রবি ধূমকেতু ও এক পাগলের গল্প
পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যাও তুমি বাঙালীকে দ্বিখন্ডিত
অবস্থায় দেখতেই পাবে। এ ভাঙণ তার পরাধীণতার কাল থেকে রক্তে মজ্জায় মিশে গেছে। তাই
তারা গানে প্রাণে খেলার মাঠে সবেতেই দুই দলে ভাগ হয়ে থাকে। তা সে মোহনবাগানের সাথে
ইস্টবেঙ্গলের খেলাই হক আর পদ্মার ইলিশ আর কোলকাত্তাই চিংড়ী। রবিঠাকুরকে নিয়ে যখন
মাতামাতি তুঙ্গে তখন বাঙালির ঘরে আরেক মেঠো মানুষের আনাগোনা শুরু হল। সে মানুষ
রাইফেল চালায় আবার বাঁশিও বাজায়। ঠিক যেন কেষ্ট ঠাকুর।
সালটা ছিল ১৯২২, গরমকাল।
আমি তখন আই.এ পাশ দিয়ে শখের কাব্যি করি। কালেজের বন্ধুরা উৎসাহ দেয়, বলে তোর হবে।
তখনই বন্ধুবর
মইনুদ্দীনের সাথে একদিন হাজির হলাম কলেজস্ট্রীটের ৩২ নং বাড়িতে।
৩২ নং কলেজস্ট্রীটের
ঘরগুলোকে ঘর না বলে এক একটা গুমটি বলাই ভালো।
দিস্তা দিস্তা কাগজ আর
একটা পুরোনো সোঁদা গন্ধে নাকে ঝাঁঝ লাগে। তার মধ্যে যে লোকটা কি সুখ পায় কে জানে?
কিন্তু ভারী মায়া পরে যায় ওর ঐ মায়াবী চোখ দুটো দেখলে। যেন কত ব্যাথা এক ধাক্কায় সরিয়ে
এক্ষুণি হেসে উঠবে আর সারা ঘরময় চা ছড়িয়ে বলবে "দে গরুর গা ধুইয়ে-"
এই ছিল লোকটা। আমার মনে
হয় হয়ত একটু পাগলাটে গোছের কেউ হবে। আসলে কবিমাত্রই পাগল না হয়ে যায় কোথায়? খালি
ভাবের রাজ্যে স্বপ্ন-বিলাস। কিন্তু তবু এ লোক পাগল নয়। কারন যার লেখায় মাটির গন্ধ
পাওয়া যায়, যার সুরে জলের শীতলতা আর মিষটতা থাকে আবার যার ভাষার আগুনে ছ্যাঁকা
লাগে , গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়, সে ত আর যে সে লোক নয়।
বাবরী চুলে ঢেউ খেলে
যায়, কলম চলে কমলিনীর ছন্দে আর গুণমুগ্ধদের ভিড়ে ভাঁড়ে মা ভবানীরও একটু দয়া
হয়েছিল। তাই সবাই মিলে যখন সাহস করে বললুম "দাদা, একটা পত্রিকা বেরুলে ক্যামন
হয়-" তখন পাগলা কাজীর সাঁকো সত্যি নড়েছিল বোধহয়। পবিত্রবাবু, মইনুদ্দিন
হোসেন, গোলাম মোস্তাফারা যেখানে রোজ আসর মাতায় যেখানে আমি চুনোপুটি শ্যামরায় লাজুক
লাজুক হেসে গুণগ্রাহী হয়ে প্রসাদ ভিক্ষা করতে যাই, আমার কি ভাই ওদের সভায় বসা
মানায় না তা আমার উচিৎ? কিন্তু জানি না কেন সেদিন এই বিড়ালের ভাগ্যে সিঁকি ছিড়লো
আর কাজী সাহাব আমায় বললেন "ভাই শ্যাম, তোমাকে যদি একটা দায়িত্ব দেই করতে পারবে ত'?" আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে আমাকে বললে মেটকাফ
প্রেসে যেতে -
ওখানকার মালিক নজরুলের
নাম শুনেই গদগদ। "বুঝলেন মশাই বিজলীতে ওনার বিদ্রোহীটা পড়েই বুঝেছি আর পাঁচটা
জেলো কবির ফ্যাঁচফ্যাচানি নয়, পুরো চাবুক- ছারখার করে দেবে।" এই বলেই প্রকাশক
মণি ঘোষ এক টিপ নস্যি নিলেন- "তা নাম
কি পত্রিকার ?"
আমি বললাম
-"ধূমকেতু"
আগেই ঠিক হয়েছিল এক
পয়সার ফুলস্কেপ চারপাতার সাপ্তাহিক পত্রিকা হবে এই ধূমকেতু। রোজকার ছিষ্টির
গতানুগতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে নিশ্চিন্ত
ভাবে এক ঘেয়ে অন্যায় মানা জীবনকে আর প্রশ্রয় দেওয়া নয়। তাই আগুনের ভাষা বলবে এই
ধূমকেতু, অধিকারের ভাষা বলবে এই ধূমকেতু। যে লোকটা নিজে যুদ্ধের বন্দুক কাঁধে এ
ময়দান দাপিয়ে বেড়ায় সে যে শুধু বিদ্রোহী বা বীর হয়ে ক্ষান্ত থাকবে না এ ত সকলের
জানা, কারন সৈনিক সব অবস্থাতেই যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সে যুদ্ধ জীবনের, জীবনের সব
জড়তার বিরুদ্ধে।
সব যখন প্রায় ঠিকঠাক
কাজীভাই এর মাথায় খেয়াল চাপলো যে গুরুদেবের আশীর্বাদ ছাড়া নাকি এই পত্রিকা প্রকাশ
সম্ভব নয়। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় মশাই ছুটলেন বোলপুর। শান্তিনিকেতনে তখন সবেমাত্র
বৈশাখী উৎসব শেষ হয়েছে। সেরকম এক সন্ধ্যেতে নজরুলের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা ও
আশীর্বচনে কবিগুরু লিখলেন-
"আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন!
অলক্ষণের তিলকরেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্দ্ধচেতন।"
কাগজের একপিঠ ছাপা
হয়েছে। কয়েক রিম কাগজ বাকিতে কিনে বই ছাপা শুরু হয়ে গেল জোড়কদমে। এমন সময় কবিগুরুর
আশীর্বাদী লেখাটাও এসে পৌছালো আমাদের হাতে।
২৬শে শ্রাবণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ,
ইং ১১ আগস্ট ১৯২২ প্রকাশিত হল আমাদের ধূমকেতু ।প্রথম ঘন্টা দুই তিনের মধ্যেই
হকারের দল এসে খবর দিল দু হাজার কপি
বিক্রি হুয়ে গেছে আর মানুষজন আরো আরো চাইছে এই পত্রিকাকে। পরাধীণ দেশে যেন
স্বাধীনচেতনার এক স্রোত হয়ে এল নজরুলের এই প্রচেষ্টা।
[লেখাটাতে জনৈক কথক বাদে
সব চরিত্র আসল এবং পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের নজরুলের প্রতি স্মৃতি চারণ থেকে এই লেখা অনুপ্রাণিত।]
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন