১৪ আগ, ২০১৪

অরুণ চট্টোপাধ্যায়



আমাদের নজরুল


“ যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে ।
    অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে ।
              বুঝবে সেদিন বুঝবে । ‘’’
“অভিশাপ।“ কবিতায় লেখা কবির এই ছত্রগুলো কি সত্যিই আমাদের প্রতি কবির অভিশাপ বাণী? নাকি আপনজনের প্রতি কোনও তীব্র অভিমান বোধ ? একটা গোলাপ যখন তার শেষ গন্ধটা বিলিয়ে দিয়ে পাপড়িগুলো ঝরিয়ে দেবার উপক্রম করে, তখন সে কি এমনই এক অভিমান মেশানো সতর্কবাণী রেখে যায় গাছটার জন্যে ? যাতে গাছটা ভূ-লুন্ঠিত গোলাপের পাপড়িগুলোকে দেখে তার শেষ গন্ধটা বাতাসে খুঁজে নেবার চেষ্টা করে ? রূপ, রস আর গন্ধে ভরা ফুলটাকে স্মৃতিপটে সদা-উদ্ভাসিত রাখার প্রয়াস পায় ?
এ কথা সত্য যে নজরুল আজ হারিয়ে গেছেন । কিন্তু এই অন্তর্ধান নিছকই এক বাহ্য ও আবশ্যিক প্রাকৃতিক পরিণতি । নজরুলের কায়া হারিয়েছে মাত্র, ছায়া নয় । নজরুল হারিয়েছেন প্রকৃতির পশ্চাৎপট থেকে, আমাদের তথা বাঙ্গালীদের হৃদয়ের পশ্চাৎপট থেকে নয় । তাই নজরুলের খবর জানার জন্য সুদূর অস্তপারের সন্ধ্যাতারার কাছে যেতে হবে না । তাঁর হিমালয়- সদৃশ সু-উচ্চ কাব্য ও সাহিত্যপ্রতিভা, মহাসাগরের মত সুগভীর আত্মপ্রত্যয় আর দেশাত্মবোধ এবং মানবতাবোধের অপূর্ব অবিনশ্বর কীর্তিগুলির সঠিক অনুধাবনই আমাদের পৌঁছে দেবে নজরুলের সঠিক ঠিকানায় ।
সুতরাং আজ সময় এসেছে বিদ্রোহী কবিকে যথার্থ অনুশীলনের । মহাকালের কষ্টিপাথর আজ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে নজরুলের সঠিক মূল্যায়নের । নজরুলের কবিতা বাংলা সাহিত্যের ভাঁড়ারে এক অপূর্ব সম্পদ । বেশীর ভাগ কবিতাই সুরের সমুদ্রে অবগাহন করে সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করেছে । ক্লাসিক সঙ্গীত জগতে “নজরুলগীতি” নামে আখ্যায়িত হয়েছে । রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে সমান্তরাল এক প্রবাহে বিশ্বময় বয়ে চলেছে স্ব-মর্যাদায় ও স্ব-মহিমায় ।
নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী কবি । কেমন ছিল সে বিদ্রোহের প্রকৃতি ? এ ইতিহাসের অধ্যয়ন জরুরী হয়ত আরও বহু ভবিষ্যতের জন্য । মানুষের জীবনপ্রবাহ যতদিন চলবে ততদিন চলবে এ আন্দোলন । এ আন্দোলন হয়ত কোনও শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতের নয় । এ আন্দোলন হয়ত রাজার বিরুদ্ধে প্রজার নয় । এ আন্দোলন কু- প্রথার বিরুদ্ধে, এ আন্দোলন সর্ব প্রকার কুশিক্ষা বা অশিক্ষার বিরুদ্ধে, এ আন্দোলন যে কোনও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এ আন্দোলন যে কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ।
নজরুল ছিলেন সেই বিদ্রোহী যিনি কখনও মাথা নীচু করেন নি কারও কাছে । অন্যায়ের কাছে আপোষ তাঁর কাছে ছিল আত্মহত্যারই নামান্তর । তাই অক্লেশে তিনি বলতে পেরেছিলেনঃ
“বল বল, বল উন্নত মম শির !
শির নেহারি, আমার নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির ।“
নজরুল ছিলেন সেই বিদ্রোহী যিনি অত্যাচারী বিদেশী শাসকের কারাগার ভাঙ্গতে দেশবাসীদের দিয়েছিলেন এক নির্ভীক প্ররোচনা ।
“কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
রক্তজমাট শিকলপূজার ঐ পাশান-বেদী”
নজরুল ছিলেন সেই বিদ্রোহী যিনি বন্দীদের জুগিয়ে দেন অফুরন্ত সাহস, বল ও প্রেরণাবলা বাহুল্য এই বন্দীরা কেউ সাধারণ বন্দী অর্থাৎ চোর ছ্যাঁচোড় গুন্ডা বদমাশ নয় । এরা রাজবন্দী মানে তৎকালীন অত্যাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী
“ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল ঝনঝনা,
ও যে মুক্তিপথের চরণ- বন্দনা !”

দেশময় যখন অত্যাচার আর অনাচারের বান ডেকে যাচ্ছে তখন মানব-দরদী নজরুল কি শান্ত থাকতে পারেন ? অশান্ত হয়ে উঠল তাঁর কলম । লিখলেনঃ

“আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
   অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম-রণভূমে রণিবে না !”

জাত-বিচার কি শুধুই অশিক্ষা কিংবা কুসংস্কারগ্রস্ত সমাজের একটা রোগলক্ষন ? নাকি কোনও সুকৌশলী মস্তিষ্কের মরণ খেলা ? স্পষ্টভাষী কবির কলমে তাই স্পষ্ট এক সতর্কবাণীঃ

“ জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে জাত ছেলের নয়ত মোয়া ।
....................................
নারায়নের জাত যদি নাই
তোদের কেন জাতের বালাই ?
(তোরা) ছেলের মুখে থুতু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া !”

নজরুলের দেশাত্মবোধ কেমন ? অত্যাচারিতা লাঞ্ছিতা দেশ মাতৃকার নগ্ন রূপটাকে কেমন ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি ?

“আর কতকাল থাকবি বেটী
      মাটির ঢেলায় মূর্তি আড়াল,
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে
     অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল ।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক,
      বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কশাইখানা
      আসবি কখন সর্বনাশী ? “

আজকের এই স্বাধীন ভারতে কথাগুলোর অর্থ অনুধাবন করতে আমাদের কিঞ্চিত কষ্ট হলেও সেদিনের সেই ব্রিটিশ শাসকের বুঝতে অসুবিধা হয় নি এতটুকু । কবির সম্পাদিত “ধূমকেতু” পত্রিকার প্রথম পূজো সংখায় এ কবিতা প্রকাশ হওয়ার পর আর বিন্দুমাত্র দেরি করে নি তারা । চোর ছ্যাঁচড়দের মত কারাগারে অন্তরীন করেছিল এই মহাশক্তিকে । বিচার চলল কবির । আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনও আপোষ নয় । আজীবন সত্যনিষ্ঠ কবির নির্ভীক উক্তিঃ
“বিচারক জানে আমি যা বলেছি, যা লিখেছি তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয় । ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয় । কিন্তু তবু সে শাস্তি দেবে । কেন না, সে সত্যের নয়, সে রাজার । সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের । সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য ।“
দেশ পরাধীন, দেশবাসীর মাথা বিদেশীর পায়ের তলায় লুটোচ্ছে । কিন্তু এ চেতনা তখন কজন ভারতবাসীর ছিল ? এ চেতনা জোগালেন স্বয়ং নজরুল । লিখলেনঃ

“এ দেশ কার ? তোর নহে আর ।
রে মূঢ সন্তান ! ভারত মাতার ।।
  দেবতার দেশে আজ
  দৈত্য করে বিরাজ
মন্দির আজই বন্দীর কারাগার ।।“

ধর্মীয় উদারতা কেমন ছিল নজরুলের ? আসুন, এ ব্যাপারে কবির নিদান শুনি ।

“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা ?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা ।“
ধর্মের জন্য মানুষ না, মানুষের জন্য ধর্ম ? আসুন কবির কথাতেই তার বিশ্লেষণ করা যাক
   “মানুষেরে ঘৃণা করি
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি !”


মানবতাবাদী নজরুলের কাছে মানুষের থেকে বড় কিছু ছিল না । না ধর্ম। না ঈশ্বর । মানুষের মধ্যে যে কোনও ভেদাভেদকেই তিনি ঘৃণা করতেন । সাম্যবাদী কবি তাই লিখলেন সাম্যবাদের গানঃ

“ গাহি সাম্যের গান ...
যেখানে আসিয়া  এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ক্রিশ্চান ।
     গাহি সাম্যের গান ...
কে তুমি ? ............ পার্সি ? জৈন ? ইহুদী ? সাঁওতাল ভীল গারো ?
কনফুসিয়াস ? চার্বাক চেলা ? বলে যাও, বল আরো ।
বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা খুশি পুঁথি ও কেতাব বও ,
কোরান-পুরান-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও যত সখ .........
কিন্তু কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল !
দোকানে কেন এ দর কষাকষি ? ...... পথে ফুটে তাজা ফুল !
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ !
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেবতার ।
কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি –কঙ্কালে ?
হাসিছেন তিনি অমৃত -হিয়ার নিভৃত অন্তরালে ।“


নজরুল আজ আমাদের মধ্যে নেই । পড়ে আছে শুধু স্মৃতির একরাশ ফুল । এক একটা পুষ্প চয়নে আজ আমরা গড়ে তুলেছি বহু মালা । এ মালা যদি তাঁকে আমরা না দিই তাতে কি এসে যায় কবির ? কারণ তিনি তো সব দেনা পাওনার ঊর্ধে । কবি তো কিছু পেতে চান নি । বরং উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর সব কিছু । তাই তো তিনি লিখেছেনঃ

“ নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার,
তোমায় আমি করব সুজন – এ মোর অহংকার !”

আজ নজরুল আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার । তাঁর স্মৃতিটুকুই হোক আমাদের পরম সান্ত্বনা – না পাওয়ার মাঝে বেদনার কিছু প্রাপ্তির আশ্বাস ।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন