২৩ মে, ২০১৪

কাশীনাথ গুঁই

1 কমেন্টস্
সম্পাদকীয় :


বর্ষচক্র নিয়মেই চলে। তাই আবার চৈত্র অবসান – এল মহাভৈরবের হর্ষসাথী এই রুদ্র বৈশাখের সকাল। সব না পাওয়া অবসাদ ঘুচিয়ে এল নববর্ষের নতুন আশা । এর মাঝেই রাজনীতির দামামা – লোকসভার উমেদারী। নীতিহীন নেতাদের নরমে গরমে ভিক্ষা পাত্র হতে এগিয়ে আসা – মিডীয়ার ফাটকাবাজী আর বাজারের অগ্নিমূল্য। যথাপূর্বং সেই গড্ডলিকার গা ভাসানো আবার নাহলে মঞ্চ থেকে দেওয়া আস্ফালন নেমে আসবে মাথায় উপরে। কত মায়ের কোলখালি হওয়া, প্রিয়হীন কান্নার শিরশিরানী। তবুও ঋতুচক্রের টানে কলম যে হল বিমনা। কলমচীরা থামে কিভাবে – গান, গল্প, কবিতা, রম্যরচনারা যে রাতের ঘুম ভাঙিয়ে আদায় করে নেয় তাদের পাওনা। প্রভাত আলোকে মুক্তি খোঁজা আলোর মতই তাই নানা উপাচারে আজ প্রেরণার ডালি সাজিয়ে এলাম আমরা। এসনা একসাথে গাইতে – না পারলে সাথে থেকে উৎসাহের ছায়া দিতে পারবেতো বন্ধুরা।


কাশীনাথ গুঁই,
সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে।

সমর কুমার সরকার

0 কমেন্টস্
অতিথি সম্পাদকের দপ্তর থেকে
সমর কুমার সরকার


সূর্য চন্দ্রের চরিত্রের স্খলন,ফল বাঙালীর নববর্ষ বরণ।

চৈত্রের অন্তিম লগ্নে সূর্য দেব অবশেষে চিত্রা নক্ষত্রের সুখ সংস্পর্শ ও মীন রাশির এলাকা অতিক্রম করিয়া রাত্রির অন্ধকারে মেষ রাশির এলাকায় প্রবেশ করিলেন।........ এই গল্প আপাততঃ এখানেই স্থগিত থাকুক,চলুন পাঠক গল্পের গূঢ় রহস্য অনুধাবনের প্রয়াসে আমরা একবার রাশিদের ডেরায় ঘুরিয়া আসি।

এই রাশিগুলি আসলে এক একটি মধুকুঞ্জ বিশেষ । চন্দ্র নামক এক লম্পট দেবতার আকাশ অঞ্চলে এইরূপ মোট ১২ টি ঠেক বিদ্যমান। এই ১২ টি ঠেকের রক্ষনাবেক্ষণের নিমিত্ত ছয়জন পুরুষ ঠেকরক্ষক ও ছয়জন নারী ঠেক রক্ষিকা বহাল হইয়াছে। চেহারা,স্বভাব ও প্রকৃতি অনুসারে ঠেক রক্ষক ও রক্ষিকাদের নাম ও পরিচয় এইরূপ:

১.মেষ - চেহারায় বিশাল বপু হওয়া সত্ত্বেও এই ঠেক রক্ষকের বুদ্ধি গাড়ল বা ভেড়ার সদৃশ, তাই তাহার ঠেক মেষ রাশি নামেই পরিচিত।

২.বৃষ- এই ঠেক রক্ষকের চেহারাও যেমন ষণ্ড তুল্য,তেমনি প্রকৃতি ও ষণ্ডের ন্যায়। সঙ্গত কারণেই এই ঠেক বৃষ রাশি নামে পরিচিত।

৩.কর্কট – দুর্বল কর্কট যেমন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ দেখিবা মাত্র দুইটি দাঁড়া উত্তোলন করিয়া ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করে,তেমনি এই ঠেক রক্ষক ও এক হাতে ঢাল ও অপর হাতে তরবারি লইয়া সদা দণ্ডায়মান থাকেন। সঙ্কটকালে ঢাল দিয়া আক্রমণ করিবেন না কি তরবারি দিয়া আক্রমণ করিবেন এই চিন্তার মীমাংসা করিতে না পারিয়া দুই হাতই প্রবল বিক্রমে নাড়াইতে থাকেন। সুতরাং এই ঠেকের নাম যে কর্কট রাশি রাখাই সমিচীন,সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই।

৪.সিংহ- এই ঠেক রক্ষক স্ত্রীর অন্নে প্রতিপালিত হন এবং সমস্ত দিবস কেবল পড়িয়া পড়িয়া নিদ্রা দেন,অথচ সন্ধ্যায় ভীষণ রক্তবর্ণ চক্ষু মেলিয়া,চুল ,দাড়ি প্রভৃতি ধূলিকণার দ্বারা ফুলাইয়া ভীষণ বিক্রমে গোঁ গোঁ রবে বিকট চীৎকার করিয়া সকলের নিকট আপন বিক্রম প্রকাশ করেন। তাই এই ঠেকের নাম সিংহ রাশি।

৫.বৃশ্চিক- বৃশ্চিকের দুইটি দাঁড়া সম্বলিত বাহু থাকা সত্ত্বেও, প্রতিবন্ধী বিকলাঙ্গের ন্যায় সেই বাহু যুগল কেবল অঙ্গের শোভা মাত্র। তাই বৃশ্চিক সর্বদা লাঙুলের অগ্রভাগে কন্টক সদৃশ হুল ঝুলাইয়া সকল কে ভীতি প্রদর্শন করে। কোন কোন সময় আক্রমণ ও করে, কিন্তু কোন কারণে হুল ফুটাইতে ব্যর্থ হইলেই লাঙুল তুলিয়া পলায়ন করতঃ আপনার জীবন রক্ষা করে। এই ঠেক রক্ষক ও বাহু থাকা সত্ত্বেও সঙ্কট কালে মোকাবিলা না করিয়া লাঙুল উত্তোলন করিয়া পলায়নে সিদ্ধহস্ত,ইদৃশ কারণে এই ঠেক বৃশ্চিক রাশি নামে পরিচিত।

৬.ধনু – পশ্চিমবঙ্গের পুলিশে যেমন সারা জীবন স্কন্ধে বৃটিশ আমলে নির্মিত অকেজো বন্দুক ও কোমরে কতিপয় ছত্রাক সংপৃক্ত বুলেট বহন করিয়া বেড়ায়,অথচ প্রয়োজনে বন্দুক ছুঁড়িলে বুলেট বাহির হয় না,অথবা দিকভ্রষ্ট হয়, সেইরূপ এই ঠেক রক্ষকও স্কন্ধে এক অকেজো ধনুক আর তূণে কতগুলি মরিচা পড়া তীর সম্বল করিয়া ঘুরিয়া বেড়ান। তাই এই ঠেকের নাম ধনু রাশি।

৭.কন্যা-এই ঠেক রক্ষিকা বয়স্কা,অথচ সর্বদা প্রসাধনী দ্বারা রূপচর্চা করিয়া ও স্বল্পবাস পরিহিতা হইয়া বালিকা কন্যার ন্যায় ন্যাকামি করিয়া সকলের মন জয় করিবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত থাকেন। তাই এই ঠেক কন্যা রাশি নামে পরিচিত।

৮.মিথুন- এই ঠেক রক্ষিকা ঠেক রক্ষা করিবেন কি,নিজেরই চরিত্রের ঠিক নাই। যে কোন পুরুষের আহ্বানে এই ঠেক রক্ষিকা তাহার সহিত মৈথুনে সন্মত হন। তাদৃশ কারণে এই ঠেক মিথুন রাশি নামেই পরিচিত।

৯.তুলা- এই ঠেক রক্ষিকার চেহারা যেমন তুলার ন্যায় ফুটফুটে,শরীর যেমন তুলার মত নরম তুলতুলে, ব্যবহারও তেমনই তুলার ন্যায় নরম। স্বাভাবিক কারণেই এই ঠেক তুলা রাশি নামে পরিচিত।

১০.মকর- এই ঠেক রক্ষিকার নাসা তীক্ষ্ন,অথচ নাসিকার নিম্নভাগে দুই পাটি এবড়ো খেবড়ো অবিন্যস্ত দন্তরাশির বিকট শোভায় মুখমণ্ডল ভীষণ দর্শনা কুম্ভীর জাতীয় মকরের ন্যায়। সঙ্গত কারণেই এই ঠেক মকর রাশি নামে পরিচিত।

১১.মীন- পাঠকেরা অবগত আছেন,অল্প জলে মীন অতি চঞ্চল,অথচ গভীর জলে মীন নিশ্চল অবস্থায় থাকে। কোন কোন রমণী ও খুচরা প্রেমে অতিশয় চঞ্চলতা প্রদর্শন করেন,অথচ গভীর প্রেমে দায়িত্ব পালনের মানসিকতা না থাকায় গভীর প্রেমে জড়াইতে চাহেন না। এই ঠেকের রক্ষিকা খুচরা প্রেমের উন্মাদনায় আসক্ত বিধায় এই ঠেকের নাম মীন রাশি।

১২.কুম্ভ- এই ঠেকের রক্ষিকা পৃথুলা এবং পয়োধর যুগল কুম্ভ সদৃশ। তাই কবি ও সাহিত্যিকেরা এই ঠেকের নামকরণ করিয়াছেন কুম্ভ রাশি।



১২ টি ঠেকের পরিচয় আপনারা প্রাপ্ত হইলেন,এখন প্রশ্ন, এই ১২ টি ঠেকের গূঢ় রহস্যই বা কি, আর এই ঠেকে থাকেনই বা কাহারা ? লম্পট চন্দ্রের বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্বভাদ্রপদ, উত্তরভাদ্রপদ, রেবতী, অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পুর্ব ফাল্গুনী, উত্তর ফাল্গুনী,হস্তা, ও চিত্রা নাম্নী ২৭ জন নক্ষত্ররূপী স্ত্রী বিদ্যমান। এত গুলি স্ত্রী কে তো আর এক গৃহে রাখা সম্ভব নয়। আবার একই বাড়ীতে যদি পরপর ২৭ টি শয়ন কক্ষ নির্মাণ করা হয়,এবং এক এক ঘরে এক এক স্ত্রী কে রাখা হয়,তবে পতিতা পল্লী ভ্রমে অন্য পুরুষের আগমনের সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া একা পুরুষের পক্ষে ২৭ টি কক্ষের নজরদারি ও সম্ভব নয়। আবার ২৭ জন পত্নীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন ২৭ টি স্থানে ২৭ টি বসত বাড়ী নির্মাণ ও সম্ভব নয় । তাই অনেক চিন্তা ভাবনার পরে চন্দ্র মোট ১২ টি বসত বাড়ী বা ঠেক নির্মাণ পুর্বক পূর্বোক্ত ১২ জন ঠেক রক্ষক বা ঠেক রক্ষিকা নিযুক্ত করিলেন। প্রতি ঠেকে ২ টি শয়ন কক্ষ ও ১ টি বিশ্রাম কক্ষ। কিন্তু ১২ টি ঠেক পাশাপাশি নয়। চন্দ্রের চাকুরীর শর্ত হইলো প্রতি ৩০ দিনে বা একমাসে পৃথিবীকে এক উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সম্পুর্ণ একবার পরিক্রমা করতঃ পৃথিবীর সর্বত্র রাত্রিবেলায় আলোর বিকিরণের সমতা রক্ষা করিতে হইবে। বিনিময়ে সূর্য চন্দ্রকে আপন আলোয় আলোকিত করিয়া উৎফুল্ল ও জীবন্ত রাখিবেন। এখন এই উপবৃত্তাকার কক্ষপথ মোট ৩৬০ ডিগ্রী। তাই চন্দ্র কক্ষপথকে সমান ১২ ভাগে ভাগ করতঃ প্রতি ৩০ ডিগ্রী অন্তর একটি করিয়া ঠেক নির্মাণ করিলেন এবং ১২ জন রাশির হস্তে দেখাশোনার দায়িত্ব ভার দিলেন। এখন ৩০ দিনের যাত্রাপথ কে চন্দ্র সমান ভাগে ভাগ করিলেন এবং এক একটি রাশি বা ঠেকে ২.৫ দিন বা আড়াই দিন থাকিবেন বলিয়া মনস্থ করিলেন। এখন ২৭ জন স্ত্রীর জন্য ২৭ দিন বরাদ্দের পরে বাকি ৩ দিন অর্থাৎ ৭২ ঘন্টা কে চন্দ্র ২৭ জন স্ত্রীর মধ্যে সম ভাগে বন্টন করিলেন। ফলে প্রতি স্ত্রী র ভাগ্যে ভাগের ২৪ ঘন্টা ছাড়াও অতিরিক্ত ২ ঘন্টা ৪০ মিনিট সময় যুক্ত হইলো যাহাতে যাত্রাপথে গতির হেরফের ঘটিলেও প্রতি স্ত্রী ই যেন চন্দ্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ একটা দিন অতিবাহিত করিতে পারেন। সেই হিসাবে প্রতি ঠেকে চন্দ্র দুই দিন দুই স্ত্রীর কক্ষে সম্পুর্ণ দিন ও রাত্রি অতিবাহিত করেন। পরে বিশ্রাম কক্ষে তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করার পরে তাকে সঙ্গে নিয়েই পরের ঠেকের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সুযোগ পান। এর ফলে পর্যায় ক্রমে ২৭ জন নক্ষত্রই চাঁদকে সমান উপভোগের সুযোগ পান। চন্দ্র যে দিন যে ঠেকে থাকে পঞ্জিকায় সেই রাশির নাম উল্লেখ থাকে,এবং যে নক্ষত্রের সঙ্গে দিন কাটান সেই নক্ষত্রের উল্লেখ থাকে। পঞ্জিকায় তিথি হিসাবে যদি লেখা থাকে,মেষ রাশি,বিশাখা নক্ষত্র,তবে বুঝিতে হইবে যে চন্দ্র সেই দিন মেষ রাশির ঠেকে বিশাখা নক্ষত্রের সঙ্গে দাম্পত্য জীবন পালন করিতেছেন।

অধিক সম্পত্তি র মালিক হইলে যেমন সম্পত্তি রক্ষার প্রয়োজনে ক্ষমতাসীন প্রভুকে কিছু সম্পত্তি উৎকোচ হিসাবে প্রদান করিতে হয়,তেমনি একাধিক পত্নী বা উপপত্নী থাকিলে কোন কোন পুরুষ ও তন্মধ্য বাছাই করা কয়েক জন পত্নীকে ক্ষমতাসীন পুরুষের সেবায় নিযুক্ত করিয়া ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। তা ছাড়া ঐ সব পত্নী বা উপপত্নীরাও ভাগের মায়ের মত যে অল্প সময় পুরুষ সঙ্গ পান,তাতে মন পরিপূর্ণ তৃপ্ত হয় না। কাজেই পতি তাদের ক্ষমতাসীন পুরুষের সেবায় নিযুক্ত করিলে তাহারা বিগলিত চিত্তেই সেই দায়িত্ব পালন করেন। কথায় বলে, আপন পুরুষের সোহাগে তৃপ্তি যদি চার আনা বা ছয় আনা,পর পুরুষের সোহাগে তৃপ্তি ১৬ আনার জায়গায় ৩২ আনা। ঠিক এই দুর্বলতা হেতুই চন্দ্র ও সময়ান্তরে বাছাই করা ১২ জন সর্বশ্রেষ্ঠা রূপসী পত্নী কে আপন প্রতাপশালী প্রভু রবিদেব বা সূর্যের সেবায় নিযুক্ত করেন,আর রবিদেবও প্রসন্ন চিত্তেই এই উৎকোচ গ্রহণ করেন। এই ১২ জন বাছাই পত্নী হইলেন বিশাখা,জ্যেষ্ঠা,পূর্বাষাঢ়া,শ্রবণা,পূর্বভাদ্রপদ,অশ্বিনী, কৃত্তিকা,মৃগশিরা (অগ্রহায়ন),পুষ্যা,মঘা,উত্তর ফাল্গুনী, ও চিত্রা। পাঠকেরা প্র্শ্ন করিবেন,চন্দ্রের না হয় কলঙ্ক আছে,কিন্তু সূর্যের তো কলঙ্ক নাই ,তবে এইরূপ অভিরুচি কেন ? সূর্যের কি আপন পত্নী নাই ?

পাঠকগণ,একবার ভাবিয়া দেখুন,এ জগতে আপাতদৃষ্টিতে যত নিষ্কলঙ্ক ক্ষমতাবান,বিত্তশালী পুরুষ বা নারী দেখেন,যদি অন্তরালে দেখিবার সুযোগ ঘটিত,তবে দেখিতেন, রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা, সেনাপতি, অভিনেতা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, মায় লেখক পর্যন্ত যাহাদিগকে আপনারা অতি সজ্জন কল্পনা করেন, বাস্তবিক পক্ষে তাদের শতকরা ৯০ শতাংশের চরিত্রই এক বা একাধিক দোষে দুষ্ট। আর পত্নী তো অধিক সংখ্যক পুরুষের গৃহেই বিদ্যমান,তৎ সত্ত্বেও নারী নিগ্রহ ও পতিতাবৃত্তির এত রমরমা কেন ? বরঞ্চ সফল পুরুষেরই নারীর প্রতি আসক্তি সর্বাধিক। সূর্যের পত্নীর নাম সংজ্ঞা। বিবাহ পরবর্তীকালে সংজ্ঞা সূর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীর থেকে ছায়া নাম্নী এক নারী সৃষ্টি করে তাকে সূর্যের কাছে গচ্ছিত রেখে পিত্রালয়ে পলায়ন করেন। ছায়া যতই সূর্য কে শীতল রাখায় যত্নবান হন না কেন,স্ত্রীর পিত্রালয়ে গমনের দুঃখ ভুলতে না পেরে সূর্য আনন্দিত চিত্তেই চন্দ্রের উৎকোচ গ্রহণ করে ১২ মাসে ১২ টি রাশির ঠেকে উপস্থিত হয়ে ১২ জন সুন্দরী নক্ষত্রকে ভোগ করেন। এ জন্য সূর্যের স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। চন্দ্র যেমন পৃথিবীকে পরিক্রম করেন,তেমনি পৃথিবীও আবার একই রকম উপবৃ্তাকার পথে সূর্যকে পরিক্রম করে। ফলে মানুষ যেমন ট্রেনে ঘুমাতে ঘুমাতে কলকাতা দেখে দিল্লী বা বোম্বাই এ যান,ঠিক সে ভাবেই বৎসরের এক এক মাসে চন্দ্রের এক একটি ঠেক সূর্যের নিকটবর্তী হয়। আর সূর্য সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই পুরানো এলাকা বা ঠেক ছেড়ে ত্রস্তপদে অন্য এলাকার ঠেকে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট কক্ষে নির্দিষ্ট নক্ষত্রের সঙ্গে মধু যামিনী পালন করেন।

সূর্য যখন যে নক্ষত্রের সাথে মিলিত হন, তার নামেই মাসের নামকরণ হয়। অর্থাৎ বর্ষের প্রথম মাসের প্রথম দিনে মেষ রাশির ঠেকে সূর্য বিশাখা নক্ষত্রের সাথে মিলিত হন বলে প্রথম মাসের নাম হয় বৈশাখ। বৈশাখের শেষ দিনে সূর্য মেষ রাশির ঠেক ও বিশাখার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বৃষ রাশির ঠেকে জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের সঙ্গে মিলিত হন,তাই পরের মাসের নম হয় জৈষ্ঠ্য। এই ভাবে একাদি ক্রমে ক্রমানুসারে সূর্য মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ,ও মীন প্রভৃতি ১২ টি রাশিতে পর্যায় ক্রমে বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, পূর্বাষাঢ়া, শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদ, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, মৃগশিরা (অগ্রহায়ন), পুষ্যা, মঘা, উত্তর ফাল্গুনী, ও চিত্রা প্রভৃতি নক্ষত্রের সঙ্গে মিলিত হন বলেই বাংলা মাসগুলোর নাম হয় বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্ত্তিক, অগ্রহায়ন, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। এখন স্থগিত গল্প পুনরায় শুরু করা যাক। চৈত্রের অন্তিম লগ্নে সূর্য দেব অবশেষে চিত্রা নক্ষত্রের সুখ সংস্পর্শ ও মীন রাশির এলাকা অতিক্রম করিয়া রাত্রির অন্ধকারে মেষ রাশির এলাকায় প্রবেশ করিলেন। তথায় মেষ রাশির ঠেকে তার সাক্ষাত ঘটিলো দীর্ঘ প্রতীক্ষারতা বিশাখা নক্ষত্রের সঙ্গে। সূর্য দেব অতি সম্প্রতি চিত্রা নক্ষত্রকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন,তাই প্রিয়ার বিরহ বেদনায় তিনি কিছুটা ম্লান ও নিস্প্রভ ছিলেন। কিন্তু প্রাণ চঞ্চলা বিশাখা কে দেখামাত্রই সূর্য দেব তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া উৎফুল্ল ও প্রসন্ন হইলেন। [ জগতের সকল সফল পুরুষের ধর্মই তো তাই। তাহাদের সকল সফলতার মূলেই একাধিক নারী। তাহারা এক নারীর বিরহে কাতর হইতে না হইতেই অন্য নারীর আবির্ভাব ঘটে। পাঠক গণ,আমার কথাই একবার ভাবুন,জীবনে সমস্ত রকম সম্ভাবনা সত্ত্বেও যেহেতু আমার একাধিক নারীর সংস্রব ঘটে নাই,অর্থাৎ সেই রূপ সুযোগ ই কখন ও আইসে নাই,তাই আমার জীবন কেমন অবরুদ্ধই রহিয়া গেলো। যদি সুযোগ পাইতাম,তবে মনের আবেগে এমন কাব্য লিখিতাম,যাহা বাঙালীর গর্বের কারণ হইতো। তখন এই নববর্ষের দিনে হয়তো ধুতি,পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায়,হাতে পুষ্পস্তবক লইয়া বইপাড়ার এক প্রকাশনী সংস্থার প্রতিষ্ঠান হইতে অন্য সংস্থার প্রতিষ্ঠানে ঘুরিয়া বেড়াইতাম। কিন্তু যাহা হইবার নয়,তাহা লইয়া দুঃখ অনাবশ্যক।] সুর্যদেব যথাশীঘ্র বিশাখার সহিত মিলিত হইলেন। চৈত্রের শেষ রজনী অন্তে সমস্ত রাত্রি বিশাখার আলিঙ্গন তৃপ্ত সূর্যদেব বৈশাখের প্রথম দিনে প্রত্যূষে পূর্ব গগনে নব উদ্যমে ও নবীন তেজে মেষ রাশির কক্ষ ত্যাগ করিয়া বাঙালী ভক্ত দিগকে দেখা দিলেন। চারিদিক আনন্দে মুখরিত হইলো,শুভারম্ভ হইলো এক নববর্ষের।

বাঙলা নববর্ষ বাঙালীর ঘরে ঘরে,হৃদয়ে হৃদয়ে ভালবাসার উষ্ণতা প্রদান করুক। নতুন ভাবে শুরু হোক নানা আশা আকাঙ্খা আর প্রত্যাশা নিয়ে দিন চলা। সূর্য দেবের চরিত্রের স্খলনই হোক,আর যাই হোক,সূর্যের তুলনা সূর্য নিজেই। বাঙলায় প্রবাদ আছে - যদি ও আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়,তবু ও আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়। অর্থাৎ আমরা মহতের গুনটুকুই কেবল গ্রহণ করিবো। সূর্য আমাদের প্রাণ স্বরূপ,সমগ্র বিশ্বের রক্ষাকর্তা। তার কারণেই উদ্ভিদ কুল সালোক সংশ্লেষের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে জীব কুলের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রানবায়ুর যোগান দেয়। সূর্যের কারণেই মেঘ, বৃষ্টি র সৃষ্টি হয়, আমরা ১২ মাসে ৬ টি ঋতুর ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ অনুভব করি। তাই বাঙালীদের কাছে আবেদন...নববর্ষ কে শুধু এক আনন্দের দিন হিসাবে গন্য না করিয়া জীবন কে নতুন রূপে খুঁজে পাওয়ার দিন হিসাবে যাত্রা শুরু করুন। সূর্যের আলোকে পৃথিবীর সকল বস্তুর সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের অন্তরও নিরন্তর আলোকিত হোক।

অনুপ দত্ত

0 কমেন্টস্
বৈশাখী
অনুপ দত্ত


বৈশাখ মাসের প্রথম দিন৷ বছর শুরু সমস্ত শুদ্ধ মঙ্গল মনকামনা নিয়ে বাঙ্গালী জীবন৷বঙ্গাব্দ শুরু নিয়ে ইতিহাস বলে সম্রাট অশোক বাংলা দিনপঞ্জী(ক্যালেনডার)শুরু করেন৷মোগল শাসনাধীন ভারতবর্ষে মুলত হিজরি সন আর চান্দ্র (lunar) ক্যালেনডার প্রয়োগ হতো৷মৌসুমী বায়ু প্রধান ভারতে শষ্যরোপন,চাষাবাদ,ফসল কাটার সময় খুবই গুরুত্বপুর্ন আর সেটা ছিল কর বা খাজনা আদায়ের সময়৷ইসলামি দিনপঞ্জী(ক্যালেনডার) মেনে ঠিকমতো খাজনা আদায় সম্ভবপর হচ্ছিল না৷সম্রাট আকবর তখন ইরান দেশের ‘তারিখ ই জালালি’ বলে যে সৌর সময় ছিল সেটা আর চান্দ্র সংমিশ্রনে ‘তারিখ ই ইলাহি’ প্রচলন করেন৷ পরে সেটা বঙ্গাব্দ রুপে চালু হয়৷

আমাদের ব্যস্ত জীবনের খাতিরে অত শত তথ্য পড়লে মাথা ঘেটে ঘ হয়ে যায়৷সেই ছোটবেলা থেকেই হালখাতার মাস বৈশাখ থেকে শুরু করে জেনে গেছি ইংরেজী বর্ষপঞ্জির মতোই বাংলাতেও বারো মাস৷কিন্তু বাংলাতে মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নামের আদলে এসেছে৷এই যেমন

বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ
জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ
আষাঢ়া নক্ষত্র থেকে আষাঢ়
শ্রবনা নক্ষত্র থেকে শ্রাবন
ভাদ্রপাদ নক্ষত্র থেকে ভাদ্র
অশ্বিনী নক্ষত্র থেকে আশ্বিন
কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে কার্ত্তিক
মৃগশিরা নক্ষত্র থেকে অগ্রহায়ণ
পুষ্যা নক্ষত্র থেকে পৌষ
মঘা নক্ষত্র থেকে মাঘ
ফাল্গুনী নক্ষত্র থেকে ফাল্গুন
চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র

বৈশাখ মাসটা এপার বাংলার বাঙ্গালী জীবনে আরেকটা মহা আকর্ষন আছে৷সেটা হলো রবীন্দ্র জন্ম মাস৷কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গজীবনে প্রায় সবখানি জুড়ে রয়েছেন৷কোথায় একবার অনু্চ্চ স্বরে গুরুদেব গেয়েছিলেন…” মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝখানে বাঁচিবারে চাই..”৷

প্রতি উৎসবের একটা নিজের নিজের স্টাইল আছে৷সচারচর দিনকালের স্থান অনুযায়ী বদলে যায়৷অনেক দূর এখন নিমেষ কাছে হয়ে এসেছে৷বোতাম টিপলেই সব হাজির একেবারে৷

নতুন বছরের প্রথম দিনটি মিউজিক সিস্টেম জুড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত কোথাও বাউল…মন উদাস করা বাউল৷আর বাড়ীতে রান্নাবান্না তো আছেই৷টিপিক্যাল বাঙ্গালী খাওয়া..শুকতো..চাপড় ঘন্ট..লাউ কুচো চিংড়ি..নারকোল দিয়ে সোনা মুগডাল…হয়তো বা কাতলা মাছের মাথা দিয়ে…দই মাছ..মিষ্টি দই..কাঁচা আমের চাটনী৷

এখন উৎসবের ধরন ধারন পাল্টে গেছে৷তবু নববর্ষে আজ বাঙ্গালী যতই আধুনিক বলে দাবী করক ঐতিহ্য সমানে রেখে চলেছে৷

কাঠফাটা রোদ্দুর আর চিটপিট গরমে মানুষ কাবু৷পহেলা বৈশাখ মানুষকে ক্লান্ত করে না৷নতুন বছর …হালখাতার মাস…তারপরে স্টক ক্লিয়ারেন্সের এই সময়টা দোকানীদের একট হুজুক পড়ে যায়৷প্রচন্ড গরমেও প্রতিবছর ঐ এক সময়

পহেলা বৈশাখ এসে দাঁড়াবে…আরো একবার নতুন বছরের শুভ্র আলোর দিকে চেয়ে আটপৌরে বাঙ্গালী তার সারাবছর চাপা পড়ে থাকা ঐতিহ্য আর পরম্পরাকে ঝালিয়ে নিয়ে আবর বলি….’শুভ নববর্ষ ১৪২১’

রিয়া

1 কমেন্টস্
টুপটুপ চুপচুপ এলো রে নতুন
রিয়া

কাক কোকিলের ডাকে ভোর হলো যেই, ওমনি একটি বছর ডিঙিয়ে এসে গেলো নতুন বছরের ভোর। ওদিকে পূবের আকাশও সোনা রঙ মেখে সেজেছে। নতুন বছরের নতুন ভাবনার পরাগ ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ভীরু চোখে এগিয়ে আসছে। তার চাই সঠিক আলো, ঠিকানা ও উত্তাপ।

আকাশের ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে দেখি একটি ছোট্ট নতুন বছর জুল জুল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে কাছে ডাকতেই, সে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে নড়বড়ে সাঁকোর ওপরে টগবগে ঘোড়ার মতো লাফিয়ে এলো আমাদের কাছে। মেঘেদের সাত ভাই সাত সাগরের জল সাথে নিয়ে কাছে ডেকে নিলাম তাকে বড় আদরে।

ওই দূরে যে মেয়েটি বাস করে, গরীবানার গর্বে যার মাটিতে পা পড়েনা। আজ হয়তো সে বাকী সবার মতো নতুন জামা পড়ে সঙ সাজবে না। তবুও তাঁর ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়াবে নতুন বছরের ভোর। আর নতুন দিনের নতুন রবি উঁকি ঝুকি দিয়ে তাঁর কুঁড়ে ঘরের ফাঁকে সাত সকালে রাঙি গয়লানির মতো রাঙা পায়ে আলপনা এঁকে মিলিয়ে যাবে ওই পথের বাঁকে।

আর তখনই শুরু হবে বর্ষ বরণ উৎসব।

রোজ রাতে যে মেয়েটি তার ছোট ছেলেটির মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেবার জন্য এক একটি পুরুষের হাত বদলায়, নতুন বছরের সোনারোদ তার ছোট্ট ঘরটিকেও রাঙিয়ে তুলবে আবীর রঙে কোনো ভেদাভেদ না করেই।

ঠিক তখনই শুরু হবে বর্ষবরণ উৎসব।

ওই যে দূরে যে বৃদ্ধাশ্রম দেখা যাচ্ছে, সেখানে যে মা তার আদরের ছেলেটাকে একবার দেখার জন্যে চোখ মেলে পথের দিকে বসে থাকে, যার দুচোখে সমুদ্রের ঢেউ প্রতিনিয়ত। হয়তো অন্যদের মতো সে নতুন শাড়ী পরে সাজবে না, নতুন বছর কিন্তু তাকে ভুলে যাবেনা। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। সে মা তার ব্যাথা ভুলে সন্তানসম আদরে নতুন কে বুকে জড়িয়ে ধরবে।

ঠিক তখনই শুরু হবে বর্ষবরণ উৎসব।

প্রচন্ড যন্ত্রণায় তো পৃথিবীও কুঁকড়ে যায়। কখনো সখনো তার কক্ষচ্যুতি ঘটে। স্বপ্নেরা সব এলোমেলো হয়ে যায়। রাত আকাশে শুকতারা আর সপ্তঋষি চিনতে চিনতে কত রাত ভোর হয়ে গেছে। তার কাছেও কি আসবে নতুন বছরের নতুন ভোর? জড়িয়ে ধরবে তাকে পরম স্নেহে, আদরে, ভালোবাসায়? যদি আসে নতুন বছরের নতুন আলো, তবে আত্মিক অনুভবে বিনিময় উজ্জ্বল করবে তাকে। সেই খুশির রঙ পৌঁছে যাবে মনের প্রতিটি কোনায় সমান ভাবে, সমান তালে। পৌছে যাবে প্রেমের কাঠামোর প্রতিটি স্তরে।

আর ঠিক তখনই শুরু হবে বর্ষ বরণ উৎসব।

শম্পা বসু

0 কমেন্টস্
লুপ্তরত্ন
শম্পা বসু


নববর্ষ-নতুন বছর। পুরাতনকে ভুলে গিয়ে নয় তবে অবশ্যই নতুন আশা-আকাঙ্খার ভেলায় চেপে বসা। তবে স্মৃতি এক নাছোড়বান্দা, কাপড়ের খুঁট ধরে টানে।

পয়লা বৈশাখ – বাংলা বছরের প্রথম দিন । ছোটবেলায় স্কুলে “গ্রীষ্মকাল” নিয়ে রচনা লিখতে দেওয়া হত। গুরুজনদের কাছে শুনেছিলাম রচনার মধ্যে উদ্ধৃতি দিলে দিদিমণিরা নাকি বেশি নম্বর দিয়ে থাকেন। তাই খুব মনোযোগ দিয়ে মুখস্থ করেছিলাম , ‘এসো হে বৈশাখ , এসো এসো , তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’-- এই মুমূর্ষু বানান শিখতে কম মেহনত করতে হয়েছে? বার বার যখন ভুল হবার উপক্রম, তখন মা-ই শিখিয়েছিলেন সহজ রাস্তা । দুপাশে হ্রস্ব – উ , মাঝখানে দীর্ঘ ঊ । এখন আমি ছাত্রীদের শেখাই মুমূর্ষু বানান। যাই হোক, বৈশাখ মাস মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব , পঁচিশে বৈশাখ – রবীন্দ্র জন্মলগ্ন, কাজেই বৈশাখ মাস এলেও মনে বসন্তের রেশটা থেকেই যেত যেন । একদিকে দর্জির দোকানের ছিটের জামার আনকোরা নতুন গন্ধ, তখন তো আর ‘ড্রেস মেটেরিয়াল’ চলতি ছিল না, আড়াই তিন মিটারের ছিটের কাপড়ে তৈরি নতুন জামা পড়েই যার – পর – নাই খুশি আর রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের অনুশীলন। সে এক অনাবিল উত্তেজনা, আনন্দের অনুভব-- এই নিয়েই কেটেছে ছেলেবেলা।

কিশোরী বয়সে আর এক অনুভব । আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে পয়লা বৈশাখের দিন একটা রঙ্গিন ক্রোড়পত্র, নতুন সব সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটছে, লেখার প্রতি একটা আগ্রহ গড়ে উঠছে ক্রমশ। মনে পড়ে, সেই পত্রিকা মা’র হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তোষকের তলায় (তখন কার্ল অন প্রচলিত ছিল না) লুকিয়ে রাখা , দুপুরের অবসরে কোন এক মহানুভবতায় মায়ের হাতে তা তুলে দেওয়া আর সন্ধ্যাবেলায় বাবা নয়, মায়ের সঙ্গেই ভাইকে নিয়ে হালখাতার নিমন্ত্রণ রক্ষা করা। আসল লক্ষ্য ক্যালেন্ডারে নয়, মিষ্টির প্যাকেটে; দু তিনটে দোকান ঘুরে একটা করে আইসক্রিম খেয়ে সন্ধ্যের দিকে বাড়ি ফিরে আসা । মা’র কাছে জেনেছিলাম কেউ নিমন্ত্রণ করলে তা রক্ষা করতে হয় । স্থূল জগতের প্রতি আকর্ষণ গড়ে ওঠেনি তখনো ।

বিবাহোত্তর জীবন। আর পাই না ক্রোড়পত্রটা হস্তগত করতে । বাড়িতে অনেক সদস্য সংখ্যা । পড়ুন বা না পড়ুন, সেটা থাকতো শাশুড়িমা বা ভাসুর ঠাকুরের জিম্মায়। দিনের শেষে কিংবা পরের দিন যখন তা হাতে পেতাম, তার মধ্যে আর থাকতো না পয়লা বৈশাখের সকালের সেই ওম , সেই সদ্য গরম কাগজের গন্ধ । তবে এর অন্য একটা দিকও ছিলো। শাশুড়ি মা যখন হাতে একটা নতুন শাড়ি দিয়ে বলতেন , আজকের দিনে এটা একটু গায়ে ঠেকাবি , তখন দূর থেকে অনুভব করতাম আমার মায়ের সেই মমতার স্পর্শ; ভাই, বাবার জন্যে মন কেমন করে ওঠা । দিন যায়, বছর গড়ায়। হালখাতার দিনে কোন কোন বছর স্বামী হাতে করে এনে দেন স্বর্ণ সম্পদ । আস্তে আস্তে লক্ষ্য করতে থাকি প্রত্যাশা কেমন যেন বেড়েই চলেছে । কাগজে সোনার গয়নার রঙ্গিন বিজ্ঞাপনে চোখ চলে যায় অজান্তে, পরক্ষণেই ভাবি ,এত লোভ , স্থূলতা এল কোথা থেকে? ছোটবেলার সেই কিশোরী মেয়েটি বদলেই গেল নাকি! জীবনের সূক্ষ্ম তারগুলো একেবারেই কি ছিঁড়লো? আবার ভাবি, সবাই যে বলে , মেয়েদের তো শাড়ি গয়নার ওপর অমোঘ আকর্ষণ। তখন তাকেই জীবনের ধর্ম বলে মেনে নিয়ে অন্য পাতায় চোখ রাখি। আরে, লোভের আকর্ষণ তো খবরের কাগজের পাতায় পাতায়! ‘ষোল আনা বাঙালি’ , ‘তের পার্বণ’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ভজহরি মান্না’ হারিয়ে যাওয়া বাঙালি পদ নিয়ে আহ্বান করছে সাড়ম্বরে । আমরা বড়রা,সেই খাদ্য গ্রহণে উদ্যোগ আয়োজন করলেও ছেলে মেয়েরা বাদ সাধে । ও, পরবর্তী প্রজন্ম যে। তাদের কাছে তো পয়লা বৈশাখ একটা পার্বণ নয় , একটা উৎসব । বিশ্বায়ন ঘটে গেছে । তাই তারা খোঁজে চাইনিজ অথবা মোগলাই । তাই মোচা-থোড়-পাবদা মাছ নয় , চল ‘মেনল্যান্ড চায়না’ অথবা ‘ওহ ক্যালকাটা’। অতঃপর হালখাতার ভিড় ঠেলতে ঠেলতে চল পয়লা বৈশাখ উদযাপনে । ওঃ , বাংলা সালটা মনে আছে তো? কেউ যদি জিজ্ঞেস করে বসে!

আর একটা জিনিস বাদ পড়ে গেল যে ! সকাল থেকে , এমনকি আগের দিন রাত বারোটার পর থেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস বাংলা নববর্ষের ; আর যত বেলা বাড়তে থাকে , লাইকের পরিমাণও বাড়তে থাকে ততটাই। যার স্ট্যাটাসে যত বেশি ‘ লাইক’, ভেতরে ভেতরে তার গর্ববোধ ততই বাড়তে থাকে ‘দেখেছ, আমার সোশ্যাল নেটওয়ার্ক কত জোরালো’ । আর সেলিব্রেটি হলে তো কথাই নেই।

বড়দের প্রণাম জানানো উঠেই গেল বোধহয় । টাচ স্ক্রীন মোবাইলে একটা এস-এম-এস ছুঁড়ে দিলেই তো কেল্লা ফতে। কম্পিউটার আপডেট করতে থাকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া অনুভূত হয় । বেচারা সহস্রাধিক টাকার জামা পড়ে জানতেই পারলো না ছিটের জামারও একটা সুঘ্রাণ আছে , পয়লা বৈশাখ মানে যে কাঁচা আমের সুবাস আর রবীন্দ্র জয়ন্তী – তাও সেভাবে টের পেল না , সোনু নিগম ,এ , আর ,রহমত-ই যে সঙ্গীত জগতের গুরু , সেই ভেবেই আনন্দে বিভোর , আর সসে ডোবানো চিলি চিকেন আর সেঁকা কাবাবের কারসাজির আড়াল থেকে প্রাণ কাড়া ছ্যাঁচড়ার গন্ধ আর কচি পাঁঠার ঝোলের সুদূর ডাক তেমন করে অনুভব করল কই? কবির কথাটাই যেন বড় বেশি সত্য হয়ে দাঁড়ায় “মাথার মধ্যে দৃশ্য নানা /স্মৃতির মধ্যে অজস্র ফুল / তার সুবাসেই দেখতে পাচ্ছি বুকের কাছে”।

মিনহাজুল ইসলাম (অন্তর)

0 কমেন্টস্
অতিথি বৈশাখ
মিনহাজুল ইসলাম (অন্তর)



স্তব্ধ নিসর্গের নীলাভ আমন্ত্রণে
চৈত্র পেরিয়ে সময় এসে পৌঁছেছে বৈশাখের শানবাধাঁনো ঘাটে-
নোঙর ফেলেছে গ্রন্থিল বাহুবিশিষ্ট মাঝি
ধান- দূর্বা দিয়ে বরণ করতে এগিয়ে এসেছে ঘোমটা পরা নিসর্গেরবধূ –
রুক্ষতার লাল রঙে পা ডুবিয়ে ময়লা ধূয়ে পরিষ্কারচ্ছন্ন হয়ে
এখন নিদাঘ সময় উঠবে গিয়ে নিসর্গের বাড়িতে –
সেখানে অবস্থান করবে,
মাসখানেক নিসর্গকে দিয়ে যাবে ইষৎ পরিবর্তনের ছোঁয়া
কিছু শূণ্যতাকে ভরে দেবে পূর্ণতায়,
অস্পৃশ্যতাকে ছুঁয়ে দেবে মৃদু লজ্জায়,
বিবর্ণ সত্তাকে রাঙিয়ে দেবে মাল্টি কালার রঙের সুষমায়,
কষ্টের অস্তিত্বকে উড়িয়ে দেবে উৎসব- আনন্দের ইচ্ছেডানায় ...



সৌমিত্র চক্রবর্তী

1 কমেন্টস্
নতুন বছর রাত্রি উধাও
সৌমিত্র চক্রবর্তী



রাতবিরেতে রাতচরারা
ডঙ্কা দিয়ে মুখোশ খোলে,
একলা পথের একলা আলো
চুপটি করে মুখটি বোজে।

রাতবিরেতে কালোর পোঁচে
হৃদয় শব্দ বালির নিচে,
রক্তচোষা ডানা ঝাপটায়
শার্সি খোলা জানলাপথে।

রাতবিরেতে কষ্ট কবির
নষ্ট কলম চোখ মেরে যায়,
কুকুর ডাকে মাতাল হাঁকে
আঁখমিচোলি আলোয় ছায়ায়।

রাতবিরেতে ক্যালকুলেটর
আগুনচোখে চিন্তা ধরায়,
না মেলা সব হিসাব এনে
মস্তিষ্কে এসিড ঝরায়।

রাতবিরেতের কারিকুরি
ঝগড়ুটে ঝড় লালের আকাশ,
সকাল এলেই নতুন বছর-
সকাল এলেই ভোকাট্টা।

রমা চোঙদার

5 কমেন্টস্
স্বাগতম
রমা চোঙদার



পৃথ্বীর তন্দ্রা জড়ানো কুঁড়ির চোখে
সোহাগী আলোর চুম্বন দিয়ে
ফুলের হৃদয় জাগ্রত করে ভোরের রক্তিম অরুণ,
পৃথ্বীর দূর্বা কোমল হৃদয় শিহরিত হয়ে কাঁপে,
ধীরে ধীরে অরুণ পৃথ্বীর মনের সাগরে স্নান করে,
সময়ের সাথে সাথে হাওয়ার তরঙ্গে পাল তুলে,
প্রেমের জোয়ারে ভেসে যায় পৃথ্বী।
ঠিক তখনই দূরে, ঐ সবুজ দ্বীপে
পাখীদের কণ্ঠে মুখরিত হয় ভৈরবীর আলাপ।
নীলাম্বরী শাড়ি পরে কাজলাদিঘির লাজুক চোখে
অরুণকে দেয় খুশীর সদ্য ফোটা গোলাপ,
পৃথ্বীর হৃদয়ের আঙিনায়
উপস্থিত শুভপয়লাবৈশাখ।

ইন্দ্রানী সরকার

0 কমেন্টস্
নূতন বর্ষের আগমনী
ইন্দ্রানী সরকার


চৈত্রশেষের নিশাবসানে
                       বিদায় বার্তা আসে |
নববর্ষের আগমনী
                       হওয়ার সুরে ভাসে ||

পাপিয়া গাঙ্গুলী

2 কমেন্টস্
অণুকবিতা
পাপিয়া গাঙ্গুলী



আঁজলা ভরে ঠোঁট তুলে নিলে ,
শুককীট হয়ে যায় প্রজাপতি
আর পলাশ রাঙ্গা লাজুক উত্তাপে
নামে অকাল বসন্ত


নিস্তব্ধতার এক রহস্য থাকে
ওরনা ঢেকে, গোলাপী গল্পরা ...
অদৃশ্য হাতছানি দেয়


দুহাত বাড়ালে,
বুকের মাঝে যতটুকু জমি
ততটুকু লিখে দিও আমার নামে


কিছু মুহূর্ত উড়ে বেড়ায়,
কুঁচো কাগজের মতো-
মন খারাপি হাওয়ায়


মন খারাপ তুমি
পাপোষে
পা মুছতে জাননা !

বিজয় ঘোষ

0 কমেন্টস্
অণুকবিতা
বিজয় ঘোষ


(১) অনন্ত জীবন

আকাশের নীলে আছে অনন্ত জীবন
জীবনের ঠোঁটে আঁকা মৃত্যু কথন
এবার ভাসাও নৌকো অনন্ত ভাসানে
আকাশের ধ্রুবতারা মিটি মিটি হাসে ।

(২) অনুপমা

তুমি আমার রৌদ্রদগ্ধ তীব্র দহন
তুমি আমার বৃষ্টি ভেজা অবগাহন
তুমি আমার চিরকালীন রূপকথা
তুমি আমার বেলাশেষের নষ্ট ব্যথা !

শমীক জয় সেনগুপ্ত

0 কমেন্টস্
গুচ্ছ কবিতা -১
শমীক জয় সেনগুপ্ত



পাগলামি


আমায় নিয়ে ভাসতে থাকে বাঁশুরিয়া উদাস দুপুর...
একটু আমি নষ্ট হব, একটু না হয় হব মধুর।
আমায় নিয়ে ভাবছে এখন স্বপ্ন বোনা শহুরে মুখ;
একটু ভাগাভাগির দুঃখে ভুগছি একাই সুখের অসুখ।
বৃষ্টি পড়ছে-
এ ঘর ও ঘর চাতাল পাতাল
মনও দেখি উতল হচ্ছে।
ওখান থেকেই প্রথম যদি ভাবাও আমায় মনময়ুরী-
দিব্যি করে বলছি তবে,
তোমার জন্য আকাশগঙ্গা নিজের হাতেই করবো চুরি।
তখনই মন রঙীণ হবে।
এখন দেখি বসন্ততে রোজই একটু নতুন আমি,
মাতাল আমার ইচ্ছেগুলো-
বাতুল আমার এ পাগলামি।



নিজের মানুষ


আমার বয়স এখন রজতগিরির শুভ্রতাকে স্পর্শ করেছে-
ঠিক আমার নিজের মানুষটার মতই।
সে আমার সমবয়সী কারন আমি তাকে
জন্ম থেকেই নিজের সঙ্গে নিয়ে বেড়ে উঠেছি।
যেমন বেড়ে চলেছে ঝড়ের সাথে সাথে আমার হৃদস্পন্দন-
আর আমার নিঃশ্বাসের উষ্ণায়নে রোজ ভোর হয়;
রোজ সন্ধ্যা নামে-
চাঁদ আর সূর্যের দ্বৈরথে মন ছিন্নভিন্ন হয়।
আর রজত শুভ্র এই বয়সে বুকে চেপে ধরা প্রলাপ
রোজ ভেজে বৃষ্টির সাথে।
তাকে কেউ দেখে না...
কেউ ভেজে না তার ছাঁটে-
শুধু আঁকড়ে ধরা গীতবিতানের ৯৭ পাতায়
আমার সমবয়সী দোসর
আমার সাথে দুঃখ ভাগ করে নেয় ।।
বৃষ্টিতে ভিজে আমি আর আমার কথারাও
সার্ধ-শতক পেড়িয়ে চলে আসি।।




শুভ্রদীপ্ত


আমার বোহেমিয়ান মন
আর বৈধব্যের জীবন সব-
সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষায়
ক্লান্তি ছুঁতে চায়।
আকাশে ভাসছে মেঘ
আর মন গাইছে-
দেখি নাই কভু দেখি নাই
এমন তরনী বওয়া-
বারবার শুধু অগ্নিবাণে ঝাঝরা হয়েছি..
আমায় কিন্তু বর্ষার গান শোনাবে বলেছিলে!!
মনে আছ?
মনে নেই, মনে পড়ে না..
মনে রাখা শুধু যাতনা।
ডুবে যাওয়া সূর্য কথা রাখেনি।
আবার উঠবে যে তারা
দিনের শুরুতে, সেও রাখেনি কথা ।
তাই সন্ধ্যায় আমি শুভ্রদীপ্ত হব।।

হরিশঙ্কর রায়

0 কমেন্টস্
গুচ্ছকবিতা - ২
হরিশঙ্কর রায়



(১) সভ্যতা

আমাকে ঘিরে আমার প্রতিচ্ছায়া
আলো-আঁধারিতে
কেঁপে কেঁপে ওঠে,
প্রেম পথে হেঁটে হেঁটে
সভ্যতার বিকাশ খোঁজে ।
প্রতিচ্ছায়া, 'আমিই সভ্য প্রেমিক' ।
একবার ছুঁয়ে দেখোই না !
********************
এই তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম !
রক্তবীজে জন্ম নিচ্ছে অনাগত,
থরথরিয়ে কাঁপছে সভ্যতা ।



(২) বুকের ভিতর যে ব্যথা

যে দূর্বাদল জীবনের মতো পেয়েছিল সূর্যের স্বাদ !
ঢেউয়ে ঢেউয়ে স্নাত হয়,
কলকল হর্ষে লাস্যময়ী
বহমান ।

স্বপ্নালু হাওয়ায়
শান্ত শ্বাসে বেঁচে ওঠি ।
এমন বাসন্তী দিনে কেন এমন নিঠুর হলে ?

আমি আনমনা হই-
বরষ বরষ ধরে যে জলে তৃষ্ণা মেটাই
নেই, সেতো আর তেমনটি নেই ।

ও তিস্তা, তোর বুকে
কত অচেনা পথিক
পদ চিহ্ন এঁকে যায়
এপার-ওপার,
শুধু বিষ্ময়ে চেয়ে আছে
এ মরু-প্রান্তর ।



(৩) প্রেমাধাঁরে তুমি

অদ্ভূত আঁধারে যে আলো জ্বালো
তুমিই তো, তুমিই স্বাতী !
অজস্র আলোর ফোয়ারায়
চেয়ে থাকি ।
নির্বাক অন্তরের আলাপন
তুমি শোনো ?
চঞ্চল শিহরণ দখিন সমীরণ
কাঞ্চনে লেগেছে দোলা,
হেনার সৌরভে ছুটে এলো পরিমল;
তোমার পরশ চাহি নিত্য ডাকি
তুমি আসো কই ?
এ আঁধার করো দূর-
হে সুদূর ! হে সুদূর অতিথি !
অদ্ভূত আঁধারে যে আলো জ্বালো
তুমিই তো, তুমিই স্বাতী ।

উজ্জ্বল ঘোষ

0 কমেন্টস্
নিমন্ত্রণ
উজ্জ্বল ঘোষ



ঝরা পাতায় পাঠিয়ে দিও
তোমার নিমন্ত্রণ।
ফাগুন পলাশ সাজিয়ে তোমায়
করবো আমন্ত্রন।।

শাল বনেতে বাজবে মাদল
গাইবে গান কোকিল।
বইবে বাতাস নেচে নেচে-
বাজবে নুপুর সন্ সন্ সন্ সন্

ঝড়বে শিমুল বারি
করবে আলিঙ্গন-
সাঁঝের বেলায় জ্বালবো প্রদীপ-
হাসবে তোমার মন।।

ঝরা পাতায় পাঠিয়ে দিও
তোমার নিমন্ত্রণ।।

আকাশ দত্ত

0 কমেন্টস্
নো এন্ট্রি
আকাশ দত্ত



শহরের জনপদ চীরে
যে সর্পিল মিছিলটা
রান্নাঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত ডিঙিয়ে গ্যাছে,
কামদুনি, মোমবাতি, ধর্নার হার্ডল পেরিয়ে
এটা তার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

পতপত
উড়িয়ে দেওয়া রঙে
যে বাইশবছরটা
ধোপদূরস্ত ক্যানভাসিং এ ব্যস্ত,
গত দেড় বছর ধরে তার শেজো বোনটা
রোজ রাত্তিরে পার্টিসম্পাদকের বাড়ী যায়
বাধ্যতামূলক টিভি দেখতে

নগরে বন্দরে
কয়েকটি জারজ জিজ্ঞাসার
ভুল যাতায়াত ছাড়া
এ সর্বাঙ্গ খুলে দেওয়াতে নতুনত্ব কিছু নেই

আনুষ্ঠানিক খবরে প্রকাশ,
সরলরেখা বরাবর হেঁটে চলা
রাস্তাটাও বেবাক ভুলে গ্যাছে
সোজাসাপটার বৈচিত্র্য বোঝাতে
শেষ কবে ব্যবহার করা হয়েছে তাকে 


কাজলী চক্রবর্তী

0 কমেন্টস্
আসবে তো ফিরে
কাজলী চক্রবর্তী



জানো , আমি প্রহর গুনি?
আমি প্রহর গুনি শিশু সূর্যোদয় থেকে বার্ধক্যের সূর্যাস্ত পর্যন্ত ।
নবজাত ফিকে সন্ধ্যে থেকে নিকষ নিশি পর্যন্ত
শুধু তোমার প্রত্যাগমনের আশে !!

জানো , আমি প্রহর গুনি?
আমি প্রহর গুনি ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে,
দোয়েল-কোয়েলের সুর মুর্ছনায়,
মেজাজী চৈত্র্যের ঘুঘু ডাকা দুপুরে বেগুনি ফুল ফুল ছাতায়
আমার হারিয়ে যাওয়া হৃদয়কে খুঁজে পেতে !!

জানো , আমি প্রহর গুনি?
আমি প্রহর গুনি প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধে,
ঝিলমিল রামধনুর লাজুক আলোয় ,
শ্যামলা মেয়ের কলসকাঁখে মেঠো গ্রাম্য পথে
আমার সকাল,দুপুর ,সাঁঝবেলা কাটে তোমার প্রতীক্ষায় ।
শুধুই তোমার প্রত্যাগমনের আশে
তুমি আসবে তো ফিরে শেষ প্রহরে?

শ্রীশুভ্র

0 কমেন্টস্
মনফড়িং
শ্রীশুভ্র



সব নারী ঘরে ফেরে না!
সব নদী ডুব সাঁতার জানে না!
পায়ে পায়ে বাঁধন খোলার আয়োজনে
নকশিকাঁথার দুপুর হাতছানি দিতে থাকে!
নদীর বাঁকে গোধুলির আলপনা নারীর মনের কথা বলে!
যে নারীরা ঘরে ফেরে না,
যে নদী ডুব সাঁতার দেবে না, চতুর্দশীর চাঁদে তাদেরও মন কেমন করে!
রাত্রি তৃতীয় প্রহরে
নদীর বাঁকে বাঁকে, শরীরের অপভ্রংশ পূর্বরাগ ধরলে
কুমারী জ্যোৎস্না টলমল করে ওঠে!
স্থির চাঁদ নিষ্পলক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে!
সব সঙ্গম ভালোবাসার জলে ভেজে না!
সব প্রেম প্রজাপতির রঙে ডানা মেলে ওড়ে না!
তবু নদীর ঢেউ আর নারীর ওম দুকূল ছাপিয়ে যেতে চায়!
বর্ষার মেঘে আষাঢ় নামলে
শ্রাবণঘন সন্ধ্যায় ভরে ওঠে
নদী আর নারীর সময়!
তখন কে আর ঘরে ফিরে যেতে চায়!

প্রণব বসুরায়

0 কমেন্টস্
পিছনে তাকানো
প্রণব বসুরায়



স্বর্ণ-ঊর্ণনাভ থেকে স্তব্ধতা, নির্মোক সত্য
উত্তরের হিম-গন্ধ সমেত ।
বন্ধুত্ব, প্রণয়, অপ্রণয় ইত্যাকার অলৌকিক শব্দগুলি
পারলৌকিক জ্ঞানে সম্পৃক্ত...
#
তবুও তো অশ্বপৃষ্ঠে গমনের কালে
উপলখন্ড বাঁচিয়ে পিছনে তাকালে
শান্ত বনান্তের টিয়া রং
রঙে রঙে রংবাহার...
#
তবে কেন পারলৌকিক জ্ঞান!
তবে কেন পিছনে তাকানো ?

ইন্দ্রানী সরকার

0 কমেন্টস্
প্রতিশ্রুতি
ইন্দ্রানী সরকার



একান্নতম পীঠে তোমার আসার প্রতিশ্রুতি
বৃষ্টিতে ভেজা গোলাপের পাপড়ি হয়ে
ঝরে পড়ে আমার সারা শরীরে।

করমচা রঙা হাত আমার হাতে রেখে
মৃদু মৃদু নিঃশ্বাসে যখন বলে ওঠো ভালোবাসি,
প্রতিটি নিঃশ্বাসে থাকে গোলাপের সৌরভ।

মনে হয় এত কাছে কখনো আসি নি আগে
বিকেলের রাঙানো মেঘ উঁকি মেরে দেখে যায়
আমাদের এই আবেশে জড়ানো আবেগ।

বাতাসে তখনো তোমার গন্ধে মাখা আমেজ
এত অফুরান হাসি কি করে আসে ?
আকাশের নীলে তোমারি আঁকা সবুজ।




মৌমিতা চন্দ্র

2 কমেন্টস্
রাতের কবিতা
মৌমিতা চন্দ্র



গলির মোড়ে জমজমাট সন্ধ্যে,
আর ফুল দোকানে ভিড় দেখলেই বুঝি-
আজ মায়ের খুব কষ্ট
বুড়িমাসির ঘরে আমিও তখন বড় হওয়ার কষ্টে ছটফটে
মায়ের যত্নে সাজানো মূর্তি গুলো ভন্ড,
আক্রোশে নিজেই ঈশ্বর
বংশানুক্রমে

চার প্রহর শেষে চিল শকুন গুলো যখন
ভুলে যাওয়া বাড়ির পথ খুঁজে,
বুড়িমাসি তখন মহল্লার বাচ্চাদের এক এক করে শুভরাত্রি জানায়।
আগোছালো ঘর হালকা হাতে গুছিয়ে-
জ্বলজ্বলে চোখে মার ডাক
"মুন্নি খাবি আয়"

খালিপেটে সুয্যি প্রণাম করে
রাত খেতে বসে
মা-মেয়ে..
বাসি ঠান্ডা কড়্কড়ে ভাত।
হাসিমুখে আস্বাস ভাসে
"কালই তোর সব বই কিনে দেবো"

আপাত নির্লিপ্ত মনে তন্নতন্ন মাকে খুঁজি-
ঠান্ডা চোখের সামনে সব আঁচড় গুলো অক্ষর হয়ে যায়।

বিমল সরকার

0 কমেন্টস্
লেক
বিমল সরকার



জলের কাছাকাছি গেলেই ,
অনুভবে টের পাই তোর গন্ধ।

স্পর্শকাতর জলের তরঙ্গ
কচুরিপানায় ধাক্কা খেয়ে ,
ফিরে আসে তোর ফেলে আসা কোলে ,
তোর স্পর্শ মেখে হিম হয়ে দাঁড়ায়
বনজ ইউক্যালিপটাস ।

একটি পাতা নিঃসঙ্গ উদাসীন ,
ঝরে পড়ে হাতের তালুতে ,
পাতার স্পর্শে টের পাই ,
অনুচ্চার হাসিতে কেঁপে ওঠা ঠোঁট ।

তিরতির হাওয়া আর জলজ ঘ্রাণ ,
চিনে গেছে তোর নিত্য আসা যাওয়া ,
শীতের দুপুর তখন
মসৃণ ত্বকে পিছলে পড়া রোদ ।

সযত্নে লুকিয়ে রাখি জামার আস্তিনে ,
তোর খোঁজে আসা ঝরে পড়া পাতা ,
যখন এমন তুই আনমনা উদাস ,
পৌঁছে দিই সবুজ পাতা তোর জিম্মায় ।



ব্রতী মুখোপাধ্যায়

0 কমেন্টস্
কবিতাপাঠ
ব্রতী মুখোপাধ্যায়


এক একটি শব্দ দেবশিশুর মুখ, পাপস্পর্শ নেই
রেশমের শরীর এক একটি শব্দের
অসাধারণ আলোর খেলা --- হলুদ, নীল, শ্যামল, লাল
হৃদয়খালির মাঠ

এক একজন মায়ের চোখ
এক একজন তাকিয়ে, মনোরমা
মনোরমা, ভালোবেসেও, আমার সঙ্গে আসে নি
কেউ কিন্তু বন্ধুই, ক্রান্তিকালের, বয়ঃসন্ধিকালের

ভালোই লাগছিল
বুক একসময় আঙুল হয়ে, আদর করতে চেয়ে

তখন ওই ভেজা ভেজা, জল, জলের শুকনো রেখা
চোখের জল, আমি চিনি
হায়, হায়, আঙুলের ডগায় এমন লাল, রক্ত, রক্ত আমার চেনা
এইসব আবার কি ? ছাইদানা, স্বপ্নপালক পুড়ে পুড়ে
কোথায় যে ছিল!

না ভাই, পড়ছিলাম কবিতা, লিখেছেন ভাইবন্ধু কেউ, এইসময় ... 


রিঙ্কু দাশ

0 কমেন্টস্
আজ ফাগুনে
রিঙ্কু দাশ



অন্তঃসলিলা আগুন জ্বেলেছ প্রাণে
বৈকালিক বৃষ্টি আসুক নেমে ;
কোন দূরে সুদূর অজানিয়া সুর
নীল জানালায় উদাসী অন্তঃপুর --
আসা যাওয়ার পথের বাঁকে
সুর পুড়িয়ে আগুন জ্বেলে রাখে !
পলাশ শিমুল নির্বাসিত , একা কিংশুক......
আজ ফাগুনে বৃষ্টি বুকে অন্তঃসলিলা আগুন জ্বলুক ।

সায়ক চক্রবর্তী

0 কমেন্টস্
আমাদের তারারা
সায়ক চক্রবর্তী


অনেকদিন পর রাতের মত রাত পেলাম - ঠিক যেমন রাত হওয়া উচিৎ - ঐতিহাসিক তারা, ছেলেভোলানো চাঁদ আর কবির উর্বর ক্ষেতি - কালো অথচ অর্থপূর্ণ আকাশ। তারা আর আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিনিময় করছি সৌন্দর্য, স্মৃতি আর বিষাদ। তারাদের সাথে আমাদের মিল পাই যখন সেও হারায় মেঘের আড়ালে। হাল্কা নীলাভ আভা পরিমাণমত ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের উপর - চুম্বনরত প্রেমিক-প্রেমিকাদ্বয়ের উপর, ষ্টেশনমাস্টারের অন্ধ ফ্ল্যাগের উপর, মায়ের ব্যস্ততামাখা উলকাঁটার উপর, নোংরা ছেলেটার প্রশ্নময় ঘায়ের উপর...আরও অনেকের উপর সমতা বজায় রেখে শেখাচ্ছে সাম্যবাদ। সেদিনটায় সূর্যের আলো ছিল বলেই দিন ডেকেছিলাম, নয়ত তার হাতের রেখায় যখন আমার রেখা মিলল না, তখন হঠাৎ অন্ধকার করে এলো আকাশ, তারারা অনেকদুরে টিমটিমে আলোয় মলম দিচ্ছিল। আমাদের বাড়ির পাশে যে মেয়েটা এক রাতে অনেকদূরে তারা হয়ে গেছিল, সেই মেয়েটার স্বপ্নটা অনেক বড় ছিল কি? নাকি চোখে পড়ার মত ছিল না বলেই আলোর ফুলকি হয়ে যেতে হল কে জানে! তাকে দেখেছি অনেকবার তারা হয়ে আলো তো দিচ্ছে সবাইকেই! যে মেয়েটার দাদু বলেছিল 'ওই দেখ, তোমার বাবা', সে মেয়েটা আজও খুঁজতে খুঁজতে আকাশের দিকে তাকালে ভেতরের ঘর থেকে মা ডাকে 'দীপা, বাবার ফটোটা পরিস্কার করে কালকের শুকনো মালাটা সরিয়ে নতুনটা দে...' - বাবাকে একবার ছোঁয়া যায়। তারাগুলো নানা রকমের মুখোশ পরে আমাদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। কখনও তো এত দূর মনে হয়নি দূরত্বে থেকেও। দূরত্ব বোধ হয় স্কেলে না ; মনেই কমবেশী হয়। এখন যাদের মুখের উপর তারাদের আলোর ভাষা প্রাগৈতিহাসিক লিপির মত ছড়িয়ে আছে, তাদের ছুঁয়ে আছে ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যময়তা। তারাদের নাম প্রিয়, সবারই এক নাম – কোন এক প্রিয়তম কেউ ওখানেই যে থাকে। যদি কোনদিন হাত ধরাধরি করে তারাখসা দেখে কেউ কিছু চেয়ে বসে, ব্যথা লাগে – ক্ষয়িষ্ণুতা তো কখনও ইচ্ছাপূরক হতে পারে না। তারাদের মাঝে আমরা ; নাকি আমাদের মাঝে তারারা, কখনও ভাবিনি, তবে যখনই কাছাকাছি থেকেছি আমরা, শিখেছি আলোর মত। তখনই অক্ষরে অক্ষরে ঠোকাঠুকি লেগে হয়ে যায় –

নিঃশব্দের আলখাল্লা গায়ে ওই যে লন্ঠন ভাসে;
তার নীচে কি আশ্চর্য – দেখছি আশ্চর্য হরেক আর
ধারাপাত পার হতে হতে ঘুম এলে তোমাদের শুকরিয়া।
দেখার অনেক কিছু ফেলে রেখে যদি শাশ্বত
চিনে নিয়ে ভালবাসি, তবে পৃথিবী গোরস্থান।
ভেসে আছে আলো আশীর্বাদ –
বুকে মেখে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে গেছে যারা
তাদের সেলাম। উঠোন-আঁচল পেতেছি,
চুপ তোমাদের কাছে আঁকা শিখে আমিও
জ্বলতে শিখি – চোখ ভালবাসি যারা দেখে।

শ্রীশুভ্র

0 কমেন্টস্
যখন সময় থমকে দাঁড়ায়
শ্রীশুভ্র


কোথায় যেন তাল কেটে গেছে জীবনের আটপৌরে ছন্দে। মাঝে মাঝেই ঠিক এমনই যেন মনে হয়। জীবন শুরুর যুগে সাধারণ ভাবেই বিশ্বাস আর ভরসার অনুভবটা অনেক সহজলোভ্য ছিল, কিন্তু প্রতিদিনের নিয়মিত ব্যস্ততায় এই দুটি অনুভবের অস্তিত্ব ক্রমশই যেন ফিকে হয়ে চলেছে। ব্যাক্তিগত সম্পর্কের সুতোগুল দিনে দিনে কতই আলগা হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক পরিসরে তার প্রভাব পরছে সুদূরপ্রসারী। কর্মক্ষেত্রের জগতে তো কথাই নেই, সন্দেহ আর সংশয় সাবধানে পা ফেলতে সাহায্যই করে এক দিক দিয়ে। কিন্তু এই যে সংশয় আর সন্দেহ, আমাদের রোজকার জীবনে ওতোপ্রতো ভাবেই জড়িয়ে আছে আমাদেরকে, আমাদেরকেই তা যেন ভেতরে ভেতরে দীর্ন করে দেয়, বিচ্ছিন্ন করতে থাকে অন্যদের কাছ থেকে। আর তখনই খুব একলা হয়ে পড়ি আমরা চলমান সমাজ জীবন থেকে।

কবি বলেছিলেন “বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো” আর আমরা চলেছি ঠিক তারই উলটো অভিমুখে। খুব গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, দাম্পত্য সম্পর্কই আমাদের জীবনের মূল ভরকেন্দ্র। যেখান থেকে পারিবারিক জীবনের পরিসর গড়ে ওঠে; সমাজজীবনের ভিত প্রস্তুত হয়। আর যে সমাজের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে রাষ্ট্রের কাঠামোটা। ফলে আমাদের ভালোমন্দ সবকিছুর পেছনেই দাম্পত্য সম্পর্কের একটা অভিঘাত আছেই। ফলে ব্যক্তিজীবনে এই সম্পর্কের প্রভাব আমাদের প্রকৃতিকে অনেক অংশেই নিয়ন্ত্রণ করে। এই সম্পর্কের সুস্থতা আমদের বিশ্বাসী হতে সাহায্য করে। উল্টোটা ঘটলেই আমরা সবকিছুর সম্বন্ধেই বড়ো বেশি সন্দিহান হয়ে পড়ি। যে সন্দেহ আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। আমদেরকে সবকিছুর সম্বন্ধেই সংশয়াতুর করে তোলে, কোনোকিছুর উপরেই যেন আর ভরসা রাখতে পারি না। আর তখনই কবির কথা মতো সকলের সাথে চলার যে অভিমুখ, সেটাই গড়ে ওঠে না আমাদের সমাজজীবনের পরিসরে ব্যক্তিজীবনের দোটানায়। ঠিক তখনই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকি চলমান জীবনের মূলস্রোত থেকে।

কিন্তু কেন এই সংশয়, এই সন্দেহ? বিশ্বাস আর ভরসার এই একান্ত অভাব আমাদের ব্যক্তিজীবনের পরিসরে? কেন এত দোটানায় ভুগতে হয় আমাদেরকে? কেন পারি না নিঃসংশয় হতে নিজেরই প্রিয়তম মানুষটির সম্বন্ধে? আসলে আমরা আমাদের অহং আর লোভের প্রবৃত্তিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকি অধিকাংশ সময়েই। তাই সবসময়ই সভয়ে থাকি এই বুঝি আমার সব হারিয়ে গেল। এই বুঝি আমার ভাগে আমার প্রাপ্যটুকু কম পড়ল বিশেষ করে। এই বুঝি আমার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হতে হল আমাকে, এই বুঝি ঠকে গেলাম আমিই। অথচ ভেবে দেখিনা আমরা নিজেরা কতটা ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পেরেছি অন্যের, কতটা নিঃসংশয়ে রাখতে পেরেছি আর একজনকে। আর সেইটি করতে গেলে নিজের যে অহংটিকে বিসর্জন দিতে হয়, নিজের যে লোভগুলির অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে হয় নিজেকে; সে সম্বন্ধে কোনোই হূঁশ থাকেনা আমদের নিজেদেরই।

ঠিক তখনই অন্যের স্বাধীনতাতেই সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত থাকি আমরা। খর্ব করতে চাই অপরের স্বাধীনতার পরিসরটিকেই। আশা করি তাহলেই বুঝি কোনভাবে ঠকে যাওয়ার হাত থেকে পরিত্রাণ পাব। আমার ইচ্ছাদীন করে রাখতে চাই আর একজনকে, হয়ত সবচেয়ে যাকে ভালবাসি বলে দাবী করি, তাকেই এই ভাবে নিজের আয়ওত্তাধীন রাখার মধ্যেই নিশ্চিন্তি খুঁজি আমরা। ঠিক এইভাবেই নিজের অজান্তেই নিজের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরটিকে সংশয়াচ্ছন্ন করে তুলি আমাদেরই অহং আর লোভের প্রবল তাড়নায়। পারস্পরিক বিশ্বাস আর ভরসার সুতগুলো এভাবেই আলগা হতে থাকে দাম্পত্যের পরিসরে, যার প্রভাব পরে পরিবারের অন্যন্য সম্পর্কগুলির উপরেও। সমাজের ঘরে ঘরে যখনই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখনই আলগা হয়ে পড়ে সমাজের ভিতটাই। রাষ্ট্রও বাদ যায় না এর প্রভাব থেকে। আর সেই সামগ্রিক অবিশ্বাসের বাতাবরণে, সংশয়ের অন্ধকারে জীবনের সব আনন্দই যেন ম্লান হয়ে ধরা পরে মনের আয়নায়। তখনি আমরা ক্রমশই একলা হতে থাকি আমাদের পরিপার্শ্ব থেকে। তখনি মনে হয় কোথায় যেন তাল কেটে গেছে জীবনের আঙ্গিনায়। সমাজের সর্বস্তরেই যখন এই ঘটনা ঘটতে থাকে, তখন স্বভাবতই সৃষ্টি হয় এক সামাজিক অবক্ষয়ের। যার সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়ে শিশু কিশোরদের বেড়ে ওঠার উপরে। ফলে তাদের প্রকৃতির বিকাশই হতে থাকে এক সংশয়দীর্ণ অবিশ্বাসের বাতাবরণের মধ্যে দিয়ে। এইভাবেই দূর্বল হতে থাকে মানুষের সাথে মানুষের স্বাভাবিক প্রীতির পরিসরটুকুও। পারস্পরিক সৌজন্য বিনিময়ের হাসিটুকুও আর অম্লান থাকে না, থাকে না তাতে প্রাণের আন্তরিক ছোঁয়াটুকুর সম্প্রীতির পরশ। কেবলই লৌকিক কৃত্তিমতার খোলসে ঢুকে পড়ি আমরা প্রত্যেকেই। প্রানের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ অবরুদ্ধ করে আমরা কেবলই অভিজ্ঞতার তিক্ততায় জীবনের ছন্দকে উষর করে তুলি। হয়ত আধুনিক সভ্যতার এটাই বাস্তব ফলশ্রুতি। কিন্তু এখান থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। তবে তাদের জন্য একটা প্রথমিক পথের হদিশ রেখে যেতে হবে কিন্তু আমাদেরকেই, নয়ত অসম্ভব হবে তাদের পক্ষে স্রোতের উলটো অভিমুখে দাঁড় টানা। আর তখন সময় শুধুই থমকে দাঁড়াবে না, ব্যর্থ করে তুলবে মানুষের মূল অভিপ্রায়কেই, যেখানে মানুষের বড়ো পরিচয় মনুষত্যের উদবোধনেই।

ব্রতীন বসু

0 কমেন্টস্
এক কবিতার দুঃখ
ব্রতীন বসু



এক কবিতা অনেক ভাবনাচিন্তা করে মনস্থির করলো কবির সাথে দেখা করবে,তাকে একবার যেতেই হবে,অনেক দেরি হয়ে গেছে,এখন না গেলে হয়তো আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না ।

একশো বছর পেরিয়ে গেছে কবি ওকে ফেলে চলে গেছেন স্বর্গলোকে,কিন্তু মহাকবি,সবাই চেনে, খুঁজে নিতে অসুবিধে হল না । রাস্তায় রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা হল ।

পেন্নাম গুরুদেব, আমার কবি কোথায় আছে বলে দিতে পারেন ।

তুমি কোন কবিতা, তোমার নাম কি ?

আজ্ঞে, আমাকে আপনি চিনবেন না,পলাশীর যুদ্ধ আমার সহোদর ।

ও নবীন সেন কে খুঁজছ, ওইদিকে যাও পেয়ে যাবে । গিয়ে দেখি কবি মেঘের বুকে গোলাপ গাছ

লাগাচ্ছেন ।

নমস্কার কবি,আপনাকে সামনে কোনদিন আর দেখতে পাবো ভাবিনি, কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার,কি করে যে বোঝাই আপনাকে ?

আহ, বিরক্ত কর না,দেখছ না, মেঘদের কষ্ট হয়, আজকাল মেঘলা দিনে নতুন প্রেমিক প্রেমিকাদের মনে আর কাঁটা ফোটে না, তাই একটা ব্যবস্থা করছি,পরে এসো ।

আমাকে আপনি চিনতে পারলেন না?

কে তুমি, কবি মন দিয়ে গাছ লাগাতে লাগলেন, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ও না ।

আমি আপনার সৃষ্টি , আমাকে কেউ পড়ে না,আমি,আমি,আমি খুব ক্লান্ত,আমাকে মুক্তি দিন ।

কবি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন । সারা গায়ে সব কাটা, শুধু একটা আমি শব্দ কাটা হয়নি, সেই আমিত্বের জ্বালা, একাকীত্ব,গর্ব, যেন এক সংঘর্ষের মৌচাক ।

কবি সযত্নে গোলাপ পাতা দিয়ে মুছে দিলেন আমি শব্দটি ।

আজ থেকে তুমি আমার ভেতর আবার ফিরে এলে,চল এক সাথে মেঘের দুঃখ ঘোচাই ।

রাজর্ষি মজুমদার

0 কমেন্টস্
শাপার্দি দিজোনো দামোনোর দুটি কবিতার অনুবাদ
রাজর্ষি মজুমদার


আমি চাই

আমি তোমাকে সহজ ভাবে ভালোবাসতে চাই
সেই সব শব্দ দিয়ে –
যেগুলো কাঠেরা আগুনকে না বলে ছাই হয়ে গেছে।
আমি তোমাকে সহজ ভাবে ভালোবাসতে চাই
সেসব সংকেতে,
যেগুলি বৃষ্টিকে মেঘ না দিয়েই ভিড়ে হারিয়ে গেছে।



আমি বৃষ্টি থামালাম

আমি বৃষ্টি থামালাম।
এখন সূর্য আমার অপেক্ষা করে,
কুয়াশার হাল্কা চাদর উঠিয়ে নিচ্ছে
সকালের গা থেকে।
ভেতরে কিছু একটা টের পাচ্ছি :
ফুঁড়ে যাচ্ছে ভেজা মাটি;
একটা অপেক্ষাকে গর্ভবতী করল বৃষ্টি এবং রোদ।
আমি সূর্যকে থামাতে পারলামনা
আমায় ফুল ফোটানোর কাজে জোর করার জন্যে


[কবি পরিচিতি -
শাপার্দি দিজোনো দামোনো জন্ম - ১৯৪০ প্রথম কাব্যগ্রন্থ - মাতা পিসাউ (ছুরি)
ইন্দোনেশীয়ার অন্যতম প্রধান কবি]

অমলেন্দু চন্দ

0 কমেন্টস্
দুটি অনুবাদ কবিতা
অমলেন্দু চন্দ

Langston Hughes - হারলেমের কবি বলে দুনিয়ার কাছে পরিচিত হতে হতে একদিন তাঁর কবিতার আবেদন নিয়ে সার্বজনীন হয়ে গেলেন, তাঁর ক্রিটিক দের ভাষায় "হি ওয়াজ ইন্টেন্সলি সাব্জেক্টিভ, প্যাসনেট, কিনলি সেন্সিটিভ টু বিউটি, অ্যান্ড পজেসড অফ অ্যান আনফল্টারিং মিউসিক্যাল সেন্স" তাঁর এই কবিতাটিতে - The Negro Speaks of Rivers - কালো মানুষের লড়াইয়ের কথা রয়েছে, তাঁদের দাসত্বের গ্লোরিফিকেসান দিয়ে নয়, তাঁদের সংগ্রামের ছবি দিয়ে নয়, সে এক ইতিহাসের কথা বলে। অনুবাদের ক্ষমার্হ চেষ্টা করেছি

Langston Hughes
The Negro Speaks of Rivers

I have known rivers
I have known rivers ancient as the world and older than the
flow of human blood in human veins

My soul has grown deep like the rivers

I bathed in the Euphrates when dawns were young
I built my hut near the Congo and it lulled me to sleep
I looked upon the Nile and raised the Pyramids above it,
I heard the singing of Mississippi when Abe Lincoln
went down to New Orleans, and I have seen its muddy
bosom turn all golden in the sunset.

I have known rivers
Ancient dusky rivers

My soul has grown deep like the river


কালো মানুষের নদীর কথা

আমি নদীর আখ্যান জানি
বয়স্ক পৃথিবীর অতি-বৃদ্ধা সমস্ত নদীদের চিনি
মানুষের শিরা-উপশিরা জুড়ে আজন্ম বয়ে যাওয়া তাদের রক্তের চেয়ে
পৌরানিক নদীদের কথা অধিগত হয়ে আছে এই চেতনায়

আমার আত্মন ওই নদীদের মত গভীরের দিকে চলে গেছে

অনাদী অতীতের সেই তরুন প্রত্যূষে আমি ইউফ্রেটিশের জলে সিনান সেরেছি
কঙ্গোর উঠোনে গড়া পর্ণ কুটিরে আমি
পয়স্বিনীর কাছে ঘুম পাড়ানিয়া শুনে ঘুমিয়ে গিয়েছি কতবার
নীল নদ আর তাঁর অববাহিকায় আমি নজর পেতেছি বলে
উঁচু পিরামিড গুলো আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে
যে সময়ে এব লিঙ্কন হেঁটে গিয়েছিল নিউ অরলিন্সের দিকে
মিসসিসিপি গান গেয়েছিল আমি শুনতে পেয়েছি
আমি দেখেছি সেদিন তাঁর কর্দমাক্ত বুক
বিকেলের আলোয় সোনালী হয়ে গেছে

আমি নদীর আখ্যান জানি
জানি সব পৌরানিক ধূসর নদীর কথা

আমার আত্মন ওই নদীদের গভীরের গহীন ছুয়েছে


Langston Hughes (অনুবাদ)

God in his infinite wisdom
Did not make me very bright
So when my action are stupid
they hardly take him by surprise!

ওয়াকিবহাল ঈশ্বরের অনন্ত অভিজ্ঞতা
গড়েন নি আমাকে খুব বুদ্ধিদীপ্ত করে
তাই বলদকে গো বোধে ব্যাপৃত দেখেও
তিনি আদৌ বিস্মিত হন না কখনও!