২৬ ফেব, ২০১৪

কাশীনাথ গুঁই

1 কমেন্টস্
আমাদের দু’ চার কথা




“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।।“….

                            (সুরকারঃ শহীদ আলতাফ মাহমুদ
                         গীতিকারঃ আব্দুল গাফফার চৌধুরী)


১৯৫২ সালের সে ২১শে ফেব্রুয়ারী , অভিনব এক আত্মত্যাগ দেখেছিল এই বিশ্ব সেদিন। শুধু মাতৃভাষা কে সম্মানীয় আসনের মর্যাদা দিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল রফিক (রফিক উদ্দিন আহমদ ), বরকত (আবুল বরকত), সালাম (আব্দুস সালাম), শফিউর (শফিউর রহমান) , জব্বার (আব্দুল জব্বার)… সেদিন বাঙলাদেশের রাজপথে। ভাইয়ের রক্তে রাঙানো সেই ২১শে আবার পেরিয়ে এলাম, আরো অনেকবারের মতই। তারপরেও কি সম্মানিত রাখা গেছে মায়ের ভাষাকে - আধুনিকতার মুখোশ পরতে গিয়ে আমরা কি ভুলিনি ভাষার সেই সম্মান! তবুও একুশ আসে !আর মাতৃভাষা দিবসের মাস ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সেই ভাষা সৈনিকদের যাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ঢাকার রাজপথ। একুশে ফেব্রুয়ারী মানে মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানানোর শিক্ষা, সেটা নিজের মাতৃভাষা, দেশের সংখ্যালঘুদের মাতৃভাষা, পৃথিবীর সকল জাতির মাতৃভাষা ও ভাষা-বৈচিত্রের প্রতি সম্মান জানানোর শিক্ষা।

আমরা প্রেরণা অনলাইনের মাধ্যমে যেন তুলে আনতে পারি বাংলাভাষা সচেতন মানুষের / মানুষদের কলমচারিতার অন্তরঙ্গ কাহিনী, যেন অব্যাহত রাখতে পারি আমাদের বাংলাভাষা চর্চার ক্ষুদ্র প্রয়াস, এই আশা নিয়েই ‘প্রেরনা’ র এবারের ডালি। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় পরিবারের সকলের সাহায্য পাব এই আশা রাখি।

- কাশীনাথ গুঁই

শঙ্কর চক্রবর্তী

0 কমেন্টস্
অতিথি সম্পাদকের কলম



প্রেরণা নামটি সার্থক । তা না হলে আমি কখনও কিছু লেখার দুঃসাহস দেখাতাম না । প্রেরণা যদিও বাঙলা ভাষা ও সাহিত্ত্যের সব ক্ষেত্রেই নিজেকে মেলে ধরেছে , আমি শুধু কবিতা নিয়েই কয়েকটা কথা বলব . সাধারনতঃ সম্পাদকরা হচ্ছেন কবিতার আকাশে উপগ্রহ , তারা অপর কবিদের আলোয় আলোকিত । কখনো যে দু ' একজন নক্ষত্রকে এরকম উপগ্রহের কক্ষ পথে বিচরণ করতে দেখা যায় তা নিতান্তই গ্রহের ফের বা নিয়মের ব্যতিক্রম । কবিতা সম্পর্কে কিছু ভাবনা আমার ভাল লাগে । কবিতা সম্পর্কে চিরন্তন সত্য একটাই ' কবিতা যে বোঝে শুধু সেই বোঝে' । কবিতা কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও বাস্তবকে অবাস্তব করে দিতে পারে । মনে হয় , কিছু অযথা বিভ্রম কবিতা লেখার জন্য অত্যন্ত জরুরী । কবিতার জগৎ উদ্দাম স্বাধীন - সেখানে কেউ কারও প্রভুত্বও করেনা , দাসত্বও করেনা মনে হয় কবিতা সম্পর্কে পৃথিবীর যাবতীয় সংজ্ঞা , সূত্র ,মন্তব্য সবই অসম্পূর্ণ -তা কবিতাকে স্পর্শ করার একটা প্রয়াস মাত্র।


সবার জন্য রইলো আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা ।


- শঙ্কর চক্রবর্তী

ইন্দ্রানী সরকার

0 কমেন্টস্
আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের স্মরণে
ইন্দ্রানী সরকার

ভাষা আন্দোলন দিবস বা শহীদ দিবস, বাংলাদেশে পালিত একটি জাতীয় দিবস। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার লক্ষ্যে সংগ্রামে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এই জাতীয় দিবসটি পালন করা হয়। সেই চর্যাপদের কবিদের থেকে শুরু করে বড়ু চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, কৃত্তিবাস, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ এবং আরও কতজন বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন তা বলার শেষ নেই | বাংলা ভাষা যে শুধু আমাদের মাতৃভাষা তা নয়, এ যেন আমাদের শৈশব অবস্থা থেকে পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক হবার এক অতীব প্রয়োজনীয় মাধ্যম | বাংলা ভাষার অনুধাবন ও অনুশীলনের মাধ্যমে বাঙলী আজ বাংলা সাহিত্যে পূর্ণ অবয়বে প্রস্ফুটিত হয়েছে | আজি কমল মুকুলদল খুলিল | রবীন্দ্রনাথের একটি গান বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির স্মরণে:

মনোমন্দিরসুন্দরী !
মণিমঞ্জীর গুঞ্জরি স্খলদঞ্চলা চলচঞ্চলা?
অয়ি মঞ্জুলা মুঞ্জরী !
রোষারুণরাগরঞ্জিতা !
বঙ্কিম-ভুরু-ভঞ্জিতা !
গোপনহাস্য-কুটিল-আস্য কপটকলহগঞ্জিতা !
সঙ্কোচনত অঙ্গিনী !
ভয়ভঙ্গুরভঙ্গিনী !
চকিত চপল নবকুরঙ্গ যৌবনবনরঙ্গিণী !
অয়ি খলছলগুণ্ঠিতা !
মধুকরভরকুণ্ঠিতা
লুব্ধপবন -ক্ষুব্ধ-লোভন মল্লিকা অবলুণ্ঠিতা !
চুম্বনধনবঞ্চিনী দুরূহগর্বমঞ্চিনী !
রুদ্ধকোরক -সঞ্চিত-মধু কঠিনকনককঞ্জিনী ।।



অনিমেষ সিংহ

0 কমেন্টস্














২১শের কে ?
অনিমেষ সিংহ


আমি ২১ শের কেউ একজন ।
আজ চড়চড় করে পারদ ঊর্দ্ধগামী
শাহবাগী যৌবনের ভীড়ে
শৈশবের ধুলো যত উঠে আসছে বুকে।
আবিরের রাত দিন আমার বাংলায় ।
আমি দ্বীখন্ডিত হয়েছি শুধু ।
চোখে দেখিনা ।
আঙ্গুলে বাংলা বিদ্যাসাগর বিপ্লবের মাইল স্টোন ।
দেখ কেউ মালা দেয়নি একটিও।
মালসার ভীড়ে উল্লঙ্গ শীশুরা
থালা বাটি সুন্দরবন কালাপানি নিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে অন্ধকারে ।

২১ শের তুমি কে ?
আমি শালা প্রবঞ্চক !
কবিতায় সুডৌল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
মৃগনাভি চুসতে চুসতে দিঘল চোখ দেখি তোর
হে আমার বঙ্গ মাতা ।
ও একুশ তোকে রেপিডলি ধর্ষন করে যাচ্ছি !
আগুনে আমাদের যত বর্নপরিচয় স্তন পীয়ূষ জল ।

আমি ২১শের কে ?
বোন পো ?
জোওয়ান মরদ !
ধুর , রক্তের আগে পবিত্র হতে চাই বড়
২১শের কবিতায় ! 

রিয়া

2 কমেন্টস্
আ মরি আমার ভাষা
রিয়া



আমাদের অনেকেই তোমাকে অস্বীকার করছে
অনেকেই তাদের শিকড়কে উপড়ে ফেলতে চেয়েছে
তুমি তো সেই প্রাচীন, প্রায় বৃদ্ধাশ্রমে অপেক্ষারত
আমার প্রিয় ভাষা, বাংলা ভাষা
কিন্তু আমি তো তোমাতেই লিখছি, তোমাতেই ডুবছি।
জানি এখানে আজ ভাষার অন্ধকার হয়েছে, কিন্তু রাত্রি নয়।
একদিন আবার দেখবে পতন থেকে উৎসার পর্যন্ত
আগামী বাসনা তুমি ময়।
শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারীই কেন , আমি যে তোমায়
রোজ লিখছি দেওয়ালের উপর, খাতার পাতায় মনের খাতায়।
আমার শিকড়ের ভাষায় আমি রোজ লিখছি
ভালোবেসে তোমায় আমার ভাষা, বাংলা ভাষা
আমি অন্ধকারের একেবারে গভীরে নাভিমূলে তোমাকে লিখেছি
কিন্তু যারা তোমায় ভুলে গেছে জেনো তারা একদিন ফিরে আসবেই
কেননা কোন কিছুতেই তোমার ভরাডুবি হবে না
এবং আমরা যাবো আবার তোমার হাত ধরে
আরোগ্য সাধ্য আলোর অভিমুখে...


সুদীপ্তা চ্যাটার্জী

0 কমেন্টস্











একুশ

সুদীপ্তা চ্যাটার্জী



সেদিনের সেই অবাক দিন
শীতের ডানায় আড়মোড়া ভাঙছিল
এক নতুন স্বপ্ন ভোর
ইতিহাসের শরীর জড়িয়ে
নগ্ন পায়ের মিছিল
বাঁধ ভাঙ্গা বাতাসে বারুদ ঘ্রাণ
থৈ থৈ পলাশ রাঙা রক্তে ছোপানো
মায়ের আঁচল জড়িয়ে
বর্ণমালার প্রত্যয়ে জ্বলে উঠেছিল চারটি প্রদীপ ...

রাফসান জানী

0 কমেন্টস্
জকিং এবং জোকিং
রাফসান জানী



ডিয়ার লিসেনার,

এখন প্লে করছি একুশে ফেব্রুয়ারির স্পেসাল থিম সং, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুরারি" গানটি শুনতে চেয়ে রিকুয়েস্ট করেছেন অনেকেই। তাহলে, নাউ এনজয় দিস সং এবং কোত্থাও যাবেন না ফিরে এসে আরো কিছু স্পেসাল উপহার থাকছে আমাদের সুবিশাল ভাণ্ডার থেকে, ততক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকুন, লেট্‌স এঞ্জয়েনিং.....

*** আহা: কতো স্বাদের জগাখিচুড়ি ভুণা বাংলা আমরা বলতে শিখেছি ! রক্তের বিনিময়ে।

সায়ন দে

1 কমেন্টস্












মাতৃভাষার আন্তর্জাতিকতাঃ
UNESCO-র ২১শে ফেব্রুয়ারি উৎযাপন


সায়ন দে
গবেষণা সহায়ক,
ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা




শুরুতেই আমার কয়েকজন বাংলাদেশী বন্ধুর একটা আক্ষেপের কথা বলি যা বোধহয় সকল বাংলাভাষী মানুষেরই আক্ষেপ, তা হল–বাংলাদেশের যে রক্তঝরা ভাষা আন্দোলন ও আত্মবলিদানের ইতিহাসকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রসংঘ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে প্রতিবছর, সেই ইতিহাসকে স্বয়ং রাষ্ট্রসংঘ তথা বাংলার বাইরের মানুষনাকি খুব একটা মনে রাখেনি। কথাটা খুব যে মিথ্যে তা কিন্তু নয়। সংঘের ওয়েবসাইট ও প্রচারপত্রগুলিতে কোথাও ১৯৫২সালের সেই আত্মত্যাগের ইতিহাস বিস্তারিতভাবে বিধৃত নেই। তবে বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখলে দেখা যাবে,এই ইতিহাস বোধহয় বাইরের দেশের কাছে ভিতর থেকে অনুধাবিত হয়েছে ও বিশ্বের কাছে মাতৃভাষার গুরুত্বকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। আর সে কাজে কাণ্ডারি অবশ্যই রাষ্ট্রসংঘ।

এতদিন ধরে অনেক জায়গায়, অসংখ্য লেখায় একুশে আন্দোলন ও ভাষা দিবসের ইতিহাস, গুরুত্ব, ব্যাপ্তি ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানা আঙ্গিকে বহু আলোচনা হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রসংঘ তথা পশ্চিমী দুনিয়া যেভাবে বাংলার ভাষা আন্দোলনের মর্মার্থটাকে বিশ্বের দরবারে প্রয়োগ করেছে, যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে বাংলার সাথে সাথে সকল মাতৃভাষাকে, যেপথে বিশ্বজুড়ে সে আন্দোলন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উৎযাপনের মধ্যে বেঁচে রয়েছে, সে নিয়ে আমরা খুব একটা আলোচনা করিনা সাধারণত। এই কথিকায় আমি তথ্যের আলোকে মূলত রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (UNESCO) কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের ক্রমপর্যায়গুলো তুলে ধরে মাতৃভাষার জন্যে আবদুল, রফিক, বরকত, সালামদের লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক সার্থকতার জায়গাগুলো দেখানোর চেষ্টা করেছি।

একথা বলাই যায়, ১৯৫২র আন্দোলন থেকে ২০০০তে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি - অনেকটা সময় লেগেছিল বিশ্বের কাছে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বকে মেলে ধরতে ও ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। দেশে বিদেশে বেশ কয়েকজন বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা নেতৃদের মিলিত উদ্যোগে রাষ্ট্রসংঘের সংস্থা UNESCO-র অধিবেশনে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর পাশ হয়েছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের ঐতিহাসিক প্রস্তাব যা খোদ পাকিস্তান সহ মোট ১৮৮টি দেশর সমর্থন লাভ করেছিল।আর তারপর ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখটা UNESCOপৃথিবী জুড়ে সকল মাতৃভাষার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুভাষাবাদ(Multilingualism)-এর গুরুত্বকে উৎসাহ দিতে ‘আন্তর্জাতিকমাতৃভাষাদিবস’হিসাবে পালন করে। ভাষা তার ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বিভিন্নতা সত্বেও আন্তর্জাতিক স্তরে মানুষের পরিচিতি, যোগাযোগ, শিক্ষা ও সামাজিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাই রাষ্ট্রসংঘ শুরু থেকেই চেয়েছে ভাষাগত বৈচিত্র্যকে উৎসাহ দিতে। সেখানে একসাথে ইংরাজি ও ফরাসী কাজের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পাশাপাশি চিনা, আরবি, রুশ ও স্পেনীয় ভাষাকেও একযোগে সরকারী ভাষার মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রসংঘ বহুভাষাবাদকে আন্তর্জাতিক সংহতির ধারক-বাহক করে তুলতে সচেষ্ট হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও বহু মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আত্মত্যাগ রাষ্ট্রসংঘকে তার ভাবনার পরিপূরক একটা তাগিদ প্রদান করেছিল, যা রাষ্ট্রভাষার গণ্ডি পেরিয়ে আঞ্চলিক ও মাতৃভাষা বৈচিত্র্যের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঐক্যের দিশারীহয়ে ওঠার স্বপ্ন জাগিয়েছিল সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে।

স্বপ্ন সত্যির পথে UNESCO প্রত্যেক বছর ২১শে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবস উৎযাপনকে হাতিয়ার করে বিশ্বে মাতৃভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝে নিতে চায়। তাদের সামনে উঠে আসে সেই সংক্রান্ত একাধিক সমস্যার কথা যা তারা তাদের সীমানায় দাঁড়িয়েই সমাধানের চেষ্টা করে থাকে। ২০০০ সাল থেকে এই কর্মযজ্ঞ শুরু হবার পর, ২০০২ সালে এক সমীক্ষায় পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৬০০০ মাতৃভাষার মধ্যে ৩০০০এরও বেশি ভাষার বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি এই শ্লোগান তোলা হয় মাতৃভাষা দিবসের দিন – “In the galaxy of languages, every word is a star”. ২০০৩ সালে চতুর্থ মাতৃভাষা দিবস পালন উৎসবে UNESCO মাতৃভাষায় শিক্ষা, প্রচার ও অগ্রগতির জন্যে সকল প্রকার উৎসাহ দানের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। ২০০৪ সালের উৎযাপনে মাতৃভাষায় শিশু শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া হয় ও সংস্থার সকল কার্যালয়গুলোতে আয়োজন করা হয় শিশুদের তাদের বিদ্যালয়ে নিজ মাতৃভাষায় লেখা খাতার অনবদ্য প্রদর্শনী। পরের বছরে এই উৎসবের মূল সুরটাই নিবদ্ধ থাকে দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষদের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ ব্রেল ও নানা সাংকেতিক ভাষার প্রচার ও প্রসারের ওপর।UNESCO, The World Blind UnionওThe World Federation of the Deaf যৌথভাবে আয়োজন করে প্রদর্শনীও। ২০০৬ সালে বিশ্বের প্রায় ৬০০০ ভাষায় কথা বলা ও লেখা মানুষ একযোগে ভাষাগত বিভিন্নতা, বহুভাষাবাদী শিক্ষা ও সাইবার দুনিয়ায় ব্যবহৃত ভাষার প্রয়োগকে সামনে রেখে পালন করে সপ্তম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পরের বছরে, ২০০৭ সালের২১শে ফেব্রুয়ারি উৎসবের থিম ঠিক হয় মাতৃভাষা ও বহুভাষাবাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন। এ বছরেই রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় ২০০৮ সালকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা বর্ষ’ (International Year of Languages) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

'Languages matter'শ্লোগান তুলে UNESCO২০০৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক ভাষা বর্ষ’ তথা মাতৃভাষা দিবস পালন শুরু করে প্যারিসে।সংস্থার প্রধান পরিচালক কইচিরো মাতসুরা বললেন, সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণ হল ভাষা, যা মানুষকে, তার গোষ্ঠী ও ব্যক্তিত্বকে চিনতে শেখায় ও তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ প্রশস্ত করে। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সব শ্রেণিকে এগিয়ে এসে পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষাকে রক্ষা ও বিকশিত করতে হবে। মাতৃভাষার বিপদ বলতে কি বোঝায় তা তথ্যের মাধ্যমে তুলে ধরে বলা হয়, মোট ৭০০০এরও বেশি ভাষার মধ্যে ৯৬% ভাষায় কথা বলেন মোট জনসংখার মাত্র ৪% মানুষ। আর গড়ে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে ভাষা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে, কারণ সেই ভাষায় আর মানুষ কথা বলছেনা। আর এই হারে চলতে থাকলে অচিরেই অর্ধেক মাতৃভাষার অপমৃত্যু ঘটে যাবে অগোচরে। তাই এই বছর মাতৃভাষা বাঁচানোর জন্যে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।এছাড়াও দ্বিভাষা তথা বহুভাষাবাদে সহায়ক এমন শিক্ষা ও সেখানে মাতৃভাষার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ, এ ধরণের শিক্ষার প্রশিক্ষন দান, স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রসার, ভাষাগত বিভক্ত বিভিন্ন এলাকার বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসা, ভাষাগত বাধা অতিক্রম করার জন্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার, অনুবাদ প্রকল্প চালু, দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতিতে দেশীয় ভাষার ভূমিকাকেস্বীকৃতি প্রদান সহ একাধিক অনুষ্ঠান ও কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষাবর্ষ উৎযাপন করা হয়।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উৎসবে UNESCO স্থানীয় ভাষা সংরক্ষণে প্রযুক্তি কতটা সহায়ক হবে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। সঙ্গে সার্বিয়া প্রজাতন্ত্রের কোভাকিকা নামক একটি গ্রামে যেখানে একাধিক সংখ্যালঘু মানুষ বহু ভাষায় কথা বলে, সেখানে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভার এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন সার্বিয়ার সব বিদ্যালয়ে একটা পাঠ মাতৃভাষায় নেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়। মাতৃভাষার বিকাশে এভাবে উৎসাহ প্রদান কর্মসূচীর এখানেই শেষ হয়ে যায়নি।২০১১ সালে UNESCO বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২১শে ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের জন্য একসাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই হিসাবে জিম্বাবয়ে, মরক্ক, কম্বোডিয়া, পর্তুগাল, নেপাল, রাশিয়া, সার্বিয়া প্রভৃতি একাধিক এলাকায় নানান কর্মশালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। এ বছরের থিম ছিলঃ ভাষা ও ভাষাগত বৈচিত্র্য প্রসারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার। ২০১২ সালে আরও বিস্তৃত ভাবে মাতৃভাষার গুরুত্বকে সামনে আনতে থিম ঠিক করা হয়- “Mother tongue instruction and inclusive education”. UNESCOবিশেষ ভাবে শিক্ষার অধিকারের অংশ হিসেবে মাতৃভাষার উপযোগিতা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও বেশি করে মাতৃভাষার প্রয়োগকে জোর দেয় এই বছর। ২০১৩ সালে চতুর্দশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস গোটা বিশ্বের সঙ্গে UNESCO তেও পালিত হয় মহা সমারোহে। থিম ছিল-‘স্থানীয় ভাষায় পুস্তক ও ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার’। আঞ্চলিক স্তরে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় তথা প্রচারমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে মাতৃভাষার গরিমাকে সুদৃঢ় ভাবে উদ্ভাসিত করার কাজে কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণের চেষ্টা করা হয় এবার।‘Books for Mother tongue education’ শ্লোগান তুলে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রসারের তাগিদে আঞ্চলিক ভাষায় পুস্তক যোগানের গুরুত্বকে সামনের সারিতে রেখে শেষ হয় এ বছরের কর্মসূচী।এ বছর ভারতের পাঞ্জাবী ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ২০১৪ সালেও নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে এই দিনটি পালিত হবার কথা, যেখানে তুর্কি মাতৃভাষা দিবস পালনেরও পরিকল্পনা রয়েছে। প্রত্যেক বছরের বিশেষ পদক্ষেপের সঙ্গে নিয়মিত ভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষাবাদের ওপর অবদানের নিরিখে প্রদান করা হয় লিঙ্গুয়াপ্যাক্স পুরস্কার। ২০১১ সালে এই পুরস্কারে ভূষিত হন এদেশের উপজাতি ভাষা ও লৌকিক ঐতিহ্য চর্চায় নিয়োজিত প্রাণ গুজরাত নিবাসী গণেশ এন. দেবী।

এই ভাবে বছরের পর বছর UNESCOতার নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রধান ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষাকে প্রান্তিক অবস্থা থেকে সামনের সারিতে আনার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই সকল উদ্যোগ ঠিক কতটা কার্যকর হয়েছে বা হচ্ছে সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। তবে মাতৃভাষার ওপর গুরুত্ব আরোপ ও তার ব্যবহারের সপক্ষে সচেতনতা বৃদ্ধির মাত্রা রাষ্ট্রসংঘের তরফ থেকে দিন দিন যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তাতে আশার আলো দেখতেই পারি আমরা। আর সেই সঙ্গে এই গর্বও অনুভব করতে পারি, ১৯৫২ সালের সেই রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস পৃথিবী ভুলে যায়নি, বরং সেই ইতিহাস UNESCO-র হাত ধরে আন্তর্জাতিক স্তরে মাতৃভাষার তাৎপর্যকে কুর্নিশকরবার পথ দেখিয়ে চলেছে আজও।

সঞ্জয় চ্যাটার্জ্জী

0 কমেন্টস্













সবার উপর মানুষ সত্য

সঞ্জয় চ্যাটার্জ্জী



জানিনা কখন নিদ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলাম। অকস্মাৎ এক আবেগ স্পর্শ অনুভূত হল মননে, কোনো এক রমনীয় ছলাকলায় উদ্বেলিত শিরা ধমনীতে পেলাম আকর্ষণ। এ কোন চেতনা ধাবিত হয় আমার অঙ্গে অঙ্গে? ঘুম ভেঙ্গে গেল নিদারুণ উত্তেজনায় !

চোখ মেলে দেখি কোথাও নেই তো কিছুই আমি ছাড়া ! অন্ধকারে একলা ঘরে সেই তো বিছানায় আমি একাই ! তবে কি কেবল স্বপ্ন দোষেই আক্রান্ত ছিলাম নিদ্রায়? হয়তো তাই ! খোলা জানালায় একফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে যেন মুচকি হাসে। ঝিরি ঝিরি বাতাস বয়ে আনছে কোনো ফুলের বাস, দূরে কোথাও এফ এম রেডিওতে বাজছে কোনো স্বর্ণ গান, নিস্তব্ধ প্রকৃতি যেন আমায় দেখে খিলখিলায় ! কেন জানিনা এ রাত্রি আমায় সর্পিল এক আবেগ মাখায় ! আবার ঘুম আসে...নিজের মনেই মুচকি হেসে সব ঝুট বলে চোখ বন্ধ করি।

জানিনা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, ঘুম ভেঙ্গে গেল এক নারী কন্ঠে। কে যেন বলছে ডেকে, "কেমন আছ !" চোখ মেলে চাইলাম, আবার সেই শূণ্যতা ~ বিছানা, আমি, অন্ধকার, আর সেই খোলা জানালা। এখন আকাশে চাঁদ নেই, ঢেকে গেছে কোনো বারিদ পিছে; হাওয়াও এখন তাল মিলিয়ে আনছে না বয়ে সুরভি। কেমন যেন গুমোট মার্কা বিশ্রী এক প্রকৃতি ! নিরানন্দ, ঘোর নিরানন্দ ! মন ছেয়ে যায় বিষন্নতায়, কে ডাকলো তবে? উঠে পরলাম বিছানা ছেড়ে, জ্বলন্ত সিগারেট আঙ্গুলে জড়িয়ে জানালা ভরিয়ে দিলাম ধোঁয়ায়। কিন্তু সেটা বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আবার সেই রমনীয় কন্ঠস্বর ! "কেমন আছ?" সচকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম, অন্ধকার, প্রবল অন্ধকার ! কম্পিত কলেবর হতে ভাঙ্গা ধ্বনি নির্গত হল, "কে? কে ওখানে?" দরজার কাছে অনুভূত হল আবছা কোনো নারী মূর্তি ! হিম হয়ে এলো দেহ, একি ! কে এ !! "ভয় পাচ্ছ?" "ভয় কিসের?" "আমি তো মানুষ নই !" "তবে শঙ্কা কেন মনে?" "শান্ত হও। কোনো ক্ষতি করব না তোমার। ক্ষতি তো মানুষে করে, আমরা তো কেবল নিরাকার হয়ে ঘুরে বেড়াই।"

ততক্ষণে ভয়ে সিঁধিয়ে গেছি, হাতের সিগারেট কখন জ্বলে নিভে গেছে, আমতা স্বরে বললাম, " ক-কে তুমি?" সে বলল, " তোমারই মত মানুষের পৈশাচিক শিকার আমি। আমি দামিনী। একদিন আমিও মানুষ ছিলাম। হেসে খেলে ঘুরে বেড়াতাম তোমাদের সমাজে। আমারও একটি পরিবার ছিল, একটি ছোট ভাই ছিল, এক বিধবা মা ছিল। তোমারই মত আমার এক সাথীও ছিল। আজ শুধু ছিলটাই আছে, আমি আর নেই !"

"কী হয়েছিল তোমার?" জানিনা আমার অস্পষ্ট ভাষণ সে শুনতে পেল কিনা ! একটা নীরবতা, এক তিমির অন্ধকার, তারপরে সে বলল, "পাড়ায় ছিল কুখ্যাত কিছু কালো হাত, পথে ঘাটে চলতে গেলেই উড়ে আসতো তাদের শ্লেষাক্ত বাণী। একদিন এক রাত্রে ফিরছিলাম কলেজ শেষে, আমি ও আমার সাথী। মদ্যপ কুচক্রীরা জানতাম না থাকবে সেদিন ওঁত পেতে, জানতাম না তাদের লালসার শিকার হতে হবে সেদিন আমাকে ! জানতাম না সাত আট জনের পৈশাচিক অঙ্গ আমায় করবে এফোঁড় ওফোঁড় ! জানতাম না নগ্ন হতে হবে আমায় সেদিন কতগুলো নোংরা চোখের সামনে ! হাজার ক্রন্দন, কাকুতি, মিনতিও সেদিন করতে পারে নি তাদের ক্ষান্ত ! সঙ্গীর আমার মুণ্ডহীন দেহ রইলো পরে রাস্তার 'পরে। যখন তাদের পৈশাচিক তাণ্ডব চলছে আমায় ঘিরে, দেখেছিলাম চেয়ে খেলছে তারা মুণ্ড নিয়ে ফুটবল খেলা ! অকস্মাৎ আঁধার ঘনিয়ে এলো আমার চোখের তারায়, দুহাত জুড়ে মিনতি করেছি, ওগো তোমরা এবার ছেড়ে দাও ! অট্টহাস্যে উঠলো চেঁচিয়ে সেই পিশাচের দল, "তোকে ছেড়ে দেবো আমরা ভেবেছিস কি করে. তোর ভবলীলা সাঙ্গ করে তবেই আমাদের শান্তি !" অকস্মাৎ কঁকিয়ে উঠেছিলাম এক তীব্র যন্ত্রণায়, দেখি চেয়ে ফিনকি দিয়ে ছুটছে শোনিত আমার অঙ্গ চিরে ! কোনো এক লৌহ শলাকা ঢুকছে তার মধ্যে ! অবশেষে নির্বাপিত হল আমার জীবনদীপ, শেষবারের মত মাকে আমার ডেকেছিলাম সেদিন আমি, জানিনা সে বাণী পৌঁছালো কিনা আমার মায়ের কানে !"

ভয় ভীতি দূর হয়ে গেছিল নিজেরই অজান্তে, সেই অশরীরীর নীরব যন্ত্রণা মুহুর্মুহু আঘাত হানছিল আমার বুকে ! তার কান্নায় ধ্বনিত হচ্ছিল "এর বিহিত করো ! বিচার করো এর !" ধীরে ধীরে ভোরের আলো ঘরের মেঝেতে এসে পড়ল, কখন রাত কেটে ভোর হয়ে গেল জানতেও পারি নি। চোখ উঠিয়ে দেখি ঘর শূণ্য, বললাম "আছ?" "দামিনী?" কোনো সাড়া নেই, জানিনা কখন সে চলে গেছে ! মনে পড়ল সেই কথাটা, "সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই !"

অশোক কুমার লোধ

1 কমেন্টস্
আলোয় ফেরা
অশোক কুমার লোধ



কথা ফুরিয়ে যাওয়া দুটি মানুষ , একটি বিবাহিতা নারী ও একটি বিবাহিত পুরুষ । ওরা পরস্পরের সহকর্মী । একই অফিসের একাধিক বিভাগে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পাশাপাশি টেবিলে । স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময়ের পালা শেষ হতেই যে যার মত কাজে ব্যস্ত । দুজনেই কিছুটা অস্বাভাবিক অন্যদের চোখে । কারণে অকারণে ওদের হা হা হি হি নেই , নেই অহেতুক উচ্ছ্বাস , অফিসের চলতি হাওয়ায় বেজায় বেমানান । আসলে রুচিতে বাধে আলোচনার বিষয়বস্তুতে -- কে কার সাথে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে ইদানীং অতি উৎফুল্ল , এই মুহূর্তে কি তার রগরগে রসায়ন , কিম্বা কার শাশুড়ি কত বজ্জাত , কে কার বরকে কেমন বাধ্য ছাগল বানাতে পারদর্শী , কিছু মেয়েলি ন্যাকামি বা কিছু পুরুষালী আস্ফালন ও অসভ্যতা – অফিসের এই চলতি রসালাপ বড় বিচিত্র ও বিরক্তিকর । এসবের থেকে দূরে সরে থাকা মানেই অনেকের কাছে তারা অহংকারী , দেমাকি , অসহ্য ।

তমালি সেন , বয়েস ৩০ + , গড়নে গড়পড়তা বাঙ্গালী নারী । চমৎকার কণ্ঠস্বর , কথা শুনলে কানের আরাম হয় । চোখে পরার মতো দুটি গভীর চোখ চশমার আড়ালে , চরম উদাসীন চাউনি । কাজের ক্ষেত্রে যদিও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ , সহযোগিতা চাইলে সহজেই মেলে । সর্বদাই ইয়ার-ফোনে গান শোনেন বা অন্য কিছু শুনতে ব্যস্ত , কে জানে কি শোনেন ! তবে কীবোর্ডে আঙ্গুল চলে ঝড়ের গতিতে , অদ্ভুত এক যন্ত্র - মানবী না কি বিষাদ প্রতিমা !

দিগন্ত রায় , বয়েস ৩৫ + , সুখী সুখী চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত দুটি অপলক অচঞ্চল চোখ । কাজের অবসরে মুখ গুঁজে থাকেন কোনও বইয়ের পাতায় । কখনো উপন্যাস কখনো বা গল্প , কবিতায় ! কাজের ক্ষেত্রে এনার দিকেও আঙ্গুল তোলার কোনও অবকাশ নেই , কাজের কথা ছাড়া অবশ্য অন্য কোনও কথাই বলেন না তেমন ! অদ্ভুত এক নিঃস্পৃহ নিস্তরঙ্গ জীবনে অভ্যস্ত দুর্বোধ্য মানুষটি ।

এহেন দুটি মানুষের প্রাত্যহিক দেখা সাক্ষাৎ কালের নিয়মে । উভয়েই উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল , সেটা কথায় না বললেও বোঝা যায় , বুঝে যান দুজনেই । এভাবেই বইতে থাকে সময় , চলতে থাকে নিয়মমাফিক কাজ , সাজতে থাকে নীরব কথামালা দুটি মানুষের অন্তরে অন্তরে । একজনের হঠাৎ অনুপস্থিতি অপরজনকে বিচলিত করে , মন খারাপ হয়ে যায় , ফাঁকা ফাঁকা লাগে । আবার ব্যক্তিগত কারণ জানতে চাওয়াও তো স্বভাববিরুদ্ধ । পরস্পরের প্রতি এই যে অদৃশ্য টান , এই সামান্য চাওয়া পাওয়ার কি কোনও বৈধতা আছে ? মুগ্ধতা কি কোনও বৈধতার ধার ধারে কখনো ? না বোধ হয় । এভাবেই কিছু না হ্যাঁ হয়ে যায় , ভেঙ্গে যায় সংযমের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ।

কথা ফুরিয়ে যাওয়া দুটি মানুষ অনেক কথা বলতে চেয়ে ছটফট করতে থাকে । শুরু হয় ছোট ছোট সংলাপ , পরস্পরের চোখে চোখ রাখা , দুজনেই পড়ে নিতে চায় না বলা কথাদের , দুটি হাত ছুঁতে চায় কিছু উষ্ণতা , নীরবতা হারায় মুখরতায় । শুরু হয় একসাথে আসা ও যাওয়া । জানা হয়ে যায় পরস্পরের পছন্দ অপছন্দের লম্বা তালিকা , কিছু আলো কিছু ফেলে আসা অন্ধকারের মুহূর্ত ।

তমালি – “ আপনি অনেকটাই আমার মতো ! কু-সংস্কার মুক্ত , বিজ্ঞান - মনস্ক , যুক্তিবাদী , খানিক কাজ পাগলও বটে ! ” দিগন্ত – “ হ্যাঁ , তা বলতে পারেন , আমাদের দুজনেরই রুচি ও সংস্কৃতি-গত মিল থাকায় এই অফিসে আমরা ভীষণ বেমানান । ফাঁকি দিয়ে সরকারী টাকা পকেটে পুরতে বিবেকে বাধে । ” তমালি – “ সে তো একশবার কিন্তু এত দুঃখবিলাস কেন আপনার ? কেনই বা অমন গুটিয়ে রাখেন , আড়ালে রাখেন নিজেকে ? ” দিগন্ত – “ ওই একই প্রশ্ন তো আমারও আপনার কাছে ! ” তমালি – “ কি হবে জেনে ? সব অঙ্কের ভাগফল মেলে না কি ? কিছু ভাগশেষ থেকেই যায় ! ” দিগন্ত – “ জীবনের গণিতে আমিও বড়ই কাঁচা , হিসেবের খাতা ভুলে ভরা । ভালোবাসায় প্রতারিত হয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত বদল বাবা মায়ের অবুঝ আবদার মেটাতে , না কোনও শঠতা আমি করিনি , তাদেরই পছন্দের একটি মেয়েকে সমস্ত অতীত ইতিহাস জানিয়ে বিয়ে করে বুঝেছি তার মধ্যে কোনও প্রেম নেই , গান নেই , কবিতা নেই , আছে শুধু প্রবল আত্মসুখ , সন্দেহ আর অকারণ অবিশ্বাস । আমি কিন্তু আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার । গড়পড়তা সাদামাটা মানুষ ও চালাকির মুখোশ আমাকে ক্লান্ত করে । বহুদিন পরে আপনাকে পেলাম আমারই মতন সংসার বিমুখ , উদাসীন । ” তমালি – “ বিশ্বাস করুন , আমিও খুব সাধারণ একটি সংসার চেয়েছিলাম নিজের । যেখানে আমার আমির মর্যাদা থাকবে , সুর তাল গান থাকবে জীবনের ছন্দে । আমার বিয়ে করা পুরুষটির স্বরূপ ধরা পড়লো বিয়ের পরে , যে বিয়ের আগে আমার গান শুনে আহ্লাদে গদগদ হয়েছিল , এখন সে চায় না আমি গান করে সময় নষ্ট করি ! আমার চাকরির টাকাটি তার প্রয়োজন , প্রয়োজন সংসারে বিনামূল্যে যাবতীয় কাজ এবং ভোগ করার জন্যে একটি শরীর মর্জিমাফিক , মনের কোনও স্থান নেই সেখানে , এর বাইরে নারীর আর কোনও জগত থাকা অনুচিত বলেই মনে করে যে মানুষ , তাকে মানুষ ভাবতেও ঘেন্না হয় । ”

বোবা কান্নারা মুক্তি চায় অচেনা পাটিগণিতে । জীবনের অঙ্কে হিসেব মেলে না বেহিসাবি সময়ের হাতছানিতে । একাধিক চোখ প্রত্যহ মেপে চলে দুটি মানুষের আচরণ । দিগন্ত ও তমালি দুজনেই বেশ বুঝতে পারে তারা ক্রমশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে । অথচ কে কি জানে ? আর কতটুকুই বা জানে ? না জানা গল্পটিও অল্প অল্প করে অনেক বড় হয়ে যায় । এই বিড়ম্বনা এড়াতে দুজনেরই চাই কিছুটা সময় আর অকপটে কথা বলার , কাছে আসার নির্জনতা ।

অবশেষে একদিন একসাথে দুজনেই পৌঁছে যায় অচেনা অজানা কোনও এক মড়া নদীর মোহনায় , একটি নির্জন কটেজে । আগল ভেঙ্গে পাগলপারা দুটি শরীর মন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বাধাহীন স্বতঃস্ফূর্ততায় । ঠিক পুরুষের সাথে সঠিক নারীর মিলন হ’লো ফুরিয়ে আসা গোধূলির আলোয় । সম্পূর্ণ হ’লো দুটি অসম্পূর্ণ জীবন এবং একটি শপথ নিলো দুজনেই – “ এই দিনটির পুনরাবৃত্তি আর নয় । ” বিকেলের আলো ফুরিয়েছে অনেক আগেই , আকশে জমতে থাকা মেঘের কালো কখন যে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরতে শুরু করেছে টের পায়নি কেউই । এরপর বৃষ্টি এলো খুব জোরে । কাকভিজে দুটি মানুষ ফিরে যায় যে যার ঘরে ।

সুমিত রঞ্জন দাস

0 কমেন্টস্








রহস্যময়ী

সুমিত রঞ্জন দাস



বিশ বছর আগের মাধবীরাত
আজও খেলা করে চন্দ্রাতপে আমার ভিতরে;
মায়ার আবেগ আলিঙ্গনের আমন্ত্রন
বজ্রনির্ঘোষ মুহুর্তের দুর্নিবার আকর্ষন
লাজরাঙা মৃদুভাষ্য - ছুঁয়ে যায় মিলনশয্যায়।

সেইসব স্বর্গ, অঙ্গীকার
আছে অনলান্তে নিশ্চিন্ত অদৃশ্যে
দুরত্ব মাপার সাহস রাখিনি কোনদিন,
তবু বিশ্বাস রাখি -
ফিরে পাব সুরেলা রাত আর নিশুতির আকন্ঠ গান।

আজও যে খুলে যায় জোৎস্নায় মায়াবতী শব্দের ছোঁয়ায় ...

সেখ সাহেবুল হক

0 কমেন্টস্









একলা একুশ

সেখ সাহেবুল হক



অধিকার শব্দটা ভালবাসার সংবিধানে ঘাস কাটে
অ্যালার্ম ঘড়িটাকে থাবড়ে রাগ মেটাই –
প্রত্যাখানের গোলাপ জমা মৌনমেঘ ইনবক্স
শুকনো ঘ্রান পরিচলন বৃষ্টিপাতে।
প্রেমপত্রগুলো কার হাতে পড়েছে
জানেনা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের চিত্রগুপ্ত...
সুইচড অফ নম্বরটা চোরাস্রোত ভ্যালেন্টাইন,
ভাটিয়ালী সুরে কবিতা ভাসাই নৌকার চিত্রকল্পে।
লেডিস কামরার কৌতূহলে সাইজ জিরো চাঁদ নামে
বিকেলের রাণাঘাট লোকালে।
খরখরে দাঁড়ি ছোঁয়া লোমকূপ থুতনির কাটা দাগে
থার্মোমিটার আঁকা রেলপথ,
ধুতরা ফুলে বসন্ত আসে প্রেমিকের পায়ে
কপালে জমা অপচিতি ঘামে।
ঘুঘু দেখা জ্বরে জলপট্টির পেলবতায়
ভুলবকা নামে প্রেম ঝোলে কড়িকাঠে।



সৌমেন্দ্র লাহিড়ী

0 কমেন্টস্









মন্দ মেয়ে

সৌমেন্দ্র লাহিড়ী



আমি তো নাটোরের বনলতা সেন নই
যে আমায় নিয়ে কেউ কবিতা লিখবে-
অথবা
আমি তো শানু লাহিড়ী নই
যে আমায় নিয়ে নাটক লেখা হবে -
অথবা
আমি তো সুজনের ছেলেবেলার রোশনারা নই
যে মধ্য বয়সের তীব্র আঁচে আমায় মনেপড়বে ।
না- না- না -আমি কেউ নই
কেউ নেই আমার ।
আমার হারিয়ে গেছে সবই
আর, হারিয়েগেছি আমি ।
একবার, বার বার
দাঁড়িয়ে থাকি আমি ,
চড়াসাজ , রাস্তার ধার
লালবাতি
মিলে মিশে একাকার ।
গভীর রাতে
একাকী জেগে থাকা ল্যাম্পপোষ্টের নিচে
বা কালভার্টের পাশে দাঁড়িয়ে
কখনও মনে হয়
আমার যদিএকজন বেণীমাধব থাকত
অকপটে বলতে পারতাম মনের কথা
হয়তো, হয়তো বা না ।
আশা নিয়ে বাঁচি
বুকে নতুন স্বপ্ন আঁকি
তবু, সারা শরীরে নখের আঁচড় নিয়ে
লোভাতুর পসরা সাজিয়ে
জেগে রই ,আমি মন্দ মেয়ে ।



কাশীনাথ গুঁই

0 কমেন্টস্








অনিত্য জগৎ

কাশীনাথ গুঁই


দিন আসে দিন যায়।
কথা রয়ে যায়- স্মৃতির কোঠায়।
সম্পর্কেরা কাহিনী হয়ে হারায় কোথাও।
ব্যথারা একা একাই কথা কয় যখন আঁধার ঘনায়।
চাঁদ তার গতি আর জোছনা হারায় যদি ভোর হয়।
সূর্যের বিক্রমে তারারা আর জোছনা ভয় পায়-ভালবাসা পালায়।
আমি ওদের কোনটাই নয় তবু সবাই আমাকে বিচ্ছেদ উপহার দেয়।।।

বাপ্পা প্রদীপ

0 কমেন্টস্
খেলাঘর
বাপ্পা প্রদীপ



হে তুমি বসে আছ
ধ্বংসের বীণা লয়ে
সৃষ্টির সিদ্ধ আসনে,
একা একা বসে গোণো
ক্ষণিকের দিনগুলি
খেলা শেষে খেলা ভাঙ্গো –
ভৈরব মনে।

কুসুম এনেছ যদি –
জীবনপল্লবে
স্ফুরিত কর হে তারে
আপন গৌরবে,
তোমারই সৌরভ
ছড়ায়ে যেতে চাই
তোমারই খেলাঘর মাঝে।

হরিশঙ্কর রায়

0 কমেন্টস্










এক কবি, দুই কবিতা

হরিশঙ্কর রায়



( ১ )
জংলী মানব


আর বুঝি দু'হাত বড় হ'লে
'ঈশ্বর' তোমাকে ছুঁয়ে দেব।
শুনেছি তোমার অনেক লম্বা হাত !
সে হাতেই করো মাপজোখ,
একবার ছুঁয়ে দিলেই হ'ত ।
অতঃপর আমি লম্বা হবো, ঈশ্বর !
আর সব বুভুক্ষ জংলী মানব ।



( ২ )
অযুত বার


এত, এত আঁধারের পরে
পূর্ণিমাগুলো চুপি চুপি হাসে !
অথচ বসন্তগুলো কেমন বেমালুম হারিয়ে যাচ্ছে জল-হাওয়া ।
বোধের দিগন্তে হেঁটে হেঁটে দেখেছিলাম
ধূলি ওড়া পশ্চিমা বাতাস,
কাঠ ফাটা রোদে ব্যাকুল দূর্বা ঘাস,
আকাশে ছিল অনেক মেঘ
তবু পাড়ার ছেলেরা গেয়ে যায় বৃষ্টি-বন্দনা ।
সব কিছু বদলে গেলেও তো কোন ক্ষতি নেই !
আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারি অযুত অযুত বার !

কেমন স্বার্থপর আমি ?

অলভ্য ঘোষ

0 কমেন্টস্










হার জিত
অলভ্য ঘোষ



যে হেরে যাওয়া তেও
গর্ব লুকিয়ে আছে ; সে
হারে তেও তৃপ্তি আছে ।
কিন্তু যে জয়ে শুধু গ্লানি
আর ক্লান্তি লেগে পদেপদে;
আভিজাত্য নেই সততার ;
সে জয়ের মালা ফাঁসির
ফাঁদের মত; দম আটকে
আসে আত্ম-দংশনে । হার
জিত আপেক্ষিক ক্ষণস্থায়ী।
যা স্থায়ী । কর্ম । ইতিহাসে
চুলচেরা বিচারে স্থানাংকিত
করবে আমাদের ।

ইন্দ্রানী সরকার

0 কমেন্টস্













গুচ্ছ কবিতা

ইন্দ্রানী সরকার



মেঘদূত


মেঘদূতেরা উড়ে উড়ে আসে
ঝড়ের রাতের অলীক বার্তা নিয়ে
যার মধ্যে সারাংশ শুধু শুন্য!
শুন্যের কোঠায় যার শুরু আর শেষ |
উদ্ভাসিত চন্দ্রে হাজারো ধূমকেতু
বর্ষিত হয়, তবু চাঁদ অটল নিজের স্থানে..
পারদের ওপারে তাই অপার বিস্ময়----
আর কত আঘাত দিলে খানখান হবে
তার বরফ শীতল কোমল হৃদয় ?
আর কতটা মিথ্যে অপবাদে
লেগে যাবে দাগ ওই অপাপবিদ্ধ চাঁদে ?
আর কতটা হঠকারিতার নিদর্শনে
ভেঙ্গে যাবে বিশ্বাস মানুষের উপর?



জীবন - ছবি


অলস দুপুর ক্লান্ত নূপুর পাখি ভুলে গেছে গান,
কে যেন আজ বলে গেল হারিয়ে গেছে প্রাণ |
মধুর মধুর মিষ্টি মধুর আর মধুর এই মন,
মাধুরিমায় ভরিয়ে নাও দুদিনের এই জীবন |
জীবনের এই খোলা খাতা কতই না তাতে আঁচড়,
তবুও তাকে বাঁচিয়ে রাখে ভাঙা বুকের পাঁজর |
জীবন এত ছোট কেনে বলে গেছেন যে কবি,
তাঁর কথাটাই সত্যি বড় আঁকতে জীবন-ছবি | |



নই মায়াবিনী 


রেশমী জরীতে জড়ানো বেনী চোখেতে টানা সুরমারেখা
কপালের মাঝে উজ্জ্বল তারা
ছলছল মেঘ চুপিসারে বলে,
কে তুমি মায়াবিনী মেয়ে ?

চপল আঁখি দুটি বড় উজ্জ্বল ত্র্যস্ত চাহনিতে একরাশ কথা ;
ময়ুরকন্ঠী রাঙা শাড়ি পরিধানে ,
জোছনা আকাশে সপ্তর্ষি শুধায়,
কে তুমি মায়াবিনী মেয়ে ?

ভেজা বাতাসে কাঠচাঁপা সুবাস
জুঁই চামেলীতে ভরা চারিপাশ
নদীর ঢেউয়ে ছলাত ছলাত বিরহী ডাহুকী ডেকে উঠে বলে,
কে তুমি মায়াবিনী মেয়ে ?

নিথর নীরব তার আধভেজা চোখ ঠোঁট দুটি কাঁপে মৃদু থরথর
শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে নিয়ে
ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে সে,
আমি শুধু এক সাধারণ মেয়ে ||

সৌমিত্র চক্রবর্তী

0 কমেন্টস্









ক্লিন্ন

সৌমিত্র চক্রবর্তী


এও তো একরকম থাকা,
থাকা না থাকার নো ম্যানস ল্যান্ডে
বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝের চড়ায়,
বহুবার চেষ্টা করেও
সত্যিটা চাপাই থাকে ক্ষণিক আবেগে।
এও তো বাঁচাই একরকম,
দুবেলার অন্ন পরমান্নের ধুন্ধুমার চাহিদায়,
শীত ও নাশীতের লক্ষ্মণরেখায়
তেজ হারানো চুনকামে,
বহু পরিকল্পনা করেও
সত্যিটা ঘুমিয়েই থাকে
খাজুরাহো ভাস্কর্য মায়ায়।
এও তো অস্তিত্ব ঘোষণা
অস্তিত্বহীন হয়েই...

ইন্দ্রনীল

0 কমেন্টস্

















মন খারাপের পর্ব (১)
ইন্দ্রনীল


মন,
তোর জন্য আর তেমন মন খারাপ হয় না।
অথচ, তুই আছিস কি নেই-
সেই খোঁজটা প্রতিদিনের মত
আজ ও আমার লেট নাইট বেডে।
সুইজ্‌ অন করলে
আজ ও চৌকাঠের গণ্ডি পেরোতে ভয় করে
-একা হয়েছি তো ।
অফ করলে মনে হয়
অন্ধকারের গাঢ়ত্ব ক্রমশই ভয়ানক।
চিরাচর অভ্যেস বদলে দিলাম
রাতে ঘুমাই না তারপর
দিনের অত আলো সহ্য হয় না বেশিক্ষন।
মিডনাইটে ঘুম ঘুম পায়।
কড়া করে কফি , সিগারের এস্টের সাথে সময় কেটে যায়।
জানিস , আজ বড্ড মন খারাপ আমার,
তোর ইমেল গুলো চেক করতে করতে
ড্রাফট বক্সে হাত দিয়েছিলাম।
তারপর, এক এক করে ফুরিয়ে গেলো
কোথায় একটা ফাঁকা হয়ে গেলো।
দেখি,জানালার পাশে কুয়াশার জাল আটকে আছে।
বিন্দু বিন্দু জল জমা হয়েছে এস্ট্রের ওপর।
চারপাশে আলো আঁধারের সঙ্গমের উৎস থেকে
এক চিলতে গোলাপী মেঘ,
আমার দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ।
কি বললো জানিস ?
“খোকা এবার ঘুমিয়ে পড়”।
সবাই আমাকে ঘুমোতে বলে
কেউ একবারও উঠে দাঁড়াতে বলে না তো। 


শ্রীশুভ্র

1 কমেন্টস্











দুই মলাটের কাব্য

শ্রীশুভ্র


আয়ুর কাপে চুমুক দিয়ে চলেছি রোজকার ছাপোষ বয়স!
প্রেয়সীর ফিকে স্মৃতি...
গৃহিনীর তর্জনী...
ইনবক্সে মাঝরাতের...
অক্ষর সজ্জার ফাঁকে ফাঁকে
বয়সের ভাঁড়ার ক্রমেই হালকা হচ্ছে দেখে
সকালের রোদের সাথে
অহরহ নিভৃত আলাপের
সময় যায় বেড়ে....
সুখ দুঃখের মলাটের রোজনামচায় একান্ত
স্বাক্ষরে কালি কম পড়ছে
একটু একটু করে!
সন্ধ্যার বাতাসে আবহমান
ইতিহাস মিটমিট করে হাসে; ফিরে ফিরে আসে! পূর্বপুরুষের ফ্রেমে
প্রতিবিম্ব পড়ে দুশ্চিন্তার!
চৌষট্টি খোপে
কিস্তিমাতের আসরে, নিধিরাম সময়সরণী
তাড়া দেয় শেষঘন্টার!
তবু মাথার চুল গুনি!
আতরের গন্ধে
অপেক্ষা ঊর্বসী মেনকার!
শিথিল রাতের পাহারায়
তবু, বয়সের নোনা
স্বাদ মধু হয়ে ঝরতে চায়
আরও একবার!

মৌ দাশগুপ্তা

1 কমেন্টস্
ফেয়ারওয়েল - গী দ্য মোপাসাঁ

মূল নামঃ গী দ্য মোপাসাঁ ছদ্ম নামঃ জোসেফ প্রুনিয়ের, গী দ্য ভলম্যান্ট, মফ্রিনিউস ইত্যাদি।

জন্মঃ ৫ই অগাস্ট ১৮৫০, শাতো দে মেরোমেসনিল, ফ্রান্স ,প্রতিভাবান এই লেখক ৬ই জুলাই ১৮৯৩ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্যাসি, ফ্রান্সে আত্মহত্যা করেন।


অনুবাদক - মৌ দাশগুপ্তা

দুই বন্ধুর রাতের খাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো ততক্ষণে। রেস্তোরাঁর কাঁচের জানালা দিয়ে তারা দেখতে পাচ্ছিলো বাইরের রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা, জনসমাগম। প্যারিস শহরের কোনও এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাস এসে আলতো পরশ বোলাচ্ছিলো তাদের গায়ে। এমন সন্ধ্যায় মন চায় লাগমাড়া আনন্দে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়াতে গাছের তলায় কিংবা নদীতীরে চাঁদের আলোয় বসে ফড়িং, ঘাসপোকা আর লার্ক পাখির সাথে সময় কাটাতে …

দুই বন্ধুর একজন, হেনরী সিমন,(বছর পঁয়তাল্লিশেক বয়স,একমাথা টাক এবং ভারী স্বাস্থ্য ), বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি যেন ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো---

- “নাহ...পিয়েরে, বুঝলে দিনদিন কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কি দুঃখের ব্যাপার বলো দেখি। আগে এমন আনন্দময় সন্ধ্যায় নিজেকে আমার কত চনমনে মনে হতো, অথচ এখন, কেন যেন নিজেকে বড্ড বুড়োটে লাগে। ...আমাদের জীবনটা আসলে খুবই ছোট”!

অপর বন্ধুটি- পিয়েরে গার্নিয়ার, সে ছিলো বয়সে কিছু বড় কিন্তু চেহারায় অনেকটা রোগাপাতলা এবং তুলনামূলক ঝকঝকে চেহারার। সে অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিলোঃ

- “দ্যাখো ভাই, বয়স তো আমারও হয়েছে কিন্তু নিজে সেটা বুঝতেই পারিনি।তুমি তো জানো, আমি চিরকালই বেশ হাসিখুশি, ছটফটে বিন্দাস স্বভাবের ছিলাম। মানুষ প্রত্যেক দিন নিজেকে আয়নায় দ্যাখে তো, তাই নিজের চেহারার পরিবর্তনটা সে চট করে ধরতে পারে না--- কারণ এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটা প্রতিদিন, ২৪ ঘন্টা ধরেই হয়,কিন্তু খুব ধীর গতিতে। যদি নেহাতই কেউ টের পেতে চায় তাহলে তাকে অন্তত পাক্কা ৬ মাস আয়নার দিকে তাকানো বন্ধ করে দিতে হবে। তারপর যেদিন আয়নার সামনে দাঁড়াবে সেদিন... ওহ, সে এক নাটক হবে বটে! এই মেয়েদের কথাই ভাবো না একবার। কি কাঁদোকাঁদো দশা হবে তখন এদের! মেয়েদের তো আবার সব আনন্দ, ক্ষমতা এবং মনোযোগের উৎস হলো তাদের রূপ, সারাটা জীবন এদের শুধু কাটে নিজের রূপের চিন্তা করে, অথচ তাদের রূপ সাকূল্যে টেঁকে কতদিন বলো ? ৫ বছর? ১০ বছর, ? তো যেমনটি বলছিলাম , আমি বুড়ো হয়েছি নিজেও বুঝতে পারিনি, ৫০বছরেও আমি নিজেকে যুবকই ভাবতাম। কিন্তু সত্যি যখন বুড়ো হয়ে যাওয়ার উপলব্ধিটা হলো, আমি প্রায় ৬ মাস সেই ভয়ঙ্কর বোধটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।আসলে উপলব্ধিটাই হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। ব্যাপারটা তাহলে তোমায় খুলেই বলি।

হেনরী সিমন আগ্রহভরে ঝুঁকে এলো টেবিলের ওপর।পিয়েরে গার্নিয়ার, পানর গ্লাসটা শেষ রে চেয়রে হেলান দিয়ে মোটা চুরুটটা জ্বালাতে একটু সময় নিল, হয়ত গল্পটা বলার মত করে কথাগুলোকে সাজিয়ে নিলো, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে কড়িকাঠের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে ছড়তে গল্প বলার ভঙ্গীতে মৃদু স্বরে বলতে থাকলোঃ

- আর দশটা পুরুষ মানুষের মত আমিও প্রেমে পড়েছি। সত্যি বলতে কি, পড়েছি তো অনেকবারই কিন্তু তার মধ্যে একটাই সত্যিকারের প্রেমে পড়া। ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ ইত্রেতাত নামক এক সমুদ্রতীরে, সেও ধরো প্রায় বছর বারো আগের কথা।

জায়গাটা ছোটখাট, আকারে খানিকটা ঘোড়ার খুরের মত, চারদিকে ছোটবড় পাহাড়ে ঘেরা, সে পাহাড়গুলো আবার রহস্যময় গুহামুখে ঠাসা থাকতো। দুটো বড়ো পাহাড় ছিলো সেখানে, তার মধ্যে একটা অনেকখানি লম্বা হয়ে সমুদ্রের ভেতরে চলে এসেছিলো , আরেকটা ছিলো অনেক নিরেট ধরণের কিন্তু বালিয়াড়ী পেড়িয়ে বেশীদূর এগোয়নি। মহিলারা সকালে স্নানের সময়ে বড় বড় উঁচু উঁচু পাথরের খাঁজে , রং বেরংয়ের ছাতার তলায় , বালুবেলায়, জলের নাগাল বাঁচিয়ে তাদের নানা রঙের স্নানের পোশাকগুলো রঙীন ফুলের মত করে সাজিয়ে রাখতো। যখন প্রখর রোদ এসে সমুদ্রের নীল-সবুজ জলে ঝিকমিক করে উঠতো , প্রকৃতি ও যেন হেসে উঠতো আপনমনে। স্নানের রোব পরে মেয়েরা একে একে আসতো, তারপর জলে নেমে ঠিক ঢেউয়ের ফেনার কাছাকাছি এসে আলতো করে সেটা খুলে ছুঁড়ে দিতো... তারপর ছোট ছোট পা ফেলে সমুদ্রের জল ছুঁয়ে খানিকটা দৌড়ে যেতো , কিছুক্ষণ জলের সাথে খেলা করে তারপর ফিরে আসতো হাঁপাতে হাঁপাতে। একা একা জলের ধারে বসে আপনমনে স্নানরতাদের দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। সেই ভীড়েই ওকে প্রথম দেখি।

বুঝলে হেনরী, প্রথম যখন সেই সুযৌবনা মেয়েটিকে আমি জলের মধ্যে দেখলাম, আমার এত তীব্র একটা ভালোলাগার অনুভব হল যে আশেপশের বাকি সব স্বল্পবেশী সুন্দরীরা যেন ম্রিয়মান হয়ে গেল। মৎসকন্যার মত ওর জলের সাথে মাতামাতি দেখতে দেখতে কি যে এক আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিলো যে কি বলবো,... আমি তো একেবারে যাকে বলে কিনা বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে একসময় তার সাথে আমার পরিচয় হলো, আর পরিচয় হওয়ার পরেই আমি ওর প্রেমে একদম ঘাড় মুচড়ে পড়লাম। এমন বেহাল দশা তাও একটা বিবাহিত মহিলার জন্য আমার আগে আর কখনও হয়নি! সকাল হলেই আমার মনটা একটি বার ওকে দেখতে কি কথা বলতে বড় ছটফট করতো। এভাবে দাসনুদাসের মত একজন রমণীর বশ্যতা স্বীকার করার অনুভূতিটা খুব বেদনাদায়ক তো বটেই তবে আবার ভালোও লাগতো। ওর মাখনরঙা শরীর, নীল চোখ,ওর কাঁচভাঙা খিলখিলে হাসি, হাওয়ায় ওড়া সোনালী চুল, এমনকি ওর শরীরটার সামান্যতমও বিভঙ্গও আমাকে এক অনির্বচনীয় আনন্দ দিতো, আমাকে যেন পাগল করে দিতো, আমার ভেতরটা কেমন যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগার সম্মোহনে ছেয়ে ফেলতো।ওর অঙ্গভঙ্গী, ওর হাঁটাচলা,কথাবলা, ওর অপাঙ্গে মুচকি হেসে তাকানো, এমনকি ওর পোশাকগুলোও, যেন আমাকে প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলছিলো। ওর মাথার স্কার্ফ, হাতের গ্লাভস, গাউন,মাথার টুপি সব মিলেমিশে এক নতুন নেশায় ভরিয়ে তুলেছিল আমায়। মোহাবিষ্টের মত আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।এর আগে যেন কোনও মহিলার রূপ-রঙ-শালীনতা-মেধা-লাবণ্য-সৌন্দর্য- কমনীয়তা-বুদ্ধিমত্তা একই সাথে এত গভীরভাবে আমায় নাড়া দিয়ে যায় নি।এর আগে কখনও কোন মেয়ের গালের টোল, কমলালেবুর মত ঈর্ষনীয় নরম ঠোঁটের ওঠানামা, ফরসা কানের লতির গোলাপি আভা, বাঁশীর মত নাকের সামান্য একটা ভাঁজ, কপালের পাশে সোনালী চুলের গোছা আমাকে এমন মাতাল করে দেয়নি।

সে বিবাহিতা ছিলো,ছুটি কাটাচ্ছিলো বান্ধবীদের সাথে। তবে ওর স্বামী শুধুমাত্র শনিবারে আসতো আবার সোমবারেই চলে যেতো। জানি না কেন ওই উদ্ভুটে লোকটার ওপর আমার এুকুও হিংসা হতো না। ভগবানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে নিজের করে পেয়েও হেলায় হারানোর জন্য লোকটাকে খানিকটা করুণাই করতাম। কেমন হীন, ভাগ্যহত বলে মনে হতো। আর তার চুলবুলে বউটাকে আমি কি পাগলের মত ভালোই না বাসতাম! আমার কাছে ও ছিলো ঠিক সৌন্দর্যের দেবী, কামদেবীর মূর্ত প্রতিভূ। । এমনি ভাবে কোথা দয়ে যে তিন তিনটে মাস কেটে গেলো বুঝতেই পারিনি। আমার ছুটীর মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। চাকরী তো আর ছাড়া সম্ভব নয়, রুটিরুজির ব্যাপার, অতএব আমার মনহারিনীকে ছেড়ে আমাকে বিষাদক্লান্ত হৃদয়ে, ভারাক্রান্ত মনে পাড়ি দিতে হলো সুদূর আমেরিকার উদ্দেশ্যে। চলে এলাম ঠিকই কিন্তু তার স্মৃতি আমার হৃদয়ে পাকাপাকিভাবে বাসা বেঁধেনিলো। বছরের পর বছর কেটে গেলো, তবু আমি তাকে একটুও ভুলতে পারলাম না। ওর সেই অসাধারণ রূপের ছটা, তীব্র রসবোধ, কিশোরীসুলভ অভিমানী ভালোবাসা যেন আমার চোখের এবং মনের পরিসরে চিরকালের মত আসন করে নিয়েছিলো। কত মেয়েই তো এলো,গেলো, আমার জীবনে কিন্তু ওর মত দ্বিতীয় কাউকে পেলাম না যাকে মনের মানুষ ভেবে ভালবাসায় সোহাগে আদরে ভরিয়ে দিতে পারি। ১২ বছর মোটেও এমন কোনও দীর্ঘ সময় নয়। মানুষ চট করে বুঝতেও পারে না যে কোথা দিয়ে এতটা সময় চলে গেলো। সত্যিই আমার একেকসময় মনে হতো যেন ১২ বছর নয়, ইত্রেতাতের সেই মায়াবী সোনালী বালুতট যেন আমি ছেড়ে এসেছি মাত্র কয়েক মাস হলো। এরপর শোনো আসল কাহিনী, এই গেলো বসন্তে কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে মেজোঁ-লাফিত এ খাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। তো ট্রেনে চড়েছি, ঠিক ট্রেনটা ছাড়বে ছাড়বে করছে তখন একজন মোটাসোটা লালমুখের স্থূলকায়া মহিলা চারটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমার বগিতে হাঁপাতে হাঁপাতে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো। স্বভাবতই আমি মহিলার মুখের দিকে একবার তাকালাম, ইয়া বড় চাঁদপানা মুখ, বড় সাইজের তরমুজের মত মাথাটকে বহু কষ্টে একটা রিবনওয়ালা টুপির মধ্যে সেঁধানো হয়েছে। বেচারী হাসফাঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো, তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠতে গিয়ে তার প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসার মত অবস্থা।চোখমুখ টকটকে লাল। চর্বির ভারে দরদর করে ঘামছে। মহিলাটি ধপাস করে জানলার ধারে বসে পড়ে খাবি খাওয়া মাছের মত গোল মুখ করে শ্বাস নিতে লাগলো, সঙ্গের বাচ্চাগুলো কলকলিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করলো। আমি বিরক্তমুখে খবরের কাগজটা খুলে পড়তে লাগলাম।খেয়াল করলাম মহিলাটি বারবার আড়চোখে আমার দিকে দেখছেন কিন্তু আমি সেই বিগতযৌবনার মধ্যে মহিলাসুলভ কোন কমনীয়তা, সৌন্দর্য বা যৌন আকর্ষন পেলামনা যে দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখবো। অতএব নিপাট ভদ্রলোকের মত মুখের সামনে খবরের কাগজটা তুলে ধরে পড়ার ভান করতে লাগলাম। অ্যাসনিয়েরেস পার হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ আমার সেই প্রতিবেশিনী আমার দিকে ফিরে বললেন

- যদি কিছু মনে না করেন... আপনি... মঁসিয়ে গার্নিয়ের নন?

অবাক হয়ে বললাম,

- হ্যাঁ, আমিই।

আমার কথা শুনে সে হেসে ফেললো। আনন্দের হাসি নয়, ক্লান্ত বিষণ্ণ হাসি।

- তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারোনি! ...

আমার একটু সংকোচ হচ্ছিলো। মুখখানা এতোক্ষনে বেশ খানিকটা চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো, নীল চোখ, কমলা ঠোঁট, কিন্তু কবে দেখেছি বা কোথায় দেখেছি কিছুই মনে করতে পারছিলাম না।তাই উত্তর দিলামঃ

- হ্যাঁ, মানে... না... আমি আপনাকে দেখেছি নিশ্চয়ই... কিন্তু নামটা ঠিক... মনে করতে পারছি না।

সে একটু লজ্জা পেয়ে বললো

- আমি মিসেস জুলি লেফেরে!

আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এই কিনা সে! মোটাসোটা লালমুখের বেঢপ দেহের স্থূলকায়া মহিলা ! শেষবার যখন আমি তাকে দেখি তখনও সে মা হয়নি। ছিপছিপে চুলবুলী তন্বী তরুনী , এখন চার চারটি বাচ্চার মা, বাচ্চাগুলোও বেশ বড় হয়ে গেছে এতদিনে।তার সেই উষ্ণদেশীয় কোমল সৌন্দর্য আর কিশোরীসুলভ কমনীয়তার ছিঁটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই এখন। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো যেন এই তো গতকালই আমি তাকে দেখেছি আর আজ আবার দেখছি, অথচ এত পার্থক্য! এও কি সম্ভব! হতবিহবল হয়ে আমি আবার তাকালাম ওর দিকে। নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে এলো আমার। আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া দিন, সেই ফুরিয়ে যাওয়া যৌবনের জন্য কান্না পাচ্ছিল আমার। শুধু মনে হচ্ছিলো এই ফ্সীতকায়া বেপথু মহিলাটিকে আমি চিনি না। সেও কেমন স্তম্ভিত ভঙ্গীতে আমার মাথা থেকে পা অবধি বারবার দেখছিল। একসময় জলভরা বিষণ্ণ চোখে একটু থেমে থেমে বললোঃ

- আমি একেবারে বদলে গেছি, না? কি আর বলি তোমায়, সবকিছুরই একটা সময় থাকে, তাই না, বলো? তুমি যখন আমায় চিনতে তখন আমি সদ্যতরুনী,বিবাহিত কিন্তু বউ-বউ ভাবটাও আসেনি তখন, আজ দ্যাখো, আমি মা হয়েছি...শুধু একজন ভালো মা! আর যা কিছু ছিলো আমার জীবনে তার সবকিছুকে বিদায় জানিয়েছি। তবু তোমায় কিন্তু ভুলতে পারিনি। কোনদিন ভাবিই নি, আমাদের এভাবে আবার দেখা হবে, ওহ... আমিই ভুল ভেবেছিলাম যে এতবছর পরও তুমি আমাকে দেখলেই চিনতে পারবে। তুমিও তো অনেক বদলে গেছো। এটা সত্যিই তুমি কিনা, আমার কোনও ভুল হচ্ছে কিনা সেটা ধরতেই আমার অনেক সময় লেগে গেছে। তোমার চুলও তো অনেক পেকে গেছে! খয়েরী গোঁফেও পাকা চুলই বেশী দেখা যাচ্ছে, চিবুকে দুই থাক ভাঁজ এসেছে, গায়ের রঙটাও রোদে পুড়ে তামাটে, মুখে বলীরেখা দেখা দিচ্ছে, আসলে ১২টা বছর হরিয়ে গেছে জীবন থেকে ... ভেবে দ্যাখো, ১২ বছর! আমার বড় মেয়েটার বয়সই এখন ১০!

আমি ওর বড় মেয়েটার দিকে তাকালাম। তার মধ্যে আমি তার মায়ের সেই সৌন্দর্যের কিছু ছোঁয়া খুঁজে পেলাম কিন্তু তখনও সেই সৌন্দর্যের মধ্যে খানিকটা বালিকাসুলভ অপূর্ণতা ছিলো, জীবনটা আমার কাছে জোর গতিতে ছুটে চলা একটা ট্রেনের মতই মনে হচ্ছিলো তখন। ততক্ষণে আমরা মেজোঁ-লাফিত এ পৌঁছে গেছি। আমি আমার সেই পুরনো বান্ধবীটির হাতে চুমু খেলাম আলতো ভাবে, কিন্তু কোন কথা বলতে পারলাম না। আসলে সেই মুহূর্তে আমি আমার কথা বলার শক্তিই প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম।তারপর অনেক রাতে, নিজের ঘরে ফিরে, শোবার ঘরের পূর্নদৈর্ঘ্যের আয়নাটার সামনে দাঁড়ালাম।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজেকে। সাইডটেবিলে রাখা আমার অল্পবয়সের ছবিটার দিকে নজর গেলো। তখনই আবিষ্কার করলাম আমি ঠিক কতটা বদলে গেছি, কতোটা সময়ের ছাপ পড়েছে আমার শরীরে, কতোটা বুড়ো হয়ে গেছি আমি। বুঝলাম আমার যুবাকালের সময়, আমার যৌবন আমাকে বিদায় জানিয়েছে।