৩ সেপ, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা

0 কমেন্টস্

সম্পাদকীয়

প্রেরণার উৎসবে দুচার কথা


কিছু অসুবিধা কাটিয়ে উঠেও আমাদের পরিবারের সকলের প্রিয় "প্রেরণা অনলাইন" ওয়েবম্যাগ আজ প্রকাশিত হল আপনাদের শুভকামনা আর সহযোগীতা সাথী করেই। গ্রীষ্মের দাবদাহ পাড়ি দিয়েও আষাঢ় গগনে তেমন দেখা মেলেনি কাজল কাল মেঘের। মনে তাই ভাবনা এসেছিলো বৈকি – কি জানি কি হয়। কিন্তু - না আর কোন কিন্তু নেই।ভাদ্রের দিনের ভাবনা যতই বসুক জাঁকিয়ে আমরা মাতবই উৎসবে- ঝড় উড়িয়েছে ঘরের চাল, বানভাসি হয়েও থামেনি মনের তানে তানপুরার আলাপন।কবির কবিতা আর সাহিত্যের সব শাখা-প্রশাখাই নেচে উঠল তাই প্রেরণার হাতে হাত মিলিয়ে। চলুন আমরা এগিয়ে চলি উৎসবের প্রস্তুতিতে একসাথেই।


এবারের সম্পাদকমণ্ডলীঃ

সুমিতরঞ্জন দাস।
ইমেল নায়ীম।
সায়ন দে।
দেবী রায়।
কাশীনাথ গুঁই।

প্রেরণা-কবিতা প্রতিযোগীতায় যারা সম্মানিত হয়েছেনঃ

পর্ব -৩
বিষয়- কে আমি।
১ম- সুদীপ্তা চ্যাটার্জী বুয়া।
২য়- ঋত্বিক দাশশর্মা।
৩য়- সর্বজিত সরকার।

পর্ব -৪
বিষয়- ছোটবেলা।
১ মাত্র বিজয়ী- সুদীপ্তা চ্যাটার্জী বুয়া।

ছোটগল্প - ফারহানা খানম

0 কমেন্টস্


কথা দেয়া ছিল
ফারহানা খানম


সকাল সকাল এই দৃশ্যটা অকল্পনীয় আর অসহ্য ,অদিতি রাগ করবে না দেখবে ভেবে পেলো না অগত্যা চা এর কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রইলো ।এসময় ভাইয়া এলো তিনিও নির্বাক ,কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যা যা বলে চেঁচিয়ে উঠলেন । অদিতি বলল কি করলে ভাইয়া ? ইসশ পাখিটা ধরা যেতনা ? এসময় চোখ মুছতে মুছতে মিমিও এসে পড়েছে ,সে শুধু দেখলো ৪/৫টা সবুজ টিয়া উড়ে যাচ্ছে , তার বায়না ওটা চাই । এই হৈ চৈ এ পাশের বাড়ির দোতালায় মুকুল গান থামিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে ...মুকুল চেঁচিয়ে বলল ভাইয়া আমি ছবি তুলেছি , এদিক থেকে অনিক বলল যাক তুমি দুর্লভ দৃশ্যটা ধরে রেখেছ তাহলে ? আমায় দিও ছবিটা ।

রোজ ভোরে নামাজ শেষ করে খালি পায়ে বাগানে হেঁটে হেঁটে অদিতি আর অনিক চা খায় , গাছগুলো দেখে পানি দেয় পরিচর্যা করে পুরনো ফুল তুলে নেয় ঘর সাজায় এ সময় পাশের বাড়ির মুকুলের বোন মৌ আসে , ওপাশের দোতালা বাড়ির শানু চার তালার মামুন তিন তলার রুপা এসে ফুল নিয়ে যায় ।, তারপর ওরা পড়তে যায় ।

বাগানটা ওদের দুই ভাইবোনের নিজের হাতে করা কোন মালী নেই ,অদিতি আর অনিক দুজনে দেশী -বিদেশী ফুলের গাছ লাগায় যত্ন করে আবার পরের মৌসুমে লাগাবে বলে বীজ রাখে যত্ন করে । শরতে শিউলি গাছটার নিচে যখন রাশি রাশি শিউলি পরে থাকে সবুজের বুকে শিশির জড়ানো শিউলি কি যে অপূর্ব দেখায়!কিংবা জ্যোৎস্না রাতে যখন চন্দ্রমল্লিকা বা হাসনাহেনা ফোটে কি সুন্দর যে দেখায় ফুলগুলো যেন এক একটা নক্ষত্র !

তা আজ যে ঘটনা অদের যুগপৎ অবাক আর রাগান্বিত করেছে তা হল বারান্দার ধারের যে বেড তাতে সূর্যমুখীর ১২ টা গাছ তাতে বিরাট বিরাট খয়েরী -হলুদ সূর্যমুখী ফুটে ছিল । ত সকালে নিয়ম মাফিক অদিতি চা এর কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দেখল ৩/৪ টা টিয়ে পাখি সূর্যমুখী ফুলের বুকে বসে ফুলের খয়েরী বীজ খুঁটে খাচ্ছে পাপড়িগুলো তছনছ হয়ে আছে , এ দৃশ্য অকল্পনীয় আবার নির্মম সুন্দর, অদিতির মনে হচ্ছিল যেন পাখিগুলো ওর বুকে ঠোকর দিচ্ছে! তখন ভাইয়াও এসে নির্বাক তাকিয়ে থাকে ।ঠিক এই সময় প্রতিদিন মুকুল বারান্দায় বসে রেওয়াজ করে সে প্রথম বারান্দায় এসেই এ দৃশ্য দেখতে পায় দৌড়ে গিয়ে মোবাইল নিয়ে এসে ঘর ছবি তুলতে তৈরি হয় আর একটা ছবি তুলতেই নিচে গোলমাল বেঁধে যায় । মিমি পাখির জন্যে কান্না জুড়ে দেয় ।

ধীরে ধীরে রঙ পাল্টাচ্ছে আকাশে নীল কমে গাড় হচ্ছে সাদা আর সোনালী আভা । কয়েকটা প্রজাপতি উড়ছে ফুলে ফুলে। সুন্দর ঝির ঝিরে হাওয়া । বেশ কিছু নতুন ফুল ফুটেছে অদিতি আর অনিক বাগানে নেমে গেল গাছের পরিচর্যা করতে হবে ফুল নিয়ে সাজাতে হবে । । অদিতি পড়ে ক্লাস টেনে অনিক ভার্সিটিতে পড়ছে ২য় বর্ষে ।অদিতি ফুল তুলতে থাকে মৌ কে কিছু ফুল দিল, সে নিজে কিছু গাঁদা ফুল নিয়ে উঠে পড়লো । মুকুল ওপর থেকে বলল আমার জন্যে কিন্তু ৩ টে গোলাপ দিও অদিতি ,৩ টি গোলাপ দিয়ে দিল তুলে । ফুটন্ত গোলাপগুলো পাপড়ি মেলে ফুটে আছে সেগুলো সে ধরল না , বাকী যে কটা আছে ধরলেই ঝরে যাবে । উঠে এল ওরা বাগান থেকে বেলা বাড়ছে ঝকঝকে রোদ কিন্তু বার বার মনে পড়ছে ক্ষতবিক্ষত ফুলগুলোর কথা ।

নাস্তার টেবিলে মা জিজ্ঞেস করেন কিরে সকালে কি নিয়ে এত গোলমাল হলরে ? মিমি মহা উৎসাহে ঘটনা বর্ণনা করে এও বলে তার একটা টিয়া পাখি আজই চাই , মিমি পড়ে ক্লাস সিক্স এ ।বাবা হেসে বলেন বেশ তো রুনু তুমি কাঁটাবন থেকে ভালো দেখে একটা পাখি কিনে দাও ওকে তবে হ্যাঁ মামনি পাখিটাকে কিন্তু তুমি কথা শেখাতে হবে ।মিমি বলে শেখাবো । সবাই হাসতে থাকে ।

অদিতি নিজের ঘরে এসে পড়তে বসে। মৌ আর অদিতি একই স্কুলে পড়ে একটু পড়েই ওরা স্কুলে যাবে এসময় মুকুল আসে এ বাড়িতে ওদের আর ওই বাড়িতে এদের অবাধ যাতায়াত । কেউ কিছু মনে করেনা ,মুকুল এসে বলে

---আমার গোলাপ কই?

----কেন সকালেই ত দিলাম মৌ এর হাতে ,

---কেন তুমি নিজে দিতে পারনি ? অদিতির সারা মনে অদ্ভুত এক আলোড়ন নিজেকে শান্ত রেখে বলে একই ত কথা আপনি ফুল চেয়েছেন আমি দিয়েছি ,

----এক কথা নয় কাল থেকে তুমি দেবে আমি নিচে নেমে হাত বাড়িয়ে নেব ।

অদিতি বলে বেশ দেব । মুকুল যায় অনিকের ঘরে একটা বই নিতে এসেছিল সে , তারপর মনে হল অদিতিকে একটু ঘাবড়ে দিই ,এমনি অদিতি খুব শান্ত মেয়ে ওর সাথে দুষ্টুমি করতে বেশ লাগে ।ও খুব শান্ত আর দেখতে শ্যামলা মিষ্টি । আর খুব ভিতু ।

অদিতি আর মৌ রেডি স্কুলে যাবে অনিক চলে গেছে ওর পরীক্ষা মা বলেন মুকুল আমার হাতে অনেক কাজ একটা রিক্সা ঠিক করে দাও ওদের দেখো রিক্সা ওয়ালা যেন বুড়ো আর ভাল হয় ,মুকুল হাসতে হাসতে বলে

----বুড়ো কি ওদের টানতে পারবে খালা ?এক এক জনের যে ওজন ।হেসে ফেলে মা বলেন

--- বাবা দুষ্টুমি রাখো দেরি হয়ে যাচ্ছে ওদের ।

ওরা বেড়িয়ে পড়ে । ওদের বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে বড় পুকুর , এর ধার ঘেঁষে বড় বড় গাছ আর শান বাঁধানো ঘাটে সারাবেলা কেউ না কেউ গোসল করে ,কাপড় কাঁচে গল্প করে ,মোটের ওপর লোকের আনাগোনা থাকেই । গাছগুলো সুন্দর তুমুল হাওয়া দেয় পানিতে সাতার কাটে রাজ হাঁস আর হাঁস ।

পুকুর পাড়টা পেড়িয়ে একটা গলি ,ভাগ্য প্রসন্ন না হলে গলির মোড়ে না গিয়ে রিক্সা পাওয়া যায় না । ওরা গলিটা পার হওয়ার সময় দুটো বখাটে ছেলে কি যেন বলে ওদের লক্ষ্য করে মুকুল ভীষণ রেগে কিছু বলতে যায় লোকজন থামায় ওকে তবে সেও সাবধান করে দেয় কোনোদিন যেন এ পাড়ায় না দেখা যায় ওদের । এরপর মুকুল ওদের রিক্সা ঠিক করে দিয়ে সেও চলে যায় ভার্সিটিতে সে এবার প্রথম বর্ষের ছাত্র তার বিষয় গণিত ,ভীষণ রসকষহীন মনে হয় তার ।

ক্লাস শেষে বাসায় এসে মুকুল ভাবতে বসে অদিতিকে তার শুধু ভাল না বেশ ভালো লাগে কিন্তু কথাটা বলার সময় এখনো আসেনি সামনে ওর এস এস সি পরীক্ষা এসময় এই কথা বলে ওকে ভাবিয়ে তোলা ঠিক হবে না ,অথচ না বলতে পেরে সে ছটফট করে রাত দিন ।একটা ভয়ও কাজ করে যদি অদিতি ওকে না বলে ? না ওকে তেমন অপছন্দ করে বলে ত মনে হয়না।

অদিতি খুব সরল একটা মেয়ে ছোট থেকে ওকে দেখছে ,বই পড়া আর বাগান করা এই নিয়েই মেতে থাকে সারাক্ষণ । মুকুলের খুব অপছন্দ ওদের গানের মাষ্টার কে ,ওরা তিনজন মানে অদিতি মৌ আর মিমি যখন গান শিখতে বসে ,মুকুল খেয়াল করে দেখেছে মাষ্টার যেন অদিতির দিকে একটু বেশি মনোযোগ দেয় , আর বেছে বেছে প্রেমের গানগুলোই ওকে শেখাবে বড় রাগ হয় তার , এসময় মা খেতে ডাকেন ।

ফাগুনের এই দুপুরগুলো দুর্বিসহ! কি মন উদাস করে ...পুকুর পার থেকে আসা হাওয়া কি যেন বলতে চায় , বার্তা টা ঠিক ধরতে পারেনা মুকুল ,আমের মুকুলের গন্ধ অন্যরকম আবেশ ছড়ায় কাউকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে ,তখনই ভেসে উঠে অদিতির মুখটা । বাগানের দোলনায় নির্জন দুপুরে অদিতি যখন আনমনে দোল খায় আর গেয়ে ওঠে ' কত যে কথা ছিল ,কত যে ছিল গান...' মনে হয় ওর জন্যেই গানটা গাইছে ... অদিতির হাতে থাকে বই এলোমেলো চুল, কি অপরূপ যে লাগে ওকে দেখতে যেন ফুলপরী ।পথ ভুল করে থেকে গেছে যেতে পারেনি নিজের দেশে ... অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য ।

আচ্ছা অদিতি কি কিছুই বুঝতে পারেনা ওকে ? অদিতির জন্মদিনে মুকুল চুপি চুপি ওকে ছাদে ডেকে এনে গোলাপ আর প্রেমের গানের সি ডি উপহার দিল তবুও কি মেয়েটা বুঝল না ? না কি বুঝেও বুঝতে চায় না ?

লাল কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে মুকুল ভাবে আর নয় কালই ওকে বলবে যদি অন্য কেউ এরই মধ্যে ওর জীবনে এসে পড়ে ।ওই গানের মাস্টারটা যদি এসে পড়ে ওদের মাঝে ? না দেরী করবে না মুকুল কিছুতেই না ।

কিছু দিন কেটে গেল নিজের নিয়মে দিন শেষে রাত নামলো বেশ কয়েকটি অমাবস্যা পূর্ণিমাও এলো গেলো কিন্তু অনিকের আর বলা হোল না। কি এক সঙ্কোচে । সে খুব ব্যস্ত এখন গানের প্রতি খুব ঝোঁক বেড়েছে আর সামনে পরীক্ষা ।

দিন কাট তে থাকে অদিতিও ব্যস্ত পড়ালেখায় সামনে পরীক্ষা মুকুলেরও ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলছে সেও ব্যস্ত , বাগানটার দায়িত্ব এখন অনিকের আর মিমির ।

অদিতির পরীক্ষা গান শেখা বাদ । পুরোদমে লেখাপড়া করছে রুটিন মেনে ।স্যার আসেন পড়িয়ে যান কোচিং যায় মায়ের সাথে মাঝে মাঝে মিমি আর ভাইয়ার সাথে খুনসুটি , মিমির টিয়াটা নিয়ে দুষ্টুমি , এভাবেই কাটছে তার সময় , পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খুব মনে পড়ে মুকুলের কথা ও কি এত ব্যস্ত অর মনেও পড়েনা ওর কথা ? এখনো রোজ ভোরে অদিতি বাগানে হাঁটে তারপর পড়তে বসে আর মুকুল তখন রেওয়াজ করে বারান্দায় একবারও ত তাকায় না ওর দিকে , বুক চিরে কান্না আসে অভিমান হয় না আর ভাববে না সে মুকুলের কথা ।

আসলে মুকুল ঠিকই খেয়াল করে অদিতিকে কিন্তু মনে হয় অদিতি কেন নিজে থেকে একটা কথাও বলে না ? এত অহংকার কিসের ? আবার এও ঠিক মুকুল ভীষণ ব্যস্ত পরীক্ষা নিয়ে এর মধ্যে ঠিক প্র্যাক্টিক্যল পরীক্ষার আগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ,অথচ বসে থাকলে চলবে না অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে হবে পেপারস রেডি করা অনেক কাজ এগিয়ে আসে বন্ধুরা সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে অন্তরা ।

মাঝে মাঝে অদিতির মুখটা খুব বেশী মনে পড়ে , সেদিন ও এসেছিল বাগানের গোলাপ নিয়ে মুকুল কে দেখতে ,কিন্তু অভিমানে মুকুল কথা বলেনি কেন এত দেরীতে এল ও ? অদিতি মুখ ভার করে চলে এসেছে ওর চোখের কোনে কান্না জমেছিল । না ওকে কাল ক্ষমা চেয়ে নেবে ভাবলও সে । কিন্তু ব্যস্ততার কারণে মনেই থাকলো না সে কথা ।

সেদিন রাতে খুব সুন্দর জ্যোৎস্না ছিল ,বাগানে হাসনাহেনা ফুটেছে গন্ধে পাড়া মাতাল রাত তখন বারটা প্রায় মুকুল গাইছিল ' কাজলও নদীর জলে , ভরা ঢেউ উচ্ছল ছলে ...' এই গানটা, অদিতি নিজের অজান্তেই বাগানে এসে বসে , মনে হয় মুকুল ওর উদ্দেশেই গানটা গাইছে কাল যেভাবেই হোক সে জানাবে মুকুল কে তার ভালোবাসার কথা ।

মুকুল ভাবে অদিতি শুনতে পাচ্ছে ত ?

এসময় বাগানে আসে অনিক ও বলে তুই একটা গান কর নারে ? অদিতি গায় ''চাদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে ...' বাবা মাও এসে বসেন ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান শোনে মুকুল মৌ আর খালা খালু ।

কি সুন্দর গাইল ও বুকটা কেমন করে উঠলো অনিকের না ওকে বলতেই হবে কাল 'ভালোবাসি ' ।

এদিকে ভয়াবহ রক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করে আছে মুকুল জানত না জানলো দুদিন পর খাবার টেবিলে বাবা বললেন আমাকে রাজশাহী বদলী করা হয়েছে এ মাসেই যেতে হবে । সবাই খুব অবাক হয় অথচ করার কিছু নেই সরকারি চাকুরী বদলী করলে যেতেই হবে । মা বলেন মৌ এর জন্য ভাল স্কুল পাবো ত ? এই ক্লাস নাইনের বছরটা খুব জরুরী সময় । বাবা বলেন পাবে সরকারী স্কুলেই ওকে নিয়ে নেবে এটা নিয়ম ।এখন গোছগাছ করতে থাকো আমি আগে যাই তোমারা দুমাস পর এসো , সেভাবেই গোছগাছ চলতে থাকে ।মুকুল হলে সিট যোগার করে নেয় । দুমাস পর মৌ রা ঢাকা ছেড়ে চলে যায় । যাবার সময় খুব কান্নাকাটি করে সবাই ।

যাবার দুই দিন আগে অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে খালা বলেন ভালো করে পরীক্ষা দিশ , তুই যে আমার বউমা হবি ।

খালার কথাটা কানে বাজতে থাকে আনন্দ শিহরণ খেলে দেহ মনে । খালা আরও বলেন এত তাড়াতাড়ি বলতাম না কিন্তু বলার ত সময় পাবনা তাই বলা তোর মায়ের সাথে কথা হয়ে আছে তুই আমার ছেলের বউ হবি ,মুকুল ও জানে তোকেও বলে রাখলাম । তবে এও বলি তোর যদি এতে মত না থাকে বা মুকুলের যদি মত না থাকে আমরা জোর করবো না । মুকুলের খুব পছন্দ তোকে এখন তোর মত বল । সামনে মা আর খালা দুজনেই দাঁড়িয়ে ভীষণ লজ্জা করে অদিতির ,সে অস্ফুটে বলে আপনাদের মতই আমার মত সেদিন থেকেই সে ভাবতে শুরু করে ওর বিয়ে হয়ে গেছে মুকুল ওর স্বামী । মনে তখন আনন্দের বন্যা । চলে গেলেন খালারা। সব কেমন খালি খালি লাগছে মৌ নেই মুকুল নেই । দুপুর বেলায় মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায় খুব কান্না পায় ।

খালারা যাওয়ার পর মুকুল হল থেকে মাঝে মাঝে আসে । আগে ২/১ দিনের ছুটি হলে এসে রাতে থেকে যেত ,সেই দিনগুলো খুব আনন্দের হত সারাদিনই হৈ চৈ গান । মা ভালমন্দ রান্না করতেন ,ইদানীং ও আসেনা বললেই চলে , ভাইয়ার সাথে দেখা হয় হয়ত কিন্তু ভাইয়ার কাছে জানতে চাইতে খুব লজ্জা করে অথচ কি কষ্ট যে হয় মনে মনে । অদিতির পরীক্ষা শেষ হাতে অফুরন্ত সময় । এখন মুকুলের দেখা নেই । একদিন হঠাৎ এল মুকুল কেমন যেন দূর দূর ভাব রাতে থাকতে খুব অনুরোধ করলো মা থাকলোনা সে ,এক সময় অদিত ও বলল আজ থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে ? মুকুল বলল হবে পড়াশুনার খুব চাপ ।

মুকুলের মনে তখন তোলপাড় একদিকে অদিতি অন্য দিকে অন্তরা । ও অদিতিকে ভুলতে পারছেনা অন্তরাকেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না বরং অন্তরার ছায়া গাড় হয়ে উঠছে ওর মনে । অন্তরা অদিতির চেয়ে অনেক বেশী পরিপক্ব , সাবলীল , ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে মুকুল, অনেক বিষয় নিয়েই যা অদিতির সাথে বলা যায় না ।

অদিতি এখনো ছেলে মানুষ । লজ্জাবতী লতার মত ছুঁয়ে দিলেই নেতিয়ে পরে, যা বলে মুকুল সেটাই মেনে নেয় ভালো বলে । নিজের মতামত দিতে পারেনা ।সিদ্ধান্ত নিতে শেখেনি । ও অবুঝ ।

অন্তরা তা নয় ও সিদ্ধান্ত দিতে ও নিতে জানে মুকুলকে অনেক বিষয়ে পরামর্শ দেয় সে ।

অদিতি কে কথা দেওয়া আছে এখন সে কি করবে ? ভেবে ভেবে রাতের ঘুম হারাম হয়েছে ওর ।

এখনো সে অন্তরাকে বলেনি অদিতির কথা আর অদিতিকে ত বলার প্রশ্নই আসেনা অন্তরার কথা বলার । আরো ভাবতে হবে তাকে ।

দিন দিন জায়গা করে নিচ্ছে মুকুলের অন্তরার সাথেই আজ কাল অনেকটা সময় কাটে ওর ।পড়াশুনা সব কিছুতেই অন্তরা তাকে খুব সাহায্য করে ।ওদের দুজনকে প্রায়ই একসাথে এখানে ওখানে বেড়াতে দেখা যায় । ব্যাপারটা অনিকের ও জানতে বাকী থাকে না ।কিন্তু এই মুহূর্তে সে অদিতিকে কাঁদাতে চায় না তাই ওকে কিছু বলবে না বলেই ঠিক করে ।

সেদিন একা ঘরে মুকুল মা কে প্রশ্ন করে

-----কেন কথা দিয়েছিলে মা? এখন যে আমার বোনটা কষ্ট পাবে বুঝতে পারছ ? সে সব খুলে বলে মাকে, মা চুপ হয়ে যান একদম ,ভাবেন এ কি করলাম আমরা ? মুকুল বলতে থাকে

--- ভাবলে না একবারও বড় হলে মানুষের ইচ্ছেও বদলে যেতে পারে ? ওদের নিজেদের ইচ্ছে অনিচ্ছা থাকতে পারে?

----মা বলেন ওদের ত সব জানিয়েছি । তাও মুকুল এমন করতে পারলো ?

-----অদিতি জানে কথা দেওয়া আছে ?

----কেন মা ওকে জানালে ? ও নিশ্চয় মুকুলকে অনেক স্বপ্ন দেখছে ,তুমি বুঝতে পারছ ওর এই বয়সে স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট কত তীব্র হবে ?

মা চুপ করে কাঁদতে থাকেন । এখন মুকুল কেউ ত দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই এ হল মনের ব্যাপার । রাতে অদিতির বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলবেন ঠিক করেন ।তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন ,অদিতিকে বোঝাতে হবে ,মন ভাল রাখতে হবে ।

সেদিন থেকে অনিক খুব মনোযোগী হয়ে ওঠে অদিতির প্রতি বাগানের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন উদ্যমে । কলেজে ভর্তির জন্য পড়তে বলে বেড়াতে নিয়ে যায় । অদিতি সব বুঝতে পারে সে এতদিনে জেনে গেছে কি হয়েছে ?অনেক আগেই আঁচ করেছিল এখন সন্দেহমুক্ত হয়েছে ।

মায়ের অনুরোধে নিজের মুখ রক্ষার খাতিরে এখনো মুকুল কে যেতে হয় ওই বাসায় , একদিন দুপুরে অদিতি যখন এলোচুলে বাগানে দোলনায় বসে বই পড়ছিল আসলে ও কিছুই পড়ছিল না বই হাতে নিয়ে ভাবছিল ... দুপুরের নির্জনতায় খুব মন খারাপ ছিল তার সে শুনছিল মৌমাছির গুনগুন দেখছিল প্রজাপতির উড়ে যাওয়া দুটো শালিক হাঁটছে শিউলি গাছের ছায়ায়। এসময় মুকুল এল গেট দিয়ে ঢুকতেই অদিতি ডাক দেয়,-এদিকে আসুন ও তাকে আপনিই বলে ,মুকুল অপরাধী মুখে থমকে দাঁড়ায় ...কাছে আসে অদিতি যায়গা করে দিয়ে

---বলে বসুন খুব সংকোচে ওর পাশে বসে মুকুল অথচ ছয় মাস আগেই এই সংকোচ ছিল না তার ।

একটু চুপ থেকে নিজেকে সামলে নেয় অদিতি তারপর বলে এত ভাবছেন কেন বলুন তো ? আপনার অন্য কাওকে ভাল লেগেছে লাগতেই পারে তার জন্য এত দ্বিধা কেন ? আপনি আমাকে বললেই তো মিটে যায় সব । আপনি মুক্ত আমি ত আপনাকে কোনদিন কথা দিই নি বলিনি ভালোবাসি তাহলে কিসের বন্ধন আপনার ? যাকে ভাল লেগেছে তার কাছে ফিরে যান ...বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে মুকুল প্রশ্ন করে তুমি জানলে কি করে ?

---সেটা কোন দরকারি বিষয় নয় যা দরকারি ছিল বলেছি ।

---না তবুও বল কি করে জানলে ? আর তুমি কি করে এভাবে সমস্যার সমাধান করে দিলে তুমি জানোনা আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ।

----জানি সব জানি কিন্তু জোর করে পেতে চাইনা । কথা দিয়েছিলেন আমাদের দুজনের বাবা -মা তাই না । আজ আপনার একজন কে ভালো লেগেছে ,কাল আমার ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে তাই এ কথা দেয়া নেয়ার মূল্য আর নেই ।

-----তুমি বড়দের মত করে ভাবতে শিখলে কবে অদিতি ?এভাবে দুই মিনিটে সমস্যার সমাধান করে দিলে তুমি কি করে? কষ্ট হল না তোমার ? আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব কষ্ট পাবে এসব শুনলে ।

-----না হল না কষ্ট .. আর এসব কথা কি লুকিয়ে রাখা যায় ?.ভাবনার কথা বলছেন ? পরিস্থিতি আমাকে এভাবে ভাবিয়েছে ,আপনি যতটা অবুঝ ভাবেন আমি তত অবুঝ নই মুকুল । কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ ও নেই আপনি ভেতরে যান মা আছেন ।

--- আচ্ছা এখন বল তুমি কি করে জানলে ?

-----বলতেই হবে ? তবে শুনুন সেদিন আপনি একটা খাতা ফেলে গিয়েছিলেন সেখানে লেখা ছিল আপনার এই ভাললাগার কথা । আর আপনার আচরণেই প্রকাশ পাচ্ছিল আপনার দ্বিধার কথা , ইদানীং খুব এড়িয়ে চলছিলেন আমাকে যাই হোক , খাতাটা আমি রেখে দিয়েছি নিয়ে যাবেন আজ ।আর খালা খালুকে বলবেন এই বিয়েতে আমার মত নেই।

----বেশ তাই হবে বলে উঠে যায় মুকুল আর অদিতি তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ...

বাগানে শিউলি গাছের ছায়ায় এতক্ষণ দুটো শালিক ছিল এখন একটা একা মনের সুখে ঘুরছে ।অদিতি ভাবে আজ থেকে আমিও ওর মতো একাই উড়বো মনের আকাশে ............

অনেক বছর পর অদিতি তখন ডাক্তারি পাশ করে চাকরী করছে এতদিনে মিমি কলেজে পড়ছে মৌ এর বিয়ে হয়েছে সে বিদেশে থাকে বরের সাথে । অদিতির দেখা হল মুকুলের সাথে এয়ারপোর্টে অদিতি ট্রেনিং এ যাচ্ছে ইংল্যান্ড আর মুকুল যাচ্ছে অফিসের কাজে সে বেশীর ভাগ সময় ওই দেশেই থাকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে এসে ওরা থমকে দাঁড়ায় ,মুকুলের চুলগুলো সাদা , চালচলনে বেশ ভারিক্কি ভাব , বলে

----কেমন আছ অদিতি ?

-----ভালো ।আপনি একা যে ?

---তুমিও ত একা ?

অমিত সবসময় একাই ছিলাম একাই আছি কিন্তু আপনি একা কেন ?

---- অন্তরা নেই ।আমাদের প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে ...

---মেয়ে কোথায় থাকে কেমন আছে ? বয়স কত ?

---বলছি দাঁড়াও মেয়ে এতিম খানায় মা মারা যাবার পর ওকে দেখার কেউ ছিল না বয়স ৩ বছর ।

----কেন অর নানা - নানু নেই

---না তারা এই বিয়ে মেনে নেননি ওর সন্তানের দায়ভার কেন নেবেন ? আমিই বা কেন দেব?

---তাই বলে এতিম খানায় বড় হবে ও ?

--- হা উপায় কি বল অণুর যে কেউ নেই আর । আমি থাকি ব্যস্ত কে দেখবে ওকে ? মৌ টাও বিদেশে ।একবার মনে হয়েছিল তোমার কাছে যাই পরে ভাবলাম কোন মুখে যাবো ? আজ আরও অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে তুমি বিয়েই করলে না । আমার জন্য তোমার জীবন ও নষ্ট হল।

কোন কথা বলল না অদিতি শুধু মনে মনে ভাবল বিয়ে তো হয়েছিল সেই ছোট বেলায় আর ভেঙেও গেল তখনি । পুরো জার্নিতে অদিতি কোন কথা বলল না । প্লেন ল্যান্ড করবে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইক্রোফোনে তার ঘোষণা আসছে সিট বেল বাঁধতে বলা হচ্ছে ,

--- তখন অদিতি বলে একটা কিছু চাইবো দেবেন ?

---কি দেব বল ? আমার দেবার মত কিছুই নেই আর ...তবুও যদি থাকে দেব বল তুমি ।কিছুক্ষণ চুপ থেকে অদিতি বলে ,

----অণুকে চাই আমিও বড় একা , আমি ওর দায়িত্ব নেব মানুষ করবো ।ও জানবে আমি ওর খালা । ওর কোন অযত্ন হবে না ,এখনো মা আছেন ,আমরা দুজনে ঠিক ওকে দেখে রাখবো ।

----- দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মুকুল বলে বেশ তাই হবে ,ফিরে এসে ওকে তোমাদের ওখানে রেখে আসবো ,তোমার কাছে আমি হেরে গেলাম চিরকাল । ওর চোখে ভেসে ওঠে সেই ক্ষতবিক্ষত সূর্যমুখী ফুলটা একদিন নিজে সে ছবিটা তুলেছিল।

অদিতি মনে মনে বলে তোমার জন্যই আমার ঘর বাঁধা হোল না সংসার করা হোল না , জগতের স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের কাছে আমি কবেই হেরে বসে আছি চোখের সামনে ভেসে ওঠে উড়ে যাওয়া সেই টিয়া পাখিটা ।

প্লেন তখন লন্ডনের মাটি স্পর্শ করল মাত্র ।

ছোটগল্প - সৈয়দ রায়হান বিন ওয়ালী

0 কমেন্টস্


ভাঙ্গনের নিগুঢ়ে কাঙ্ক্ষিত আগামী
সৈয়দ রায়হান বিন ওয়ালী


অনেক ভেবেচিন্তে এবং দীর্ঘদিন নিজের সাথে বোঝাপড়া শেষে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দীপান্বিতা। তীব্র আবেগের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে অকস্মাৎ নেয়া সিদ্ধান্ত এটি নয়।

আশেপাশে একটাও রিক্সা নেই। হাতের ব্যাগটাকে অনেক বেশী ভারী মনে হচ্ছে। তেমন কিছুই তো নেয়নি সে সাথে। তবুও এত কষ্ট হচ্ছে। শরীরটা আসলেই অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।

বড় রাস্তার মাথায় একটা রিক্সা দেখা যাচ্ছে, এতোটা কাছে নয় যে ডাক দিলে শুনতে পাবে। দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করলো দীপান্বিতা। ট্রেনটা মিস করলে ঝামেলা হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আর কি কোনদিন এই সাহস তাকে পথে নামাতে পারবে? হয়তো আর কোনদিনও এমন সাহস দেখানোর সাহস করা তার হয়ে উঠবে না। ভাবতে ভাবতে সে বড় রাস্তার মাথায় এসে দাঁড়াল। ট্রেন ষ্টেশন যাবেন? তাড়া সূচক প্রশ্ন ছুড়ে দিল সামনের খালি রিক্সাটার চালককে লক্ষ্য করে? রিকশাচালক মাথা কাঁত করে হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই ব্যাগ হাতে রিক্সায় চেপে বসল দীপান্বিতা রিক্সা ভাড়া না মিটিয়েই। রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালা কে বলল, ভাই একটু তাড়াতাড়ি চালাবেন, নইলে ট্রেনটা ধরতে পারবো না। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। কোন উত্তর না দিয়ে রিক্সা চালতে শুরু করলো যুবক রিকশাওয়ালা।

ফের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নীল দীপান্বিতা। পারবে কি এই রিকশাওয়ালা তাকে দশ মিনিটের ভেতর স্টেশনে পৌঁছে দিতে? ঠিক ঠিক আটটায় যে ট্রেনটা ছেড়ে যায়। রিকশাওয়ালাটা তার কথামত বেশ জোরেই রিক্সা টানছে। আকাশ পাতাল ভাবনা চলছে দীপান্বিতার মাথার ভেতর। ছেলেটার কথা চিন্তা করেই বারে বারে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তাকে ছাড়া ছেলেটা চলবে কি করে? সেটাই তাকে বেশী ভাবাচ্ছে এবং পাশাপাশি কষ্টও দিচ্ছে। ছেলেটার জন্যই তো দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠছে তার যাত্রা পথ। অনেক স্মৃতি মনে পরে যাচ্ছে। কত স্মৃতি! কত স্মৃতি! এক যুগেরও অধিক সময় মানুষটার সাথে ঘর করলো সে অথচ মানুষটা কোনদিন তাকে তার নিজস্ব পরিচয়ে বেড়ে উঠতে দিতে চাইলো না। এই বিংশ-শতাব্দীতে, এত পাশ দেয়া অথচ এত পশ্চাৎপদ ভাবনা চিন্তার মানুষও থাকে! আশ্চর্য! তার স্বামীর বেড়ে ওঠা সঙ্ক্রান্ত কোন বিষয়ে সে তো কখনও বাঁধা দিতে যায়নি! তবে কেন সে এমন? সব পুরুষেরাই কি এমন? নারীকে সারাজীবন তারা পদানত করে রাখতে চায়? নারী কি পুরুষের ব্যবহার্য কোন পণ্য? না কি পোষ মানে এমন কোন গৃহপালিত পশু? প্রচণ্ড ক্ষোভে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে তার অন্তর। মানুষটার এই হীনতা আর বিজাতীয় গোঁড়ামির কারণেই আজ তার প্রাণের সন্তানের মায়া ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। মানুষটাকে সে কোনদিন ও কোন কিছুর বিনিময়েও ক্ষমা করবে না। মানুষটা তার জীবন টাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিয়েছে।

কত সখ ছিল তার পড়ালেখা শেষ করবে, ভালো চাকরি করবে, আর সব নিজের পায়ে দাঁড়ানো স্বনির্ভর নারীদের মত। অথচ এই মানুষটাই তার কোমল ও মমতা প্রবণ তরুণী মনের সুযোগ নিয়ে তাকে তার পড়ালেখা টা পর্যন্ত শেষ করতে দেয়নি অথচ নিজে ঠিকই পড়ালেখা শেষ করে, ধীরে ধীরে নিজের পেশাগত সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে। কিসের কমতি ছিল তার। লেখাপড়ায় তো সে একদম খারাপ ছিল না, আর সব মেয়েদের চেয়ে তার সাধারণ জ্ঞান ঈর্ষা করার মতই ঋদ্ধ ছিল। ছিল গান শেখার সহজাত ক্ষমতা আর সৃষ্টি কর্তা প্রদত্ত সুরেলা ধ্রুপদী কণ্ঠস্বর। ছিল নরম কাদামাটির মত সুগন্ধে ভরা এক জ্ঞান পিপাসু হৃদয়। আফসোস! কিছুই সে কাজে লাগাতে পারেনি। না ভুল, লোকটা কাজে লাগাতে দেয়নি। ভালবাসার দোহাই দিয়ে, ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করে ঘরে নিয়েছিল। ভালবাসা! ভালবাসার অর্থ বোঝে সে, না বোঝার কোনদিন চেষ্টা করেছে?

এতোটা বছর কিভাবে সে সংসার করেছে কেউ কি জানে সব! কেউ কি বোঝে একটি তরুণী কি ধরনের লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা নিয়ে এই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর ও অকৃতজ্ঞ মানুষটার সাথে এত দিন ঘর করেছে সে! না জানে না। জানে না আর বোঝে না বলেই অনেকে তাকে ভুল বোঝে। ভুল বুঝেই তার বিরুদ্ধে বলে নানান অকথা কুকথা।

পুনরায় হাত ঘড়িটার দিকে তাকাল সে। পথ টা প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে এসেছে। রিকশাওয়ালা টা বেশ জোরেই টেনে চলেছে রিকশা। সকাল আটটা বাজতে আর মাত্র ছয় মিনিট বাকী আছে। ট্রেনটা ধরতে না পারলে সত্যি অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। পরের ট্রেন সেই রাত দশটা। ট্রেনটা মিস করলে এতক্ষণ সময় সে কাটাবে কোথায়? এই ভেবে অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলো দীপান্বিতা।

আর কতক্ষণ লাগবে। আবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকাল দীপান্বিতা। আর মাত্র দুই মিনিট বাকী। ডান দিকে বাঁক নিচ্ছে রিক্সাটা, ষ্টেশনে প্রায় পৌঁছে গেছে সে। হটাৎ তীক্ষ্ণ আর বিকট আওয়াজের সাথে সাথে পেছন থেকে প্রচণ্ড ধাক্কায় রিকশা থেকে ছিটকে রাস্তায় আছড়ে পড়ল সে । মাথার পেছনে কে যেন হাতুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত করলো। মাথার পেছনে তীব্র বেদনা ও দু চোখে অন্ধকার নিয়ে জ্ঞান হারাল দীপান্বিতা।

... ... ...


মা, ও মা, কি, কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? কি হয়েছে তোমার? কাঁদ কাঁদ গলায় প্রশ্ন করে চলে ঋদ্ধ। ধড়মড়িয়ে এবং প্রায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে উঠে বসে দীপান্বিতা। তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশ দেখে নিয়ে, আতংকিত ও বিহবলিত কণ্ঠে প্রায় স্বগতোক্তির মত বলে উঠে, আমি, আমি এখানে কেন? পরোক্ষনেই ঋদ্ধকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করে উঠে, কিরে, কি হয়েছে তোর, তুই কাঁদছিস কেন? এবং প্রায় সাথে সাথেই, আবার জিজ্ঞেস করে, আমি, মানে আমি হসপিটালে কেন? তীব্র উত্তেজনা প্রশ্নমালা শেষ হবার আগেই, বিদ্যুৎ ঝলকের মত দীপার মনে পড়ে যায় সব কথা। ঢাকা যাচ্ছিল সে। রেল স্টেশনে পৌঁছে যাবার একেবারে শেষ মিনিটে রিকশাটা যখন স্টেশনে ঢোকার জন্য ডান দিকে বাঁক নিচ্ছিল ঠিক তখনই পেছন থেকে একটি দ্রুত গতির কোন একটি কিছু এসে তাদের রিকশাকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দেয়। আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত প্রচণ্ড ধাক্কার কারণে তার শরীর উল্টে প্রথমে পিঠ ও মাথার পেছনের অংশ পিচ ঢালা কঠিন রাস্তায় সরাসরি আছড়ে পড়ে। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। শুধু একটি কিশোর মুখের ছবি মনের গহীনে ভেসে উঠতে না উঠতেই দপ করে সব কালো হয়ে যায়।

... ... ...


এখন কটা বাজে রে ঋদ্ধ? তোর বাবা কোথায়? সুস্থির হয়ে কিছুটা ক্লান্ত গলায় এক সাথে দু দুটো প্রশ্ন করে বসে ঋদ্ধকে দীপান্বিতা। ঋদ্ধ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, রাত এগারোটার কাছাকাছি। আর বাবা ডিউটি ডাক্তারের সাথে দেখা করে বাসায় গেছে। তোমার জন্য খাবার ও দাদু কে নিয়ে আসতে। রাতে তো কাউকে থাকতে হবে, নাকি?

কে নিয়ে এলো আমাকে এখানে? একই রকম ক্লান্ত গলায়, আবারও প্রশ্ন করে ঋদ্ধকে দীপান্বিতা। রাস্তার কয়েকজন লোক তোমাকে তোমার ব্যাগ ও মোবাইলসহ এই হসপিটালের ইমারজেন্সি কক্ষে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। পরে বাবা এসে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে তোমাকে এই কেবিনে ভর্তি করিয়েছে, বলে ঋদ্ধ থামল।

আচ্ছা ঋদ্ধ, আমি যে রিকশায় যাচ্ছিলাম সেই রিকশা চালকের অবস্থা কি? তার কি বড় কোন ক্ষতি হয়েছে?

ঋদ্ধ জানালো, সে এ ব্যাপারে কিছু জানে না। তারপর প্রায় আঁতকে উঠে বলে উঠলো, ওহো তোমাকে তো একটি বিষয় জানাতে ভুলেই গেছি। মা, এক আংকেল এসেছিল। সেই আংকেল টা যার কথা তুমি আমাকে বলেছিলে। তোমার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায় অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করে এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। যাওয়ার সময় এই প্যাকেট টা দিয়ে গেছে। এই কথা বলে বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিল থেকে একটি প্যাকেট হাতে নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দিল ঋদ্ধ।

চমকে উঠলো দীপান্বিতা। তবে কি উনিই চলে এসেছে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে তাকে দেখতে, সেই সুদূর ঢাকা থেকে? যার উপর ভরসা করে সে এই অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করেছিল। যার যুক্তি আর অনুপ্রেরণা তাকে তার অর্গল ভাঙ্গার সাহস দেখিয়েছিল। কার কাছে তার দুর্ঘটনার খবর জানলেন উনি। আর কিভাবেই বা জানলেন যে আমি এখানে? একগাদা প্রশ্ন জেগে উঠলো তার মনে।

প্যাকেটটা হাতে নিয়েই দীপান্বিতা বুঝে গেলো যে এর ভেতরে কোন বই আছে। তবে কি সেই বইটি, যে বইটির কোথা সেই মানুষটি খুব বলতেন? দ্রুত হাতে প্যাকেটটা খুলে ফেললো। ঠিক তাই, সে যা ধারণা করেছিল। সেই বইটি, “মার্জিনে মন্তব্য”, লেখক সৈয়দ শামসুল হক। আর একটা খাম। খামটাও খুলল দীপান্বিতা। একটা চিঠি আর কিছু টাকা। বই, টাকা আর চিঠি দেখে চোখে জল এসে গেল দীপান্বিতার। আশ্চর্য মানুষ তো উনি এমন সময়েও ঠিক ঠিক তার প্রিয় জিনিসগুলোর কথা মনে রেখেছে। চিঠি পড়তে শুরু করলো দীপান্বিতা।

সে লিখেছে,

প্রিয় দীপা,

যাকে সামনাসামনি কখনও দেখা হয়নি তাকে প্রথমবার দেখার অজানা আনন্দে মনটা বিভোর ছিল সেই মধ্যরাত থেকে, তাকে যে হেমন্তের এই সন্ধ্যায় এভাবে এমন অসহায়ভাবে দেখতে হবে ভাবিনি। ট্রেনে উঠেই আমাকে ফোন দেয়ার কথা ছিল তোমার। তুমি জানিয়েছিলে, তোমার ট্রেন সকাল আটটায়। তাই সকাল সোয়া আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন ফোন পেলাম না তখন কেন যেন অজানা আশঙ্কায় মনটা দুলে উঠলো। তোমাকে ফোন করলাম, একবার, দুবার, ধরলে না তুমি। অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। আবার ফোন করলাম। এবার অপরিচিত লোক ফোন ধরল। তাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে হড়বড় করে তোমার দুর্ঘটনার কথা জানালো এবং বলল তারা তোমাকে একটি হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করতে ঐ লোকটি বলল যে তুমি অজ্ঞান অবস্থায় আছো আর তোমার মাথার পেছন থেকে একটু একটু রক্ত ঝরছে। কি যেন কি হারানোর আশঙ্কায় ফের জিজ্ঞেস করলাম তোমার পরিবারের কাউকে খবর দেয়া হয়েছে কিনা লোকটি জানালো যে, সে এ ব্যাপারে কিছু জানেনা। আমি লোকটির কাছে হসপিটালটার নাম জিজ্ঞেস করে ফোন কেটে দিলাম। ফোন কেটে দিয়েই তোমার স্বামীকে ফোন দিয়ে জানালাম যে তুমি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছ এবং এখন তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। উনি আতঙ্কে আঁতকে উঠলেন, আমার পরিচয় জানতে চাইলে পুনরায় ফোন কেটে দেয়ার আগে তাকে শুধু বললাম, প্লিজ, তাড়াতাড়ি হসপিটালে যান নয়তো দীপার বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। বাসার কাউকে কিছু না বলে তোমার জন্য যে বইটি কিনে রেখে দিয়েছিলাম সেটা, কিছু টাকা, আর আমার ব্যাবহারের কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাগে ভরে সোজা বাস ধরে তোমার এখানে। হসপিটালে পৌঁছে দেখি তোমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেবার পর ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। মাথা ছাড়া আর কোথাও তেমন চোট লাগেনি আর মাথার আঘাতটাও গুরুতর কিছু নয়। ভাবছ এত খবর কিভাবে পেলাম? রিসেপশন থেকে তোমার কেবিন নাম্বার সহ সবকিছু জেনে নিয়েছিলাম। জেনে নিয়েছিলাম ডিউটি ডাক্তার কোথায় বসে। ডিউটি ডাক্তার কে বলেছিলাম আমি তোমার আত্মীয়,আত্মীয় তো নাকি? ডিউটি ডাক্তার সব খবর জানালো। কেবিনে গিয়ে দেখি তোমার ছেলে মুখ অন্ধকার করে তোমার বিছানার পাশের চেয়ারে বসে আছে। তোমার স্বামীকে কোথাও দেখলাম না। তোমার ছেলের কাছে আমার পরিচয় দিলাম, দেখলাম ও আমাকে চেনে। হয়তো তুমিই আমাকে ওর কাছে পরিচিত করিয়ে রেখেছিলে।

সন্ধ্যার একটু আগেই আমি এখানে পৌঁছেছি। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হোল। তুমি ঘুমচ্ছ আর আমি লিখছি। আমার কাছে, তোমার অনেক দিনের আবদার ছিল আমি যেন তোমাকে একটি চিঠি লিখি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। আজ এই অবেলায় অসময়েই সেই সময়টা হয়ে গেল। হসপিটালের ক্যাফেটেরিয়ার এক কোনে বসে, মন খারাপ নিয়ে লিখছি। ভয় হচ্ছে এই ভেবে, দীর্ঘ দিনের লাঞ্ছনা গঞ্জনার ভেতর দিয়ে জন্ম নেয়া যে আত্মউপলব্ধি তোমার ভেতর পুরাতন, জীর্ণ অস্বাস্থ্যকর অর্গল ভাঙ্গার সাহস দেখিয়েছিল, এই আঘাত তোমাকে সেই চেতনা থেকে বিচ্যুত করবে কিনা, থাকবে কিনা চারিত্রিক সেই দৃঢ়তা যা তুমি আমাকে বিভিন্ন সময় জানিয়েছিলে। দীপা, তোমার এই আত্মউপলব্ধিজাত চেতনা ও দৃঢ়তাই যে তোমার কাঙ্ক্ষিত আগামীর গড়ে তোলার মূল শক্তি, তা কি তুমি জান? আজকের এই আঘাতের মানসিক ও শারীরিক দখল পার হয়ে তুমি কি পারবে তোমার স্বপ্নের আগামীর জন্য পুনরায় যাত্রা করার সাহস দেখাতে। কে জানে। পারাটাই উচিৎ, কিন্তু এটাও তো সত্য কত উচিৎই আমাদের আর করা হয়ে উঠে না। যে কোন অর্গল ভাঙ্গা যে সত্যি কঠিন দীপা, সত্যি কঠিন ...। তোমাকে দেব দেব বলে অনেক দিন ধরে যে বইটি আমি তোমার জন্য আগলে রেখেছি সেই বইটি আজ তোমাকে দিয়ে গেলাম, সঙ্গে কিছু টাকা, হয়তো তোমার কাজে লাগবে। খরচ করতে সংকোচ বোধ করো না। প্রয়োজনে আয় করে দিয়ে দিবে, কি বল? একটু আগেই আবার দেখে এলাম তুমি এখনো ঘুমচ্ছ, ঘুমোও। তোমার সত্যি একটি লম্বা ঘুম দরকার।

আমি রাতের ট্রেনেই ফিরে যাব। সারা রাস্তায় এই ভাবতে ভাবতে যাব যে তুমি তোমার সব অর্গল ভেঙে ঠিকই একদিন বেরিয়ে আসবে। হয়তো, এমনি সারা রাত কোন এক ট্রেনের কোন একটি কেবিনে কোন এক সুদূর অজানা যাত্রায় আমরা একজন আরেকজনকে আরও গভীরভাবে জানার সুযোগ পাব। সেই অপেক্ষায় রইলাম। আজ এই পর্যন্তই। ভালো থাকার চেষ্টা কর।

ইতি

সুহৃদ

চিঠি পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো দীপান্বিতা। ঋদ্ধ জিজ্ঞেস করলো, মা তোমার কি খারাপ লাগছে। কোন উত্তর দিল না দীপান্বিতা, বলল আমাকে ধরে একটু বারান্দায় নিয়ে যাবি বাবা। ঋদ্ধ একটু অবাক হলেও কিছু না বলে বলল, ঠিক আছে ওঠো, তোমাকে ধরছি আমি। বিছানা থেকে নেমে, ঋদ্ধর হাত ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল দীপান্বিতা। রাত কটা বাজলো? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো সে। তার ট্রেন কি শহর ছেড়ে চলে গেছে? হসপিটালের পেছনের দিক দেখা যাচ্ছে বারান্দা দিয়ে। একটু দুরেই ফসলের মাঠ। বাইরে কি আজ জ্যোৎস্না নাকি। অগ্রাহায়ন মাসের কয় তারিখ আজ? পূর্ণিমা নিশ্চয় নয়। আলো আঁধারি পরিবেশ চারপাশে। হটাৎ বিপ বিপ শব্দে বেজে উঠলো বিছানার উপর মোবাইলটা। ঋদ্ধ কে মোবাইলটা আনতে বলল দীপান্বিতা। ঋদ্ধ বিছানা থেকে মোবাইলটা এনে মার হাতে দিল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঋদ্ধ কে ঘরে যেতে বলল দীপান্বিতা। ঋদ্ধ ঘরে চলে গেল। মেসেজটা পড়তে শুরু করলো সে। মেসেজে লেখা আছে... কিছুক্ষণ আগেই তোমার শহর ছেড়ে আমার শহরের দিকে যাত্রা করেছে ট্রেনটা। এখন প্রায় মধ্যরাত, বাইরে কেমন অস্পষ্ট জ্যোৎস্না। তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। একটি ফলন্ত ফসলের মাঠের বুক চিরে আমাদের ট্রেনটি ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। আমদের দুজনের কি কোন গন্তব্য আছে, দীপা...

কলিং বেল বেজে উঠল। কেবিনের দরজা খুলে দিল ঋদ্ধ। ঘরে ঢুকল ঋদ্ধর বাবা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দীপাকে বারান্দায় দেখে, শিরিষ কাগজের মত শুষ্ক ও ধারালো কণ্ঠে বলে উঠলো, ওখানে কি করছ দীপা, ঘরে এসো শরীর খারাপ করবে। চোখ মুছে ফের বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো দীপান্বিতা ঢুকে পড়ল রুমে।

ছোটগল্প - সর্বজিৎ সরকার

1 কমেন্টস্


অদ্ভুদ মৃত্যুর পর
সর্বজিৎ সরকার


পাড়ার প্রতিবেশী অমলেশ চাটুজ্জ্যের মৃত্যুটা কিভাবে হল সেটা জানে না কেউ।কিন্তু মৃত্যুটা যে স্বাভাবিক নয়,তা বোঝা গেছিল মৃতের শরীরে কিছু অদ্ভুদ দাগ দেখার পর।সেদিন রাত বারোটা চল্লিশ নাগাদ সারা পাড়াজুড়ে একটা প্রবল ভয় মিশ্রিত চিৎকার ঘুরে ফিরে যায়।অমাবস্যার সেই রাত্রে যখন সবাই তার দেহ নিয়ে রওনা দিল শ্মশানের পথে,তখন এক ভয়াবহ ঝড়ের মুখোমুখি হল তারা।সেি বিশাল ঝড়ে শ্মশানের সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়...দেহ ফেলে পালায় শ্মশানযাত্রীরা!আল্লারাখা শুধু সেই দেহ ফেলে যায়নি কোথাও!কিন্তু তারপর দিন থেকে আর কেউ আল্লারাখার খোঁজ পায়নি!দেহটার ও কোনোরকম হদিশ মেলেনি।

রোজ রাত্রে অমলেশ বাবুর বাড়িতে গেলাসের ঠোকাঠুকি শোনা যায়।ঠুমরীর সুর আসে ভেসে ওই বাড়িটা থেকে।বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে আছে কিছুদিন...সন্ধ্যে হলে ওই বাড়ির সামনে কেউ পা বাড়ায় না!যেদিন আল্লারাখা নিরুদ্দেশ হ্ল,সেই সময়টা চলছিল রমজান মাস।এই পাড়াতেই বাড়ি আল্লারাখার।অমলেশ বাবুর সাথে ভালই সখ্যতা ছিল তার।মাঝে টাকা পয়সা নিয়ে একটু বচসা অবশ্য হয়েছিল তাদের!অমলেশ বাবুর ধারদেনা ছিল প্রচুর...কিন্তু তার মৃত্যুর কোনোরকম কিনারা করা গেল না,আল্লারাখার নিরুদ্দেশ হওয়ার ও!

আজ সেই বাড়ি পাড়ার অন্যতম ভূতবাড়ি নামেই পরিচিত।রাত্তিরে নাকি বাড়ির আশেপাশে আতরের গন্ধ ছড়ায়।ভোরের দিকে আজান শোনা যায়,আবার নানারকম নবাবী সুর ভাসে বাড়ির আনাচে কানাচে!কেউ বুঝে উঠতে পারে না এই অদ্ভুদ ধরনের ঘটনার পেছনের রহস্যটার কথা।কেন ঘটছে এসব হিন্দুবাড়িতে!ঠাওর করতে পারে না কেউ!

পাড়ার কিছু মানুষ ঠিক করে ওঝা এনে ভূত তাড়াবার।অমাবস্যার রাতে যখন যজ্ঞে ঝাঁড়ফুক শুরু হ্য়,তখন সে উন্মত্ততা যেন বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে!কোনো লাভ হয়নি এসব তন্ত্রসাধনায়!কিন্তু পাড়ার সবাইকেই আল্লারাখার নিরুদ্দেশ বড় ভাবিয়ে তোলে!এরকমভাবেই চলতে থাকে ভূতবাড়ির অন্দরমহলের নানা ঘটনা,যার টুকরো উচ্ছিষ্ট পাড়ার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে!

একদিন সবে সন্ধ্যে হয়েছে!হঠাৎ লোডশেডিং এ সারা পাড়া অন্ধকার হয়ে যায়।পূর্ণিমার আলো পড়ে ভূতবাড়ি বেশ আলোময় হয়ে উঠেছে।পাড়ার কিছু মানুষ দেখতে পেল আল্লারাখার মতো কেউ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসে শ্মশানের রাস্তা বরাবর হাঁটা শুরু করেছে!পাড়াপড়শি অনেকবার ডাক দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি।কেউ সামনে এগিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়াবার সাহসটুকুও দেখায় নি।এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানের কাছে গিয়ে সে যেন কোথাও মিলিয়ে গেল!সবাই বেশ ভয়,আতঙ্ক নিয়ে বাড়ি ফিরেছে;চারিদিকে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে!

কিছুদিন হল ভূতবাড়ির উগ্রতা বেশ ম্লান,প্রায় থেমেই গেছে বলা চলে।একদিন সকালে কিছু মানুষ সাহস নিয়ে সেই বাড়ির ভেতর গিয়ে ঢোকে।চারদিক খুঁজে কিছু না পেয়ে যখন সিঁড়িঘরের সামনে আসে,তখন হঠাৎ তাকিয়ে দেখে অমলেশ বাবুর দেহটা পড়ে আছে মাটিতে!অদ্ভুদভাবে কোনো পচন ধরেনি...সেদিনের মতোই নিথর!চমকে ওঠে সকলে...বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থকে কিছুক্ষণ!অবশেষে তারা ঠিক করে দেহটা কবর দিয়ে দেবে ওই বাড়িতেই।কথামতো সব ব্যবস্হা হয়...কাজটাও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়!

তারপর থেকে সব শান্ত...কিন্তু আল্লারাখার সেই সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ করে উদয় হওয়া,আর তারপরেই শ্মশানের দিকে গিয়ে কর্পূরের মতো উবে যাওয়ার কারণ কেউ খুঁজে পায়নি!কেবল তার গলার লকেটটা অদ্ভুদভাবে মিলেছিল অমলেশ বাবুর বাড়ির উঠোনে!
...আজও রাত্তির হলেই গা ছমছম করে সেই বাড়ির আশেপাশে...সেই বাড়ি আজ এত শান্ত..নিস্তব্ধ..চুপচাপ বলেই!

ছোটগল্প - ইন্দ্রজিৎ চ্যাটার্জী

1 কমেন্টস্


উৎসব - বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে
ইন্দ্রজিৎ চ্যাটার্জী


১)
একরাশ কাশ ফুটেছে নেত্রাবতি নদীর পাড়ে। শেষ বর্ষার ঘোলাজলে দাঁড়িয়ে অনল ঐ কাশের সারিতেই খুঁজতে থাকে তার রূপসী বাংলাকে। তার কানে যেন বেজে ওঠে অষ্টমীর ঢাক।

মুম্বাই থেকে আগ্রার দিকে দৌড়ে যাওয়া হাইওয়েটা এখানে একটু থমকে আছে। নাসিক শহরের থেকে অনেকটা দূরে নেত্রাবতি নদীর ওপর নতুন সেতু তৈরির কাজটা শেষ হলে, ভারতবর্ষ আরও গতি পাবে। সেই সেতুবন্ধের কাজেই কন্সট্রাকশন কোম্পানি কলকাতার এই তরুন ইঞ্জিনিয়ার অনলকে এনে ফেলেছে।

ক্যেলেন্ডারে অক্টোবর। অথচ এখানে দশেরা ছাড়া ছুটি নেই। সপ্তাহে সাত দিনই পাথর- সিমেন্ট- স্টিলের বাঁধুনি শক্ত করার কঠিন ব্রতে লেগে থাকা। এখানে পুজোর গন্ধ নেই, আলো নেই, বাজনা নেই। নেই সপ্তমীর কলাবৌ, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধি পুজোর আরতি। নেই পায়ে পায়ে হাতিবাগান থেকে কলেজ স্কোয়ার আর বাবুবাগান থেকে মুদিয়ালি। নেই পুজো পরিক্রমার অনন্ত আনন্দের ফাঁকে রাতজাগা চোখে কোনও কিশোরীর রিদয়-মিশাইলের আকস্মিক আক্রমন।

বাস্তবে ফিরে আসে অনল। আঙুর আর বাজরার খেতের সীমানা পেরিয়ে কংক্রিটের পিলার উঠছে। মেধা আর শ্রমের নিপুণ সমন্বয়ে মাথা তুলছে নতুন ভারতবর্ষ। অনলের মনে পড়ে, "...জয়ং দেহি, যশ দেহি...।। "

২)
যোশীমঠের এক চায়ের দোকানে দেখা বরুনের সঙ্গে। সেলফোনে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার সময়েই হয়তো আমার বঙ্গভাষণ শুনেছিল। কাজেই দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারি ভ্যান থেকে এগিয়ে এসে আলাপ জমালো জলপাই উর্দি পরা যুবক। রানাঘাটে বাড়ি ওর। অন্য কোনও চাক্রির সুজগ-সুবিধে না হওয়ায় অ্যাথালিট বরুন একদিন ভারতীয় সৈন্যদলে নাম লিখিয়েছিল। তারপর বছর সাতেক এদিক-ওদিক ঘুরে এখন বদ্রিনাথ থেকে ৩ কি.মি দূরে মানাগ্রামে ওর ক্যাম্প। বাবা-মা-বন্ধু-পরিজন ছেড়ে বাংলার ছেলে আজ ভারতবর্ষকে রক্ষা করার দৃঢ় ব্রতে অটল।

মিষ্টিমধুর তানে সুর তুলে নীচে বয়ে যাচ্ছিল অলকানন্দা নদী। আর সেদিকে তাকিয়েই বরুন বলছিল, " জানেন, শুধু পুজোর সময় এলেই মনটা কেমন হয়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙালি টুরিস্ট দেখি এই যোশীমঠ আর বদ্রির পথে। আর আমি ভাবি, রানাঘাটে আমাদের ফুটবল মাঠের কোনে রঙিন কাপড়ের ঘেরাটোপে পাঁচদিনের আনন্দ জেগে উঠছে। শুধু আমিই সেখানে নেই। আমাদের সাবেকী দুর্গাপ্রতিমার সামনে ভোগদানের পর দুপুরে যখন একসাথে ওরা সবাই খেতে বসবে, হুল্লোড় করবে কিম্বা নবমীর রাতে মেতে উঠবে ধুনুচি নাচের তালে, আমাকে কি মনে পড়বে? এখানকার এই বরফ হিম হাওয়ায় ইন্দ্রিয় সজাগ রাখার নিত্য অনুশীলনের মাঝেও বরুনের মন যেন ঐ কটা দিন ওর মফস্বলি শহরের যাবতীয় উৎসবেই ফিরে যায় বারবার। মিলিটারি ভ্যানটায় ফিরে যাবার আগে বলে, "বাবা-কাকাকে তো পাবনা। বিজয়ার একটা এডভান্স প্রনাম আপ্নাকেই সেরে নিই।" আমি তাড়াতাড়ি বুকে টেনে নিই ভারতবর্ষের এই অতন্দ্র প্রহরীকে।

৩)
" শুক্তো তো আছেই, আজ আলু-পোস্তও হয়েছে। নেবেন তো?" টেবিলে ভাতের থালা এগিয়ে দিতে দিতে রবি বলে।
চেন্নাই এগমোর স্টেশনের কাছেই এই হোটেলটা বাঙালি খাদ্যরসিকদের খুব প্রিয়। কাজের ফাঁকে মধ্যান্যভোজ সারতে এসে এখানেই বাঁকুড়ার জয়ক্রিস্নপুরের রবীন্দ্রনাথ বাগের সাথে আলাপ। তবে হোটেল বয়ের নাম তো আর রবীন্দ্রনাথ হয়না; তাই লোকমুখে রবি।

" কি রবি? পুজোয় দেশে যাচ্ছ তো? " প্রশ্ন শুনেই রবির চোখ গোলগোল হয়ে যায়। ডাল- শুক্তো- মাছ- চাটনির গামলা পেরিয়ে ওর মন হাঁটা লাগিয়েছে রাঢ় বাংলায়। সেখানে চক্রবর্তীদের ভাঙা দালানে ওদের পাড়ার একমাত্র দুর্গাঠাকুর রাংতার সাজে অপরূপা; নতুন ফ্রক, চুড়িদার আর শাড়ীর সাজে গ্রামের লক্ষ্মী-সরস্বতীরা কেমন অচেনা; শিউলিফুলের গন্ধে ম ম করছে মণ্ডলদের পুকুরপাড়, সোনাদি আর নতুন বৌঠান কত যত্ন করে নারকেল নাড়ু গড়ছে নৈবিদ্যে সাজাবে বলে; ধুপ- ধুনো- ঢাক- ঢোলের চারদিন পার করে দ্বারকেস্বর নদের বুকে দুর্গতিনাশিনীর আবার ফিরে যাওয়া।

নাঃ, গত দু'বছরের মতো এবারেও পুজোয় বাড়ি ফিরবেনা রবি। একজন চেনা লোকের হাতে মা আর বোনের নতুন শাড়ি কেনার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। আর এখন আবার টাকা জমাছছে সামনের বছর বোনটার বিয়ে দেবে বলে। পুজোর ছুটিতে চেন্নাই শহরেও অনেক টুরিস্ট। তাই, টিপস এর টাকাও মন্দ জম্বে না ।

চিরন্তন ভারতবর্ষে ভাইয়ের দায়িত্ববোধ কি কম !!


৪)
পুজো এসে গেছে। ঢাক- ঢোল- কাঁসির সমবেত বাদ্যে জেগে উঠছে আমার বাংলা। জ্বলে উঠছে একশো আট প্রদীপের ঝাড়। আমার মহানগরী কত সহস্র মানুষকে আপন করে কাছে টেনে নিয়েছে উৎসবের রঙ চেনাবে বলে। আবালবৃদ্ধবনিতা পায়ে পায়ে মিশে যাচ্ছে সেই আলোর উৎসবে। আর এই অপূর্ব মায়াবী আলো থেকে বহুদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কতসব অনল, বরুন আর রবি। চোখ বুজলেই তারা দেখছে, প্রানের উৎসব থেকে বহুদূরে উড়ে যাচ্ছে এক নীলকণ্ঠ পাখি ।।

ছোটগল্প - অলভ্য ঘোষ

0 কমেন্টস্
স্বপ্ন
অলভ্য ঘোষ


একটা কাঠঠোকরা পাখি সাত রঙ্গের ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল সায়ক গাছটার কাছে যেতেই ; তার ডানা থেকে একটা পালক খসে পড়ে তখনো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সায়কের মুখের সামনে থেকে পড়লো মাটিতে । সায়ক সেটা হাতে তুলে চোখ বন্ধকরে গালে বুলল । চোখ বন্ধ অবস্থায় সায়কের মনে হল আকাশে রামধনু আকাশ ছেড়ে তার পায়ের কাছে যেন এক মহাসমুদ্র নির্মাণ করেছে । তার পর সেই রং ধার করে বৃহৎ-সুন্দরী গাছটার আশেপাশের চাতাল জুড়ে অপরিচিত সব অপূর্ব ফুলের বাগিচায় ঢেকে গেল মুহূর্তে । হরেক রংয়ের প্রজাপতিদের ঢল নামলো নিমিষে । বৃষ্টির মতো তারা ফুলের ওপর ঝরে পড়লো । কয়েকটা সায়কের মাথায় বুকে উড়ে এসে বসতে ভুল করলো না । সায়কের একবার হৃদপিণ্ডের কাছাকাছি বসা প্রজাপতিটাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করার ইচ্ছে হল ; পরক্ষনেই মনে হল যে তার মনের এত কাছাকাছি এসে ধরা দিয়েছে হাত দিয়ে ধরতে গিয়ে যদি সে উড়ে যায় ।ওরা জানে মানুষ ফুল ছেরে গাছ কাটে , পশুদের কাছে এমন ভয় নেই । লোভ সংবরণ করে প্রাপ্তি টুকুতেই যখন আনন্দ পাচ্ছিল সায়ক ; হটাৎ একটা ঠাণ্ডা নরম স্পর্শ সে তার পায়ের ওপর অনুভব করে । সাপের গা ঠাণ্ডা হয় ; আর বাগানে সেটি থাকা কিছু অসম্ভব নয় । সাপ অনুমানেই সায়ক চোখ খুলে দেখল ওটা একটা গিরগিটি ।করাতের খাঁজ কাটা পিট , ডায়নোসার মতো দেখতে বড় গিরগিটিটা শুকনো পাতার ওপর থেকে করমর শব্দ তুলে ঘার ঘুরিয়ে সায়কের দিকে দেখতে দেখতে গাছটার আড়ালে পালায় । সায়ক চোখ খুলে কিছুটা হতাশ হয়ে ছিল ফুলের বাগিচার বদলে শুকনো পাতার আবর্জনায় প্রজাপতিদের সমারোহের বদলে এই গিরগিটিটাকে আবিষ্কার করে । তবে সে রুক্ষতা কাটিয়ে পরিবেশের সাথে রং মিলিয়ে মিলিয়ে সায়ক আর প্রকৃতির সাথে লুকোচুরি খেলা বহুরূপী গিরগিটি টাকে সায়কের এবার বেশ ভাল লাগে । গিরগিটি টাকে যখন আর গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ায় দেখা যাচ্ছিলো না তখন সায়ক সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতে গেলে একটা কাঠবেরালি তার সামনে দিয়ে ছুটে পালায় । সেযেন বলে ;
- বাঁচতে চাও তো পালাও এখান দিয়ে ।
সায়কের মনে হল এ তার শোনার ভুল । সে জানে ডারউইনের তথ্য ; বাঁচতে হলে এ পৃথিবীতে পালানো চলেনা লড়তে হয় ।যে লড়ে সেই বাঁচে । যে লড়তে জানে না সে বাঁচতেও জানেনা । মৃত্যু এখানে ছায়ার মতো মানুষের পিছু ধাওয়া করে আর মানুষ সম্মুখ সমরে তাকে বারবার পরাস্ত করে জীবনকে রাজ মুকুট পড়ায় । পিছু পালালেও যখন মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই নেই বুদ্ধিমানের কাজ মৃত্যুকে বরন করে তার মোকাবিলা করা । মাথায় চড়িয়ে তাকে শাসন করতে না দিয়ে পোষা কুকুরের মতো বস করা ।গাছের পেছনে গিয়ে সে দেখল গাছের গায়ে একটা বিশাল গর্ত আর সেই গর্তের গা বেয়ে সাড়ি সাড়ি লাল কাঠ পিঁপড়ে মুখে করে ডিম নিয়ে উদ্বাস্তুদের মতো দেশান্তরিত হচ্ছে । সায়ক মনে মনে যেন তাদের জিজ্ঞেস করলো ;
- কোথায় চললে তোমরা ?
তারা যেন চি চি করে বলল ;
- এক স্বপ্ন-পুরীতে । ভারি সুন্দর স্বপ্নের মত সে জায়গা ।
সায়ক বলল ;
- সেখানে কী কী রং আছে ?
তারা বলল ;
- হরেক । শুধু দেখার মতো চোখ চাই ।
সায়কের মনে হল পিঁপড়ের সাথে কথোপকথন শোনার কান ও অনেকের থাকে না । তারা চেনা বন্ধুদের
অনেকের মুখ তার মনে পড়লো ; বধির আড়ষ্ট সেই পাথরের মতো মুখ গুলোর ওপর সায়ক দেখল
ঝলসে চলেছে নানা ভি ডি ও গেমের আলো আঁধারি । যখন মেশিন গানের আওয়াজ ; বাইকের রেস ;
থ্রিলার মিউজিকের ককটেল সায়কের শিরা উপশিরা বেয়ে চৈতন্যকে তার বন্ধুদের মতো বসকরে নিচ্ছিল ;
সায়ক কানে হাত চাপাদিয়ে চোখ বন্ধ করেনিল । সমস্ত আওয়াজ ঢাকা পড়ে গিয়ে একটা নিস্তব্ধতা
নেমে এলো সমস্ত চরাচরে । ধীর স্থির ধ্যান ভাঙ্গা ঋষির মতো সায়ক চোখ খুলে তাকাল বুড় গাছটার
প্রকাণ্ড কাণ্ডের গায়ে ক্ষোদিত বিশাল আকার গর্তটার দিকে । সে দেখল পিঁপড়েদের মিছিল শেষ হয়ে
গিয়েছে । হরেক রং - হরেক সাদ সায়কও পেতে চায় স্পর্শ ,গন্ধ , অনুভবে হৃদয়ের চোখ দিয়ে ; মস্তিষ্কের
বুদ্ধি-দিয়ে ; এই মহাবিশ্বের তিলবৎ সৌন্দর্য ও যেন তার দৃষ্টির অগোচরে গিয়ে চেতনাকে অভিষিক্ত করতে ভুলে
না যায় । তাই সায়ক স্বপ্ন-পুরি এক স্বপ্নের রাজত্বে যাবার উদ্দেশ্যে বড় গর্তটার কাছে এগিয়ে গেল । সায়ক দেখতে পেল বড় গর্তটার গা বেয়ে বৃহৎ গাছটার কাণ্ডের ভেতর একটা সিঁড়ি পথ অন্ধকার গুহার প্রবেশ দারের মতো এগিয়ে চলেছে ভূপৃষ্ঠের কেন্দ্রের দিকে । মশালের মতো জোনাকির আলো তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল । পথে সায়ক দেখতে পেল সিঁড়ির অনেকটা দূরে সেই গিরগিটি টাকে । তার কিছু পেছনে পিঁপড়ের মিছিল টা এগিয়ে চলেছে সায়ক বুঝল সকলেই চলেছে ওই স্বপ্নের রাজ্যের দিকে । হটাৎ অন্ধকারে ওৎপেতে বসে থাকা একটা পেঁচা উড়ে এসে গিরগিটি টায় ছোঁ মারে ; ধরে নিয়ে চলে যায় । কয়েক টা বাদুর ফরফর করে উড়ে চলে যায় সায়কের মাথার ওপর দিয়ে বিকট আওয়াজ করে । পিঁপড়ে গুলো মিছিল ভেঙ্গে ছোটা ছুটি করে । সায়ক প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও নিজেকে সংযত করে। সে জানে ভয়কে প্রশ্রয় না দিয়ে জয় করতে হয় । না হলে ভয়ের আসংখ্যায় জীবের অনেক মূল্যবান কার্য অধরা থেকে যায় ।দূরে সিঁড়ির শেষে সায়ক দেখতে পেল আলোক সাগরের ঢেউ । অসম্ভব রোমাঞ্চ নিয়ে যখন সায়ক সিঁড়ির কিনারায় গিয়ে পৌঁছল
সিঁড়ির ওপর বসে আকাশ থেকে পৃথিবী দেখার মতো দেখল একটা নতুন দেশকে মাকড়সার জালে বেষ্টিত সিঁড়ির শেষ প্রান্তের গহ্বর মুখ থেকে।
এখানে নাগরিক সভ্যতার ধূয়া -গ্যাস ,গাড়ি- ঘোড়া , বড় বড় বিল্ডিং , লাইট পোস্ট ,ফ্লাইওভার, কারখানার চিমনি কিংবা ওয়ারলেস-টি.ভি অথবা টেলিফোনের টাওয়ার নিদেন পক্ষে খাবার জলের উঁচু ট্যাঙ্ক কিছুই দেখা গেল না । দেখা গেল শুধু একটা সমুদ্র আর রাশি রাশি ফুল আর ফলের বাগান সমুদ্র তটে । সে সব বাগানে কাজকরা মানুষ গুলোকে ওপর থেকে পিঁপড়ের মতো দেখাল সায়কের চোখে । এদিকে
সেই মিছিলের লাল কাট পিঁপড়ে গুলো সিঁড়ির শেষের এই মাকড়সার জালে আটকে চটপট করছিল বেশির ভাগের মুখ থেকে ডিম গুলো খসে পড়েছিল সমুদ্রের জলে । এটুকু ভেবে পিঁপড়েরা আস্বস্হ ছিল তারা সে সুন্দর দেশে পৌঁছাতে না পাড়লেও তার ছানারা পাবে এক সুন্দর পৃথিবীর সাদ । সায়ক ভাবে যে জাল থেকে একটা পিঁপড়েও গলতে পারেনা সেই মিহি জাল টপকে সেও বা সে দেশে যাবে কিকরে । মাকড়সার
জালের ফাঁক থেকে সে আবার দেশটাকে দেখে ; সমুদ্রের বুকে বড় বড় জাহাজ ভাসছে না । ছোট একটা ডিঙ্গির ও দেখা মেলা ভার । শুধু রূপোর মতো চিকচিক করা কূল কিনারা হীন জলরাশি যেন জ্ঞান গর্ভ গভীরতা বুকে ধরে অপেক্ষা করছে কোন এক দেব দূতের যে এসে ডুব সাতরে তার গভীরতায় পৌঁছে সঞ্চয় করবে জ্ঞানের মণিমাণিক্য । কিন্তু সে দেবদূত কোথায় ? অনেক টা ঝুঁকে অনেক ওপর থেকে সায়ক সেই দেব দূতের সন্ধান করতে করতে হটাৎ হরকে পড়লো মাকড়সার জালে । বোধয় সায়ক কে দেখেই মাকড়সা টা কোথাও কাছাকাছি লুকিয়ে পরেছিল । সে জালে জড়িয়ে পড়তেই লোমশ বড় বড় ঠ্যাং গুলো নিয়ে সে জাল বেয়ে সায়কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । মুখ দিয়ে জাল বুনে সায়কের হাত পা বেঁধে ফেলার চেষ্টা করলো সায়ক যখন হাতপা ছুড়ে তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল সহায় হল সরবো হারা পিঁপড়ে গুলো । তারা মরণকামড় দিয়ে বসলো মাকড়সার সারা দেহে । সায়ক সুযোগ বুঝে হাতদিয়ে মাকড়সার জাল ছিঁড়তে লাগলো সে জাল এতো মজবুত আর মায়াবী কষ্ট করে ছিঁড়লেও সাথে সাথে জোড়া লেগে যায় । অনেক কষ্টে জালে একটা বড় ছিদ্র বানিয়ে সেখান থেকে সায়ক মহাকাশচারীর পৃথিবীতে ফিরে আসার মতো টুপ করে ঝরে পরে সমুদ্রের জলে । অনেক ওপর থেকে পড়ায় সমুদ্রের অনেকটা গভীরে চলে যায় সায়ক । সমুদ্রের তলায় কোরালের নগরের ওপরে মাছদের ঝাঁক যুদ্ধের এরোপ্লেনের মতো পাক খাচ্ছিল । সায়ককে দেখে একটা অক্টোপাস সড়ে গেলে কোরালের ওপর রাখা তার পেটের তলায় একটা নীল জ্ঞান নীলায় সূর্যের আলো পরে নীল শিখায় জলের ওপর প্রতিফলিত হয়ে পড়ে । ডুবুরির মতো ডুবসাঁতারে সেটার কাছে গিয়ে সায়ক সেটা সংগ্রহ করে । নীলা টা হাতে তুলে নেবার সময় জেলির মতো একটা চটচটে পদার্থ কোরালের গা থেকে তার হাতে সে অনুভব করে ।
তার তালু বদ্ধ নীলা টা সায়কের যেন মনে হল কথা বলছে ।
- আমায় সঞ্চয় করে তোমার কী লাভ ?
সায়ক বলে ;
- বা জ্ঞান অর্জন করতে কে না চায় ।
নীলা বলে ;
- সে তুমি করেছো । অনুসন্ধান করতে করতে তুমি আমার এতো কাছে পৌঁছে আমার সম্পর্কে সমস্ত কিছু জেনে নিয়েছ । আমার বাহ্যিক নীল শরীর টা সঞ্চয় না করলেই নয় । জ্ঞান তো মগজে সঞ্চিত ;টেকে সম্পদ সঞ্চয় করে কী লাভ । আমার জন্য ; চোরে সিঁদ কাটবে , ডাকাতে তোমায় লুট করবে ,
লোভী প্রতিবেশী বা নিকট আত্মীয় তোমাকে ঠকাবে , প্রিয় বন্ধু বিশ্বাস ঘাতকতা করবে । এই সবকিছুই যখন একটা পাথরের টুকরোর জন্য তা হলে সেটা বর্জন করনা কেন বাপু । যে সম্পদ মানুষে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট করে জানি না তোমরা মানুষের সে সম্পদ অধিকারে কী লাভ পাও ।তোমার অন্তরে সিঁদকাটার
কিংবা মস্তিষ্কে ডাকাতি করার সাধ্যি কার নেই । চুরি ডাকাতি দুরের কথা তোমার মনের মনি মাণিক্য যদি বিশ্বাস ঘাতকতা করেও কেউ নিতে চায় ধরা পরে যাবে । সায়কের মনে হল সে নতুন কত কিছু শিখল । যা তার পড়ার বইয়ের কোথাও লেখানেই । নীলাকে ধন্যবাদ জানাবে বলে সে যেই না হাতের মুঠো খুলল
দেখল শুধু তার হাতের মধ্যে একরাশ বুজ-বুজ সমুদ্রের ফেনার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে । সায়ক হতাশ হল না বুঝল কোনকিছুর প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির চেয়ে বড় ভেবে দেখা সেটা আদপে কতটা জীবনের প্রয়োজনীয় । সে ডুবুরির মতো যখন ওপরে ভেসে উটতে লাগলো দীর্ঘায়ু একটা কচ্ছপ তার পাশ থেকে ভেসে গেল । খরগোসের
সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় কচ্ছপের জেতার গল্প সকলে জানে ; কচ্ছপের মন্থরতা সম্পর্কে অভিযোগ সর্বজন অবিদিত । তবে এই উভয় চর টি এখন তার সম্পর্কিত সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করে সাঁ সাঁ করে সায়কের সামনে থেকে ডাঙ্গার দিকে ভেসে চলল । যাবার সময় সে যেন সায়কের কানে কানে বলে গেল ;
-সময়ের সাথে তাল-মিলিয়ে গতিশীল হয়েছি আমরা । বলতে পারো এটা আমাদের অভিযোজন ।
সায়ক বলে ;ধীরে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে সে চলে । লম্বা দৌড় জিততে হলে দম সঞ্চয় করা খুব জরুরি ।
সায়ক যে অভ্রান্ত প্রমাণিত হল মাঝপথে কচ্ছপকে হাঁপিয়ে হাবুডুবু খেতে দেখে । লুকিয়ে পড়া লাল ক্যাঁকরা দের গর্তের পাশে সায়ক যখন পারে উঠে বালুকা তটে এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে বেশ কিছুটা সতেজ হয়ে উঠে সে দেশ দেখতে যাবার উপক্রম করছিল । কচ্ছপ টা পারে পৌঁছায় ।
সায়ক বলে ;
- জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই কিন্তু জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার ; তোমার আয়ু তিনশো বছরের কতকিছু শিখবে বলো দেখি ।
এমুহূর্তে সেই কচ্ছপ যে কি শিক্ষা পেল হাঁপিয়ে উঠে সে কিছুই বলতে পারলো না ; হা করে শুধু সমুদ্র পারের বাতাস নিতে থাকলো । তখনি একটা অতভূত বাঁশির সুর দূরে কোথায় বেজে উঠলো । সেই বাঁশির সুরের মূর্ছনায় মোহিত হয়ে শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে সায়ক এগিয়ে চলল নতুন দেশের সুর সাগরের দিকে । সাগর য়ই বটে ; সমুদ্রের চড়ার বড় বাঁকটা পেরতেই বাঁশির সুরটা অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের কনসাটে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল । যা সে আগে কোন দিন শোনেনি । সায়ক যখন বিচিত্র সুরের বাদ্য যন্ত্রের উৎস স্থলে গিয়ে পৌঁছল দেখল সে এক মহা মিলন সমারোহ । আমাদের দোতারা , বীণা , সন্তুর তো আছেই; সাথে আছে প্যরাগুয়ান বীণা , জাপানি কোটো ,ত্রিনিদাদের ইস্পাত চাটু ,চীনা ইয়ানজিকিন , অস্ট্রেলিয়ান ডিডজেরিডোও আর কতকি ।বিভিন্ন বর্ণের ; বিভিন্ন পোশাকের ; নানা রকম বাদ্যযন্ত্র ধারী একদল লোক ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে এই মিলন মেলায় তাদের ভাবের আদান প্রদান করছে সুরের মাধ্যমে । আনন্দের সুরে প্রত্যেকে নাচছে ; আবার করুন সুরে সকলে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠছে । বিষণ্ণতা হতাশার সুর কার কাছে আশার হতে পারে না । সায়ক এই প্রথম বুঝল একমাত্র সুরের একটা সার্বজনীন ভাষা আছে । যেমন চিত্র
দেখে আমার চিত্রকারের মনের ভাব বুঝি আমাদের সাথে চিত্রকারের মনের সংযোগ ও জারণে সংমিশ্রণ হয় । সঙ্গীতেও এ শক্তি বিদ্যমান । সঙ্গীতে যদি বিদেশী ভাষার ব্যাবহার থাকে আর আমরা যদি সে ভাষা নাও জানি এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না সেটা আমার কোন ভাবকে জাগিয়ে তুলছে ভালবাসার না ঘৃণার । আসলে মানুষের কয়েক টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য জাতি -ধর্ম-বর্ণ ; দেশ -কাল-পাত্র নির্বিশেষে এক । যেমন জাতীয়তা বোধ বা দেশপ্রেম । আর সেই বৈশিষ্ট্য গুলোই মনে অধিক আলোড়ন ঘটালে সুরের মূর্ছনায় তার বহি প্রকাশ ঘটে । সঙ্গীত হয়ে ওঠে সকলের । অতি বড় নিষ্ঠুর ব্যক্তিও গান শুনে কানে হাত চাপা দেয়না । সায়ক যখন সুরের মূর্ছনায় আপ্লুত হয়ে উঠেছিল সুযোগ পেয়ে বাঁশিওলা আবার বাজাতে শুরু করলে সমারোহের মাঝখানে সায়ক তাকে আবিষ্কার করে । কাঁধে তার ঝোলা ব্যাগ আর ব্যাগ ভর্তি বাঁশি । সায়কের মনে হল অমন বাঁশি তার যদি থাকতো হৃদয় মিলিয়ে পৃথিবীর সবার সাথে ইংরাজি , ফার্সি, আরবি না শিখেও ভাবের আদান প্রদান করতে পারতো অনায়াসে । নানা বর্ণের মানুষের ভিড় ঠেলে সায়ক যখন বাঁশি আলার দিকে এগিয়ে চলল সে তখন অন্য কোন সমারোহে প্রদীপ প্রজ্বলনের উদ্দেশ্যে চলল ।
সায়ক কে সে লক্ষও করল না ; ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল । ভিড় পেছনে ফেলে ছুটে সমুদ্র তটের আর কিছুটা এগিয়ে গেলে সায়ক আবার শুনতে পায় সেই বাঁশিওলার সুর । সায়ক ছুটে চলল দুই একবার সমুদ্র পাড়ের বালির ওপর পড়ে গেলেও সে থামল না । সমুদ্রের পাড়ের নতুন বাঁকটায় এসে দিগন্ত
বিস্তৃত পটে আর কাউকে দেখতে পেল না সে । সা সা করে বয়ে আসা দমকা হাওয়ায় সমুদ্রের গর্জনের সাথে একখণ্ড বাঁশির সুর তখনো লেগে । সুরটা যেন সায়ক কে কানে কানে অনন্তের পথের মোরে বাঁশিওলার ঠিকানা দেয় । সায়ক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে । আর একটা বাঁকের পর সে দূরে বাঁশিওলা কে দেখতে পায় ।
অনন্তের পথে আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে সে ; কোন অচেনা রঙ্গের সন্ধানে অপর কোন অচেনা স্বপ্নরাজ্যে । সায়ক ছুটেগিয়ে যখন তার ঝোলা টেনে ধরল ;একটা বিভেদ , বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা হীন ব্যাপ্ত সুরের বাঁশির জন্য । সায়কের কক্ষচ্যুতি ঘটলো । মা রান্না ঘর থেকে এসে পটাস করে আটা মাখা হাতেই
স্কেলের বাড়ি বসাল সায়কের পিঠে । ডেক্সের ওপর থেকে চোখ মুছতে মুছতে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল চক্ষু তার রক্ত বর্ণ ।
- হোম-ওয়ার্ক করতে বসলেই ঘুমপায় না । তারা তারি কমপ্লিট কর আমি রান্না সেড়ে এসে দেখবো । আবার আঁকা স্কুলে যেতে হবে । কাল পাড়ায় আঁকা প্রতিযোগিতা
আছে । গত বার যা এঁকেছিলি আমি কার কাছে মুখ দেখাতে পারি না ।

পরের দিন যেমন খুশি আঁক প্রতিযোগিতায় সায়ক মনে করেকরে তার স্বপ্নের ফেরি-ওলার ছবি আঁকতে আঁকতে সময় পেরিয়ে গেল । ছবি টি আর সম্পূর্ণ হল না ।
গত বছরের মতো এবার টুবলু প্রথম হওয়ায় তার মা বেস ভিজিয়ে ভিজিয়ে ছেলের গুণকীর্তন করলো । সায়কের মা মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরে সায়ক কে আবার ঠেঙ্গাল ।
- গাধা টা তোর দারা কিছুই হবে না ।
সায়ক কাঁদতে কাঁদতে বললো ;
- হবে কী করে স্বপ্ন টা পুরপুরি দেখতে দিলে ।
আবার স্বপ্নের কথা শুনে সায়কের মা আর চোটে গেল । কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল বেডরুমে ;
- রাত দিন সুযোগ পেলেই শুধু ঘুম আর হাবি যাবি স্বপ্ন ।
সায়ক যন্ত্রনায় কাতরে উঠে বললো
- কান ছার লাগছে ; আজ পর্যন্ত আমার কোন স্বপ্নই তুমি পুর পুরি দেখতে দাওনি ।
সায়কের মা আর চেঁচিয়ে ওঠে ;
- তুই ক্লাসে ফাস্ট হবি ; আঁকায় distinction পাবি ; কম্পিউটারে তোর দখল থাকবে সকলের থেকে ভাল ; তোর সাথে জেনারেল নলেজে কেউ পরবে না । এ গুলো আমার
স্বপ্ন । আমার কোন স্বপ্ন টা তুই পুড়ন করছিস বল দেখি ?
সায়ক বিরক্ত হয়ে বলে ;
- তোমার স্বপ্ন তুমি দেখ ; আমার স্বপ্ন আমাকে দেখতে দাও ।
এবার সায়কের মা আরো রেগে গিয়ে তার পিটে কিল মারতে মারতে তাকে বেডরুমে আটকে দরজা বন্ধ করে দেয় ।
- আজ থেকে তোর খাওয়া দাওয়া সবকিছু বন্ধ ।

রাতে কাজ থেকে ফিরে বাবা সে ঘরের শিকল খুলে ঘরে ঢুকে দেখল সায়ক অঘোরে ঘুমিয়ে কি যেন বির বির করে । সায়কের আর কাছে গেলে সে পরিষ্কার শুনতে পেল
সায়ক বলছে ;
- ফেরি-ওলা তুমি তোমার বাঁশি বন্ধকরো এখান থেকে যাও । আমার মা তোমার সাথে আমায় দেখলে কষ্ট-পাবে । আমি মা কে কষ্ট দিতে চাইনা ।
সায়কের মা রাতের রান্না সেড়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে;
- ওকে ডেকে দাও । না খেয়ে শুলে আবার শরীর খারাপ করবে ।
সায়কের বাবা বলেন :
- আস্তে কথাবলো ; এক দিন না খেয়ে শুলে কিছুই হবে না l
সায়কের বাবার কাছে সায়কের ঘুমন্ত প্রলাপ শুনে সায়কের মার চক্ষু ভিজে যায় ।
রাতে বিছানায় শুয়ে সায়কের বাব যখন তার মায়ের কাছ থেকে সংসারের খুঁটি নাটি খবর নিচ্ছিল সে শোনে সায়কের আঁকা সেই ফেরি ওলার কথা গ্রামের বাড়ির রথের মেলায় এমনি একটা ফেরি-ওলার কাছথেকে সায়কের বাবা একটা আড় বাঁশি কিনেছিল শখকরে । বাঁশি বাজানোর তার ছিল খুব ইচ্ছে ; কিন্তু তার বাবা সায়কের ঠাকুর দা রাগ করতেন ; বলতেন '' শেষ মেষ যাত্রা দলে গিয়ে ভিড়বে । " তার আর বাঁশি বাজানো হয়নি । সে এখন সরকারি দপ্তরের ক্লার্ক । অথচ তার বাড়িতে এক সময় রবীন্দ্র নজরুলের ছড়াছড়ি ছিল । বাবা মহা মনবের উদাহরণ দিলে এদের কেই সামনে দাঁড় করাতেন । অথচ কোন দিনও বলেননি ; দুক্ষু-মিয়া যদি যাত্রাদলে বাঁশি বাজিয়ে কাজি নজরুল হতে পারে '' আমাগো পোলা বাজাইলে জাত জাইবো কেন ? '' অনেক রাত অব্ধি সায়কের বাবার আর ঘুম এলো না । বাল্য স্মৃতি সংরক্ষিত একটা টিনের বাক্সর মধ্যের
লাট্টু , লেত্তি , লাটাই , গুলি কতকিছু সে উলটে পালটে দেখে শেষমেশ তার সেই মেলায় কেনা আড় বাঁশিটা হাতে তুলে নিল ।

পরের দিন সকালে সায়কের বালিশের তলায় সায়ক আবিষ্কার করলো তার স্বপ্নের ফেরি-ওলার সেই বাঁশি । সেটা স্বপ্ন না সত্যি; বোঝার জন্য সায়ক নিজেকে চিমটি-কাটে ।

প্রবন্ধ - সায়ন দে

0 কমেন্টস্
ধর্ম ও ধর্মীয় উৎসবঃ প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে দুচার কথা
সায়ন দে



ধর্ম মানুষকে একটা সময় হিংসা, দলাদলি আর বিশৃঙ্খল জীবনযাপন থেকে শান্তি ও সংঘবদ্ধ জীবনের রাস্তা দেখিয়েছিল... আজ ধর্ম মানুষকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সেই বিশৃঙ্খলতায়, সেই হানাহানিতে । উৎসব মানুষকে মেলায়, ভাবের আদানপ্রদানের মাঝ দরিয়ায় মানুষ চিনতে শেখায় । কিন্তু সেই উৎসব আজকাল কেবলই ব্যবসা হয়ে গিয়েছে । মানুষের আবেগ, বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে চলছে কেনাবেচা, লাভ ক্ষতির হিসেব নিকেস । রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা ব্যস্ত সেই উৎসবে জমায়েত বিপুল সমর্থনকে ভোট বাক্সে সুনিশ্চিত করতে । যাদের নিয়ে এতো লাফালাফি এতো আড়ম্বর, সেই ঈশ্বর কেন জানিনা বড়ই চুপচাপ । আস্তিকরা বলবেন তিনি সবই দেখছেন ও ঠিক সময়েই সঠিক ব্যবস্থা নেবেন । আর ঈশ্বর-অবিশ্বাসীদের দল এখানেই খুঁজে নেবে তাদের ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার দাবীর পিছনে আরও একটা যুক্তি । এদেশীয় ধ্রুপদী আধ্যাত্মবাদ নিজের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে যদি তা সহ্য করি বা পাশ্চাত্য আধুনিক এনলাইটেড যুগের পণ্ডিতরা জগতের যে প্রাকৃতিক নিয়ম (Law of Nature)-এর কথা বলতেন সেই নিয়ম যদি মেনে নিই কিংবা আর্থসামাজিক দিক থেকে মার্কসের তত্ত্ব অনুযায়ী এই সমাজের সব কিছুর ওপর পুঁজিবাদী প্রভাবের অতি সক্রিয়তা এই ব্যবস্থাকে ভেঙে সমাজ বিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারা অনুসারে সমাজতন্ত্রের দিকে আমাদের নিয়ে চলেছে বলে যদি ধরে নিই, তাহলে হয়ত এ যা কিছু হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে বলেই মনে হবে । কিন্তু আদৌ কি সব ঠিক হচ্ছে ? ঠিক ভুলের বিচার করার আমরাই বা কে ? আমরা যদি কেউ নই তাহলে কে করবে বিচার ? নিত্যদিন নৈতিকতার অবক্ষয় যে সত্যিই হয়ে চলেছে তার দায় স্বীকার করবে কোন পক্ষ ? আবার নৈতিকতা যে টিকিয়ে রাখতে হবেই এমন মাথার দিব্যিই বা কে দিয়েছে ? এই সব প্রশ্নের মাঝে ‘ধর্মীয় উৎসব’ এর ধারণাকে প্রতিস্থাপন করলে যেটা পাওয়া যাবে তাতে বোধহয় নতুন করে কিছু ভাবার জায়গা তৈরি হতেই পারে ।

প্রথমেই বুঝে নিতে হবে সাধারণ উৎসব আর ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে পার্থক্যটাকে । আসলে সত্যি কথা বলতে কি, কোন পার্থক্যই নেই । ‘উৎসব’ ধারণার জন্ম ধর্ম পালনের মধ্যে থেকেই, তাই সে অন্নপ্রাশন, বিবাহ, জন্মদিনের মত নিতান্তই ব্যক্তিগত উৎসব হোক বা দুর্গা পুজো, ঈদ, ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার-এর মত সার্বজনীন উৎসবই হোক, সব উৎসবেই ধর্মীয় ছোঁয়া একটু না একটু হলেও আছে । ধর্মকে বাদ দিয়ে উৎসব হতে পারে না । তাই ধর্ম ও উৎসবের উদ্দেশ্যটা কোথাও গিয়ে এক হয়ে গেছে; অর্থাৎ মানব মিলন ঘটানো । কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে যে এই উদ্দেশ্য আজ ভূলুণ্ঠিত । স্বার্থ, লোভ, ক্ষমতা লিপ্সা এ সব মানুষের আদিম গুণ, আগেও ছিল এখনও আছে, যতদিন মানুষ থাকবে এ গুণ গুলো ততদিনই থাকবে, তাহলে ধর্ম-উৎসবের আদর্শ ও উদ্দেশ্যে এতো অবক্ষয় এলো কেন ? মানুষের ঈশ্বরে বিশ্বাস বা ভাগ্যের সংশয়ে ঈশ্বর ভক্তির তো বিন্দুমাত্র হ্রাস ঘটেনি, তাহলে ? ধর্ম নিয়ে ভাগ বাঁটোয়ারাও তো কম হল না, যে যারটা বুঝে নিতেই তো এতো দেশ ভাগ, এতো আলাদা আলাদা ধর্ম সাধনার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, এতো সংস্কৃতির ভেদাভেদ মেনে চলা হল, ধর্ম রক্ষার জন্যেই তো এতো কিছু, তাহলে এতো অবক্ষয় কেন ? অবক্ষয়গুলো আর আলাদা করে না উল্লেখ করলেও উত্তরটা আমরা সবাই এভাবেই জানি যে, আমরা ধর্ম কেবল মূর্খের মত পালনই করে এসেছি যুগ যুগ ধরে, ধর্মের মর্মার্থকে অনুধাবন করিনি, আর যারা ধর্মকে বোঝানোর দায়িত্ব নিজে থেকেই নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছেন, তারা যে যুগ যুগ ধরে আমাদের ভুল বুঝিয়েই আসছেন তাও আজ স্বীকার না করে উপায় নেই । রাষ্ট্র কখনোই ধর্মকে চোখ রাঙিয়ে নিজের মত করে খুব বেশীদিন চলতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না, তাহলে কে নেবে দায় ? আর কেই বা দেখাবে রাস্তা ?

ধর্ম বা ধর্মীয় উৎসব কি তাহলে না থাকাই ভালো ? যদি এই মন্দির, মসজিদ, গির্জা না থাকে, যদি রথের মেলা, মহরম আর গুড ফ্রাইডে না থাকে, তাহলে কি ভালো হবে ? না থাকবে বাঁশ আর না বাজবে বাঁশি, না থাকবে ধর্ম, না থাকবে উৎসব আর তাহলে কি এতো অবক্ষয় থেমে যাবে ? না বোধ হয় । একটা পরিচিত কলঙ্কিত অবক্ষয়ের উদাহরণ দিয়েই বলি, নারী নির্যাতন ও শারীরিক অবমাননা কি কোন ধর্ম মানে ? মদের নেশায় চুর হয়ে লাল চোখের দূষিত পুরুষত্বের রক্তাক্ত আস্ফালন কি কোন ধর্মীয় উৎসব বাদ দেবে ? দুর্গাপূজা হোক বা ঈদ উল ফিতর, কোনও উৎসবের পবিত্রতা কি তাদের পাশবিকতার হাত থেকে রেহাই দিতে পারবে নারী দেহকে ? পারবে না । কারণ এসব যে ধর্ম, উৎসব ধারণার সৃষ্টির আগে থেকে মানব সভ্যতায় ঢুকে পড়েছিল, আর ধর্ম বা উৎসব কোনটাই পারেনি সেই অবক্ষয়ের বিষ কে বার করে দিতে । আজ সমাজে যে কটা অবক্ষয়ের বিষ লুকিয়ে থেকে সমাজটাকে কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তার সবকটাই প্রাক- ধর্ম কলঙ্ক, ধর্ম সেগুলোকে শেষ করে দিতেই বানানো হয়েছিল, কিন্তু তা শেষ হয়নি, কারণ ধর্মের কারবারিরা কখনো নিজেদের স্বার্থে কখনো অক্ষমতায় সেই কলঙ্কগুলোর উপর দিয়ে কেবল একটা প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিল, আর সেই প্রলেপের নামই হল ‘সভ্যতা’, ‘নৈতিকতা’, ‘উৎসব’ আর ‘নিয়ম-কানুন’ । এখন তো সেই প্রলেপগুলোই খুলে খুলে পড়ছে আর আমাদের আসল রূপটা ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে । ধর্ম বা ধর্মীয় উৎসব আমাদের জংলিপনার ঐতিহ্যের মাঝে কেবল কয়েকটি যুগের নাটক ছাড়া আর কিছু নয় । আমরা এখন এই নাটকের যুগের শেষ দৃশ্যে অভিনয় করছি । সভ্যতার প্রেক্ষাগৃহে ধর্ম আর উৎসবের নাটক শেষ হলেই আমাদের খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে জঙ্গলের বাস্তবতায় ।

কবিতা - শ্রীশুভ্র

0 কমেন্টস্


বিদ্ধস্ত শৈশব!
শ্রীশুভ্র


 

বড়ো বিস্ময় লাগে! যখন দেখা যায় তিন বছরের শিশু ঘরে বসে হোমটাস্ক করছে মায়ের কাছে, কিংবা শিক্ষকের কাছে! ঠিক যে সময় তার মায়ের সাথে, দাদা দিদির সাথে লুকোচুরি খেলার কথা! যখন ঠাকুমা দিদিমার কাছে রাক্ষোস খোক্ষোস দত্যি দানোর গল্প শোনার কথা! অফিস ফেরত বাবার পিঠে চেপে ঘোড়া চালানোর কথা!



সে সব কিছুই বাদ! পরদিন মর্নিং স্কুল! অতএব সমস্ত হোমটাস্ক করে যেতে হবে ঠিকঠাক! নয়তো মিসের কাছে বকুনি খাওয়ার ভয়! তিন বছরের শিশুর দীক্ষা হতে থাকে সামাজিক অসম্মানের ভয়ের! তিন বছরের শিশুকেও জানতে হয় পাশ ফেলের গল্প! শিশুকে পাশ ফেল শেখাতে গিয়ে আমাদের খেয়াল থাকে না, কখন আমরা জাতি গঠনের দায়িত্বে পুরো ফেল করে বসে থাকি, নিদারুণ ভাবে!



নিজের সন্তানকে দ্রুত শিক্ষিত করতে গিয়ে আমরা খেয়াল করি না, কোন কোন নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি থেকে শিশু ও তার শৈশবকে বঞ্চিত করে ফেলি! গোড়ায় গণ্ডগোলের মতো আমরা ভুলেই যাই যে মানুষ হিসেবে আমরাও সবুজ সজল প্রকৃতিরই অন্যতম বিশিষ্ট প্রকাশ! প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা যত যথাযথ হবে, ততটাই মানবিক হয়ে উঠতে পারবো আমরা! নাগরিক জীবনের পরিসরে আজ যা অকল্পনীয় অবাস্তব বলে প্রতিভাত হয়!

কিন্তু শিশুর শৈশব প্রকৃতির সম্পৃক্ততা আত্মীয়তা দাবি করে প্রবল ভাবেই! অথচ যে সময়ে শিশুর সাথে প্রকৃতির নিত্য পরিণয় ঘটার কথা, হওয়ার কথা প্রতিদিন শুভদৃষ্টির, ঠিক সেই সময়েই আমরা শিশুর শৈশবকে বেঁধে ফেলি স্কুল থেকে হোমটাস্কের রুটীনে!




মনস্তত্বের দিক দিয়ে দেখলে দেখা যায় যত অল্প বয়সে শিশুকে নিয়ম নীতির বেড়াজালে বেঁধে ফেলা যায়, ততই তার মৌলিকতা বিকাশের পথটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে! যতই তাকে আর পাঁচটি শিশুর মত সভ্য ভব্য ফার্স্ট গার্ল কিংবা বয় করে গড়ে তোলা হতে থাকে ততই তার নিজস্বতা গড়ে ওঠার পথটা সংকুচিত হতে থাকে! এই ভাবে আমরা ঘরে বাইরে শিশুর স্বাধীন মৌলিক বিকাশের পথটি বন্ধ করে দিয়ে বসে আছি! শৈশবের প্রয়োজন প্রকৃতির সাথে আত্মিক মেলবন্ধন! স্বাধীন ইচ্ছার মুক্ত পরিসর! প্রতিনিয়ত কল্পনা শক্তির স্ফূরণ! আবেগের বাধাহীন প্রকাশ! এবং এরই সাথে সুস্থ সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে আদর আর স্নেহের যথাযথ বন্টন!



আসলে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরিই বৃটিশের দ্বারা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটা প্রক্রিয়া, যা দেশজ জলবায়ু পরিবেশে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, ঐতিহাসিক সমাজ বিবর্তনের ধারায় গড়ে ওঠেনি সমাজ জীবনের অন্তঃস্থল থেকে! এখানেই ভারতবর্ষ তথা বাংলার কপাল পুড়েছে! দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে কিন্তু সে অর্জিত স্বাধীনতা নয়! ফলে শিক্ষাব্যবস্থাও চলছে পরাধীন যুগের ধারায়! এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল কয়টি ধারা হল মাতৃভাষা বর্জন! বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানের উন্মেষ নয়, মুখস্থ বিদ্যার চর্চায় পরীক্ষায় বেশি নম্বর জোগাড়! মৌলিক চিন্তা শক্তির বিকাশ সাধন নয়, উন্নত বিশ্বের অন্ধ অনুকরণ!

ফলে শিশুর শৈশবের পঠন পাঠনেও এই ধারা চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রথম থেকেই!




যতদিন যাচ্ছে শিশুর উপর লেখাপড়া যেন ততই দমবন্ধ ফাঁসের মতো চেপে বসছে!

পড়া স্কুল হোমটাস্কের বাইরে কার্টুন চ্যানেল ছাড়া শিশুর আজ আর কোনো নিজস্ব জগত নেই! শৈশবের কল্পনার সাম্রাজ্য আজ টিভি আর কম্পিউটার টার্মিনালে সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে! শিশুর খেলার মাঠ ছিনতাই হয়ে গিয়েছে রিয়েল এস্টেটের সর্বগ্রাসী খিদের কাছে! ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা গানের স্কুল, নাচের স্কুল, আঁকার স্কুল, খেলার স্কুল, সাঁতারের স্কুলেও সেই ঘড়িধরা রুটীনে বাধাপ্রাপ্ত শৈশব! শিশুর স্বাধীনতা বাবা মায়ের সামাজিক কম্পিটিশনে নিয়ন্ত্রিত! ভাবতে অবাক লাগে উন্নত বিশ্বের সমকক্ষ হতে গিয়ে আমরা কি অক্ষম হয়ে পড়েছি শিশুর শৈশবকে আনন্দের উৎসব করে গড়ে তুলতে!




পারিবারিক পরিসরেও যে, শিশু সবসময়ে সব ঘরেই তার উপযুক্ত পরিবেশ পায় তাও নয়! অধিকাংশ সংসারে একমাত্র সন্তান হওয়ার জন্যে বাবা মায়ের অতিরিক্ত নজর সামলাতে হিমশিম খায় অবুঝ শৈশব!
পারিবারিক সমস্যাগুলির অনভিপ্রেত অভিঘাত শিশুর উপর সাংঘাতিক কু প্রভাব ফেলে! অধিকাংশ ঘরেই দাদু দিদিমার স্নেহ ছায়ায় এই কু প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার পরিসরটুকুও পায় না আজকের শিশুরা! ফলে ঘরে বাইরে একটা অদ্ভুত খাঁচায় আটকে পড়ে ছটফট করে শিশুর অন্তরাত্মা! যার গভীর প্রভাবে শিশুর অবচেতনে মানবিক প্রত্যয়গুলি ঠিকমত দানা বাঁধার সুযোগ পায় না!

পরবর্তী জীবনে শৈশবের এই ঝড়ঝাপটা অনেকটাই স্বার্থপর করে গড়ে তোলে তাদের! যার দায় কোনোভাবেই তাদের নয়!



আমরা যদি মনে করি, যুগধর্মে এটাই যখন জীবন বাস্তবতা তখন এভাবেই গড়ে তুলতে হবে আমার শিশুর শৈশব, তাহলে মস্তবড়ো ভুল হবে! একথা ঠিক, সমাজ পরিবর্ত্তনের ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই!

দেশের ভ্রান্ত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরেও শিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা সম্ভব নয় কারুর পক্ষে! তবু নিজেদের সাংসারিক পরিসরে শিশুর জন্যে আদর্শ শৈশবের একটা সুস্থ সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতেই পারি আমরা! পারি একটু সচেতন থাকলে! পারি নিজেদের জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরে মানবিক মূল্যবোধগুলিকে যথাযথ ভাবে লালন করলেই! দুঃখের বিষয় অধিকাংশ পরিবারেই অভিভাবকরা নিজেরাই এসব বিষয়ে সচেতন নয় ততটা যতটা দরকার!




তাই অভিভাবকদের ভেবে দেখার সময় এসেছে শিশুকে তার হারানো শৈশব ফিরিয়ে দেওয়া যায় কিনা! পুরোটা না হলেও কতটা? সমাজবিদদের এবং শিক্ষাবিদদের এগিয়ে আসতে হবে! শিক্ষা প্রণালীর খোলনোলচে বদলে দেশজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যে গড়ে তুলতে হবে উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা! উন্নত বিশ্বের দেশগুরির শিক্ষা ব্যবস্থার শক্তির কারণগুলি অনুধাবন করে তার থেকে পুষ্ট করতে হবে এদেশের শিক্ষাক্রম! শিশুশিক্ষার আদর্শ পদ্ধতি হল খেলতে খেলতে খেলার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা দান! শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর এইভাবে শিশুকে তার ভাবরাজ্যের কল্পনার সাম্রাজ্যে পূর্ণ স্বাধীনতায় মানুষ করতে পারলেই শিশু ফিরে পাবে তার হারানো শৈশব! সফল হবে শিশুকে মানবিক দীক্ষায় দীক্ষিত করা!

কবিতা - সুবর্ন গোস্বামী

0 কমেন্টস্



আমার রুপালি ঘড়ি
সুবর্ন গোস্বামী


আমি তখন সত্তর ও নীরবতার খুব কাছাকাছি
রোগা কব্জিতে প্রাচীনতম রুপালি ঘড়িটি
পড়ছে সময়ের পুঁথি,এক এবং অদ্বিতীয়;
যাকে আড়ালে আমি এখনও ঈশ্বর বলে ডাকি।

ঘড়ির ডায়ালে ছায়া ছায়া আত্মপ্রতিকৃতিতে মগ্ন আমি
বারবার বাজিয়ে শুনছি বিশুদ্ধ রাগিণীতে বীতশ্রদ্ধ এলার্ম।
গত জন্মের উপাখ্যান।
‘তুমি নেই...তুমি নেই...তুমি নেই...”
এরকমটাই শুনতে যেন পাশের বাড়ীর
নিয়মনিষ্ঠ হারমোনিয়ামে খেয়ালী খাম্বাজ।

আমি ততদিনে নেমে এসেছি শীর্ষের শুন্য থেকে
আরও কয়েকটা দশক নিচে।
সরলরেখার সমান্তরালে হেঁটে ছেড়ে দিয়েছি
একান্নবর্তী বারান্দার ইচ্ছে।

শুধু শরীর অথবা হাড়ে সেই রুপালি ঘড়িটি
নবজাতকের কান্না থেকে সত্তর ও নীরবতা অবধি
কখনও থামেনি।


কবিতা - অনুপ দত্ত

0 কমেন্টস্















এক অন্তরীন প্রশ্ন
অনুপ দত্ত



আমি একএ কনিষ্ট বেদুইন৷
তোমার ভুবনে মহত্ত্বকাড়া-ইনসাআল্লাহ৷
আমি শাহরুখ লড়াই স্বদেশ জন্মভূমি
আমি হৃত্ত্বিক ঐকান্তিক কৃষ্ণ ম্যাজিক
আমি অমিতাভ বৃদ্ধরাজা অডিওপাউস৷

আমি রেসের শরীরে দুরন্ত অশ্ব-হ্রেষা৷
আমি হাতির কালো খোদাইচিত্র বিশালতা
আমি অনন্য৷ আমি অনন্ত হয়ে থাকা বসুধা ব্যকুলতা৷

তুমি আমার প্রেমে অসীম প্রভুত্ব
তুমি আমার নির্জনদুপুর সঙ্গবিহীন নারী
তুমি আমার সঙ্গবিতান পরিবর্ত্তন সেই ট্রাডিশন
তুমি আশা আমার সমস্ত পরিবর্ত্তন সমীচিন৷

আমি বর্ত্তমান নই৷
আমি নই আগামীকাল৷
আমি আমার সমস্ত অতীত
আমি ভবিষ্যৎ ৷
ভালবাসা মন দারুন কাঙ্গাল৷

আমি নিজেই এক অন্তরীন প্রশ্ন
আমি হিপোক্রিট নই অশুভ অর্বাচীন বিবাদী
আমি এক অখন্ড কবিতা৷
কবিমানস আমারমানসে,
মানসী এক শান্ত উদার পদ্মফুল৷

কবিতা - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

0 কমেন্টস্



স্বর্ণযুগ
শর্মিষ্ঠা ঘোষ


শ্লোগানগুলো হাতফেরতা হতেহতে গান হতে পারতো
ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির আওয়াজ নাড়িয়ে দিলো বদলে দেয়াল
যা কিনা কোনো বিপ্লবের বাপের নিজস্ব ছিলোনা

আমাদের বাপ পিতেমো' টগবগে যুবককালে ফিরে যাচ্ছেন
মায়েদের মেটেহাঁড়ির গল্প যেমন শুনেছে রাইসকুকার
বিশদ হবার বিপজ্জনক অভ্যাস সিন্দুকে রেখেছেন কাল্ঠাকুর

সন্ধ্যের পর গোস্বামী বাড়ির চৌকাঠে গান বসে না
কারাযেন ছাপাখানা করেছে সেখানে আজকাল
জনশ্রুতি সেখানে ছাপা হয় স্বর্ণযুগের দিস্তে দিস্তে ইস্তেহার

কবিতা - শমীক সেনগুপ্ত

0 কমেন্টস্


অন্য কোন নন্দিনী
শমীক সেনগুপ্ত


ভালোবেসে,ঠাকুর পড়ে ডাকলো যে কেউ "নন্দিনী.."
আমি কিন্তু আসলেতে চিলেকোঠার বন্দিনী ।
শর্ত অনেক নিয়ম প্রচুর...তাকেই ভাঙি রঙ্গে;
সব কিছুকেই মেনে নিয়ে মনও চলে সঙ্গে।

আমি কিন্তু পাশবালিশে লুকোইনা মুখ-
সুখের খোঁজে চোখ ভেজে না ,
যায়না মাথা অন্য কোন বুকে-
আনন্দে মুখ ঝলমলিয়ে হাসে
বাসে ভালো মান-অভিমান মন
ইচ্ছেগুলো কখনো বা নিচ্ছি কোথাও টুকে ।

ওরা আমায় পাগল বলে, হয় ত' আমি পাগল-
আঁটকে থাকা বন্ধ মনের খুলতে যে যাই আগল;
সন্ধ্যা হলে দিয়া জ্বেলে,ভাসাই নীলে হৃদি-
ভাসে দেয়া আকাশেতে, সূর্য না ছোঁয় যদি ।।

কবিতা - রাহুল রায়চৌধুরী

0 কমেন্টস্


কবিতা
রাহুল রায়চৌধুরী


~১~

শামুকের খোলটাকে ভেঙে দিও না প্লীজ
লজ্জা ঢাকবার জন্য ওর আর একটাও শাড়ি নেই ...

~২~

লজ্জাবতীকে ছুঁয়ে দিলে
তোমার মেয়েকে কাল ঠিক ও র‍্যাগিং করবে ...

~৩~

সেজেগুজে বিয়ে করতে চলেছ, মেয়েটি শুনেছি খুব বিদুষী
আরও শুনেছি মিহির শেষ পর্যন্ত খনা’র জিভ কেটে নেন ...

~৪~

সৎ মহিলা অফিসারটিকে সাসপেন্ড করা হল
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নির্ঘোষ ~
‘তোমাকে এভাবেও ধর্ষণ করা যায়’

কবিতা - সৌমিত্র চক্রবর্তী

1 কমেন্টস্


মহাভোজ
সৌমিত্র চক্রবর্তী


বুনো কুকুরগুলো থাবা চাটছে,
পাকস্থলীতে লাফালাফি করছে
সদ্য চালান হওয়া কাঁচা মাংসদল ...

গোল বৃত্তের মাঝখানে শীতার্ত
কালচে হয়ে যাওয়া মুখগুলো বলিরেখায় কম্পমান,
যদিও ওদের শংসাপত্রের বয়স সবুজ ...

ইতিমধ্যেই কয়েকজনের ল্যাজামুড়োয়
প্রাতরাশ জমে উঠেছিল শ্বাদন্তবাহীদের,
জমে উঠছে বহু উপোসীর মহাভোজ উৎসব ...

দ্রুত জঙ্গলবসত মিলিয়ে যাচ্ছে
ঠাকুরমার ঝুলির পোকাকাটা পাতার ভাঁজে,
জিভ বের করা বুনোকুত্তার লালা গড়ায়...


অতিবিপ্লবীর ছদ্মতকমা খোলস ছেড়েছে,
যৌনরস পৃক্ত শ্বাপদমস্তিষ্ক ক্ষণিক বিশ্রামে,
ঘন্টার অপেক্ষায় কান খাড়া মহাবলি উৎসব।

কবিতা - মিলন চ্যাটার্জি

1 কমেন্টস্


পাহাড় বলে একটি ছেলে ,নদীর বুকে থাকে …
মিলন চ্যাটার্জি


পাহাড় --এই জানিস তুই না থাকলে আমার কি হবে ?

নদী -- কি আবার হবে ! পাহাড়ে বরফ পড়বে ? হি হি

পাহাড়--আরে তা নয়, তবে আমার ফাঁকা ফাঁকা লাগবে খুব ।

নদী -- তাতে আমার কি ! আমি নিজেকেই ভালোবাসি ।

পাহাড়--জানি, আমরা সবাই নিজেকে ভালোবাসি, তবু কিন্তু সম্পর্ক টিকে থাকে । আমরা নিজের জন্য কি কাঁদি ? মনে তো হয় না ।

নদী -- দেখ, তুই যেটা করিস সেটা পাহারাদারি। আমি কোথায় যাবো, কি করবো সেই কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে ! আজব !

পাহাড়--আসলে কি জানিস, ভালোবাসা হল একটা তরঙ্গ । সে এতো বোঝে না, সে জানে শুধু আগলে রাখা ।

নদী -- আমার তাতে কিছু আসে যায় না ।

পাহাড়--আচ্ছা বেশ, তুই ভালো থাক আর জ্বালাবো না ।

নদী -- হি হি , জ্বালাবো না । এসব নাটক বন্ধ কর । সবাই একই কথা বলে, যাত্রা দলে নাম লেখা , নাম করবি ।

পাহাড়-- ঠিকই বলেছিস , নাটকই বটে । নাম করবো , হা,হা,হা ।

নদী -- আমাকে আর বিরক্ত করিস না, আমার এসব শুনলে হাসি পায় । ভালোবাসা শুনলেই আমি হাসি, আমার এতে কিচ্ছু এসে যায় না ।

পাহাড়-- কিন্তু ভালোবাসা তো একটা আদি শব্দ, এর বিকল্প কিছুই নেই । টাই বলে ফেলি রে, সরি ।

নদী -- হুম, ঠিক আছে । অন্য কাজের কথা থাকলে বল ।

পাহাড়-- কাজের কথা, না তা নেই । আজকাল সারাদিন ছাতিম ফুলের গন্ধ পাই , কিন্তু এটা কাজের কথা নয় । সারাদিন মনে হয় একটা কাঁটা ফুটে আছে বুকে, নিজেকে আজকাল খুব ছোট লাগে বুঝলি ।

কট্‌ ------- ফোনের ওপারে অতলান্ত নীরবতা !
এফ এম চালাই একটু।

" তীরেও নাই পাড়েও নাই / যেজন আছে মাঝখানে "

এই ভালো, অপার নিস্তব্ধতায় এই গানই যাপনের মূল্য দিক ।

কবিতা - রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

0 কমেন্টস্



মিছিল
রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ


নীরব সংশয় প্রতিটি
সৃষ্টির শেষে ।
বারবার সংকল্পের বারান্দায়
                         কপাল ঠেকিয়ে
মুছে যাই মিছিলে ।
রূপক রাতের নিঃশ্বাসে
জাবর কেটে যাবতীয় কান্না ক্রমশ এলিয়ে থাকি রোগাক্রান্ত মেঘে ।

কবিতা - ওয়াহিদ জালাল

0 কমেন্টস্


আগুনের বনজ পাখি
ওয়াহিদ জালাল



তখন আমার পাশ ঘেঁষে
একটুকরো আগুন মৃদু পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলো
আমি পতঙ্গের মতো পাখনা ভিজিয়েছি
তার গলেপড়া শরীরে ।

পৃথিবী ততক্ষণে
নষ্ট ডিমের মতো ঘুমিয়েছিল
আপন শরীরের উপর
বাতাসগুলো অনলে-চুম্বনে অধীর !

আমি শুধু একা
ভুবন পুড়া গন্ধে ডুবেছিলান
সাহসের আড়ালে
শুকনো নরম জিজ্ঞাসার মতো ।

যে আগুন
সম্মুখের দিকে যাচ্ছে
তার শরীরের গরম ভরসা
ছায়ার হয়ে ছায়ায়,

আদিম মানবতার উপর
হুমড়ি খেয়ে পড়ে সত্যের সম্ভাবনা,
আর নগ্ন স্তনে তার ভিজানো বারুদ
দিয়ে মাখিয়ে দিয়েছে চিতার সভ্যতা !

কবিতা - অলক বিশ্বাস

0 কমেন্টস্
 
কড়া
অলক বিশ্বাস


তুমি থাকলেই রাত্রি দীর্ঘ হয়
চুপিচুপি ফুরোয় সময়
ঘেরা মশারিও জেনেছে স্থির,
ভালোবাসি আসলে তোমায়।

এই তো আমার মুখে রেখেছো দু’চোখ ছায়া
আলোছায়ায় উদ্বেল ভরছি চিত্রপট
ছুঁয়ে ছুঁয়ে তোমাকে সাজাই
চুম্বনে বুকেতে উপুড় করে মায়া।

প্রণয়ের দাগ কেটে চলি
মাতলামি বেহিসেবী খেলায়
চলে আসি আরও কাছাকাছি
ভাঁজে ভাঁজে তোমাকেই খুলি

ঘুমিয়ে বেঘোর পাড়া
চাঁদ সরে যায় এবং হারায়
আমাকে আগলে রাখো বলে
ব্যর্থ হয় হাজার কড়া নাড়া। 


কবিতা - সায়ক চক্রবর্তী

0 কমেন্টস্


বেঁচে ওঠো স্মৃতি
সায়ক চক্রবর্তী


যেভাবে বেঁচে আছি ; এটা কোন থাকা নয় –
দু একটা লাউডগা চাল বেয়ে নামবে,
চকির পায়ার তলে গড়াগড়ি দিবে তোমার
বহু বছরের চেনা ফেটে যাওয়া পা,
তারপরই মনে হতে পারে বেঁচে আছি
তোমার ওই বাসি শাড়ীর গন্ধে।
মাঝে মাঝে মনের বাসর ঘরে মনে হয়
জ্বলে ওঠে দাবানল
থেমে যায় রাত
ঝড় বয়ে যায় বুকে একটুকু সময়ের জন্য।
যেভাবে বেঁচে আছো তুমি ; এটা কোন থাকা নয় –
ফিরে দেখো কলপাড়ে এঁটো বাসনের স্তুপ
বেজে ওঠে বেহালার মত।



কবিতা - সুজন ভট্টাচার্য

0 কমেন্টস্


আমাকে
সুজন ভট্টাচার্য


আমাকে নিবিড় করে এনেছ ভূমিতে ,
প্রথম আলোর সাথে সহজ যে গান
কিশোরীর মনে আনে সংকেত ভোরে –
তার মত করে
আমাকে মিশিয়ে নাও
তোমার আঁচলে ।
কোন পথ আমারি সে ছিল
কতদূরে রাখা ছিল কুটিরে- ঠিকানা –
আর কোন দায় নেই তার
খুঁজে নেবে বলে এক আপামর শেষ ।
যতটুকু পেয়ে যাওয়া দুহাতের কোষে
যে সব আলোরা তবু অকাতরে লীন,
বড় বেশি ভালবেসে তারাও আমার ।
তোমার ভূমিতে এসে অ-পাপ সকাল
যা কিছু আমার নয়- আমাকেই দিল,
যা আছে আমার হয়ে- সামান্য যা সব
সবকিছু তুলে নিল ভোরের থালায়..
অতীত - কাহিনীক্রমে হাজার ধূলো
তাদেরও যাত্রার ডাক শালিকের পথে,
অশথের ডাল ছুঁয়ে যে মননের বাসা
তাকেও উজাড় করে মোহানার বাঁকে
আবার নতুন করে আকাশকে চেনা ।



কবিতা - শ্যামল রায়চৌধুরী

0 কমেন্টস্


আমার কবিতা
শ্যামল রায়চৌধুরী


আনন্দ, বিষাদ , শব্দ ,বর্ণ
আবেগ , উৎকণ্ঠা ,আহ্লাদ অপূর্ণ ,
চেতনায় আঁকিবুঁকি গুন গুন স্বরে।
মস্তিকের কুঠুরিতে জমে থরে থরে -
বাষ্পীভূত হয়ে মেশে আকাশের মেঘে
ডানা মেলে উড়ে যায় ভাবের আবেগে ,
বরিষণ ধারা সনে খেরোর খাতায়
আমার ভাবনা ... সে তো আমারেই মানায় !
কাটাকুটি , লুটোপুটি মনের নগ্নতা
কল্পনার আল্পনা ...... সেই তো কবিতা ...।।

কবিতা - ইন্দ্রনীল

0 কমেন্টস্


কবিতার কোলাজ
ইন্দ্রনীল



আমার ঘন ঘন নিশ্বাস কবিতার কোলাজে,
আমার ভেতরের যতো আগুন সবটুকু কাগজের দুই পিঠে।
তবু প্রতিশ্রুতি তোমার দু চোখে ,আমার গভীর প্রণয়।
বিবর্ণ গোধূলি আমার প্রণয়ের উপকূলে নিয়ে আসে মন্দাক্রান্তা।
বৃষ্টির মাদকতায় শ্যামলিমা আমার প্রেম কে প্রাপ্তি দিলো,
তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক ।
কালবৈশাখী বহুবার আমার ধমনীর রক্তে বিষ ঢেলে গেছে।
বিষাক্ত শরীর আমার অন্তর আত্মাকে দুষিত করছে ।
মনের একাংশ এই বিষ ওগরাতে চায়।
এমনিতে আমি নীলকন্ঠ,
তোমারা কি চাও, আমার সারা শরীর বিষময় হোক?
আগুনের মতো এই বিষ ঝরুক, কাগজের দুই পিঠে।
তাহলে হয়তো আবার, নীলকন্ঠ হতে পারবো।

কবিতা - শামীম পারভেজ

0 কমেন্টস্


তুমি আমার শুধু আমার
শামীম পারভেজ


যেদিকে তাকাই শুধু ফুল আর ফুল
নানান রঙের ফুল
মৃদু হাওয়ায় সেগুলো দুলছে
সুবাস ছড়িয়ে চলেছে সর্বত্র
এরই মাঝে লুকিয়ে আছো তুমি
লুকুচুরি খেলছো
তোমার চেয়ে সুন্দর ফুল এখানে আর নেই
আর আমি খোঁজে বেড়াচ্ছি তোমায়
তবুও দৃষ্টিতে পড়ছোনা
ভালবাসার বর্শিতে পড়ছোনা ধরা
তুমি যতই কষ্ট দাও
বেদনা আর যন্ত্রণা দাও
তবুও আমি বর্শি ফেলতে থাকবো আমরণ
এই ফুল বাগে যতদিন না তোমাকে পাই
তুমি আমার শুধু আমার.........।

কবিতা - রাজর্ষি ও শ্রেয়সী

0 কমেন্টস্



পত্রকবিতা
রাজর্ষি ও শ্রেয়সী


দোলের আগের দিন ওরা দ্যাখা করেছিল। প্রকৃতি সেদিন পরিপূর্ণ ছিল বসন্তে। ওইদিন লাল আবির মাখিয়ে দেয় অনিরুদ্ধ চিত্রলেখা'কে। চিত্রলেখা'ও ছেড়ে দেয়নি। মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল। আর তার প্রেক্ষাপটে'ই এই চিঠি।
___________________________________________________________

ঋতুরানি,
হ্যাঁ, এই নামেই ডাকবো তোমায়।
বসন্ত আর তুমি যে একেবারেই সমার্থক।
বাসন্তিক চাঁদ তোমার ভ্রূ-যুগলে,
পলাশ কৃষ্ণচূড়ায় রাঙ্গা ওষ্ঠাধর।
অথবা আবিরের মত রঙিন তোমার অভিমান।
ভুলি কি করে চিত্রলেখা?

আমার জন্য তুমি পাগল হবে?
কতটা বৃষ্টি আনবে চিত্রা?
বসন্তের বৃষ্টি যে শুধুই বিহ্বলতা,
তা কি তুমি জান ?

তোমার ভ্রু'র নীচের ওই তিল'টা,
মাঝে মাঝে উজ্জ্বল হয়ে স্বপ্নে চলে আসে।
তখন রাতগুলোকে কবিতা কবিতা মনে হয়।
চিত্রা, হৃদয় আজ তছনছ ।
হৃদয় আজ তছনছ ।
হৃদয় আজ তছনছ ।


বসন্ত সভ্যতার ফুল রাজ্যে তোমাকে আমন্ত্রন জানিয়ে গেলাম,
চিরকালীন যৌবন যাপনের কামনায়।
ঋতুরানি, চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার কোরো কিন্তু।

........................... অনিরুদ্ধ
====================================================

অনিরুদ্ধ,
নিঃস্ব নির্ঝর দেখেছ কখনও তুমি?
অনন্তের বুকে উদাসীনা, বৈরাগিনী......
কি করে বোঝাই,
আমার স্বত্বা'ও যে আজ তোমার বুকে নিঃশর্ত সমর্পিতা।
তোমার দু-চোখের গভীরতায় স্বেচ্ছা নির্বাসিতা।

বসন্তের অপরিহার্যতা তোমার কাছে বিপর্যস্ত বারবার।
রাগ-অনুরাগের মিশ্রণে আজ চিত্ত বিকল।
বসন্তের বৃষ্টিতে কতটা বিহ্বলতা আছে জানিনা।
তবে কালো তিলের গভীরে
তোমার প্রগাঢ় ছোঁওয়ার যাদুস্পর্শে
মেঘরাঙা বিহ্বল দুপুরেরা'ও
অবিরাম বৃষ্টি হয়ে যায়।

মোহিনী ফাগুনের শেষবেলার রংটুকু'তে যে
তোমার ছোঁয়া'রা মিশে রয়েছে।
প্রেমানুরাগের রঙিন জোয়ারে তাই
হৃদয় আজ পরিপ্লাবিত।
আর এই বিমুগ্ধ হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসায়
আরও এক মুঠো লাল ছোঁওয়া আমার অনিরুদ্ধের জন্য।

ভালোবাসা নিও।
......................... তোমার ঋতুরানি।

কবিতা - রাজর্ষি মজুমদার

0 কমেন্টস্


অভিশাপ
রাজর্ষি মজুমদার


অভিশাপ দেখেছ কখনও?
একসময় ওটা নিজের ছিল, বেশ আপন।
দুর্ভাগ্যের মতই ছিল পদক্ষেপ।
সেখানে খুচরোরা লজেন্স হতে পারতনা।
অভিশাপ দেখনি বোধ হয়।
ওখানে পিঁপড়েরাও পাসপোর্ট পেয়ে থাকে।

আজ আর কেউ অভিশাপ দেয়না।

দুর্ভাগ্যের নমুনাগুলো নিয়ে খারাপ নেই।
তবুও অশোক কিংশুকের বেড়ার ওপারে বাড়ি বানাই।
তখন যেমন চেয়েছিলুম তেমন হয়ত হয়না।
শেষ পর্যন্ত যা হয়েছিল, তাকে স্মৃতিসৌধ বলা চলে।
অভিশাপ নয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বুকের ভেতর কয়েকটা হাতুড়ি হৃদয় পিটছে।
মৃত্যুর জাগরণ থেকে বোধহয় উদ্ধার পেয়ে যাব।
কিন্তু ঘামগুলোর হাট থেকে এজন্মে নিস্তার নেই।
মে মাসের দুপুরগুলো আমার কাছে অভিশাপ।
পরমার্থ লাভের উদ্দেশ্য থেকে আমায় সরিয়ে দেয়।