২৯ অক্টো, ২০১৩

প্রবন্ধ - মৌ দাশগুপ্ত


কুসংস্কার ও আমরা
মৌ দাশগুপ্ত




কুসংস্কার বিরোধী কর্মী নরেন্দ্র দাভোলকার স্বভাবে ছিলেন আজীবন লড়াকু৷ তাঁর নেতৃত্বেই মহারাষ্ট্রে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল আন্দোলন৷ বাধ্য হয়েই মহারাষ্ট্র সরকার কুসংস্কার এবং কালো জাদু বিরোধী আইন আনায় সম্মতি দিয়েছিল৷ সেই সমাজসেবী নরেন্দ্র দাভোলকারের মাথা ফুঁড়ে দিল আততায়ীদের ঘাতক বুলেট৷ সময়টা খুব পুরানো না। মাত্র ২০শে আগস্ট ২০১৩। যুক্তিবাদ, সংশয়বাদ, মানবতাবাদ, নাস্তিকতা কিংবা ইহজাগতিকতার মত আধুনিক ধারনাগুলো সমাজ সচেতন মানুষের কাছে ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু তবুও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ ‘বিশ্বাস নির্ভর’ সিস্টেমের আবর্তেই বন্দি। হাজারো প্রচলিত সংস্কার, তুক তাক, অপবিশ্বাস, ব্যক্তিপুজা আর সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ইদানিং যুক্ত হয়েছে বৈজ্ঞানিক মোড়কে পুরে সুবেশিত উপায়ে ভাববাদের পরিবেশন।

আমাদের দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বহু যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা, বিশ্বাস, গোঁড়ামি,কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। যা প্রতিনিয়ত মানুষ কথায় ও কাজে ব্যবহার করে থাকে।সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই সমাজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য কুসংস্কার থেকে এখানে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করার চেষ্টা ।এসবের সঙ্গে বিজ্ঞান ও ধর্মের কোন মিল নেই,শুধুমাত্র সামাজিক বিভিন্ন পরম্পরায় আমরা অনেকে এসব মেনে আসছি । এসব কুসংস্কারের মধ্যে কিছু সাধারণ বিবেক বিরোধী এবং রীতিমত হাস্যকরও । এসব না মানলে কোথাও কেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও শোনা যায়নি আজ পর্যন্ত । শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সচেতন, অসচেতন সব ধরনের মানুষ অন্ধবিশ্বাসে এগুলোকে লালন করে। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরী কিনা সেই আলোচনায় না গিয়ে আসুন জেনে নেই এমনি কিছু মজার কুসংস্কার । তবে কারো নিয়ম বা অনুভূতিতে আঘাত লাগলে তার জন্য আমি দায়ী থাকবোনা ।

১) ডান হাতের তালু চুলকালে টাকা আসবে। আর বাম হাতের তালু চুলকালে বিপদ আসবে।

২) বাড়ী থেকে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশে বা’র হলে সে সময় বাড়ির কেউ পেছন থেকে ডাকলে অমঙ্গল হয়।

৩)রাতে নখ, চুল ইত্যাদি কাটতে নাই।

৪) বিড়াল মারলে সমপরিমাণ লবণ দিতে হবে।

৫) ঘর থেকে কোন উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর পেছন থেকে ডাক দিলে যাত্রা অশুভ হবে।

৬) ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হবে।

৭) ছোট বাচ্চাদের দাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্তে দাঁত ফেলতে বলা হয়, এবং সঙ্গে এই মন্ত্র বলতে শিখানো হয়, “ইঁদুর ভাই, ইঁদুর ভাই, তোর চিকন দাঁত টা দে, আমার মোটা দাঁত টা নে।”

৮) ভাঙ্গা আয়না দিয়ে চেহারা দেখা যাবে না। তাতে চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে।

৯) হঠাৎ বাম চোখ কাঁপলে দুঃখ আসে।

১০) রাতের বেলা কাউকে সুঁই-সূতা দিতে নাই।

১১) খালি ঘরে সন্ধ্যার সময় বাতি দিতে হয়। না হলে ঘরে বিপদ আসে।

১২) কোন ব্যক্তি বাড়ি হতে বাহির হলে যদি তার সামনে খালি কলস পড়ে যায় বা কেউ খালি কলস নিয়ে তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করে তখন সে যাত্রা বন্ধ করে দেয়, বলে আমার যাত্রা আজ শুভ হবে না।

১৩) শকুন ডাকলে মানুষ মারা যাবে।

১৪) পেঁচা ডাকলে বিপদ আসবে।




এতো গেল পুরানো কুসংস্কার। এবার আধুনিক কুসংস্কার নিয়ে কিছু বলা যাক। ভ্রান্ত চিন্তা, কুপমুন্ডুকতা আর অন্ধবিশ্বাস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজকেও। কার্ল মার্ক্স, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ, মাদার টেরেসা, শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বড় বড় নামগুলো তৈরী করেছে ইতিমধ্যেই তৈরী করে ফেলেছে কিছু অযাচিত মিথ; জন্ম দিয়েছে শত সহস্র স্তাবকের। এ সমস্ত মনীষীদের আনেকেই অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল চিন্তা করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার তৈরী করেছে কিছু অন্ধবিশ্বাসীদের যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মানেই অভ্রান্ত সত্যি। তাদের ‘আরাধ্য দেবতাদের’ ন্যুনতম সমালোচনাও তাদের কাছে অসহনীয়। গনহিস্টিরিয়াগ্রস্ত এ সমস্ত স্তাবকদল বোঝে না যে, যুক্তির কাছে ‘ব্যক্তিপূজা’র প্রাবল্য অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না। রবীন্দ্রনাথের ব্রক্ষ্মসঙ্গীতের ওপর নির্ভর করে প্রমাণিত হয় না পরম ব্রক্ষ্মের অস্তিত্ব। শুধু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেই নয়, কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের প্রশস্তি করেছেন, ভেবে নিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন ছাড়া ভারতবাসীর মুক্তি অসম্ভব। আবার কখনও বা নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তিকে অস্বীকার করে বলেছেন, ‘প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।’। এধরনের বিশ্বাস কিংবা মন্তব্যগুলোর কোনটিই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অভ্রান্ততা তুলে ধরে না, বরং প্রমাণ করে যে চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। একজন প্রকৃত যুক্তিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমাজ সংস্কার ও কুসংস্কার থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিই।

আমাদের নব্য সম্প্রদায় উন্নতিপথের কণ্টকস্বরূপ কুসংস্কারগুলিকে একেবারে উন্মূলিত করিতে চান, ইহা অপেক্ষা দেশের সৌভাগ্য আর কিছুই নাই। কিন্তু কোন্টা কুসংস্কার সেইটে বিশেষ মনোযোগ করিয়া আগে স্থির করা দরকার। মন্দ মনে করিয়া ভালোকে দূর করিয়া দিলে দেশের বিশেষ উপকার হয় না, কারণ, কেবলমাত্র মহৎ-উদ্দেশ্য লইয়া ঘরকন্না চলে না। তাহা ছাড়া, দেশী কুসংস্কারের জায়গায় হয়তো বিলাতি কুসংস্কার রোপণ করা হইল, তাহার ফল হইল এই যে, গোরা ডাকিয়া সিপাই তাড়াইলে, এখন গোরার উৎপাতে দেশছাড়া হইতে হয়! যাহা হউক, ইহা বোধ করি কেহ অস্বীকার করিবেন না যে, যদি সেই কুসংস্কারই পুষিতে হইল তবে আমাদের দেশের আয়ত্তাধীন রোগা ভেতো কুসংস্কারই ভালো, বিলাতের গোখাদক জোয়ান কুসংস্কার অতি ভয়ানক!’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ অজয় রায় তার ‘বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞান মনস্ক সমাজ নির্মান’ নামক একটি নিরিক্ষাধর্মী প্রবন্ধে লিখেছিলেন,

‘জ্ঞানের একমাত্র উৎস যদি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি হয়, তাহলে সেই সমাজে নেমে আসবে বন্ধ্যাত্ব, সমাজ হবে জড় চেতনা-চিন্তায় আচ্ছন্ন, সৃষ্টিশীলতার স্থান দখল করবে কুসংস্কার, মূর্খতা, কুপমন্ডুকতা আর অজ্ঞানতা। আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে কুসংস্কার আর প্রযুক্তিবিদ্যার ফসলকে আত্মস্থ করার পারস্পরিক সহাবস্থান। বিজ্ঞানের যুক্তি চাই না, চাই তার ফসল, পাশে থাক অন্ধবিশ্বাস আর ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পন। এই সমাজেই সম্ভব - ড্রয়িং রুমে রঙ্গিন টেলিভিশন সেট স্থাপন, এবং হিস্টিরিয়া-আক্রান্ত কন্যাকে পীরের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রেরণ। এই সমাজেই সম্ভব- অনুরসায়নবিদদের রসায়ন চর্চার পাশাপাশি তথাকথিত পীরের পদচুম্বন।’

বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আজ যখন মানুষ মঙ্গলে পাড়ি জমানোর আয়োজন করছে, মহাশূন্যে বসতি স্থাপনের তোড়জোড় করছে বিভিন্ন মরণ ব্যাধির বিরুদ্ধে তার অস্ত্রকে করে তুলেছে আরো শাণিত, মাতৃগর্ভের বাইরে সন্তান ধারণের চিন্তা করছে, ঠিক সে সময়ে আমাদের দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী মনে করে মানুষের চাঁদে যাবার ঘটনা পশ্চিমা ষড়যন্ত্র, ভূমিকম্পের সময় আজান দিলে ক্ষয়ক্ষতি হবে কম, ‘শেতলা দেবী’র পূজা দিলে বন্ধ হবে কলেরা, স্বপ্নাদিষ্ট সাধুবাবার কথায় বিশ্বাস করে এই মহান ভারতে হাজারটন সোনার লোভে মাটি খোঁড়া হয় সরকারী মদতে।আজও।দেশে প্রচলিত ধ্যান ধারণাগুলোকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। 




প্রথমত সংস্কার। এগুলো বেশির ভাগই জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতাপ্রসূত। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারের আগে বিভিন্ন ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা দিতে মানুষ তার কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করতো, যুক্তি ও পরীক্ষাকে বাদ দিয়ে। এর মধ্যে কিছু কিছু সংস্কারের বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়, ফলে এসব হয়ে যায় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ হিসেবে ‘রাত্রে গাছতলায় ঘুমানো বা বিশ্রাম নেয়া টিক নয়।’ এই প্রচলিত বিশ্বাসটির কথা ধরা যাক। রাতের বেলায় উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণ (যে প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ সৌরশক্তির সাহায্যে তার খাদ্য তৈরি করে এবং অক্সিজেন নির্গত করে) প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে, কিন্তু শ্বসন (এতে নিগর্ত হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড) চালু থাকে। ফলে রাতে উদ্ভিদের আশেপাশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আধিক্য ঘটে। জানা কথা, মানুষের জন্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মোটেই ভাল নয়।

দ্বিতীয় বিভাগটি হচ্ছে ভ্রান্ত বিশ্বাস-সংস্কারের মধ্যে যেগুলোর কোন প্রামাণিক ভিত্তি নেই। একটা উদাহরন, মহাশুন্যে পৃথিবীর অবস্থানকে ধরা যাক। পৃথিবীতে কোন বস্তুকে অবলম্বন ছাড়া আমরা ভেসে থাকতে দেখি না। এবার এই তত্ত্বটিকে পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে বলতে হবে পৃথিবী দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘নাগরাজ বাসুদেবে’র সহস্র এক ফণার ওপর। কিংবা এটি রয়েছে কোন কচ্ছপের পিঠে। অথচ, নিউটন এসে দেখালেন পৃথিবী শুন্যে ভেসে রয়েছে কোন অবলম্বন ছাড়াই। তার বড় অবলম্বন সূর্যের টান বা অভিকার্যের।

তৃতীয়টি অন্ধ বিশ্বাস, এই ক্ষেত্রে আমরা আর একটা উদাহরণ দেবো। পুরুষ (অনেক নারীও বটে) বিশ্বাস করে ‘মেয়ে সন্তান হয় স্ত্রীর দোষে’। কাজেই গ্রাম বাংলায় পুরুষের পুত্র সন্তান লাভের আকাঙ্খা অনেক নারীর জন্য বয়ে আনা দুর্ভোগ। অথচ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে মায়ের কোন ভূমিকাই নেই। সংক্ষেপে বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- পুরুষের জনন কোষে থাকে ‘এক্স’ ও ‘ওয়াই’ ক্রোমোজোম (ক্রোমোজোম হচ্ছে জীবকোষের কেন্দ্রস্থ একটি উপাদান যাতে বংশগতি বৈশিষ্ট্যের ধারক ‘জীন’ থাকে) এবং মেয়েদের শুধু ‘এক্স’ অর্থাৎ ছেলে। আর পিতৃদেবের সরবরাহকৃত ক্রোমোজোম যদি হয় ‘এক্স’ তাহলে সন্তান হবে ‘এক্স-এক্স’ ক্রোমোজোম বিশিষ্ট অর্থাৎ মেয়ে। কুসংস্কার বা ভুল বিশ্বাসগুলো ছাড়া প্রচলিত বিশ্বাসের সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান হচ্ছে ‘অন্ধ বিশ্বাস’। অন্ধ বিশ্বাসগুলোর মূল ভিত্তিই হচ্ছে ধর্ম।

“পথের দাবী” উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নায়ক সব্যসাচীর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন “সমস্ত ধর্মই মিথ্যা,- আদিম দিনের কুসংস্কার। বিশ্বমানবতার এতোবড় পরম শত্রু আর নেই।” খ্রীষ্টান ধর্ম প্রসঙ্গেই উক্তিটা এসেছিলো। কিন্তু আজ অনুমান করি, সেদিন ওকথা বাঙালীর পক্ষে ওভারডোজ ছিল। ঔপন্যাসিক হিসাবে শরৎচন্দ্রের অনেক স্ববিরোধ থাকতে পারে, সব্যসাচী নিখুঁত চরিত্র না হতে পারে। সাহিত্য আলোচনার দিকে না গিয়েও এটুকু বলতে পারি যে একথা পড়ে অনেকে শকড হয়েছিলেন।সত্য কথা বলবার বিপদ অনেক।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন