৩০ ডিসে, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৯ম সংখ্যা

1 কমেন্টস্
সম্পাদকীয়


শীত এলো আবার ঝঞ্ঝার দাপটে সে নিজেই কাঁথামুড়ি নিয়েছে তবু ক্রিসমাসের ছুটিতে আমরা মশগুল। ক্রিসমাসকে বড়দিন মেনে,নিউ ইয়ার কে নববর্ষ করে উল্লাসে,হুল্লোড়ে আমরা কত কি না করতে পারি এই ছুটির অবসরে। এই অবসরে,চার রাজ্য সহ খোদ রাজধানীতে আরেক ঝঞ্ঝার দাপটে দেশের রাজনীতি উত্তাল। নতুন আশার বাতি জ্বালিয়ে আসা ক্ষমতার সমীকরণে কি ঘটে তা দেখার আশায় উন্মাদ আমরা।দেখা যাক আগে কি হয়। বরদিনের-নববর্ষের হুল্লোড় ছাড়িয়ে পিকনিকে তো যেতেই হবে আমাদের।

কংক্রিটের জঞ্জাল ছাড়িয়ে বেড়িয়ে পড়তেই, দুচোখে দুপাশের ফসল কেটে ঘরে তোলার মেহনতি হাতেরা সলাজ হাসিতে ডেকে নেবে আমাদের। কোথাও তখন শীতের লোভ আনা সব্জীগুলো হাতছানি দিয়েছে। যদিও আজ ওদের গায়ে হাত দিলেও হাত পুড়ে যাবে। চড়িভাতির অবসরে,অন্ত্যক্ষরি,খালি গলার গানের সাথে হয়ে যাক না দুটো স্বরচিত লেখার পাঠোধ্বারের কাজ। চারিপাশের চোখ বোলানো রঙে রেঙে উঠুক মনের কোরা কাগজখানা। এসব নিয়েই এবারের প্রেরণার উপাচার। পরিবারের সকলের কাঁচা হাতের রান্নাতে নিজেরাই নাহয় মশগুল হয়ে যাই না এবারটা।

“প্রেরণা অনলাইন”- এর সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষে
কাশীনাথ গুঁই।

কবিতা - আকাশ দত্ত

0 কমেন্টস্
আকাশ দত্ত
বকেয়া



তুমি এসেছিলে!
এখনও
বিছানা খুঁজলে
দু একটা নদী পাওয়া যেতে পারে
স্বপ্ন আঁকা বেডসিটে
স্ফুরিত যৌবন

দশ বাই
দশ ফুট ঘরে
কিচিরমিচির জলোচ্ছাস
ঋতুমতী কিশোরীর
প্রথম কামবেগের মত

জানতাম
ভরাকোটালের টানে
তিনপ্রহরের বিল
ভেসে যাবেই

তবুও
গলায় বেঁধা আস্ত জীবন
পুরোণো বাড়ীর ইট
আনাচে

আর আমার
ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া আঙুল

আচ্ছা
বলতো,
কিছু কি বাকি রয়ে গেলো
হারাতে?

কবিতা - রাজর্ষি ঘোষ

0 কমেন্টস্
মেঘবালকের বৃষ্টিকথাঃ কিংবা ছেলেমানুষি বলতে পারো
রাজর্ষি ঘোষ



মেঘবালকের ছেলেমানুষি বলতে পারো...
কিংবা কৃষ্ণার মেয়েবেলা।

তবু গোপন যে আগুন,
পুড়িয়েছে বা পোড়ে নি ইকারাসের ডানা...
প্রদীপের সলতে নয় সে আমার মেঘদূত।

আমার মেঘদূত শিশিরের ভোর...
আসন্ন বা আগামী একফালি সূর্যের আলো।
উড়িয়ে দিলে পায়রা, পড়িয়ে দিলে বসন্ত
পুড়িয়ে দিলে গ্রীষ্ম, শীত বা আমাদের সহবাস।
কিংবা

তাকে মেঘবালকের
সামান্য একটু ছেলেমানুষিও বলতে পারো। 


কবিতা - কাশীনাথ গুঁই

1 কমেন্টস্
হলুদ ঘুড়িটা
কাশীনাথ গুঁই



উড়তে থাক হলুদ ঘুড়িটা।
ভোকাট্টা হয়ে আজ যে স্বাধীন হল সে।
উড়বে সে আজ আপন পাখা মেলে-
তারপর হয়ত হারিয়ে যাবে কাল আকাশে।
সকালে ওঠা সূর্যিটা তার রাঙা আভাতে দেখবে-
একটা তালগাছের প্রেমে জীবনটা তার লটকে গেছে।
সুখী সে আজ –
ইচ্ছামত আকাশ দেখার স্বাধীনতা যে পেয়েছে।
দোকানীর সাতরঙা লক্কা পায়রাদের সাথে
কাটানো জীবনটা থেকে মুক্ত ।
একেপেয়ে তালগাছেই সুখী আজ –
দুজন অন্তত দুজনকে পেয়েছে নিজের ক’রে।



কবিতা - রীতা ঘোষ

0 কমেন্টস্
সংঘর্ষ
রীতা ঘোষ



মনের মধ্যে সংঘর্ষ,
লড়াই জারী..... '' নারীত্ব বনাম মাতৃত্ব ''
অলীক সুখের খোঁজে দিশেহারা নারীত্ব
পুনর্জীবন চায় প্রেমালিঙ্গনে,
একঘেয়ে শ্বাসরোধ করা অনুভূতিগুলো বিদ্রোহ জানায় বারবার
মুক্তি চায় পঙ্গু প্রতিশ্রুতি হতে ,
গা ভাসাবে পরকীয়া স্রোতে.........

কিন্তু, টান পরে মাতৃত্বের শেকলে
স্নেহ , মমতা , ভালোবাসার বন্ধনে স্থির চিত্ত
কর্তব্য ও দায়িত্বের শীতলতায় আড়ষ্ট পদক্ষেপ
অপরাধবোধে শিথিল পরকীয়া গাঁঠছড়া |

ক্ষনিক থামে , পিছিয়ে আসে ধীরে ধীরে
অসাধারন তৃপ্তি মনপ্রাণ জুড়ে
সৃষ্টির উল্লাসে ওঠে মেতে
জয়ী হয় মাতৃত্ব !!!

কবিতা - ইন্দ্রানী সরকার

0 কমেন্টস্
মেঘদূত
ইন্দ্রানী সরকার



মেঘদূতেরা উড়ে উড়ে আসে
ঝড়ের রাতের অলীক বার্তা নিয়ে
যার মধ্যে সারাংশ শুধু শুন্য!
শুন্যের কোঠায় যার শুরু আর শেষ |
উদ্ভাসিত চন্দ্রে হাজারো ধূমকেতু
বর্ষিত হয়, তবু চাঁদ অটল নিজের স্থানে..
পারদের ওপারে তাই অপার বিস্ময়----
আর কত আঘাত দিলে খানখান হবে
তার বরফ শীতল কোমল হৃদয় ?
আর কতটা মিথ্যে অপবাদে
লেগে যাবে দাগ ওই অপাপবিদ্ধ চাঁদে ?
আর কতটা হঠকারিতার নিদর্শনে
ভেঙ্গে যাবে বিশ্বাস মানুষের উপর?

কবিতা - রফসান জানি

1 কমেন্টস্
দ্বিপ্রহরের কান্না
রফসান জানি



আজ বেশ রাত করেই ফিরছি,
হাত ঘড়িতে বারোটা আট
শহরের এক মাথায় আমার বাসা ।
আদৌ কখনো ভয় ডর ছিলনা,
হাঁটছি তো হাঁটছি ফাঁকা পথে
রিকশা গুলো আজ নেই কি এক অরাজকতায় ।
পৌষের কুয়াশা নিয়ন আলোকে ভোতা করে
মুচকি হাসছে শিশির ভেজা পিচ ঢালা রাস্তা
এঁকেবেকে চলে গেছে ।
রাস্তার দু ধারে শত শত অট্টালিকার দল
সারি বেধে সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় দেখছে প্রতিযোগীতায় ।
শহুরে রাস্তায় দিনদিন
দিন সংকীর্ণ হচ্ছে সরু গলিপথের মত ।
নেড়ি কুত্তারা আমায় দেখে ছুটে আসে,
ঘেউঃ ঘেউঃ ঘেউঃ
পথ ছার বাছা আমি চোর নই ।
প্রহরীর নিঃশ্বাসে সাইরেন বাজে
টুলে বসা প্রহরীর ঠোটে বাশী চোখে রাজ্যের ঘুম ।
নাক ডাকছে সাইরেনের ধ্বনিতে ।
এ শহরের মানুষ গুলো, অট্টালিকা, প্রহরী ঘুমে বিভোর
কেউ শোনেনি পথ কেঁদেছে ।
রাত কেঁদেছে তার দীর্ঘদেহী দুঃখ নিয়ে,
সূর্য ছোঁয়না মাটি উদয় লগ্নে,
আমি আর একদল নেড়ি কুকুর
প্রতিরাত শুনি দ্বিপ্রহরের কান্না ।



কবিতা - শ্যামল রায়চৌধুরী (শ্রী শ্যাম)

0 কমেন্টস্
পুরনোতেও নতুন
শ্যামল রায়চৌধুরী (শ্রী শ্যাম)



শব্দ যখন বাক্য হোয়ে
ফিরে ফিরে আসে
ছন্দে দোলায় , কান্না হাসি
অম্লমধুর রসে ,
খাঁচার পাখি যা উড়ে যা
আকাশ তোরে ডাকে
ভর দুপুরে ফেরিওয়ালা
পেটের দায়ে হাঁকে ......
দিবা নিদ্রা ... বলতে নারি
আলস্য বা আমেজ
হাতড়ে খুঁজি মনকুঠুরি
সবই আছে সতেজ ,
বর্ষবরণ সাজছে সবে
নতুন রঙ্গীন সাজে ,
আমি বাপু বেশ আছি
পুরনোতেই মজে...
বারে বারে হাত বাড়ায়ে
ফিরে ফিরে পাই-
তোমার কাছে বাঁচতে শেখা
ওস্তাদের সানাই ,
সব সয়েছ সব দিয়েছ
পুরনোতেও নতুন...
নবীন বরণ চিত্ত হরণ
তোমার প্রেমে তরুণ......।।


কবিতা - লাভলী ভট্টাচার্য্য

0 কমেন্টস্
বিভ্রান্তি
লাভলী ভট্টাচার্য্য



সমস্ত বিভ্রান্তির শেষে ,একদিন নিমগ্ন বিকেলবেলা
বৃষ্টি হয়েছিল অসময়ের শ্রাবণে ,
আষাঢ়ের ঢলে ভেসে যাব,ঐ টুকুই আকাঙ্খা
আবছা ছিল ভগ্ন নদীর আরেক কুল ,
আমি পায়ে হেঁটে পৌঁছে ছিলাম অনেক দূর
গোধূলি বেলার আসন্ন লগ্ন ,
চেনা মুখগুলোও তখন কেমন যেন অচেনা
নাকি ,কেবল আমার চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেছিল ?
চারিদিকে অতল জলের ঢেউ, মাটি ও আকাশে
সাঁকো হয়ে দাঁড়িয়েছিল , বৃষ্টি
দুহাতে আঁকড়ে ধরেছিলাম , ভোলাতে কিছু অপমান , কিছু অবসাদ
প্রগাঢ় অন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিলাম , নীল স্রোতে
হারাতে চেয়েছিলাম , এক অজানা পথে , ঠিকানা না রেখে ...।।
শুধু মনের কাছে নিবিড় হয়েছিলাম , শেষ বারের মতল ,
আচমকাই চোখের কোণে আধভাঙ্গা রাতের টুকরো গুলো ছুঁয়েছিলাম ,
ওরা ছায়ার মতই তখনও লেগে ,বিলীন হয়নি সমুদ্রের সফেদ ফেনায় ...
ভাবনা কে পেছনে ফেলে ,অবিরল বৃষ্টিতে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম হাত ,
রাতের প্রহর শেষে
আকাশের প্রান্তে প্রান্তে সম্ভাবনাময়ী সকাল খুঁজে নিয়েছিলাম ,
অনন্ত সমুদ্রের তটে ।

কবিতা - হরিশঙ্কর রায়

0 কমেন্টস্
দুটি কবিতা
হরিশঙ্কর রায়


একটি অপমৃত্যু ও আমি

হয়তো আমার গলিত লাশ দেখে একদিন
চিত্‍কার করে বলব,
এতো আমি নই?
এ আমার মুছে যাওয়া প্রতিরূপ।
যেমন করে পাথর ঝড়-বৃষ্টিতে
ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়,
তেমনি করে আমার স্ব-হিংস আত্মচৈতন্য বোধগুলো
উড়ে উড়ে হাওয়ায় মলিন।
যে আমার অন্তড়ালের ছিন্নভিন্ন রূপ এঁকে দিলো,
তাকে কি ঈশ্বর বলে ডাকতে পারি ?
না... !
তাকে যে নামে ডাকব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম

সেখানেও ভেজাল ঢুকে গেছে ।
অথচ ঈশ্বর, ঈশ্বর বলে
কি করুণ আকুতি আমার ?
যে আকাশ ঠাই দিয়েছিলো,
দেখি সেখানেও যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে,
মেঘের কান্না সইতে পারি না বলে ফিরে এসেছি আমি।
এখন আগুন হয়ে জ্বলতে থাকি, পুড়তে থাকি, অর্ধগলিত লাশ হয়ে থাকতে পারি।
গণতান্ত্রিক জীবনে আমার লাশ দেখে ঈশ্বরও ভয় পেয়ে গেছে,
কারণ আমি এখন অপমৃত্যু ।



নবজাতক

হে নবযৌবন !
জন্ম দিয়ো না
নবজীবন,
কেননা এখন
সময় খুব কষ্টদায়ক।
কদম কিংবা লাল বল
ককটেল হয়ে যায়।
ঝলসানো শরীর
করুণ আর্তনাদ দেখে দেখে...
কিভাবে প্রত্যাশা করো?

বরং প্রতীক্ষা করো ।
অতঃপর...
সুরেলা বসন্তে
সৃষ্টির উল্লাসে মাতো।

নবজাতক
স্বর্গীয় হাসি হাসুক
দোদুল দুলুক
ভূবন ভুলুক
এবং ভুলুক।

কবিতা - অলক বিশ্বাস

0 কমেন্টস্
ইচ্ছে
অলক বিশ্বাস


তোমার ডাকে দাঁড়িয়ে বাঁকে
মাতাল হাওয়া বেলা
মেঘ যাচ্ছে নিরুদ্দেশে
বৃষ্টি অবেলা ।

ঘূর্ণিপাকে এদিক ওদিক
উদ্ভ্রান্ত খেয়া
কোথায় তুমি হৃদয় আমার
ইচ্ছে একটু ছোঁয়া !

আয় বৃষ্টি সাঁতার দেবো
ভিজছি চোখের জলে
স্বপ্ন ফুঁড়ে কন্যে ওগো
ডুববো স্থলে ।



কবিতা - সুমন কুমার সাহু

0 কমেন্টস্
কিছু দীর্ঘশ্বাস
সুমন কুমার সাহু



আমি যে তোমায় ছুঁয়েছি
রাতের আঁধারে
মেঘ ভাঙা কান্নার মাঝে
বুকের ফাটলে বিদ্যুত ঝিলিকে -
ঘোর একাকিত্বে ।

তোমাকে পেয়েছি ভোরের আকাশে
ঘুম ঘুম চোখে
এক আচলা জলে মুখ ধুতে গিয়ে
আয়নার সামনে ।

বিচ্ছেদে কাঁদি কোথা আমি তুমি
ভালবাসা বিশ্বাস
নির্জনে বসি কান পেতে শুনি
আমার ই নিশ্বাস ।

তুমি-আমি আজ ও স্বপ্নের ফেরি -
আর কিছু দীর্ঘশ্বাস ।
নিজেকে কি কখনো দেখিনি আমি ?
হয়ত বা ছিলনা অবকাশ ।
 

কবিতা - দীপঙ্কর বেরা

0 কমেন্টস্
আলোতে শিশির খেলা
দীপঙ্কর বেরা



বিদ্রোহী চোখ তুলেই আকাশ মুহূর্তে
সোনালি রোদের ছায়া বিনয়ী আবর্তে
বৈঠকী শিশির গল্পে বাতাস মধুর
উদাস তারার মেলা ভাবনা সুদূর
পলক বাঁচিয়ে নেশা ঘাসেরাই মুগ্ধ
ছটা পড়বে জেনেই তো আলস্য দগ্ধ
বিদায়ী বিলম্বে তাও ঝরে পড়ে আলো
গাছেদের মৃদু মন্দ খুশির স্বপ্নালো
আদরে রুগ্ন বিভ্রম সাযূজ্যে তারুণ্য
বেদনার মুহ্য মোহতে বিষয় অরণ্যে
সরলের হৈমন্তিক প্রেমের বিহান
গড়িবে সভ্যতা মনে আপ্লুত সন্তান
বিঘ্নের বিলাপ সাজে অন্তরে শুভেচ্ছা
জীবন জীবনে মিলে আনন্দিত ইচ্ছা ।। 



কবিতা - সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী

0 কমেন্টস্
রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া
সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী



জুমজুম হিম পড়ছে আচ্ছাদনে,
লেজের তলায় মুখ লুকিয়ে বশম্বদ
কুকুরেরাও স্বপ্নকন্যা খুঁজতে উধাও,
আজকাল ক্ল্যাসিক চোরের বড় অভাব -
এই শান্ত মায়ামাখা রাত চোরকেও
আরামপ্রিয় করে নিকম্মা করেছে।
বালাপোষের মিষ্টি অহংকারে
ল্যাটেরাইট মাটি জুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া
গুচ্ছ শীত আর অন্ধকারের জটিল
অঙ্কের সরল মিশ্রণে সোঁদা গন্ধ চলকায়,
শীত টের পাওয়ার আগেই
হুইসেল বাজিয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া
ধূমকেতুর জ্বলন্ত শেষ মাথার খন্ড
আছড়ে পড়ে নির্বিবাদ গৃহস্থালীর
বরফ সম্পর্কের আপাত মৃত ধমনীতে।
হাই পাওয়ারের চশমা খুলে ফেলে লেহন
করে যাই একমনে রাত্রির দেহনিসৃত সুগন্ধি,
কাবুলি ব্রাউন সুগারও পিছিয়ে
কয়েকশো যোজন রাত্রির হৃদচিহ্ন থেকে।

কবিতা - গৌতম চট্টোপাধ্যায়

0 কমেন্টস্
মৃতপ্রায়
গৌতম চট্টোপাধ্যায়



বাকি আরও একটি দিন,
নিষ্প্রভ দীপশিখা মুখ তুলে চায়,
জ্বলন্ত কোমল প্রবাহে।
এ রূপময় রঙ্গমঞ্চে,
এসেছ একা যাও তবে ক্ষণে,
কাঠের পুতুল করে খেলা প্রাণে।

কিছু আধ চিমটি,
ভোতা নখ খেলতে ব্যর্থ;
বর্ণনামুখি মহিমা তোমার,
তৃষ্ণায় ফাটা বুক বিন্দুর খোঁজে।
একই গুচ্ছ একই শব্দ,
একলাই হেটে চলে পদ্মা নদীর মাঝি,
সাহিত্য জানো কি?জানিনে,
মানুষ মর্যাদা আসেনি।

ঠায় নেই জগতে,
কুশল মাকড়সার কৌশলী চাল,
অজ্ঞতা ভেসে চলে স্রোতে।
শুকনো ঝরা পাতা,
ঝরে যায় অতলে,
দোলায় টলোমলো নতুন।

বিরহ বেদনা অবসাদ ভুলে,
দেখি যেদিকে যায় চোখ,
এ মন কেউ বোঝে না।। 
 
 

কবিতা - রেটিনা বরুয়া

0 কমেন্টস্
বয়স
রেটিনা বরুয়া



তুমি শুধালে, তোমার বয়স কত ?
বয়সের হিসাব রাখিনি তো আমি ?
এক উদ্দাম কিশোরীর মত ছুটে যাওয়া এদিক থেকে ওদিকে ,
বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে কেউর দিকে তাকিয়ে
থাকা দুরন্ত বালকদের সাথে খেলা করা,
গাছের এ ঢাল থেকে ও ঢালে লাফিয়ে পড়া চঞ্চলা হরিণীর মতো
নদীর পাড়ে দাড়িয়ে ঢেউয়ের আনাগোনা দেখা ।
সবে তো করি এই বয়সে ।

তুমি শুধালে বয়স কত ?
বয়সের হিসাব এখনও রাখিনি আমি,
সংসারের ঘানি টানতে টানতে বয়ে যায় বেলা
ঘোমটা মাথায় সারাদিন এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘোরাফেরা ।
এর প্রয়োজন ওর প্রয়োজন শুনতে শুনতে
কেটে যায় বেলা নিজের দিকে তাকানোর সময় কোথায় ?
শুধু মাঝে মাঝে দরজায় দাড়িয়ে মনে হয় তার কথা,
একদা যে আমাকে ভালবেসেছিল আমিও যাকে ভালবেসেছিলাম ।
তুমি শুধালে এখন তো বল বয়স কত ?
এখনও জানিনা আমি আমার বয়স কত
শুধু জানি পড়ন্ত বেলায় এখন আমি একাকী দাড়িয়ে
আমায় চারিদিকে শূন্যতা খেলা করে,
যে ঘরে আমি ছিলাম সব সে ঘর আজ আমার জন্য বিভীষিকাময় ।
এখন শুধু মনে হয় মৃত্যুর কতটা দূরে আমি দাড়িয়ে
অতীত বর্তমান সব ভুলে যায়,
আজ এর বয়স জেনে কি হবে
বয়স শুধু শেষ হবে অন্থিম শয্যায় ।

মুক্ত কবিতা - অমলেন্দু চন্দ

0 কমেন্টস্
বরং শ্মশানে যা
অমলেন্দু চন্দ



শুদ্ধতার করোটিতে কি থাকে – স্বর্গ আর নরক দুটোই তো আরাধ্য শক্তির কলিজাছেঁড়া পাতাবাহার। হুরপরীবাহার না দোজখের দোসরের অদৃশ্য রুপের টান - কতটা লবেজান করে ভুক্তোভুগীই জানে, আর জানে মহাজন ফেরেস্তারা। নাকি জানার ফেরেব্বাজি চলে। এদিকে যখন তখন হেঁতালের জঙ্গলে বৃশ্চিকের বিরূপতা জারিজুরির তেরটা বাজায়, সে আর এক খেউর। কোনই মামলা নেই তবু বুকের বাগানে এখন তখন সম্ভ্রমহানি’র বিচারের বসন্তউৎসব। ধমনীর যদি একটা গলা থাকত ঠিক হিস হিসে ফিস ফাস হার্ট অ্যাটাকের সংবাদ আগে ভাগে দিত।

খাঁচা বানাতে শিখিনি কখনো – ফলে মুথাঘাস চেপে ঠায় বসে থাকি, খুঁটিতে বাঁধা ছাগলের মিহি ব্যা ব্যা নিয়ে, আমিই বেট আবার আমিই শিকারী। একটা গাদা বন্দুক আছে দড়াম করবার জন্য। এই এলোমেলো জীবনমরন চারিয়ে রয়েছে শুধু লহমার প্রতীক্ষারোদ্দুর।
##

দাঁতাল বাকি থাকা সব বিজল্প বিস্ময়গুলো ঘড়ি আর সময়ের সঙ্গতে অস্থির ভারতনাট্যম, সারাক্ষন ফুস ফুসে চাপ থৈ থৈ। তৃষ্ণা গুলো কিছুতেই বর্ষার নদীর মত অহংকারী ডাঁটো সাটো আঁটো চেহারা ধরে না। মিটমিটে মিতব্যায়ীর মত শাসায় অত তৃষ্ণা ভাল নয়। স্পর্ধার পাল খাটাব কি শালা সিন্দবাদের ভিস্তির তাগদ টাও তো নেই। সাধ ছিল কর্কশ রোদের নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধতায় পা ডুবিয়ে আত্মদর্শনের আম্বা নিয়ে সাপের পাঁচ পা হব, হা হতোস্মি। কাঙাল মদ্যপের বাস্তুভিটে ভস্ম করে মেঘদুনিয়ার ফড়িং ওড়ানো। শুধু অবচেতনের এক গৌতমেচ্ছা ঝুলে থাকে অস্তিত্বের কিনার ছুঁয়ে – সুজাতা আসবে। আজও কিন্তু আসে নি! অথচ আশ্চর্য কোন সংস্কারের ঘোরে লালন করে যাচ্ছি একটা উপলক্ষ। নিজেকে ন্যাংটো করে আর কত দেখান যায়। তাই কষ্টটাকে জমিয়ে রাখি ওডিকলোন ছিটিয়ে।
###

এক একটা গানে এক একটা শব্দ উড়াল ভরে রাখে নিজের ডানায়, ধ্বনির উদ্ভাসের আর ঘোরের নোঙরে – আমি কাঙাল তবু কিছুতে মাপা হল না শুক্লা দ্বাদশীর দিনে বোষ্টুমির গাওয়া অন্তরার কারভেচার। ধীশক্তি দিতে বড় কার্পণ্য করেছ ভর্গদেব। সাধের অমূর্ত কান্নার দাপটে নোঙরবিহীন মাঝে মাঝে নিজের গহীনে গার্ড অফ অনার নিতে চলে যাই।
####

সমাপতনে শেষ যখন আসে তখন শেষ ততটাই অর্থপূর্ণ বা অর্থহীন যতটা যাপন ছিল। সব থাক অন্বেষণ বাচালতা উর্ণাজাল বাকসংযম বিসম্বাদ বা দ্বৈরথ কিম্বা মেরুদন্ড হিম করা স্বপ্নের শাসন। তবু অ-তুলনা শব্দটির মানে ঠিক ঠাক জানা হবে না। হে জীবন “তুমিই সৌন্দর্য আজও দু চোখে, তোমার ধ্যানেতেই মগ্ন অহর্নিশ...পরিমাপ করে যাই অনন্ত দ্রাক্ষার উৎস ঢালতে পার কতখানি বিষ (হুমায়ুন আজাদ) ”
#####

আজকাল যখন তখন শব্দের বিভ্রমে খুব ধাঁধা লেগে যায়,
অথচ অনায়াসে যখন তখন মুঠো খুলে
এখানে নামায় কথার ভ্রমর ...
একলা খুশিতে, সব বিখ্যাত কুখ্যাত অভিমানী শিশিরের মত
টুপ টাপ লেগে থাকে সময়ের ঘাসে।

…... বৈদগ্ধের হারেমে খোজার মত বিশ্বাসী থাকবার অপচেষ্টাতেই জীবন কেটে গেল। আর্তের শিশির তুমি এ জ্যোৎস্নায় ভিজিও আমাকে – একটু ঔদাসিন্য দাও ভালেরির মত।
######

অনুবাদ কবিতা - অভিলাষা দাশগুপ্ত আদক

0 কমেন্টস্
অনুবাদ কবিতা
অভিলাষা দাশগুপ্ত আদক


'হাইকু' পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম কাব্যরূপ। একবচন ‘হাইকি’ থেকেই বহুবচন ‘হাইকু’ এসেছে। ‘হাইকু’ জাপানী ভাষায় কবিতা লেখার একটি পদ্ধতি যা বিশেষ একটি রীতিকে মেনে লেখা হয়ে থাকে। তিনটি পংক্তিতে ৫-৭-৫ বিন্যাসে ১৭টি মাত্রায় এই কবিতাগুলো লেখা হয় । অর্থাৎ প্রথম লাইনে ৫টি, দ্বিতীয় লাইনে ৭টি আর শেষের লাইনে ৫টি সিলেবল নিয়ে মোট ১৭ সিলেবালে হাইকু রচিত হয়।

জাপানী কবি বোশা কাওয়াবাতা (1897-1941) –এর ছয়টি হাইকুর বঙ্গানুবাদ

(১)
ধীরে নিশব্দে
তুষার ঝরে যাচ্ছে
অদ্ভুত ছন্দে…

(২)
শিশিরবিন্দু
পাথরে ঝকমকানো
নিটোল সিন্ধু…

(৩)
লিখি,দেখি,মুছি,
অবশেষে খুঁজে পাই
গোটা কবিতা…

(৪)
ফুলের মত
আমরা প্রেমে ফুটি,
ঝরি নিঃশর্ত…

(৫)
হিমবৃষ্টিতে
ছাতা মাথায় কে যায়
লোক হাসাতে…

(৬)
জোনাকদানা
ঝিকিয়ে জ্বললেও
আলো দেয়না…

উৎস:
· Paintbrush: A Journal of Poetry, Translation and Letters(Spring&Autumn, 1983 issue).

প্রবন্ধ - সুদীপ নাথ

0 কমেন্টস্
পরিবহন ও দু একটি কথা
সুদীপ নাথ



আপনি যখন যানবাহন চড়েন আমাদের শিশুর জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে, নিজেদের বা সঙ্গী-সাথীদের, স্বার্থে আমরা দুচাকা, তিনচাকা, চার চাকা, যে যানবাহনেরই আরোহী হই না কেন, আমাদের করনীয় অনেক কিছুই থাকে। কারণ, ২০০৫ সালে ভারতে, এক লক্ষ দশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে পঁচিশ লক্ষ মানুষ হাসপাতালে গেছে এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০১৫ সালে দুই লক্ষ মানুষের মৃত্যু হবে ও পঁয়ত্রিশ লক্ষ মানুষ জন হাসপাতালে যাবে। একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, প্রায় সব যাত্রীকেই চলমান যানবাহনে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকতেই দেখা যায়। অনেকেই চলন্ত গাড়িতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটান। আর চালকের অসভ্যতা, যেমন রেষারেষি, মোবাইলে কথা বলা এসব দেখলে দুয়েকজন সাহসী যাত্রী হয়ত প্রতিবাদ করেন সময়ে সময়ে, কিন্তু সহযাত্রীদের সহায়তা তেমন একটা পান না বললেই চলে। যাইহোক, চলুন এই উদাসীনতা কিভাবে আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, মানে বিপদের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তা খতিয়ে দেখা যাক। দুর্ঘটনায়, যাত্রীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ কিন্তু মাথায় আঘাত লাগা। মাথা ছাড়া সরীরের অন্য কোন অঙ্গে আঘাত লাগলে মৃত্যু হয়না, যদিও অল্প সংখ্যক মারাত্মক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বেশি রক্তপাত বা দেরিতে চিকিৎসার কারণেই মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া, মাথায় আঘাত থেকে বহুবিচিত্র স্থায়ী অস্থায়ী গুরুতর মানসিক ও স্নায়বিক রোগ দেখা দেয়। এই ধরণের কত রোগী যে, পরিবার সহ পথে বসে যায়, কে তার খোঁজ রাখে। এসবের আমরা খোঁজ পাইনা কারণ, তারা জীবন্মৃত হয়েই থাকে, থাকে সাধারণের দৃষ্টির বাইরে। মিডিয়া দুর্ঘটনার খবর ছেপে দিয়ে, সরকারকে দোষারোপ করেই, বিষয়টা থেকে দূরে চলে যায়। আমরা কেউ পেছনের দিকে তাকাই না। অথচ আমরা একটু সতর্ক হলে, সব না হলেও, প্রায় সব ক্ষেত্রেই অন্তত মাথাটা বাঁচাতে পারি। চলন্ত গাড়িতে, উদাসীন না থেকে, যে গাড়িতে আছেন ও যেসব গাড়ি এগিয়ে আসছে, সেগুলোর গতি-প্রকৃতির উপর অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও সজাগ দৃষ্টি রাখবেন, যেন অন্তত মাথাটা বাঁচানোর চেষ্টা করতে কয়েক সেকেন্ড সময় পান। মনে রাখবেন, মাথায় অল্প-স্বল্প আঘাতেও ভিতরে রক্ত ক্ষরণ হয়ে মৃত্যু হতে পারে, যাকে ইংরাজিতে বলে ইনটারনেল হেমারেজ হয়ে মৃত্যু। চলন্ত গাড়িতে সবসময় সীট বেল্ট বাধতে হবে। মোটর সাইকেলে হেলমেট পরতে হবে। যারা লজ্জায় এসব মানবেনা, তাদের মনকে তৈরি রাখতে হবে, দুঃখ জয় করে রাখতে হবে। তাহলে, নিজের শিশুকে হা্রালেও কোন অসুবিধা হবেনা। আর যারা লজ্জাকে জয় করতে পারবেন, তারা গাড়িতেও হেলমেট পরবেন। এটা মোটেই হাসি ঠাট্টার কথা নয়, এটা আমাদের মত লক্ষ লক্ষ মানুষ ও শিশুর জীবন মরণের প্রশ্ন। আমরা না হয় মরতে রাজি, কিন্তু শিশুরা কী দোষ করেছে? ওরা কেন বড়দের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পুতুল হয়ে থাকবে। আমাদের কোন অধিকার নেই তাদেরকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেবার। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ৭/৮ বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভারত সরকারকে গাড়িতে হেলমেট পরার জন্য সাহায্যের হাত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তা কতদূর এগিয়েছে জানা যায়নি। এদিকে, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আর নেতাবাবুরা, আমলারা যার যার ঘর গোছানোর ব্যস্ততায় নামকে ওয়াস্তে দায়সারা দুঃখ প্রকাশ, প্রতীকী সভা করে, উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে জনসাধারণকে আশ্বস্ত করে দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছেন।

প্রবন্ধ - মৌ দাশগুপ্তা

0 কমেন্টস্
এক আত্মপরিক্রমা : বাংলাসাহিত্যের এক অনন্য নারীবাদী কবি,
মল্লিকা সেনগুপ্ত (
শেষ পর্ব )

মৌ দাশগুপ্তা



এই পুরাণ আর মহাকাব্যিক চেতনাভূমিতেই কি তৈরি হয়েছে মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিমন? একাধিক কবিতায় বারংবার এসেছে সীতা, দ্রৌপদী, মাধবীর কথা। সেই সব কারণেই হয়তো তাঁকে ‘নারীবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু এই দাগানো ছেঁদো ব্যাপার। এতে কবি এবং কবিতাকেই অসম্মান করা হয়।মল্লিকার কবিতাগ্রন্থগুলির ধারাবাহিক পাঠ থেকে এটা বেশ বোঝা যায় যে দিন যত গিয়েছে কবি ততই চেয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে তাঁর কবিতা কেবল একটি মেয়ের বন্ধুই নয়, হয়ে উঠুক তার হাতিয়ারও, আর কে না জানে হাতিয়ার যতই ধারালো 'ততই কার্যকরী!' মল্লিকা সেনগুপ্তের একটা অনিন্দ্যসুন্দর কবিতার নাম ‘রেডলাইট নাচ’। নাচের মঞ্চে যে কত নারী আসেন, তাঁদের প্রতিটি দেহভঙ্গিমায় যে কত ব্যথা লুকিয়ে আছে, তারা যে সমাজের নিগ্রহ পেরিয়ে এখন মনোরঞ্জনে মত্ত, সেই বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায়।

‘বীণা সর্দার খালি গলায় এমন গান গেয়ে উঠল যে
মধুসূদন মঞ্চের বাতাস করুন হয়ে এল
তেজী হরিণীর মতো সারা মঞ্চে নেচে বেড়াচ্ছে সে
কে বলবে, তিনবার ওকে বিক্রি করে দিয়েছিল ওর বাবা !
নেপাল বর্ডার থেকে পুলিশ উদ্ধার করে এখানে এনেছে
পুরনো কথার ঘায়ে মাঝে মাঝেই ওর মাথা খারাপ হচ্ছে ।‘
[রেডলাইট নাচ]
মেয়েদের দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা, লাঞ্ছনা, উপেক্ষা,সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে বারবার সরব হয়েছে তাঁর লেখনী।কবির নিজের কথায়, ‘আমি কান্না গড়ি, আগুন লিখি, নিগ্রহ দেখি অঙ্গার খাই,লাঞ্ছিত হই, আগুন লিখি।‘মানছি, তাঁর প্রতিটি কবিতা হয়তো শিল্পিত সুষমায় উত্তীর্ণ নয়, সেটি সম্ভবও নয়।
‘এ ভাবে হাচ থেকে এয়ারটেল হয়ে
আবার রিলায়েন্স স্বামীর ঘর’
গোছের লাইনে চমকও নেই, কবিতাও নেই। এ ভাবেই বহু জায়গায় রান মিস, তবু খেলার দক্ষতায় হাততালি না দিয়ে উপায় নেই। ঠিকঠাক ছন্দ-ব্যবহার না জানলে
‘দিল তো পাগল হ্যায় বাঙালির মনে
গ্লোবাল লোকাল সব কিলবিল করে’
-এর মতো লাইন লেখা বেশ শক্ত।
অসুস্থ অবস্থায় লেখা ‘আমাকে সারিয়ে দাও, ভালবাসা’ বইয়ের ১৩ নম্বর কবিতাটা যেমন।

‘আমাকে বাঁচতে হবে, যত ভাবি, ততই উহারা
সহানুভূতির রসে চিটচিটে জিভ দিয়ে চাটে।’
মারণ রোগে দেখতে এসে যারা আহা-উহু করে, তাদের প্রতি বিরক্তি। তারা কোথায় থাকে? সহানুভূতির রসে। মনুষ্যেতর পিঁপড়েদের মতো। সে কারণেই তৎসম ‘উহারা’ শব্দের ব্যবহার। নারীবাদী-টাদীর ঢের আগে মল্লিকা সেনগুপ্ত তাই কবি।
‘যে ভাবে আদিম নারীরা তোমাকে প্রণাম জানাত, আমি সেই ভাবে
প্রণাম জানাই পুরুষ তোমাকে,’
মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতায় নারীর প্রতিবাদ আছে, কিন্তু তথাকথিত পুরুষবিদ্বেষ নেই। ‘স্বামীর কালো হাত’ নামে তাঁর একটি কবিতা পড়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। দাম্পত্য সম্পর্কের খুটিনাটি খুনসুটি নিয়ে লেখা ওই কবিতায় মশারী গুঁজে দেওয়ার নৈমিত্তিক ঘটনার বিবরণ চমৎকার ভাষা পেয়েছে। কবিতাটি একটু পড়ে নেওয়া যাক—
‘মশারি গুঁজে দিয়ে যেই সে শোয় তার
স্বামীর কালো হাত হাতড়ে খুঁজে নিল
দেহের সাপব্যাঙ, লাগছে ছাড় দেখি
ক্রোধে সে কালো হাত মুচড়ে দিল বুক
বলল, শোনো শ্বেতা, ঢলানি করবে না
কখনও যদি ওই আকাশে ধ্রুবতারা
তোমাকে ইশারায় ডাকছে দেখি আমি
ভীষণ গাড্ডায় তুমিও পড়ে যাবে,
শ্বেতার শ্বেত উরু শূন্যে দুলে ওঠে
আঁকড়ে ধরে পিঠ, স্বামীর কালো পিঠ ।‘
মল্লিকার কবিতা-র বিষয় হিসেবে এসেছে নানান প্রসঙ্গ। ‘তেভাগার ডায়েরি’ নামের এক কবিতায় শ্রমজীবী নারীর প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে নতুন এক ভাষায়। শ্রমের বিনিময়ে যে নারী পায় কেবল পোকা আলু আর আতপ চাল, সে যে তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য পায় না, তা বলা-ই বাহুল্য। তবু সেই শ্রমজীবী নারী তাঁর খোঁপায় লালফিতে জড়িয়ে নেয়। এই লালফিতা শুধু আর রূপসজ্জার অংশ হয়ে থাকে না, হয়ে উঠে বিপ্লবের প্রতীক। এমনকি কাস্তের ফলকও হয়ে ওঠে তাঁর অলঙ্কার। যে তেভাগায় দুই ভাগ শ্রমিকের আর একভাগ মালিকের কথা বলা হয়েছে, মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতার নারী দেখতে পান, সেখানে দুইভাগ নিয়ে যাচ্ছে ‘গৃহমুষিক’। কিন্তু এটি নারী মেনে নেয় না, সে ‘উনুনের চার পাশে বসে হাত গরম করে’। আর তখনই তাঁর ঘোষণা পল্লবিত হয়।
দূরের চাষিকে শালপাতা মুড়ে খবর পাঠাও
আনো কেরোসিন, যদি দরকার হয় আগুন জ্বালাব
[তেভাগার ডায়েরি]
সাদামাটা উপকরণে যে কত উপাদেয় কবিতা-অস্ত্র তৈরি করা যায়, মল্লিকা তা নিজ হাতে করে দেখালেন।'অর্ধেক পৃথিবী' গ্রন্থটির প্রথম কবিতা 'আপনি বলুন মার্কস'৷ ইতিহাসকে প্রশ্ন করতে করতেই মল্লিকা পৌঁছে গিয়েছিলেন নিজস্ব বীক্ষায়।মার্কসবাদী ও নারীবাদী তাত্ত্বিকরা অনেকেই হয়তো এই কবিতাটিতে মল্লিকার অবস্থানটিকেও প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারেন,
কখনো বিপ্লব হলে
পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাস্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী
হবে ?
(আপনি বলুন, মার্কস…মল্লিকা সেনগুপ্ত)
'আপনি বলুন মার্কস'-এর পরে বার বার তত্ত্বের সঙ্গে এই বোঝাপড়া মল্লিকার কবিতার কেন্দ্রে জায়গা পেয়েছে৷ 'ফ্রয়েডকে খোলা চিঠি'-তে তিনি লিখেছেন,
'পুরুষের দেহে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ /
দিয়েছে শাশ্বত শক্তি, পৃথিবীর মালিকানা তাকে /
ফ্রয়েডবাবুর মতে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্য থাকে /
পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা করে পৌরুষের প্রতি৷ '
অক্ষর নিয়ে হেলায় ছেলেখেলা করে গেছেন কবি। একটি উদাহরনের লোভ সামলাতে পারলাম না।
অয় অজগর আসছে তেড়ে
ছোট্ট মেয়ের স্বপ্ন ঘেরে
আমার তোমার সবার চোখে
ময়াল সাপের মতন ও কে ?
ইঁদুর ছানা ভয়েই মরে
ধর্ষিত সে ভীষণ ঝড়ে
ঈগল পাখি দ্বিতীয় ভয়
থানা পুলিশ কোর্টে রয়
উট চলেছে উল্টোপুরাণ
মধ্যযুগে সে অভিযান
ঊনো জমির দুনো ফসল
বঙ্গদিশি মেয়ের দল
ঋতুবেলায় অশুচি নারী
অন্য সময় ঠেলবে হাঁড়ি
৯-কার কেমন ডিগবাজি খায়
লুপ্ত হওয়ার লাজ শঙ্কায়
একুশ থেকে ইচ্ছা-পোশাক
যে দেখে তার চক্ষু টাটাক
ঐ দেখো ওর ঘোমটা খোলা
বোরখা খোলা আপন ভোলা
ওল খেও না ধরবে গলা
ময়ালকে তা মিছে বলা
ঔষধে যে ময়াল মরে
সে ঔষধ কি আছে ঘরে..
(স্বরবর্ণ)
আবার এই কবিই 'ছেলেকে হিস্ট্রি পড়াতে গিয়ে' কবিতায় জানিয়ে দেন হিস্ট্রি আসলে 'হিজ স্টোরি', লেখেন, 'আসলে হিজড়ে ছিল ইতিহাসবিদ'৷

আমার তো কখনো কখনো মনে হয়েছে সমসাময়িকদের মধ্যে সম্ভবত মল্লিকাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি মহাভারতপ্রাণিত।‘মাধবী’র কথাই ধরা যাক। মহাভারতে মহর্ষি বিশ্বামিত্র তাঁর শিষ্য গালবের কাছে এক কান সাদা, এক কান কালো এক লক্ষ ঘোড়া দক্ষিণা চান। গালব রাজা যযাতির কাছে যান। দানবীর যযাতি তাঁর কন্যা মাধবীকে গালবের হাতে সম্প্রদান করেন। গালব এক-একটি রাজ্যে যান, সেই রাজারা সেই রকম দুষ্প্রাপ্য ২৫ হাজার ঘোড়া দান করেন। বিনিময়ে শুধু মাধবীকে এক বছর তাঁদের সঙ্গে থাকতে হবে, পুত্রের জন্ম দিতে হবে। মল্লিকার কবিতায় প্রথম দিকে মাধবীর চোখের আগুনে ছ্যাঁকা খেতেন গালব। সেই চোখ ক্রমে পানাপুকুরের মতো ঘোলাটে, নিস্তরঙ্গ। কবিতার শেষে গালবের থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে মাধবীর সেই ঘোলাটে চোখ ফেটে রক্ত নামে। ‘সেই রক্ত আজও থাকে নারীর সিঁথিতে।’ কোনও তত্ত্ব বা প্রতিবাদ নয়, আচমকা আজকের সীমন্তিনীদের সঙ্গে সে দিনের মাধবীকে একাকার করে দেওয়া। রাজারা হয়তো নেই। কিন্তু সংসার, চাকরি, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদির লেলিহান আগুনে আজকের মাধবীরাও কি আগুন হারিয়ে ক্রমে ক্রমে হয়ে যান না নিস্প্রভ?

এই ধরনের কবিতাগুলিতে কবিতার ভিতরেই মল্লিকা এক তর্কের উত্থাপন করেছেন, মেয়েদের নির্যাতনের বাস্তবতাকে অশ্রুসজল অক্ষরে বর্ণনা করে হাততালি পেতে চাননি, সেই বাস্তবতাকে, হ্যাঁ, কবিতাতেই, বিশ্লেষণ করে পাঠকের মস্তিষ্ককে আক্রমণ করেছেন৷ইতিহাস আর পুরাণকেই নয়, প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া ক্লাসিক বাংলা কবিতাকেও পুনর্নির্মাণ করেছেন তিনি৷ 'বীরপুরুষের মা ' এই পুনর্নির্মাণের এক সার্থক উদাহরণ৷ রবীন্দ্রনাথের 'বীরপুরুষ'-এ হিরো ছোট্ট ছেলেটি, সেই কেন্দ্রে, মা মার্জিনে৷ মল্লিকার কবিতায় কিন্ত্ত মার্জিন থেকে কেন্দ্রে এসে দাঁড়ান বীরপুরুষের মা৷ ‘মা’ মল্লিকা লেখেন,

'একলা মা আর একলা ছেলে
ডাকাতগুলো দেখতে পেলে
কী হবে বল্ বীরপুরুষ খোকা?
তুই করবি যুদ্ধ, আর আমি রইব বোকা !
স্পষ্ট বলছি তা হবে না আর
তুই ওদের তির ছুঁড়লে আমিও দেব মার৷'
এই রকম পংক্তি রচনার জন্য বাংলা কবিতার মল্লিকা সেনগুপ্তকে, কবি হিসেবে তাঁর সাহস, ধী ও দক্ষতাকে, প্রয়োজন ছিল৷ এভাবেই মল্লিকা সেনগুপ্ত হয়ে ওঠেন সমাজসচেতন এক কবির নাম।

নারীর জড়তা ঝেড়ে তিনি হয়ে ওঠেন কেবলি কবি। কিংবা কথামানবী। পাঠক/ পাঠিকার প্রিয় কবি। আশির দশকের বাংলার আধুনিক কবিতার অন্যতম কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত আজ আর আমাদের মধ্যে নেই । গত ২৮শে মে ২০১১ শনিবার ভোর ৫টা ৪৬ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। কথামানবী না থাকলেও রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টি, তাঁর আধুনিক মেয়েলী চুপকথা থেকে রূপকথার স্মরণিকারা।

প্রবন্ধ - রিয়া

1 কমেন্টস্
ভাষাসন্ধান (প্রথম পর্ব)
রিয়া



পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাবংশগুলির মধ্যে প্রথমেই যেটি উল্লেখ যোগ্য তা হল - ইন্দো ইওরোপীয় বা ইন্দো জার্মানিক বা আর্য ভাষাবংশ। এটা নিয়ে আবার দ্বিমত আছে, এবং দুটো মতই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম মত অনুযায়ী ইন্দো- ইওরোপীয়ান ভাষা ভাষী দের অর্থাৎ আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল মধ্য- ইয়োরোপ , আবার দ্বিতীয় মতে আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশে। এই আর্যজাতি পরবরতী কালে ভারতবর্ষ ও ইয়োরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর থেকে আরও ১০ টি প্রাচীন শাখার জন্ম হয়। শাখাগুলি হলঃ-

১/ ইন্দো- ইরানীয়
২/ বাল্তো- স্লাভিক
৩/ অ্যালবানীয়
৪/ আর্মেনীয়
৫/ গ্রীক
৬/ ইতালিক
৭/ জার্মানিক
৮/ কেন্লটিক
৯/তোখারিয়
১০/ হিত্তিয়।

ভাষাবংশ কি? বৃহত্তর জনসাধারন যখন একটি ভাষায় কথা বলে আর সেই ভাষাটি যখন বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে যখন এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের পারস্পরিক যোগাযোগ কমে যায় তখন তাদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষাগত পার্থক্য গড়ে ওঠে।এবং এই আঞ্চলিক পার্থক্য যখন খুব প্রকট হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই অঞ্চল ভাষা গত স্বাতন্ত্রতা লাভ করে আর স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদাও পায়। এইভাবে স্বতন্ত্র ভাষার জন্ম হয় ।

যদিও ভাষা স্বতন্ত্র্র হয়, কিছু পার্থক্য থাকে তবুও কিছুদিন সাদৃশ্যও থেকে যায়। অর্থাৎ একই উৎস থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলির মূল শব্দভাণ্ডারে যেমন সংখ্যা শব্দে, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শব্দে, গৃহপালিত পশুর নামে এবং দৈনন্দিন কাজ কর্মের সাথে যুক্ত শব্দে একই সাদৃশ্য চোখে পড়ে। অর্থাৎ এই সাদৃশ্য গুলি কিন্তু আসে একই ভাষাগত উৎস থেকে।আর এই আদি ভাষাগুলিকে অর্থাৎ যেখান থেকে বিভিন্ন ভাষার জন্ম হয়েছে তাকেই বলা হয় ভাষাবংশ। ইন্দো-ইয়োরপিয়ান বংশের সমৃদ্ধ প্রাচীন ভাষা হল- গ্রীক, ইন্দো- ইরানীয় শাখার আবেস্তিয় ও সংস্কৃত । ইতালিক শাখার ল্যাটিন আর জার্মানিক শাখার গথিক ভাষা। কারোর মতে এই বংশের প্রাচীন ভাষা বৈদিক সংস্কৃতে লেখা ঋগ্বেদ- সংহিতা যেটা আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টপূর্বে রচিত এবং সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম গ্রন্থ। তাছাড়া এই বংশের কয়েকটি প্রাচীনতম সমৃদ্ধ ভাষা হল- ইন্দো- ইরানীয় শাখার ফার্সি, বাংলা, হিন্দি । বাল্তো- স্লাভিক শাখার রুশীয়। গ্রীক শাখার আধুনিক গ্রীক। ইতালিক শাখার ফরাসী, ইতালিয়, স্পেনীয়। জার্মানিক শাখার ইংরেজি ও জার্মান ।

মূল ইন্দো- ইয়োরোপীয়ানদের একটি শাখা এসে ভারতবর্ষ ও ইরান-পারস্যে প্রবেশ করে। এই শাখার ভাষাকেই বলা হয় ইন্দো-ইরানিয় বা আর্য ভাষা। এই শাখাটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছিলো। একটি শাখা গিয়েছিল ইরান-পারস্যে যার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় পারসিকদের ধর্মগ্রন্থ 'আবেস্তা'য় খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে। আর অন্য শাখাটি আসে ভারতবর্ষে। যে শাখাটি ভারতবর্ষে প্রবেশ করে তাকেই আমরা বলি ভারতীয় আর্যভাষা।

আনুমানিক তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতবর্ষে এই আর্যভাষার প্রবেশ ঘটে। তারপর নানান স্তর পেরিয়ে নব নব রূপে আজও এই ভাষা ভারতে বেঁচে আছে। ভারতবর্ষে প্রবেশের কাল থেকে বিচার করলে আজ পর্যন্ত আর্যভাষার বিস্তৃতি কাল হল প্রায়, পাঁচ হাজার বছরের। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসকে পরিবর্তনের লক্ষণীয় পদক্ষেপ অনুসারে তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা হয়।

১/ প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা
২/ মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা
৩/ নব্য ভারতীয় আর্যভাষা

জীবন্ত ভাষা মাত্রই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে পরিবর্তিত হয়ে চলে, প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষাও লোক মুখে নিজে থেকেই কালে কালে পরিবর্তিত হয়ে আসছিল। কিন্তু বেদের ভাষাকে এদেশের ব্রাহ্মণ, সমাজ নেতারা, মনিষীরা ' দেবভাষা' বলেই বিশ্বাস করতেন। এবং প্রকৃতির অপরিহার্য নিয়মে ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছিল তাকে তারা দেবভাষার বিকৃতি বলেই মনে করতেন। কারন তাদের ধারনা ছিল মূল ভাষার ব্যাকরণ শিখিয়ে দিলে এতে ভাষা বিকৃতি বন্ধ হবে । এর ফলে সেইসব মনিষীগন ব্যাকরনের নিয়ম দিয়ে ভারতীয় আর্যভাষার শুদ্ধ ও মার্জিত রূপের যে আদর্শ রচনা করলেন তারই নাম হল 'সংস্কৃত', আর যারা এই রকম সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ সৃষ্টি করেছিলেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন মহামনিষী পাণিনি।

যাইহোক পাণিনি নিজে ছিলেন উদীচী অর্থাৎ উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলের অধিবাসী। আর সেই সময়ে শিক্ষিত বিদগ্ধ আর্যদের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান ছিল পশ্চিম ভারতের মধ্যপ্রদেশ। এইখানেই শিক্ষিত ব্যাক্তিদের মুখে ব্যবহৃত শুদ্ধ আর্যভাষাকে আদর্শ রূপে গ্রহন করে এবং তার সঙ্গে নিজের মাতৃভাষা উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলের কিছু উপাদান মিশ্রিত করে পাণিনি তাঁর ব্যাকরনে শুদ্ধ সংস্কৃতের রূপ বিধিবদ্ধ করেন। অশ্বঘোষ থেকে শুরু করে কালিদাস, ভবভুতি, ভারবি, মাঘ, বিশাখ দত্ত, শুদ্রক, বানভট্ট, প্রভৃতি কবি ও রচনাকারদের রচনায় এই সংস্কৃত ভাষার প্রভাব রয়েছে। মূলত একই ভারতীয় আর্যভাষা বিভিন্ন যুগে পরিবর্তিত হয়ে পৃথক রূপ লাভ করেছে। এবং প্রত্যেক যুগে তাকে পৃথক নাম দেওয়া হয়েছে।

প্রত্যেক যুগের ভাষাগত নিদর্শন আমরা পাই ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্য রচনায় বা প্রত্ন লিপিতে। তাছাড়া ভারতীয় আর্যভাষার মূল নিদর্শন পাওয়া যায় হিন্দুদের প্রাচীনতম গ্রন্থ ' বেদ' এ। আমরা জানি বেদ হল চারটি। যথা- ঋক, সাম, যজুঃ ও অথর্ব। প্রত্যেক বেদের আবার চারটি অংশ- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, এবং আরণ্যক। এগুলির মধ্যে ঋগ্বেদ- সংহিতাই প্রাচীনতম। এই ঋগ্বেদ সংহিতাই হল আর্যভাষার প্রাচীনতম দলিল। বৈদিক যুগে ভারতীয় আর্যভাষাই হল ভারতীয় প্রাচীন ভাষার অবিমিশ্র অবিকৃত নিদর্শন।

ভাষার সম্মান নির্ভর করে তার প্রকাশক্ষমতার ওপর। যে ভাষা যত বিচিত্র ভাব ও বস্তু এবং যত গভীর অনুভুতিতে প্রকাশ করতে সক্ষম সেই ভাষা ততই উন্নত। ভাষার এই প্রকাশক্ষমতার প্রধান আধার হল ভাষার শব্দসম্পদ।আবার এই শব্দসম্পদ কে তিনটি ভাবে সমৃদ্ধ করা হয়েছে

১/ উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত প্রাচীন শব্দের সাহায্যে,
২/ অন্য,, ভাষাথেকে গৃহীত কৃতঋণ শব্দের সাহায্যে
৩/ নতুন শব্দ সৃষ্টির সাহায্যে।

আজকের উন্নত বাংলা ভাষাও এই তিনটি উপায়ে নিজের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।

(কপিরাইট আইন অনুসারে রিয়া দাশগুপ্তা র রচিত এই লেখা বিনা অনুমতি তে কোথাও প্রকাশ আইনত দন্ডনীয়)

ধারাবাহিক উপন্যাস - অলভ্য ঘোষ

0 কমেন্টস্
পর্ণমোচী
অলভ্য ঘোষ



(তিন)


মিতা আর রুমা হেঁটে-চলেছে । কলেজ থেকে বাড়ির এই পনের মিনিটের রাস্তা গল্প করতে করতে অতিক্রম করে তারা ।গল্পের বিষয়বস্তু সাংসারিক কিংবা পড়াশোনা সংক্রান্ত যাই হয়ে থাকনা কেন;এ জগতের আর দশটা মেয়ের মত তারা সিনেমার নায়ক নায়িকার কুষ্ঠী বিচার কিংবা কোন লাস্যময় ছেলের রূপে আসক্ত প্রেমাক্রান্ত বাক্যালাপ করেনা । এ গ্রহে বসবাস করেও তারা যেন ভিন গ্রহের জীব ।

এখন তাদের আলোচনার বিষয় পূর্বরাগ । চতুর্থ পিরিয়ডে কমপালসারি বাংলা ক্লাসে অধ্যাপিকা সাথীলেখা রায় চৌধুরী যখন পূর্বরাগের অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের চিত্র জয় করছিলেন । মিতার মনে হয়েছে বড় বেশি মানব মানবির প্রেম কে তুলে ধরেছেন অধ্যাপিকা । দিদুনের মুখে চণ্ডীদাসের মুখস্থ কলি গুলোর সরল ব্যাখ্যাতে আজ পর্যন্ত দেহস্থ প্রেমের আভাস খুঁজে পায়নি মিতা । সেগুলো বারবার ভক্তি প্রেমের আধারে ভগবানের প্রতি প্রেমের ইঙ্গিত বহন করেছে ।

"রজকিনী-রূপ কিশোরী স্বরূপ কাম-গন্ধ নাহি তায়

রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম বড়ুচন্ডীদাস গায় ।।"

রজকিনী রামী বাঁশুলি মন্দিরের দেবদাসী । প্রতিদিন সকালে জল তুলে মন্দির ঝাঁট দেয়; বিদ্যুতলতার মত তনুশ্রী অপূর্ব মুখাবয়ব

রজকিনীর। একদিন মন্দিরের ভোগ নিতে এসে চণ্ডীদাসের সাথে আলাপ হয় তার । নানুরের অদূরে তেহাই গ্রামে ছিল এই রজক তনয়ার বাস । চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি ঊষাকালে অজয় নদের পাড়ে যজ্ঞিডুমুর গাছের তলায় নানুর গ্রামের মধ্যবয়স্ক পুরোহিত চণ্ডীদাস বুকে প্রেমনিয়ে বসে থাকতেন পিতৃ-মাতৃহীনা এই রামীণির জন্য । চণ্ডীদাসের আশ মেটেনা কিছুতেই এই রজকিনী রামীকে দেখে ।

এক এক সময় মিতার মনে হয় । আর জন্মে সে চণ্ডীদাসের রজকিনী ছিল । রুপম কি ছিল চণ্ডীদাস ? না ভাবনাটাকে পশ্রয় দেয়না মিতা ।

চণ্ডীদাস ছিলেন গ্রামের এক মন্দিরের পুরোহিত। গ্রামের এক নিচু জাতের অস্পৃশ্য মেয়েকে ভালোবেসে পা ধোয়া জল খেয়েছিল । পুরোহিত থেকে কবিতে পরিণত হয়েছিলেন চণ্ডীদাস ।

কখনো এই নারীমূর্তিকে তাঁর মনে হয় তাঁর বৈষ্ণব কাব্যের শ্রীরাধিকা আবার কখনো তাকে মনে হয় বাঁশুলি দেবীর প্রতিমূর্তি । একদিন রাতে স্বপ্ন দেখে তীব্র কাম-পিপাসা জাগে চণ্ডীদাসের শরীরে । সতীলক্ষ্মী স্ত্রী পদ্মজা মনের দুঃখে চলে গেছে তাকে ছেড়ে । একঘেয়ে নারী সঙ্গ বিবর্জিত জীবন কাটছিল চণ্ডীদাসের । কিন্তু তখন পূর্ণ যৌবন তাকে ছেড়ে যায়নি । স্বপ্নে চণ্ডীদাস একবার দেখেন রামী কে একবার দেখেন দেবী বাঁশুলির মুখাবয়ব । উথলপাথল মন । ভোর হতেই ঝাঁটা হাতে রামীণি আসে । রজকিনীর কাছে আসে চণ্ডীদাস। রামীর রাই-অঙ্গের ছটায় পুলকিত শ্যাম !দুহাত বাড়িয়ে রামীর বাহু ছুঁতে-গেলে কুণ্ঠিত,লজ্জিত রজকিনী দূরে সড়ে যায় ।

-কি করছেন গোঁসাই?

বাঁশুলি দেবীর বেদী স্পর্শের,দেবী-বিগ্রহকে ছোবার,ভোগ নিবেদন করার মন্দিরের সব অধিকার চণ্ডীদাস সফেদিতে চায় পরাজিত সৈনিকের মত নিচু জাতের মেয়ে রামীণিকে ।পাড়ার লোকে যদি একঘরে করে দেয় চণ্ডীদাসকে !দিক । জনঅরণ্যে একা বাঁচার চাইতে অরণ্যে প্রিয় সখ্যতায় বাঁচা অধিক শ্রেয় ।

রুপম ও কি ভালবাসার আগুনে পুরে এই ভেদবমির শ্রেণী বৈষম্য ময় সমাজ টাতে সত্য সুন্দরের প্রাকৃতিক তাড়নায় আজকের চণ্ডীদাস হতে চাইছে । মিতা যত ভাবে প্রশ্রয় দেবেনা ;মিতার ভাবনার জমিন ফুঁড়ে স্থানে অস্থানে ম্যানগোভ অরণ্যের মত মাথা উচুকরে দাঁড়ায় রুপম ।

মিতার মনে হয় রামীণি কি পড়েছিল দোটানায় !পুরুষের চোখে যে কামের আগুন জ্বলে প্রকৃত ভালোবাসা তা নয় । কেবল শরীরের আকর্ষণ । শরীর ফুরলে ভালবাসাও ফুরায় ।

রুমা বলে;
- "এখন কার চন্ডীদাসেদের এখন আর বার বছর ছিপ ফেলে বসে থাকার ধৈর্য নেই ।পাখি উড়ে-যাবে । একটা নয় ভিন্ন ভিন্ন ঘাটে একসাথে ছিপ ফেলে । আর রজকিনীরাও হাজার ঘাটে ঘুরে টোপ গেলে যখন তখন। গেলার সময় ও ভাবে না;ভাবে না উগরোবার ও সময়। দুই তিন মাস প্রেম টিকলে সেঞ্চুরি । টেস্ট-পালটে গেছে টেস্ট-ম্যাচ উঠে-গেছে;সবাই টোয়েনটি টোয়েনটি খেলছে । "

মিতা বলে:
- "আসলে এখন মাল্টিটাস্কিং,মাল্টিথ্রেডিং এর যুগ। তাল মিলায়ে না চলতে পারলে লোকে লজ্জা পায়। "

রুমা পারেনা মিতার অনেক কথা বুঝতে;তাদের দুজনার আলোচনায় অনেক সময় এঁটে ওঠেনা রুমা । হটাৎ উলটো ফুটপাতে চোখে পড়লো রুপম কে । ওপারের ফুটপাত থেকে তাদের ফলো করছে সে । রাস্তার লোকজন গাড়ি ঘোড়া কোন কিছুতেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই । রুমা ফিস ফিস করে কথাটা কানে তোলে মিতার ।

মিতা আড় চোখে দেখে রুপম কে । রুপমের চোখ দুটো এখন করুন ভাবে বর্ষার অপেক্ষমাণ চাতকের মত তাকিয়ে আছে মিতার দিকে । সব টাই কি নাটক !মিতা তলিয়ে দেখেনা ।

মেনরাস্তা ফেলে রুমা আর মিতা প্রবেশ করে পাড়ার গলি রাস্তায় । ছেলেটা এখনো অনুসরণ করে-চলেছে তাদের ।

-"নতুন কোন বদ মতলব আঁটে-নিতো । পাড়া পর্যন্ত চলে এলো বাড়ি টা চিনতে চাইছে বোধয় ।"

-"সব সময় মানুষ কে সন্দেহের চোখে দেখাটা ঠিকনয় মিতা ।"

-"সন্দেহভাজন হলে তাকে সন্দেহ না করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ;এরা সবপারে ..."

-"বিশ্বাস,ভালবাসা এ গুলো কি শুধুই কেতাবি..."

-"টি ভি খুব দেখছিস মনে-হচ্ছে । সিনেমা না সিরিয়ালের ডায়লগ এটা ।জীবন টা সিনেমা নয়;নায়ক নায়িকার দেখাহল অমনি প্রেমে পড়ে গেল ;যেন প্রেমে পড়বে বলেই পা বাড়িয়েছিল ;পরিচালক সুযোগ করে দিলেন । তারপর ধেই ধেই করে নাচো । সিনেমা তিন ঘণ্টার বেশি হয় না । জীবন কয়েক কোটি ঘণ্টার ; মামুলি কিছু ভুলের জন্য এতটা সময় নষ্ট-করবো কেন । চানাচুর ভাজা খেতে খেতে প্রেমে পড়লে চানাচুর শেষ হলে ঢোঙা টাই পড়ে থাকবে ; প্রেম থাকবে না । আমাকে যদি রুপম ভালবাসে;কেন ভালবাসল ?"

-"সব কেনর কোন উত্তর হয়না মিতা । আমি একটা মেয়ে ছেলেদের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে ।"

-"পাঁচ-মিনিটের জন্যেও যার সাথে আমার কোনদিনও কথা হয়নি;আমার ভালমন্দ কোনকিছুয়ই হদিস যে জানেনা । কয়েক দিনের চোখের দেখায় ভাল লাগতে পারে ;ভালবাসা জন্মাতে পারেনা ।Love at first Sight হতেই পারেনা । এক নজরেই ভালো লাগা শারীরিক।এখানে আবেগের চেয়ে শারীরিক আকর্ষণ বেশি কাজ করে। ভালবাসা লাউ কুমড়ো গাছ নয় পুঁতলাম আর ফল ফলল । সত্যিকার ভালবাসা বটবৃক্ষের মত যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে উৎসের সন্ধান হারিয়ে যায় উৎসেচকে । তাছাড়া আমার একটা ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান আছে যা কোন দিনও রুপম দের সাথে মিশ খেতে পারেনা ।"

-"ভালবাসা এত হিসেব নিকেশ করে হয় নাকি !"

-"তোর ফিল্মে হয় না ।"

-" বাস্তবে অহরহ তাই হয় । আকাশের মেঘ পথের ধুলোর সাথে লুকোচুরি খেলতে পারে কিন্তু কখনো আকাশ ছেড়ে নেমে আসেনা পথের ধুলয় ।"

-"কে বলেছে নেমে আসেনা ;তুই শুধু চিনতে পারিস নি মিতা । আকাশে মেঘ জমতে জমতে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে ধুলোর বুকে । ধুলকি তখন পারে বৃষ্টিতে না ভিজে থাকতে ।"

পূর্বরাগের পূর্বানুভূতি এখন মনে-হচ্ছে মিতার চাইতে রুমার অবগত হয়েছে ভাল ।রুমার কাছে পরাভব টা ধরা পরে-গেল মিতার ছলছলে চোখ দুটতে । আর একটাও কথা না বাড়িয়ে সে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো । আজ প্রথম রুমার কাছে মিতার পরাজয় ; অন্তঃকরণে হয়ত এ হার টাই চাইছিল সে নিজে ।

রাত বারটা আলো নিভান । বারান্দার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রুপম । ভবানিপুরের বারে আজ বন্ধুদের ছাড়াই গিয়েছিল সে। মথাটা এখনো চিনচিন করছে তার । গভীর নিস্তব্ধতাকে বার বার ভেঙে চলা দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক আওয়াজটা মাথার ভেতর যেন দুরমুশ পেটাচ্ছে রুপমের । দিনের বেলা ওটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না রাত যত বারে ঘড়িটার বাহাদুরি বারে ততো। মাথার চুলগুলো দুই হাতে মুঠো করে ধরে সে । তার ইচ্ছে করে ওগুলো উপরিয়ে ফেলতে। এই ইট কাট লোহালক্কড়ের পৃথিবীতে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে ;একা মনে হচ্ছে তার ।

সহসা গাড়ীর আওয়াজ ঘড়ির আওয়াজ ঢেকে রুপমের মাথার ভেতর যেন শেল হানলো । কান দুটোকে দুইহাতে মুঠো করে ধরেও কিছুতেই যখন রুখতে পারল না শব্দ ব্রহ্ম । ইজিচেয়ার ছেড়ে রুপম উঠে দাঁড়ালো গাড়ীর হেডলাইট সার্চ লাইটের মতো তার মুখের ওপর থেকে দেওয়ালে মিলিয়ে যাবার পূর্বে ;তিক্ত বিরক্তিতায় কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে সব রাগ উগরে দেয় সময়ের ওপর । দেওয়াল থেকে ঘড়িটা নামিয়ে বারান্দা থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলেদেয় রুপম । কাঁচ ভাঙ্গার ঝনঝনানি আওয়াজের সাথে গাড়ীর ঘরঘরানি বন্ধ হয় ;নেভে হেট লাইট। দরজাটা সজোরে খোলে ; দু জোড়া পা শব্দ করে ছুটে আসে রুপমের দিকে । সুইজ কট করে অন্ হতেই সমস্ত ঘরটা আলোকিত হয়ে ওঠে ।

-" What's happened !"

কথাটা বলতে বলতে পেছন থেকে রুপমের গলা জড়িয়ে ধরে তার মাম । মামের perfume এর ঝাঁজাল গন্ধটা নাকে যেতেই রুপমের সমস্ত গা টা গুলিয়ে ওঠে । মামের হাতটা গলা থেকে ছাড়িয়ে বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় রুপম ।

প্রণব এতক্ষণ কাঁধে ঝোলান কোটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সুইজ বোডের সামনে । কোটটা সোফার ওপর ছুড়ে ফেলে;বে-সামাল পায়ে ধপ করে বসে পড়ে সোফায় । ম্যাক-ডেলের গন্ধে সমস্ত ঘর টা রি রি করে ওঠে ।

-"তুমি রাগ করেছ রুপ।আমরা তোমার জন্য কিন্তু অনেকক্ষণ ওয়েট করেছিলাম । সেল টা সুইচ অফ করে রেখেছিলে কেন । কতবার ট্রাই করলাম....."

মাম ইজিচেয়ার টা ধরে দাঁড়িয়েছিল । আবার এগিয়ে আসে রুপমের কাছে ।

-"আমি ভেবেছিলাম তুমি পরে যাবে;রামঅবতার কে দিয়ে গাড়ী বাড়ি তেও পাঠিয়ে ছিলাম । রাই তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর কেক কাটে । "

-"সুইট গাল্ । দারুণ দেখতে হয়েছে মেয়েটাকে । "

প্রণব দুইহাতে মাথার ওপর তুলে হাই তুলতে তুলতে বলে ফেলে কথাগুলো ।

রুপের কাঁধে হাত রাখে মাম ।

-"আমার ছেলেও কমকিসে ।"

আবার কিছুটা দূরে সোরে যায় রুপম ।

-"Mom ; please leave me alone."

চোখ কপালে ওঠে তনুশ্রীর । হতাশ ভাবে ঘুরে তাকায় প্রণবের দিকে । হাত তুলে ইশারায় তনুশ্রীকে শান্ত হতে বলে ;সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে । মুখের মালবোরা সিগারেট থেকে ফুর ফুর করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাতের লাইটার টা সোফার সামনের টেবিলে ছুঁড়ে রাখে প্রণব । এটা তার একটা অভ্যাস।প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সে আর কোনকিছুর মূল্য-দেয় না । আবার প্রয়োজনে খোঁজে ।

-"মিস্টার সেন-গুপ্ত আজ প্রকাশ্য পাটিতে অ্যানাউন্স করে বসলো রাই এর সাথে তোমার অ্যানগেজম্যান্টের কথাটা । প্রপোজালটা অবশ্য অনেক আগেই আমি প্রপোজ করেছিলাম । "

-"engagement!"

তনুশ্রী তার চড়া মেকআপ স্বত্বেও বিবর্ণ মুখে একটা চেষ্টা-কৃত হাসি ধরে রেখে প্রণবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

-"ভেবেছিলাম আমরা তোমায় সারপ্রাইজ দেব ।"

-"What stupid thinking.প্রতিটা সম্পর্ক তোমাদের কাছে খেলনা না !"

ছেলের এইরকম বিরূপ মন্তব্যে মা বাপের মুখের যেমন জ্যামিতিক অভিব্যক্তি হওয়া সম্ভব ঠিক তেমন কিছু প্রণব তনুশ্রীর মুখে প্রকাশ পেল না । মনে মনে তারা যেন এমন প্রলাপের আসংখ্যা করে বসে আছেন । প্রতিষেধকের আয়োজন করতে চাইছেন রুপমের জন্য । টেবিলের অ্যাস ট্রেতে অবাঞ্ছিত সিগারেটের ছাইটা অবহেলায় ঝাড়তে-গিয়ে মেঝেয় পড়ে যায়; পাখার হাওযায় সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে ঘর নোংরা করে।অন্য সময় তনুশ্রী খেঁচ খেঁচ করে নোংরা বলে প্রণব কে । এখন পাকেচক্রে ভগবান ভূত । প্রণব মুখ খোলে ।

-"ছোট থেকে রাই এর সাথে তোমার ঘনিষ্ঠতা একে অপরকে খুব ভাল করে চেন-জান,পছন্দকর ।"

-"রাই এর সাথে সম্পর্কটা নিছক বন্ধুত্বের । আমি এর অতিরিক্ত কিছু কোনদিন ভাবিওনি ভাবতেও পারবো না ।"

তনুশ্রীর ধৈর্যর বাঁধ ভাঙছিল;

-"জানতে পারি রাই এর মধ্যে কমতি কি আছে ।She is sophisticated girl."

-"মাম আমার জীবন টা বাজার নয় মাপজোপ করে সম্পর্ক...."

তনুশ্রী থামিয়ে দেয় রুপমকে ।

-"Vagabond দের মত কথা বোলনা রুপ ।"

উত্তপ্ত পরিবেশে প্রণব জলপট্টি দেবার চেষ্টা করে ।

-"দেখ রুপ মিস্টার সেন-গুপ্ত আমাদের কোম্পানির ফিপটি পার-সেন্ট শেয়ার হোল্ডার ।এরকম কত কোম্পানি যে ওনার হাতের মুঠয় তার হিসেব নেই । ওনাদের সাথে আত্মীয়তা হলে তোমার স্ট্যাটাস কমে-যাবে না রুপ;বাড়বে । রাই একমাত্র সন্তান মিস্টার সেন-গুপ্তর অবর্তমানে ধরে নিতে পার সমস্ত প্রপাটি তোমার ।"

-"জীবন টাকি Algebra এক্স ধরে মিলিয়ে নেব । আমার জীবন টা নিয়ে প্লিজ বিজনেস করনা ডেড । প্রপাটির সাথে বিয়ে করার কোন রকম ইন্টারেস্ট আমার নেই । আর যদি স্ট্যাটাস এর কথাই বল আমার জানতে ইচ্ছেকরে মামকে বিয়ে করার পর তোমার স্ট্যাটাস কতটা বেড়েছে ।"

তনুশ্রীর মেকআপ করা লাবণ্য ময় মুখ খানাতে ; রুক্ষতার বাতাবরণ ছেয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ । এবার তার ফরসা গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো । রুপম যেন সপাটে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে তার গালে । রুপমের ঔধত্ব তনুশ্রীর ধৈর্যর সীমা লঙ্ঘন করায় রাগে অপমানে থর থর করে কাঁপছিল তনুশ্রী । ভুরু কুচকে চোখ দুটো কপালে তুলে বলে;

-"তোমার ইন্টারেস্ট কোথায় ;কলেজের ঐ গাঁইয়া মেয়েটার ওপর ?সে তো তোমাকে পাত্তাই দেয়না ।"

-"ও তোমরা তাহলে সবি-জান ।"

তনুশ্রী ঝংকার দিয়ে ওঠে;

-"এও জানি সকলের সামনে ওর হাতে তুমি থাপ্পড় খেয়েছ । কলেজ থেকে তোমাকে ঘার ধাক্কা-দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে । তোমার জন্য আমাদের মাথা ধুলয় মিশে-যাচ্ছে । "

রুপমের চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে । কিছুক্ষণ মাথানিচু করে থাকার পর আস্তে আস্তে মাথা তোলে সে।

-"Mom try to understand me ."

-"তোমার বলতে লজ্জা করছেনা রুপ । আমাদের বাড়ির চাকরেরও একটা সম্মান আছে । ওই বস্তির below standard মেয়েটা কোন ভাবেই এ বাড়ির যোগ্য নয় । "

রুপম বাইরের দিকে তাকাল । দিনের আলোয় ঝকঝকে প্রাণবন্ত লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ গুলকে এখন এক একটা কালো বৃহৎ আকার ডায়নোসারের মত দেখাচ্ছে । তার তলায় ছোট ইউক্যালিপটাস চারা গুলো যেন ডায়নোসারের বাচ্চা । জুরাসিক যুগ অতিক্রম করে এ যুগের মাটি স্পর্শ করেছে । রুপমের মনে হয় এ বাড়ির বাহ্যিক গম্ভীরতা তাকে গোগ্রাসে গিলে খেতে আসছে ।

মায়ের কথার জের টেনে আবার মুখ খোলে রুপম ।

-"একবার ভেবে দেখেছ মাম তোমার যোগ্যতা কতটা । রুপমের যোগ্য মা হয়ে উঠতে কোনদিন তুমি পেরেছ কিনা । পাটি,স্ট্যাটাস,ক্লাব,সোসাইটি ছোটবেলা-দিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে কান পচে গেল । আয়া মার হাতে আমাকে দিয়ে তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পরদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়েছ ।

কোন কোন দিন রাতে ফিরে জ্বর ছেলের মাথায় হাত রেখে আয়া-মাকে জিঞ্জেস করেছ টনিক টা ওকে খাইয়ে ছিলে । দেখেছ জ্বরটা কত ? তার পর হয়তো তোমার ভালবাসার প্রাপ্তি স্বরূপ ঘুমতে যাবার আগে এক গালে কিস্ করেছ । কত দিন তোমার কাছে ঘুমতে চেয়েছি তুমি বলেছ কাল ঘুমিও আজ আমি ভীষণ টায়াট ;কাল আর ফিরে আসত না । আমরা বেড়াতে গেলেও তোমায় সম্পূর্ণ ভাবে পেতাম না । আমি থাকতাম আয়া মায়ের ঘরে । জান মাম জ্বরে কাঁতরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া রাত গুলতে ;আমি যখন স্নেহ খুঁজতাম আশ্রয় খুঁজতাম আমার মুখের সামনে ভেসে উঠতো পয়সা দিয়ে কেনা আমার আয়া মায়ের ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো ।"

তনুশ্রী চিৎকার করে ওঠে ।

-"What do you mean ?"

-"আমি আর নতুন করে এই ভালবাসা চাইছিনা মাম । মিতা আমাকে রিফিউজ করার পর বুঝেছি তোমাদের থেকে শেখা ভালবাসা কতটা পোশাকি Formal। Hi; Hello; Bye বললেই

তোমাদের ভালবাসা ; তোমাদের আবেগ উচ্ছ্বাস সম্পর্ক সব কিছু শেষ হয়ে যায় । সোজা সস্তা । রাই খুব ভাল মেয়ে । But she is also part of the damned culture and society. ভালবাসি বলে ওকে আমি ঠকাতে পারবো না ।I hate this culture , society , love & relation ."

কথাগুলো বলা শেষ হতেই রুপ তার বেড রুমে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধকরে দেয় । প্রণব অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুন ছিল মা ছেলের ঝগড়া । সে রুপমের দরজার কাছে এগিয়ে যায় ।

-"রুপ....রুপ....শোন.....দরজা খোল । তুমি ডিনার করেছো । "

দরজার ওপাড় থেকে কোন উত্তর আসেনা ।

প্রণবের বুকে মুখ গুজে রুপমের ধারালো কথা গুলোর হৃদয় অনুরণনে কেঁদে ওঠে তনুশ্রী । প্রণব সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।

-"Upset হয়ে পড় না;সব ঠিক হয়ে যাবে ।"

(চলবে)

ছোটগল্প - শ্রীশুভ্র

0 কমেন্টস্
জন্মের দাগ
শ্রীশুভ্র

 

(পর্ব=১)

গড়িয়াহাটার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে মনে মনেই বিড়বিড় করছিল মন্দিরা! অদ্ভুত সব কাজকারবার এদেশের! দরকার রাসবিহারী রোডের উপর উড়ালপুল! তৈরী হল গড়িয়াহাট রোডের উপরে! আশ্চর্য্য! অথচ বাইপাস মুখি ট্রাফিকের সংখ্যা ঢাকুরিয়া মুখির থেকে অনেক বেশি! কিন্তু কে কাকে বোঝাবে? সিগন্যাল পেয়ে যেতেই যে একসিলেটরে চাপ দেবে সে উপায়ও নেই! এত ব্যস্ত একটা মোড়ে সেটা সম্ভবও নয়! মানুষের ভিড়ে গাড়ির ভিড়ে রাস্তা ফাঁকা পাওয়াই দুস্কর! তারপর যত্রতত্র অটো! কখন একটু ধাক্কা লেগে যাবে, দোষ হবে চারচাকার! সামনের শাদা রঙের সুইফ্টটাকে ওভারটেক করতেই আবার ফোনটা বেজে উঠল! ডেস্ক থেকেই ফোন করেছে! পেশেন্টের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে!

গতকালই গুরুতর আহত হয়ে এমার্জেন্সিতে ভর্ত্তি হয় একজন! মোটর সাইকেল একসিডেন্টে! মাথায় হেলমেট ছিল, তবুও সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে ইনটারনাল হেমারেজ ধরা পড়েছে! পেশেন্ট পার্টিকে জানানোও আছে অবস্থা ফিফটি ফিফটি! অন্তত বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে ভরসা দেওয়ার মতো বলার উপায় নেই কিছু! পেশেন্টের অবস্থা কিছুটা স্টেবল হলেই একটা মেজর অপারেশন করতে হবে! আইসিসিইউতেই রাখা আছে! কিন্তু সকাল থেকেই পেশেন্টের পাল্সরেট ফল করে যাচ্ছে! সুগার হাই! ফলে অসুবিধেও আছে! রঞ্জন আছে! কন্স্ট্যান্ট মনিটরিং করেও যাচ্ছে! তবু ডিপার্টমেন্ট হেড হিসেবে সব দায়িত্ব মন্দিরারই! পার্কিং স্লটে গাড়ি রেখেই মন্দিরা লিফ্টের দিকে দৌড়ালো!

ডঃ রঞ্জন প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে দিয়েছেন! মন্দিরা পেশেন্টের অবস্থা দেখে নিউরোলজির জয়ন্ত বিশ্বাসকে ডেকে নিল! তিনি সব রিপোর্ট দেখে মাথা নারলেন! - মনে হচ্ছে সার্ভাইভ করবে না বুঝলেন!

-এখনই অপারেশনের রিস্কটা নিলে!

-গড নওজ! তবে পেশেন্ট পার্টি যদি রাজী হয়! বলেই নিতে হবে, চান্স নেই তবুও...

-রাইট! আমি বলে রেখেছি যদিও!

-না! দে সুড নো, উই আর ট্রাইং আওয়ার লেভেল বেস্ট আগেইনস্ট অল ওডস!
একচুয়্যালি চান্স ইজ ভেরী স্লীম!

মন্দিরা ডঃ রঞ্জনকেও ডেকে নিল! রঞ্জনও সহমত হলেন!
-যদিও লস্ট কেস, ইয়েট উই ক্যান গীভ ইট আ লাস্ট ট্রাই!

মন্দিরা ওটি রেডি করতে বলে পেশেন্ট পার্টির সাথে কথা বলে নিতে বলল ডঃ রঞ্জনকে!

ওটি থেকে বেরোতেই ভদ্রলোককে দেখে খুব চেনা চেনা মনে হল! কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না মন্দিরা! উদ্বিগ্ন মুখে পেশেন্টের খবর জানার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন! নীল রঙের কোট প্যান্টে দীর্ঘ ঋজু চেহাড়া! এক মাথা শাদা ঢেউ খেলানো চুল! বয়স হলেও নির্মেদ টান টান শরীর! মন্দিরা কে দেখেই একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে পেশেন্টের খবর জানতে চাইলেন!

আশ্বস্ত করার মতো অবস্থা নয়, তবু ডাক্তারিতে আশা করেই যেতে হয়!

বলল ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখতে! নিজে যার উপর কোনো ভরসাই রাখতে পারেনি কোনোদিন!

ভদ্রলোককে পেড়িয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎই চোখে পড়ে গেল ওর বাঁদিকের কানটা! আর তখনই টুটুনের শেষ কথাটা মনে পড়ে গেল মন্দিরার! এতগুলো বছর পর!

সেই দিনটার কথা আজও ভুলতে পারেনি মন্দিরা! মন্দিরা তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী! আর টুকুন যাদবপুরে আর্টসে সেকেণ্ড ইয়ার! ছাত্র রাজনীতির হাত ধরে ক্রমশই জড়িয়ে পড়ছে দলীয় রাজনীতিতে! রাজনীতির বিষয়ে তখনো বোঝবার মতে বয়স হয়নি মন্দিরার! তবু টুকুনের মুখে বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আর্থসামাজিক স্তরে রাজনীতির গুরুত্ব নিয়ে অনেক কথাই শুনতো! দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা, দূর্নীতির প্রতিরোধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা, আরও কত কিছু নিয়ে একনাগারে বলে যেত টুকুন! খুবই রূপবান ছিল! বেশ একটা নায়কোচিত নেতৃত্বের ভাব ফুটে উঠত ওর উদ্বীপ্ত কন্ঠস্বরে! আর সেটাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করতো ক্লাস নাইনের মন্দিরাকে!

সেদিনটা ছিল লক্ষ্মীপূজোর পরদিন! বুধবার! আগেরদিন বড়ো মাসীর বাড়িতে ধুমধাম করে লক্ষ্মীপূজোয় সবাই হইচই করেছে! টুকুন বরাবরই এসব ধর্মীয় বিষয় থেকে দূরে থাকলেও সবাই মিলে একজায়গায় জড়ো হওয়ার উৎসবে ঠিক সামিল হয়ে যেতো! কিন্তু সেদিন টুকুনের যেন কি হয়েছিল! সবার মাঝে থেকেও যেন একা হয়ে যাচ্ছিল! মন্দিরার বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কিছু একটা সমস্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে ওর ভেতরে! প্রথমে জিজ্ঞাসা করেও সদুত্তর পায়নি! কিন্তু চাপা টেনশনের একটা আঁচ মাঝে মাঝেই ফুটে উঠছিল ওর চোখেমুখে! আর সেটা ঢাকার চেষ্টা করছিল এর ওর পেছনে লেগে! কেউ না বুঝলেও মন্দিরার বুঝতে দেরি হয়নি! টুকুনকে ও অনুভব করতে পারত অনেক গভীরে!

খুব বেশি কিছু বলেনি টুকুন! শুধু বলেছিল পার্টির মধ্যে দূর্নীতিগ্রস্ত মাফিয়ারাই শক্তিশালী হয়ে উঠছে দিনে দিনে! এদেরকে এক্সপোজ্ড করতে হবে! তখনো জানতো না হয়ত, মাফিয়াদের হাত কতটা লম্বা! পরের দিন খবর পেয়ে মন্দিরা যখন বড়ো মাসির বাড়ি পৌঁছালো তখন মেডিক্যাল থেকে টুকুনের ডেডবডি রওনা দিয়েছে! বড়ো মাসি তখন অচৈতন্য! কে বলবে এই বাড়িতেই আগের দিন অত আনন্দ উৎসব হয়েছে! সকালের বাজারটা টুকুনই করতো! কিন্তু সেদিন আর বাজারে গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি! বড়ো রাস্তার মোড়েই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে শুট করে দিয়ে চলে যায় দুটো ছেলে! গুলিবিদ্ধ টুকুনকে পাড়ার ছেলেরাই হাসপাতালে নিয়ে যায়! কিন্তু পথেই শেষ হয়ে যায় টুকুনের যাবতীয় প্রতিরোধ!

একজন মোটর সাইকেলে ছিল! আর একজন টুকুনকে গুলি করেই চালকের পিছনে উঠে পালিয়ে যায়! মৃত্যুর আগে পাড়ার ছেলেদেরই বলে যায় টুকুন! শুধু শেষ কথাটা বলেছিল, শ্যুটারের একটা কানে বিশাল একটা কালো জরুল! না আর কোনো কথা বলার সামর্থ্য হয়নি টুকুনের! সেই ক্লাস নাইন থেকে সেই দিনটা তাড়া করে বেড়ায় মন্দিরাকে! আজ এতগুলো বছর- সারাটা জীবন টুকুনের মতো আর কাউকেই খুঁজে পায়নি! বলা ভালো খুঁজতে চায়নি! বুকের নিভৃতে সেই স্মৃতিটুকু নিয়েই বাঁচিয়ে রেখেছে ওর টুকুনকে!

ভদ্রলোকের বাঁ কানেও বিশাল একটা কালো জরুল! শাদা চুলের ফাঁক দিয়েও চোখে পড়ে গেল মন্দিরার! অনেক, অনেক গুলো বিনিদ্র রজনী অপেক্ষা করেছিল হয়ত এই দিনটার জন্যেই!

ছোটগল্প - শমীক (জয়) সেনগুপ্ত

1 কমেন্টস্
আজগুবি নয়
শমীক (জয়) সেনগুপ্ত



মন ভালো নেই, কান্না পাচ্ছে বা কষ্ট হচ্ছে খুব- এ সব নিয়ে পাতায় পাতায় যে শিরশিরানী উত্তুরে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিল ছেলেটা.. তার খবর নিতে দরজায় নক না করে ঢুকে পরলো

মাতাল পবন; আচ্ছা আজ নাকি ফুলেদের সাথেও ও কথা বলেনি! গঙ্গাফড়িং আর গুবরে পোকা কানাকানি করছে... "এটা ওর বড় বেশী দেমাক। একরত্তি ছেলে সে কি না -"

"চুপচুপ, " সাবধান করে দেয় প্রজাপতি;ছেলেটা বাঁশী হাতে ঐ পথ দিয়েই যাচ্ছে- বাঁশের বাঁশীতে সুর নেই। দুপুরের আলসেমি মেঘে মেঘে অভিমান এঁকে দিয়েছে। আমবাগানে বোল ধরতে এখনো মাস তিনেক বাকি। কিন্তু সবাই তার দিকে তাকালেও আজ তার বড্ড একা লাগছে। ছেলেটার ঠোঁটে লাল আভা, ভারী দগদগে। তাই বাঁশী তার হাতে বাজছে না। সব চুমুতেই ছ্যাঁকা পোড়া হচ্ছে মন। রোদ্দুরে পিঠ ঠেকিয়ে শক্ত চোয়ালে ছেলেটা বাঁশী আঁকড়ে

বসে আছে।

"ও ছেলে তোর পিঠে রোদ লাগছে না ?"

লাগুক।

"তোর পিঠ পুড়ছে যে-"

পুড়ুক।

"কষ্ট হয় না !!"

চোখের জল চেপে ছেলেটা বলল "আমার এখন ভারী সুখ।"

তারপর কত সময় নুড়ির ফাঁকে ফোকড় বেয়ে জল এল কুলকুলিয়ে.. শ্যাওলার সোঁদা দাগে

সবাই আমের মুকুলের অপেক্ষায় আছে । কিন্তু ছেলেটার কথা সবাই ভুলে গেছে । বুড়ো আমগাছ খালি বলল "ছেলেটা বাঁশী বাজাবে না ?"

আকাশের তারাগুলো সবাই যদি ছেলেটাকে আলো দিত না পুড়িয়ে তবে হয়ত' সুর থাকত আজ। কৃষ্ণগহ্বরে আলো থাকে না ।। যেমন অভিমানে আলো থাকে না । সেখানে কে যেন

ডাকলো " ও ছেলে-"

শব্দগুলো ব্রক্ষ্মের আকার ধারন না করেও বুদ্বুদের মত মিশুক অন্য কোন কালো বুকে- সব ডাকে সাড়া মেলে না,যেমন ভাবে সব রূপকথাই আজগুবি নয়।।

হালকা হালকা ঠান্ডা পরেছে আর আমার ঘুমে ঢুলতে থাকা চোখে

পিঁপড়ের কামড়ের মত স্বপ্নগুলো কুটকুট করছে। কথা ছিল জেগে

জেগে স্বপ্নের ওপর রঙ বুলাবো,কিন্তু সাদা কালো ক্যনভাসে আর সব রঙই বেমানান। আচ্ছা আমি না কি খুব সুন্দর হয়ে উঠি যখন ঘুমোই, আর জেগে থাকলে ভীষণ বেখাপ্পারকমের অদ্ভূত থাকে আমার মন.. আসলে আমি বুঝতে পারি না। মেঘেরা খবর চালাচালি করে রোদ বৃষ্টির ফাঁক দিয়ে আর ভুলে যদি কখনো সে খবর আমার কাছে আসে হাওয়ায় ভেসে ভেসে আমি তখন শুনে ফেলি...তবু বুঝতে পারি না।

রাতের অন্ধকারে আমার নরম তুলতুলে টেডিটাকে জড়িয়ে ভুলতে চাই নিজের অস্তিত্ব, আসলে বয়স আমায় প্রাচীণ করেনি। মন আমার জড়তাকে আকাশ বানিয়েছে..আর চিন্তাগুলোকে নদী।

আর একফালি রোদ্দুরে হাসি এলোমেলো হাওয়ার খাঁজে লুকিয়ে থাকা মন খারাপকে বলে," এই বেঁধে দিলাম রুমাল তোর দু চোখে, এবার কানামাছি ভোঁ ভোঁ.......... সুখ পেলে তবে ছোঁ ।"

সুখটা এখন অনেকটাই গরম ভাঁড়ে ঠান্ডা চায়ের মত হয়ে গেছে।

হাত জ্বলছে, এদিকে পাঞ্ছা মিয়ানো অনুভূতি। পেলাম তবু মন ভরে না। ওদিকে দুঃখটাও আরেক কাপ চা... সে হল ঠান্ডা কাপে ছ্যাঁচ্চোর গরমের মত, জিভ পুড়িয়ে জাহির করে আমি আছি।

মিয়ানো চায়ের স্বাদ পাল্টাতে অদলবদল পলিসি চলে কিন্তু পোড়া

জিভে যে ক্যান্ডিডও কাজ করে তিনদিন পর থেকে ঐ জ্বালা বোঝে কোন শালা।

আমাদের সব ভাব ভালবাসা চায়ের টেবিলেই ।।

আর সব কল্পনাই আসলে বাস্তবের নামান্তর ।।

ছোটগল্প - জয়তী ভট্টাচার্য্য

1 কমেন্টস্
ভোলামন মন রে
জয়তী ভট্টাচার্য্য



বচ্ছরে এই একবার ''টেচকি'' চাপে দাস পরিবার ! দাস বাবু, দাসগিন্নি, আর ওনাদের তিন ছেলে মেয়ে ।

প্রত্যেক বছর ছেলেমেয়ের ইশকুলে বড়দিনের ছুটিতে যখন পুরী যাওয়া হয় দিন চারেকের জন্য । তা এই বছরেও দাস পরিবারের এই বাত্সরিক পুরী ভ্রমন এর কোনো ব্যাত্যয় হয় নি । হাবরা (হাওড়া আর কি) ইষ্টিশন থেকে জগন্নাথ এক্সপ্রেসে চেপে এবারেও প্রতিবছরের মত ওরা যাবে পুরী । “জয় জগন্নাথ !!” বলে বেরিয়ে পড়া গেল । প্রতিবারের মত এবারেও মালপত্তর একটু বেশি রকমের বেশি হয়ে গেছে । দাস পরিবারের কর্তা গিন্নি ট্রাভেল লাইট কি জিনিস জানেন না, জানলেও মানেন না । সঙ্গে প্রচুর জামাকাপড়,শীতের চাদর ,বাচ্চাদের গরম জামা, জলের বোতল,'' টিফিন কেরি ''। সব মিলিয়ে সঙ্গের জিনিসপত্র এক্কেবারে গন্ধমাদন হয়ে উঠেছে! তাতেই সুখ ! কম জিনিস পত্র নিয়ে বেড়াতে যাওয়া আবার কেমন ধারা বেড়াতে যাওয়া ? বিদেশ বিভুই জায়গায় গিয়ে অসুখবিসুখ যদি করে ,তার জন হরেক রকমের ওষুধপত্র, সে-ও ভুল হয়না ! তা এবারেও দাস পরিবার, যথারীতি হরেক আকারের বাক্স প্যাঁটরা সঙ্গে নিয়ে , দশ বছরের আর চার বছরের দুটি ছেলে,আর সাত বছরের একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন,হাওড়া ইষ্টিশনের দিকে ।''টেচকি ''তে ফাইনালি চাপার আগে দাসবাবু তিনবার ফিরে গেলেন,দরজা খুলে বাড়ির ভিতরে গেলেন, সব ঘরের আলো গিন্নি শেষ মুহুর্তে নেভাতে ভুলে গেছেন কিনা দেখে নিলেন,ফ্রিজ অফ হয়েছে কিনা,গ্যাস সিলিন্ডার বন্ধ করেছে কিনা,এই দেখো কান্ড,বাড়তি পড়ে থাকা কটা মাছের টুকরো পাশের বাড়ির ফ্রিজে রাখতে পাঠাবে ভেবে কৌটোয় রেখে শেষ অবধি ভুলে গিয়ে রান্নাঘরের তাকে রেখে সাত তাড়াতাড়ি গিন্নি গিয়ে টেচকি তে চেপে বসে আছে । সংসারে একটুও যদি মন থাকে ! সেই কৌটো নিয়ে বেড়িয়ে ছোট ছেলের হাতে পাশের বাড়িতে রেখে আসতে পাঠালেন, গিন্নিকে মৃদুমন্দ একটু ধমক লাগিয়ে । ধমকের ডোজ বেশি হলে, সেখানে পৌঁছে ,রাত্রে ছেলেপুলেগুলো ঘুমুলে রাত্রিকালীন সুখটি মাটি,বিদ্রোহিনী হয়ে উঠবেন গিন্নি । শেষ পর্য্যন্ত রওনা হওয়া গেল ! ''টেচকি'' একটু করে এগোয় আর দাসবাবুর ইটা মনে পড়ে সেটা মনে পড়ে।

- ওষুধ নিতে ভোলোনিতো ?

- “টিপিনকেরি”টা কে নিল ? টেচকির ডিকিতে ভুলে রেকে দাওনি তো ?

গিন্নির সরোষ জবাব ধেয়ে আসে বুলেট এর মত ,

- ''নারে বাবা , ওই তো মিনির হাতে ধরা আছে , দেখতে পাচ্ছ না ?''

- ''তপনকে বলেছ ? রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ি থেকে চলে যাবার সময়ে পাখা আলো সব যেন ঠিকঠাক নিবিয়ে যায় ?''

এবারেও গিন্নির বুলেট বর্ষণ ,

- ''হ্যারে বাবা ! গতবার ভুলে গেছিল বলে কি এবারেও ? আমার ভাই অত ভুলো নয় , বরঞ্চ সেই যে সেবার ঠাকুরপো কি করেছিল মনে নেই তোমার?''

- ''কি করেছিল?''

- ''তা মনে থাকবে কেন? এ যে তোমার নিজের ভাই, গ্যাস নেভাতে ভুলে গেছিল , সকালে উঠে চা করে খেয়ে গাস্ত জ্বেলে রেখে চলে গেছিল''-

- ''তাতে কি? আমরা তো সেদিন ভোরবেলায় ফিরে এসেছিলাম ,বেশি গ্যাস খরচ হয়নি''

- তা আমার ভাই পাখা নেবাতে বুলে গেলেই বা তাইলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে শুনি ?''

- ''যাকগে যাকগে যেতে দাও দিকিনি , দুদিনের জন্য বেড়িয়ে আর অত টেনচন করতে হবে না, জগন্নাথ দেব এর কৃপায় সব দেকবে ঠিকঠাক থাকবে !''

গিন্নি হাত জোড় করে মহা ভক্তি ভরে কপালে ঠেকালেন, দেখাদেখি কর্তাও ! তিন ছেলেমেয়ে আপাতত মা-বাবার সন্ধি স্থাপনে খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো যেন ! পৌঁছে গেছে হাওড়া ,ট্যাক্সি থেকে সব একে একে নামানো হলো,বাক্স,প্যাঁটরা ,লটবহর,গোনাগুনি করে কুলির মাথায় চাপানোর আগে প্রচুর দরকষাকষি চলল ! অবশেষে একসময়ে জগন্নাথ এক্সপ্রেস স্টেশন ছেড়ে রওনা হলো ! গিন্নি জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন,

- ''দুগ্গা-দুগ্গা,কালি-কালি শিব-শিব !''

কর্তা বললেন,

- ''টিফিন কেরি ?''

ছোট ছেলে বলল

- '' আমি কিন্তু রাত্তিরে ওপরে ঘুমুবো বলে দিলুম ''!

ট্রেন ছুটছে, দাসবাবু কেমন যেন উশখুশ করছেন,একবার উঠে দরজার কাছে যাচ্ছেন, ফিরে আসছেন,বসছেন, উঠছেন , পাশে সহযাত্রীরা বিরক্ত হচ্ছেন,গিন্নি বললেন,

- ''এমন করছ কেন? একটু স্থির হয়ে বোসো দিকিন!''.....

দাসবাবুর দোনামোনা সুরে জবাব,

- ''না ,আসলে মনেহচ্ছে, শেষ বার বেরোনোর সময়ে আমি সদর দরজায় তালা লাগাতে ভুলে গেছি''....

- ''সেকি কথা?এইত,দরজার চাবির গোছা আমার বাগে আছে ''...

- ।না''না ,চাবি তোমার হাতে দিয়েছি সে আমার মনে আছে কিন্তু দরজায় তালা লাগাতে ভুলে গেছি ,পরিস্কার মনে পড়ছে''........

- ''তপনকে একবার ফোন করে দেখো,সাইকেল নিয়ে ছুট্টে গিয়ে দেখে এসে ফোন করতে বলো''......

তাই করলেন দাসবাবু, ফোন সুইচড অফ্ ! ...

- ।''ঠাকুরপো কে করো !” …..

- ’’ফোন তুলছেনা,বোধহয় বাড়িতে ফোনটা ফেলে রেখে গেছে!’’………………………..!!’

- ’নাঃ নাঃ ! আর এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবেনা,চলো সব নেমে পড়ি,বাড়ি ফিরি ,এরপর যেখানে ট্রেন থামবে নেমে পড়ব’’….

ট্রেন থামলে সপরিবারে নেমে আবার হাওড়ামুখী লোকাল ট্রেনে চেপে হাওড়া । ছেলেমেয়েরা কাঁদো-কাঁদো,এবছরের পুরী যাওয়া মাঠে মারা গেল,গিন্নী রেগে আগুন,সারাপথ স্পিকটি নট । বাড়ির দরজায় ট্যাক্সি এসে থামল,কর্তা ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছেন, বড় ছেলে দৌড়ে গিয়ে ফিরে এল…

- ’’ওমা ! ওবাবা !! দরজায় তো ডবল তালা দেওয়াই আছে !’’

গিন্নী ঝাঁঝঁ করে উঠলেন,

- ’’তখুনি আমি বলেছিলুম !’’………

’’কর্তার মৃদু প্রতিবাদ,

- ’’তুমি অমনি বলেছিলে?’’…………..

গিন্নীর রাগত জবাব,

- ’’ওসব ছেড়ে এখন গুনে গুনে মালপত্তর নামাও দিকিন’’!

- ট্যাক্সিড্রাইভারকে ডিকি খুলতে বলতে গিয়ে দাসবাবুর মনে পড়ল ডিকিতে চারটে সুটকেস তোলাই হয়নি,সেগুলো ট্রেনে সিটের তলাতেই রয়ে গেছে ! মেয়ে বড় সাধের লুচি আলুরদম ভরা ‘’টিফিনকেরি’’হাতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে !

৫ ডিসে, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৮ম সংখ্যা

1 কমেন্টস্
সম্পাদকীয়



বাঙালীর তের পার্বণের সাময়িক ছেদ পড়লো। বানভাসি মানুষের বুকে শত আত্যাচার অনাচারের কামদূনি বহেছিল তবু উৎসব যেমন আসে তেমনিএসছিল। আকাশপ্রদীপের আলো নিভেছে। মাঠে মাঠে ধানের শীষে সোনালি আভা আবার কোথাও ভানভাসি পলিতে লেপতে থাকা শুকনো গাছে আগরা। এর মাঝে পৌর নির্বাচনের তরজা পেরিয়ে ফলাফলের প্রতিক্রিয়া, আর্থিক কেলেঙ্কারির নব কলেবর - সব নিয়েই আমাদের 'প্রেরণা' পরিবারে নানা ভাবনা। কলম কামড়ে বুকের জ্বালা নেভেনা কিন্তু প্রশমিত করতেই হয়। আমরা সভ্য সমাজের জীব - মানুষ নামের অভিযোজিত এক সম্প্রদায়। দিনযাপন আর প্রাণধারণের গ্লানি শুষে নেয় সামাজিক,অ-রাজনৈতিক সব ছন্দপতন। তাই প্রচারের আলোকে কালকের ক্ষত লালচে থেকে তামাটে হবার আগেই আরেক ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভুলে যাই কি ঘটেছিল আর কি করতে চেয়েছিলাম। শুধু কলমচিরাই মনে করিয়ে দিতে পারেন ভুলে যাওয়া গ্লনি আর অবক্ষয়ের প্রতিবাদে সামিল করতে পারেন আমজনতাকে। সেই দায় মাথায় নিয়ে 'প্রেরণা' পরিবারের সদস্যরা হাজিরা দেয় মাসে মাসে। চলুন দেখি এবারে কি রাখা আছে আপনাদের দরবারে।

প্রেরণা অনলাইন পরিবারের পক্ষে –

সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যবৃন্দ



কবিতা - অমলেন্দু চন্দ

0 কমেন্টস্
হ্যালো প্রেম - বাড়ি আছো
অমলেন্দু চন্দ



উইলোর ঝরে পড়া পাতার লালে
ঋতুটা ফল
পাতাঝরানোর ফাঁকে প্যারিসীন প্রেমিকের
জুগল বিহার
গঙ্গার ধারে
একটা একলা মেয়ে সে অঞ্চলে এসে যদি হটাৎ প্রশ্ন করে
চোখ তুলে
আমাকে পৌঁছে দেবেন?
হ্যালো অনুভব তুমি কি উত্তর দেবে?

প্যারিসীন শিষ্টাচার সম বা অসম যে কোন বয়েসের বাঁকে
দাবি করে বাঁ হাত বাড়িয়ে তুমি তাকে ডেকে নেবে
মাদামোয়াজেল বলে
এরপর ভুল করে আপনি সম্বোধনে যদি তাকে ডাকো
সে বুঝে যাবে কোনদিন প্রেমেই পড় নি
অথচ গঙ্গার ধারে নগরপালের শিষ্টাচার
তোমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাতকড়া
আর সম্বোধনে অস্ফুট ফোঁপানি
"স্যার, আমি মানে আমি তো কিছুই..."

অতঃপর প্রেম
বৈধতার প্রশ্নে
ফ্রন্ট্যাল ভিউ দিতে রাজিই হয় না আজকাল

কবিতা - হরি শংকর রায়

0 কমেন্টস্
মহাপ্রলয়
হরি শংকর রায়



আমার একখানা দু'চালা ঘর চাই শুধু!
দু'বিঘা জমিও চাই না।
রৌদ্রের প্রখরতা,
ঝড়োহাওয়া কিংবা শীতের
রুক্ষতাকে আটকে দেবার জন্যে;
ঠিক ততটুকুই!
উর্বর করে নেবো আপন হাতে......
মনোভূমি।
সমস্ত আগাছার জন্ম দেবো
মাঠে, ঘাটে, আকাশে ও চাঁদে;
উত্তর,দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে
বিস্তৃত শিকড় গেড়ে
শুষে নেবো সুচিন্তিত রসবোধ অথবা সমস্ত মতবাদ।

ভূত ও ভবিষ্যত্‍ জানবো না কোনদিন।
অন্ধকারেই থেকে যাবো;
আরও একবার মহাপ্রলয়ের
আকাঙ্খায়।

কবিতা - গৌতম চট্টোপাধ্যায়

0 কমেন্টস্
সামাজিকতা
গৌতম চট্টোপাধ্যায়



আজও পাইনি কবি সত্তার প্রমান,
নিস্তরঙ্গ মুহূর্ত যায় ভেসে প্রকাণ্ড স্রোতে;
বিরহ মন মুক্তি হাসি,
বাঁধনছাড়া নরখাদকে।
যে শিশু কোমল সবুজ,
আজ পড়ন্ত সূর্য পশ্চিমে;
যা সহজ কেবলই তুচ্ছ,
জিলিপি তে লালসাসিক্ত সমাজ;
তাই দুদণ্ড কথা,
হাওয়ার তোড়ে সংক্রমণে।

জীবনের মেলা রঙ্গমঞ্চের দোরগোড়ায়,
পরচুলো ছেলে মেয়ে করে খেলা।।

কবিতা - ঝিলিমিলি

1 কমেন্টস্
রেললাইনটার ধারে
ঝিলিমিলি



প্রাণের ভেতরে টান পরেছে
শেষ প্রান্তের নির্জনে কাঁদছে চোখ
একা একা কাঁদতে চাইছে
রেলগাড়ী হায় নিয়ে গেছে কিছু বেলা
শব্দের বহর বলে দিয়েছিল ফিরবে না তারা
বহু রাতের নিঃশব্দে চেনা সুর বাজে
বাঁশীর বেদন বাড়ে ধীরে বুকের গভীর খোঁজে
ঝড়ঝঞ্ঝা ছিলই থাকবেও
তা তোমাতে আমাতে ঘিরে অভিমানের পথ
সেই যে গেছে বেঁকে আর আসেনি ফিরে
কত কথা ভেসে গেছে অজানারই স্রোতে
রেল লাইনটার ধারেই একটি কথা ফেলেছিলি
মনের কোন ভুলেই বসে থাকি কথাটারে তুলে
কেঁদে কেঁদেই বলেছিলি চাঁদ সুরুজের দিব্যি
তুলে ভালোবেসেছিলি এই আমারেই
স্বপন বপন করে সেই কথারে ফিরিয়ে নিতে
আর এলি না
রয়ে গেলি শেষে আমারই চোখের জলে - 

কবিতা - রেটিনা বড়ুয়া

0 কমেন্টস্


আনুধাবনে
রেটিনা বড়ুয়া



বিছিন্ন কোন এক রাতে আঁধার ক্ষণে
নিশ্চুপ একাকীত্বে হৃদয় ভাঙ্গা কোন এক জলস্রোতে
বয়ে চলে ঝর্না ধারা,
ঝরে যায় যা আছে দুঃখ নিয়ে সাথে,
ঝরে পরে নিবিড়ে।
আমি দূর হতে শুনি একাকীত্বের সুর,
বয়ে চলে স্রোতধারা দূর বহু দূর।
এমনি কোন দিন ছিল,
অনুধাবনে পেয়েছিলাম তারে,
হৃদয় স্পর্শে ছুঁয়েছিলাম ভালবাসার সুর,
দিন বদলের খেলায়,
মেঘ বৃষ্টির ভেলায় বয়ে চলে স্রোতধারা দূর বহুদুর।
হৃদয় ভাঙ্গা কোন এক জলস্রোতে বয়ে চলে ঝর্না ধারা,
সুখের আড়ালে দুঃখে গড়া এ প্রলয় সুমধুর।