ্যেন দৃষ্টিতে খেয়াল রাখে সেস্থানের স্বল্পবয়সীনীরা অরাদেক্সন এর ইঞ্জেক্সান নিয়মিত নিচ্ছে কি না যেটা গাই গরুকে মোটাসোটা রাখার স্টেরয়েড। কোকাট পল্লির স্তম্ভিনিদের মোটাসোটা না রাখলে খদ্দের দের ভিড় তারা সামলাবে কি করে।দেবরটি পেশায় ডাক্তার ছিলেন, এখনো ডাক্তারিই করে চলেছেন এক ভিন্ন মাত্রায়। দেবরানী বিয়ের আগে ছিলেন ধনীর আদরিনী, এখন পরিত্যক্তা কষ্টচারিণী, সিঁথিতে সিঁদুর অনেকদিনই দেননা, কিন্তু কোন কোন দিন মধ্যরাতে তাঁর জানলার বাইরের বকুল গাছের পাখিগুলোর ঘুম ভেঙ্গে যায় - কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদে। কোন সন্তান নেই দেবরানীর, বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ডাক্তার ঘর ছেড়েছিল, দেবরানীর রূপের আগুন ছিল তখন পুবাকাশে। কেন যে ডাক্তার ঘর ছেড়েছিল তাঁর অনেকটাই আজও রহস্য। আগুন নিভে গেছে, আলোর আভাষ আজও আছে। জ্বালা হয়েছিল আলো ... সূর্য নয় চন্দ্র নয় রূপের আগুনে, তারপর ... জ্বলেছিল চিতা - স্বপ্নের ঝরা পাতা ধিকি ধিকি আজও জ্বলে ... বুকে নিয়ে সমাধির শীতল পাথর।

মেহেদি রাঙানো দু হাত তুলে স্বপ্নের কিংখাবের ভেতর অরুন্ধতী বাঁচতে চেয়েছিল,সে কিংখাবে মাখানো বিষ জ্বালিয়ে দিল তার উদযাপন। যদি কল্পিত সুখের ছায়াতেই নক্শীকাঁথার বুনট মাখা গালিচা বেছান যেত তাহলে সবার সুখের ইস্টিকুটুম আতাগাছে বাসা বাধত আর বলত সই কই সই আর স্বপ্নেরা কুটুম হয়ে দেদার আসত ঘরে। এখন কষ্টনদীর বুকে দাঁড় বাওয়ার অবসাদ কেবল গভীর রাতে কান্নার ছলাত ছল আর সতর্ক বাতাস দমবন্ধ বুকে ধরে রাখে, বেশী দূরে যেতে দেয় না সে আওয়াজ, শুধু জানালার ওধারে পাকুড় ডালের পাখিরাই শোনে। গাঢ় তমিশ্রার মত আবিল আঁধারের জটিল জিহ্বায় সে কান্নার স্বর নিঃসাড়ে অরুর বালিশ তৈলাক্ত করে।

কি অদ্ভুত ঐতিহ্য এদেশের পুলোমারা পতিতা হয়। তাদের কান্নার বসুধারা পেরিয়ে কেউ মন্ত্র পড়েনা - মধুবাতা ঋতায়তে মধুক্ষরন্তি সিন্ধব - বাতাস মধুময় হোক, সব নদীরা মধুময় হোক। শুধু আগুন সাক্ষী থাকে সে কান্নার কারনের আর কেউ কেউ রাখে খবর। এক সন্ধ্যায় চায়ের টেবিলে সাগরবাবুর ঢাকাই জামদানী পরিহিতা অর্ধাঙ্গিনী - আদপে সাগরবাবুই তার অর্ধাঙ্গ মানে সাইজে আধা, তো সেই অঙ্গিনী সাগরবাবুর পরিবার চা ঢালতে ঢালতে বললেন - জান কাল রাতেও অরুন্ধতী কাঁদছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কাগজটা মুখের ওপর থেকে একটু নেমেছিল, যেন একটা নিরুচ্চার নজর বলছে - এখনো! কেন ... আর কত নোনাপানির স্বাদ নেবে মেয়েটা...কাগজ আবার নিশ্চুপ মুখ ঢেকেছিল।

অরুন্ধতী সাগরবাবুর ভাইয়ের বউ, যাকে ঘরে রেখে সাগরবাবুর ভাই আজ চোদ্দ বছর দেশান্তরি। স্পেসের কারভেচার মনে মনে মাপতে গিয়ে অঙ্কে মেলেনি, জীবনের অঙ্কেও তাই সাগরবাবু কোনদিন সেটা মেলাতে পারেন নি। বোধহয় সে অঙ্কে ভাইয়ের দেশান্তরী হওয়ার দায়ভাগ অরুন্ধতীর ভাগে কিছুটা হলেও বর্তেছে। অন্তত সাগর জায়া তাই ভাবেন যে বেচারি অরুন্ধতী জানলই না যে সাগরবাবুর আদালতে তার বিচার হয়ে গেছে - দোষী। কলমের ভাঙা নিব টা বুঝি মাঝে মাঝে অরুন্ধতী দেখতে পায় যখন এক আধদিন রবিবারের সকালে চায়ের টেবিলে দিদিভাইয়ের ডাকে এসে বসে আর সাগরবাবু সারাক্ষণ কাগজের আড়াল থেকে দু এক টুকরো কথা ছুঁড়ে দেন।

তবু মাঝে মাঝে সাগরবাবুর চওড়া চাহনি যেন কিছু আভাষ দিতে গিয়েও থমকে থাকে , যেন কোন লজ্জাবোধ না কি কোন কিছুর জন্য নিশ্চুপে দোয়া মাগে আর সেটাও পুরো হয় না কি এক যন্ত্রনার আভাষে। তার ঘরণী টের পায় না। শুধু সেই সব সময়ে কাগজের ওপর ঝুকে পড়তে থাকা চোখ বা কপালটার দিকে অরুন্ধতীর বোবা চাউনি যেন কি বলে ওঠে, সাগরবাবু দেখেন না আর ঘরণী টের পায় না, শুধু একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন - কি রে অরু? নিরুত্তর অরু'র চোখে তৎক্ষনাত সেই বোবা চাউনির ফিরে আসা - দেখে ঘরণী আর কথা বাড়ান নি। খারাপ লাগলেও অরুর কান্না যে এ বাড়িতে জীর্ণ বস্ত্র তুল্য নষ্ট বিবর্ণ বাতিল তাস, হোক না অরু সেই তাসের দেশের রানি।

পনেরো বছর আগে বিয়ের রাতে দেবরূপ সব সারা হয়ে গেলে - মানে বিয়ের রসম রিওয়াজ শেষ হয়ে গিয়ে যখন দুজনে কাছাকাছি পাশাপাশি বসে সে রাতের নায়ক নায়িকা, চুপি চুপি অরুন্ধতীকে শুধিয়েছিল - যদি জানতে পাও আমার অনেক - না না - ভীষণ কিছু অসামর্থের কিছু দুর্বলতার কথা - তুমি কি ভাববে তখন। বয়স তখন মনের ভরা ষোল - দুজনেরই - ডাক্তার পাশ করেছে বছর চারেক আগে, আটাশ নাকি উনত্রিশ, আর অরুন্ধতী তো সবে ইউনিভারসিটি সেরে ডক্টরেট শুরু করেছে - তাও আবার সাহিত্যে! সেই চর্চার সুবাদে স্বপ্নের তুঁষে আগুন ধরিয়ে নিরুপাক্ষ কল্পনার ভুট্টা পুড়িয়ে সদ্য সীমন্তিনীর নুন লঙ্কার মাখামাখি ফ্যান্টাসির বুনো আহ্লাদে বাকসিদ্ধা হয়েছিল অরু - ধনবানের আদরিনী যাকে রূপ তো দিয়েইছিল তার বংশের জীন আর গুনবতী করে তোলায় বাপ মা কাকা জ্যাঠার কোন ত্রুটি ছিল না, বলেছিল - আমি অরুন্ধতী, তোমার যে দুর্বলতা বা অসামর্থ্যই থাক তোমাকেই প্রদক্ষিণ করে যাবো। ভেবছিল অসামর্থ আর দুর্বলতা - হাহ, পসার জমে নি আর একটু আধটু নার্সদের সঙ্গে ইয়ে টিয়ের কথা বলছে হয়ত। দেবরুপ সাগরবাবুর চাইতেও সুদর্শন সুপুরুষ, তায় আবার ডাক্তার - দুর্বলতা না থাকলে পুরুষ মানুষ মানায় নাকি তায় আবার এরকম অনেক মেয়ের হিংসে ধরানর মত স্বামী হয়েছে। গরবিনী আদরিনী অরু মজেছিল রূপের প্রেমে।

রূপের জ্বালানি যে আংরাও হয়ে সব সমস্ত কালো করে আলোবাতাসহীন শব্দগন্ধ হীন উদভ্রান্তি হয়ে যেতে পারে - অরু'র সযত্ন সক্ষম লালনে পালিত সৌন্দর্য যৌনতা বিদ্যে বুদ্ধি চতুরতা বা কোন বশীকরন মন্ত্রের তীব্রতা সে অজুত নির্জন বিভ্রান্তির প্যারাবোলা মাপতে পারে নি।

কালরাত্রিতেই শুরু স্বপ্নপোকার হামাগুড়ি। তারপর তো কাঁচপোকা টিপের হাতছানি, শরীরের গাছে শুঁয়োপোকা যখন তখন শির শির,। , ফলে ইমিউন এন্দোক্রাইন আর কারডিও ভাস্কুলার সিস্টেমের যখন তখন এক্সারসাইজ শুধু রাত বিরেতে নয়, দিনেমানেও দেখা হলেই, বরারোহা লাস্যের কপট কুহকী - না কপট নয়, অকপট, জঘনের সতীপিঠে পেয়াস বহুত হ্যায় বরষাতি মাতম ছায়ে - অভীপ্সু পিপাসার অহিচ্ছত্র ধরে সঘন জঘন খোঁজা বারে বারে ।

রূপ ছুঁয়ে দেখত সেই হাতির দাঁতের মত গ্রীবা আর মুখ ডোবাত র‍্যাভেন পাখির মত ঘন কালো আর লম্বা চুলে, অরুন্ধতীর বাদামি চোখ, সে ভ্রু পল্লবে ডাক দিলে রূপ হিতাহিত জ্ঞ্যান হারাত দীঘল সেই শরীরের বাঁকে, প্রমাণকালভবেভয়ো রত অবস্থাপনম - ফলশ্রুতি অরুন্ধতী টক খেতে আরম্ভ করল। ভ্রুপল্লবের বালিয়াড়িতে হাঁসেদের চৈ চৈ তখন অন্য রূপ অন্য স্বাদ নিয়ে ভাসতে শুরু করেছে জৈবিক নিয়মে। শরীরের মধ্যে মন যদি কোথাও প্রত্যক্ষ বাস করে তো সে মানুষের চোখে। রূপ সে চোখের ভাষায় সেই আকুল আহ্বান খুঁজে পাচ্ছিল না, আর ওদিকে চপলা হরিণী দিনে দিনে গজেন্দ্র গামিনী হয়ে ওঠায় ডাক্তারিতেই রূপ মন দিচ্ছিল বেশী করে। একদিন দুপুরে রূপ অরুর দুধের গেলাসে দুটো ট্যাবলেট ফেলে দিয়েছিল। খেয়ে ভয়ঙ্কর ঘুমের মধ্যে অরু টের পেয়েছিল আবছা রূপ তার হাতে একটা আই ভি ইঞ্জেক্সান দিচ্ছে। ঘরটাও অচেনা - ভিন্ন গন্ধে ভরা। সাড়া শরীরে অসম্ভব ব্যাথা নিয়ে জ্ঞ্যান ফিরতে অরু টের পেয়েছিল সে নারসিং হোমে - রুপের নারসিং হোম। নার্সের কাছে আর পরে রুপের মুখে জানতে পারে ওর ঘুমের মধ্যে ব্লিডিং আরম্ভ হয়েছিল, তাই ওকে সেভ করতে গিয়ে বাচ্চাটাকে ...

ধুসর রংধনুর মত ফ্যাকাশে অরুন্ধতী হঠাৎ যেন টের পেয়েছিল যে পরিমণ্ডলে তারা হয়ে প্রদক্ষিনের স্বপ্ন সে দেখেছিল সেটা আসলে মহাশুন্য - জাগতিক ত্রিশঙ্কু অবস্থা মহাজাগতিক নিয়মের বাইরে। হৃদপিণ্ডের কম্পাঙ্কের গ্রাফ একটা অশালীন ভয়ের হাঁয়ের মধ্যে দিয়ে ঠিকরে উঠে গেছিল আর শামুকের প্রকৌশলে সে গুটিয়ে গেছিল নিজের মধ্যে। কোথায় গেল তার সেই কিশোরীর ফ্রক ওড়ানো হাওয়াবাতাসের মত উল্লাসের উচ্ছাস। স্থিতিস্থাপকতার পেন্ডুলাম হঠাৎ অস্থিতির ক্যারাভ্যানে উঠে রওয়ানা দিল অনভিপ্রেত যাত্রায়।

সেদিনও অদ্ভুত লেগেছিল অরুন্ধতীর - সাগরবাবুর নিরুচ্চার নজর। বোবা সে চাউনির অ্যাক্রিলিক জোছনায় কি করে ভিজতে হয় সে রহস্য অরু'র আজও অজানা। ও শুধু আভাষ পেত চশমার কাঁচ-ঘরের ভেতরে আটকে যাওয়া কথাগুলোর গায়ে সানসেটের আলো নির্বাক বালিহাঁসের মত ডানা ঝাড়তে ঝাড়তে উড়ে যাচ্ছে। কি রয়ে গেছে অজানা মাঝে মাঝে ওই কুয়াশার গ্রিল ধরে ঝাঁকিয়ে নিয়ে বুঝে দেখবার ইচ্ছে হয়েছে অরু'র, কিন্তু সে ইচ্ছে গুলোও প্রসব বিহীন রয়ে গেছে শেষতক।

গাগর ছিল, লজ্জাবস্ত্র অঙ্গরাখা ছিল শুধু গলায় পেঁচিয়ে ডুবে মরার যমুনা ছিল না, তাই কলঙ্কিনী বিরহিণীর শিয়র ভেজার কান্না রোজ রাতে শুধু পাকুরের ডাল আর সে ডালে বসত করা পাখিরাই শুনে চুপ করে থেকে গেল। বেসুরের রাত জাগা ক্ষরনের অন্ধকারে ওই পাকুরের রাতজাগা পাখিগুলোও জেনে গেছে রোদলাগা সকালের লাল আর কোনদিন ওই জানলার অন্ধকার ভেঙে ফিরে আসবে না। সাগরবাবু চেয়েছিলেন, কিন্তু কোনোদিন মুখ ফুটে আট বছর কেটে যাওয়ার পরেও বলতে পারেন নি, শুধু চশ্মার কাঁচের আলো ঝিকিয়ে উঠে ছায়ামাখা হয়ে গেছে আর অরুও সে আভা দেখেও বোঝেনি বরদা ভাই কি বলতে চেয়ে নীরব থেকে গেলেন। পাঁশুটে জন্ডিস মার্কা অভাবী চাঁদের রক্তে বিলি রুবিনের ক্লেশ তাই সকালের রোদ চোখ মেরে চলে গেল অরুর জীবনে, দা ভাই নীরব রয়ে গেলেন, ভাই কে বড় ভালবাসতেন, তাই কোনোদিন অরু কে বলা হল না - কন্যে রে তুই এবারে গা আই অ্যাম ফ্রি ফ্রম ইউ অ্যাট লাস্ট, শুধু চশমার কাচে আলোর টুকরোগুলো পুড়ে পুড়ে আলো থেকে কালো রাত হয়ে নিবে গেল।

ছোটগল্প - মৌ দাশগুপ্তা

1 কমেন্টস্
সনাতনের ডায়েরী থেকে:
মৌ দাশগুপ্তা


সময় খুব অলস মন্থর গতিতে চলছে আজকাল, কিছুতেই যেন সময়টা আর কাটতে চাইছে না এখানে। চোখ মেললেই সেই একঘেঁয়ে গাছের পাতা, হলদেটে সবজে ঘাস, দোতলা বাড়ীটার ছাদে ঝুঁকে আসা আমগাছ, সেই কাক শালিখ চড়াইয়ের কূটকাচালি। এখানে সবকিছু ঠিক আমার মতই বুড়ো হয়ে গেছে। কি আর করি। রোদে পিঠ দিয়ে বসে সকাল থেকে অনেকবার পড়া আজকের আনন্দবাজারটাই আবার মেলে ধরি চোখের সামনে। বাসি খবর। বুড়িয়ে যাওয়া খবর। ঘরে এমন কোন বই নেই যেটা পড়া হয়নি। নতুন কেনাও হয়নি বহুদিন, কেই বা যাবে কিনতে! আমার আর সেই পায়ের জোরটাই তো আজকাল টের পাই না। ঘরে কেউ নেই কথা বলার জন্য। টিভিটাও দেখা হয়না চোখ থেকে জল পড়ে বলে। তবে সারা দিনরাত মুড়ির টিনের মত ওটাই কানের কাছে বাজে। জানান দেয় যে আমি পুরোপুরি একা নই।

মাঝে মাঝে সিনেমার কাটা রিলের মতো ছোট ছোট দৃশ্য ফিরে আসে আমায় অলস মনের দেওয়ালে। ঠিক একই ঘর, একই বারান্দা, একই জানালা। তখনো সবকিছু বুড়িয়ে যায়নি। আমার বউ ভবানী আপনমনে গান গাইছে গুনগুনিয়ে করে আর ছাঁকনি দিয়ে চা ঢালছে কাপে। আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে, ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর লাজেরাঙা মুখটা আরকটু মিষ্টি হয়ে উঠলো দুষ্টুমীর ঝিলিকে। কোমরে কাপড় জড়িয়ে উঁচু টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ঝুল ঝাড়ছে, অতিরিক্ত পরিশ্রমে ফরসা মুখটা লাল হয়ে গেছে। এমন সময় কাঁথায় শোওয়া সনত কেঁদে উঠতেই তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। আমিতো ঘাবড়ে গেছি, কার দিকে যাবো? ছেলে না বৌ? সে সব দিনগুলো কত তাড়াতাড়ি যে ফুরিয়ে গেল! ভবানী চলে যাবার পর প্রথম প্রথম আমার ভীষণ কষ্ট হতো,খুব কান্না পেতো, নিজেকে খুব অসহায় মানুষ মনে হতো। বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছিল। সনতটা না থাকলে হয়তো জীবনটা আমার আজ অন্য খাতেই বইত। শুধু ঐ মা মরা ছেলেটার মুখ চেয়েই আজো বেঁচে আছি।

সনতের জীবনটাও কেমন খাপছাড়া হয়ে গেল। কম বয়সে মা মরায় ছেলেটাকে বুকে আগলে মানুষ করেছি। সাধ্যের অতিরিক্ত খরচা করে ভাল স্কুল কলেজে পড়িয়েছি। ছেলেও আমার পড়াশুনায় তুখোড় ছিল। অনায়াসে স্কুল কলেজের পাট মিটিয়ে নিজের ব্যাবসা ফেঁদেছে। কলেজের পট মিটিয়েই নিজে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ওর কলেজের প্রফেসর জে এন মাইতির মেয়ে ঐন্দ্রিলাকে। ওদের বাড়ীর আপত্তি থাকলেও আমি সাদরে দুজনকে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। বেশ চলছিল দিনগুলো। বছর দুয়েক পরে আসলো সন্তু, আমার আদরের নাতি। কিন্তু তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলের ছেলেটাকে আমাদের বাপ-ব্যাটার ওপর ফেলে বৈতরনীর ওপাড়ে পাড়ি জমালো ফুটফুটে মেয়েটা, কদিনেই ছেলের বউ থেকে যেন মেয়ে হয়ে গেছিল আমার, কি মায়াতেই না জড়িয়ে ফেলেছিল। আমার ভাগ্যটাই এইরকম। যম বারবার কুটুম হয়ে আসে আমার বাড়ী, খালি ব্যাটা ঘাটের মরাটা আমাকেই চোখে দেখতে পায় না।

তবে কিনা সে আঘাতও সয়ে গেছি আমার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে, তখন তো আবার আসলের সুদটুকুও ছিলো। আমার সন্তু। ছেলের ঘরের একমাত্র নাতি আমার, বংশপ্রদীপ, আমার কত আদরের,কত প্রশ্রয়ের। আসলে আমি লোকটাই বড় অগোছালো, কিছুই তো জীবনভর ঠিকমত গুছিয়ে করে উঠতে পারলাম না। সনত তো দূর অস্ত, এখন অবসর জীবনে ঘরে বসে থেকেও মা মরা নাতিটাকে মনের মত করে গড়ে তুলতে পারিনি। সবাই বলতো আমার অতি আদরেই নাকি বিগরাচ্ছে ছেলেটা, আর এখন? কেউ আর কিচ্ছুটি বলে না। সন্তুর কথা ভাবলেই নিজেকে কেমন অপরাধী লাগে। ওর মুখটা মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। মাত্র একুশের ছিলো নাতিটা আমার,মাত্র একুশের , আবাগীর ব্যাটা ঐ চিত্রগুপ্ত তখনই ওর নামটা খাতায় তুলে নিল। জীবনটাকে যে ভালোমত চিনতেই পারে নি তার সাথে জীবনের কি যে শত্রুতা ছিল কে জানে। অথচ জীবনের লীলাটা দেখো, আমার নয়নের মনিটাকে, শিবরাত্রির সলতেটাকে রতনবাবুর ঘাটে চিতায় পুড়িয়ে এসেও আমি দিব্যি বেঁচে আছি, খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমচ্ছি, চলছি ফিরছি। বেঁচে তো আছি। যদিও এই ঘাটের মরা হয়ে বেঁচে থাকাটাকে বাঁচা বলে কিনা জানিনা। জীবনের এমনই মহিমা। মুখে যদিও বলি সনতটার কথা ভেবেই মরতে পারি না, কিন্তু সেটা কি সত্যি? আমারই যে কথাটায় বড় ধন্দ লাগে আজকাল। কে জানে বৌ, ছেলের বৌ, নাতি সবার আয়ূ খেয়ে আমি এক একালের যযাতি বেঁচে থাকার আনন্দে বেঁচে আছি কিনা!

গরমের এই দুপুরটা ভুতুড়ে বাড়ির মতই নীরব,রহস্যময় । নিজেকে নিয়ে ভাবার অখন্ড অবসরে পাগল পাগল লাগে।কেন যে মরন আসে না আমার, কেন যে অনর্থক বেঁচে আছি।

আজ সকাল থেকেই বড় অস্থির লাগছে। পুরানো স্মৃতিগুলো বড় ভাবাচ্ছে আমায়। কি যে করি। সনতটা পাগলের মত সারাটা দিন কাজে ব্যস্ত থাকে। রাতে নেশায় চূর হয়ে টলোমলো পায়ে ঘরে ফেরে। সবই দেখি, সবই বুঝি। কিন্তু করার তো কিছু নেই। অন্যদিন কাজের ছেলেটা মানে বিনু থাকে আশেপাশে, আজ ও গেছে বোনের বাড়ী। ফাঁকা ঘরের বিষণ্ণতটা আর সহ্য হচ্ছে না। আকাশ পরিস্কার্‌, রোদে টইটম্বুর তবু ঘরের ভেতর কেমন গুমট বাতাস পাক খেয়ে যাচ্ছে । আশেপাশে কোথাও ভাঙ্গা ভূতুড়ে গলায় ডাকছে একটা কাক । গাড়ির হর্ন আর রিকশার টুং-টাং ছাড়া কোন আওয়াজ এই বুড়ো কানে শুনে পচ্ছিনা। রাস্তা দিয়ে একটা পুরানো কাগজ কেনার ফেরিওয়ালা ক্লান্ত আলসে সুরে ডাকছে, কা...গ...জ। কা...গ...জ। বেঁচে থাকা নামের প্রহসনটার আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যাক। এভাবে বাঁচার, বেঁচে থাকার কোন মানেই হয়না। এর একটা তাৎক্ষণিক সমাপ্তি আজই চাই আমার, হ্যাঁ, আজই।

সিদ্ধান্তটা নিয়ে একই সাথে অস্থির আর চনমনে বোধ করছি। আত্মহত্যারও কিছু নিয়ম আছে । সে অনুযায়ী প্রথমেই লিখে ফেলতে হবে একটা সুইসাইড নোট।সন্তুর ঘরটায় ওর ছেড়ে যাওয়া টেবিলে বসে কাগজ আর প্রিয় কলমটা টেনে নিয়ে কাঁপা হতে লিখে ফেললাম আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র সুইসাইড । “ আমি জানি আর মানিও, যে, মানুষ বেঁচে থাকে বেঁচে থাকতে চাওয়ার আনন্দে। বাবা মা বেঁচে থাকে সন্তানের জন্য। আর তাঁদের সন্তানরা বেঁচে থাকে তাঁদের সন্তানের জন্য , কিন্তু আমার তো আর সেরকম কোন দায় নেই? তবে আমি কেন বেঁচে আছি? সত্যি বলতে কি, আমার এই ফসিল হয়ে যাওয়া জীবনের মহত্ত্বের ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সন্দিহান।মৃত্যু ভয় আর পরকাল ভীতিকে জয় করা সোজা কথা নয়।আমিও মরতে ভয় পাই,শুধু মরার পরে কি আছে তা জানিনা বলে। কিন্তু আজ অহেতুক ভয় পাবো কেন? আমার জীবন থেকে এক এক করে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজতে হলে তারা যে পথ ধরে এগিয়ে গেছে আমাকেও যে সেই পথেই চলতে হবে। অতএব, এই আত্মহত্যাকে আমি স্বেচ্ছায় জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া বলব। যা একটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়া কিছু নয়।“ সনাতন মুৎসুদ্দি। ২২ শে মে,২০১২।

লেখাটা শেষ করে আমি কেঁদেই ফেললাম ।যদিও আমি জানি, এই ঘর, এই বারান্দা ,বারান্দার পর সিঁড়ি ,তারপর একতলার এই ঘর সেই ঘর করে ফাঁকা বাড়ীতে আমার এই চিৎকার , কান্নার আওয়াজ কারো কানে পৌঁছাবে না। কারোর ঘুম ভাঙ্গাবেনা। কত গ্রীষ্ম- বর্ষা ,শীত – হেমন্ত এলো আর গেলো। কত দিনরাত কাটয়ে দিলাম এই পৃথিবীতে। ভাবতে ভাবতেই মনে হল ঘরে যেন আমি আর একা নই। আমার মা, আমার বাবা, জলে ডুবে অকালে মরে যাওয়া আমার কিশোর ভাইটা, আমার ভবানী, ঐন্দ্রিলা, সন্তু ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমায়। ওদের সবাইকে কেমন ছায়ার হালকা পেলব ছায়র পুতুল মনে হচ্ছে , দেখতে শক্ত মনে হলেও ফুঁ দিলে ঠিক উড়ে যাবে। বস্তুত স্মৃতিচাপা এক বিস্মৃতির পাথরের নিচের রহস্যময় অতীতের অন্ধকার থেকে, পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে মৃত মানুষদের মিছিল। সব কিছু মিলেমিশে সময়ের সুতার জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এক অস্তিত্বহীন সময়ের ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছি আমিও।

পরিশিষ্টঃ
প্রবীন নাগরিক সনাতন মুৎসুদ্দিকে ওনার নিজের বাসভবনে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাড়ীর দোতলা চিলেকোঠার ঘরে টেবিলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহটি প্রথমে নজরে পড়ে বাড়ীর পুরাতন গৃহভৃত্য বিনুর। সনাতন মুৎসুদ্দির হাতে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গেলেও চিকিৎসকের অনুমান অকস্মাৎ সন্নাস রোগেই ওনার মৃত্যু ঘটছে। আমরা ওনার আত্মার চির শান্তি কামনা করে ওনার পরিবারের উদ্দেশে আমাদের আন্তরিক সহমর্মিতা ব্যক্ত করছি।

ছোটগল্প - কাশীনাথ গুঁই

1 কমেন্টস্
স্বার্থপর
কাশীনাথ গুঁই

রাতে ঘুমের ঘাটতি ঘটাতাম তাই দুপুরে দুঘন্টা ভাতঘুমের একটা অভ্যেস ছিল আমার। তারপর একঘন্টা শরীরচর্চার বরাদ্দ ছিল বাঁধা। বাড়ীর কেউও ঐ সময়টা কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি কখনও।

মাধ্যমিকের টেষ্ট মনের মত হওয়ায় খুশীমনে সেদিন সকাল থেকে শুধু আকাশবানীর নানা অনুষ্ঠানেই সময় কাটিয়েছি-সারা পাড়ায় তখন শুধু হেডস্যার এর মানে তপতীদের বাড়ীতেই দূরদর্শনের অবাকবাক্সটা ছিল। প্রাইমারী থেকেই তপতী আমার ক্লাসমেট। কিন্তু খেলা আর পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোন অনুষ্ঠান দেখাশোনার ছাড়পত্র তপতীও পেতো না কখনও।আমি কিন্তু পড়ার সময়েও রেডিওতে গান,নাটক কোন অনুষ্ঠানই ছাড়তাম না-সব বন্ধুদের মত তপতীও হিংসেই করত। কারণ এরপরও আমাকে ডিঙিয়ে কেউ ফার্স্ট হতে পারত না।

ঘুম চোখ ধুয়ে ফেরার সময় দেখি তপতী বোনের সাথে কথা বলছে। আমার ঘরটা আমার জগত- বোনেদেরও ঢুকতে দিই না খুব একটা। হঠাৎ তপতীকে ঢুকতে দেখে তাই অবাক হতে যাচ্ছি তখনই ওর চোখের জলে থমকে গেলাম। ---- এখনই একবার দিঘীর পাড়ে আয়।

কোন প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই ঝড়ের মত বেড়িয়ে গেল। কিছু বোঝার অবকাশ ছিলনা,অগত্যা পিছু ধাওয়া করতে হল। দিঘীর পাড়ে একটা বুড়ো বট আছে –ঠাকুর্দাও ওটার বয়স জানতো না। বাগাল ছেলেরা গরু চড়াতে এসে দুপুর তক ওর ছায়া দখল করে-গরুগুলো দিঘীর পাড়ে ঘাস খায়। সন্ধ্যে পর্যন্ত কাকীমা-বৌদি আর পাড়ার সব মহিলাদের পেট ও মগজ সাফাইয়ের ঠাঁই এ জায়গাটা আমি সজত্নে এড়িয়ে চলি। এখনও বোধহয় সময় হয়নি ওদের আসার তাই জায়গাটা শুনশান। মেয়েটা মরতে এখানেই জায়গা পেল ভেবে মগজ আমার ঝাঁঝাঁ করছে-নেহাৎ চোখভরা জল আমাকে আসতে বাধ্য করলা। এসে ওকে না দেখে আরও রাগ বাড়ল আমার। পালানোর জন্য পিছন ফিরতেই পিছন থেকে কে যেন দুহাতে জড়িয়ে ধরল। ফোঁসফোঁসানি শুনে ঝুঁটি ধরে সামনে টানতেই ওই সাপ আমাকে আরও কঠিন বাঁধনে বাঁধল।

----আমি মরে যাব তোকে ছাড়া। তুই আমাকে বাঁচাবি, কথা দে। নাহলে ছাড়বো না – এই দিঘির জলে এখনই ডুবে মরব তোকে নিয়ে।

----আরে বাবা, বলবি তো কি হয়েছে। নাহলে আমি কি করব। তাড়াতাড়ি বল। এখনই সব গেজেটের দল এসে হাজির হবে, আমি পালাব কিন্তু।

----কাল আমাকে দেখতে আসছে। ছবিতে পছন্দ করে রেখেছে। বৌদির মাসীর ছেলে-ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার। দেখলেই গিলে খাবে-ছোটবেলা আমি দেখেছি হিরোকে। আমি তোকে ছাড়া বাঁচব না। কথা দে, তুই আমাকে নিয়ে পালাবি কিনা।

----আচ্ছা,মুশকিল! পছন্দ হলে এমন পাত্র কেউ হাতছাড়া করে। হিরোর উপযুক্ত হিরোইন হবি। তোর এই পিঙ্গল আঁখি,শুভ্র ত্বক-হিরোইন হয়েই তো জন্মছিস। আমাকে জ্বালাসনে,যা লক্ষ্মী মেয়ের মত বাড়ী গিয়ে কাকীমার বেনারসী ট্রায়াল করগে। নাহলে আমি গিয়ে সব বলছি স্যারকে-আমি বিশ্বাসঘাতক হতে পারবো না। জানিসতো আমাকে সবাই কত বিশ্বাস করে।

----অহংকারে কোনদিন চোখতুলে তো আমাকে দেখলিনা। আমার কটা চোখ নিয়ে আবার ঠাট্টা করছিস,সব বলার কি ভয় আমাকে দেখাচ্ছিস- নিজেই বইখেকো ভীতুর ডিম একটা। আমার এই অপমানের শাস্তি থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না দেখিস। তোকেও কাঁদতে হবেই – আমি জানি তুই আমাকে ছেড়ে আর কাউকে ভালবাসতেই পারবি না। মনের কথা বলার সাহসই নেই তোর মত ভিতুর ডিমের। সারাজীবন বই নিয়েই থাকবি, বউ জুটবে না দেখে নিস।

আরেকদফা গর্জন ও বর্ষণ এবং আমার বুকের মাঝে ওর নিজেকে লুকোনোর নিষ্ফল চেষ্টাকে বাধা দিতে পারিনি সেদিন। ওর কান্নার কাঁপুনিটা অজান্তে কখন আমার সিস্টোল-ডায়াস্টোলে মিশিয়ে দিয়েছে মেয়েটা তা টের পেতে সত্যি কদিন দেরী হয়েই গেল। হেডস্যার ভাল ছাত্রটিকেই পাত্রের রিসেপশনের জন্য বাসস্ট্যান্ডে রেখেছিলেন। পছন্দ সেরে যাওয়া পর্যন্ত সারাক্ষণ তপতির মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার-ওকে অদ্ভুত কাঠিন্য দিয়ে নিজেকে বাঁধতে দেখে ভিতরে কেঁপে উঠেছি,জানুয়ারীর বিকেলেও ঘেমেছি গেঞ্জী ভিজিয়ে। খেতে পারিনি -সুখাদ্যের থালা ককুরে খেয়েছে আমি অভূক্ত থেকেছি মনখারাপকে পেটখারাপ প্রমানিত করে।ও পারেনি খেতে, কাকীমা আন্দাজে চেপে ধরেছেন পাত্রকে বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে আসতেই,জরুরী কাজের অজুহাতে পালিয়েছি। ওর মুখের দিকে আজ সত্যি সত্যি এই প্রথম দেখলাম - ফর্সা মুখটা যেন রক্তহীন মনে হল।

রাতে সত্যি জ্বর এল। ব্যথায় ছটফট করেছি। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি বিছানায় নিমপাতা - ডালসুদ্ধ। মা এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল--–

- এখনও জ্বর আছ,বেরোবি না,তোর পক্স হয়েছে। সারাদিন সমাজসেবা করে এসব যে বাধালি - সামনে পরীক্ষা বুঝে নিয়ম মেনে তেরটা দিন কাটালে নিম হলুদ দেব,তারপর বাইরে যাস। তেরাত্রি এখন বইও ছুঁবি না,বুঝলি।

মা বেরোতেই বোন এসে জানাল একটু আগেই কলকাতা থেকে ফোনে তপতীর বিয়ের তারিখ পাকা হয়েছে পরের রবিবার। আমি একবার তপতীকে ডাকার কথা বলতে গিয়েও পারলাম না –যদি আবার ছোঁয়াচে রোগটা ওর বিপদ ঘটায়! একটু পরে শুনতে পেলাম যে নিম হলুদের পরদিন মা তপতীকে আইবুড়ো ভাতে ডেকেছে, আর সময় কৈ তাই – মনটা ভাল হয়ে গেল শুনেই। ও এসে ভাত খেয়ে গেল কিন্তু মা নাকি আমার ঘরে আসতে দেয়নি পরের মেয়ের দায়িত্বের কথা মনে রেখে। বাইরের জানালা থেকে একটা কঠোর চাউনি ছুড়ে দিয়ে পালাল কোন কথা না ব’লে। বিকালে ওর মা এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে তাকাল একচোখ জিঞ্জাসা নিয়ে-আমার দুচোখের জলে কিছু বুঝল হয়তো---

- আমি কিছু করতে পারলাম নারে তোদের জন্য। মাষ্টারটাও সব জেনেও এমন করবে ভাবিনি রে। মাষ্টারটাও তোকে পছন্দ করে কিন্তু আরও পাঁচটা বছর এই আগুনে মেয়েকে ঘরে রাখতে রাজী নয়, তাই জানাশোনা পাত্রটা হাতছাড়া করতে চাইছে নারে, নাহলে তোর মাও তো অরাজী নয় রে! মেয়েটাও গুমরে মরছে – আমার হয়েছে যত জ্বালা। রোগটা না বাধালে.... এখন পালাতেও তো পারবি না। মুখপোড়া বিধাতাটা যে কি চায়।

বিড়িবিড় করতে করতে পালিয়ে বোধহয় চোখের জল আড়াল করল ককিমা। এরা আমাদের নিয়ে এত ভাবে – টেরটিও পাইনি শুধু আমিই। কি নির্বোধ আমি।

আমার এই বন্দীত্বের ন’দিনের মাথায় ওর গায়ে হলুদ নিয়ে পুকুরঘাটে যাওয়ার সময় বাইরের জানালায় মুহূর্তের স্যিলুট দর্শন দিয়ে যাওয়ার সময় একটা শব্দ শুধু হাওয়ায় ছুড়ে দিল – স্বার্থপর।

প্রবন্ধ - অনুপ দত্ত

1 কমেন্টস্
মুম্বাই দূর্গা পূজা:ভালো লাগা দশ
অনুপ দত্ত



অক্টোবর মাস! বর্ষার মেঘ সরে গিয়ে মুম্বাই শহরে এক স্বস্তির নি:স্বাস নিয়ে আসে! কথায় বলে....'মুম্বাই কা বরিস...বাদল কি গর্দিশ'! সমস্ত আকাশ এক নীল সুবর্ণ ফুরফুরে আবহাওয়া নিয়ে আসে! মহারাষ্টের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান 'গণপতি বাপ্পা মোরিয়া' শুরু হয়ে যায়....চলে প্রায় সাত দিন I সঙ্গে থাকে নবরাত্রীর ঝলমলে অনুষ্ঠান...রঙ্গী বেরঙ্গি পোশাক...মেলামেশা...আর পপুলার ডান্ডিয়া নাচ !

নবরাত্রির সাথে সাথে এক অঘোষিত আওয়াজ মুম্বাই পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে ...'আমাদের মা আসছেন '! বলিউড বাঙালি সমাজে এক সাজো সাজো রব পড়ে যায়! সাজো সাজো বলছি একারণে....বাস্ত সিনেমা ..সুটিং ..ডাবিং'এর থেকে নিশ্চিন্তে চার দিন সময় বের করে নেয়া ...প্রোগ্রাম গুলো কে আগে পিছে করে একটা সমঝোতায় নিয়ে আসা.... চিত্র পরিচালক আর প্রযোজক দের কাছ থেকে...বেশ দুরহ ব্যাপার .কিন্তু মন স্থির থাকলে সেটা করে নিতে হয় আরকি ! তা না হলে পুরো বছর টা কলকাতা ছেড়ে দূর্গা পূজার যে আমেজ টা নষ্ট হয়ে যায় ! সিনেমা পাড়ায় বেশ উত্সব উত্সব ভাব নিয়ে আসে..যেমন বিপাশা /রানী/মৌসুমী/কাজল/তানিশা/জয়া/ অমিতাভ/অভিজিত/অনুরাগ/আরো অনেকে ...এদের এক বিশেষ ধারা থাকে দূর্গা পূজা পান্ডালে /যেন মুখিয়ে থাকে রূপোলি পর্দা থেকে বেড়িয়ে জনসাধারণে মেশার তাগাদায় / পুজোর এক সপ্তাহ আগে থেকেই মুখে একটা 'No Work' বোর্ড যুলিতে রাখে এরা ! হিন্দিতে একটা কথা আছে..'ঠেক'! মুম্বাই বলিউডের আর্টিস্ট দের সে রকম কিছুটা 'ঠেক' আছে...যেমন বিপাশা যাবে রানীর পুজোতে ! জয়া /অমিতাভ/ঐশ্বর্য /অভিষেক যাবে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজেতে! উঠতি আর্টিস্ট যারা ভাগ্য নির্ধারণের জন্য মুম্বাই আস্তানা নেন তারা বশীর ভাগ যান অভিজিতের লোখান্দবলার পূজাতে ! সব মিলিয়ে বেশ ঘরোয়া ব্যাপার সেজে উঠে চারিদিক! কমবেশি প্রায় ১০০ টা পুজো হয় মুম্বাই/থানে/নভি মুম্বাই মিলে !


প্রায় ২৫ বছর ধরে আমি মুম্বাইয়ের দূর্গা পূজা দেখে আসছি ....পরিবর্তন নজরে পড়েছে...অনেক !পরিবর্তনশীল জগতে সেটাই নিয়ম ....কিন্তু সেই সব পরিবর্তনের ভেতর থেকে খুব সাধারণ এবং জনপ্রিয় দশটা ভালো লাগা যদি সাজিয়ে নিতে হয়...তা হলো ..............

· ১) পূজা মন্ডপ : কলকাতা থেকে একটা আলাদা নিজস্ব স্বরূপ আছে এখানকার পূজা মন্ডপ গুলোর ! বেশে বড়সড় ( কয়েকটা ছাড়া) ! আলোর রসনায় খুব বেশি না ! এক সঙ্গে প্রায় অনেক লোক ঠাকুর দেখতে পারা !

· ২) দোকানদারী : প্রায় প্রত্যেক পূজা মন্ডপে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা বিশেষ পণ্যর দোকান বসে ! তাঁতের শাড়ী / ঢাকাই শাড়ী / নতুন বই প্রকাশন কলকাতা /মাটির গহনা শান্তিনিকেতনের /মিষ্টি দই আর সর্বপরি বাঙালি বিখ্যাত রসগোল্লা ......

· ৩) ধুপচি/ ধুনুচি নাচ : কলকাতার বাইরে এসে ছোটবেলার দেখা সেই অসাধারণ ধুপচি / ধুনুচি নাচের আসর এখানে বসে মোটামুটি প্রত্যেক পুজো উত্সবে ! লাল পেড়ে শাড়ী পড়ে মহিলারাও এতে অংশ নেন বেশ সরবে এবং গৌরবে! সচেয়ে বড় কথা হলো...কোনো কোনো পান্ডালে এর প্রতিযোগিতাও হয় !

· ৪) খিচুরী ল্যাবরা প্রসাদ : ভোগ খাওয়ার নামে এ এক অদ্ভুত উপভোগ মুম্বাই শহরের পুজো গুলোতে ! পুজোর সব কতদিন মুম্বাই বাঙালিদের রান্নাঘর তালাচাবি দিয়ে রাখেন গিন্নীরা !খোলবার জো নেই...এমন কি পারলে সকালের ব্রেক ফাস্ট না করতে পারলে তারা যেন বড় খুশি হন আর কি ! প্রত্যেক দুপুরে খিচুরী ভোগ আর লাবরা তরকারী...আর শেষে পায়েশ বা একটা অন্য কিছু মিস্টি ! দুপুরবেলায় লাইন দিয়ে প্রসাদ নেবার মারামারি..তারপর নিজেদের গ্রুপে ফিরে এসে খাওয়া আর আড্ডা ...ভগবান..সে এক নিরিবিছিন্ন আনন্দ আর আনন্দ! আগেই তো বলেছি..রাতেও রান্নাঘর বন্ধ তো..সন্ধেবেলা পুজো মন্ডপ ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখে কোথায় এক জায়গায় বসে পড়া ...হয় কলকাতা বিখ্যাত এগরোল..না হয় চিকেন রোল ..একটা হলেই হলো...খাওয়া টা বড় নয়...বড় হলো কলকাতার স্বাদ আর অফুরন্ত আড্ডা...আড্ডা..আড্ডা !আরো একটা বিশেষত লক্ষ করেছে..এই ভজন উত্সবে...হাজার হাজার অবাঙালি পূরুষ মহিলা যোগ দেন! আমার হিসেবে মহিলারা বেশি...বেশ বাঙালি মহিলার মতো শাড়ী পড়েন আরকি!

· ৫) মেলামেশা : এই এক সুন্দর সুযোগ দূর্গা পুজো উপলক্ষ্যে ...মুম্বাই'এ কাজের চাপে ..বেশি করে রোজকার অফিস যাবার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যাবার ব্যস্ততা ..নিজেদের মেলামেশাটা প্রায় সীমিত হয়ে পড়ে! এমন হয় দেখেছি..এক সোসাইটিতে থেকেও দেখা সাক্ষাত হয় না বললেই চলে! পূজামন্ডপগুলো সেই মিলন স্থল হয়ে ওঠে!

· ৬) কালিবাড়ি কালচার : এখানে মোটামুটি সব কালীবাড়িতে দূর্গা পুজোর আয়োজন হয় এবং খুব সাত্ত্বিক ভাবে পুজো পালন হয় !কালিবাড়ির পুজো গুলোতে অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দেবার হিড়িক দেখবার মতো !

· ৭) আভিজাত্য : মুম্বাই'এ সমস্ত বাঙালী সমাজের একটা বিশেষ আভিজাত্য আছে...সে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীই হোক বা চাকুরিজীবী'ই হন ! এ কয়েকদিন এখানে বেশ নজরে পরে সেটা! পোশাক কথা বলার ভঙ্গি দেখে দুর থেকে বলে দিতে পারে কেউ উনি বাঙালী বা বাঙালিনী!

· ৮) সেলিব্রেটি দর্শন : সান্তাক্রুজ মুখার্জী বাড়ির পুজোতে ভিড় হয় রানী / কাজল কে দেখার সুবাদে বা কথা বলার সুবাদে ! লোখান্দওয়ালা পুজো মন্ডপে আলাদা একটা চার্ম থাকে...উঠতি শিল্পীদের ভিড়...দেখার জন্য

· ৯) নোতুন শিল্পী সংসদ : ১০০ ভাগ পুজো মন্ডপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়...সন্ধে ৮ টার মধ্যে মোটামুটি একটা আধা পেট ভরা খাবার খেয়ে ..মন্ডপে সীট নিয়ে গ্রুপে বসে পড়া ...স্টেজে নতুন শিল্পীরা তাদের হয় নতুন আলব্যাম বা সিনেমা হিট গান পরিবেশন করেন! এ এক সুন্দর পরিবেশ কে কাকে টপকে আগে বেরোবে বলে....বেশ ভালো লাগে...বেশ উপভোগ করা যায় !

· ১০) বাঙ্গালীয়ানা : মুম্বাই শহর ব্যবসায়ী ভিত্তিক শহর! সারা বছর এই ব্যাণিজিক পরিবেশে থেকে তাদের নিজেদের পোশাক আশাক'ও পরিবর্তন হয়ে ওঠে! ধুতি পাঞ্জাবি বা শাড়ী ব্লাউজ পড়া পূরুষ বা মহিলা নজরে পরে না সচরাচর দৈনন্দিন জীবনে! কিন্তু পুজোর কটা দিন বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাসে সবাই মোটামুটি অন্তত একবার করে তাদের নিজেদের সাজান নিজেদের আদরে! আমি এমন'ও দেখেছি ...শাড়ী পড়া মহিলা অন্য চেনা মহিলাকে সন্বোধন করছেন........হাই,..হাউ আর ইউ ? পরে যখন বুঝতে পারেন ভুল হয়েছে...তখন এক অফুরন্ত হাসির রোল পুজো মন্ডপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আর সেখানেই...বাঙালী ভালবাসা!

প্রবন্ধ - সমর কুমার সরকার

7 কমেন্টস্
বৌদ্ধ শাস্ত্রের আলোকে চর্যাপদের সাধন তত্ত্ব
সমর কুমার সরকার

খ্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে লুই,কুক্কুরী,বিরুবা, গুণ্ডরী, চাটিল্ল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিণ্ডা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেন্ঢণ, দারিক, ভদ্র, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী, লাড়ীডোম্বী প্রভৃতি চব্বিশ জন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য বৌদ্ধ ধর্মের সাধন তত্ত্বের প্রকৃত গূঢ় তত্ত্বগুলিকে সাংকেতিক রূপকের আশ্রয়ে সঠিক রূপে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রাকৃত ভাষাতে কতগুলি পদ রচনা করেছিলেন। পদ গুলিতে পদকর্তা দের নামের সঙ্গে বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর উল্লেখ থাকায় বোঝা যায় পদগুলিকে সুর সহযোগে গাওয়া হ’তো। যে প্রাচীন পুঁথি তে পদগুলি সঙ্কলিত হয়েছিল তার নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, তাই গান বা পদগুলিকে গবেষক রা ‘চর্যাগীতি’ বা ‘চর্যাপদ’ নামে অভিহিত করেন। চর্যাপদ গুলি সৃজ্যমান বাংলা ভাষার এক মূল্যবান নিদর্শন। বর্তমান কাল পর্যন্ত আবিস্কৃত বাংলা ভাষার সমস্ত নিদর্শনের মধ্য চর্যাপদের ভাষাই প্রাচীনতম। চর্যাপদ গুলিতে সন্ধ্যা ভাষার আবরণে দ্বৈত অর্থ সম্বলিত উচ্চ স্তরের ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্বের চর্চা করা হ’তো। চর্যাপদ গুলির বাহ্যিক রূপ সাদামাটা ও অনাড়ম্বর হলেও ভাবগত অর্থ ছিল কাব্য সুষমা সম্পন্ন ও বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের নানা দিগদর্শনে পরিপূর্ণ।

সহজিয়া বৌদ্ধ তান্ত্রিক বা সিদ্ধাচার্য রা চর্যাপদের মধ্যে তাদের তন্ত্রসাধনার মন্ত্র গোপনে বেঁধে রাখতেন। যারা তান্ত্রিক সাধনা করেন, কেবল তারাই সেই মন্ত্র বুঝতে পারতেন। অন্যদের কাছে সেই গান ভিন্ন অর্থবহ মনে হ’তো। যোগ সাধনা বলে কুলকুণ্ডলিনী কে জাগরিত করতে পারলে যে অজর অমর হওয়া যায় সেই বিষয়ে সিদ্ধাচার্য বিরুবা একটি অদ্ভুত চর্যাপদ রচনা করেন, যার সাধারণ অর্থ ও ভাবগত অর্থ উভয়ই ভীষণ জটিল ও অর্থবহ।

বিরুবাপাদানাম্
রাগ – গবড়া

এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ।।

সহজে থির করি বারুণী সান্ধঅ।
জেঁ অজরামর হোই দিঢ় কান্ধঅ।।
দশমি দুআরত চিহ্ন দেখইআ।

আইল গরাহক অপণে বহইয়া।।
চউশটি ঘড়িএ দেল পসারা।
পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা ।।
এক সে ঘরলী সরুই নাল।
ভণন্তি বিরুআ থির করি চাল।।

[শব্দার্থ : শুণ্ডিনি = মদ্য বিক্রেতা স্ত্রী লোক, সান্ধঅ = প্রবেশ করলো, চীঅন =চিক্কণ/সূক্ষ্ম, বাকলঅ = বল্কলের দ্বারা, বারুণী = মদ, বান্ধঅ = বানালো/তৈরী করলো, থির= স্থির, অজরামর = জরাহীন ও মৃত্যুহীন, হোই = হয়, দিঢ় কান্ধঅ = দৃঢ়স্কন্ধ, দশমি দুয়ারত = দশমী দ্বারে, দেখইয়া= দেখে, আইল = এলো, গরাহক = গ্রাহক/খরিদ্দার, অপণে = নিজে, বহইয়া= পথ বেয়ে, চউশটি = ৬৪ চৌষট্টি, ঘড়িএ = ঘড়ায়, দেল= দেখালো, পসারা = পসরা/বিক্রয় যোগ্য দ্রব্যাদি, পইঠেল = প্রবেশ করলো, নিসারা = নিষ্ক্রমণ, ঘরলী = ছোট ঘড়া, সরুই=সরু, ভণন্তি = বলেন, চাল= চালো/চালনা করো ]

প্রাকৃত সন্ধ্যা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ টি কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :-

একই মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো আর সূক্ষ্ম বল্কলের সাহায্যে মদ চোলাই করলো। সহজে চিত্ত স্থির করে মদ চোলাই করো,যেন মদ্য পানকারী জরাহীন অমর ও দৃঢ়স্কন্ধ হয়। দশমীর দুয়ারেতে আমন্ত্রণের সঙ্কেত দেখে গ্রাহক নিজেই পথ বেয়ে চলে এলো। মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি চৌষট্টি টি ঘড়ায় সাজানো মদের পসরা গ্রাহক কে দেখালো। খরিদ্দার ভিতরে প্রবেশ করার পরে আর বের হবার নাম নেই। একটাই ছোট ঘড়া, তার মুখ সরু। বিরুবা বলেন,ধীরে ধীরে চালনা করো।

প্রাকৃত বাংলায় রচিত চর্যাপদটি এমনই অদ্ভুত যে,এর সাধারণ অর্থের ক্ষেত্রে যেমন কঠিন সব ইঙ্গিত রয়েছে,তেমন ই সহজিয়া বৌদ্ধ সাধন পদ্ধতির ভাবগত অর্থেও দুর্বোধ্য সব ইঙ্গিত রয়েছে । বিশুদ্ধ বাংলা রূপান্তরের প্রতিটি ছত্র কে বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো, যেন পাঠকেরা দ্বৈত অর্থ সম্বলিত চর্যাপদের স্থূল বাহ্যিক ও সূক্ষ্ম বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের মাধুর্য রস উপলব্ধি করতে পারেন।

“একই মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো আর সূক্ষ্ম বল্কলের সাহায্যে মদ চোলাই করলো” -মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি দুইটি ভিন্ন ঘরে প্রবেশ করলো,কারণ দুই ঘরে তার দুইটি পেশা একসঙ্গে চলছে। একটা ঘরে সে বকযন্ত্র বা চোলাই যন্ত্র দিয়ে উ্ত্তম মদ প্রস্তুত করে এবং তা সাজিয়ে রাখে। সহজ আনন্দ লাভের আশায় যারা আসেন, তাদের মদের যোগান দিয়ে উচ্চ মার্গের তুঙ্গ আনন্দ দেওয়াই তার প্রধান পেশা। অপর ঘরে সে গ্রাহক কে দেহ মিলনে তৃপ্ত করে, এটি তার দ্বিতীয় পেশা।

সহজিয়া বৌদ্ধ সাধন তত্ত্ব মতে মানব দেহে মেরুদণ্ডের নিম্ন দেশে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে কুন্দস্থানে রয়েছে মূলাধার চক্র।এই মূলাধার চক্র সুষুম্না নাড়ীর একটি গ্রন্থি। বৌদ্ধ তান্ত্রিক শাস্ত্রে সুষুম্না হ’লো নৈরামণি বা নৈরাত্মা, বোধিচিত্ত, অবধূতী বা যোগীনির প্রতীক। সুষুম্না নাড়ীর বাম দিকে ইড়া ও ডান দিকে রয়েছে পিঙ্গলা নামক আর ও দুইটি নাড়ী। ইড়া ও পিঙ্গলা যথাক্রমে শক্তি ও শিবের প্রতীক। মানব দেহে সঞ্চারমান প্রাণবায়ূ ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্য দিয়ে সতত চক্রাকারে আবর্তিত হয়। ইড়া ও পিঙ্গলাকে সংযত করার সাধনাই তন্ত্র সাধনা। ইড়া ও পিঙ্গলাকে সাধনার মাধ্যমে সুষুম্না তে মিশিয়ে দিতে পারলে সাধনা বলে সুষুম্না পরিণত হয় সহস্রায় বা মহাসুখ চক্রে, সেখানেই আছে মহা সহজানন্দ, অর্থাৎ সেখানেই শক্তি ও শিব রূপী জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনে নির্বাণ সুখ লাভ হয়। সুষুম্নাই হলো এ স্থলে শুণ্ডিনি। তার একটি ঘর হলো ইড়া ও অপর ঘরটি হল পিঙ্গলা। সাধন তত্ত্বের রসে আপ্লুত সাধক কে সুষুম্না প্রথমে ইড়া তে সাধনার সুরায় আসক্ত করে, তারপরে পিঙ্গলাতে মিলন সুখে তৃপ্ত করে। কাম প্রবৃত্তি থেকে যে যৌন শক্তির উদ্ভব হয় তাকে সাধকেরা কুম্ভক প্রক্রিয়ায় ইড়ার মাধ্যমে উর্ধ্ব পথে মস্তিস্কে পাঠায়। মস্তিস্কে সঞ্চিত যৌন শক্তি সাধনার প্রভাবে ওজঃ বা আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত হয়ে পিঙ্গলার পথে মূলাধার চক্রে ফিরে আসে।এই প্রক্রিয়ায় সমস্ত যৌন শক্তি ওজঃ শক্তিতে রূপান্তরিত হলে মোহ মুক্তি ঘটে এবং সহস্রায় জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের ফলে মহা সহজানন্দ লাভ হয়।

“সহজে চিত্ত স্থির করে মদ চোলাই করো,যেন মদ্য পানকারী জরাহীন অমর ও দৃঢ়স্কন্ধ হয়” – মদের চোলাই যত ভালো হয়, গ্রাহকেরা তত বেশী তৃপ্ত হয়, তাই মন স্থির করে মদ চোলাই করতে বলা হয়েছে, যেন মদ্য পানকারীরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়।

আসলে বৌদ্ধ সাধকদের বলা হয়েছে, তারা যেন একাগ্র চিত্তে কুম্ভক সমাধির মাধ্যমে মূলাধার চক্রে কুল কুণ্ডলিনী কে জাগ্রত করে সাধন পর্ব সমাধা করেন, যাতে তারা জরা হীন মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে মাথা উঁচু করে চলতে পারেন।

“দশমীর দুয়ারেতে আমন্ত্রণের সঙ্কেত দেখে গ্রাহক নিজেই পথ বেয়ে চলে এলো”-মানব দেহে দশটি ছিদ্র বর্তমান, যাদের দশ দুয়ার বলা হয়। দুইটি চক্ষু ছিদ্র, দুইটি কর্ণ ছিদ্র, দুইটি নাসিকা ছিদ্র, একটি গ্রাস নালী ছিদ্র, একটি পায়ু ছিদ্র, একটি রেচন ছিদ্র ও একটি জনন ছিদ্র মিলিয়ে মোট দশটি ছিদ্র হ’লো দশ দুয়ার। দশমীর দুয়ার অর্থাৎ যৌনাঙ্গে আমন্ত্রণের সঙ্কেত পেয়ে গ্রাহক নিজেই শুণ্ডিনির কাছে এলো।

বৌদ্ধ ধর্মমতে জগতের কল্যাণ সাধনের জন্য যিনি স্বয়ং নির্বাণ লাভ থেকে বিরত থেকে অপরকে নির্বাণ লাভে সহায়তা করেন, তাকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব। বুদ্ধত্ব লাভের জন্য বোধিসত্ত্বগণকে জন্ম জন্মান্তরে দশ পারমী পূর্ণ করতে হয়। এই দশ পারমী হলো- দান, শীল, নৈষ্কম্য,ক্ষান্তি, বীর্য, সত্য, অধিস্থান, মৈত্রী, উপেক্ষা ও প্রজ্ঞা। সাধকেরা বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সাধনা করতে গিয়ে জানতে পারলেন এই দশ পারমীর কথা, এবং এই দশ পারমী লাভের উপায় সুষুম্না তে নিহিত আছে জানতে পেরে সাধকেরা নিজেই সুষুম্নার শরণাপন্ন হ’লেন।

“মদ বিক্রেতা শুণ্ডিনি চৌষট্টি টি ঘড়ায় সাজানো মদের পসরা গ্রাহক কে দেখালো”-নর নারীর যৌন জীবন কে সুখী,তৃপ্তিকর ও সন্তোষজনক করার জন্য নারীদের কণ্ঠ সঙ্গীত, যন্ত্র সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কণ, নৃত্যকলা, কেশ শয্যা, হস্ত শিল্প, রন্ধন প্রভৃতি চৌষট্টি প্রকার গুণে দক্ষ হতে হয়। এদের বলা হয় চৌষট্টি কলা। এই চৌষট্টি কলার কয়েক টি তে পারদর্শিনী হলেই নারী রা পুরুষ দের হৃদয়ে গভীর অনুরাগের সৃষ্টি করতে পারেন। শুণ্ডিনি কে পুরুষের মনোরঞ্জন করতে হয়, তাই শুণ্ডিনি গ্রাহকের মন বুঝে এই চৌষট্টি কলার কোন না কোন একটির সাহায্যে তার মন জয় করে।

আসলে এখানে বলা হয়েছে, নারীদের চৌষট্টি প্রকার কাম কলার সবগুলি থেকে মুক্ত হতে না পারলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ অসম্ভব। সুষুম্নার সহায়তায় কুলকুণ্ডলিনী কে জাগ্রত করে দীর্ঘ সাধনায় এক একটি করে কাম কলার মোহ হতে মুক্ত হতে হয়। সুষুম্না রূপী নৈরাত্মা সাধকদের এক এক করে চৌষট্টি প্রকার কাম কলা হতে মুক্ত করে।

“খরিদ্দার ভিতরে প্রবেশ করার পরে আর বের হবার নাম নেই”- শুণ্ডিনির সান্নিধ্য পেয়ে গ্রাহকেরা এতই মত্ত যে আর বাইরে আসার নাম নেই।

আসলে বলা হয়েছে উপযুক্ত সাধন পথের সন্ধান পেয়ে সাধকেরা একবার যদি নৈরাত্মার সাহচর্যে সহজানন্দের সন্ধান পান, তবে আর গৃহী জীবনে ফিরে আসেন না।

“একটাই ছোট ঘড়া, তার মুখ সরু। বিরুবা বলেন,ধীরে ধীরে চালনা করো ” – মিলনের পথ সংকীর্ণ, তাই অহেতুক তাড়াহুড়ো অনুচিৎ।

সুষুম্না নাড়ী মানব দেহের একটি ক্ষুদ্র অংশ। সুষুম্নার সূত্রাকার পথ অতি সূক্ষ্ম। এই সূক্ষ্ম পথেই জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে । তাই বিরুবা উপদেশ দিচ্ছেন অতি ধীরে ধীরে সাধনার পথে এগিয়ে চলো।

এই ভাবে আমরা যদি ক্রমাগতঃ ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের সমস্ত চর্যাপদগুলিকে বৌদ্ধ শাস্ত্রের আলোকে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখা যাবে, সব গুলিতেই সাধন তত্ত্বের কোন না কোন গূঢ় রহস্য দক্ষতার সঙ্গে মানব জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলির আবরণে সুন্দর কাব্যিক রূপে বর্ণিত।

বৌদ্ধ সহজপন্থী সাধকেরা মনে করতেন ললনা ও রসনার মিলনে সংবৃত বোধি চিত্ত উৎপন্ন হয় ও তা নির্মাণ কায়ে অবস্থান করে। নির্মাণ কায়ে অবস্থান কালে সংবৃত বোধিচিত্ত নিচের দিকে ধাবিত হতে চায়। কিন্তু যোগ সাধনা বলে একে উর্ধ্বগামী করতে পারলে তা রূপান্তরিত হয় পারমার্থিক বোধিচিত্তে। এই পারমার্থিক বোধিচিত্তকেই চর্যাপদে নৈরামণি বলা হয়। চর্যাপদের আদি কবি শবরপাদ একটি চর্যাপদ রচনা করেন,যা তে এই নৈরামণির উল্লেখ আছে। আাপাতদৃষ্টিতে একে নর নারীর প্রেম ও মিলন চিত্র মনে হলেও, এর মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান সাধন পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।

শবরপাদানাম্
রাগ –বল্লাড্ডি

উঞ্চা উঞ্চা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহারী।
তোহেরী ণিঅ ঘরণী ণামে সহজসুন্দরী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী।।
তিঅ ধাউ খাট পড়িলা সবরো মহাসুহে সেজি ছাইলী।
সবরো ভুঅঙ্গ ণইরামণি দারী পেহ্ম রাতি পোহাইলী।।
হিআ তাঁবোলা মহাসুহে কাপুর খাই।
সুণ ণইরামণি কন্ঠে লইআ মহাসুহে রাতি পোহাই।।
গুরুবাক ধনুআ বিন্ধ ণিঅ মণে বাণেঁ।
একে সর সন্ধাণেঁ বিন্ধহ বিন্ধহ পরম নিবাণেঁ।।
উমত সবরো গরুআ রোসে।
গিরিবর সিহর সন্ধি পইসন্তে সবরো লোড়িব কইসেঁ।।

[ শব্দার্থ :উঞ্চা উঞ্চা= উঁচু উঁচু,পাবত=পর্বত,তঁহি=তথায়,বসই=বাস করে, সবরী=শবরী,বালী=বালিকা, মোরঙ্গি পীচ্ছ = ময়ূর পুচ্ছ,পরহিণ = পরিধান করেছে, গীবত = গ্রীবায়/গলায়, গুঞ্জরী = গুঞ্জা/কুঁচ ফল, মালী = মালিকা, উমত = উন্মত্ত, সবরো = শবর, মা কর =করিস না, গুলী = গোলমাল, গুহারী = গুহা বাসী, তোহেরী= তোর, ণিঅ = নিজ, ণামে=নামে,ণাণা=নানা/ বিভিন্ন, তরুবর=গাছ, মৌলিল=মুকুলিত হলো, গঅণত=গগনে/ আকাশে, লাগেলি=লাগলো/ ঠেকলো, ডালী=শাখা, একেলী=একা, হিণ্ডই=ঘুরে বেড়ায়, তিঅ=তিন, ধাউ=ধাতু, মহাসুহে=মহাসুখে,সেজি= শয্যা, ছাইলী=পাতলো/রচনা করলো, ভুঅঙ্গ=ভুজঙ্গ/নাগর, দারী = রমণী, পেহ্ম রাতি = প্রেমময় রাত্রি, হিআ=হিয়া/হৃদয়, তাঁবোলা= তাম্বুল / পান, কাপুর = কর্পূর , সুণ=শূণ্য, ণইরামণি=নৈরাত্মা, গুরুবাক=গুরুবাক্য, ধনুআ=ধনুক, বিন্ধ=বিদ্ধ করো, নিবাণেঁ = নির্বাণ কে, সিহর = শিখর, পইসন্তে = প্রবেশ করে, লোড়িব=লড়াই করিব ]

প্রাকৃত সন্ধ্যা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ টি কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :-

উঁচু উঁচু পর্বতের উপরে বাস করে শবরী বালিকা। শবরীর পরনে ময়ূর পুচ্ছ ও গলায় গুঞ্জার মালা। উন্মত্ত শবর,পাগল শবর গোলমাল ক’রো না। তোমার নিজ ঘরণী হ’লো সহজসুন্দরী। বিভিন্ন গাছপালা মুকুলিত হ’লো,তাদের ডালপালা গিয়ে ঠেকলো আকাশে। একলা কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী শবরী এ বনে ঘুরে বেড়ায়। তিন ধাতুর খাট পেতে শবর মহাসুখে শয্যা রচনা করলো। শবর ভুজঙ্গ নৈরামণির সঙ্গে প্রেমের রাত্রি কাটালো। হৃদয়রূপী তাম্বুলে মহাসুখে কর্পুর খেলো। শূণ্যদেহ নৈরাত্মা কে গলায় জড়িয়ে মহা সুখে রাত কাটালো। গুরুবাক্যের ধনুকে নিজের মন কে বাণ বিদ্ধ করো। এক শর সন্ধানে বিদ্ধ করো পরম নির্বাণ কে। গিরিবর শিখর সন্ধিতে প্রবেশ করে উন্মত্ত শবর লড়বে কি ভাবে ?

বৌদ্ধ সাধন পদ্ধতির আলোকে বিচার করে চর্যাপদটির বিশুদ্ধ বাংলা রূপান্তরের প্রতিটি ছত্র কে বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো, যেন পাঠকেরা দ্বৈত অর্থ সম্বলিত চর্যাপদের স্থূল বাহ্যিক ও সূক্ষ্ম বৌদ্ধ সাধন তত্ত্বের মাধুর্য রস উপলব্ধি করতে পারেন।

“উঁচু উঁচু পর্বতের উপরে বাস করে শবরী বালিকা” - এই মানব দেহ যেন সুমেরু পর্বত,মস্তিস্ক হলো পর্বতের শিখর। সেই শিখরে বাস করে সহজানন্দ পানে প্রমত্ত শবরের সহজ সুন্দরী গৃহিণী নৈরামণি বা নৈরাত্মা দেবী। মস্তকে অবস্থিত পারমার্থিক বোধি চিত্তই হলো এই নৈরামণি। প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব বৃত্তি থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়,তাকে ঊর্ধ্ব দিকে মহাবিদ্যুত আধার মস্তিস্কে প্রেরণ করতে পারলে, সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌন শক্তি “ওজঃ” বা আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত হয় । মানব দেহের সমস্ত পাশব যৌন শক্তি ওজঃশক্তি তে পরিণত হয়ে গেলে মানুষ নির্বাণ লাভ করে ও মহাপুরষের পর্যায়ে উপনীত হয়।

“শবরীর পরনে ময়ূর পুচ্ছ ও গলায় গুঞ্জার মালা”- শবরী র এক ই অঙ্গে বিলাস বৈভব ও কৃচ্ছসাধন এই দুইটি প্রতীক নিত্য বর্তমান। বিলাসের ভাব বিকল্প রূপ বর্ণময় ময়ূর পুচ্ছ ও কৃচ্ছসাধনের গুহ্য মন্ত্ররূপ হলো গুঞ্জার মালা।

“উন্মত্ত শবর,পাগল শবর গোলমাল ক’রো না। তোমার নিজ ঘরণী হ’লো সহজসুন্দরী”-বিষয় আনন্দে মত্ত শবর রূপী চিত্তকে সতর্ক করা হচ্ছে, যেন সে শবরী রূপী পারমার্থিক চিত্ত নৈরাত্মা কে চিনতে ভুল না করে।একমাত্র তার সঙ্গেই শবরের মিলন হওয়া উচিত।

“বিভিন্ন গাছপালা মুকুলিত হ’লো,তাদের ডালপালা গিয়ে ঠেকলো আকাশে। একলা কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী শবরী এ বনে ঘুরে বেড়ায়” - মানব দেহ রূপী সুমেরু পর্বতে অযত্নে কাম, ক্রোধ,মোহ, লালসা প্রভৃতি অবিদ্যা রূপ তরু মুকুলিত হয়েছে। তাদের শাখা প্রশাখায় মনের আকাশ অন্ধকার। তাদের ভেদ করে জ্ঞানের আলো প্রবেশ করতে পারছে না। সেই অন্ধকার কাননে নৈরাত্মা একাকিনী ঘুরে বেড়ায়। তাকে চেনার একমাত্র উপায়,তিনি বজ্রের অগ্নির মত আলোকময় জ্ঞান মুদ্রারূপী কুণ্ডল শোভিত হয়ে ঘুরে বেড়ান।

“তিন ধাতুর খাট পেতে শবর মহাসুখে শয্যা রচনা করলো”- তিন ধাতুর খাট বলতে এখানে কায়, মন ও বাক বুঝানো হয়েছে। কায়, মন ও বাক সংযম হলো সাধনার প্রথম ধাপ। জীবাত্মা রূপী শবরের সঙ্গে পরমাত্মা রূপী শবরীর মিলনের জন্য উপযুক্ত শয্যা চাই। তাই শবর কায়, মন ও বাক্য সংযমের খাট বা বেদীর উপর শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্ম রূপী মহাসুখের শয্যা বিছালেন।

“শবর ভুজঙ্গ নৈরামণির সঙ্গে প্রেমের রাত্রি কাটালো”-শবর ও শবরী প্রেমের রাত্রি কাটালো, অর্থাৎ অবশেষে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন হলো।

“হৃদয়রূপী তাম্বুলে মহাসুখে কর্পুর খেলো,শূণ্যদেহ নৈরাত্মা কে গলায় জড়িয়ে মহা সুখে রাত কাটালো”- জীবাত্মা রুপী শবর পরমাত্মা রূপী শবরীর সঙ্গে সম্ভোগচক্রে মিলিত হলেন, ফলে ব্রহ্মজ্ঞানানন্দ তুল্য নির্বাণ সুখ ভোগ করলেন। এর পরে শবর হৃদয় রূপ তাম্বুলে মহাসুখ রূপী কর্পুর খেলেন,অর্থাৎ চিত্ত কে অচিত্ততায় লীন করলেন।

“গুরুবাক্যের ধনুকে নিজের মন কে বাণ বিদ্ধ করো।এক শর সন্ধানে বিদ্ধ করো পরম নির্বাণ কে”_ শবরপাদ জানাচ্ছেন-গুরুর বাক্য রূপ ধনুকে সাধকের মন রূপী শর যোজনা করে নিক্ষেপ করায় একবার শরসন্ধানেই নির্বাণ কে বিদ্ধ করা গেছে, অর্থাৎ গুরু প্রদর্শিত পথে মন প্রাণ দিয়ে সাধনা করায় এক বারেই নির্বাণ সুখ লাভ হয়েছে।

“গিরিবর শিখর সন্ধিতে প্রবেশ করে উন্মত্ত শবর লড়বে কি ভাবে?”-নির্বাণ লাভের পর সহজানন্দ পানে প্রমত্ত জীবাত্মা মস্তকে অবস্থিত মহাসুখ চক্রে এমন ভাবে প্রবিষ্ট হয়েছে যে তার আর বিষয় বিষে দুষ্ট ক্লেদাক্ত জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই।

কৃচ্ছ সাধনের দ্বারা নির্বাণ লাভ সম্ভব, তবে কৃচ্ছসাধনের জন্য যে শিক্ষা বা জ্ঞান প্রয়োজন,তার জন্য গুরু সঙ্গ আবশ্যক এবং গুরুকে জিজ্ঞাসা করেই মুক্তির উপায় জানতে হবে। লুইপাদ নামক এক বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এই তত্ত্বের প্রচার কল্পে পটমঞ্জরী রাগে গীত এই চর্যাপদটি রচনা করেন:

লুই পাদানাম্
রাগ–পটমঞ্জরী

কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুছ্ছিঅ জাণ।।
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই।।
এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনু পাখ ভিড়ি লাহু রে পাস।।
ভণই লুই আমহে ঝাণে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পাণ্ডি বইঠা।।

[ শব্দার্থ:কাআ=দেহ/শরীর, তরুবর=বড় গাছ, পঞ্চবি=পাঁচটি, ডাল=শাখা, চীএ=চিত্তে, পইঠো=প্রবেশ করে, কাল= মৃত্যু রূপী দেবতা, দিঢ়=দৃঢ়/শক্ত, মহাসুহ=মহাসুখ, ভণই=বলেন, পুচ্ছিঅ=জিজ্ঞাসা করে, জাণ=জানো,সঅল= সর্বকাল, সমাহিঅ=একাগ্রভাবে ধ্যান মগ্ন, কাহি করিঅই= কি করিবে, নিচিত = নিশ্চিত/অবশ্যই, মরিঅই = মরিবে, এড়ি = এড়ানো/বর্জন করা, এউ=এই, ছান্দক= ছন্দের, বান্ধ = বন্ধন, করণক = ইন্দ্রিয়ের, পাটের আস = পারিপাট্যের আশা, সুনু পাখ = শূন্যপাখা, ভিড়ি=ভর করে, লাহু রে = লও রে, পাস = পাশে, আমহে = আমি, ঝাণে = ধ্যানে, দিঠা = দেখেছি, ধমণ চমণ = শ্বাস-প্রশ্বাস, বেণি –দুই রকম, পাণ্ডি=পিড়া, বইঠা = বসেছি।]

প্রাকৃত বাংলা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :

মানুষের দেহ বৃক্ষের পাঁচ টি ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করে। মনকে দৃঢ় করে মহাসুখ পাও। লুই বলে -গুরু কে জিজ্ঞাসা করে সব জেনে নাও। সুখে বা দুঃখেতে মরণ যখন নিশ্চিত,তখন সব সময়ে তপস্যা করে কি হবে ? এই ছন্দের বন্ধন এবং ইন্দ্রিয়ের পারিপাট্য ছেড়ে শূণ্য পাখায় ভর করে তার কাছে যাও। লুই বলে আমি শ্বাস-প্রশ্বাসের পিড়ায় বসে ধ্যানে সব দেখেছি।

কিন্তু লুইপাদের এই চর্যাগীতি র বিশুদ্ধ বাংলা রূপান্তরের প্রতিটি ছত্র কে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মনকে নিয়ন্ত্রণ, ইন্দ্রিয় দমন এবং গুরু বাক্য অনুসারে চিত্তের সাধন দ্বারা যে নির্বাণ লাভ সম্ভব,সেই তত্ত্বই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

“মানুষের দেহ বৃক্ষের পাঁচ টি ডাল ’’- মানুষের শরীর কে যদি একটা জীবন্ত গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে চক্ষু,কর্ণ,নাসিকা,জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় দেহ বৃক্ষের পাঁচটি শাখা স্বরূপ,যা মানুষের জীবন কে নিয়ন্ত্রণ করে।

“চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করে”- ইন্দ্রিয় গুলি মানুষ কে ভোগময় জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করে। মানুষ যত ভোগ করে,তত ভোগের স্পৃহা বাড়ে। ভোগ বিলাসে অভ্যস্ত মানুষ ভোগের ব্যাঘাত ঘটলেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। তখন মন অশান্ত হওয়ার ফলে মনের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে, অনিয়মিত ও বিশৃঙ্খল জীবন যাপনের দরুণ শরীরে কাল রূপী ব্যাধির আবির্ভাব ঘটে।

“মনকে দৃঢ় করে মহাসুখ পাও”- মনকে যত দৃঢ়তার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা যায়,মন তত শান্ত হয়। অশান্ত মন কখনই ঈশ্বর সাধনার উপযোগী হয় না। এ জন্য যোগী গণ ঈশ্বর সাধনার অঙ্গ হিসাবে নানা যোগ ব্যায়াম, প্রাণায়াম প্রভৃতির সহায়তায় চিত্ত সংযম করেন। কৃচ্ছ সাধনে মন যত সফল হয়, ভবিষ্যতে ঠিক সেই অনুপাতে সুখ বৃদ্ধি ঘটে।

“গুরু কে জিজ্ঞাসা করে সব জেনে নাও”-নির্বাণ লাভের জন্য যে প্রজ্ঞা ও উচ্চ ভাব মার্গে বিচরণের উপযুক্ত মানসিক দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয়,তা একমাত্র ধর্ম সাধকেরাই অর্জন করতে পারেন। সে জন্য সাধন পথে অগ্রসর হতে গেলে গুরু সঙ্গ প্রয়োজন । গুরুদেব জ্ঞানাঞ্জন শলাকার ছোঁয়ায় শিষ্যের জ্ঞান চক্ষুর উন্মীলন ঘটালে তবেই শিষ্য সাধনার উপযুক্ত হন। গুরুর কাছ থেকে মুক্তির উপায় জেনে নিলে সাধন পথের বাধা বিঘ্ন গুলিকে সহজেই অতিক্রম করা যায়।

“সুখে বা দুঃখেতে মরণ যখন নিশ্চিত,তখন সব সময়ে তপস্যা করে কি হবে ?”-মানুষ মরণশীল। জরা,ব্যাধি ও মৃত্যুর হাত থেকে কারও রক্ষা নেই। বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে সর্ব প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য। নির্বাণ লাভ করতে পারলে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে এবং পুনর্জন্ম হয় না। কিন্তু বোধিলাভ ছাড়া নির্বাণ সম্ভব নয়। উপাসনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও পরম জ্ঞানকেই বোধি বলা হয়। তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তপস্যার মাধ্যমে বোধি লাভ ও বোধি লাভে প্রাপ্ত জ্ঞানের সহায়তায় নির্বাণ লাভের প্রয়োজনেই তপস্যা ।

“এই ছন্দের বন্ধন এবং ইন্দ্রিয়ের পারিপাট্য ছেড়ে শূণ্য পাখায় ভর করে তার কাছে যাও।“ –মুক্ত পক্ষ পাখীর মত শূন্য মার্গ অবলম্বন করলে অর্থাৎ জাঁকজমক বা ইন্দ্রিয়ের পারিপাট্য সমূহের অকারণ ভার পরিত্যাগ করলে মন মুক্ত হয়,এবং মুক্ত মন মুক্তির সহায়ক হয়। মুক্তি লাভ করলে আত্মা বুদ্ধে বিলীন হয়।

“লুই বলে আমি শ্বাস-প্রশ্বাসের পিড়ায় বসে ধ্যানে সব দেখেছি”-লুইপাদ নিজেই ছিলেন একজন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। বৌদ্ধ ধর্মের সাধন তত্ত্ব তার জানা ছিল। শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ বা কুম্ভক সমাধি দ্বারা দেহের প্রকৃতি দোষ খণ্ডন করে, নির্বিকল্প সমাধিতে বোধি চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখসঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়,এই কথাই পরিশেষে তিনি উল্লেখ করেছেন।

সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,বজ্রযানী ও সহজযানী পন্থী সিদ্ধাচার্য গণ সন্ধ্যা ভাষায় অতি সহজ কথায় চর্যাপদ গুলি রচনা করলেও বাস্তবে তা ছিল দ্বৈত অর্থবহ, দুরূহ এবং সাধন তত্ত্বের গভীর ভাব ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ।।

মায়াপ্রপঞ্চ ও দ্বৈতবোধের উর্ধ্বে স্থিত যে ‘বোধিচিত্ত’, তাকে সকল প্রকার দ্বৈতবোধ পরিহার করে সাধন যোগে অবধূতিকা মার্গের পথে ‘মহাসুখকমল ’-এ স্থিত করে যদি সাধক মহাসুখ লাভ করেন, তবে মায়াময় পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞানরহিত হন। কুক্কুরীপাদ নামক এক বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এই তত্ত্বের ভাব কল্পে গবড়া রাগে গীত এই চর্যাপদটি রচনা করেন:

কুক্কুরীপাদানাম্
রাগ–গবড়া

দুলি দুহি পীঢ়া ধরণ ন জাই ।
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাই ॥
আঙ্গণ ঘরপণ সুন ভো বিআতী।
কানেট চোরে নিল অধরাতী ॥
সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগই।
কানেট চোরে নিল কা গই মাগই ॥
দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই ।
রাতি ভইলে কামরু জাই ॥
অইসনী চর্য্যা কুক্কুরীপা এঁ গাইল ।
কোড়ি মাঝেঁ একু হি অহি সমাইল ॥

[ শব্দার্থ:দুলি = কাছিম, দুহি = দোহন করে,পীঢ়া = পাত্র/ ভাঁড়, ধরণ = ধারণ করা, রুখের = গাছের, তেন্তলি = তেঁতুল, কুম্ভীর = কুমীর, আঙ্গণ = প্রাঙ্গন/আঙ্গিনা, সুন = শোনো, ভো=ওহে, বিআতি = বাদ্যকরী, কানেট = কানের অলঙ্কার, অধরাতী = মধ্য রাত্রি, সসুরা = শ্বশুর, বহুড়ী = বধূ, মাগই = চাইবে, কাউ = কাক, ডর = ভয়, কামরু = কামরূপ, অইসনী = এই রকম, কোড়ি = কোটি, একু = একজন, সমাইল = বুঝতে পারলো।]

প্রাকৃত বাংলা ভাষায় লিখিত এই চর্যাপদ কে বিশুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করলে সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় :

মাদী কাছিমের দুধ দোহন করে ভাঁড়ে ধরে রাখা যাচ্ছে না। গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়। ওগো বাদ্যকরী শোনো,ঘরে আর অঙ্গনে প্রভেদ নেই,ঘরের মধ্যেই অঙ্গন। অর্ধ রাত্রিতে চোরে কানের অলঙ্কার চুরি করে নিয়ে গেল। শ্বশুর ঘুমিয়ে পড়ল আর বধূ জেগে রইল। চোরে যখন কানের অলঙ্কার নিয়েই গেল, তখন কার কাছে গিয়ে আর চাইবে ? দিনের বেলায় বধূ কাক দেখে ভয় পায়, অথচ রাত্রি হলেই সে কামরূপ যায়। কুক্কুরীপাদ এমন চর্যাপদ গাইলেন, যা এক কোটি মানুষের মধ্যে হয় তো একজন ই বুঝতে পারবেন।

সাধারণ ভাবে কবিতাটিকে বিশ্লেষণ করলে মনে হয় –“এক পরপুরুষে আসক্ত বধূ, দিনের বেলায় এমন ভাব দেখায় যে কাকের ডাকেও ভয় পায়, অথচ রাত হলেই সে কামরূপ যায় অর্থাৎ কামস্পৃহা চরিতার্থ করে। বধূটি মধ্য রাত্রে শ্বশুরের নিদ্রার সুযোগে ঘরের বাইরে এসে পরপুরুষের সঙ্গে সম্ভোগ ক্রিয়া করছে। তার দুর্বলতার সুযোগে চোরের মত স্বভাবের পুরুষ তার যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে তার কানের অলঙ্কার ও হরণ করেছে। বধূ এখন কার কাছে কানের অলঙ্কার চাইবে ?

বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য গণ মানব শরীরের ষটচক্র স্থিত অখিল পদ্ম কে “মহাসুখ কমল" রূপে ও কুন্দস্থানে সুষুম্না নাড়ীর মুখদেশে মূলাধার চক্র কে “বজ্রমণিরূপ আসন” রূপে কল্পনা করেন। তাদের মতে গভীর রাত্রে ইন্দ্র্রিয়াদির সুষুপ্ত অবস্থায় কুম্ভক সমাধি দ্বারা দেহের প্রকৃতি দোষ খণ্ডন করে, নির্বিকল্প সমাধিতে কুলকুণ্ডলিনী কে জাগরিত করে অর্থাৎ মহাসুখ কমল কে বজ্রমণিরূপ আসনে স্থাপন করে বোধি চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখসঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়।

এই তত্ত্বজ্ঞানের আলোকে এবং পদকর্তার ইঙ্গিত অনুসরণ করে চর্যাপদের প্রতিটি ছত্র কে বিশ্লেষণ করলে চর্যাপদটির এই রপ ভাবগত অর্থ পরিস্ফুট হয়ঃ

“মাদী কাছিম কে দোহন করে দুধ ভাঁড়ে ধরে রাখা যাচ্ছে না” - ‘মহাসুখ কমল’ কে জাগ্রত করে বজ্রমণি রূপ আসনে ধরে রাখা যাচ্ছে না অর্থাৎ ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী কে বশীভূত করে মনের দ্বৈত ভাব দূর করে জ্ঞানের আধার মন কে নির্বাণের পথে চালিত করা যাচ্ছে না, ফলে স্বাভাবিক নির্মল আনন্দ লাভ সহজ হচ্ছে না।

“গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়”- মানব দেহকে যদি গাছ বলে কল্পনা করা হয়,তবে তেঁতুল রূপী অম্ল ফল হলো তার অন্তরের অবদমিত বিকৃত বাসনা। তেঁতুল কে কুম্ভীরে খায় অর্থে ইঙ্গিত করা হয়েছে কুম্ভক সমাধি র সাহায্যে মনের বিকৃত বাসনা কে নিবৃত্ত করা যায়।

“ঘরে আর অঙ্গনে প্রভেদ নেই,ঘরের মধ্যেই অঙ্গন”-দেহ যদি মনের ঘর হয়, তবে তার অঙ্গনে অর্থাৎ মনের মধ্যেই মহাসুখরূপ অঙ্গনে নির্বাণ লাভ সম্ভব হয় যদি দেহ ও মন এক হয়ে যায়।

“অর্ধ রাত্রিতে চোরে কানের অলঙ্কার চুরি করে নিয়ে গেল”- অর্ধ রাত্রিতে ইন্দ্রিয় গুলি সুষুপ্ত অবস্থায় থাকে, সেই সময় প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের অভিষেকের সময়। কানেট বা কানের অলঙ্কার হলো এক জাগতিক বস্তু র প্রতীক যার প্রতি মানুষের মোহ জন্মে। চুরি করা অর্থে ভাবের ঘরে চুরি করা। মধ্য রাত্রে ইন্দ্রিয় গুলি যখন সুপ্ত অবস্থায় থাকে,তখন কুম্ভক সমাধির সহায়তায় মন প্রজ্ঞার দ্বারা ভাবের ঘরে চুরি করে মনের প্রকৃতি দোষ অর্থাৎ পার্থিব বস্তুর প্রতি মোহ কে হরণ করে।

“শ্বশুর ঘুমিয়ে পড়ল আর বধূ জেগে রইল”-এই ইঙ্গিতের দ্বারা বোঝানো হয়েছে শ্বাসবায়ু যখন ঘুমিয়ে পড়ে অর্থাৎ স্থির থাকে তখন পরিশুদ্ধ প্রকৃতি রূপিণী আত্মা জেগে থাকে।

“দিনের বেলায় বধূ কাক দেখে ভয় পায়, অথচ রাত্রি হলেই সে কামরূপ যায়”-কাক প্রকৃতির আবর্জনা খেয়ে জীবন ধারণ করে ,তাই কাক বস্তু জগতের ভয়াবহ পরিণতির প্রতীক। কামরূপ অর্থে বোঝায় মহাসুখ সঙ্গম বা নির্বাণ লাভের মহা আনন্দ। দিনের বেলা যখন সকল ইন্দ্রিয় সজাগ অবস্থায় থাকে তখন পরিশুদ্ধ আত্মা বস্তু জগতের ভয়াবহ পরিণতি দেখে ভয় পায়, অথচ গভীর রাত্রে ইন্দ্রিয় গুলি যখন সুপ্ত অবস্থায় থাকে, তখন পরিশুদ্ধ আত্মা নির্বিকল্প সমাধিতে কুলকুণ্ডলিনী কে জাগরিত করে চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করলে মহাসুখসঙ্গম হয় বা সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দ উপলব্ধি হয়।

“কুক্কুরীপাদ এমন চর্যাপদ গাইলেন, যা এক কোটি মানুষের মধ্যে হয় তো একজন ই বুঝতে পারবেন”-অবশেষে কুক্কুরীপাদ সংশয় প্রকাশ করেছেন, তিনি যে চর্যাপদ গাইলেন, তা এক কোটি মানুষের মধ্যে একজন ও বুঝতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে।

আজ বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডার যখন আমাদের হাতের মুঠোয়, তখন রাশি রাশি পুস্তক পড়েও যখন চর্যা পদের ভাবগত অর্থ উদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছি, সেই নিরিখে খ্র্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের জন্ম লগ্নে রচিত এই চর্যাপদ প্রসঙ্গে করা উক্তি টি মোটেই অতিশয়োক্তি নয়।

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র

3 কমেন্টস্
বাংলা ও বাঙালি!
শ্রীশুভ্র



নববর্ষ ১৪২০! কালের মাত্রায় নতুন বছর বাংলা ও বাঙালির জীবনে! বাংলা পঞ্জিকা মতে এক হাজার চারশত ঊনিশ বছর অতিক্রম করে বাঙালির নতুন বছরে প্রবেশ! যদিও বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস তারও পুরানো! ইতিহাসের পর্ব থেকে পর্বান্তরের পথরেখা ধরে গড়ে ওঠে দেশ জাতি ও জাতীয়তা!


বাংলার একটা অতীত আছে! আছে মহাভারতসম তার ইতিহাস! সেই ইতিহাসের পথরেখায় গড়ে উঠেছে বাঙালির জাতিসত্ত্বা! আর সেই জাতিসত্ত্বার সূত্রে আজকের খণ্ড বিখণ্ড বাংলা! বস্তুত এক বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার বিবর্তনে গড়ে ওঠা বাঙালির হাতে রূপ পেয়েছে আজকের খণ্ড বিখণ্ড এই বাংলা! বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির পাশে বাঙালি তৈরী করেছে এক অভুতপূর্ব জাতিসত্ত্বার মৌলিক পরিচয়!এক বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার প্রকৃতিগত চারিত্রিক বৈশিষ্টের মৌলিক বিন্যাসে গড়ে উঠেছে আজকের বাঙালি! যে কারনে ১৯৪৭ এর দেশভাগ! যে কারণে বাংলার নেই কোনো অখণ্ড মানচিত্র! যে কারণে বাঙালির নেই কোনো জাতীয় পরিচয়! পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির পরিচয় ভারতীয় হিন্দু এবং ভারতীয় মুসলিম হিসেবে! বাংলাদেশের বাঙালির পরিচয় বাংলাদেশী মুসলিম এবং বাংলাদেশী হিন্দু হিসেবে! ওদিকে ত্রিপুরার বাঙালি হিন্দু ও বরাক উপত্যাকার বাঙালি হিন্দুরাও নিজেদের ভারতীয় পরিচয়ের আশ্রয়েই অধিক স্বচ্ছন্দ! এবং এই বিভিন্ন গোষ্ঠীবদ্ধ বাঙালি মানস পরস্পরকে অনাত্মীয় জ্ঞানে পরস্পরের মধ্যে একটি স্বাভাবিক দূরত্বের, ব্যবধানের পার্থক্য সৃষ্টি করে রাখতে ভালোবাসে!



আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে একই মাতৃভাষা ও ভৌগলিক জলবায়ু এবং দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করেও রাজনৈতিক মানচিত্রের এই রকম খণ্ড বিখণ্ড বিভাজন সম্পূর্ণ অতুলনীয়! অভুতপূর্ব! এর কারণ বহুবিধ হলেও মূলগত বৈশিষ্ট নিহিত বাঙালির নৃতাত্বিক ঐতিহ্যে! সুবিখ্যাত গবেষক চিন্তাবিদ ডঃ আহমদ শরীফের মতে বাঙালি রক্তসঙ্কর জাতি! আনুমানিক সত্তর ভাগ অষ্ট্রিক, বিশভাগ ভোটচীনা, পাঁচ ভাগ নিগ্রো এবং বাকি পাঁচ ভাগ অন্যান্য রক্ত রয়েছে বাঙালি ধমনীতে! এই মিশ্ররক্তপ্রসূত স্বভাব সাঙ্কর্যই তাঁর মতে বাঙালির অনন্যতার কারণ! ফলে বাঙালির রক্তেই রয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব! তাই সে আজও বাঙালি জাতীয়তাবোধে দীক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি!



এই রক্তসাঙ্কর্য বাঙালিকে অভিন্ন জাতিসত্ত্বায় সংহত হতে উদ্বুদ্ধ করেনি! ফলে তার মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ গড়ে ওঠার কোনো স্বাভাবিক পরিসর কোনোদিনও ছিল না! ছিল না জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মানসিকতা! যে কারণে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন বৈদেশিক শাসনের অধীনে কেটে গিয়েছে বাংলার শত শত বছর! ফলে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন বৈদেশিক ধর্ম, সংস্কৃতি, ও ভাষা শাসন করেছে বাংলার জনমানসকে! এই অধীনতা আবার বাঙালির চরিত্রে স্বাধীন আত্মপ্রত্যয় সম্ভূত বাঙালি জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার পক্ষে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছিল! যে কারণে বাঙালির জীবনচেতনায় বৈদেশিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে!



বস্তুত বাংলার ইতিহাসের পটে পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেনদের হাত ধরেই বাংলার সহস্র বৎসর ব্যাপী পরাধীনতার সূচনা! এবং এই পর্বে যে তিনটি বিষয় বাংলার জাতিসত্ত্বায় যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে সেগুলি হল ক্রমান্বয়ে, বল্লাল সেনের আমলের বর্ণভিত্তিক হিন্দু ধর্মের জাতপাতের কড়াকড়ি! মুসলীম বিজয়ের প্রভাবে ইসলামের ব্যাপক প্রসার! বৃটিশের ডিভাই এণ্ড রুল পলিসির আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রতন্ত্রের পত্তন!এই তিনটি প্রভাবের ব্যপকতা এবং তীব্রতায় হাজার বছর ব্যাপী বঙ্গ জীবনে দেশীয় জাতীয়তাবোধের উন্মেষের কোনো সুযোগই ঘটেনি! ফলে বঙ্গজীবনে দেশীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ না হওয়ার কারণ শুধুই নৃতাত্বিক নয়!



বাংলায় দেশীয় জাতীয়তাবোধের উন্মেষ না ঘটার ঐতিহাসিক কারণগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল হিন্দুধর্মের বর্ণভেদ প্রথা! বংশ পরম্পরায় প্রবাহমান এই প্রথা সমজে শ্রেণী বিভাজনকে সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করে অর্থনৈতিক শোষণকে দৃঢ় ও চিরস্থায়ী করেছিল! উচ্চবর্ণের হিন্দুর আধিপত্যে নিম্নবর্গীয় জনসাধারণ বংশপরম্পরায় বঞ্চিত ও শোষিত হতে হতে দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করতে থাকে! এই দুই শ্রেণীর মধ্যে বর্ণহিন্দুদের সৃষ্ট এই দূরোতিক্রম্য ব্যবধান তখনই বাঙালিকে বিভাজিত করে রাখে দুই প্রান্তিক অবস্থানে! শত শত শতাব্দী ব্যাপী এই বিভাজন বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষের পক্ষে প্রথম অন্তরায় হয়ে ওঠে!



সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত শোষিত শ্রেণী পুরুষাক্রমে এই ভাবে বর্ণহিন্দুদের থেকে পৃথক জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়! এরপর মুসলীম বিজয়ের প্রভাবে এই শ্রেণীর বেশিরভাগ মানুষ ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বে আকৃষ্ট হয়ে দিনে দিনে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকলে বঙ্গসমাজ হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ে বিভক্ত হতে থাকে! ইসলাম গ্রহণ অর্থনৈতিক ভাবে তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটাতে না পারলেও ইসলামের সাম্য ও ভাতৃত্বের মধ্যে তারা মানসিক আশ্রয় লাভ করে! কিন্তু বর্ণহিন্দুদের সামাজিক আধিপত্য পুরুষানুক্রমে মুসলিম সমাজকে কোণঠাসাই করে রাখতে সক্ষম হয়, কারণ শিক্ষার অধিকার এবং পেশাগত সুযোগসুবিধে তাদের হাতেই রয়ে যায় বরাবর!



বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় পেশাগত ভাবে নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি বর্ণহিন্দুদের অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য বোধ ধর্মান্তরিত মুসলিম সমাজের সম্বন্ধেও সমান ভাবেই প্রবাহমান থাকে! বস্তুত বাংলায় এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্বের কারণ প্রথমত অর্থনৈতিক পেশাগত শ্রেণী বিভাজনজাত! তার সাথে বৈদেশিক ইসলাম ধর্ম ও তার সংস্কৃতির সাথে সনাতন বর্ণহিন্দু সংস্কৃতির বৈপরীত্য যোগ হয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথমাবধি কোনো আত্মিক সংযোগ সাধন হওয়ার সুযোগই ঘটেনি শতাব্দীর পর শতাব্দী! তবু এই দুই সম্প্রদায় স্ব স্ব গণ্ডীতে আবদ্ধ থেকেও পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করে দেয়!



দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কারণ ছিল মূলত তিনটি! ধর্মান্তরিত মুসলিম সমাজ ঐতিহাসিক ভাবেই বর্ণহিন্দু সমাজের আধিপত্যবাদকে পুরুষানুক্রমে তাদের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিল! এবং জীবন জীবিকার কারণে পেশাগত ভাবে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বর্ণহিন্দুদের উপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আগাগোড়া নির্ভরশীল ছিল!
এদিকে বিদেশাগত মুসলমান সাম্রাজ্যের কাছে রাজনৈতিক পরাধীনতার কারণে বর্ণহিন্দুদেরও মুসলিম সমাজকে মেনে নিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তিপূর্ণ সহবস্থান বজায় রাখতেই হয়েছিল! যদিও মুসলিম ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর বর্ণহিন্দুদের অর্থনৈতিক শোষণ চলতেই থাকে! ফলে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্ত্বার উন্মেষই ঘটল না!



বাংলার সমাজজীবনের এই রকম অবস্থানের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়ের মতোন তাণ্ডব নিয়ে এসে পড়ল প্রবল পরাক্রান্ত বৃটিশ! সুচতুর বৃটিশ যেহেতু মুসলিম সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করে দেশকে পরাধীন করল, তাই তাদের ডিভাইড এণ্ড রুল প্রয়োগ করে তারা মুসলিম সমাজকে রাজনৈতিক ভাবে ব্রাত্য করে বর্ণহিন্দুদেরকে, সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধেসহ অগ্রাধিকার দিতে থাকল! পত্তন হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের! যার সুযোগ গ্রহণ করে সেই বর্ণহিন্দুরাই জমিদার থেকে রায়বাদুর হয়ে উঠল! ওদিকে বাংলার মুসলিম সমাজ যে তিমিরে ছিল, পড়ে থাকল সেই তিমিরেই! বাংলার এই যুগান্তরের পর্বে আর একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল! বৃটিশের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা!



বৃটিশ শাসনের প্রথম যুগে কালাপানি পার হলে বর্ণহিন্দুদের গোবর খেয়ে শুদ্ধ হতে হতো! কিন্তু সেই বর্ণহিন্দুরাই সর্বপ্রথম বৃটিশ প্রবর্তীত আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী গ্রহণ করে! এর কারণও ঐতিহাসিক! বাঙালায় শিক্ষা ব্যবস্থার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ও অধিকার বর্ণহিন্দুদেরই কুক্ষিগত ছিল! যার সুযোগে সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের চর্চা করা সম্ভব হতো! কিন্তু বৃটিশ শাসন কালে ইংরেজী ভাষা ও বৃটিশের দেওয়া ডিগ্রী অর্জন না করলে সেই অধিকারগুলি বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছিল না! তাই তারা শুধু এই শিক্ষাপ্রণালী সাদরে বরণই করল না, অচিরেই বিলেত গিয়ে জাতে উঠতে থাকল! কিন্তু মুসলিম সমাজ বৃটিশের শিক্ষালয় থেকে দূরেই রয়ে গেল প্রথমে!



ফলে বর্ধিষ্ণু বাঙালি হিন্দুরা যখন বৃটিশের প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষায় নিজেদের যুগোপোযগী করে নিতে থাকল, একই সময় বাংলার মুসলিম সমাজের আর্থিক স্বচ্ছল শ্রেণী ধর্ম পুস্তকের মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রাখল! ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণহিন্দুরা দ্রুত এগিয়ে গেল! মুসলিমরা পড়ে থাকল মধ্য যুগীয় অন্ধকারে! এদিকে বর্ণহিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বৃটিশের তৈরী ভারতীয় রাষ্ট্রতন্ত্রে নিজেদের ভারতীয় বলে অনুভব করতে যতটা শিখল, বাঙালি বলে অনুভব করতে শিখল না ততটা! অন্যদিকে বাঙালি মুসলমান তার বাঙালিত্ব ভুলে ইসলামী হয়ে উঠতে স্বচেষ্ট হলো! এবং ভারতীয়তা আর হিন্দুত্ব সমার্থক ভেবে মুসলিম সমাজ ইসলামী জাতিসত্বায় বিশ্বাসী হল!



বাঙালি হিন্দু দিনে দিনে ভারতীয় হিন্দু হয়ে উঠল! বাঙালি মুসলিম আরবের ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মধ্যে নিজেদের শিকড় কল্পনা করে আত্মপ্রবঞ্চনাজাত আত্মপ্রসাদ লাভ করল! ফলে উভয় সম্প্রদায়ই তার মূল বাঙালি ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার বিস্মৃত হয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ব এবং পাকিস্তানী ইসলামী চেতনায় নিজেদের অস্তিত্বের নোঙর ফেলে পরস্পর পরস্পরের বিদেশী হয়ে উঠতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করল! অথচ আর্থিক অনগ্রসর শোষিত বঞ্চিত সমাজের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সামাজিক সহাবস্থান ও পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ তখনো বর্তমান ছিল! কিন্তু সমাজ নিয়ন্ত্রণের চালিকা শক্তি তাদের হাতে না থাকাতে বঙ্গসমাজ কার্যত সুস্পষ্ট ভাবেই দুই সমাজে বিভাজিত হয়ে থাকল!



এই প্রসঙ্গে এটাও স্মরণযোগ্য যে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণ মূলত বর্ণহিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল! তা বাংলার সর্বত্র সর্ব শ্রেণীর মধ্যে আদৌ পরিব্যাপ্ত হয়নি! এবং সেই নবজাগরণ ঘটে মূলত ভারতীয় হিন্দুদের আধুনিক যুগোপযোগী হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই! ফলে সেই নবজাগরণের সূত্রে বর্ণহিন্দুরা ভরতীয় হয়ে উঠে তাদের বাঙালিত্বকে করল গৌণ! পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বাঙালি দেশনেতরা ভারতবর্ষের কথাই ভেবেছেন! বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কথা তাদের চেতনায় উদয় হয়নি! মুসলিম নেতারাও ইসলামী জাগরণের তাগিদে তাদের বাঙালিত্বকে ভুলে পাকিস্তানপন্থী হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করলেন তাদের সম্প্রদায়কে! বাংলা হল উপেক্ষিত!



বাংলার দূর্ভাগ্য বাংলার কোনো মনীষী, দেশনেতাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি! তাঁরা একপক্ষ ভারতীয় ও অপর পক্ষ ইসলামী জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়ে বাঙালির সাম্প্রদায়িক বিভাজনকেই অনিচ্ছাকৃত মদত দিয়ে বাঙালিকে এক পক্ষে ভারতীয়তায় অন্য পক্ষে ইসলামী জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ করলেন! ফলে জাতীয়তা তাদের কাছে হয়ে উঠল স্বধর্মীর সংহতি মাত্র! ডঃ আহমদ শরীফের কথায়, "তাই বাঙালি হিন্দু শিক্ষিত হয়ে হিন্দু হয়েছে, মুসলিম হয়েছে মুসলিম- কেউ বাঙালি থাকেনি!" ১৯৪৭ এ বৃটিশ কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের চক্রান্তে বাংলাকে যখন দুখণ্ড করা হল, বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিভক্ত করা হল, তাতে দুঃখ করার কেউ রইল না!



"দেশ নয়, ভাষা নয়, গোত্র নয়, ধর্মই আজও বাঙালির জাতীয়তার ভিত্তি!" (ডঃ আহমদ শরীফ).
তাই দেশীয় জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতিসত্ত্বায় আজও অধরাই রয়ে গেল! বাঙালি মননে আজও ধরা পড়ল না যে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে দেশ গড়ে ওঠে না! জাতির উন্নতি ঘটাতে পারে না ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ! বাঙালি তিন শতাব্দী ধরে ইউরোপের অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত থাকল, অথচ ইউরোপীয় দেশগুলির অন্তরাত্মার চারিত্রশক্তির সন্ধান পেল না! অনুধাবন করল না তাদের বিপুল উন্নতির মূল চালিকা শক্তি দেশীয় জাতীয়তাবাদ যা গড়ে ওঠে দেশ মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে! ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে নয়! ইউরোপের ৯০% দেশই খৃষ্টান! তবু ইউরোপীয় দেশগুলির দেশীয় জাতীয়তা ভিন্ন! (17)



বঙ্গমনীষা এই মূলসত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ায় তার মূল্য দিতে হল বাংলাকে খণ্ডবিখণ্ড করে! জাতির অন্তরে আজও বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বা দেশীয় ও বাঙালি হয়ে উঠতে পারেনি! ইতিহাসের পথরেখায় বাঙালি আজ ভারতীয় আর বাংলাদেশী, হিন্দু আর মুসলমান! বাঙালি নয়! ইতিহাসের এই ধারা নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহমান! তাই বিশ্বের মানচিত্রে জাতি হিসেবে বাঙালি চতুর্থ বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠী হলেও, বিশ্ব রাজনীতিতে বাঙলা অপাংক্তেও! উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ সহ অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সর্ব বিষয়ে পশ্চাদ্বর্তী! দুঃখের বিষয় হলেও এটাই স্বাভাবিক পরিণতি! আজও বাঙালি তার এই বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে! কিন্তু অনুধাবন করছে না!



বাঙালি যত বেশি শিক্ষিত হয়েছে তত বেশিই সে বাংলার সমাজ জীবন থেকে, বাংলার আবহমান ঐতিহ্য থেকে, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে ক্রমাগত দূরবর্তী করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে! বস্তুত সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপধ্যায় তাঁর বাবু প্রবন্ধে শিক্ষিত বাঙালিদের ছবিটি নিখুঁত বর্ণনা করে গিয়েছেন! ফলে এই শিক্ষিত বাঙালি ক্রমেই সমাজ বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তি জীবনের বৈভব সন্ধানী হয়ে উঠেছে! বাঙালি হিন্দু, অবাঙালি ভারতীয়দের মধ্য নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে স্বচেষ্ট হয়েছে! বাঙালি মুসলমান মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের জাত ভাই হয়ে ওঠার চেষ্টায় প্রবল ভাবে ইসলামকে আকঁড়ে ধরার চেষ্টা করেছে! তাইতো গড়ে ওঠেনি বাঙালির জাতীয় ঐক্য!



আবার নববর্ষ পঞ্জিকার গণনার পথে বাংলার প্রভাত ছুঁয়ে উন্মুখ! উন্মুখ বাঙালির চেতনায় অখণ্ড দেশীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের প্রত্যাশায়! উন্মুখ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে উঠে বাঙালির জাতীয় ঐক্যের বাস্তবায়নের সহস্র বছরের সুপ্ত স্বপ্ন বিভরতায়! উন্মুখ বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে মিলনে! উন্মুখ বিশ্বসভায় আত্মমর্য্যাদায় আত্মপ্রতিষ্ঠার আশায়! উন্মুখ বাঙালির অস্তিত্বের সত্য মূল্যের পূর্ণ উদ্ভাসনে! কিন্তু বাঙালি তার সহস্র বৎসর ব্যাপী বিচ্ছিন্ন জাতিসত্বার নৃতাত্বিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণগুলিকে ব্যর্থ করে বাংলার এই আর্তিকে সত্য করে তুলতে পারবে কি আদৌ? এ শতাব্দীতে না হলেও আগামী শতাব্দীতে? আর এক নববর্ষে ???

অনুষঙ্গ - অনুপম দাশশর্মা

1 কমেন্টস্
ছ্ন্দ বিষয়ক কিছু আলোচনা
অনুপম দাশশর্মা


বাজারময় পলিপ্যাক। বাজারের ব্যাগ হাতে দেখা যায় গোনাগুনতি ক্রেতাকে। তা আমার প্রতিবেশী বিজন হালদার কিন্তু ব্যাগ আনার অভ্যেস ছাড়েননি। ভীড় বাজার, সব্জীর দোকানে পটলের দাম শুনে চক্ষু চড়কগাছ। দেড় ইঞ্চি সাইজ পটল ১০০ টাকা প্রতি কেজি, অথচ গিন্নীর ফরমাইস করতে হবে পটলের দোর্মা। দাঁত শক্ত্ করে ব্যাগ ভরতে ভরতে বিজনবাবু স্ব্গোতক্তি করলেন-

চরচর করে দাম চড়ে যায়
ঝরঝর করে ঘাম ঝরে যায়

মনে মনে আওড়াতে বিজনবাবু চমৎকৃত হয়ে গেলেন। আরে বাঃ দিব্যি একটা পদ্য হয়ে গেল। বিজনবাবু পড়তে ভালবাসেন, ভালবাসেন তাঁর ছেলের পদ্যবই আবৃত্তি করে পড়তে কিন্ত্ কোনদিন স্ব্প্নেও ভাবেননি নিজে কিছু লিখতে পারবেন। বিজনবাবুর মন বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল, বাড়ি ফিরে একটা খাতায় খসখস করে লিখে নিলেন লাইনদুটি।

বিজনবাবু অজান্তেই বাংলা কবিতার অন্যতম একটি ছন্দ তাঁর লেখায় এনে ফেলেছেন। আসুন, আমরা সেটি নিয়েই একটু আলোচনার আসর বসাই।

বাংলা কবিতার ছ্ন্দ তিনটি। অক্ষরবৃত্ত , মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত্ ।

কবিতাকে ছন্দে বাঁধতে গেলে কিছু আবশ্যিক নিয়ম মানতেই হয়। আধুনিক কবিরা ছন্দের ধার ধারেনা, বলা যায় অতি আধুনিক কবিতা ভাবের ইচ্ছাপ্রকাশে রূপসী।

তবু কবিতার নিয়ম বা ব্যকরণ জানা উচিত। জানার পর তা অমান্য করেও লেখা যায়। কাজ না শিখলে যেমন ফাঁকি দেওয়াটা সহজ হয় না তেমনি কবিতায় মিলের ব্যপারটা না জেনে মিলের উঠোন পেরোনো যায় না। অতএব আমরা ছন্দের আসরে ফিরে আসি। আগেই লিখেছি বিজনবাবু অজান্তে যে লাইন দুটি লিখে ফেলেছেন তা আদ্যোপান্ত্ অক্ষরবৃত্ত ছন্দ তে গড়া।

চরচর /করে দাম/ চড়ে যায়
ঝরঝর/ করে ঘাম/ ঝরে যায়

লক্ষ্য করে দেখুন প্রত্যেকটি লাইনে পর্ব ভাগ করে দেখানো হয়েছে, এই ছন্দে যত অক্ষর বা বর্ণ তার তত মাত্রা অর্থাৎ প্রতিটি অক্ষর একটি করে মাত্রা পেয়ে থাকে। উপরে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেকটি পর্বে একটি করে মাত্রা দেওয়াতে চারমাত্রা করে তিনটি পর্বে তৈরী হয়েছে লাইন দুটি। এভাবে মোট মাত্রার সংখ্যা ১২ এবং পর্ব ৩ ।

যদি দেখো /কোনো রাতে/ ঘুমন্ত শি/য়রে
জোড়া জোড়া/ নীলপরী /গান গেয়ে/ চলে

এই দুই লাইনে যদি চাল কে ভাগ করে দেখা যাচ্ছে এটি চারমাত্রার চাল। আর এখানে চারমাত্রার চালের পাশে পড়ে থাকছে বাড়তি দুই মাত্রা। এই বাড়তি দুই মাত্রার ব্যবহারে কবিতা পড়তে মাঝে একটু দম নেবার সুযোগ আসে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল আসলে চারমাত্রার চাল। চাল বাড়াতে গেলে চার-এর যে কোনো গুণিতকের সাথে ( যেমন ৪x২=৮, ৪x৩=১২, ৪x৪=১৬ ইত্যদি ) দুই যোগ করে তত সংখ্যার মাত্রা দিয়েই অক্ষরবৃত্তের লাইন তৈরী হয়।

সাতনরী হার চাইছ কিংবা সাদা হাতি
জেনে রেখো আমি শুধু দিতে পারি বর্ণে চড়ুইভাতি

এই দুই লাইনকে পর্ব্ ভেঙ্গে দেখানো যাক।

সাতনরী / হার চাই / ছ কিংবা / সাদা হাতি
জেনে রেখো /আমি শুধু / দিতে পারি / বর্ণে চড়ু / ই ভাতি

পর্ব ভেঙ্গে দেখালে দেখা যাচ্ছে প্রথম লাইনে চারমাত্রার চাল চারটি কিন্তু পরের লাইনে চার মাত্রার চারটি চালের পাশে বাড়তি তিন মাত্রা বসে গেছে।

সুতরাং অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বাড়তি মাত্রার ভাঙ্গা পর্ব্ না রেখেও লাইন যেমন তৈরী করা যায় তেমন বাড়তি ভাঙ্গা পর্ব দুই তিন ও হতে পারে। অবশ্যই বাড়তি চার হয় না কেননা চার হলেই সেটি মূল পর্বে ঢুকে পড়ে আলাদা করে আর ভাঙ্গা পর্ব হয় না।

অক্ষরবৃত্তের সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ হলো।

(চলবে )

প্রবন্ধ - প্রদীপ কুমার দাস

1 কমেন্টস্
নাস্তিক ও সন্ন্যাসী
প্রদীপ কুমার দাস



দিনটি ছিল ১৫ই অক্টোবর ১৮৯২, বেলগাম শহরের নামকরা আইনজীবি সদাশিব বালকৃষ্ণা ভাটের অতিথি হয়ে এলেন এক যুবক সন্ন্যাসী। আগন্তুক সন্ন্যাসী নিজের পরিচয় জানিয়ে মহারাজা কোল্হাপুরের ব্যক্তিগত সচিব রাওসাহেব লক্ষ্মণরাও গোল্ভাল্কারের লেখা একটা চিঠি ভাটে সাহেবের হাতে দিলেন। ভাটে সাহেব তার বাড়িতে বেলগামের সব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এলেন, এই সন্ন্যাসীর দর্শন করার জন্য। ব্যতিক্রম একমাত্র তত্কালীন সাব ডিভিসানাল ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্র।

হরিপদ মিত্র বিশ্বাস করতেন সব সন্ন্যাসীরা ভন্ড এবং ঠগ, এরা প্রচন্ড কুঁড়ে, কোনো কাজ করতে নারাজ তাই এরা পেশা হিসাবে সন্ন্যাসকেই বেছে নেয়। ভাটে সাহেব হরিপদ বাবুর এই ধারণার কথা খুব ভালভাবেই জানতেন। কিন্তু, তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এই তরুণ সন্ন্যাসীর সঙ্গে যদি হরিপদবাবুর দেখা হয় তাহলে তার সন্ন্যাসী সম্বন্ধে সমস্ত ধারণা বদলে যাবে। ১৮ তারিখ সন্ধ্যাবেলা হরিপদবাবু তার বৈঠকখানায় এসে দেখেন ভাটে সাহেব এক তরুণ সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ভাটে সাহেব খুব উচ্ছসিত হয়ে আলাপ করিয়ে দিলেন, “ইনি হলেন একজন উচ্চশিক্ষিত বাঙালি সন্ন্যাসী, তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন”। হরিপদবাবু দেখলেন আগন্তুক সন্ন্যাসীর পরণে গেরুয়া পোশাক, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, পায়ে কোল্হাপুরি চপ্পল, দাড়ি খুব পরিষ্কার করে কামানো এবং দুই চোখ থেকে যেন এক অদ্ভুত দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে। হরিপদবাবু যদিও একটু সময়ের জন্য সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্বে আকর্ষিত হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু তার মনে একটা সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছিল। “এই বাঙালি সন্ন্যাসীকে নিয়ে তার বন্ধু কেন এসেছে? তবে কি সন্ন্যাসীর তার মারাঠি বন্ধুর বাড়িতে থাকতে অসুবিধা বলে এখানে থাকার মতলব?” এই ভেবে তিনি সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মশাই কি ধুমপান করেন? আমি কায়স্থ, আমার একটি হুঁকা আছে, যদি আপনার কোনো অসুবিধা না থাকে তাহলে আপনি সেটি দিয়ে ধুমপান করতে পারেন, আমি তাহলে আপনার জন্য তামাক সাজিয়ে দিতে পারি।” সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি বিড়ি, সিগারেট বা হুঁকা যা পাই তাই দিয়েই ধুমপান করি। আর আপনার হুঁকা থেকে ধুমপান করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই’।

হরিপদবাবু সন্ন্যাসীর জন্য তামাক সাজিয়ে এনে আলাপ করতে বসলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার আর বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না যে এই সন্ন্যাসী অন্যান্য সন্ন্যাসীর থেকে কত আলাদা। তিনি সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্বে এতটাই আকর্ষিত যে তিনি তাকে তার বাংলোতে থাকার অনুরোধ করলেন। সন্ন্যাসী মৃদু হেসে অসম্মতি জানালেন।

পরেরদিন ভাটেসাহেবের বাড়ি গিয়ে তিনি দেখেন বেলগামের সমস্ত বুদ্ধিজীবী পরিবেষ্টিত হয়ে সন্ন্যাসী উঠানে বসে আছেন আর সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।

ইতিমধ্যে, সম্মানীয় এক আইনজীবি প্রশ্ন করলেন, “আমরা আমাদের সকাল এবং সন্ধ্যাবেলার প্রার্থনার জন্য যে মন্ত্রোচ্চারণ করে থাকি, সেগুলো সব সংস্কৃত ভাষায় হবার জন্য আমরা তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারি না। এমন মন্ত্রোচ্চারণের কি উপকারিতা?” সন্ন্যাসী উত্তরে বললেন, “ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। আপনি ইচ্ছা করলে অনায়াসে ওই কয়েকটা মন্ত্রের মানে শিখতে পারেন। আর সেটা যদি না করতে পারেন, তাহলে তার জন্য কাকে দায়ী করা উচিত আপনি বলুন? আর যদি মন্ত্রের মানে নাও জানেন, তবু, যখন আপনি প্রার্থনা করতে বসেন, তখন আপনার মনের মধ্যে একটা পবিত্র কাজ করার ভাবনা আসে, যেটা সম্পূর্ণ পাপমুক্ত। যদি কারো মনে কিছু ভালো চিন্তা কাজ করে তাহলে সেই চিন্তা প্রসুত ফল ও ভালো হবে”।

কোনো একজন বললেন, “ধর্মীয় আলোচনা বিদেশী ভাষায় করা উচিত নয় কারণ আমাদের পুরাণ এর অনুমতি দেয় না”। উত্তরে সন্ন্যাসী বললেন,”ধর্মীয় আলোচনা এত পবিত্র, যে কোনো ভাষা একে অপবিত্র করতে পারেনা। বেদে এর উল্লেখ আছে। হাইকোর্টের রায় কি লোয়ার কোর্ট খারিজ করতে পারে?”

সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলে হরিপদবাবু আকর্ষিত হলেও তার মনে যে সন্ন্যাসীদের প্রতি এক তিক্ততা ছিল, সেটা পুরোপুরি চলে যায়নি। তিনি সন্ন্যাসীকে জিগ্গেস করলেন, সন্ন্যাসীরা এমন অলস জীবনযাপন করে কেন? কেনই বা তারা অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যের প্রত্যাশী হয়ে থাকে? তারা কেন এমন কোনো কাজ করেনা, যাতে সমাজ লাভবান হয়?

সন্ন্যাসী বললেন, “দেখুন, এই যে আপনি এত পরিশ্রম করে এত অর্থোপার্জন করছেন এর সামান্য এক অংশই আপনি নিজের জন্য খরচা করে থাকেন, এর বেশ কিছুটা অংশ যাদের আপনি নিজের মনে করেন তাদের জন্যে খরচা করে থাকেন। অথচ, আপনি তাদের জন্যে যা করছেন তার কৃতজ্ঞতাও তারা স্বীকার করেন না, বা তাদের প্রাপ্তিতে তারা পরিতৃপ্তও নয়। বাকি যেটা সারা জীবন ধরে সঞ্চয় করছেন, সেটা শুধু যক্ষের মত রক্ষা করে যাবেন, উপভোগ করতে পারবেন না। যখন আপনার মৃত্যু হবে, অন্য কেউ এসে সেই সঞ্চয় শুধু যে ভোগ করবে তা নয়, উপরন্তু আপনাকে গালাগালি দেবে, আরো কিছু বেশি সঞ্চয় না করে যাবার জন্য। অথচ একজন সন্ন্যাসী হয়ে কিছুই করিনা, যখন খিদে পায়, আমি ইশারায় অন্যকে জানাই আমার খিদে পেয়েছে, কিছু খাবার প্রয়োজন; যা পাই তাই খাই। আমি সংঘর্ষও করিনা আবার সঞ্চয়ও করিনা। এবারে আপনি বলুন কে বেশি বিজ্ঞ? আমি নাকি আপনি?”

এই ভাবে তিনি একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে থাকেন আর সন্ন্যাসী তার উত্তর দিতে থাকেন। এমনি করে নয়টি দিন দেখতে দেখতে চলে গেল। এর মধ্যে হরিপদবাবু সপরিবারে দীক্ষা নিলেন। জীবনে এই প্রথম হরিপদবাবু কারো চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলেন।

বলাবাহুল্য এই তরুণ সন্ন্যাসীটি স্বামী বিবেকানন্দ। বেলগাম থেকে তিনি ট্রেনে মারগাঁও এর উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেন। কর্নাটক সরকার ২০০০ সালে হরিপদ বাবুর সেই বাংলো এবং সংলগ্ন জমি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করেছেন। আজ সেই বাংলো সংরক্ষণ করে সংলগ্ন জমিতে বেলগাম রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপিত হয়েছে। বেলগাম অবস্থান কালে হরিপদ মিত্র বিবেকানন্দের একটি ছবি তোলানোর ব্যবস্থা করেন। সেই ছবিটি ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তিনি কোল্হাপুরি চপ্পল পরে আছেন।

মুক্তগদ্য - ইমেল নাঈম

2 কমেন্টস্
দৃষ্টির পরিমিতি
ইমেল নাঈম


জামার ভেতর শূন্যস্থানে কেমন যেন ব্যথা অনুভব করি , মনে হয় কোথায় কি যেন নেই । মিরাকল হলেও সত্য এই পৃথিবীতে একজন হৃদপিণ্ডবিহীন মানুষ বেঁচে আছে ম্যাডিকেল সায়েন্সকে ভুল প্রমান করে , আর সেই মানুষটি আমি । ঠিক তোমাদের মত নয় আমার জীবন। তোমরা বিপদ দেখলে পালাও আর আমি বিপদকে বুকে টানি , দুঃখ পেলে প্রাণখুলে হাসি , ব্যথাকে মনে করি একমাত্র প্রিয় বন্ধু । মেয়ে দেখলে আড়চোখে তাকাই , তাও তোমাদের মতন করে নয় । সকল মেয়ের মাঝে খুঁজে ফিরি হারিয়ে যাওয়া প্রিয় একটি মুখ ।

বৃক্ষের সাথে আমার অদ্ভুত মিল , দুজনেই প্রিয় মানুষের জন্যে পথ চেয়ে থাকি । বৃক্ষ যেমন জানে না কখন ফিরবে তার প্রেমিকা তেমনই আমি জানি না কখন খুঁজে পাবো তাকে । কত ফুলের দিকে চোখ যায় , কোন ফুল আমার মনের কথা বলে না । বুকের ভেতরে শুনশান নীরবতা বারবার বলে উঠে তুই একা … বড্ড একা ... ছায়াও তোর আপন নয় রে বোকা ।

মাঝে মাঝে ভাবি ভালবাসা মানে কি ? ভালবাসা মানে কি একজন মানুষকে অনর্থক ভালবেসে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া । একদিন তুমি একটি কবিতা আবৃতি করে বলেছিলে ভালবাসা হল তিনটি ফুলের সমন্বয় । একটি আমি অন্যটি তুমি আর বাকিটা ভালবাসা । তোমার বিমুগ্ধতায় নিমজ্জিত হয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম , ঝড় নয় একটু এলোমেলো বাতাসেই যে ঝরে যায় ফুলের পাপড়ি , যেমনটি ঝরে গেলে তুমি , নষ্ট হলাম আমি আর উড়ে গেল প্রেম।

এভাবেই প্রতিটি রাত পেরিয়ে যায়, ভোর আসে না । বুকের ভেতরে পিনপিন ব্যথা জানান দেয় ভালবেসে হৃদপিন্ডহীন মানুষও নিঃস্ব হতে জানে ।

মুক্তগদ্য - লাভলী ভট্টাচার্য্য

1 কমেন্টস্
খোলা চিঠি..
লাভলী ভট্টাচার্য্য


প্রিয়তমেষু,

অচেনা , অজানা দুটো পথ ছিল। মন ? সেতো চেনা অসম্ভব। কথা হোতো কিন্তু অন্য কিছু নিয়ে , সেখানে ভালোলাগা ছিল ,ছিলনা ভালোবাসা । ভালো লেগেছিল প্রথম দেখায় , মিথ্যে বলবো না। বলতে গিয়েও আটকে যেতাম ,কারণ টা আর উল্লেখ করতে চাইনা আজকের দিনে ।পরিচয় টা এস এম এস এ আরও গভীর হল ,একটা যেন অপেক্ষা থাকতো কখন বাজবে টেলিফোন ? এই Dec এই হাতে হাত ধরার ইচ্ছে প্রকাশ । এক নিমেষে হারিয়ে গেছিলাম। একটা দিন একান্তেপাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে দাঁড়ালো । অবশেষে পেয়ে গেলাম ,..

শুরু হল পথচলা পাশাপাশি ,শুরু হল ভাগাভাগি,জীবনের অনুভূতি ,সুখ-দুখ,কান্না-হাঁসি ।

আমরা ভোগ করতে চাইনি , অবৈধ সম্পর্ক এটাও মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না ।আমাদের দুজনার পরিবার মেনে নেবেনা ভেবেই এগিয়ে ছিলাম... তাই সম্পর্কের নাম দিতেই এক চিমটে সিঁদুর ...পবিত্রতায় ভরে গিয়েছিল মন। কয়েকটা দুপুর একান্ত আমাদের ...ভালোবাসার । মাঝখানে কিছুটা দ্বন্দ অভিমান, রাগ কষ্ট , তবুও ফিরে যাওয়ার ভাবনাতেই , একরাশ যন্ত্রণা । তাই সব ভুলে বার বার ফিরে ফিরে আসা । অনেক কিছু বলেছি , কেন জানো ? আমার জায়গা হারানোর ভয়ে । আমি দূর হতে চাইনা , তোমার অনুভব থেকে তোমার শরীর থেকে । তবুও যদি কোনোদিন আমার জায়গা অন্য কেউ নিয়ে ফেলে ...যেন সেই দিনটাই আমার শেষ দিন । তবে এরকম দুর্ঘটনা যদিও বা ঘটে কোনোদিন , আমাকে নিজের মুখেই বোলো ।আমি অন্য কারো কাছে এটা মেনে নিতে পারবো না । সত্য টা স্বীকার করলে হয়তো বা মরে গিয়েও বেঁচে যেতে পারি । এসব মনে নিও না।বলতে পারলে আমি শান্তি পাই আর একটা কথা না বললে আজ নিজের কাছেই হেরে যাবো... সব কথার পর ঐ তোমার তিনটে মন্ত্র ...I love U…যত বার শুনেছি , ততবার আরও শুনতে চেয়েছি ...হাসবে শুনলে,কাল আমি গুনেছি এই একবছরে তুমি আমাকে 32,850 বার এই কথা বলেছো, ভালো বেসেছ তার চাইতেও অনেক গুন বেশী ।আজ স্বপ্নীল মুহূর্তের স্মৃতিচারণ রঙিন থাক মন প্রাণ ,হাতে হাত নাহয় আজ নাই বা হল এক ।

একান্তে কাটানো সময় গুলো আবার সাজিয়ে দেবো ,সুখে দুখে সবটুকুই ভাগ করে নেবো আগামীর পথ তোমার আমার ধুয়ে দেবে সব ক্লান্তি , সাথে নিয়ে পরম প্রাপ্তি ,সাথে থেকো , আমায় ভালবেসো ...

একদিন একরাত শুধু রয়েছি নিজের সাথে একা ,ভুলিয়ে সব না পাওয়া , পেরিয়ে অপেক্ষার সময়ের সীমা । সময় টা সময়ের আগেই যেন এগিয়ে খুব ,কি যেন এক বিষম তাড়া ।.....................

ঠিক যেমন চেয়েছিলাম , ঠিক আমার মতই দিশেহারা , বলার আগেই সবটা বলতে চাওয়া ।অনুভুতি গুলো শিয়রে ,খুব চেনা ,আকাশ টা জোছনার আদরে ঢেকে নিজেকেই করেছিলো আড়াল । কথায় কথায় , কিছু না বলা কথায় , কিছুটা বুঝে নেওয়ায় খানিক প্রচেষ্টায় ।ক্লান্ত চোখ।।নিদ্রা যখন আসন্ন , একটু ক্ষোভ , শেষ টা তো জেগে থাকার কথা ছিল ...

প্রেমের পায়ের শব্দ যেন আচমকাই নিস্তব্ধ ।অনেক দিন পর সূর্যোদয় টা দেখেছিলাম...কি পবিত্র ...কি স্নিগ্ধ ।কেমন চারিদিক আলো হয়ে যাচ্ছিলো , কিছুক্ষণ আগেও ছিল ঘোর অন্ধকার। কি নীরব নিস্তব্ধ সব কিছু। পুরো শহর ঘুমিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ লাগছিলো ঘুমন্ত তোমাকে! একরাতে তোমাকে আমি সারারাত পাহারা দিয়েছিলাম, নির্ঘুম চোখে ঘুমন্ত তোমার দিকে আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আর ঐ শেষ রাতের জোছনা টা একাই ছিল সাক্ষী। সেইদিনও আমি দেখেছিলাম আঁধার শেষে কিভাবে ভোর হয়!! শেষ রাতের শেষ আঁধারেও আমি তোমাকে দেখেছিলাম আবার ভোরের প্রথম আলোয় আমি তোমার দিকেই চেয়েছিলাম! আমার ডাক শুনেই তো তোমার ঘুম ভেঙ্গেছিল!!! ফোলা চোখে তাকিয়ে কি মিষ্টি করেই না তুমি হেসে বলেছিলে... ডাকলে না কেন? সূর্যোদয় টা যে একসাথে দেখার কথা ছিল । .দেখতে দেখতে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো!!যেখানে রাতের শেষ সেখানেই নতুন দিনের প্রারম্ভের অস্তিত্ব ... নতুন সূর্য উঠল, কিচির মিচির পাখির ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম...শুধু একবার নিজের মনেই বললাম ... দেখলে না তো কেমন করে একটি রাতের শেষে কেমন করে একটা নতুন দিনের জন্ম হোলো.. একই লগ্নে ...., আমার চোখে চোখ রেখে শুধু একবার দেখে নিও ...


...আমার অর্ধ সমাপ্ত খোলা চিঠি...খুব সাধারণ হয়েও...আমার কাছে অসাধারণ ...


ইতি…

কবিতা - অভিলাষা

2 কমেন্টস্
গোলাপকলি
অভিলাষা


ও আমার গোলাপকলি,কবে ফুটবি রে তুই বল,
হেসে খেলে হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চল।

লাজে রাঙা গালের আভা,যেন স্ফটিকের বিচ্ছুরণ ,
তোকে দেখেই কান্না চেপে হাসতে পারে মন।

ধীরে ধীরে ফুটে ওঠা,গন্ধে ভরিয়ে তোলা,
রঙ ছড়িয়ে পাপড়ি মেলে আলোর সাথে খেলা।

গোলাপকলি,সই রে আমার,চোখে জলের বান,
রঙ হারিয়ে পাপড়ি খসে যখন তোর জীবন অস্তমান ।

আমার কথা যা শুনে যা, আমার সাধের সই,
গোলাপ হয়েই আসিস আবার,অপেক্ষাতে রই।।


কবিতা - অমিতাভ দাশ

1 কমেন্টস্
চার –এ চতুর্মুখ
অমিতাভ দাশ


(১) উড়বি?

দূরের চৌকাঠ!...
         তুমি কি জানালায়?

রূপালি ধানভানা...
         আওয়াজ শোনা যায়?

ঈষৎ উদ্বেল...
        ঝড়েতে ডানা মেল্

ও পাখি মন চায়...
        আসি ও ঝঞ্ঝায়



(২) আধিপত্য

ধ্রুপদী ওই ত্রিপদী বিন্যাসে
                        অনিবার্য
                                ধার্য ছিল টান

দ্রৌপদী তাই মননদী সকাশে
                        মিলিয়ে নিল
                                স্বতন্ত্র সে বান

উনিশ বিশের তারতম্যে রোখ্
                        আধিপত্য
                                একজনেরই হোক

বৃত্তভাঙা নিবিড় করা চোখ
                        যে নিয়েছে
                                রূপসা শরীর ঘ্রাণ



(৩)অন্ধকার ডাইনি মাইল

অন্ধকার ডাইনি মাইল বাঁয়ে ফেলে
তুলকালাম ভালবাসার চোখ জ্বেলে!
দীপ্ত হও আর্তনাদ...ঘুম ভাঙাও!
আমায় নাও! আমায় নাও! আমায় নাও!

কোথাও কোন দুর্যোধন ভয়ংকর
আটকে দেয় নগ্নতার স্বয়ংবর
তফাৎ যাক পাগলা থাক মেহের আলী
সকল ঝুট করবো লুট! জানলি তুই!

আহ্লাদের পান্ডা এই কান্ডারী
ঝঞ্ঝাট ও দুর্যোগের ভান্ডারী
এ নীল বিষ অহর্নিশ নিস যে তাও
বললি যে? 'আমায় নাও! আমায় নাও!'


(৪) ছিপ

সময়...
এবার তোকে জামা খুলে দেখাই!

আয়
তোকে দেখাই...ঠিক

কোথায়...কোন কোণে
আমার বুকে
             কোন সুক্ষণে

নখের আঁচড় ছিপ

ফেলে
কে জানি কে

আটকেছে ট্রাফিক!