আমাদের নজরুল
“ যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে ।
অস্তপারের
সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে ।
বুঝবে
সেদিন বুঝবে । ‘’’
“অভিশাপ।“ কবিতায় লেখা কবির এই ছত্রগুলো কি সত্যিই আমাদের
প্রতি কবির অভিশাপ বাণী? নাকি আপনজনের প্রতি কোনও তীব্র অভিমান বোধ ? একটা গোলাপ
যখন তার শেষ গন্ধটা বিলিয়ে দিয়ে পাপড়িগুলো ঝরিয়ে দেবার উপক্রম করে, তখন সে কি এমনই
এক অভিমান মেশানো সতর্কবাণী রেখে যায় গাছটার জন্যে ? যাতে গাছটা ভূ-লুন্ঠিত
গোলাপের পাপড়িগুলোকে দেখে তার শেষ গন্ধটা বাতাসে খুঁজে নেবার চেষ্টা করে ? রূপ, রস
আর গন্ধে ভরা ফুলটাকে স্মৃতিপটে সদা-উদ্ভাসিত রাখার প্রয়াস পায় ?
এ কথা সত্য যে নজরুল আজ হারিয়ে গেছেন । কিন্তু এই অন্তর্ধান
নিছকই এক বাহ্য ও আবশ্যিক প্রাকৃতিক পরিণতি । নজরুলের কায়া হারিয়েছে মাত্র, ছায়া
নয় । নজরুল হারিয়েছেন প্রকৃতির পশ্চাৎপট থেকে, আমাদের তথা বাঙ্গালীদের হৃদয়ের
পশ্চাৎপট থেকে নয় । তাই নজরুলের খবর জানার জন্য সুদূর অস্তপারের সন্ধ্যাতারার কাছে
যেতে হবে না । তাঁর হিমালয়- সদৃশ সু-উচ্চ কাব্য ও সাহিত্যপ্রতিভা, মহাসাগরের মত
সুগভীর আত্মপ্রত্যয় আর দেশাত্মবোধ এবং মানবতাবোধের অপূর্ব অবিনশ্বর কীর্তিগুলির
সঠিক অনুধাবনই আমাদের পৌঁছে দেবে নজরুলের সঠিক ঠিকানায় ।
সুতরাং আজ সময় এসেছে বিদ্রোহী কবিকে যথার্থ অনুশীলনের ।
মহাকালের কষ্টিপাথর আজ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে নজরুলের সঠিক মূল্যায়নের । নজরুলের
কবিতা বাংলা সাহিত্যের ভাঁড়ারে এক অপূর্ব সম্পদ । বেশীর ভাগ কবিতাই সুরের সমুদ্রে
অবগাহন করে সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করেছে । ক্লাসিক সঙ্গীত জগতে “নজরুলগীতি” নামে
আখ্যায়িত হয়েছে । রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে সমান্তরাল এক প্রবাহে বিশ্বময় বয়ে চলেছে
স্ব-মর্যাদায় ও স্ব-মহিমায় ।
নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী কবি । কেমন ছিল সে বিদ্রোহের প্রকৃতি
? এ ইতিহাসের অধ্যয়ন জরুরী হয়ত আরও বহু ভবিষ্যতের জন্য । মানুষের জীবনপ্রবাহ যতদিন
চলবে ততদিন চলবে এ আন্দোলন । এ আন্দোলন হয়ত কোনও শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতের নয় । এ
আন্দোলন হয়ত রাজার বিরুদ্ধে প্রজার নয় । এ আন্দোলন কু- প্রথার বিরুদ্ধে, এ আন্দোলন
সর্ব প্রকার কুশিক্ষা বা অশিক্ষার বিরুদ্ধে, এ আন্দোলন যে কোনও সামাজিক বৈষম্যের
বিরুদ্ধে, এ আন্দোলন যে কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ।
নজরুল ছিলেন সেই বিদ্রোহী যিনি কখনও মাথা নীচু করেন নি কারও
কাছে । অন্যায়ের কাছে আপোষ তাঁর কাছে ছিল আত্মহত্যারই নামান্তর । তাই অক্লেশে তিনি
বলতে পেরেছিলেনঃ
“বল বল, বল উন্নত মম শির !
শির নেহারি, আমার নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির ।“
নজরুল ছিলেন সেই বিদ্রোহী যিনি অত্যাচারী বিদেশী শাসকের
কারাগার ভাঙ্গতে দেশবাসীদের দিয়েছিলেন এক নির্ভীক প্ররোচনা ।
“কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
রক্তজমাট শিকলপূজার ঐ পাশান-বেদী”
নজরুল ছিলেন সেই বিদ্রোহী যিনি বন্দীদের জুগিয়ে দেন অফুরন্ত
সাহস, বল ও প্রেরণা । বলা বাহুল্য এই বন্দীরা
কেউ সাধারণ বন্দী অর্থাৎ চোর ছ্যাঁচোড় গুন্ডা বদমাশ নয় । এরা রাজবন্দী মানে
তৎকালীন অত্যাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ।
“ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল ঝনঝনা,
ও যে মুক্তিপথের চরণ- বন্দনা !”
দেশময় যখন অত্যাচার আর অনাচারের বান ডেকে যাচ্ছে তখন
মানব-দরদী নজরুল কি শান্ত থাকতে পারেন ? অশান্ত হয়ে উঠল তাঁর কলম । লিখলেনঃ
“আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ
কৃপাণ ভীম-রণভূমে রণিবে না !”
জাত-বিচার কি শুধুই অশিক্ষা কিংবা কুসংস্কারগ্রস্ত সমাজের
একটা রোগলক্ষন ? নাকি কোনও সুকৌশলী মস্তিষ্কের মরণ খেলা ? স্পষ্টভাষী কবির কলমে
তাই স্পষ্ট এক সতর্কবাণীঃ
“ জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে জাত ছেলের নয়ত মোয়া ।
....................................
নারায়নের জাত যদি নাই
তোদের কেন জাতের বালাই ?
(তোরা) ছেলের মুখে থুতু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া !”
নজরুলের দেশাত্মবোধ কেমন ? অত্যাচারিতা লাঞ্ছিতা দেশ মাতৃকার
নগ্ন রূপটাকে কেমন ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি ?
“আর কতকাল থাকবি বেটী
মাটির ঢেলায়
মূর্তি আড়াল,
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে
অত্যাচারী
শক্তি চাঁড়াল ।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক,
বীর যুবাদের
দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কশাইখানা
আসবি কখন
সর্বনাশী ? “
আজকের এই স্বাধীন ভারতে কথাগুলোর অর্থ অনুধাবন করতে আমাদের
কিঞ্চিত কষ্ট হলেও সেদিনের সেই ব্রিটিশ শাসকের বুঝতে অসুবিধা হয় নি এতটুকু । কবির
সম্পাদিত “ধূমকেতু” পত্রিকার প্রথম পূজো সংখায় এ কবিতা প্রকাশ হওয়ার পর আর
বিন্দুমাত্র দেরি করে নি তারা । চোর ছ্যাঁচড়দের মত কারাগারে অন্তরীন করেছিল এই
মহাশক্তিকে । বিচার চলল কবির । আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনও আপোষ নয় । আজীবন সত্যনিষ্ঠ
কবির নির্ভীক উক্তিঃ
“বিচারক জানে আমি যা বলেছি, যা লিখেছি তা ভগবানের চোখে
অন্যায় নয় । ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয় । কিন্তু তবু সে শাস্তি দেবে । কেন না, সে
সত্যের নয়, সে রাজার । সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের । সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য ।“
দেশ পরাধীন, দেশবাসীর মাথা বিদেশীর পায়ের তলায় লুটোচ্ছে ।
কিন্তু এ চেতনা তখন কজন ভারতবাসীর ছিল ? এ চেতনা জোগালেন স্বয়ং নজরুল । লিখলেনঃ
“এ দেশ কার ? তোর নহে আর ।
রে মূঢ সন্তান ! ভারত মাতার ।।
দেবতার দেশে আজ
দৈত্য করে বিরাজ
মন্দির আজই বন্দীর কারাগার ।।“
ধর্মীয় উদারতা কেমন ছিল নজরুলের ? আসুন, এ ব্যাপারে কবির
নিদান শুনি ।
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা ?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা ।“
ধর্মের জন্য মানুষ না, মানুষের জন্য ধর্ম ? আসুন কবির
কথাতেই তার বিশ্লেষণ করা যাক ।
“মানুষেরে ঘৃণা
করি
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি !”
মানবতাবাদী নজরুলের কাছে মানুষের থেকে বড় কিছু ছিল না । না
ধর্ম। না ঈশ্বর । মানুষের মধ্যে যে কোনও ভেদাভেদকেই তিনি ঘৃণা করতেন । সাম্যবাদী
কবি তাই লিখলেন সাম্যবাদের গানঃ
“ গাহি সাম্যের গান ...
যেখানে আসিয়া এক
হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ক্রিশ্চান ।
গাহি সাম্যের
গান ...
কে তুমি ? ............ পার্সি ? জৈন ? ইহুদী ? সাঁওতাল ভীল
গারো ?
কনফুসিয়াস ? চার্বাক চেলা ? বলে যাও, বল আরো ।
বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা খুশি পুঁথি ও কেতাব বও ,
কোরান-পুরান-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও যত সখ .........
কিন্তু কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল !
দোকানে কেন এ দর কষাকষি ? ...... পথে ফুটে তাজা ফুল !
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ !
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেবতার ।
কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি –কঙ্কালে ?
হাসিছেন তিনি অমৃত -হিয়ার নিভৃত অন্তরালে ।“
নজরুল আজ আমাদের মধ্যে নেই । পড়ে আছে শুধু স্মৃতির একরাশ
ফুল । এক একটা পুষ্প চয়নে আজ আমরা গড়ে তুলেছি বহু মালা । এ মালা যদি তাঁকে আমরা না
দিই তাতে কি এসে যায় কবির ? কারণ তিনি তো সব দেনা পাওনার ঊর্ধে । কবি তো কিছু পেতে
চান নি । বরং উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর সব কিছু । তাই তো তিনি লিখেছেনঃ
“ নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার,
তোমায় আমি করব সুজন – এ মোর অহংকার !”
আজ নজরুল আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার । তাঁর স্মৃতিটুকুই
হোক আমাদের পরম সান্ত্বনা – না পাওয়ার মাঝে বেদনার কিছু প্রাপ্তির আশ্বাস ।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন