২৯ অক্টো, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৭ম সংখ্যা

0 কমেন্টস্
সম্পাদকীয়


উৎসব


কাকভোরে উঠেই বেতার,দূরদর্শনের সাথে পাল্লা দিয়ে লাউডস্পীকারে দেবীপক্ষের আগমন ঘোষিত হয়েছিল সাথে প্রতীক্ষা দেবীর আগমনের।সামাজিক,রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক সব যাতনাকে আর বাড়ীর ভিতর বাইরের সব জঞ্জালকে হয় তাড়িয়ে নয়ত ঢেকে নিয়েও এই কটা দিনে বাঙালী মাতবেই মাতৃ-আরাধনায়। সাধ্যকে ছাপিয়ে যাবে সাধের আকাশ-সারা বছরেরে সব দৈন্যকে মায়ের চোখের আড়ালে রাখতেই যে যতটা পারবে নতুন করে সাজাবে বাসস্থান থেকে পরিবার আর পারলে আত্মীয় পরিজনদেরও। এবারেও তাই হয়েছিল ।

চতুর্থী থেকেই শুরু হয়েছিল দিনগোনা - সাজ সাজ রবে শহরের নামীদামী সব মণ্ডপে ফিতে কেটে কোটী-বাজেটের পূজা উদ্বোধনের সাথে প্রচারিত হতে শুরু করল কলা ও কৃষ্টির নামে বেহিসাবী অপচয়ের সপক্ষে গালভরা মিথ্যের বুনিয়াদ।গত বছরে এই উৎসবে ঝরতি-পড়তি বাদ দিয়েও খরচ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটির মত।পূজাকে আন্তরিকতায় ভরিয়ে-আতিশয্যের আর অকারণ দেখনদারীর প্রতিযোগীতামুক্ত করলে বিশাল অঙ্কের অর্থ বাঁচানো যায়। তাতে প্রতি বছর বেশ কিছু নিরন্ন মানুষের রোজগারের স্থায়ী ব্যবস্থা ও অন্ন সংস্থান হতেই পারে। তাতে এই পূজা হবে আরও অনেক বেশী আনন্দমুখর। যাক সেকথা।

বেশ মানুষের ঢল নেমেছিল পূজার শুরুতে। পূর্বাভাস ছিলই-তা সত্যি করেই অষ্টমীর সকালে অন্ধ্র-উড়িষ্যার সীমা পেরিয়ে সামুদ্রিক ঝড়দানব 'পিলিন' হানা দিয়েছে এ বঙ্গেও। এভাবেই শেষ হবে হাজার কোটির তামাশা। নদী পুকুর মাটিতে মিশে যাবে কদিনের মোহ। তারপর আবার সেই নেই-রাজ্যির বারমাস্যা।আমরাও বারোমাসের মত কলম হাতে সাজিয়েছি 'প্রেরণা'র ডালিকে- মরশুমী শিউলী আর পদ্ম দিয়ে। সাথে নাম না জানা আরও অনেক ফুল এসেছে এই অনলাইন পত্রিকায় তোমা-সবাকার হৃদয়ে একটু জায়গা ক'রে নিতে। এই পরিবারে তোমাদের লেখা পেয়ে যেমন খুশী আমরা তেমনি আনন্দ পাবো এখানে পাঠের আনন্দের প্রতিফলন দেখতে পেলে।আনন্দের আতিশয্যের বদলে আন্তরিকতার বিশ্বাস নিয়ে আবার সবাই আরেক উৎসবের প্রতিক্ষায় থাকলাম।


সম্পাদক মণ্ডলীর পক্ষে -
কাশীনাথ গুঁই।
মৌ দাশগুপ্তা।
সুমিতরঞ্জন দাস।


পরিচালন মণ্ডলীর পক্ষে -
মিতা অজানা
ইমেল নাঈম
সায়ন দে
দেবী রায়-মুখার্জী
সুদীপ্তা চ্যাটার্জ্জী
ঋতুপর্ণা বিশ্বাস সরকার
জয় সেনগুপ্ত এবং
কাশীনাথ গুঁই।

কবিতা - রীতা ঘোষ

0 কমেন্টস্
বোধন
রীতা ঘোষ



দাঁড়িয়েছিলাম তে মাথার মোড়ে,
যেখান থেকে ঠিক সোজা রাস্তাটা পৌঁছায় আমার বাড়ীর চৌকাঠে,
যেটা ধরেই একদিন বেড়িয়ে এলাম পথের বাঁকে ।

একদিকে নাম , যশ , খ্যাতি
অন্যদিকে দুহাত বাড়িয়ে তুমি
বেছেনিলাম তোমার ভালোবাসা.....

বাঁধনহারা চঞ্চল মন বেপরোয়া হতে সময় নেয় নি সেদিন
নিজের অজান্তেই ধরে ফেল্লাম তোমার হাত...
বাইশটা শ্রাবণের তৃষ্ণা বুকে চেপে অসহায় চাতকের মতো ।

পাঁচ পাঁচ দশ আঙুলের সেতু বন্ধনে হলো অনুভূতির আদানপ্রদান,
জ্যোৎস্না ভেজা রাতে গগনচুম্বী অট্টালিকার কোল ঘেঁষে হাঁটলাম পাশাপাশি
আমাকে ঋণী করে , ধনী হলে তুমি ।

ধৈর্যের পরীহ্মায় উত্তীর্ণ তুমি , সময়কে করলে বন্দী
দুরন্ত বাতাস আর চতুর্দশীর চাঁদ ছিলো সাক্ষী,
বাঁশ খড়ের কাঠামোয় হলো নতুন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা ।

মুহূর্তেই বেজে উঠলো বিসর্জনের ঢাক,
বিচ্ছেদের করুন সুরে ভারাক্রান্ত চারিপাশ
আর শুধু অন্তহীন প্রতীক্ষা ... আগামী বোধনের সূচনায়...!!!

কবিতা - ঊষসী ভট্টাচার্য

1 কমেন্টস্
রিয়্যালিটি শো
ঊষসী ভট্টাচার্য



আমাদের মৃত্যু শুধু আসবে বলে একদিন
পাত পেড়ে বসে আছি,
আজকের শুভ মহরতে
আমাদের বেনামী সুখ দুঃখ
রিয়্যালিটি শো, দেখতে দেখতে
টিভি ছেড়ে জীবনের পর্দায় চোখ মেলেছে,
আমাদের জীবনের ছাই ফুরিয়ে এসছে সদ্য,
পোড়া বালিশ,রাজপথ আর চিতার ফারাক
ফুটে উঠছে বানানে বানানে ।
আমাদের এক চিলতে রোজনামচার চাওয়া পাওয়া
আঁতুড় ঘরে উয়া উয়া স্বরে জৌলুষ খুঁজছে,
আমরা তবু অপরেশনে ভয় পাই খুব...
জানি প্রত্যঙ্গ অপ্রয়োজনীয় হলেও
ছিল...
এই স্বর বয়ে বেড়াতে পারব না আর ...
ছিল,
এই আশ্বাস নিয়েই আমরা
বেঁচে থাকতে ভালোবাসি ,
চিতা কাঠ বুকে করে ...

কবিতা - মৌ সেন

0 কমেন্টস্
খেদজন্ম
মৌ সেন



এপাড়া ও বেপাড়ার মাঝে বয়ে যাচ্ছে হিমালয়.
রূপোর পাত্রে পরমান্ন খাচ্ছি .
তোমার ঘরের চালে খড় ছাওয়া হয়নি এ বছর .
আসছে বছরে সাত কাহন খড় বরাদ্দ
গতজন্মের খুদের দাম মেটাতে .
নৌকার সাদা পাল ছিড়ে গেছে.
ছুঁচ নিয়ে দাঁড়িয়েছি পাহাড়ের পাদদেশে .
এ জন্মে সুতো নিয়ে চলে গেছে ময়দানব ,
এ জন্মে বিনিদ্র রাত ,
এ জন্মে রক্তের দ্রুত নীল রং ,
এ জন্মে আকাশের দিকে মাঝ রাতে মুখ তুলে
করুণ সুরে বুক ফাটা আর্তনাদ.
'দা ...দা... আমি বাঁচতে চাই'

কবিতা - অনিমেষ সিংহ

1 কমেন্টস্
সুর হারা
অনিমেষ সিংহ



শব্দ আসছে না কিছুতেই ।
রিনিক ঝিনিক
বৃষ্টি এ আশ্বিনে,
টালমাটাল নদী...!
চোখে এতো জ্বালা সই
ছন্দ আসে না যে ।
দুপুরের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে সকাল।
বীতকাম, না চাওয়ার
যত অসাধ্য সাধন
বিদেশি বাতাস
শনশন বয়ে যায়
প্রাঙ্গণে, অলিন্দে...
যুগপৎ দাঁড়াই ,
বাঁশি নিয়ে গেছে ও পাড়ার শ্যাম-রাই,
কমলে কান্তার সে পথ
বড়ই সুজন হীনা !
কবিতা হাসে না যে আর

আমি পাশ ফিরে শুই

কবিতা - সন্দীপ দাশ

0 কমেন্টস্
যেদিন জানলাম
সন্দীপ দাশ



যেদিন জানলাম,
বুকের ভিতর গভীর ক্ষত, সেদিন,
কোনভাবেই দুঃখ এল না...
মিশে গেলাম জনারণ্যে অনায়াসে।
মানুষের কাছে দাবি করতে গিয়ে
বিলিয়ে দিতে হল সব; অবশিষ্টাংশ
কেড়ে নিল বাকিরা...।

মরীচিকার মত ভাষাহীন চোখ
জল খুঁজছে প্রতিনিয়ত।

শুধু দেখলাম,
যখন সত্যিই দুঃখ এল
তখন, বুকের ভিতর কোন ব্যথা হল না।


কবিতা - রাফসান জানী

0 কমেন্টস্
শরতের দুপুর এবং নারী ও প্রকৃতি
রাফসান জানী



এখন শরতের দুপুর, সূর্য লুকানো দুপুর ।
আমার বাড়ির সামনে নদী
বয়ে চলে উপছানো জলধারা ।
আমি দেখি হাওয়ায় দোল খাওয়া কাঁশবন ।
দু একটা নৌকা পাল তুলে চলে হেঁলেদুলে ।
দেখি শরতের সাজ প্রকৃতি ঠিক তোমার মত,
করে আমায় উদাস, আত্নহারা ।
এপার হতে দেখি ওপারে মিশেছে আকাশের রং ।
শিল্পীর নীপুণ হাতে আঁকা জীবন্ত ক্যানভাস,
এ যেন এক জীবন্ত প্রদর্শনী ।
মুগ্ধ হয়ে হেটে যাই নদীর বাঁকে ।
শরত্ এলেই নদীর ধারে আসি,
তোমায় মনে পরে বলে ।
মনে পরে শরতের এক দুপুরে
হেঁটেছিলাম আমরা নদীর কুলে কাঁশবনে ।
নিঃশব্দ চারপাশে শুধু কাশবনে
আছড়ে পরা শনশন শব্দ কানে আসে ।
এখনো নৌকা ভাসে আমার বালুচরে ,
তাতে তুমি নাই বসে । কাছে থেকেও হারিয়েছ তুমি ।
তোমার পায়ের আওয়াজ পাব
তাই আসি বারবার ফিরে,
এই চিরপরিচিত কাশবনে শরতের দুপুরে ।
খুঁজবো তোমার পায়ের ছাপ ।
আসব বারবার একা তোমায় ছড়া ।
এখন শরতের দুপুর, সূর্য লুকানো দুপুর ।
আমার বাড়ির সামনে নদী
বয়ে চলে উপছানো জলধারা ।

কবিতা - কাশীনাথ গুঁই

0 কমেন্টস্
মোহানা
কাশীনাথ গুঁই



ভাদ্রের বাদলা দিন। ঘোরতর বর্ষণ। একলামনে মানসীরই শুধু আসা যাওয়া। কথা বলা।মনের আড়ালটুকু তোলা।কবি তো বলেই গেছেন, - ‘এমনদিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরষায়।‘




কাল বিকেলে ঘন মেঘে ভয় না পেয়ে যদি আসতে মেলার মাঠে-
ভিজতাম দুজনে একসাথে।
এই মেঘলা আশ্বিনে – যাই যাব বর্ষণে,
তবু দেখা হত আবার সেই ফেলে আসার ক্ষণে।
খুব কি ক্ষতি হত – লোকে হাসত হয়ত,
এমন অসম সিঞ্চনে।
তুমি আমি সমান্তরাল নদী-
ঘোর বাদলে পাড় ভাঙলে যদি একটু আধটু মিলি
দোষ দেখে না কেউ।
সবাই জানে দুই নদীতে মিলবেই এক মোহানাতে ।
সাগর আর নদীর মোহানাতে।
জন্ম নাহয় এক দশকের আগে-
হয়ত কিছু তফাৎ আছে সময়ের ভাবনাতে।
হয়ত সাগরের ঠিকানাটাই দু’জনের কাছে দু’রকম।
তাই ব’লে কি ভাবছ এটাই মনে ,
তোমার আমার মেলার আশা আটকাবে ওই সাগরে?

পুনশ্চঃ লেখার নাঝে মানসীর দূরভাষে ভাবনা সব ফেল্লাম হারিয়ে।

কবিতা - সর্বজিৎ সরকার

0 কমেন্টস্
মনখারাপ
সর্বজিৎ সরকার



দুপুর থেকেই আজ আকাশটা ঘন কালো
পরিবেশটাও থমথমে হয়ে আছে।
বৃষ্টি যে হবেই,তা বেশ পরিষ্কার সবার কাছে!
আমার চোখ তখন জানলার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে-
বাড়ির বেলগাছটার দিকে।
মা চুপ করে ঠাকুরঘরে বসে;
প্রার্থনাহীন এক পাথরের মতো!
আকাশ এমনি ভার যে সন্ধ্যে মিশে গেছে মেঘের সাথে!
ঘড়িতে তখন ছ-টা বেজে সতেরো মিনিট।
ঘরের কোণে রাখা ফোনটা বেজে উঠল তার অস্তিত্বের দাবি নিয়ে!
টেলিফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা এক কান্না চাপা গলা;
বহুদিনের যুদ্ধ হল শেষ!
আমার মাসিমণি ছুটি নিয়ে চলে গেছে দূরে,
আকাশের ওই কালো মেঘের থেকে অনেক দূরে!
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ...
বৃষ্টি বোধহয় মনখারাপের সঙ্গী!
আমি নীরবে ঘরে গিয়ে পুরনো রেকর্ডটা চালালাম।
“ভরা থাক স্মৃতিসুধায়...বিদায়ের পাত্রখানি!”
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল।
মা তখনও ঠাকুরঘরে...অন্ধকারে!
বৃষ্টিরা বাইরে খেলছে তখন মনখারাপের সাথে;
ভেজা মাটির ওপর।
গানের সুরটা যেন তবু মিলে মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়!


কবিতা - মৌসুমী ভট্টাচার্য্য

0 কমেন্টস্
সেদিন শরতে
মৌসুমী ভট্টাচার্য্য



"শিউলি ফুলেরা পড়ল ঝরে শিশিরের আদর মেখে"
একথা শুনেছিলাম এক কবির মুখে,
ভালবেসে বলেছিল চুপিচুপি কানের কাছে ,
গড়েছিলাম স্বপ্নের অট্টালিকা ঘুমের দেশে ,
এঁকেছিলাম আল্পনা চাঁদের উঠোনে ,
জ্যোৎস্নাময়ী গোলাপগন্ধি রাতে
দীপাবলির আলো মেখে যখন তুমি এলে
পরমা প্রকৃতিতে হারিয়ে যাবার দুর্মর বাসনা নিয়ে
উড়েছিলাম গাংচিল হয়ে ,
ভোরের শিশির মেখে দেখেছিলাম
তোমার পূর্ণ রূপ ।
একমুঠো নীলে দুরন্ত বাতাস
আজ শান্ত অধীর প্রতীক্ষায়
খুঁজে বেড়ায় তোমার পদচিহ্ন
ভেজাবালিতে,
সাগর পারে ..


কবিতা - রাজর্ষি ঘোষ

0 কমেন্টস্
আগমনীঃ দেবলীনার কথা
রাজর্ষি ঘোষ



আগের পূজোয় যখন দেবলীনার বাবা বিসর্জন গেলেন
নিমতলার এক কোণে বসে খুব হেসেছি আমি।
হেসেছি... কারণ হাসা ছাড়া কিছু করার ছিল না।

একটার পর একটা লাশ হালকা হিমেল রাতে টাটকা পুড়েছে শ্মশানের কোলে।
পাটকাঠি মৃত্যুর ব্যবসায় দশভূজা ধুয়ে গেলেন আলতো গভীরে।
মা ভৈঃ জলে সেদিন সেকি টান।
পট পট করে নাড়ি ছিঁড়ে গেল চোখের সামনে।
আমি কাঁদতে পারি নি।

একটা ক্লান্ত নিঃশ্বাস বলেছিল ওকে জড়িয়ে ধর।
আমি বুকে নদীর এঁটো জল টেনে নিয়েছি
আর চোখ না মোছার ছলে বারবার হেসে বলেছি
এই দেখ কেমন জোকার সাজতে পারি আমি।

দেবলীনা আমার ছিল না। 
 
 

কবিতা - সুব্রত রয়

0 কমেন্টস্
হয় প্রেমে পড় নয় ফ্রেমে যাও
সুব্রত রয়



তোমাকেও বলি সখি,
হয় প্রেমে পড়ো নয় পথ ছাড়ো
এভাবে রেখো না ঝুলিয়ে
তাল গাছে বাবুইএর বাসা
দিনে রাতে রোদে জলে ঝুলছে তো ঝুলছেই
হয় পড়ো প্রেমে নয় ফ্রেমে যাও
চুমু খেয়ে সায়ানাইড ঠোঁট।

কবিতা - অমলেন্দু চন্দ

0 কমেন্টস্
শুধু আমি জানি
অমলেন্দু চন্দ



বদলে যায়
ঘুলঘুলির ফোকর দিয়ে ছাদ ছোঁয়া বিকেলের রং
প্রতিদিন সাঁঝ বাতি জ্বালাবার আগে
জ্বলে ওঠা নিয়নের আলোয়
বদলে যেতে থাকে টুপ টাপ
সময়ের জলপাই অবয়েব উড়ে যায়
রাত্রির ঘনত্বের ব্যাকুল কঞ্চুকীর ট্রান্সপারেন্ট মহিমায়

কাকেদের বাসায় ফেরার তাগিদ
তাদের ওড়ার শব্দ অদ্ভুত আয়তনবান
অশীতিপরের প্রায় অন্ধ হয়ে আসা চোখে
সন্ধ্যার মত এক সঙ্গোপন সস্ফুট মিনতি
হরদম ঝরে পরে দৃষ্টির কার্নিশে
হরি দিন তো গেল

চিরন্তন তুমি জানলেনা
পৃথিবী এখনও চুপিসারে ভাল থাকে
দেওয়ালের ভ্রান্তিবিলাশ আর সবুজ মাটির মিথে
ভাঙ্গনের জনপদে।

কবিতা - ইমেল নাঈম

0 কমেন্টস্
লিপিবদ্ধ
ইমেল নাঈম



ক্ষয়িষ্ণু সময়ের কথাই বলতে এলাম তোমার কাছে
সম্পূর্ণ পরাজিত জীবনের অপলাপ শুনাতেই
প্রবেশ আমার এ' ঘরে ।
পাতা ঝরার মিছিলে আজ শোনা যায়
কার মৌন পদধ্বনি
কোন সে যুবক আজ সেজেছে অ্যালেকজান্ডার ।
রবিন হুডের মতন কে চুরি করে নিয়ে গেল
অসময়ে ফোটা টিউলিপ আর সোনালী মন ,
প্রস্থানের চিহ্ন ছাড়া ,
পাই নি খুঁজে চিরচেনা মাটির পরশের সাথে
মিশ্রিত হলুদ প্রভা ।
সন্নিকটে আজ বেজে চলেছে গানের সুর
উৎসবের আমেজে পালটে গেছে বাড়িটার রূপ
একটু পরেই এখানে শুরু হবে নতুন অধ্যায় পাঠ
এই পথ ধরে নামবেন সদ্য বিজয়ী অ্যালেকজান্ডার ।
পরাজিতদের চেয়ে বেশি কিছু বলার অধিকার নেই
তাদের একমাত্র কাজ হারানো রাজ্যের গল্প বলা।
গতকাল ঠিক যেভাবে ভুলল আমায়
আজ বাদে কাল তুমিও হারাবে ঠিকানা ,
পরাজিতদের কথা মনে রাখে না মানুষ
ইতিহাসে কখনোই তাদের নাম লিপিবদ্ধ হয় না ।

কবিতা - গৌতম চট্টোপাধ্যায়

0 কমেন্টস্
ভালবাসার চোখ
গৌতম চট্টোপাধ্যায়



যা রে পাগলি,
তোকে আজ মুক্তি দিলাম ধোঁওয়ার গোলায়;
তোর গোলাকৃতি মন কাড়েনি,
স্লিম সিগারেটেই আমি তুষ্ট।
মরা কান্না ন্যাকামো খেলায়,পদক তোর প্রাপ্য।
হাথ কাটবি?ব্লেড আনবো?
পৌরুষ অহঙ্কারে রক্ত সয় ধাঁতে।
পাগলামি তো ঢের জানা আছে,
লক-লক করে অন্য নাগর জড়াবি।

ভালবাসার নামে নিষ্প্রাণ ছোঁয়াছুই,
ঘুঁটি রূপে ফরমাস পালন করি।।


কবিতা - অশোক কুমার গাঙ্গুলি

0 কমেন্টস্
মহা পুষ্পাঞ্জলি
অশোক কুমার গাঙ্গুলি



সপ্তমীর সন্ধ্যাবেলা ,
দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায় ,
তাকিয়ে দেখি এক গাছ ভর্তি সুগন্ধি শিউলি ,
অনেক ভেবে স্থির করলাম মনের মাঝে তাই ,
কাল ওতেই দেব অষ্টমীর মহা পুস্পাঞ্জলি ...
হঠাত বাগানে চোখ মেলতেই দেখি ,
একটা বাচ্ছা ভিকিরি ছেলে ,
একি অকল্যাণ !
আমার সাধের শিউলিগুলি ,
বেটা যাচ্ছিলো তুলে নিয়ে !!!!!!!
দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরে ,
তারে দিলেম কয়েক ঘা !!!
কিন্তু , হতচ্ছাড়া বেয়াদব ছেলে ,
একদম ই কাঁদতে জানে না !!!
আমার চোখে তাকিয়ে বলে ,
“ বাবু , কাল সকালে এই ফুল গুলো ,
যদি বেচতে পারি আমি ,
মেলাই যাব ভাইর সাথে ,
কিনে দেব হরেক রখম খেলনা ,
কিন্তু মা বলেছেন মেলার জিনিস ,
একটু খানি দামী ...
আর কাল বিকেলে ভাই কে নিয়ে ,
সুধু একটু ঠাকুর দেখতে চাই ,
দাওনা বাবু কয়েকটা ফুল ,
আমি ধরছি তোমার পা ই “ ...
সপ্তমীর ঐ সন্ধ্যারতির , ঘণ্টা ধ্বনির তালে ,
মন সাগরে উঠলো জোয়ার ,
বাচ্ছার দুই হাথ ভরাই শিউলি ফুলে ,
ঠিক করেছি এবার আমি ও মা তোমাই বলি ,
“ কাল সকাল হলেই দেবো অঞ্জলি আর ,
তার সাথেই হয় যেন মোর স্বার্থ জলাঞ্জলি “ ...
শুভ শারদীয়ার এই কটি দিন কাটুক সবার ভালো ,
আশীর্বাদ করিস মা গো , সবাই তো সন্তান ,
তাই উচ্চ নীচ সবার ঘরেই জ্বলে যেন আনন্দের-ই আলো ...


দীর্ঘ কবিতা - সঞ্জয় চ্যাটার্জ্জী

0 কমেন্টস্
প্রমত্ততা
সঞ্জয় চ্যাটার্জ্জী



আহ ! এক ঢোঁক খেলাম,
হমমম, বেশ তিক্ততা আছে।
যাক, এবার তাহলে কাজ হবে।
আয়েশ করে পা ছড়িয়ে বসি,
মনে স্ফূর্তি নিয়ে আসি...
এক, দুই, তিন...পাঁচ...আট...দশ...
উঁহু ! হচ্ছে না তো কাজ !!
জলটা বেশি হয়ে গেছে মনে হয় !
এবার একটু বেশি মেশাই,
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
বেশ কড়া লাগছে তো !
এবার ঠিক দাওয়াই হয়েছে !
এক, দুই, তিন...পাঁচ...আট...দশ...
টিক-টিক-টিক-টিক-
ঘড়ির কাঁটা ঘুরেই চলেছে,
আরে ! কাজ হবে কখন !
নাহ ! এভাবে হবে না !
পুরো বোতলটাই ঢালতে হবে !
ঢোঁক, ঢোঁক, ঢোঁক, ঢোঁক-
এবার হবে ! হতেই হবে !
হমমম, বেশ তো,
মাথাটা যেন - মাথাটা যেন কেমন ঘুরছে না...??!!
চোখটা কেমন যেন ঝাপসা !
হা ! হা ! হা ! হা ! কি বলেছিলাম?
বলেছিলাম না, হবেই কাজ !
দ্যাখ, দ্যাখ কেমন কাজ হচ্ছে !
এবার বল ! তখন তো খুব বলেছিলি !
কেমন ! দেখিয়ে দিলাম তো !
গেলাম তো ভুলে তোর কথা !
দিলাম তো, দিলাম তো তোকে,
স্মৃতির আবর্জনা থেকে দূরে ঠেলে !!
এক, দুই, তিন...পাঁচ...আট...দশ...
কিন্তু একি ! একি হচ্ছে !
আমার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে তুই নাচ্ছিস কেন ??
তোকে তো দূর করে দিয়েছি আমি,
স্মৃতির ঘর থেকে চিরতরে !
তবে কেন আমায় ঘিরে ঘিরে তুই নাচ্ছিস??
কেন এখনো আমার রাজপ্রাসাদে,
মাথায় সরতাজ পড়ে তুই আছিস বসে,
আমার মনের সিংহাসনে?
কেন এখনো তোর বাহু দুটি মেলে,
ডাকছিস তোর বুকের সুধার মাঝে?
ভেবেছিস কি? আমি যাব তোর কাছে?
আবার তোকে জড়িয়ে ধরে, মুখ চুম্বন করবো?
আবার তোর ঐ সর্বনাশী চোখের তারায়,
ডুববো দিবা নিশি?
আবার সেই চেনা নাম ধরে,
ডাকব অনুক্ষণ?
তার চেয়ে আমি ডুবে যাব আরও,
সেই মাদক লাল জলে,
আমি ডুবে যাব আরও,
ডুবে যাব আরও, সেই বিষ সলিলে !!
কিন্তু একি?!!
যত বার ভাবি ভুলে যাব আমি,
তুই এসে দানা বাঁধিস এই মনে !
আমি যত ডুবি এই মাদক নেশায়,
তুই ভেসে উঠিস দু নয়নে !
তবে কি ! তবে কি
এই মদের থেকেও, তুই নেশাতুরা?...!!


গুচ্ছকবিতা - শ্রীশুভ্র

0 কমেন্টস্
গুচ্ছকবিতা
শ্রীশুভ্র



(১)
অমৃতকুম্ভের সন্ধানে


বিষাক্ত নদীর ঢেউ ভেঙ্গে
আহত পথে
নারীর কাছে এসেছি
অমৃতকুম্ভের সন্ধানে!
এখানে আসমুদ্রহিমাচল
ষড়ঋতুর আবর্তন!
শষ্যমুখ পৃথিবীর বয়সিনীর মতো হৃদয়ের সবুজে
কেবলই প্রেমের পলাশ দোলে! কৃষ্ণচুড়া আদর দুহাত বাড়ালে সকালের রোদ
আজও সহাস্যে কথা বলে!
এখানে সান্ধ্য জলসার আসরে ঊর্বসীর বিভঙ্গে
মহাকাব্য! মৃদঙ্গে নোবেল শান্তির বার্তা! নূপুরের তালে
সমস্ত মিছিলের ইতিহাস
সংগ্রামের আলপনা হয়ে ফোটে!

এখানে প্রতিশ্রুতির ভোকাট্টা ঘুড়িটা

ব্যাথা আর উপশমের পার্থক্য বুঝতে পারে!
এখানে ক্রুশবিদ্ধ যীশু বিমুগ্ধ আন্তরিক সংলাপে!
শিশুর সহজপাঠ থেকে
সংবিধানের ধারা নারীর ওমে ভিজিয়ে নিলে
এখনো বলা যায়, তুমি সুন্দর! আমি ভালোবাসি!




(২)
অভিসার


মনদূর্বার ঘরে শিশিরবিন্দুর মিছিল, যৌথরাত প্রাত্যহিক
গঙ্গাস্নানের মন্ত্র নিয়ে ঘড়িতে দম দিচ্ছে আজকাল!
কানাঘুষায় গুজবের পাখা ওড়ে

যদি পরচর্চার সরস পরিসরে, তবুও এসময়ে
চক্ষুলজ্জায় কাটছাঁট করাই ভালো!

ম্রিয়মান সংবাদ শিরোনামে নয়,

বিতর্ক মুখে ওড়া যাক ফ্ল্যাশ লাইটের জৌলুসে!

সবুজ পৃথিবী অবুঝ তো নয়!
মানুষের ঘরবাড়ি রিপুর সংসারেই শুধু
মনু-- থেকে থেকে সংহিতা
আওরান! শ্রাবণসন্ধ্যার
আসরে পলাশবাসর
কৃষ্ণচূড়া রক্তিম করে দিলে দিক! মাঝরাত ভরে
অমাবস্যা না-হয় পাহারাই দেবে!

ঠিক! তোমার গোপন উষ্ণতার কৌটোয় আমার
স্বাক্ষর ধরা থাক,
আকাশের উদাসীন নীলে
সমুদ্রের সফেন স্বাক্ষরের মতোন!

তারপর: কাল কি হবে, না হবে, দেখা যাক!



(৩)
মন ফড়িং


সব নারী ঘরে ফেরে না!
সব নদী ডুব সাঁতার জানে না!

পায়ে পায়ে বাঁধন খোলার আয়োজনে

নকশিকাঁথার দুপুর হাতছানি
দিতে থাকে!
নদীর বাঁকে গোধুলির আলপনা

নারীর মনের কথা বলে!

যে নারীরা ঘরে ফেরে না,

যে নদী ডুব সাঁতার দেবে না,

চতুর্দশীর চাঁদে তাদেরও মন কেমন করে!
রাত্রি তৃতীয় প্রহরে
নদীর বাঁকে বাঁকে, শরীরের অপভ্রংশ পূর্বরাগ ধরলে
কুমারী জ্যোৎস্না টলমল করে ওঠে!

স্থির চাঁদ নিষ্পলক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে!

সব সঙ্গম ভালোবাসার জলে ভেজে না!

সব প্রেম প্রজাপতির রঙে ডানা মেলে ওড়ে না!

তবু নদীর ঢেউ আর নারীর ওম দুকূল ছাপিয়ে যেতে চায়!
বর্ষার মেঘে আষাঢ় নামলে
শ্রাবণঘন সন্ধ্যায় ভরে ওঠে
নদী আর নারীর সময়!
তখন কে আর ঘরে ফিরে যেতে চায়!



(৪)
ব্রহ্মকমল!


মধ্যরাতের যোনিতে লিঙ্গের
অযথা কুচকাওয়াজ শুনি!
এখানে নিষিদ্ধ কোরাসে
ভ্রূণের স্বপ্ন জুড়ে
ঊরুসন্ধির নৃত্য!
পৃথিবীর বয়সিনী চন্দ্রকলার
বিবস্ত্র আকঙ্খায়
চিত্রকরের ইজেল জুড়ে
বাৎসায়ণের ভারতবর্ষ!
তবুও নক্ষত্রদোষ ছাড়েনি
আমাকে! বৃশ্চিক সনদে নেই

মেঘদূতের অক্ষরেখা কোনো!
সময়ের বিরুদ্ধ সংঘটনে
অঘটন পটিয়সীর নৃত্য!
গোপন ইস্তেহারের
সুড়ঙ্গ জুড়ে
কুরুক্ষেত্রের দিনলিপি!
হায় প্রেম তোমার মানসসরোবর ঢুঁড়ে
পাইনি ব্রহ্মকমল একটিও!
মালোবিকা সান্ন্যালের
উদ্ধত আঁচলে গভীর দংশন আছে! তবুও মৃত্যুর আগে
নাভিকুণ্ডের ওম সঙ্গম তিমিরে ক্রুশবিদ্ধ হলে
হে নবজাতক, তোমার
ঠিকুজী জুড়ে ব্রহ্মকমল
খুঁজে ফিরো আর এক বার.....



(৫)
ভালোবাসার স্বরলিপি!


জলের দাগে ব্যাথা লিখে
দেখেছি টাপটুপ ইতিহাসের শিরদাঁড়া বেয়ে

বিক্ষোভ মিছিলে বেদনাহত মৌন বাঁশির সুর!
বিশুদ্ধ রাগিনীর ফ্লাগ মার্চের
সকালে রামধনু বৈঠক
মধ্যরাতের খতিয়ান নিলে
বিবস্ত্র হয় লজ্জা!
তবু লাল নীল ওড়নার
সবুজ হাতছানি:
ক্লান্ত দু-তিন পেগ
উসখুস-সন্ধ্যা কখনো
এড়াতে পারেনি!
কালপুরুষের ছায়া ধরে ধরে
অরুন্ধুতী আলোর ডাক
শুনবো বলে কত নারীর
ঠোঁটে উৎকর্ণ থেকেছি সারা রাত!
ব্যস্ত যৌবনের ম্যারাথন
জুড়ে আসমুদ্র হিমাচল-
পাঁজরে দাঁড়ের শব্দে
ভালোবাসার ভগ্ন ইমারত!
মধ্যবর্তী আবেগের দহন জুড়ে আলিঙ্গনের ফাঁপা আওয়াজ মেঘমল্লার নামাতে
পারেনি আজও!
ওদিকে ভালোবাসার স্বরলিপি জুড়ে
নিস্তব্ধ সংলাপ প্রহর গোনে
পথিকের!

আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা - ঋত্বিক দাশ শর্মা

0 কমেন্টস্
শরম লাইগবেক লাই
ঋত্বিক দাশ শর্মা



বছর ধইরে বইসে ছিলম দিনটর জইন্যে
সেই কব্যে তু ডাগর হব্যি... জোয়ান হব্যি...
আজু মুর মুনেটো পরে কেনে... সেইদিনগুলার কুথা...
আদুল গায়ে ছুট্টে জিতাম হেই জংগলে দুজনাতে,
ফরিং,ময়না,টিয়া,আরু কুত কি ধইরে দিতাম তুকে ...তুর বাহানায় কেনে!
মুর সাথে জেইতে তুর শরম লাইগত লাই ...
ছুট্টে জিতম ইখান থিকে উখানে ...
তারপর কুপাই লদিতে ...দুজনাতে,ধুপ ভর ঝাপাইতাম ... নাঙ্গা হইয়ে ...!
সেদিন তুর কুনো শরম লাইগত লাই...।
দুজনায় হাত ধইরে আলটর উপর দিয়ে ঘরকে জিতাম কেনে,
তুদের দাওয়াতে পানি ভাত খেইয়ে ...
মুদের শিমুল গাছটর তল্লায় গুল্প কইরতে কইরতে
কুখন যে দুজনায় গায়ে গা লাগায়ে ঘুমায়ে পইরতম
শরন লিত লাই... তুর কুনোও শরম লাইগত লাই ...।
কুনদিন বাদলা দিনে ভিজতে ভিজতে যুখন সিল কুরাইতাম কেনে
হটাত বাজটর আওয়াজে ডরে তু মুকে জরায়ে লিতিস ..
তবু সেদিন তুর কুন শরম লাইগত লাই ...।
তুকে লিয়ে সেদিন...উনেক স্বপন দিখতম ...
বিহা কুরব, লাচ কুরব, হাঁড়িয়া খাব, গানা হুবে ...
আরু কুত কি হুবে ...!
কিন্তুক মুর বাপটো কেনে ...মুকে পাঠায়ে দিল সহরে
লিখা পুড়া করার লাইগ্যে, বড় মানুষ করার লাইগ্যে...
মু চইলে জিলাম তুর থেইক্যে উনেক দূরে ...!
গাঙ ফিরলম দস বচ্ছর পর...
ফিরে দিখলম কেনে...কিচ্ছু লাই !!!
সেই জঙ্গল টো আর লাই...
থিকাদারের মানুষ গুলা সব কাইটে লিছে কেনে !!
সেই কুপাই লদি টো আর লাই ...
উয়ার জল সব সুকায়ে গিছে কেনে !!
সেই সিমুল গাছটো আর লাই ...
কুন একদিন বাজ পইরে উ মুরে ট গিছে কেনে!!
মুর সে ছুট্ট মিঠা ফুলমনিটো...অ ভি আর লাই কেনে ...
ডাগর ফুলমনিটোর বিহা হইছে... হাবা মংলুর সাথে !!!
তুর আজ সরম লাগে মুদিকে তাকাইতে কেনে ...
তুর আজ সরম লাগে মুর কাছে আইস্তে কেনে...!!!!
বচ্ছর ধইরে বইসে আছি দিনটর জইন্যে
সেই কব্যে তু ইকা হব্যি... বুহ্রা বেটি হব্যি !!!
শরম লাইগবে লাই ...!

রম্য কবিতা - মানস বিশ্বাস

0 কমেন্টস্
অভিনব খাই-খাই
মানস বিশ্বাস



খাই খাই কোর নাকো বসে যাও চেয়ারে।
রান্নাটা কিরকম টের পাবে এবারে।
রাঁধুনী সে রন্ধনে অতি পটিয়সী,
হাতার বদলে তার হাতে আছে অসি।
আহার ভোজনে যারা নয় তত দক্ষ,
তাদেরও গেলাতে পারে ভক্ষ্য-অভক্ষ্য।
কলমীর রস দেয়,দেয় চায়ে নুন,
খেয়ে দেখো এ চায়ে আছে কত গুন।
দুধ জ্বাল দিয়ে তাতে রসুন ফোড়ন,
না খেলে যায় না বোঝা এ চীজ কেমন।
পায়েসে আদা বাটা রেসিপি নতুন,
খেলে তবে বুঝবে রাঁধুনীর গুণ,
মুরগীর দুধ আর বাছুরের ডিম,
খেতে বসে মাথাটা যে করে ঝিমঝিম।
পেঁয়াজের রস আর হলুদের বাটা,
বানায় পরোটা দেখি নেই তাতে আটা।
কাঠাঁলের খোসা দিয়ে লঙ্কার বড়ি,
লা-জবাব খাবার রে, আহা মরি মরি।
বালি দিয়ে ডাল আর পাথরের ডালনা,
পাঁচতারা হোটেলে খুঁজলেও পাবে না।
আর কিছু দেব নাকি?শুনে বলি, “বাবারে!
এবার রেহাই দে, দয়া কর আমারে।“
গুড়গুড়ি রাঁধুনীটা একেবারে শিশুরে,
খাওয়াটা কেমন হল বোঝা যাবে ঢেঁকুরে।

অনুবাদ কবিতা - মালঞ্চ দাশগুপ্ত

0 কমেন্টস্
অনুবাদ

মূল কবিতা :
Manawydan’s Glass Door (d’après David Jones, 1931)

মানাউদানের শার্সি

অনুবাদ : মালঞ্চ দাশগুপ্ত


পৃথিবীর এ প্রান্ত শান্ত, নির্বিকার,যেন ঘটেনি কিছুই,
তাই ভাঁজ করে রাখা কোটের মত
অলস সময়ও যেন শান্তিতে ভাঁজ হয়ে পড়ে আছে,
সুযোগের অপেক্ষায়।

কাঁচের দরজার ওপাশে দৃশ্যমান অশান্ত সমুদ্র,
সূর্য্যের আলোকে প্রতিফলিত করছে অনন্তের সন্ধানে,
অস্বচ্ছ দেওয়ালে বাঁধা পেয়ে ঝলমলাচ্ছে সে প্রতিবিম্ব,
তেমনি শান্তির খোঁজে ভ্রাম্যমান আমার দৃষ্টিও মাথা কুটে মরে
গারদের বদ্ধ প্রাকার আর অভয়ারণ্যের মুক্ত প্রান্তরে।

হাতলবিহীন কাপে যেমন কিনারা নেই,
সমুদ্রে ভাসমান জাহাজে নেই যান্ত্রিক কোলাহল,
তেমনি নীল দুঃখবিলাসে আর্দ্র আমার জীবনখাতাতেও
শান্তির লেশমাত্র নেই।



ছোটগল্প - অভিলাষা দাশগুপ্ত আদক

0 কমেন্টস্
অন্য অপু-দূর্গা
অভিলাষা দাশগুপ্ত আদক


ভাইফোঁটার দিন জন্ম বলে চাটুজ্জেবাবুর মেয়ে শিউলি (মানে দুগ্গা) ওর ছোটভাই শরতকে (মানে অপুকে) নাম ধরে না ডেকে ‘ভাই’ বলে ডাকত। তাই থেকে অপুকে পাড়ায় অনেকেই ভাই বা ভাইদা বলে। গোড়ার দিকে অপুর অভিমান হত, ভাবত ওর দিদি বুঝি ওর নামটাই জানে না কিন্তু এখন এই ক্লাশ ফাইভে উঠে বোঝে ওটা দিদির আদরের ডাক।অপুর আবার দিদি অন্ত প্রাণ,পিঠোপিঠি কিনা, যত ভাব তত ঝগড়া।তবু দিদিকে বড্ড ভালবাসে অপু।এই যেমন এবার পূজোর আগে তাল ধরেছিল অপু, ওর একটা লাল টুকটুকে রেসিং সাইকেল চাই,তার বদলে পূজোর জামাকাপড় হাতখরচা কিছ্ছু চাইনা। কিন্তু মায়ের কানের কাছে গুনগুন করলেও বাবাকে বলার সময় কিন্তু ‘দুগ্গা সহায়’।এমনিতে শান্তশিষ্ট ছেলেটার দু’টোই নেশা। এক সাইকেল, দুই ফুটবল। বিশেষত একসময়ের স্পোর্টং ইউনিয়ানের নিয়মিত স্ট্রাইকার গৌতম সাধুখাঁ ওদের স্কুলের গেমস টিচার হয়ে জয়েন করে একই পাড়ায় ঘরভাড়া করেছেন আর সকাল সন্ধ্যা পাড়ার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে মাঠে নামছেন বলে নেশাটা আরো বেড়েছে।চাটুজ্জেবাবু ব্যাঙ্কে চাকরী করেন। স্ত্রী রমাদেবীও প্রাইমারী স্কুলটিচার। মেয়ের আবদারে ছেলেকে সাইকেল কিনে দিলেও শর্ত করিয়ে নিয়েছেন দুবেলা পড়তে বসতে হবে।

ভাইফোঁটার দিন সকালে বাগানের দূর্বাঘাসের ওপর থেকে চন্দন বাটবে বলে শিশির তুলতে তুলতে দুগ্গা দেখলো পাশের বাড়ীর পিন্টুকে ক্যারিয়ারে বসিয়ে গেট খুলে বেরোচ্ছে অপু।

- কোথায় যাস ভাই এত কালে?

- মাঠে রে দি’ভাই, স্যার বলেছেন আজ টিম সিলেক্ট হবে।

- আজ ভাইফোঁটা, না গেলে নয়? তোর জন্মদিনের নারায়ন পূজোও তো আছে।

- এই যাবো আর আসব। প্রমিস, আজ খেলবনা। দ্যাখ না তোর বানানো পূজোর নীল কাঁথাকাজের পাঞ্জাবীটা পড়েছি।এ পড়ে কেউ ফুটবল পেটায়? টিমে সিলেক্ট হলেই চলে আসব।

- তাড়াতাড়ি আসিস কিন্তু।

কে জানত এ যাওয়াই ছেলে দু’টোর শেষ যাওয়া।গলি থেকে বেরিয়ে খোলা রাস্তায় উঠতে না উঠতে একটা মালবোঝাই ডাম্পারের মুখোমুখি। কারোরই কিছু করার ছিল না।আইনি ঝামেলা মিটিয়ে মা দিদির বুকফাটা কান্নার মধ্য দিয়ে অপুকে যখন সবাই শেষযাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে, তখন নারায়ণ পূজোর জন্য সাজানো ঠাকুরঘরে বিগ্রহের সামনে দুগ্গার সাজানো ভাইফোঁটার থালায় রাখা প্রদীপটা জ্বলতে জ্বলতে তেল ফুরিয়ে কালো হয়ে নিভে গেছে।

ছোটগল্প - হরি শংকর রায়

0 কমেন্টস্
অশ্রুজলে ভাসি
হরি শংকর রায়



মাঝ নদীতে নৌকাখানা আটকে গেল।
 
হ্যাঁ ! আমি তিস্তা নদীর কথা বলছি।
 
আজ সন্ধ্যায় যখন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ থানার কাকিনা হয়ে চর ভেঙে-ভেঙে গংগাচড়ার মহিপুর ঘাটে আসছিলাম তখন অদূরে মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ জলের সাথে আপন মনে খেলছে।

আহা ! কী অপরূপ !

মাঝি বলল, নৌকা আটকে গেছে।
 
সত্যি বলছি, হিসাব মেলাতে পারছিলাম না।
 
আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা। এই হলো আমার হাঁটুজল ভাঙা সাধের তিস্তা নদী। ও নদী ! তুমি কাঁদো ! আমি অশ্রুজলে ভাসি।

ধারাবাহিক উপন্যাস - অলভ্য ঘোষ

0 কমেন্টস্
পর্ণমোচী
অলভ্য ঘোষ



প্রথম পর্বের পর……..


কামাল কে ধাক্কা মেরে দু পা পেছনে সড়ে দাঁড়িয়ে ছিল মালতী । -"হাতে চুড়ি পড়ো গে । পুরুষ হয়ে জন্মেছো একটা মাইয়া মানষের রক্ষা করনের ক্ষমতা নাই । তবে জেনেরাই-খ তোমারে নাপাইলে আমি বিষ খাব । "

কামালকে ঝাঁকিয়ে কামালের শত-ছিদ্র জামাটা মুঠ থেকে মুক্ত করে কাঁদতে কাঁদতে দ্রুতগতিতে ছুটে পালিয়ে ছিল মালতী। পেছনে পুকুর ঘাটে পড়েছিল মালতীর কৈশোর;কামাল আর তার গ্রাম । দিনের শেষে সন্ধে রাতের অন্ধকারের আধিপত্য বিস্তার করে বসছিল তিলে তিলে ।

সানাই এর সুর তখনো অনুরণিত হয়ে চলেছিল মালতীর কর্ণ গহ্বরে । দুই হাতে কান চেপে অভিজাত বনেদি একটি গৃহের সুসজ্জিত ফুলাচ্ছাদিত বিছানার এক পাশে বসেছিল মালতী । পরনে লাল বেনারসি । চোখ দুটো অশ্রু প্লাবনে ফোলা । দরজার কপাটের আঘাত হল । বাইরে থেকে প্রায় ধাক্কা খেয়েই ঘরে প্রবেশ করেছিল বিপিন । বিপিন মালতীর বর । একদিন আগে সবে এদের নব দাম্পত্য জীবনের শুভ সূচনা হয়েছে । সোহাগ রাত ;মালতী সঙ্কুচিত । সে কামালের কথা ভাবছিল । হটাৎ তার ভাবনার প্লাবন ভেঙে হয়েছিল বিপিনের সে ঘরে প্রবেশ ; দরজায় খিলের আওয়াজ টা বুকে বেজেছিল বাজ পড়ার মত। মালতীর বুক ধড়পড় করছিল । তার খুব কাছে এসে বসেছিল বিপিন । বিপিন যত চাইছিল দূরত্ব কমাতে । মালতীর ততো ইচ্ছে করছিল মৃত্যু তার সহসা উপস্থিত হোক । এক মাত্র মৃত্যুই কার নিমন্ত্রণ রক্ষা করে না । আত্মহনন করতে গেলেও মানুষ ব্যর্থ হয় । যদি মৃত্যু না স্বেচ্ছায় হননকে উপসর্গ করে আসে । বিপিনের হাতে অপসারিত ঘোমটার আড়ালে মালতীর লক্ষ্মী মূর্তির মত মুখ খানা উন্মোচিত হতেই ; মালতীর সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল ;হাতের মুঠো আলগা হয়ে সবুজ তুঁতের ডেলাটা খসে পড়েছিল বিছানায় । মালতী চোখ বুজে নিলে রাঙ্গা ঠোঁট দুটো তার আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল ভয়ে । শিকারির করপুটে বন্দি কবুতরের মত তার বুক ধড়পড় করছিল তখনো ।

-"আমারে দেইখো ।" প্রথমটা লজ্জা পেলেও ;প্রস্ফুটিত কুড়ির মত চোখ মেলে তাকাতে হয়েছিল মালতীকে । কৃষ্ণবর্ণ বছর পঁচিশের বলিষ্ঠ যুবক বিপিন সোহাগ রাতের প্রেমালাপের বাইরে বেড়িয়ে ছোট্ট মেয়ে মালতীকে সংসারে তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য গুলো সম্পর্কে মাস্টারের মত জ্ঞান দিয়ে চলেছিল। আর কোনে বৌ মালতী বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নেড়ে সায় দিতে দিতে এক সময় ঘুমে ঢুলছিল । গার্হস্থ্য জীবনের মালতী তখন কিছুই বোঝে না । বোঝার কথাও না । তবে এটুকু বুঝেছিল তার স্বামী বাবাজীবনটি কামালদার মত গোবেচারা নয় রাশভারী গম্ভীর ।বাবা মায়ের কনিষ্ঠ পুত্র বিপিন । সে চাইছিল যে সুখ,স্বাচ্ছন্দ্য,সেবা তার বাবা মা তাদের পুত্রবধূর কাছে প্রত্যাশা করে বসে আছেন তা থেকে যেন বঞ্চিত না হন । সংসারের নিয়ম কানুন ;নীলের বাতি,শিবরাত্রি, বিপদ তারিণী একের পর এক শৃঙ্খলে সেদিন থেকেই আবদ্ধ হয়েছিল মালতী । লক্ষ্মী ; লক্ষ্মী প্রতিমা । কুমোরপাড়ায় অর্ডার দিয়ে যেমন টি মনগড়া মেলে । মালতীকে ঠিক তেমনটি হতে হয়েছিল । পান থেকে চুন খসলেই ছিল শাশুড়ির মুখ ঝামটা । রাতে তার লোকটা আদর করতো খুব ;ঘাসের গায়ে ভোরের শিশির যেমন সূর্যের প্রকটতায় উবে যায় তেমনি কামালের প্রেম উবে যাচ্ছিল মালতীর জীবনে বিপিনের উষ্ণতায়।

সমস্ত ঘরটা অন্ধকার । ঘর ঠিক বলা যায় না ঝুপড়ি । চেঁচাড়ি,বাঁকারি,টিন,টালি,ইট বহুবিধ উপকরণের সমন্বয়ে নির্মিত মাথা ছাওয়ার জায়গা । একটা ছোট্ট তক্তপোশ ,কয়েকটা বড় বড় পুটলি ,একটা টিনের বাক্স ,দেওয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডার ,ঘরের এক কোনে রাখা কালো পোড়া মাটির ছোট্ট একটা খাবার জলের কুঁজো । ঘরে আসবাবপত্র কম হলেও সব কিছু বেশ পরিকল্পনা মাফিক রাখাছিল ।শিশু কন্যা সহ মালতী ঘুমচ্ছিল তক্ত পোষের ওপর । কোয়া বিন্যস্ত কাঁঠালের গন্ধে মাছি যেমন ভনভন করতে করতে ছুটে আসে ;তেমনি ফিসফিস কথোপকথনে ;ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজে পিচের ড্রামের তৈরি বন্ধ দরজা ফাঁক করে ;মোমবাতি হাতে অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করেছিল স্ফীত কায় মাঝ বয়সী এক ভদ্রমহিলা সহ গিলেকরা পাঞ্জাবী পরিহিত এক বাবু গোচের ভদ্রলোক । মেয়ের গায়ের ওপর থেকে মালতীর অবশ হাত সরিয়ে ঘুমাচ্ছন্ন তার মেয়েকে মোমবাতি মাঝেতে রেখে ঝুঁকে পোড়ে কোলে তুলে নিয়েছিল মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা । মালতী বিন্দু মাত্র বুঝতে না পেরে পাশ ফিরে শুয়েছিল । আঁচল টা বুক থেকে খসে পড়ায় রংচংয়ে গাজনের সং এর মতো বাবুটি একদৃষ্টি সে দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল । বাচ্চা কোলে সেদিকে তাকিয়ে গলা খাঁকড়ানি দিয়ে স্ফীত মহিলা টি বলেছিল; -"কই টাহাটা দাও দেখি । " লোকটা গেঁটের থেকে টাকা বাড় করেদিলে ;ভদ্রমহিলাটি অদ্ভুত এক নিপুণ ভঙ্গিতে বাচ্চা কোলে টাকা গুনে কমতি অনুভব করায় আর দশ টাকা বকশিস না ঘর ভাড়া দাবি করেছিল। মুখের সামনে কাবাব ; বাবুটি দরাদরিতে না গিয়ে আর দশ টাকা বারকরে দিলে ;তুষ্ট হয়ে টাকা আঁচলে বেঁধে মেঝে থেকে মোমবাতি টা তুলে বাচ্চা কোলে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিল মহিলা টি । বিছানার ওপর ছিল শিকার । টিনের দরজায় ছিটকানি এঁটে বাবুটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ক্ষুধার্ত হায়েনার মত মালতীর ওপরে । ঘুম ভাঙ্গা মালতী অন্ধকারে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা ছোবল মারতে শুরু করেছিল । ঘন নিশ্বাসের আওয়াজের সাথে তক্তপোষের ক্যাচ ক্যাচ ভেঙ্গে পড়ার সঙ্গত যখন ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করেছিল বাবুটির গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বাবুর শরীরের কোন নরম স্থানে কামর বসিয়ে দিয়েছিল মালতী ।

অর্ধ অবচেতন ;অনাবৃত বস্ত্র,এলোমেলো চুল,রক্তাক্ত শরীর মালতী হেঁটে চলেছিল নিস্তব্ধ গ্যাস পোস্টের আলোছায়া ঘন বড় রাস্তা ধরে । দিশেহারা !কোথায় কোনদিকে কেন হাঁটছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না মালতী । সহসা একরাশি আলো তার মুখ স্পর্শকরে ;মালতী মাথা ঘুরে লুটিয়ে পড়েছিল রাস্তায় । একটা মোটর কার সবেগে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে ছিল তার সামনে । কার থেকে নেমে এসেছিল এক বয়স্ক ভদ্রলোক চোখে চশমা,মুখে কাঁচা পাকা এক রাশ দাঁড়ি । -"কে মা তুমি ?" লোকটা মালতীর বাঁ হাত তুলে হৃদস্পন্দন খুঁজেছিল । মারা যায় নি মালতী তখন জ্ঞানশূন্য । জনশূন্য রাতের রাস্তায় লোকের অনুসন্ধান করে ব্যর্থ হলে উপায়ন্তর না দেখে ভদ্রলোক মালতী কে চাগিয়ে তুলেছিল নিজের মোটরে ।

ভোরের আলো সবে মাত্র ফুটেছিল । রাতের বড় রাস্তার মোটর গাড়ী টা এসে থেমেছিল কালীঘাটের এক বস্তি পাড়ার মুখে। কার থেকে সেই বুড় ভদ্রলোকটির সাথে নেমে দাঁড়িয়ে ছিল মালতী । চোখ মুখ তখনো উসকো খুসকো কেবল পোশাকের পরিবর্তন হয়েছিল তার । গায়ে ছিল একটা দামী শাড়ি । যা কেনার ক্ষমতা তার ছিলনা; ভাবার ও অবকাশ ছিলনা সেটা তাকে মানাচ্ছে কিনা । মালতীর সাথের ভদ্রলোক চারিদিকে চেয়ে বুঝে গিয়েছিল যে আচরণ মালতীর ওপর করা হয়েছিল তা সে পাড়ায় ছিল খুবই স্বাভাবিক । নিষিদ্ধ পল্লীটির আনাচে কানাচে সেই সকালেও কয়েকটা মেয়ে তীর্থের কাকের মত ছিল দাঁড়িয়ে । রাস্তার কলে স্নান করা অর্ধ-নগ্ন পুরুষদের ভিড়ে কোন কোন মেয়ে মুখে দাঁতন নিয়ে অপেক্ষা করছিল মুখ ধোবার জন্য । মালতী আগে আগেই যাচ্ছিল । তার পেছনের বাবুটির দিকে দেখছিল সকলে । একটা ঝুপড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরেছিল মালতী । বালতি হাতে মেদপূর্ন বেঁটে গোছের গত দিনের রাতের দালাল মহিলাটি এগিয়ে এলে মালতী বলেছিল ; -"আমার পোলাপান কই ।"

মালতীর সাথের ভদ্রলোকটির দিকে রহস্যপূর্ণ ভাবে তাকিয়ে মহিলাটি জিজ্ঞেস করেছিল ।

-"ইনি কেডা । বাবু নাকি ?" –

- "আমি ডক্টর চিন্তামণি সরকার । আপনি নিশ্চয়ই মেঘমায়া দেবী ?" –

"আপনার চিন্তে ভুল হয় নাই চিন্তামণি বাবু । তবে আপনার সঙ্গের মাইয়াটারে কতটা চেনেন ?" -"কাল রাতে একটা পেসেন্ট দেখে ফেরার পথে এই মেয়েটা আমার গাড়ীর সামনে পড়ে ;প্রথমটা আন্দাজ করেছিলাম পরে ওর কাছ থেকে বুঝেছি ওর ওপর নির্যাতন করা হয়েছে । "

মালতীর চিবুক বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছিল । কত মেয়ের অশ্রু রাশিতে সিক্ত এ পাড়া তার খবর কোন দিনই জানতে পারেনা মালতীর মত মেয়েরা ।বাঁকা চাউনিতে চেয়ে মেঘমায়া বলেছিল ।

-"আর কী জানেন । "

কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে চিন্তামণি সরকার মালতী সম্পর্কে যা জেনেছিল এক এক করে বলে যাচ্ছিলেন । ওপার বাংলা থেকে পাঁচ বছরের ছেলে ও ছয় মাসের শিশু কন্যাকে নিয়ে সবে মাত্র কলকাতার মাটি ছুঁয়েছিল মালতী । তার স্বামীর ;মালতীর কন্যা সন্তান জন্মাবার কয়েক দিন আগেই দাঙ্গায় প্রাণ যায় । বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল দাঙ্গাবাজরা । লুট করেছিল ধানের গোলা । প্রাণের তাড়নায় এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে;কাঁটাতার টপকে মালতী ইন্ডিয়াতে ঢুকেছে চোরের মত । দূরসম্পর্কের মাসি মেঘমায়া দাসের বাড়ি কলকাতায় ছুটে এসেছিল একটু আস্তানার অভিলাষে । চিন্তামণি গড় গড় করে বলে যাচ্ছিলেন ।

-"আর আপনি তাকে দিয়ে......"

মেঘমায়া বলেছিল; -"ব্যবসা করায়েছি । " –

"আপনার লজ্জা করছেনা বলতে ।" –

"লজ্জা করনের তো কিছুনাই । এইডা ভদ্র পাড়া নয় । এইহানে মাইয়ারা দেহ বেইচাই গ্যালনের জোগাড় করে । ওর মত মাগী এইহানে অনেক আছে কেউ পালায় নাই সতী হতি । "

রাগে চিন্ময় সরকারের ফরসা মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল । -

"জানেন আপনাকে আমি পুলিশে দিতে পারি । " –

"ওটি কইরবেন না লাভ হইব না । " –

"ওর ছেলে আর মেয়েটাকে দিন । আমি এখান থেকে নিয়ে যাব ওদের ।" –

"দেহেন চিন্তামণি বাবু রাগ করেন কেন । মাথা ঠাণ্ডা করেন । " ঠোঁট টাকে দাঁতে চেপে মেঘ মায়া দেবী স্বভাব সিদ্ধ ঢংয়ে ফিস ফিস করে বলেছিলেন ; -"সাদ লওয়ার বাসনা জাগিসে তা নেন না । মাইয়াটারে ভাগায়ে আমার ব্যবসা ডোবান কেন। "

প্রবল বজ্রবেগে ধমক দিয়ে উঠেছিল ডাক্তার চিন্তামণি । মহিলা না হলে চর কষিয়ে দিতেও হয়ত দ্বিধা করতেন না । মেঘমায়ার মেদাক্ত কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছিল ;এটুকু বুঝতে তার আর অসুবিধা ছিলনা যে এ বাবু টি এ পড়ায় দেহের সওদা করতে আসেনি । এসেছে এক প্রবল মানবিক টানে । চিৎকার চেঁচামেচি তে আসে পাশে বেস কিছু লোক জমে গিয়েছিল । মেঘ মায়া বোধয় বিপদের আসংখ্যা করছিলেন । ভয় পাচ্ছিলেন শেষ মেষ মেয়ে পাচারের দায়ে বুড়ো বয়সে হাজত বাসের । তাই হাঁক পেড়েছিলেন;

-" মেনকা ....ও মেনকা ও দুটারে লইয়া আন । "

মেনকা আবির্ভূত হয়েছিল তার কোলে মালতীর ছয়-সাত মাসের শিশু কন্যাটি মায়ের অনুপস্থিতি তে নির্দ্বিধায় পুপসি বোতলে দুধ খাচ্ছিল । মেনকার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে ফেল ফেল করে সবার মুখের দিকে দেখ ছিল মালতীর হাড় জিরজিরে নাক থেকে সিকনি ঝরে চলা ছেলে টা । মালতী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে প্রায় ছো মেরে ছিনিয়ে নিয়েছিল মেয়েটাকে ;বিশ্বাস , আস্থা ,ভালবাসা,স্নেহ ,মমতা বাংলাদেশের দাঙ্গাবাজ লোক গুলোর মত মালতীর মাসির হৃদয়ে ছিটে ফোটা নেই ;এক রাত্রির ব্যবধানে মালতী বুঝে গিয়েছিল । সদ্যজাত বাছুর কে গাই যেমন চেটে চেটে মাতৃত্বের স্নেহে সুরক্ষার অনুভূতি প্রদান করেন ;তেমনি মেনকার অসুরক্ষিত আঁচল ছাড়িয়ে বসে পড়ে বাঁ হাতে নিজের ছেলেকে বুকে চেপে ধরে তার শুষ্ক মুখে চোখের জল আর চুম্বনের রেখায় মালতী মাতৃত্বের স্পর্শ তুলে দিচ্ছিল। চির মাতৃত্বের পূজারী ভারত বর্ষ যে খবরের পাতায় পাতায় ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের আখরা হয়ে উঠেছে সে কথা ভেবে শিউরে উঠছিল চিন্তামণি । ভোগ যত বাড়বে ;মানুষ ততোই পণ্য হবে ; হবে বিপন্ন । বুঝতে পেরেছিলেন তিনি । যে প্রগাঢ় তীব্র স্নেহ মালতী তার সন্তান দ্বয় কে প্রদান করছিল তা অনেক কঠিন হৃদয় কেই গলিয়ে দেয় চক্ষু সজল হয়ে ওঠে । কিন্তু মেঘ মায়ার মায়া বর্জিত কসাই হৃদয়ে মালতীর এই সন্তান প্রীতি বিন্দু মাত্র মমতার সঞ্চার করতে পারছিল না । তার বাঁকা হাসি টি এ সব কিছুকেই ঢং বলে চিহ্নিত করে চলেছিল ।

মালতীর শেষ সম্বল হয়েছিল ডাক্তার চিন্তামণি কর । দেবদূতের মত এগিয়ে এসে মালতীর মাথায় হাত রেখে নিজের বাবার মত মালতী কে বলেছিলেন ; -"চল মা । "

এ হাত সকলের কপালে জোটে না । জুটলে এ পৃথিবীর অনেক অসহায় মানুষের সাহারা জুটে যেত ;অনেক বেদনার ভার হতো লাঘব ।

চারটের ঘণ্টাটা ঢং ঢং করে বেজে উঠলো । দূরে নামাজ পাটের আওয়াজ দিদুন কে নিত্যদিনের মত বিছানা ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। দিদুন চোখ মেলে তাকাল । ভেন্টিলেটর থেকে কয়েক ফোটা আলো চুইয়ে ঢুকছে ঘরে। ক্ষীণ হলেও দিনের আভাস টুকু প্রদানের ক্ষমতা এর যথেষ্ট । দিদুনের দুচোখ ভেজা । কাল রাতে মিতার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পুড়ন অ্যালবামের ঘোলাটে ছবি গুল স্মৃতির পৃষ্ঠা উলটে পালটে দেখেছে সে । বিছানায় পিঠ রাখার আর উপায় নেই । দেরি হয়ে যাবে । জল তুলে দুধ আনতে যেতে হবে দিদুন কে । বাজার টা ছেলেই করে । বৌমার রান্নার যোগার করে স্নান সেরে ঠাকুরের জল বাতাসা দিয়ে আহ্নিক করে কাজে বেড়য় দিদুন। একটা প্রাইমারী স্কুলে বাচ্চা দেখা শোনার কাজ করে সে। স্কুল থেকে ফেরার পথে সেলাই । টালিগঞ্জের এই দোতলা বাড়ির ছাদ আর স্কুলের কাজটা ডাক্তার চিন্তামণির দৌলতেই দিদুনের পাওয়া । চিন্তামণি সরকার আজ আর এ পৃথিবীতে নেই । বছর কুড়ি হল মারা গেছেন । দিদুনের মাথার ওপর তার সাদা কালো আবছা অস্পষ্ট ছবিটা বাঁধাই ফটো ফ্রেমে ঝুলছে । ছবিটাকে রোজকার মত ঘুম থেকে উঠে প্রণাম করেন দিদুন । নিজের বাবার মত শ্রদ্ধা করতেন দিদুন চিন্তামণি সরকারকে । ছবির ওপর শুকনো একটা রজনীগন্ধার মালা রূপ-রস ,যৌলশ হারিয়ে মাকড়সার সাম্রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত । দিদুন বিছানা ছেড়ে ঘরের দরজা খোলে । ভোরের আলো দ্বারস্থ অতিথির মত অভ্যর্থনা পেয়েই আসন গেড়ে বসল । অস্পষ্ট ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । দিদুন এগিয়ে যায় ছবিটার দিকে । কত চড়াই উতরাই পেড়িয়ে সেদিনের গ্রাম্য মেয়ে মালতী আজ মিতার দিদুন হয়েছে । শুকনো মালাটার মত সে শুকিয়েছে । তবু ঝড়ে পড়েনি । মাকড়সার জালের মত তাঁকে ধরে রেখেছে ছেলে ,মেয়ে ,বৌমা ,নাতনি এ সংসারের জটিল জটলাগুলো ।

গভীর দৃষ্টিতে দিদুন ছবিটার দিকে চেয়ে থাকে । একটা সুখ স্মৃতি জেগে ওঠে । - সর্বহারা মালতীর মাথায় হাত রেখে ছবির মধ্যকার ভদ্রলোকটি । তার স্নেহ আপ্লুত কথায় পিতৃ প্রেমের আভাস ।

-" তুই নাই বা হোলি আমার ঔরসজাত । তবু-তো আমি তোর নব জন্মদাতা । আমাকে তুই বাবা বলে ডাকতে পারবিনা-মা ! "

মালতী চোখের জল আর সামলে রাখতে পারেনি । -"বাবা..." বলে কাঁদতে কাঁদতে নব পিতার দু পা জড়িয়ে ধরেছিল ।

ভগবান তাকে ধন ঐশ্বর্য কিছুই দেননি দিয়েছেন চোখের জল । সুখে দুখে মনি মাণিক্যের মত তাই মালতী ও গুলোই খরচা করে । অন্যের কাছে তার চোখের জল সামান্য হতে পারে তুচ্ছ হতে পারে ;তবে মালতীর কাছে তা হৃদয় নিংড়ানো এক মাত্র সম্বল ।

দিদুনের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে মিতার ঘুম ভেঙ্গে যায় । বিছানা ছেড়ে পিছন থেকে দিদুনের কাঁধ স্পর্শ করে সে । ঠিক সেই সময় শিয়ালদাগামী প্রথম লোকালটা রেফারির মতো হুইসেল বাজাল । মিতার দিকে ঘুরে তাকায় দিদুন । সে বুঝতে পারে বেলা হয়েছে ;আর সময় নষ্ট করলে দেরি হয়ে যাবে স্কুলে ।

(চলবে)

প্রবন্ধ - মৌ দাশগুপ্ত

0 কমেন্টস্

কুসংস্কার ও আমরা
মৌ দাশগুপ্ত




কুসংস্কার বিরোধী কর্মী নরেন্দ্র দাভোলকার স্বভাবে ছিলেন আজীবন লড়াকু৷ তাঁর নেতৃত্বেই মহারাষ্ট্রে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল আন্দোলন৷ বাধ্য হয়েই মহারাষ্ট্র সরকার কুসংস্কার এবং কালো জাদু বিরোধী আইন আনায় সম্মতি দিয়েছিল৷ সেই সমাজসেবী নরেন্দ্র দাভোলকারের মাথা ফুঁড়ে দিল আততায়ীদের ঘাতক বুলেট৷ সময়টা খুব পুরানো না। মাত্র ২০শে আগস্ট ২০১৩। যুক্তিবাদ, সংশয়বাদ, মানবতাবাদ, নাস্তিকতা কিংবা ইহজাগতিকতার মত আধুনিক ধারনাগুলো সমাজ সচেতন মানুষের কাছে ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু তবুও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ ‘বিশ্বাস নির্ভর’ সিস্টেমের আবর্তেই বন্দি। হাজারো প্রচলিত সংস্কার, তুক তাক, অপবিশ্বাস, ব্যক্তিপুজা আর সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ইদানিং যুক্ত হয়েছে বৈজ্ঞানিক মোড়কে পুরে সুবেশিত উপায়ে ভাববাদের পরিবেশন।

আমাদের দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বহু যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা, বিশ্বাস, গোঁড়ামি,কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। যা প্রতিনিয়ত মানুষ কথায় ও কাজে ব্যবহার করে থাকে।সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই সমাজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য কুসংস্কার থেকে এখানে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করার চেষ্টা ।এসবের সঙ্গে বিজ্ঞান ও ধর্মের কোন মিল নেই,শুধুমাত্র সামাজিক বিভিন্ন পরম্পরায় আমরা অনেকে এসব মেনে আসছি । এসব কুসংস্কারের মধ্যে কিছু সাধারণ বিবেক বিরোধী এবং রীতিমত হাস্যকরও । এসব না মানলে কোথাও কেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও শোনা যায়নি আজ পর্যন্ত । শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সচেতন, অসচেতন সব ধরনের মানুষ অন্ধবিশ্বাসে এগুলোকে লালন করে। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরী কিনা সেই আলোচনায় না গিয়ে আসুন জেনে নেই এমনি কিছু মজার কুসংস্কার । তবে কারো নিয়ম বা অনুভূতিতে আঘাত লাগলে তার জন্য আমি দায়ী থাকবোনা ।

১) ডান হাতের তালু চুলকালে টাকা আসবে। আর বাম হাতের তালু চুলকালে বিপদ আসবে।

২) বাড়ী থেকে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশে বা’র হলে সে সময় বাড়ির কেউ পেছন থেকে ডাকলে অমঙ্গল হয়।

৩)রাতে নখ, চুল ইত্যাদি কাটতে নাই।

৪) বিড়াল মারলে সমপরিমাণ লবণ দিতে হবে।

৫) ঘর থেকে কোন উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর পেছন থেকে ডাক দিলে যাত্রা অশুভ হবে।

৬) ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হবে।

৭) ছোট বাচ্চাদের দাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্তে দাঁত ফেলতে বলা হয়, এবং সঙ্গে এই মন্ত্র বলতে শিখানো হয়, “ইঁদুর ভাই, ইঁদুর ভাই, তোর চিকন দাঁত টা দে, আমার মোটা দাঁত টা নে।”

৮) ভাঙ্গা আয়না দিয়ে চেহারা দেখা যাবে না। তাতে চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে।

৯) হঠাৎ বাম চোখ কাঁপলে দুঃখ আসে।

১০) রাতের বেলা কাউকে সুঁই-সূতা দিতে নাই।

১১) খালি ঘরে সন্ধ্যার সময় বাতি দিতে হয়। না হলে ঘরে বিপদ আসে।

১২) কোন ব্যক্তি বাড়ি হতে বাহির হলে যদি তার সামনে খালি কলস পড়ে যায় বা কেউ খালি কলস নিয়ে তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করে তখন সে যাত্রা বন্ধ করে দেয়, বলে আমার যাত্রা আজ শুভ হবে না।

১৩) শকুন ডাকলে মানুষ মারা যাবে।

১৪) পেঁচা ডাকলে বিপদ আসবে।




এতো গেল পুরানো কুসংস্কার। এবার আধুনিক কুসংস্কার নিয়ে কিছু বলা যাক। ভ্রান্ত চিন্তা, কুপমুন্ডুকতা আর অন্ধবিশ্বাস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজকেও। কার্ল মার্ক্স, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ, মাদার টেরেসা, শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বড় বড় নামগুলো তৈরী করেছে ইতিমধ্যেই তৈরী করে ফেলেছে কিছু অযাচিত মিথ; জন্ম দিয়েছে শত সহস্র স্তাবকের। এ সমস্ত মনীষীদের আনেকেই অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল চিন্তা করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার তৈরী করেছে কিছু অন্ধবিশ্বাসীদের যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মানেই অভ্রান্ত সত্যি। তাদের ‘আরাধ্য দেবতাদের’ ন্যুনতম সমালোচনাও তাদের কাছে অসহনীয়। গনহিস্টিরিয়াগ্রস্ত এ সমস্ত স্তাবকদল বোঝে না যে, যুক্তির কাছে ‘ব্যক্তিপূজা’র প্রাবল্য অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না। রবীন্দ্রনাথের ব্রক্ষ্মসঙ্গীতের ওপর নির্ভর করে প্রমাণিত হয় না পরম ব্রক্ষ্মের অস্তিত্ব। শুধু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেই নয়, কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের প্রশস্তি করেছেন, ভেবে নিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন ছাড়া ভারতবাসীর মুক্তি অসম্ভব। আবার কখনও বা নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তিকে অস্বীকার করে বলেছেন, ‘প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।’। এধরনের বিশ্বাস কিংবা মন্তব্যগুলোর কোনটিই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অভ্রান্ততা তুলে ধরে না, বরং প্রমাণ করে যে চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। একজন প্রকৃত যুক্তিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমাজ সংস্কার ও কুসংস্কার থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিই।

আমাদের নব্য সম্প্রদায় উন্নতিপথের কণ্টকস্বরূপ কুসংস্কারগুলিকে একেবারে উন্মূলিত করিতে চান, ইহা অপেক্ষা দেশের সৌভাগ্য আর কিছুই নাই। কিন্তু কোন্টা কুসংস্কার সেইটে বিশেষ মনোযোগ করিয়া আগে স্থির করা দরকার। মন্দ মনে করিয়া ভালোকে দূর করিয়া দিলে দেশের বিশেষ উপকার হয় না, কারণ, কেবলমাত্র মহৎ-উদ্দেশ্য লইয়া ঘরকন্না চলে না। তাহা ছাড়া, দেশী কুসংস্কারের জায়গায় হয়তো বিলাতি কুসংস্কার রোপণ করা হইল, তাহার ফল হইল এই যে, গোরা ডাকিয়া সিপাই তাড়াইলে, এখন গোরার উৎপাতে দেশছাড়া হইতে হয়! যাহা হউক, ইহা বোধ করি কেহ অস্বীকার করিবেন না যে, যদি সেই কুসংস্কারই পুষিতে হইল তবে আমাদের দেশের আয়ত্তাধীন রোগা ভেতো কুসংস্কারই ভালো, বিলাতের গোখাদক জোয়ান কুসংস্কার অতি ভয়ানক!’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ অজয় রায় তার ‘বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞান মনস্ক সমাজ নির্মান’ নামক একটি নিরিক্ষাধর্মী প্রবন্ধে লিখেছিলেন,

‘জ্ঞানের একমাত্র উৎস যদি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি হয়, তাহলে সেই সমাজে নেমে আসবে বন্ধ্যাত্ব, সমাজ হবে জড় চেতনা-চিন্তায় আচ্ছন্ন, সৃষ্টিশীলতার স্থান দখল করবে কুসংস্কার, মূর্খতা, কুপমন্ডুকতা আর অজ্ঞানতা। আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে কুসংস্কার আর প্রযুক্তিবিদ্যার ফসলকে আত্মস্থ করার পারস্পরিক সহাবস্থান। বিজ্ঞানের যুক্তি চাই না, চাই তার ফসল, পাশে থাক অন্ধবিশ্বাস আর ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পন। এই সমাজেই সম্ভব - ড্রয়িং রুমে রঙ্গিন টেলিভিশন সেট স্থাপন, এবং হিস্টিরিয়া-আক্রান্ত কন্যাকে পীরের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রেরণ। এই সমাজেই সম্ভব- অনুরসায়নবিদদের রসায়ন চর্চার পাশাপাশি তথাকথিত পীরের পদচুম্বন।’

বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আজ যখন মানুষ মঙ্গলে পাড়ি জমানোর আয়োজন করছে, মহাশূন্যে বসতি স্থাপনের তোড়জোড় করছে বিভিন্ন মরণ ব্যাধির বিরুদ্ধে তার অস্ত্রকে করে তুলেছে আরো শাণিত, মাতৃগর্ভের বাইরে সন্তান ধারণের চিন্তা করছে, ঠিক সে সময়ে আমাদের দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী মনে করে মানুষের চাঁদে যাবার ঘটনা পশ্চিমা ষড়যন্ত্র, ভূমিকম্পের সময় আজান দিলে ক্ষয়ক্ষতি হবে কম, ‘শেতলা দেবী’র পূজা দিলে বন্ধ হবে কলেরা, স্বপ্নাদিষ্ট সাধুবাবার কথায় বিশ্বাস করে এই মহান ভারতে হাজারটন সোনার লোভে মাটি খোঁড়া হয় সরকারী মদতে।আজও।দেশে প্রচলিত ধ্যান ধারণাগুলোকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। 




প্রথমত সংস্কার। এগুলো বেশির ভাগই জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতাপ্রসূত। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারের আগে বিভিন্ন ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা দিতে মানুষ তার কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করতো, যুক্তি ও পরীক্ষাকে বাদ দিয়ে। এর মধ্যে কিছু কিছু সংস্কারের বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়, ফলে এসব হয়ে যায় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ হিসেবে ‘রাত্রে গাছতলায় ঘুমানো বা বিশ্রাম নেয়া টিক নয়।’ এই প্রচলিত বিশ্বাসটির কথা ধরা যাক। রাতের বেলায় উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণ (যে প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ সৌরশক্তির সাহায্যে তার খাদ্য তৈরি করে এবং অক্সিজেন নির্গত করে) প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে, কিন্তু শ্বসন (এতে নিগর্ত হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড) চালু থাকে। ফলে রাতে উদ্ভিদের আশেপাশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আধিক্য ঘটে। জানা কথা, মানুষের জন্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মোটেই ভাল নয়।

দ্বিতীয় বিভাগটি হচ্ছে ভ্রান্ত বিশ্বাস-সংস্কারের মধ্যে যেগুলোর কোন প্রামাণিক ভিত্তি নেই। একটা উদাহরন, মহাশুন্যে পৃথিবীর অবস্থানকে ধরা যাক। পৃথিবীতে কোন বস্তুকে অবলম্বন ছাড়া আমরা ভেসে থাকতে দেখি না। এবার এই তত্ত্বটিকে পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে বলতে হবে পৃথিবী দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘নাগরাজ বাসুদেবে’র সহস্র এক ফণার ওপর। কিংবা এটি রয়েছে কোন কচ্ছপের পিঠে। অথচ, নিউটন এসে দেখালেন পৃথিবী শুন্যে ভেসে রয়েছে কোন অবলম্বন ছাড়াই। তার বড় অবলম্বন সূর্যের টান বা অভিকার্যের।

তৃতীয়টি অন্ধ বিশ্বাস, এই ক্ষেত্রে আমরা আর একটা উদাহরণ দেবো। পুরুষ (অনেক নারীও বটে) বিশ্বাস করে ‘মেয়ে সন্তান হয় স্ত্রীর দোষে’। কাজেই গ্রাম বাংলায় পুরুষের পুত্র সন্তান লাভের আকাঙ্খা অনেক নারীর জন্য বয়ে আনা দুর্ভোগ। অথচ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে মায়ের কোন ভূমিকাই নেই। সংক্ষেপে বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- পুরুষের জনন কোষে থাকে ‘এক্স’ ও ‘ওয়াই’ ক্রোমোজোম (ক্রোমোজোম হচ্ছে জীবকোষের কেন্দ্রস্থ একটি উপাদান যাতে বংশগতি বৈশিষ্ট্যের ধারক ‘জীন’ থাকে) এবং মেয়েদের শুধু ‘এক্স’ অর্থাৎ ছেলে। আর পিতৃদেবের সরবরাহকৃত ক্রোমোজোম যদি হয় ‘এক্স’ তাহলে সন্তান হবে ‘এক্স-এক্স’ ক্রোমোজোম বিশিষ্ট অর্থাৎ মেয়ে। কুসংস্কার বা ভুল বিশ্বাসগুলো ছাড়া প্রচলিত বিশ্বাসের সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান হচ্ছে ‘অন্ধ বিশ্বাস’। অন্ধ বিশ্বাসগুলোর মূল ভিত্তিই হচ্ছে ধর্ম।

“পথের দাবী” উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নায়ক সব্যসাচীর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন “সমস্ত ধর্মই মিথ্যা,- আদিম দিনের কুসংস্কার। বিশ্বমানবতার এতোবড় পরম শত্রু আর নেই।” খ্রীষ্টান ধর্ম প্রসঙ্গেই উক্তিটা এসেছিলো। কিন্তু আজ অনুমান করি, সেদিন ওকথা বাঙালীর পক্ষে ওভারডোজ ছিল। ঔপন্যাসিক হিসাবে শরৎচন্দ্রের অনেক স্ববিরোধ থাকতে পারে, সব্যসাচী নিখুঁত চরিত্র না হতে পারে। সাহিত্য আলোচনার দিকে না গিয়েও এটুকু বলতে পারি যে একথা পড়ে অনেকে শকড হয়েছিলেন।সত্য কথা বলবার বিপদ অনেক।

প্রবন্ধ - সুদীপ নাথ

0 কমেন্টস্
রোমান কবিতার স্বর্ণযুগ ও লুক্রেৎসিউস্

সুদীপ নাথ



খ্রিষ্ট-পূর্ব প্রথম শতকের প্রারম্ভে, প্রাচীন রোমে বহু প্রতিভাবান কবি বসবাস করতেন। এঈ সময়কে রোমের কবিতার স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রোমান সাহিত্যের অজস্র রচণার মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে যে কাব্যটি, তার নাম DE RERUM NATURA যার বাংলা প্রতিশব্দ “বস্তুপ্রকৃতি সম্বন্ধে”।

খ্রিষ্ট-পূর্ব ১ম শতকের, একাধারে বিজ্ঞানী এবং কবি, তিতুস লুক্রেৎসিউস্ কারুস ( Titus Lucretius Carus ) এই কাব্যের রচয়িতা। তার জীবিত কাল খ্রিষ্ট-পূর্ব ৯৯ অব্দ থেকে ৫৫ অব্দ। তৎকালীন সময়ের তুলনায়, অতিশয় আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতি ও মানুষের ইতিহাস এই কাব্যটিতে লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

তার ধারণা অনুযায়ী প্রকৃতি অণু দ্বারা গঠিত। তারা পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে নক্ষত্র, পৃথিবী, জীবিত প্রাণীকূল, এমন কি মানুষের আত্মা পর্যন্ত নির্মাণ করেছে। তিনি আত্মার অমরত্ব ও পরলোক অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বুঝিয়েছেন যে, মানুষ যে আগুন, লোহা, চাষবাসের কলাকৌশল হাতে পেয়েছে তা, কোনও দৈবী করুণার দান নয়। মানুষ নিজের শ্রম দ্বারাই তা অর্জন করেছে।

ধর্মকে লুক্রেৎসিউস্ লাগামের সাথে তুলনা করেছেন, যে লাগাম, মানুষের চিন্তার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। ধর্ম উদ্ভবের কারণ হিসেবে তিনি মনে করতেন, প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞানতা ও ভয়। বজ্রপাত, ভুমিকম্প, মানুষের নিদ্রার কারণগুলোর তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন। লুক্রেৎসিউস্ তার রচণা পদ্যাকারে তার কাব্য DE RERUM NATURA-তে লিখে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।


১ অক্টো, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা

0 কমেন্টস্
সম্পাদকীয়


বৃষ্টি পিছু না ছাড়লেও মহালয়া এসে গেল। বানভাসি মানুষেরও একটু ডাঙার খোঁজ – মায়ের আবাহন যে করতেই হবে। বহুজাতিকদের হাতে খড়ি নিয়ে ‘মল’ থেকে গাঁয়ের মাতঙ্গিণী বস্ত্রালয়,কেষ্ট বেনে,যদু মযরা-সবারই আশা তার সন্তান নতুন করে সাজবে আর মাকে দর্শন করবে।তাই সাজ সাজ রব সর্বত্র।ভোটরঙ্গ, খুন-ধর্ষণ, শিক্ষালয়, হাপাতালে নৈরজ্য কাল ছিল আজ আছে থাকবেও।কিন্তু শরৎ,আগমনী সেতো বারাবার নয়।

সবার সাথেই তাই ‘প্রেরণা’ ও তার ডালি সাজিয়ে এল শিউলী সাপলা শালুকের সাথে কলমের কলরবে। কৌলিন্যে না হলেও আন্তরিকতায় এই পরিবার এগিয়ে এসেছে সদাই – সবার রঙে রঙ মেলাতে।

আমরা একসাথে সব অবক্ষয়,বিচ্যুতিকে জব্দ করেই সুস্থতার পথে পা রাখবো।

আমাদের আগামী উপস্থিতি দেওয়ালীর দীপশিখা হাতে। ততদিন এখানে গাঁথামালার ফুলের সাহচর্যে পূজার দিনগুলি
রঙীন থাকুক সবার।


সম্পাদক মণ্ডলী
‘প্রেরণা অনলাইন’

অনুগল্প - রাজেশচন্দ্র দেবনাথ

0 কমেন্টস্
অভিমান
রাজেশচন্দ্র দেবনাথ


রতন টাকাটা চুরি করলো । তুমি কিছু বলবে না ।
-কি বলবো ? নিয়েছে তো তর ভাই । ভাইয়ের টাকা ভাই নিয়েছে । এতে বলার কি আছে ।
-বা । জিজ্ঞেস না করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেল । মদ গাঁজা খেয়ে অতগুলো টাকা উড়িয়ে দেবে । টাকাগুলো যে রান্নাঘরটা মেরামত করবার জন্য বেশি সুদে এনেছি । সে দিকে খেয়াল আছে ।
-আ বেশি বকবক করিস না । এখান থেকে সরে পর ।
সুশীল আর কথা বাড়াল না । বুঝল এ সব কথা মাকে বলে লাভ নেই । সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো ।
ঘড়ির কাটায় তখন ১০ টা । সুশীলের ছোট বোন রত্না বললো , মা তুমি বিনা দোষে দাদাকে বকলে । রতনের দোষ । অতগুলো টাকা চুরি করলো ।তুমি কিছু বললে না ।
-কি বলবো বল । সুশীল শান্ত ছেলে ।মা বকলে কিছু বলবে না । চুপ করে থাকবে । আর রতন জানোয়ারটা কে কিছু বললে তো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাড়বে ।
-তাই বলে সবসময় ...

ভোরের আলো চারধারে ছড়িয়ে পড়েছে ।সুশীল রাতে বাড়ি ফেরেনি । সুশীলের অপেক্ষায় মা সারারাত উঠোনে পায়চারি করে কাটিয়ে দেয় ।সারা মুখে চিন্তার ছাপ । ছেলেটা না খেয়ে সারারাত কোথায় ছিল এসব চিন্তা তাকে জর্জরিত করছিল । এমন সময় সুশীলের বন্ধু শৈলেন দ্রুত দৌড়ে বাড়িতে ঢুকল । হাঁফাতে হাঁফাতে বললো । মাসিমা দ্রুত আমবাগানে চলুন ।
কেন,হঠাৎ আমবাগানে । কি হল ।
সুশীল আমবাগানে ফাঁসি দিয়েছে।

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র​

0 কমেন্টস্
প্রেম প্রীতি পরকিয়া
শ্রীশুভ্র​


- শেষ পর্ব -



মনস্তত্ব অনুসারে মনোবিদরা পরকীয়া নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন! সাহিত্যিক সৃষ্টি করতে পারেন কালজয়ী সাহিত্য! সমাজতত্ববিদ সমাজ সংসারের বাস্তবতায় যুগ লক্ষ্মণের সাথে মিলিয়ে গবেষণা করে জানাতে পারেন তাঁর অভিমত! কিন্তু ভাঙ্গা দাম্পত্য জোড়া দিতে দিতে ক্লান্ত নর নারীই শুধু অনুভব করতে পারে শরীর মনের গভীরে পরকীয়ার নন্দনতত্ব! আনন্দের সংঘটন! বেঁচে থাকার নব উদ্দীপনা!প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আবহমান মানব সভ্যতা যদিও পরকীয়াকে কোনো ভাবেই আইনত স্বীকৃতি দেয়নি, দেয়নি সামাজিক মর্য্যাদা, তবুও সকল দেশে সকল সমাজেই পর্দার আড়ালেই হোক কিংবা বাইরে, পরকীয়া প্রেম প্রীতির অন্যতম অমলিন নিদর্শন! বৈবাহিক দাম্পত্যে নর নারীর মিলনের পেছনে, শুধুই ভালোবাসার অনুঘটন থাকে না!

স্বামী স্ত্রীর পরস্পরের কাছে পরস্পর স্বার্থ সিদ্ধির অনেকগুলি শর্তই উদ্দীষ্ট থাকে! বিশেষ করে অনুন্নত অর্থনৈতিক সমাজে স্ত্রী রূপে নারীর ভরণ পোষণ এবং স্বামী রূপে পুরুষের সন্তান ধারণ এবং পালন ইত্যাদি! অপর পক্ষে পরকীয়ায়, অভ্যস্ত দাম্পত্যের দায়িত্ব কর্ত্তব্য পালনের একঘেয়েমি থেকে  মুক্তির রূপরেখায় অমলিন প্রেম প্রীতির সোহাগ ও আদরের অনন্ত পরিসর থাকে!

কোনো দায়িত্ব কর্ত্তব্যের শৃঙ্খল সেই প্রীতির পরিসরে শরীর মনের ঐকান্তিক প্রেমকে ধর্ষণ করতে পারে না! পারে না বলেই মানুষের শিল্প সাহিত্যে পরকীয়ার মোহনবাঁশি মানুষকে এতটাই উদ্বেলিত করে তোলে!

(সমাপ্ত)




সুক্তগদ্য - সীমা ব্যানার্জী রায়

1 কমেন্টস্
ওগো! তুমি যে আমার...।
সীমা ব্যানার্জী রায়



আমার আদরিণী শতরূপাঃ

লিখতে বসেছি চিঠি-

হয়ত হবে না শেষ লেখা-

ভাবনার সাঁকো মনে ভিড় করে

পরিয়ে নতুন বেশ

কলমের পলি হয়নি নিথর

পরিশেষে খুব শ্রান্ত.........

এই দেখো কবিতা লিখে ফেললাম, তুমি থাকলে ঠিক বলতে- “আদিখ্যেতা! বুড়ো বয়সে প্রেম করা হচ্ছে।”

আচ্ছা, তোমাকে নিয়ে লিখব না তো... কাকে নিয়ে লিখব বল? তুমি-ই তো আমার প্রথম আর একমাত্র প্রেম! আর জানো তো বুড়ো বয়সেই প্রেমটা আরো জোরালো হয়, তাই তো আজ সুন্দর একটা দিনে তোমাকে আমি মনে প্রাণে শুধু আমার করে চাইছি, শুধু আমার।

কাল রাতের বরফগুলো আজ সোনালী রৌদ্র মেখে কেমন চকচক করছে। এত বরফের মধ্যেও নিষ্পাপ লাল, সাদা, হলুদ গোলাপগুলো কেমন সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে, দেখ।

জানলা দিয়ে দেখি, শিস দেওয়া দমকা হাওয়ায় দুটো কার্ডিনাল পাখি পাশাপাশি বসে নিজেদের মধ্যে কতকিছু আলোচনা করছে আর আমি বড় একা আজ।

এত রূপ, এত আলো

লাগে না যে কিছু ভালো

বয়ে শুধু কিছু বেলা

কেন খেলি একা খেলা......তবু দেখি তুমি চুপ, আমি চুপ...।

ভাবছি অনেক লিখি, কিন্তু কি লিখি তোমায়-বল তো? আমার হাত নিশপিশ করছে লেখার জন্য -কিন্তু লেখা কই? কোথায় আছো, কেমন আছো কিছুই তো জানি না। চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই, যত রকমের ব্যবস্থা আছে করে চলেছি। নিঃস্ব্তা হল আমার দুই পাশ ঠিক এই মূহুর্তে।

আজ এই দিনে তোমাকে বড় বেশী করে মনে পড়ছে। তোমার হাতের ছোঁয়া চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবাই তোমার রুচির প্রশংসা করছে রূপা। তোমার বিয়ের আগের এই হলুদ শাড়ী পরা ছবিটা বড্ড মায়াময়ী। তুমি মানা করা সত্ত্বেও আমি বড় করে বাঁধিয়ে রেখেছিলাম। এই ছবিটা যে দেখে সেই বলে যেন জীবন্ত মায়াময়ী মূর্তি। তুমি শুনে বলতেঃ “বড্ড বেশি বলে সবাই।” সব একে একে মনে পড়ছে এখন।



আমার কথা বাদ দাও। কি নিয়েই বা আছি তোমার চৈত্ররথে? তোমার মেয়ে আজ নামকরা ডাক্তার। কাগজে কাগজে তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠছে। তাই আজ আমি সবাইকে ডেকেছি রূপা~ তোমার বাড়ীতে। তুমি তো সব সময় বলতে, “কি হবে এই বিশাল বাড়ি নিয়ে। মেয়ে একদিন পরের বাড়ী চলে যাবে। তখন তো শুধু আমরা বুড়োবুড়ির দল।”

তুমি বুড়ি! আমি ভাবতেই পারছি না, বিশ্বাস কর। তোমার আদর্শে গড়া তোমার ডুপ্লিকেট তৈরী হয়েছে তোমার মেয়ে। জান তো তোমার -আমার মতন সেও লেখে। আর তার লেখার যোগ্য সম্মান ও পাচ্ছে। তোমার ছবিতে হাসিমাখা জ্বলজ্বলে মুখখানা আমি দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। তুমি যেন কি বলতে চাইছ, কিন্তু কে যেন বাধা দিচ্ছে তোমাকে......জানিনা এটা আমার কল্পনা কিনা।

মেয়েই ঠিক করে দিল এই দিনটা, বিশ্বাস কর। আত্মীয় স্বজনে ঘর ভরে গেছে। মা কেও আজ দেখছি কত সাবলীল। তোমার দাদারা, দিদিরা, বৌ্দিরা আর ভাইপো ভাইঝিদের ভিড়ে বাড়ী সরগম। তুমি যে সবার কত আদরের তা, আজ না দেখলে তুমি বুঝতে পারবে না। শুনেছি মুম্বাই থেকে তোমার এক মাসতুতো দিদি, জামাইবাবুও এসেছেন ।

ইশ! তুমি থাকলে আজ কত মজা হত ভাব তো! ওগো, তুমি যে আমার...শুধু তুমি যে আমার। আজ মনে হচ্ছে সব গল্প। গল্পই তো আমাদের জীবন। গল্পই তো আমাদের স্মৃতি।তাই সবার থেকে সরে এসে আড়ালে তোমার ফটোর সাথে কথা বলছি। মনে হচ্ছে তুমি সব শুনেও চুপ করে আছো!

দেশে আমার মাসিমারা, মামা, মামিমারা, মেসোরা এমন কি বাড়ির কাজের মেয়েগুলোও তোমাকে খোঁজে সব সময় রূপা।

কোথায় চলে গেলে কাউকে না বলে? তোমায় কি কেউ অভিমান করার কথা বলেছিল? কত খুঁজেছি তোমায়। সবার এক কথা, “অপেক্ষা করতে হবে-ঠিক ওর সন্ধান পাব আমরা”।

হু হু করে এক্স-ওয়াই ফ্যাক্টর দিন ও রাত কেটে যাচ্ছে। এখন আমি বড় ক্লান্ত, আমার আর কিচ্ছুটি ভাল লাগে না।

মেয়ে হয়েছিল বলে মা তোমাকে সোনার কঙ্গন দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। কারণ মায়ের যে খুব মেয়ের সখ ছিল তাই। তোমার মতন দেখতে হয়েছিল বলেই না মা, নাম রেখেছেন শ্রীরূপা।

মা-ই তো তোমার নাম রেখেছেন শতরূপা। তোমার আসল নামটা অতীত কি বল? জানি হাসছ আমার পাগলামি দেখে, তাই না? হাসো! আর আমি এদিকে তোমাকে খুঁজে চলেছি অহরহ। আমাকে আর মাকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাও নি একা, কিন্তু গতবছর, এই দেখ! তোমার ছ'য়মাসের যাওয়াকে আমি এখনই গত করে দিয়েছি। তোমাকে জোর করে মাসীমার ছেলের বিয়েতে পাঠালাম কারণ আমার একটা বিরাট জরুরি সেমিনার ছিল।

এত উপরে উঠিয়ে তুমি কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেলে, বল তো? কিছুই ভালো লাগে না আজকাল, কিচ্ছুটি না।

তুমি আমাকে আসবার দিন ফোনও করেছিলে যে, তুমি কাস্টমস চেক করে লাউঞ্জে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করছ। মা-এর শরীর খারাপের জন্য তুমিই তো মা-কে নিয়ে গেলে না। সাত দিনের জন্য তুমি গেলে কিন্তু এ তো দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে রূপা। তোমাকে খুঁজে পাব বলে সব রকম ব্যবস্থা করে যাচ্ছি।

সেদিন এখানকার ফেডারাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেসন-এও তোমার জন্য বলেছি। তারাও সব রকম ব্যবস্থা নেবে বলেছে কারণ , তুমি তো আমেরিকান সিটিজেন, কাজেই তাদেরও কর্তব্য তোমাকে খুঁজে বার করা। মন খালি বলছে তুমি ঠিক আসবে, তোমাকে আসতেই হবে।

সত্যি বলছি, কি করে বোঝাই তোমাকে যে, কিছুই ভাল লাগছে না আর। এ যেন কোনরকমে দিনগত পাপক্ষয়-কোথায় বা কবে যে তোমাকে পাবো জানি না। অফিসে কাজেও সব ভুল করে ফেলছি তারা অবশ্য বুঝতে পারছে আমার মনের অবস্থা......

আজ আমি এত খ্যাতির শিখরে কার জন্য, বলতো? আমার আর কিচ্ছু চাই না। তুমি ফিরে এসো... প্লি...জ।

আজ এত লোকের ভিড় একদম ভাল লাগছে না। বিশ্বাস কর, তাই তোমার প্রিয় ঘরটাতে বসে তোমাকে লিখছি। যদি কোনদিনও আস, জানি তুমি আসবে, তখন দেখবে আমার লেখা এই চিঠি । আমি তোমাকে কত যে হারাই দিনে রাতে তার হদিশ পাবে।

মনে পড়ে বেশ সেদিনের কথা, মা আমার বিয়ের জন্য আশিটা মেয়ে দেখেছিলেন। শেষে তোমাকে হঠাৎ দেখা স্টেশনের কথা আমি আমার মা-কে বলেছিলাম। পরে আমার বন্ধু প্রসূনের কাছে জেনেছিলাম তুমি তার বোন।

আজ আর বলতে দ্বিধা নেই। তখন মা যতই মেয়ের ফটো আনছিলেন আমি-ই নাকচ করে দিচ্ছিলাম। তার সাথেও মা-ও। কারণ ছোটবেলা থেকেই আমার আর মা –এর পছন্দ একরকম ছিল।

মা বলেছিলেন, “আগে বলবি তো? প্রসূনের বোন আছে? ঠিক আছে কাল –ই প্রসূন কে বলব ওর বোনের কথা”।

মা বলাতে প্রসূন একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল, জানো তো? কারণ তোমার বয়স তখন নাকি মাত্র সতেরো। কি সুন্দর রোগা রোগা শরীর, আপেলের মতন গায়ের রঙ, এক পিঠ ঢেউ খিলানো কোঁকড়া কালো চুল। আর ছিল একজোড়া মিস্টি চোখ, যে চোখে আমি হারিয়ে গেছিলাম, পালাবার পথ খুঁজে পাই নি। লাজুক মতন ছিলে।

মা আর মাসিমা দেখে–ই কথা দিয়ে এসেছিলেন। এসেই আমাকে জড়িয়ে বলেছিলেন মা যে,- “শতরূপা-কে দেখে এলাম। আমি এমনি মেয়েই খুঁজছিলাম রে বহুদিন। মর্ত্যের কুসুম দিয়ে যেন স্বর্গে্র লক্ষী সাজানো। থাক, আর বলব না বেশী। আমার কপাল তো।”



জানো রূপা ? মা আমার বড় দুঃখী। তোমাকে বলতে বারণ করেছিলেন, মা! কিন্তু আজ আমি আর থাকতে পারছি না, তাই তোমাকে সব জানিয়ে একটু হালকা হতে চাই।



সেই ২২ বছর বয়সেই বাল্যবিধবা হয়েছিলেন আমাকে নিয়ে। আমাকে নিয়ে মায়ের তাই অনেক স্বপ্ন ছিল। কাকারা মা-কে এক বস্ত্রে বের করে দিয়েছিলেন বাড়ী থেকে ‘অলুক্ষুণে’ নামের ঘোমটা পড়িয়ে। আমার সেই ছোট্ট-খাটো মা দাদুর হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছিলেন দাদুর সংসারে। দাদুর বাড়িতে মানুষ হচ্ছি বলে মা সব সময় রান্না ঘরে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতেন। তাই মা আমার ছিল বড় প্রিয়, বড় আদরের। আমি শপথ করেছিলাম যে, মা-কে কোনদিন দুঃখ দেব না।

তাই আমার জীবনের দুই প্রিয় নারী- তোমাকে আর মাকে- নিয়ে চলে এসেছিলাম সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে, 'শান্তিনীড়' গড়ব বলে......

মা বলেছিলেন, “তোরা এখন দুটিতে যা, আমি যা পাই নি জীবনে, তোরা যেন তা থেকে বঞ্চিত না হোস এই প্রার্থনা করি আমার ঠাকুরের কাছে।” এই ছিল আমার আদরের মা!



তুমি কান্না ধরলে, একা আসবে না আমার সাথে। আমি আড়াল পেয়ে তোমাকে বলেছিলাম, “আমি কি তোমাকে যত্ন করতে পারব না? চলো না; মাকে পরে নিয়ে যাব।”

তুমি এত কম কথা বলতে যে, হ্যাঁ কি না! কি বলতে চাও জানা গেল না। তখন আমি আরো ছুটির ব্যবস্থা করে তোমাকে আর মা কে নিয়ে এলাম সাথে করে।



সে কি আনন্দের দিন ছিল রূপা, মনে আছে? কত যায়গায় গেছি বল। মায়ের মুখে সব সময় দেখতাম আত্মতুষ্টি। সত্যি তোমাকে পেয়ে আমি আড়ালে তোমার ঠাকুরকে বলতাম যে, “ তোমায় কি দিয়ে পূজো করলে তোমার ঋণ শোধ করা যাবে ঠাকুর।”

তোমাকে কিন্তু আমি রাগাতাম যে, “ধ্যুস! কি রাতদিন পূজো করো, বলো তো? আমাকে পেয়েছো তো, আবার কি চাই? হাসছি জানোতো”। তুমি হাসতে আমার কথা শুনে। হাসলে তোমার ঠোঁটের দুপাশে কি সুন্দর দুটো ছোট্ট টোল খেলত। লিপ্সটিকও তোমাকে লাগাতে হতো না, কেন বলত?

হা! হা! হা! আমেরিকান বন্ধুরা কি বলত তোমাকে দেখে? তুমি সব জানো; তাও লিখছি এইজন্য যে, সবাই জানুক আমার আদরিণী রূপা কত সুন্দরী ছিল।



২.

তুমি যেখানেই থাকো রূপুসোনা ফিরে এস, নয়ত বল কি করলে আমিও তোমার কাছে যেতে পারি? তোমার কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাও প্লিজ। মা যে বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন, সেটা কি তুমি জানো? মেয়েও তো কেমন চুপচাপ থাকে আজকাল, আগের মতন সে আর গান গায় না। আর সেই যে তোমার ছেলে “টমি” সে তো সব সময় জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা তাও বলে বোঝাতে পারি কিন্তু একটা অবলা জীব কত কষ্ট পাচ্ছে তা তুমি নিজের চোখে না দেখলে বুঝতে পারবে না।

লিখতে লিখতে কোথায় যে হারিয়ে গেছিলাম কে জানে।

হঠাৎ করে ভেজানো দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে যা দেখলাম তা তো বিশ্বাসযোগ্য না। চমকে উঠে নিজেকেই চিমটি কেটে বললামঃ” আমি সজ্ঞানে না অজ্ঞানে? এ আমি কাকে দেখছি? এ কি সত্য না কাল্পনিক।”

-“এই দেখো কি দেখছ ? এসো! সবাই মেয়ের বাবাকে খুঁজছে আর তুমি এখানে বসে আছো দরজা বন্ধ করে? মেয়ে কেমন শাড়ি পড়েছে আজ প্রথম, দেখবে এসো।”

আমি অবাক- বাকরুদ্ধ- স্ট্যাচু হয়ে গেছি। আমি মনে মনে ভাবছি আমি কি বেঁচে আছি? না, না তা হয় না। আমি বেঁচে আছি আর রূপা শোনো! তোমার জন্যই বেঁচে আছি। ছুটে তোমাকে ধরতে ইচ্ছে করছিল আবার ভাবছিলাম কি জানি আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? তাও আমি সরিয়ে ফেললাম আমার পান্ডুলিপি। তুমি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলে একটিবার কাছে এলে না, এখনও সেই নতুন বিয়ের মতন লজ্জায় থাকো।

আস্তে আস্তে বললেঃ “ সবাই অপেক্ষা করছে, পরে সব কথা হবে। এখন দেরী হলে সবাই কি ভাববে, ছিঃ! লজ্জা করে না বুঝি? তুমি না কি?”- তোমার এই রূপটাই সবচেয়ে পছন্দ আমার।

তাও হতবাক হয়ে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তোমার পিছু পিছু এসে দাঁড়ালাম সবার মাঝে। সবাই আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠে বলল, “তোমার সারপ্রাইজ গিফট এনেছি, দেখেছ।” আমি কিন্তু তখনও ঘোরের মধ্যে আছি মনে হল।

সব কিছুই একটা স্ব্প্নের, সিনেমার প্লটের মতো মনে হল। হঠাত করে এ আমি কাকে দেখছি? আমার যায়গায় যে কেউ থাকবে সেই ভাববে। এটাই তো স্বাভাবিক। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুল না, শুধু নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি এসে আমাকে বললে সেই হাসি দিয়েঃ

“~ এই তো আমি! বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

ঐ দেখ আমার তানিয়াদিদি আর তুহিন জামাইবাবু। ওদের সাথে আমি এসেছি মুম্বাই থেকে দুদিন আগে। মেয়ে আমাকে দেখে এই দিনে পার্টির ব্যবস্থা করেছে, জান তো? এত চিন্তা কেন করছিলে? আমি তো কিছুদিন আগেই গেছিলাম।”

তখনও আমার ঘোর কাটে নি। হঠাত করে এই দিনেই কি করে সে এল? অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। মনে হল ও কোথায় ছিল এতদিন; ওর হয়ত মনে নেই। মা-র কথায় আবার আমি স্বাভাবিক চেতনায় ফিরে এলাম। মা আমাকে বললেন, “এই দ্যাখ আমার রূপা আবার ফিরে এসেছে। আমাদের ছেড়ে ও কোথায় যাবে বল তো! ঠাকুর আমাদের পরীক্ষা করছিলেন আমরা সবাই পাশ করেছি বলে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।”

‌যাই হোক, হৈ হট্টগোল এর মধ্যে দিয়ে কেটে গেল শুভ মূহুর্ত। সেদিন আবার আমাদের বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। এরা কি তবে প্ল্যান করে সব করেছে? আমাকে সত্যি সারপ্রাইজ দেবে বলে রূপাকে এরাই লুকিয়ে রেখেছিল? এতদিন ধরে কেন তারা আমাকে আর মাকে কষ্ট দেবে? না...না! তা হয় না; এরা যে আমাকেও ভালবাসে খুব। আর আমার মা তো তার ছেলেকে উদাস দেখতে চান নি ।

এতদিন না এসে হঠাত করে এলই বা কি করে? অন্য কোথাও কি ছিল একটা বিরাট সারপ্রাইসড দেবে বলে, এদেরই কি সবার প্ল্যান? হাজার প্রশ্ন ভিড় করতে শুরু করেছে। রূপার তানিয়াদিদিরাই বা হঠাত আসলেন কেন এত পয়সা খরচ করে?

ফাঁক খুঁজে রুপার তুহিন জামাইবাবুকে জিগেস করতে যাব আর তুমি এসে হাজির, আমাকে হিরহির করে টেনে নিয়ে গেলে সবার মাঝে। কিন্তু একটা প্রশ্ন খালি মনের মধ্যে সাপের মত কিলবিল করতে লাগল। তারই টানাপোড়েনে মন বুনে চলেছে তখন বালুচরী আঁচলার নকশা।

সুযোগমত সবার আড়ালে তানিয়াদিকে জিগেস করলে উনি বললেন, “ সময় মত সব কথা জানতে পারবে। ইটস দি টাইম টু এনজয়। সো এনজয় নাও।”

ফাঁকা হতে লাগল বাড়ী। খালি আত্মীয় স্বজন গুলতানিতে মেতে উঠল।

তারপর একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। আমাদের মেয়ে তাতা ওরফে শ্রীরূপা আমাদেরও শুয়ে পড়তে বলল।

রূপা স্বাভাবিক ভাবে রাতের পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে বিছানায় শুতে... শুতে বললঃ “আজ বড় আনন্দের দিন ছিল, কি বল? এস দাঁড়িয়ে কেন? কি ভাবছ বল তো?” আমি বিছানায় গিয়ে শুলে ও আমার হাত ওর বুকের কাছে নিয়ে এক নিমেষে ঘুমিয়ে পড়ল। আর আমি অবাক হয়ে আমার গরবিনী রূপাকে দেখতে লাগলাম। কি প্রশান্ত মূর্তি আমার রূপার। কি সব বাজে বাজে চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছিল। দুষ্টু সন্দেহও তো মনের কোণে উঁকি মেরেছিল।

পরের দিন সুযোগ মত তুহিন জামাইবাবুর কাছে যা শুনলাম আমার অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না.........

রূপাকে নাকি পুনার গনেশ খিন্ড রোড -এর আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম থেকে খুঁজে পেয়েছেন ওনারা। ওখানে জিগেস করাতে আশ্রমবাসীরা কিছু বলতে পারে নি। রূপা নাকি কোথা থেকে এসেছে তাও বলতে পারে নি আশ্রমে। শেষে ওনারা পুলিশে খবর দেন এবং পুলিশ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। সেই কাগজে ছবি দেখে তানিয়া আর তুহিন গিয়ে নিয়ে আসে রূপাকে। খবর পেয়েই তারা আটল্যান্টায় তাদের খবর পাঠায়, কিন্তু ফোন ধরে তাতা। তারপর শশধরের মাসীমাদের খবর দেয়। কিন্তু তানিয়া ওনাদের বলে দেয় যে, শশধর যেন জানতে না পারে। তাকে সারপ্রাইজড দেওয়া হবে, সেই মতন কথা হয়ে আছে তাতার সাথে।

সব শুনে মেয়ে শ্রীরূপা তখন তানিয়াদের আসবার টিকিট পাঠায়। কারণ মেয়ে ভাবে , “মা-এর একা আসা নিরাপদ নয়।” শ্রীরূপা ওরফে তাতাই ঠিক করে এই পার্টির। বাবাকে বলে যে, মায়ের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কাজেই পার্টির আয়োজন কর। তার বাপিকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয় নি সে তার মায়ের ফিরে আসার খবর।

মনে শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন বাসা বেঁধেছিল তখন.........।।!

তাহলে কি রূপাকে কেউ হিপ্নোটিজম করেছিল, না কেউ তাকে নিয়ে গিয়ে জোর করে আশ্রমবাসী করতে চেয়েছিল, রূপা কি কারুর সাথে আলাপ হওয়ার পর আনন্দময়ী মায়ের সম্বন্ধে জানতে পেরে কৌতূহলবশতঃ আশ্রমে গিয়ে উঠেছিল......কে বলে দেবে এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর। রুপাকেও তো জিগেস করা ঠিক না। আর কিভাবেই বা জিগেস করবে!

যদিও দরকার নেই তবুও সন্দিগ্ধ মনটা বড্ড বেয়াদপী করে। একটু অবাক লাগছে যে, তুমি এসে থেকে অবধি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছ, সাজগোজ অনেক কমে গেছে। আগের মতন সেই ম্যাচ করে জামা কাপড় আর পড়ছ না তো। সব কেমন যেন ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে।

যাই হোক, যখন এসে গেছো তোমার নিজের বাসায়, তখন তোমার আসার পর থেকেই না হয় আমি আমার লেখার অর্দ্ধেক শেষ করবো ঠিক করেছি। এ তো ঠিক সিনেমা তিনঘণ্টার গল্পের মতন।

সময়ের ভেলা কেড়ে নেয় বেলা

দিগন্তে আসে ঢেউ

মাতলামো জাগে লেখা লেখা খেলা

জানে না যে আর কেউ

টাইম ক্যপ্স্যুলে ভরা আছে তব

মিস্টি হাসির ঢেউ...

জানোতো! আমি আমার লেখার এই শেষের অংশটা লুকিয়ে লুকিয়ে লিখছি যাতে তুমি জানতে না পারো। তুমি এখন নিচে আত্মীয় স্বজন-এর খাবার দাবার এর ব্যবস্থা কোরছ যেটা সব চেয়ে প্রিয় তোমার জীবনের। তুমি মনে কর “মানুষকে আদর করে খাওয়ানোটাই সব চেয়ে প্রয়োজন, নারায়নরূপী মানুষ-ই ভগবান।”

ও যাজ্ঞসেনী আমার- গভীর রাতের তটে ঠিক জোনাকী আলোর মত মসৃণ আলো দিও,

সন্ধ্যার মাস্তুলে কোথাও আগুন যেন জ্বেলো না, অরুন্ধতী চোখ ইশারায় আবার করে খুনসুটি করো ......

আজ আমি সত্যি খুব হাসছি দেখো। হা হা হা হা। শুনতে পাচ্ছো, রূপা ? সারা বাড়ী প্রতিধ্ব্নি শুনছে। সারা বাড়ী হাসছে আজ তোমার আসাতে। তুমি চিরদিন তোমার সাজানো বাড়ীতে থেকো রূপা। তোমার যেমনভাবে থাকতে ইচ্ছে হয় থেকো। কোথাও আর হারিয়ে যেও না। তোমাকে যে আমাদের সবার খুব প্রয়োজন। মেয়ে কি বলে জানো তো!

বলে, “বাপি! লেখো না তোমাদের জীবনের ভালবাসা। সেই লেখাটাই হবে আমার জীবনের ধ্রুবতারা। তোমাদের প্রেমের গল্প নিয়ে দেখবে একদিন সিনেমা হবে। আমি তার ব্যবস্থা করব বাপি। সব লোকে জানবে ভালবাসার দ্ব্যর্থক নেই।”

আমি যে তোমাকে মিস কোরতাম আমাদের মেয়ে সেটা ভালভাবেই বুঝত, কিন্তু মুখে কিছু বলত না, ঠিক তোমার মতন। আজ আমি বড় সুখী। আমি একটুও বিশ্বাস করি না- ভালবাসা কেবলি যাতনাময় ! বিশ্বাস করি-ভালবাসা সুখেরও কখনও হয়। আমরা, তথাপি, সরব ও রঙ্গীন করে তুলতে চাই আমাদের গল্পগুলোকে, আর সত্যের রাংতা, এতোই ঝকমকি ও প্রতিরোধ্য যে, এমনকি, তোয়াক্কাও করে না কোন নৈ্তিকতার।

এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না!!!

রূপা! আমার ইহকাল পরকালের সব ভালবাসা তোমার জন্য গচ্ছিত রাখলাম।

কবিতা - কাজী এনামুল হক

0 কমেন্টস্
‘মা’ আসছে
কাজী এনামুল হক



‘মা’ আসবে ধরার পরে ঘরে ঘরে তাই আনন্দ উৎসব,
মায়েরই গুণগানে পাড়ায় পাড়ায় শুনি মধুর কলরব।
নবীন প্রবীণ একসাথে সব করছে পুজার আয়োজন,
মায়ের কাছে বর চাইবে জীবন চলায় যা প্রয়োজন।

জগৎজুড়ে অসুরদের দাপট চলছে বেড়ে দিনকে দিন
ঘরে বাইরে নির্যৃাতনে মানুষ এখন ধৈর্য্যহারা দিশাহীন।
খুনখারাপি, লুটতরাজ আর নারী ইজ্জত নিয়ে টানাটানি
ঘোর কলিতে সাধু-সন্যাসও তাল হারিয়ে বেতাল শুনি।

বাপের বাড়ী আসবে নায়র দুর্গাদেবী দশভুজা
অসুর নাশে সিদ্ধহস্তা প্রয়োজনে দেয় যে সাজা
সবার মাঝে মায়ের সাজে চলছে চেষ্টা অফুরাণ
মায়ের মনে কষ্ট পেলে হবে নিশ্চিত অকল্যান।

শরৎশুভ্র পবিত্রতায় ঘটবে ধরায় দশভুজার আগমন
পাড়ায় পাড়ায় মন্ডপে মন্ডপে করছে সবাই নিমন্ত্রন। 

ধারাবাহিক - অলভ্য ঘোষ

0 কমেন্টস্
পর্নমোচী
অলভ্য ঘোষ



(এক)

কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রোগা ছিপছিপে এক যুবক । পরনে চুস জিন্সের প্যান্ট , গায়ে বাদামী সাট , চোখে গোল্ডেন গোল ফ্রেমের চশমা ।হাতে ডাইঅ্যারি । উদাসিন চোখ চেয়ে আছে সিঁড়ির দিকে । যেন খরাগ্রস্হ ভূমি বুক পেতে চোখ উনমুক্ত করে আকাশের পানে ।



বেল বেজে উঠলো । সহসা একদল ছেলে মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে । তাদের পেছনে সাদা সালোয়ার কামিজ আর নীল ওড়না বেষ্টিত বহু আকাক্ষ্মীত সেই বৃষ্টির বিন্দু । যার একহাতে মুঠকরা ছোট্ট এক টুকরো কাগজ । অন্যহাতটা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের হ্যান্ডেল টা শক্তকরে আঁকরে ধরে । চোখ দুটো রক্তবর্ন ।

এতো বৃষ্টিনয় । ঝঞ্জা অথবা সক্রিয় আগ্নেয় গিরি । এক মহা প্রলয়ের পূর্বাভাষ !

মোহনার কাছে এসে পড়া ক্লান্ত নদীর মত যুবক সোজা হয়ে দাঁড়ালো । দৃষ্টি অপরিবর্তিত । হৃদয় প্লাবন যেন বিস্তৃন্ন সমুদ্র বক্ষের আস্বাদ গ্রহনে অধিক মাত্রয় উৎসুখ ।

কিন্তু এ সাধ যে মিষ্টি নয় লবনাক্ত । সে যাইহোক ছোঁকরাটি যে এ লবনেই জাড়িত এ কথা বলবার আর বোধয় প্রয়জন পড়েনা । একটা দলাকরা কগজের টুকরো প্রত্যাখিত হয়ে এসে পড়লো তার মুখের ওপর । তার পর একটা চর । নদীর অভিমুখে যে বাঁধ সদম্ভে দন্ডায়িত হলো তা আকাক্ষ্মীত না হলেও অসহেষ্ণু নয় । কারন ছেলেটি অতলান্ত গভীরতার মোহাক্রান্ত । তাই এ বাঁধ ভাংতে তাকে হবেই । Geotropism এর প্রভাবে উদ্ভীদ মূলের মাটি ছোঁয়ার মতো ছেলেটি নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রোইল ।

হটাৎ করে কলেজ গেটের ব্যাস্ত পরিবেশে নেমেএল আপেক্ষিক স্তব্ধতা । যে ঝঞ্জা এতোখন এগিয়ে আসছিল তা আছড়ে পড়ে তরীৎ গতীতে প্রস্হান করেছে । তার এই আগমন ভূকম্পন এবং প্রস্হান ছেলেটার হৃদয়ে কতটা ঘা দিয়েগেল বুঝে ওঠার আগেই ব্যপারটা অবগত করার জন্য সবাই ছোট কাগজের টুকরো টার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো লুটের বাতাসা কুড়বার মতো ।

অপ্রত্যাসিত হলেও অধ্যাপক পি.কে পাল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে । হাতে এটেনডেন্স খাতা চক ডাস্টার । কন্ঠো গমম্ভীর ।

- " দেখি কাগজ টা । "

আবার স্তব্ধতা । কারও কারও মুখে মিচকি হাঁসি । কাগজের টুকরোটায় কি লেখা আছে ; কারও অনুমান করতে অসুবিধা হয় না । নিশ্চীৎ ওটা প্রেম পত্র । প্রেমিক মহাশয় রূপম বাঘিনী নামে

কলেজ খ্যাত মিতা কে অর্পন করে ছিল এবং মিতা তা সক্রোধে প্রত্যাখ্যান করেছে । প্রেম পত্রের আদান প্রদান এ কলেজে নতুন নয় তব প্রত্যাখ্যান পর্বটি অভিনব ।

প্রত্যাখ্যান পর্বের সমস্ত দৃশ্যটাই ওপর থেকে লক্ষ করেছেন অধ্যাপক পি কে পাল । তাই ছাত্রদের রসভজ্ঞন করে এগিয়ে এসে মন্টুর হাত থেকে কেড়ে নিলেন চিঠি টা ।

মন্টু মাথা চুলকাতে লাগলো । সবাই চেয়ে রইলো একে অপরের মুখের দিকে ।

পি কে পাল চশমার ওপরের ফাঁকা থেকে চোখ বাড়ালো কাগজের টুকরো টার ওপর । অতি পরিচিত ইংরেজী তিনটে ভালভাসার শব্দ প্রত্যেক মানুষোই কোননা কোন বয়সে কার না কার উদ্দেশ্যে তা উচ্ছারন করে । সোনালী কালিতে লেখা শব্দগুলো অভ্র আর জরীর ভেতর উজ্জবল ;পি কে পাল দেখলেন তার নিচে রূপমের নাম টা লেখা । চিঠি টা থেকে ফুরফুর করে মিষ্টি একটা সেন্টের গন্ধ বেড়চ্ছিল । সে গন্ধ অ্যাপক ছাড়াও পাচ্ছিল আসপাশের ছেলে মেয়েরা । চিঠি টা হাতের মুঠোয় সবুত প্রমান হিসাবে কড়ায়ত্ব হতেই । রূপমের দিকে আবর্তিত হলো মোটা কাঁচের পেছনের বড় দেখান পি কে পালের ডেবা ডেবা চোখ দুটো ।

-" তোমাকে ভাল ছেলে বলেই জানতাম । প্রিন্সিপাল মহাশয় তো তোমার প্রসংসায় পঞ্চমুখ । তুমি নাকি গোবরে পদ্ম্যফুল । এত দেখছি পদ্মও নয় শ্যাপলাও নয় জলার পানা কচুরী । কলেজ টাকে বিন্দাবন বানিয়ে ছেড়েচ । "

সবাই হোহোকরে হেসে উঠলো রূপম আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো অবনত ভাবে ।

পি কে পাল পা বাড়ালেন টিচার্স রুমের দিকে ;যাবার সময় শেষ কথাটি বললেন ;

-" রসায়নের বদলে এবার আমি তোমাদের রোমান্সের ক্লাস নেব ।"

প্রিন্সিপাল রুমের দরজার কাছে এসে মিতা থেমে গেল । রুমের ভেতর যেন বাজ পড়ছে । যার এদিক ওদিক ছিটকে পড়া শব্দ গুলো মিতাকেও কাঁপিয়ে তুললো ।

_" তোমাকে নিয়ে আমার আনেক আশাছিল সব আশা মাটিতে মিশিয়ে দিলে । তোমার মতো ছেলেকে রাস্টিকেট করে কলেজ থেকে তাঁড়িয়ে দেওয়া উচিত দিতাম ও তাই । নেহাত সব প্রফেসারেরা আমার কাছে আবেদন করেছে তোমাকে যেন একটা সুযোগ দেওয়া হয় ; তাই এ যাত্রায় বেঁচে গেলে । পারলে নিজেকে সুধরে নিও না হলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে।"

একটু থেমে দীর্ঘ নিশ্বাসের সাথে সাসপেন্ট লেটার টা রুপমের দিকে এগিয়ে দেন প্রিন্সিপাল ।

-"তিন মাস এ কলেজের ক্লাসরুম ,লাইব্যেরি ,কমোনরূম কোনকিছুই তুমি ব্যবহার করতে পারবে না । "

মিতা এবার এগিয়ে আসে ;

-"মে আই কামিন স্যার ? "

প্রিন্সিপল তার বাজখাই গলায় বললেন ;

-" ইয়েস কামিন ।"

প্রিন্সিপাল মহাশয়ের টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল মিতা । টেবিলের অপর প্রান্তে এখন আসামীর মতো মাথা নিচুকরে দাঁড়িয়ে রুপম । চোখ দুটো তার লাল ; এসব ছেলেদের অপমান লজ্জা স্পর্শ করে কিনা জানানেই মিতার ।

প্রিন্সিপাল এবার রুপমের দিকে তাকালেন :

-"তোমার কিছু বলার আছে ?"

ইঙ্গিতটা এমন এবার তুমি আসতে পার ।

হলকা মাথা নেড়ে রুপম জানালো -"না ।"

তারপর প্রন্সিপাল মহাশয়ের টেবিলের ওপর থেকে প্রিন্সিপালের চিঠি খানানিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বেড়িয়ে যায় । এক বারো সে তাকায় না মিতার দিকে ।

মিতার দৃষ্টি এতখোন আবদ্ধছিল টেবিলের এক কোনায় অপমান বোধ তাকেও যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে । কলেজ ময় তাকে নিয়ে হোইহট্টোগোলের অন্তনেই । নিজেকে ভীষন ছোট মনেহচ্ছে তার । একটা সামান্য চিঠি নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি না করলেই বোধয় ভালহতো । কত মেয়েকেই তো মিতা দেখেছে এমন চিঠির শিকার হতে । এইতো সেদিন বিকাশের প্রানবন্ত সেন্টদেওয়া একখানা চিঠি মিতার ডেক্সের পাশদিয়ে ক্লাস চলাকালিন পৌঁছাল মৌসুমীর ডেক্সে । মিতা বড় বড় চোখে তাকিয়েছে । কিন্তু মৌসুমি কে সে দেখেছে ব্যাপার টা বেস উপভোগ করছে সে । মিতা পারেনা ওদের মতো নিজেকে মেলে ধরতে ।

প্রিন্সিপল বললেন ;

- "কলেজের কোন ছেলের গায়ে অমন করে হাত তোলা তোমার ঠিক হয়নি । চিঠি টা নিয়ে আমার কাছে আসা উচিৎ ছিল। "

মিতা চুপ করে থাকে । চিঠি টা পাবার পর কিযে হলো মাথা ঠিক রাখতে পারেনি সে । একটা অবগ্যা অপমান ছিল চিঠিটার অন্তকরনে । কিসের অপমান মিতাও ঠিক ভালভাবে জানেনা চিঠির কোন শব্দটা তাকে অপমান করছিল । তবে ভালবাসা সম্পর্কে মিতার ব্যাক্তিগত মত হল এটি মেকি ,জোচুরি ,নোংরা অভিসন্ধী ।

প্রিন্সপল রুমের দরজা অতিক্রম করার পূর্বে প্রিন্সিপল বললেন;

-" কলেজের আনাচে কানাচে কমোন রুমে এখন অনেকে অনেক কথা বলবে কান দিয়না ওসবে । "

ক্লাশ শুরু হয়নি ছড়িয়ে ছিটিয়ে জটলা বেঁধে আলোচনার ঝড় বইছিল ক্লাশ রুমে । মিতাকে দেখে কে যেন ফিস ফিস করে বলে উঠলো

_"ঐ যে বাঘিনী এসেগেছে ।"

ছাত্র ছাত্রীরা আড়ালে আপডালে তাকে এ নামেই ডেকে থাকে । মিতার গম্ভীর ভাবমূর্তিই এ নামকরনের উৎস । রুমা মিতার একমাত্রী বান্ধবী । স্কুল থেকে সে তার সহপাঠিনি । একি পাড়ায় থাকে সে । ক্লাস রুমে রোজকার মতো সেই একান্ত বান্ধবী টির পাশে এসে বসলো মিতা ।

রুমা বলল ;

-"কিরে আসার পথে আজ আমার জন্য দাঁড়ালি না । "

মিতা বলে;

-"দিদুন বলল তোর শরীর খারাপ । তাই ভাবলাম তুই বুঝি কলেজে আসবি না । "

ক্লাসরুমের ছোট ছোট জটলা গুলো তখন এক হয়ে গিয়েছিল । প্রিয়ঙ্কা গুছিয়ে বসল ডেক্সের ওপর । মিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল :

-" না এমন সুযোগ পেলে আমি লাইন মারতে ছাড়তাম না । কলেজের সমস্ত মেয়ে যার জন্য পাগল ;তাকে পেয়ে refuse; impossible ......!"

কাকলি কর্কোস কন্ঠ্যে আরো সংযোজন করল ;

-"বেশী সতী পানা । "

দেবু হাসতে হাসতে বলল ;

-"ছেলেটাও কি মাইরী ;বাপের এত টাকা ইচ্ছে করলে হাজার টা মেয়ে চড়াতে পারে । শেষে কিনা প্রেমে পড়লো একটা unsocial শাকচুর্নীর ।"

বিকাশ এই যঞ্জে ঘি ছিটালো ।

-"প্রেম কী আর যে সে প্রেম । দেবদাসের মত ঘন্টার পর ঘন্ট্যা ক্লাসের পর ক্লাস নায়ক নায়িকার দিকে চেয়ে বসে আছে । নায়িকার সে দিকে ভুরুক্ষেপ ও নেই । "

মন্টু বলল তার গুঠকা খাওয়া লাল দাঁত বাড়করে ।

-"শেষ পর্যন্ত মনের কথাটা ছোট্ট কাগজের টুকরোয় ট্রান্সফার হল নায়িকার ডায়েরিতে । "

রিন্টু চেঁচিয়ে ওঠে ;

-"বেশ কেলেঙ্কারী । "

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো ।

মিতার মুখের চারিপাশে ঘন ঘামের বিন্দ্যু জমতে শুরু করেছিল । অশান্তির আসংখা অনুভব করে মিতা বলে ;

-"আজ আর ক্লাস করতে হবে না । চল বাড়ি যাই । "

রুমা যে কটাক্ষ করে বুঝিয়ে দিল যতসব বাজে ছেলে মেয়ে এ কলেজে জুটেছে । এটা আর কার বুঝতে অসুবিধা হলো না । বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়তেই কোন একটি ছেলে মেয়েলি গলা করে বলল:

-"বাবা বাঘিনীর সাথে থেকে ছ্যুচটাও গর্জন করছে রে ।"

মিতা থমকে ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালে তার হাত ধরে ক্লাস রুমের বাইরে নিয়ে যায় রুমা ।



(দুই)

কিছুক্ষন আগে বজবজগামী শেষ লোকাল টা রাতের নিশতব্দতাকে ভঙ্গকরে সবকিছু কাঁপিয়ে সাসা বেগে চলেগেল । অন্ধকারে ডুবে থাকা দূরের বস্তির ঝুপরি গুলো থেকে যৎসামান্য আলো ফাঁক ফোঁকর ফুরে উকি মারছে । লাইনের ওপাড়ে একটা ব্যালকনিতে কারা যেন দাঁড়িয়ে । পুতুলের মত দেখাচ্ছে তাদের । সমস্ত পাড়া নিশতব্ধ । শীতের আমেজ রাত বারটাকে যেন আর গভির করে তুলেছে । মিতার মামি এঁটোবাসন বাইরে গুছিয়ে রেখে ; স্বামী কন্যাকে নিয়ে সুখনির্দাচ্ছন্ন । দিদুন এখন বাড়ি ফেরেনি । মিতার পড়ার খরচ চালাবার জন্য সেলাই করে সে । মিতার মা চিলেকোটার ঘরে বিড়াল বাচ্ছা গুলকে কাঁকেনিয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমচ্ছে ।

মিতা মায়ের কাছে গিয়েছিল ;দিদুনের একটা ছেঁড়া শাড়ি আর কিছু টুকরো বাতিল কাপড় দিয়ে মায়ের জন্য একটা কাঁথা বানিয়েছে সে । মায়ের গায়ে ঢেকে দিয়েছে সেটা । হাত বুলিয়েছে মায়ের মাথায় । ঘুমন্ত মায়ের হাতটা নিজের মাথায় রেখে বলেছে ;

-" আমাকে আদর করবে মা । "

ওরবড় ইচ্ছেকরে ঐ বেড়াল বাচ্ছাগুলোর মতো মায়ের কোলে মাকে জড়িয়ে ঘুমাতে । মা হাত টেনে নিয়েচে ঘুমের ঘোরে । আশ্রয়হিনতার যন্ত্রনায় মিতার চোখ বেয়ে এসেছে জল । রোজ রাতে সবার চোখের অলক্ষে সে তার মাকে দেখতে আসে ; অন্ধকার এই চিলেকোটার সরু পায়রার খোপের মত ঘর টায় । এখানে কুকুর বিড়ালের মত তার মা বেঁচে আছে । সারা দিনে এই ক্ষুদ্র সময় টুকুর জন্য সে তার মাকে কাছে পায় ।

এমনি এক রাতে বিছানা থেকে উঠে মাকে আদর করতে এসেছিল মিতা । বুঝতে পারেনি মা জেগে ;গলা চেপে ধরেছিল তার । দমআটকে আসছিল ; চিৎকার করে কেঁদে ফেলেছিল মিতা !দিদুন,মামা,মামি বাড়ি শুদ্ধু সবার ঘুম যায় ভেঁঙে । মায়ের হাত থেকে মামা মিতাকে ছাড়িয়ে সজোরে চর কষিয়ে ছিল ।

-" রাতের বেলা এই পাগলিটার কাছে আদিখ্যেতা করতে এসেছিস । "

দিদুন কে গালিগালাজ করে বলেছিল ;

-" তুমি মেয়েটার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছ । "

অবশেষে সারা রাত বিছানায় দিদুনকে আঁকরে ধরে কেঁদেছিল মিতা । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বার বার বলেছিল -"ঐ পাগলী টা আমার মা দিদুন । আমার মা......."

ফাঁকা ছাদের রেলিংয়ে চিবুক রেখে মিতা চেয়ে আছে দূরে রেল লাইনের অবিচলিত স্হীর ল্যাম্প পোস্ট গুলোর দিকে । ঝড়-বৃষ্টি,শীত-গ্রীষ্ম সকল দূর্যোগ মাথায় নিয়ে ও গুলো কেমন ভাবলেস ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে । মিতা চায় ঠিক অমনি ভাবে তার দুঃক্ষ -কষ্ট ,অবগ্যা -আবহেলা,প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সব কিছুকে উপেক্ষা করে ওদের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে । অসমতল,অস্বচ্ছ এই জীবন পথে চির অটল অনড় ভাবে।

কখনো কখনো তার দৃঢ়তায় ভাঁঙ্গন চলে । মিতা অসহায় বোধ করে । কৈসর কেটে গেছে মামির ফাইফরমাইস খেটে । সদ্য প্রাপ্ত যৌবনেও তার জীবনে কোন রসসিক্ত পরিবর্তন আসেনি । তার একাকিত্বতা আরো চেপে ধরেছে তাকে । হোই হুল্লর ,সিনেমা সিরিয়াল,গান বাজনা কিছুই ভাল লাগে না তার । মা বাপের স্নেহের দুলালী হয়ে উঠতে পারেনি সে আর দশজনের মতো । দিদুন ছাড়া কাছের বলতে তার আর কেউ নেই । দিদুনের কিছু হয়েগেলে একদম একা হয়ে যাবে মিতা । কথটা ভাবলেই ভাড়ি হয়ে ওঠে মিতার মোন ।

মিতার মাথায় তেল মাখানোর সময় ;দিদুন সমস্ত আশির্বাদ ভালবাসার প্রলেপের সাথে ঢেলেদিয়ে বলে ;-"তোমারে বড় হতে হইব । মানুষ হতে হইব । কেডা কয় তোমার কেউনাই !তোমার মা আসেনা ;তারে তোমারে দেখতে হইব । আমি আর কদিন ।"

-"না দিদুন ও কথা বলনা । "

দিদুনের গালে চুমু খেয়ে এ কথাটা বললেই ছোটবেলা থেকে গলা জড়িয়ে ধরে মিতা । আদর করার ও আদর পাবার তার একমাত্র সম্বল এই দিদুন ।

পাড়ার রাস্তার আবছা অন্ধকার ভেদকরে খয়েরি চাদরে মোড়া সেই বুড়িটা এগিয়ে আসছে এই বাড়িটার দিকে । কিছু ক্ষন পরে ছাদের ভেজান দরজাটা সানডে সাসপেন্সর ভুতের বাড়ির সদর দরজার মত কেঁচকেঁচ আওয়াজে খুলে গেল । মিতা শুনতে পেল অতিপরিচিত দিদুনের আদুরে গলার ডাক ;

-"কেডারে ওহানে ? মিতু ? "

-"হ্যাঁ দিদুন ।"

চাঁপা বসাগলায় উত্তর দিল মিতা ।

-"গলাটা এমন বসলো কি কইরা ? ঠান্ডা লাগায়েছস । কি দরকার ঠান্ডায় ছাদে দাঁড়ায়ে থাকনের ?"

রোজয়ি দিদুন প্রশ্নটা ছুড়েদেয় মিতা কে । কিন্তু সে কোন উত্তর না করে দিদুনের হাত ধরে ঘরে ঢোকে। তারপর ঢেকে রাখা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমতে যায় ।

আজ মিতার নিয়মানুবর্তিতায় দিদুন ফরাক অনুভব করল । তেমন প্রানোচ্ছল অব্যরথনা ছিলনা তার ব্যবহারে । দিদুনের খাবার বেড়ে চৌকির ওপর উঠে মোশারির কোনগুলো টাঙাতে ব্যাস্ত হয়ে উঠলো সে । ছাদে ধুয়ে আসা ভিজে হাত খানা গামছায় মুছতে মুছতে এ সমস্ত কিছু দেখে দিদুন বুঝতে পারে মিতার মন টা ভাল নেই । মিতার জীবনের সব কম্পন;সব অনুভূতি দিদুনের সদা সহানুভূতিশীল হৃদয়ের রিক্টার স্কেলে ধরাপরে ছোটবেলা থেকে নিজের হাতে নেড়েচেড়ে মানুষ করেছে তাকে ।

- "কি হইছে ;তোরে কেউ কিছু কইছে ? "

মিতা মশারি গুজতে গুজতে থেমে যায় । মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে না বলে ।

দিদুন আবার প্রশ্ন করে ।

-"মায়ের শরীর খারাপ করছে । "

মিতা আবার মাথা নেড়ে না বলে বালিশের ওয়ার ঠিক করতে থাকে ।

দিদুন তবুও মিতার কথায় আশ্বস্ত হতে পারেন না ।

-"তোরে এমন মন মরা দেখাইতেছে কেন ?"

মিতা ম্লান মুখটায় একটা চেষ্টাকৃত হাসি আনার চেষ্টাকরে বলে ;

-"কই কিছু হয়নিতো । "

এই সামান্য কথাটুকু বলতে গিয়ে তার গলা ধরে আসে ।

দিদুন বিছানায় বসে মিতাকে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন । মিতাকে হালকা করার এ প্রন্হা সতের বছর ধরে অবলম্বন করে চলেছে সে । এ ভালবাসায় যেন লোহাও গলে জল হয়ে যায় ।

-" আমারে লুকাস ক সোইনামনি কে তোরে আঘাত কইরেছে !"

অতিরিক্ত আদরের সময় মিতাকে দিদুন সোনামনি বলে । কেঁদে ফেলে মিতা ।

দিদুনের বুকে মুখ গোঁজে ।

-"আচ্ছা দিদুন আমি কারো সাথে মিশতে পারি না কেন বলত !"

দিদুন আর যত্নকরে মিতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ;

-"কেডা কয় এ সব ;তার মুহে ঝাঁটার বাড়ি । আহলে তুই গায়ে ঢলাঢলি পিরিত পছন্দ করোস না তাই ওরা হিংসায় মরে । চতো খেয়ে নিবি চ । "

গ্রাস আর ওঠে না মিতার মুখে । একটা প্রশ্ন মিতা কে তোলপাড় করছে । তার কঠিন রূঢ় দৃঢ় যে আদর্শ যে চেহারা তার তলায় কী চাপা পড়েনেই এক কোমল সরল সাদাসিদে মেয়ে !আর দশটা মেয়ের মতো যে জীবনের রূপ , রস ,গন্ধ্য প্রকৃতির রোদ্রুরে মেলে ধরে সালোকসংশ্লেষের মত উপলব্ধী করতে চায় জীবন কে । মিতা বুঝতে পারে ;তার দূর্ভেদ্য আদর্শের জটলা গুলো বিধাতা স্হাপন করেছেন নিপুন ভঙ্গীমায় । এক দগ্ধ মায়ের জীবনচরিত মেয়ের জীবনের রন্ধে রন্ধে পৌঁছে সদ্য বিকশিত কিশোরী হৃদয়কে করে তুলেছে পৌড়া । সকলের চোখের অলক্ষে তাই তার মোন কাঁদে যৌবন ফিরে পেতে ।

রাতের উচ্ছিষ্ট খাবার বিড়াল দের ভোগ্য করে এঁটো বাসন ধুয়ে গুছিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় প্রবেশ করে মিতা । হাত জড়ো করে ভগবানের কাছে তার নিত্য নৈমিত্যের গুরু প্রর্থনা সেড়ে ততোখনে দিদুন ও বিছানায় পিঠ ঠেঁকিয়ে ছিল । তার চোখে দিন ক্লান্তিতে ছেয়ে আসছিল ঘুমের কোঁয়াসা । মিতার মনে তোলপাড় করছিল জিঞ্জাসার ঢেউ । হৃদয় ভেদকরে মুখমন্ডল থেকে পিছলে এবার সেই ঢেউয়ের একফালি স্পর্শকরে দিদুন কে ।

- "আচ্ছা দিদুন তুমি কখন কাউকে ভালবেসেছো ?"

দিদুনের অবসন্ন ঘুমাচ্ছন্ন চোখ দুটিতে ; মিতার প্রশ্নটা সরষের তেলের ঝাঁজের মতো ঘুম কেড়ে নিল । কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে প্রতিদিন কার মত বেড সুইচ টিপে লাইট অফ্ করে সে । তারপর মিতার কথাটা এড়িয়ে যাবার ভঙ্গীতে সে বলে ;

-" ঘুমিয়ে পড় । "

দিদুন তখন ভাসছে স্মৃতির ভেলায় ।

গ্রামের সান বাঁধান পুকুর ঘাটে বসে বছর চৌদ্দর একটি মেয়ে । সূর্য লাল বর্নের হয়ে পশ্চিমের পুকুড় পাড়ের হিজল , তেঁতুল গাছ গুলোর মাথা চুইয়ে দূরে কোথায় লুকিয়ে পড়ছে কেউ জানে না । লজ্জায় রাঙা নব বধূর মতো সূর্যটার আলতা রঙ্গে ; পুকুড়ের জল ও রক্তিম হয়ে উঠেছে । পাখিরা বাসায় ফিরছে সাড়ি বেঁধে । ঘাটে বসা মেয়েটার লাল ডোরা শারীর কোঁচরে বাঁধা একরাশ নুড়ি থেকে একটা একটা করে ছূড়ে মারছে সে । নুড়ি জলো স্পর্শ করে তলিয়ে যাবার আগে সৃষ্টি করে যাচ্ছে তরঙ্গ । একটা তরঙ্গ মিলতে না মিলতে আর একটা তরঙ্গের সৃষ্টি করে মেয়ে টা । বিন্দু থেকে তরঙ্গ গুলো ছড়িয়ে পরছে পর্যায় ক্রমে কতগুলো চক্রে ।

সহসা একটা ছেলে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে । পেছন থেকে চোখ চেপে ধরে মেয়েটার ।

এ স্পর্শানুভূতি মেয়েটার অপরিচিত ছিল না । নিজের চোখ দুটোকে স্বাধীন করে তরিৎ গতীতে অভিমানের ভঙ্গীতে দুধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে ঘাটের পাড়ের দিকে ওঠে মেয়ে টা ।

-"তোমার লগে আমার কোন কথা নাই কামাল দা । সেই দুপুর থেইকা বয়ে আছি তোমার আয়নের সময় হয় না । "

কামাল সহানুভূতির ভঙ্গীতে মেয়েটির কাছে এগিয়ে এলে চোখ থেকে ফোটা ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে মেয়েটার ।

-"কাল ফরিদ পুরের মামা বাবু আইসেন । আমারে ফরিদপুর লয়ে যাইবে । ওহানে মামার বাসায় আমার বিয়া দেবে। পাত্রর ইস্কুল মাস্টার । মামাগো গ্রেরামেই থাহে । জোয়ান মদ্দ তুমি দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে দেহ খালি । "

মেয়েটির হাত চেপে ধরে কামাল । এবার আর চোখের জল বারন শোনেনি । কামালের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বলেছিল ।

- "তোমারে না পাইলে আমি বিষ খাইয়া নেব । "

মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কামাল বলেছিল ;

-" অমন কথা কইতে নাই মালতী । "

চোখের জল মুছতে মুছতে মালতী মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল কামালের দিকে ।

-"কামাল দা চল আমরা কোহাও পালায়ে যাই । "

কামাল খুব শান্ত ভাবে বলেছিল ;

-"কোহায় পালামু । শেষমেষ কি শেয়াল কুকুরের ভোগ্য করুম তোরে । "

কামালের কয়েক সপ্তা না কাচা শতো তাপ্পি মারা সুতির জামাটা মালতী চেপে ধরে ছিল গায়ের জোড়ে ।

-"যদি বাসাই না দিতে পারবা কেন বাসা বাঁধনের স্বপ্ন দেখাইছিলে । "

কামাল ম্লান মুখে মাথা নিচু করে নিয়েছিল ।

-"আব্বা গো ধইরে বসে আছেন হিদুর মেয়ে কাফের । আব্বারে আমার ডর নাই ;ডর গ্রাম ছাড়নের কোহায় যামু কেমনে তোরে রাখুম । "

কামাল কে ধাক্কা মেরে দু পা পেছনে সড়ে দাঁড়িয়ে ছিল মালতী ।

-"হাতে চুড়ি পড়ো গে । পুরুষ হয়ে জন্মেছো একটা মাইয়া মানষের রক্ষা করনের ক্ষমতা নাই ।


(চলবে)