২৯ জানু, ২০১৪

কাশীনাথ গুঁই

0 কমেন্টস্
আমাদের দু’ চার কথা : জানুয়ারী ২০১৪




ইংরাজি নতুন বছর হলেও স্বাধীনোত্তর ভারতে আজও এই পঞ্জিকাই আমাদের জীবন-নিয়ন্ত্রক। নানা আয়োজনে হই হই করেই সে এল। এল অনেক অঘটন অনটন সাথী করেই। বিগত বছরের শেষ দিনেই আরেক নারকীয় নারিনিগ্রহ। প্রশাসনের দুয়ারে ক্লান্ত আর্জির পরে বাসা বদল করেও মুক্তি পেলনা এক নারী – লালসার দহনের পরে, আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারল ওরা নারীকে – সারা বিশ্ব দেখল ধর্ষিতার আধপোড়া মরদেহ নিয়ে পুলিশ ও রাজিনীতির দড়ি টানাটানি।

লজ্জা দিয়েই শুরু হলেও থামেনি বর্ষবরনের হুল্লোর,চরিভাতি, শরীরী আকর্ষনের নগ্ন প্রতিযোগিতার হাতছানিও। এত বর্বরতা, এত লজ্জার ঘনঘটা তবুও কেউ গেয়ে উঠছে – ভোগে-উল্লাসেই জীবনের তৃপ্তি,যারা জীবনের মূল্যবোধে বিশ্বাস করে তারাই নাকি কষ্ট পায়, যারা সমালোচনা করে তারা জীবন হারায়। আজকের কৃষ্টি হারানো আধুনিকতা ডেকে আনছে অসভ্য বর্বরতা - আবার অতি আধুনিকতায় ডেকে আনা অঘটন নিজের বাড়ীতে ঘটলেই দোষ সমাজের। নিজেদের শোধরানোর বদলে দোষারোপ করেই মেটানো যাবে না এই অবক্ষয়। বাঁচো আর বাঁচতে দাও এই আপ্তবাক্য ভুলে গেলে জঙ্গলের পথেই এগোতে হবে একথা বোঝনোর দায় চিরকাল নিয়েছে কলমচিরাই।

এখানে আমরা সকলে তাই কলমের মুখে যেন তুলে আনতে পারি অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে হুংকার,সচেতন করতে পারি আত্মভোলা সবুজের দলকে,পাথেয় দিতে পারি পথভোলাদের। এই আশা নিয়েই ‘প্রেরনা’ র এবারের ডালি। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় পরিবারের সকলের সাহায্য পাব এই আশা রাখি।



কাশীনাথ গুঁই।
প্রেরণা অনলাইন সম্পাদক মণ্ডলীর পক্ষে।

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

0 কমেন্টস্
অতিথি সম্পাদকের কলম



প্রেরণা গ্রুপে কোন এক অখ্যাত কবির কবিতার দুটি পংক্তি পড়েছিলাম -

‘বাতায়ন খুলে দেখতে চাই
একটি নতুন পৃথিবীকে’ –

নতুন পৃথিবীকে দেখতে চাওয়ার আকুতিই আমাদের তাবৎ সৃজন কর্মের প্রেরনা । আমাদের চারপাশের পৃথিবীটা, প্রতি দিন – প্রতি মুহুর্তে পালটে যাচ্ছে, নব থেকে নবতর হয়ে চলেছে আর আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিন্দুবিন্দু সৃষ্টিও সেই কাঙ্খিত নতুনতর পৃথীবীর নির্মাণের উপাদান হয়ে থাকছে ।

আমরা জানি মুদ্রিত ছোট পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিনগুলি বাংলা সাহিত্য সৃজনের গর্ভগৃহ হয়ে ঊঠেছিল, অনেক বিদগ্ধ সাহিত্যব্যক্তিত্ব উঠে এসেছেন তাদের হাত ধরে । এখনও লিটল ম্যাগাজিনগুলি সেই দায় পালন করে চলেছেন নীষ্ঠার সঙ্গে – ব্যয়বাহুল্য জনিত বিপন্নতা সত্তেও । একুশ শতকে সমান্তরাল ভাবে প্রযুক্তির হাত ধরে একই দায় বহন করে চলেছে ওয়েব পত্রিকাগুলি, যাদেরই একজন ‘প্রেরণা অন লাইন’ । নবীন প্রজন্মের সৃজনশীলতার প্রেরণা হয়েই থাকতে চায় সে । বাংলা সাহিত্যের বৈভব, তার সৃষ্টিপ্রাচুর্য ও বৈচিত্র সম্পর্কে নতুন কিছু কথা সংযোজন করার প্রয়োজন নেই । ‘প্রেরনা’ শুধু নিশ্চিতভাবেই গৌরবান্বিত বোধ করবে যদি বাংলা সাহিত্যের সেই বৈভবে কণামাত্রও তার যোগদান থাকে ।

শীতের বিদায়ে ঋতুচক্রের শেষ ঋতু বসন্তের আগমনধ্বনি স্পষ্ট হচ্ছে । আর বসন্ত মানেইতো সৃষ্টির নব নব দিগন্তের উন্মোচন । গত সংখ্যায় এক নবীন কবি তার কবিতায় একটি পংক্তিতে যেন আগাম আহবান জানিয়েছিলেন ‘সুরেলা বসন্তে সৃষ্টির উল্লাসে মাতো’ । আমিও সেই পংক্তিটির প্রতিধ্বনিই আবার উচ্চারণ করি – সৃষ্টি হোক অফুরন্ত, নবনব সৃষ্টির উল্লাস বাংলা সাহিত্যাকাশে স্থায়ী চিহ্ন রেখে যাক ।

- ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

শ্রেয়সী

0 কমেন্টস্
স্বাধীনতা'র স্বাদহীনতা
শ্রেয়সী



মাটির কোলে কিম্বা সাদা পাতায়
স্বাধীনতার রঙ আঁকে ওরা।
খুচরোর অবয়বে খোঁজে স্বাধীনতার ঠিকানা ।
ধুলোর শরীরে লেগে থাকে সন্ধ্যাতারার গন্ধ।
ওদের দিন শুরু হয় নিয়ম মাফিক শিশুশ্রমের কবিতায়।
তবু ওরা খিদে বিক্রির অবসরে এঁকে যায়
একটা, দুটো, অজস্র স্বাধীনতা।


ওদের ক্লান্তির তিনরঙায়,
আমাদের তিলোত্তমা হয়ে ওঠে স্বাধীন, গর্বিত জননী ।
খিদের নিশানা ওড়ায় পার্লামেন্ট ।
লাল-সবুজ আবীরে রঙিন হয় শহর।
হাওয়ার কানে কানে ভেসে আসে প্রতিশ্রুতিরা।
আর স্থানীয় অমুকবাবু, তমুকবাবু'রা
স্বাধীনতার মঞ্চে অমূল্য ভাষনের পর
ওদের হাত থেকেই তুলে নেন গরম চায়ের গ্লাস।


তবু ওরা স্বাধীনতা খোঁজে – ধুলো আকা পৃথিবীর বুকে,
সস্তার ডাংগুলি'তে, চুরি করে পাওয়া দু-একটা সময় আবর্তে।
স্বাধীনতা খোজে অবিরাম।
আর আমার স্বাধীন দেশের অলিতে, গলিতে
ডানা মেলে মানবিকতা তথা গণতন্ত্রের বিলাসী ধ্বজা ।
আক্ষরিক অর্থেই আমরা স্বাধীন। 
 

অশোক মজুমদার

0 কমেন্টস্
ভাত
অশোক মজুমদার



ভাত ...যদিও না রয় পেটে ,

চালিয়ে যাবো ভাষণ চেটে,

তোমার পতাকা তলে-

তুমিও আমায় টিকিয়ে রেখো

ভাত না জুটুক উড়তে থেকো,

নির্বাচনের মোহ তে কৌশলে।

দেবী রায় মুখার্জী

0 কমেন্টস্
নেতাজী
দেবী রায় মুখার্জী



নেতা হতে সবাই ব্যস্ত
শুধু চাই হাত ভর্তি স্বার্থ
আর -
পকেট ভর্তি টাকা
রক্তের বিনিময়ে তারা ফেরায় না
আমজনতাকে উপহার দেয়/ কলঙ্ক ধর্ষণ হত্যা ...

###########

ফিরে এসোনা নেতাজী
চলে যাও দূর/ বহূদূর .....
তেইশ ফিরে আসে প্রতি মাসে
জানুয়ারীও আসে প্রতি বছর
জানি ফিরবেনা আঠারোশ' সাতানব্বই…
যেমন ফিরবেনা তুমি....

সেলিম উদ্দিন মণ্ডল

0 কমেন্টস্
আমার তেরাঙ্গা
সেলিম উদ্দিন মণ্ডল



সমস্ত খুদেরাই হেঁটে যায়!
শীতের জানালায়(সকালের) শুধু পরিচিত অবলা শব্দেরা ঘোরেফেরে,
পাতা কান পাশবালিশ চিনে দেশলাই খামে
গভীর রাত্রিযাপন করে ফুলওয়ালা ফুল বেচে,
ফুল কিনতে যায়,
আমার তেরাঙ্গা উড়তে থেকে কচিদের চকলেট-বিস্কুটে ।
কুড়ি অনায়াসেই আশি হয় কোলের খোকা হয় কুড়িতে ।
আমার তেরাঙ্গা বয়সের ভার বয়
তবুও উড়তে থেকে কচিদের চকলেট-বিস্কুটে।

সুদীপ্তা

0 কমেন্টস্
২৩ অথবা ২৬ এর জানুয়ারী
সুদীপ্তা



এখন সন্ধ্যাকাল প্রদীপ জ্বলেনি গৃহস্থ কুটীরে
ষোলো আনা হিসেব নিয়ে ব্যক্তিগত যে যার আঙ্গিকে
ধীরে ধীরে শহরের ডানায় ঢাকছে গ্রাম ...
"আজ তেইশ কিংবা ছাব্বিশ মানেই"
হঠাৎ পাওয়া ওম জড়ানো শেষ বেলার ঘুম
ওদিকে গুমরে গলছে মোমবাতির দুনিয়া ...
তবুও এভাবেই পাখী জীবনের আড়ালে পাল তোলে তেরঙ্গা
উদ্বাস্তু কড়ায় ফোটে বিন্নি ধানের খই
শীতের মরশুমে অফুরান ভাঙতে থাকে পাপড়ি ঝরা স্কুল মাঠের রোদ্দুর ...
সুদূর সীমানায় এক সুরে বেজে ওঠে বিগিউল ...


শ্রীশুভ্র

0 কমেন্টস্
স্বাধীনতার অষ্টপ্রহর
শ্রীশুভ্র



বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারতের পথচলা সাতদশক অতিক্রমের পথে! মধ্যবর্তী সময়ে নানান ঘটনার ঘনঘটার ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষ আধুনিক যুগে পা রেখে দাঁড়িয়ে! কিন্তু প্রশ্ন জাগে আমরা ভারতীয়রা কতটা আধুনিক হতে পেরেছি? পেরেছি কি স্বাধীনতার মর্য্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে? পেরেছি কি আধুনিক উন্নত বিশ্বের সমগোত্র হয়ে উঠতে! বিশ্বসভায় তাদের সাথে একাসনে বসতে? পরিসংখ্যানতত্ব অনুযায়ী হয়ত পারিনি! কিন্তু ভেবে দেখার সময় এসেছে না পারার মূল কারণগুলি ঠিক কি কি? বিশেষ করে এই একই সময়সীমায় চীনের তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত প্রভূত উন্নতি! যুদ্ধ বিদ্ধস্ত জাপানের বিস্ময়কর ঘুরে দাঁড়ানো! প্রভৃতি বিষয়গুলি আমাদের যথেষ্ট অস্বস্তি দেয় না কি?

স্বাধীনতার স্বরূপ ও বিকাশ সকল দেশেই একভাবে সম্ভব হয় না! হয়ওনি! অন্তত ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই সেটা অনুধাবন করা অসম্ভব নয়! কিন্তু তবু ভারতবর্ষের মতো সুপ্রাচীন এবং উন্নত সভ্যতার একটি দেশ সম্বন্ধে আশার মাত্রাটি তীব্র হওয়ারই কথা! বিশেষ করে ভারতবর্ষ এবং চীনের প্রাচীনত্বের ঐতিহাসিকতা প্রায় সমান্তরাল যেখানে! আর ঠিক এই জায়গাতেই অনুসন্ধান করা প্রয়োজন কোন কোন বিষয়ে আমাদের দূর্বলতা রয়ে গিয়েছে আজও! যে যে বিষয়গুলি আমাদের কাম্য সমৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রবলভাবে! দূর্ভাগ্যের বিষয় ভোট সর্বস্ব রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে আমাদের অবস্থা হয়েছে, থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোরের মতোই!

বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট, এটি একটি দেশ নয়! অনেক দেশের সমাহার! বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার শাসন ও শোষনের সুবিধার্থে ভারতবর্ষকে একটি শাসনতন্ত্রে বেঁধে ছিল! এই যে এত বিভিন্ন জাতি সংস্কৃতি ভাষা সমন্বিত এতগুলি দেশ মিলে ভারতবর্ষ, তাকে একটি সাধারণ শাসনতন্ত্রের অধীনে একটি দেশের রূপ দিলে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় জাতীয়তাবাদী স্বরূপটি ঠিকমতো গড়ে উঠতেই পারে না! বিশ্বে কোনো কালেই এমন নজীর নেই কোথাও! ফলে সবাই যে যার আখের গুছিয়ে নিতেই ব্যস্ত! যে কোনো দেশ একজাতি এক সংস্কৃতি এক ভাষা না হলে, তার কোনো জাতীয়তাবাদী দেশীয় চরিত্র গড়ে ওঠে না! এটাই ভারতবর্ষের মূল প্রতিবন্ধকতা!

জাতীয়তাবোধের এই উৎসরণ ব্যাতীত স্বাধীনতার সুফল দেশের সর্ব শ্রেণীর জনগণের জন্য সুনিশ্চিত করা যায় না! যেতে পারে না! বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশগুলির উন্নয়ণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বাজাতির প্রতি প্রীতি ও ভালোবাসাই দেশীয় উন্নতির ভিত্তি সরূপ! আর সেই স্বাজাত্য প্রেমই পারে গোটা জাতিকে এক সূত্রে বেঁধে রাখতে! ঠিক এইখানেই পিছিয়ে পড়েছে ভারতবর্ষ! এতগুলি স্বতন্ত্র জাতি তাদের স্বাতন্ত্রতা অতিক্রম করে ভারতীয় জাতীয়তার মোহ কল্পনায় ঐক্যবদ্ধ হবে, সে নেহাতই কষ্টকল্পনা! স্বভাবতঃই তা হয়ওনি! আর সেই একতাবোধের অভাবেই ভারতীয় জাতিসমূহে দূর্নীতির প্রাদুর্ভাব! দুঃখের বিষয়, এই সরল সত্যটি আমরা আজও বুঝি না!

স্বাধীনতার পর গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে এই যে দূর্নীতির ব্যাপক বিকাশ তার মূলে এই কারণগুলিই মূল নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে! একদিকে দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অন্যদিকে এক শ্রেনীর বিত্তশালীর হাতে দেশের সম্পদের উপর একচ্ছত্র অধিকার! আর সেই অধিকার চর্চার জন্যই সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা! দেশের সার্বিক বিকাশের পক্ষে যা প্রধান অন্তরায়! ফলে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সহ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি আজও সুরক্ষিত নয়! আজও প্রতিটি ভারতীয়র শিক্ষার অধিকার, সুস্বাস্থের অধিকার, জীবিকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সুরক্ষিত নয়! সামাজিক সুরক্ষার ধারণা এদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি! গড়ে ওঠেনি নাগরিক দায়িত্ব ও কর্ত্তব্যবোধের সুনিশ্চিত ধারণাও!

মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির পাশা খেলা স্বাধীন ভারতবর্ষের মূখ্য চরিত্র! যেহেতু কোনো জাতীয়তাবাদী চরিত্র গড়ে ওঠেনি স্বাধীন ভারতের পরিসরে, তাই রাজনৈতিক দলগুলির অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধ করার মতো উপযুক্ত শক্তি গড়ে উঠতে পারে না দেশের মর্মমূল থেকে! এটাই গ্রেট ইণ্ডিয়ান ট্র্যাজেডী! এবং এখানেই ভারতবর্ষের প্রধান দূর্বলতা! রাজনৈতিক দলগুলিকে হাত করে দেশীয় সম্পদের উপর বৈদেশিক স্বার্থের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা ঠিক এই কারণেই সহজ! বস্তুত বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদের ধূয়ো তুলে এই কাজটিই বর্তমানে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেচে! উন্নততর ভারতের নকল ফেস্টুনের আড়ালে!

ফলত স্বাধীন ভারতের প্রজাতন্ত্রদিবস যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল দেশের আপামর জনসাধারণের মনে, তা যে আজও অধরাই রয়ে যাবে, সে তো কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়! এটাই ঘটার ছিল! কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি করব? ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে এই অন্ধকার ভারতবর্ষই কি উপহার দিয়ে যাব? না কি আমাদের নাগরিক কর্ত্তব্য বোধের মানবিক তাগিদে, অন্ধকারের উৎসের দূর্বলতাগুলি দূর করে আমাদের সাধ্যমত আলো প্রজ্জ্বলনের প্রয়াসে সামিল হব যৌথ উদ্যোগের ঐক্যসূত্রে! সামাজিক পরিসর থেকে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সকল স্তরে এই বোধ সম্ভূত আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ না নিলে, ইতিহাস হয়তো আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না কোনোদিনই!

শ্রেয়াসী কুণ্ডু

0 কমেন্টস্
প্রজাতন্ত্র দিবসের কিছু কথা কিছু অঙ্গীকার
শ্রেয়াসী কুণ্ডু



“ভারত আমার ভারতবর্ষ/ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো/ তোমাতে আমরা লভিয়া জনম/ ধন্য হয়েছি ধন্য গো”। আমাদের দেশমাতৃকা, ভারতবর্ষ। যার “শুভ নামে জাগে” আমাদের মন, প্রাণ, অন্তরাত্মা! আমাদের প্রতিটা শিরা ধমণীতে যার মাটির গন্ধে মাতাল হয় বহমান প্রতিটা রক্তবিন্দু। প্রতিটা হৃদস্পন্দন হে দেশমাতৃকা “গাহে তব গয়গাথা”। “পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাত মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ” পেরিয়ে ব্রিহত্তর বিশ্বে আজ আমাদের ভারতবর্ষের জয়গান অনুরনিত হয়। ভারতীয় সংবিধান হল ভারতে প্রণীত বৃহত্তর আইন প্রনয়ন সমষ্ঠি। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হওয়ার পর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান কার্যকরী হয়। উল্লেখ্য, ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণার স্মৃতিতে ২৬ জানুয়ারি তারিখটি সংবিধান প্রবর্তনের জন্য গৃহীত হয়েছিল। সংবিধানে ভারতীয় রাজ্যসংঘকে একটি সার্বভৌম,সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষণা করা হয়েছে; এই দেশের নাগরিকবৃন্দের জন্য ন্যায়বিচার, সাম্য ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা হয়েছে এবং জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য নাগরিকদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃভাব জাগরিত করে তোলার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। "সমাজতান্ত্রিক", "ধর্মনিরপেক্ষ" ও "সংহতি" এবং সকল নাগরিকের মধ্যে "ভ্রাতৃভাব" – এই শব্দগুলি ১৯৭৬ সালে একটি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।সংবিধান প্রবর্তনের স্মৃতিতে ভারতীয়রা প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি তারিখটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে উদযাপন করেন। ভারতের সংবিধান বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধানে মোট ২৪টি অংশে ৪৪৮টি ধারা, ১২টি তফসিল এবং ১১৩টি সংশোধনী বিদ্যমান। যার মুখবন্ধ হল, “WE, THE PEOPLE OF INDIA, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN SOCIALIST SECULAR DEMOCRATIC REPUBLIC and to secure to all its citizens: JUSTICE, social, economic and political; LIBERTY, of thought, expression, belief, faith and worship; EQUALITY of status and of opportunity; and to promote among them all FRATERNITY assuring the dignity of the individual and the unity and integrity of the Nation; IN OUR CONSTITUENT ASSEMBLY this twenty-sixth day of November, 1949,DO HEREBY ADOPT, ENACT AND GIVE TO OURSELVES THIS CONSTITUTION.” সর্বতভাবে নিজেকে দেশের হিতার্থে সমর্পণ করাই একজন দায়ীত্ববাণ নাগরিকের প্রধান নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য। সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁদের, বিন্দু বিন্দু রক্ত, ঘাম, সময়ের বলিদানে আজ এই সময়ের ভারতকে আমরা চাক্ষুষ করতে পারছি তাঁদের আত্মবলিদানকে স্মরণে রেখে দেশের স্বার্থে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এক সুশ্তহ স্বাভাবিক ভবিসগয়ত উপহার দেওয়ার স্বার্থে সমস্থ সাংবিধানিক, নৈতিক, সামাজিক কর্তব্য পালন করব এমনটাই স্বাপাথ গ্রহণ করতে আআজ এক আগুনে হাত রাখব আমরা! জয় হিন্দ!

মৌ দাশগুপ্ত

1 কমেন্টস্
প্রজাতন্ত্র দিবস ও কিছু ভাবনা
মৌ দাশগুপ্ত



বিগত ২৬শে জানুয়ারী সারা ভারতে ৬৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হল। প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে রাজধানী দিল্লী সহ সারা ভারত জুড়েই নানা রকম জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল,যেমনটি প্রতিবার হয় আর কি। তারপর, আরও কিছু কমন ফ্যক্টরও যথাবিহিত মর্য্যাদা সহকারে পুনঃপ্রদর্শিত হল, যেমন,সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ সহ নানা ধরনের সামরিক যন্ত্রপাতি সর্ব সাধারনের জানার জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শিত হল, আমরা জানলাম আমাদের সামরিক শক্তি কতটা, আমাদের বিভিন্ন স্কুলের বাচ্চারা প্রজাতন্ত্র কতটা বোঝে এবং নাচগান করে অন্যকেও বোঝানোর চেষ্টা করে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকাল আবার 'হ্যাপী রিপাব্লিক ডে' বলে শুভেচ্ছা জাননোটাও সভ্যজনের এটিকেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে ঢেলে বিকোচ্ছে 'হ্যাপী রিপাব্লিক ডে' গ্রীটিংস কার্ড। স্বাধীনতা দিবসের মত বছরের এইদিনেও সারা ভারতের সরকারী অফিস-আদালত, জেলখানা থেকে পাগলাগারদ সব জায়গাতেই একটা খুশির আমেজ দেখা যায়। ব্যক্তিগত উদ্দোগ্যে ভাল খাবার-দাবার,কখনো সখনো নতুন পুরানো জামাকাপড়, শীতবস্ত্র পরিবেশন করা হয় অনাথাশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম, কিছু হাসপাতাল, অর্থনৈতিক অনগ্রসর মহল্লায়। সুবেশা মহিলারা সেজে-গুজে অমুকবাবু তমুকবাবুর সাথে হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দান-ধ্যান করেন ও মিডিয়াকে জানান দেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ চমকায়। পরেরদিন খবরের কাগজ জানায় ২৬শে জানুয়ারীতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত ‘যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৬৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করেছে’ এবং এই উপলক্ষ্যে ‘সারা ভারতে এক অপরিসীম আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে’।

রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করা হলেও ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কাশ্মীরে। বেশকিছু আঞ্চলিক গোষ্ঠী এই দিনটাকে 'প্রজাতন্ত্র দিবস' মানতে চায় না, তাদের ন্যায্য বা অন্যায্য দাবীদাওয়া সরকারীভাবে মানা না হলে তারা 'প্রজাতন্ত্র দিবস' উদযাপন বয়কট করে এবং এইভাবে চেষ্টা করে তাদের দাবী বাস্তবায়ন করার। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ও কাশ্মীরে ২০টির বেশি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন’ স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন করে যাচ্ছে। এ কারণে তারা প্রতিবছরই স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবসে সব ধরনের সরকারি কর্মসূচি বয়কটের ঘোষণা করে, এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

তা সে উৎসব জিনিষটাই এমন। ইচ্ছা হলে আনন্দ করে অংশ নাও নয়ত মুখগোমড়া করে নিজের মনে নিজে থাকো। নো প্রবলেম। ছোটবেলা থেকেই জানি প্রজাতন্ত্র দিবস মানেই একটা গোটা ছুটীর দিন।ইচ্ছামত চলার দিন, পিকনিক , থিয়েটার,কি সিনেমা দেখার দিন,তাছাড়াও আছে পাড়ার মোড়ে, স্কুলের মাঠে, তেরঙ্গা পতাকা তোলার ভীড়ে দাড়াঁলেই একটা কমলা,দুটো লজেন্স, কি একমুঠো বোঁদে,সাথে ফ্রী ভাষণ। অঘোষিত স্বঘোষিত এবং ঘোষিত নেতা নেত্রীদের খুচরো ভাষণ, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা আজাদি-র ভাবসম্প্রসারন,নেতাজী, গান্ধী, জহরলালের ছবিতে টাটকা ফুলের মালা।প্রভাত ফেরী, বাচ্চাদের মুখোশ নাটক,বসে আঁকো প্রতিযোগীতা, বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, পথনাটিকা। খবরের কাগজের বিশেষ ক্রোড়পত্র, বাচ্চাদের হাতে তিনরঙ্গা ফেস্টুন,বাবা- কাকার শার্টে সেফটিপিনে আটকানো কাগজের তেরঙ্গা,প্রজাতন্ত্র দিবস মানেই মাইকে বা টিভিতে তারস্বরে দেশভক্তির গান বা সিনেমা ,এছাড়াও আছে লালকেল্লার সরকারী অনুষ্ঠান, সামরিক বা বেসামরিক কুচকাওয়াজ, স্কুল বা বিভিন্ন ক্লাব প্রতিষ্ঠানের তরফে প্যারেড। আমার কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দেয়, সেটা হল, একদিন মাইক বাজিয়ে আর প্যারেড করে কি সত্যিই প্রজাতন্ত্র উদযাপন করা যায়? আরে বাবা নাচাগানা তো শোনপুর মেলাতেও হয়, অমুকবাবু তমুকবাবু হাতে মাইক পেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও রক্ত গরম করা ভাষণ দিয়ে পাশ ফিরে নাক ডাকাতে পারেন,তারজন্য ‘প্রজাতন্ত্র’দিবসে’র বাহানাটা খুব জরুরী কি?

'জনগণমন' ইস্কুল থেকে শুনতে শুনতে মনের ওপর এমন ঘূণধরা এফেক্ট করেছে যে এখন গানটা বাজলে আমাদের মধ্যে কতজন হাতের কাজ ফেলে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ার সৌজন্যটুকু দেখান সেটাও প্রদীপ হাতে খুঁজে দেখতে হয়।বন্দেমাতরম গানটাই বা আজকাল আমাদের মনে কতোটা এফেক্ট করে? ছোটবেলায় রেডিওতে যে বন্দেমাতরম-র সুর শুনে বড় হয়েছি তার থেকে এ.আর.রহমানের 'মা তুঝে সালাম' –এর বন্দেমাতরমের সুর আজকের প্রজন্মকে বেশি আবেগাপ্লুত করে না কি? বিতর্কিত বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু আরো বিতর্কিত বিষয় হল, প্রজাতন্ত্র বাপারটা কি? খায় না মাথায় দেয়?দেশ প্রজাতান্ত্রিক হলে প্রজা থুড়ি দেশবাসীর টা লেজ গজায় এই সব কূট প্রশ্নের উত্তর পাই কোথায়? ...লেট করে ঘুম থেকে উঠে টিভিতে দেশাত্মবোধক সিনেমা বা ‘ডান্স ইন্ডিয়া ডান্স’,কি ‘সারেগামাপা’র রিপাব্লিক ডে স্পেশাল দেখা, পাড়ার মোড়ে, ক্লাবে, ইস্কুলে কর্নবিদারী মাইকে সোচ্চারে বাছাবাছা কিছু গানের রিপিটেশন শোনার (ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়ে) মত পাড়াতুতো দেশপ্রেমের ইনফ্লুয়েন্সে পা মিলানো ছাড়া বিশেষ কী করছে আপামর ভারতের জ ন সা ধা র ণ ? আম জনতা? পাতাকা উত্তোলন? লজেন্স বোঁদে জিলিপি বিলি? পিকনিক? পিকেটিং? গেট-টুগেদার? জমাটি মজলিস? ছুটীর দিনের আড্ডা? দুপুরে মাংসভাত শেষে জমাটি দিবানিদ্রা? পতাকা তুলে জাতীয় সঙ্গীত? নতুন জেনারেশানের মধ্যে দেশাত্ববোধ জাগে এই উপায়ে? জানি না। ঠিক যেমন জানি না ইতিহাস বইয়ের পাতা ছাড়া সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আর কোথায় আছে?

এখন এই প্রজাতন্ত্র জিনিষটা ঠিক কি? খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে পড়েছি বটে, কিন্তু সম্যক ধারনা নেই। একটু দেখা যাক। প্রথমেই সর্বজ্ঞানের ভান্ডার গুগল কি বলে দেখা যাক। “একটি প্রজাতন্ত্র হল এমন একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে জনগণ বা জনগণের একাংশ। ইংরেজি ভাষায় "প্রজাতন্ত্র" শব্দের প্রতিশব্দ "republic" এসেছে লাতিন শব্দবন্ধ res publica শব্দবন্ধটি থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ "জনগণ-সংক্রান্ত একটি বিষয়"।“ সাধারণত রাজশক্তি-বিহীন রাষ্ট্রকেই প্রজাতন্ত্র বলা হয়।ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত ভারত ‘হিন্দুস্তান’ (ভারত) ও ‘পাকিস্তান’ (বর্তমান বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল) এই দুই সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান প্রণীত হয় এবং এটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই থেকে দিনটি আমাদের দেশের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।প্রজাতন্ত্র দিবস, মানে যে দিন ভারত এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণ করেছিল স্বাধীনতা লাভের পর তার প্রথম সংবিধান, তার মানে ভারতীয় সংবিধানের জন্মতিথিই হল ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। যাক এতটুকু তো ক্লিয়ার হল, কিন্তু এরপর?


সংবিধান কি? এই প্রসঙ্গে নিজের কথা না লিখে কবীর সুমনের একটা উদ্ধৃতি দিই।

“সংবিধান? নীতিমালার সেই কাঠামো যা এক রাজনৈতিক রাষ্ট্রের বনিয়াদ? নাকি ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, পশ্চিম ভারতের সেই ‘অস্পৃশ্য’ (বন্ধু, এই দেশে জন্মে তুমি আমি এই ‘শব্দটি’ জেনেছি, আমাদের সংবিধান চেয়েছে তা মুছে দিতে, কিন্তু…) জাতির মানুষটি, যিনি ছেলেবেলায় ‘উঁচু জাতির’ হিন্দু সহপাঠীদের মুখে-হাতে লাঞ্ছিত হতেন, যিনি বরোদার গায়াকওয়াড়ের দেওয়া বৃত্তি পেয়ে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন, যিনি বরোদা পাবলিক সার্ভিসে যোগ দিয়ে আবার সেই ‘উঁচু জাতির’ হিন্দু সহকর্মীদের মুখে-হাতে লাঞ্ছিত হয়ে ওকালতি ও শিক্ষকতায় যান, যিনি দলিতদের নেতা হয়ে ওঠেন, ১৯৪৭-এ হয়ে ওঠেন ভারত সরকারের আইনমন্ত্রী, যিনি ভারতের সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন (যে সংবিধানে ‘অস্পৃশ্যদের’ বিরুদ্ধে বৈষম্য আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু…) যিনি তার পর বিরক্ত হয়ে ইস্তফা দেন, সংবিধানে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও সমাজের প্রাত্যহিকতায় দলিতদের বিরুদ্ধে বৈষম্য যে আগের মতোই চলেছে এটা দেখে যিনি ১৯৫৬ সালে দুই লক্ষ দলিত অনুগামীকে নিয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন? এই দীর্ঘ বাক্যটি পড়ে তুমি কি ক্লান্ত, বন্ধু? আমরা কেউ কেউ, কি তার চেয়েও ঢের বেশি ক্লান্ত নই সংবিধানে যা যা লেখা আছে, বাস্তবে অনেক সময় তার উল্টোটাই দেখে দেখে?
আমাদের দেশের মতো এত উদার সংবিধান কটা দেশের আছে? এর নীতিমালার একটি ভগ্নাংশও যদি ফলিয়ে দেওয়া যেত, বন্ধু? আহা, জানি, তুমি কী বলতে চাও। সেই নীতিমালার পরিসরেই তো আইন প্রণয়ন হচ্ছে। সব মানুষ সমান। শিক্ষার অধিকার সকলেরই আছে। সব নবজাতকের আছে বাঁচার অধিকার। এ-সংবিধান এ-দেশের সকলের জন্য সুবিচার, স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্ব কায়েম করতে চায়।

(কবীর সুমন - সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ১৫ মাঘ ১৪১২ রবিবার ২৯ জানুয়ারি ২০০৬)

কোনো দেশের একটি হলো ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক সত্তা এবং আরেকটি হলো রাজনৈতিক অবস্থা। যে ভূখণ্ডে আজকের ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠিত, সেই ভুখন্ডটি হাজার হাজার বছর ধরে ভৌগোলিকভাবে গঠিত হয়েছে। তারপর সেখানে গড়ে উঠেছে জনবসতি। এটি হলো প্রাকৃতিক ভারতবর্ষ। তা আগেও ছিল, ১৯৪৭-এর পরও ছিল এবং থাকবে আরও হাজার হাজার বছর—যদি পৃথিবী থাকে। কিন্তু এক নতুন রাজনৈতিক ভারতের , সার্বভৌমিক প্রজাতান্ত্রিক ভারতের, এবং এক নতুন ভারতীয় জনসত্ত্বার জন্ম হয় ২৬শে জানুয়ারী ১৯৫০ সালে। ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। সেটাকে বলা হয় ক্ষমতা হস্তান্তর। ব্রিটিশরা চলে গেল, ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা দিয়ে গেল। শাসনক্ষমতা পাওয়া মানেই দেশটি রিপাবলিক হওয়া নয়। ভারতকে ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে ঘোষণা করে শাসনতন্ত্র গৃহীত হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। সেই শাসনতন্ত্র কার্যকর হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। সেটা ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়। শুধু একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, পতাকা ও সরকার থাকলেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হয় না। তার একটি নিজস্ব সংবিধান বা সর্বোচ্চ আইন থাকা অপরিহার্য। ওই সর্বোচ্চ আইনের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়—কারও ইচ্ছামতো নয়, কোনো দেশের বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নির্দেশমতোও নয়। একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও সংবিধান অবিচ্ছেদ্য।

আজ সুবিধাবাদ হয়ে উঠেছে জাতীয় বৈশিষ্ট্য, সুবিধাবাদ পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। “গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র ও বান্ধবতন্ত্রের এমনই লীলা। না, না, সংবিধানে এ সব লেখা নেই। আছে রং-বিধানে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে লিখতে পেরেছিলেন— ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে।’ গণতন্ত্রে কি আর ‘সবার রঙ’ বলে কিছু থাকতে পারে? এক এক পক্ষের, দলের এক এক রং। সুকুমার রায়ের জবান একটু বদলে দিয়ে বলা যায়:’ রঙের আমি রঙের তুমি রঙ দিয়ে যায় চেনা’। রঙে রঙে রঙাক্কার, রঙে রঙে ঠোকাঠুকি, ধাক্কাধাক্কি, রঙের ওপর রঙের টেক্কা, পাঁচ বছর ধরে এ রঙের শাসন বা ‘রংবাজি’ এবং অন্য রংগুলির আপত্তি বা পাল্টা রংবাজি, পাঁচ বছর পর আবার রঙে রঙে লড়াই, গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় এ রং ও রঙের প্রচার, চুপচাপ কোনও একটি বিশেষ রঙে ছাপ, পরে ছাপ গোনা, যোগ-বিয়োগ করে জেতা-রং নির্ণয়, আবার পাঁচ বছর। সংসদীয় রাজনীতির বা রংনীতির এই হল মূল গল্প।“ যে কথা আমাদের পূর্বপ্রজন্মের স্বাধীনতাকামীদের কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি।

রাজধানী দিল্লী হোক কি প্রত্যন্ত কামদুনী বা মধ্যমগ্রাম), ধনিকশ্রেনী আর পুঁজিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্তন করবে, বিদেশী (পড়ুন, বিদেশিনী) শক্তি চালনা করবে দেশ, দেশীয় নেতারা অভিনয়কেই রাজনীতির পাশা করে নিজের কোলে ঝোল টানবেন, অশিক্ষা, অপুষ্টি, অরাজকতা দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে তা-ও তাঁদের ধারণায় ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকেই প্রতিটি সরকার তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তার লক্ষ্যে, কিছু ভোট বেশি পাওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সুবিধাবাদের দিকে ধাবিত করছে। ব্যক্তিগত সততা ও মেধা হয়ে পড়ছে মূল্যহীন। একটি শক্তিশালী জাতি গঠনের পথে যা হিমালয়ের মতো বাধা। এসব করে আমরা স্বাধীনতার, গনতন্ত্রের, প্রজাতন্ত্রের স্বপ্নটাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছি।আদতে, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি যে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, আজ তা ‘গুটিকয়তন্ত্র’: রাষ্ট্র জনগণের নয়, অল্প কয়েকজনের।


তবু ঐ যে কথায় বলে না ‘আশায় মরে চাষা’, আমাদেরও সেই হাল, সবই জানি, বুঝি, অনুভব করি, তবু বছরের পর বছর ‘কলুর বলদের’ মত ঠুলিপরা চোখে একই বৃত্তাকার পথে ঘুরে চলেছি,সেই নির্বাচন, সেই প্রহসন, সেই একই ট্রাডিশনের পুনরাবৃত্তি, সেই একই ভাবে আরেকটু ভালোর আশায় থাকা, আরেকটু জাতীয় স্বাচ্ছ্বন্দ্যকে অনুভব করতে চাওয়া। বাঙ্গালী/ গুজরাটি/ বিহারী / ওড়িয়া প্রাদেশিকতা বা হিন্দু / ক্রিশ্চান/ মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভেদ ভুলে ‘চক দে ইন্ডিয়া’র মত অন্তত একবার নিজেকে ‘শুধু ভারতীয়’ ভাবা । প্রারম্ভিকভাবে এটাই না হয় আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসের চাহিদা হোক। তাতেই বা মন্দ কি?


জাতীয় ফুলটা হাতে চটকালেও সম্প্রীতির গন্ধ আর বের হয় না ,
সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক ভারত’ শব্দটা রয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।
পতাকার ভাঁজে দামিনীদের চিৎকার ,নারীমাংসভোজীর উল্লাস,
কন্যাভ্রূন বিসর্জনের আর সতীদাহের নিদারুন কাহিনী,
জাতপাত,ভোটযুদ্ধে বা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে নিহতদের রক্তের দাগ ,
সীমান্ত বা সীমান্তের ভেতরে উর্দিপরা,উর্দিছাড়া দেশপ্রেমিকদের বলিদানের গল্প,
সব বুকে বয়েও আকাশে সগৌরবে উড়ছে জাতীয় পতাকা।
দিনের শুরুতে স্বচ্ছ নীল আকাশের বুকে উদীয়মান সূর্য লাল রং ছড়াচ্ছে,
সেই লাল রঙ সর্বাঙ্গে মেখেও কিন্তু আমাদের জাতীয় পতাকা তেরঙ্গাই আছে।‘

ভালো থাকুন সবাই, ভালো রাখুন, কাব্যলক্ষ্মীর সংস্পর্শে আনন্দে থাকুন।আপনাদের সবাইকে আমার শুভ আত্মসমালোচনা দিবসের শুভেচ্ছা।।

সুদীপ নাথ

0 কমেন্টস্
শিশুর কৈশোরে উত্তরণ ও আমাদের কর্তব্য
সুদীপ নাথ



শিশুর দুর্বলতার প্রতি কঠোর, যুক্তিনিষ্ঠ, খুঁতখুঁতে, সংযমী এবং অসহিষ্ণু হওয়া যতই কঠিন হোক না কেন, তা শিশুত জন্যেই সবচেয়ে আগে প্রয়োজনীয়। বাহ্যিক সংযম এবং নীতিনিষ্ঠতার আড়ালে আন্তরিকতা বজায় রেখে চলা, পূর্ণ যুক্তিনিষ্ঠতা এবং কঠোরতার আড়ালে স্নেহপূর্ণ এবং সাগ্রহ মনোযোগ প্রদান, শিশুর মানবীয় দুর্বলতাগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ এবং সেইসব দুর্বলতাগুলো থেকে তাদের মুক্তিলাভের কার্যকরি সহায়তা প্রদান- ঠিক এইভাবেই মা-বাবাদের নিজেদের শিক্ষামূলক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তি গড়া উচিত। তার কোন বিকল্প আছে কিনা, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। অনেককেই এবিষয়ে শিশুদের প্রতি অবিচার নিয়েও প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। তারা বলে থাকেন যে, এসব অবিচার নাকি আসলে কঠোরতারই নামান্তর, এইসব নাকি শিশুর মনকে শক্ত করে তুলে। আমি কিন্তু এখানে একটা প্রশন তুলবই যে, এসমস্ত সত্যিই শিশুর মনকে শক্ত করে তুলে কিনা। কারণ, শিশুরা সবসময় দুর্বল, বড়দের দাপট এবং ঔদ্ধত্যের সামনে তারা সবসমই অসহায়। বড়রা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই নিষ্ঠুর হয়ে উঠেন বরাবর। দায়িত্বহীনতা প্রয়শই নিষ্ঠূরতার জন্ম দেয়। শিশুদের প্রতি অবিচার খুবই মারাত্মক বিষয়। এসব তাদের কোমল মনকে গভীরভাবে আহত করে এবং তার নৈতিক অনুভুতিকে ক্রমশ বিকৃত করে তুলে। তার ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না। তবে অধিকাংশ ছেলে-মেয়েই বেশ ভালোভাবেই এসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। ঠিকমত পড়াশুনা করে, বাড়ীতে ও স্কুলে ভালো আচরণ করে, পরিশ্রমী হয়। অথচ এমনটিই দেখা যায়, প্রাইমারি স্কুলের সময়ে, যারা বেশ বাধ্য, তারাই কৈশোরে আমাদের জ্বালিয়ে মারে। তখন পরিবর্তনগুলো চোখে পরার মত। কিশোর বয়েসের এইসব আচার আচরণের জন্যে, আমাদের আগাম প্রস্তুতি না থাকলে, পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়। এবার দেখা যাক, আসলে এই সংকটগুলোর সময়ে ঠিক কি কি ঘটে। তখন সবচেয়ে আগে তার সাবালকত্ব আসে। এখন সে আর মাত্র বয়েসের দিক থেকেই বড় হয়নি, সে এখন বড় হয়েছে আত্মিক এবং শারীরিক দিক থেকেও। এই সময়ে, অনেক ছোটবেলার কিছুদিন ধরে চলা একগুঁয়েমি, স্বেচ্ছাচারিতা, আত্মনির্ভরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা আর আত্মনির্ভরতার অবিরাম প্রয়াসের নূতন করে আবির্ভাব ঘটে। তবে এসব শুরু হয় খুবই জটিল ভাবে। এখন তার আত্ম-বিশ্লেষণ খুব তাড়াতাড়িই ঘটে যায়, মা-বাবা ও অন্যদের দিকে সমালোচনামূলক মূল্যায়নের ঝোঁক বাড়ে। কারও প্রতি সে তার মূল্যায়ন ঘন ঘন পরিবর্তিত করে। তার কোন বন্ধু তাকে সাহায্যের হাত বাড়ালে, সে হয়ে উঠে তার কাছে খুব ভাল। কয়েকদিন পর, ঝগড়া বাধলেই বলে দেবে তাকে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না, সে আমার আসল বন্ধু নয়। কোন ছেলে-মেয়েই এই বয়েসে, পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা (contradictory comments) পছন্দ করেনা। তাই মা-বাবাদেরও কম খোঁটা খেতে হয়না। কখনো হয়ত, কোন কথা দিয়েও কথা রাখলেন না, তখনও খোঁটা শুনায়। শিক্ষকদেরও সমালোচনা করতে ছাড়েনা। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের সমালোচনা করে। প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সমালোচনা করে বা তাদের সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে। মনে রাখতে হবে, এসব কিন্তু মামুলি ব্যাপার নয়, বা যুক্তিহীন বিদ্বেষ থেকে আসা বা খেলাচ্ছলে সমালোচনা নয়। সে তখন জীবনকে নূতন ভাবে দেখতে শিখছে, সে অশান্ত ভাবে সমস্ত বিষয়ে তার মনের মত অনুকরণ যোগ্য প্রকৃত বীরকে খুঁজে চলেছে, যা এতোদিন ধরে তাকে সব্বাই মিলে শেখানো হয়েছে। কারণ সে মানুষের মত মানুষ হতে চায়। সে এখন সেই উন্মাদনায় ভুগছে। কিশোর-কিশোরীদের অবাধ্যতাকে অসৎসঙ্গের ফলাফল হিসেবে দেখা অনুচিত। অথবা ক্রমানুবতির লক্ষণ বা শিক্ষিত করে তুলতে না পারার ব্যর্থতা হিসেবেও মনে করা উচিত নয়। ভুলে গেলে চলবেনা, এই সময়েও অনেক বিষয়েই তারা বালকোচিত ধ্যানধারণা নিয়েও চালিত হয়, নাহলে একে আমরা উত্তরণ হিসেবে আখ্যায়িত করতাম না। অনেক সময় কেউ কাওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে আনদ পায়, আর এথেকে অনেক সময় ঘটে যায় দুর্ঘটনা। আবার ছেলেরা মদ খেয়ে ফেলে, আর পরিণামে শুরু হয় মারপিট। ঘরের কাজের জিনিস নষ্ট করে ফেলে। এমন ঘটনাও আকছার ঘটে। এসব ঘটনায় আমরা যেসব যুক্তি খাড়া করি, তা “এমন হবে আগে ভাবতেও পারিনি” বা “আমি তো এমন আশা করিনি” ধরণের। ছেলে-মেয়েরা এই বয়েসে এসবের পরিণাম সম্পর্কে বড়োদের সাবধান বানীগুলোকে অতি বিমূর্ত কোন ব্যাপার বলেই মনে করে। তারা ভাবে যে, এসব ব্যাক্তিগতভাবে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তারা একটা কথাই ভাবে, তা হল, “মা বাবা জানলে রক্ষে নেই”। আর কিছুই তারা ভাবেনা। তারা তাদের আত্মমর্যাদাবোধের জন্যেই এসব কাজ করে ফেলে। অন্য সব পরিণাম তাদের কাছে তুচ্ছ বলেই তারা মনে করে। কিশোর-কিশোরীরা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক বিষয়-আশয় এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আগ্রহী হয়। তাদের বিশ্বানুভুতি সবেমাত্র গড়ে উঠেছে। তাই তারা শৃঙ্খলা ছাড়াই একসাথে অনেক বিষয়ে মেতে উঠতে পারে। এই সমস্ত আগ্রহে ভবিষ্যতের কোন লক্ষ্য প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে।তাতে মজা লাগে- ব্যাস, এইটুকুই। কিশোর-কিশোরীদের মারাত্মকভাবে আকৃষ্ট করে সাবালক জীবনের বাহ্যিক বিষয়গুলো। যেমন, পোষাক-পরিচ্ছদ, চুলের স্টাইল, আঁতর, শ্যাম্পু, মদ, ধূমপান, খইনী, দ্রুত বাইকে চড়া এসব। উপরন্তু তারা তখনও মানবীয় সম্পর্কগুলোও ভালোভাবে চেনেই না। বড়রা যেসব নিয়ম ও বাঁধাধরা নিষেধ মেনে চলেন, তার অনেকগুলোই তাদের কাছে আজগুবি, একঘেয়ে আর অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এসব আচরণ, এমনকি তাদের ছোটোখাটো ব্যাপারেও প্রকাশ পায়। যেমন, সবাইকে নমস্কার করতে বাঁধে। তারা শুধু তাদেরই নমস্কার করতে চায়, যাদের ভালো লাগে। সাবালক জীবনের বাহ্যিক দিকগুলো অনুকরণ করা দিয়েই শুরু হয় তাদের সাবালকত্ব এবং তা সবার ক্ষেত্রেই। আর আত্মনির্ভরতার জন্যে প্রয়াস পর্যবসিত হয় অসংখ্য ভ্রম আর ভুল বোঝাবুঝিতে। এই ধরণের বেশিরভাগ ভুলভ্রান্তি অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সমাজবিরোধী ব্যাপার বলে কখনও বিবেচনা করা উচিত নয়। তবে এইসব ক্রিয়াকলাপের যথাযোগ্য মূল্য দেয়া আক্ষরিক অর্থেই প্রয়োজন। কিশোর-কিশোরী কবে নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে, সাহসিকতা ও ধৃষ্টতা আর স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ফারাক বুঝতে পেরে যাবে, সেই আশায় চুপচাপ বসে থাকলে, মারাত্মক ভুল হবে। এমতাবস্থায় আমাদের কী করণীয় ? একদিকে বলপ্রয়োগ করাও যেমন অনুচিত, ঠিক তেমনি চুপচাপ বসে বসে নিরীক্ষণ করেও চলা যায়না। প্রশ্নটি সত্যি সত্যিই খুব জটিল। আসুন এবার আসল স্থানে দৃষ্টিপাত করা যাক। আগে ছেলেমেয়েদের বলা হত- “এটা করা করা উচিত নয়”। কিন্তু এখন ঠিক এই কথাটিই বলা হয় বেশির ভাগ মা-বাবাদের ক্ষেত্রে। শিশু থেকে বালক, বালক থেকে তারা যখন কৈশোরে পা দেয়, তখন এইসব সঙ্কটজনক পর্বে অনেকেই বলে থাকেন, তাহলে কি তার অর্থ এই যে, তারা মাথায় চড়ে বসবে ? তা নিশ্চয়ই নয়। তবে শিক্ষার উদ্দেশ্য কিন্তু সবসময় দমিয়ে রাখা এবং বাধা-নিষেধের মাধ্যমে নাজেহাল করে তোলা নয়। শিক্ষাদীক্ষার আসল এবং সর্বোপরি উদ্দেশ্যই হচ্ছে, চরিত্রের প্রাথমিক প্রবণতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। এই সংকটজনক পর্বই হচ্ছে আসল সময়। এটাই ঠিক সেই সন্ধিক্ষণ, যার পরেই শুরু হবে, এই শিক্ষা পেয়ে, ভবিষ্যৎ বিকাশের প্রকৃত পথটাকে চিনে নেয়া। আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বজ্ঞা তথা নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি কিন্তু, পুরোপুরিভাবে কিশোর-কিশোরীদের পক্ষকে সমর্থন করতে চাইছি না। তাছাড়া এখানে সমস্ত কিছুই স্বজ্ঞায় নয়। বহু মা-বাবার প্রধান শিক্ষাগত ত্রুটি হচ্ছে এই যে, তারা তাদের সন্তানদের উপর নিজেদের অভিজ্ঞতা লব্ধ এবং মানবজাতির এযাবৎ অর্জিত জ্ঞানের ফলাফল চাপিয়ে দিতে অনবরত চেষ্ঠা করে করেন। কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকে প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রেই, নিজের অভিজ্ঞতার সমস্তকিছুই উপলব্ধি করার অদম্য বাসনা থাকে। সেই জন্যেই প্রস্তুত (readymade) সত্যকে সে গ্রহন করে অনিচ্ছায়, নিস্ক্রিয় ভাবে। এই গ্রহন কার্যকরি effective) হবে কতটুকু, তার প্রশ্ন থেকেই যায়। এসবের দ্বারা সে অনুপ্রাণিত হয় না। তাই দেখা যায়, আমাদের বহু বাধানিষেধ আর হিতোপদেশে কান দিলেও, তাদের নিজে নিজে জানার প্রলোভন থেকেই যায়। তবে আসল কথা হচ্ছে, ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে সক্রিয় কাজকর্মের মধ্য দিয়েই। নিয়ম মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে তা গড়ে উঠে না। তা’ই হচ্ছে তাদের বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটা ভালো করে আমাদের বোঝা উচিত। সে জন্যেই বাস্তবিক ক্ষেত্রে, প্রায়শই তারা মা-বাবার বাধা-নিষেধ অমান্য করে। সাধারণত তা হয় গোপনে, ক্বচিৎ প্রকাশ্যে। গোপনে এসব অমান্য করলেও, পরে অবিশ্যি সবকিছুই খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেবার সাহস দেখায়, এমন কি সবার সামনে পর্যন্ত। কিশোর বয়েসের বৈশিষ্ঠই হচ্ছে এই যে, তখন অনেক নিয়ম লঙ্ঘন করা হয় খোলাখুলিভাবে এমন কি সবার সামনে। তাদের উদারতা, স্বনির্ভরতা ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা পাওয়া উচিত সমস্ত শৈশব কাল ধরেই। কিন্তু কেবল পিতা-মাতা আর শিক্ষকদের উপদেশ স্মরণ রাখার মধ্য দিয়ে তা শেখা যায়না, আত্মস্থ করা যায়না। সর্বাগ্রে পরিবারের দৈনন্দিন জীবনই শিশুর মধ্যে এই গুণগুলো গড়ে তুলে। উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতার অনুভূতি যদি বিকশিত না হয়, তাহলে আত্মনির্ভরতা অর্জনের প্রয়াস সহজেই দ্বায়িত্বহীন বিদ্রোহ আর অর্থহীন হামলার আকার ধারণ করতে পারে, এমন চিত্র প্রায়শই চোখে পরে। এসব কারণেই অনেক ছেলেমেয়ে ঘর ছেড়ে পালায়। কৈশোরে উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতা শেখানো কি সম্ভব ? তখন কি দেরি হয়ে যায় না ? হামেশাই মা-বাবারা এমন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন। না, তখন একেবারেই দেরি হয়ে যায় না। কারণ, মানুষ উদারতার চাহিদা অনুভব করে সারা জীবন ধরেই। আর ন্যায়পরায়ণতা হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শক্তি এবং যুক্তি। এবং যেহেতু তারা এই শক্তিকে শ্রদ্ধা করে এবং পরস্পর-বিরোধীতা (self contradiction) ভালোবাসে না, তাই। তবে আসল কথা হচ্ছে, এই ন্যায়পরায়ণতা অবশ্যই বোধগম্য হয়া উচিত। আর এই ন্যায়পরায়ণতাকে একেবারে সহজ এবং সরল করে তুলেই, তাদের সামনে হাজির করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের জটিল হয়ে ঊঠা তাদের বিশ্বানুভুতি ও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই, মা-বাবা-শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও নিজেদের যুক্তিজালটি বিস্তৃত করেই তোলা উচিত। নাহলে পরিস্থিতি ক্রমশই আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে। সবকিছুই কথার কথাই থেকে যাবে। তাই আবারো বলতে চাই, ছেলেমেয়েদের দুর্বলতার প্রতি কঠোর, যুক্তিনিষ্ঠ, খুঁতখুঁতে, সংযমী এবং অসহিষ্ণু হওয়া যতই কঠিন হোক না কেন, তা তাদের স্বার্থেই সবচেয়ে আগে প্রয়োজনীয়।

রিয়া

0 কমেন্টস্
ভাষাসন্ধান (দ্বিতীয় পর্ব)
রিয়া




আমরা জানি মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম স্তরের কালসীমা ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত। এই প্রথম স্তরের মধ্যে ভারতীয় আর্য ভাষা হল অশোকের শিলালিপির প্রাকৃত। তাছাড়া এই সময়ে অন্যান্য ভাষাগুলি হল প্রত্নলিপির ভাষা, হীনযান পন্থী বৌদ্ধদের ব্যবহৃত মিশ্র সংস্কৃত বা বৌদ্ধ সংস্কৃত বা পালি ভাষা।শিলালিপির প্রাকৃত ছিল জনসাধারনের মুখের জীবন্ত ভাষা। প্রথম স্তরের প্রাকৃত ভাষার আঞ্চলিক রূপ বা উপাদানগুলি হলঃ-

১/ উত্তর পশ্চিমা ২/ দক্ষিন পশ্চিমা ৩/ প্রাচ্য মধ্যমা ৪/ প্রাচ্য।

১/ উত্তর পশ্চিমা= এই প্রাকৃতের নিদর্শন পাওয়া যায় পশ্চিম পাকিস্থানে প্রাপ্ত অশোকের শাহ্ বাজ্ গঢ়ী ও মান্ সেহ্ রা অনুশাসনে।

যেমনঃ- " অয়ং ধ্রমদিপি দেবন প্রিঅস রঞো লিখপিতু হিদ নো কিচি জিবে অরভিতু প্রযুহোতবে নো পি চ সমাজ কটব। বহুক হি দোষং সমজস দেবন প্রিয় প্রিঅদ্রশি রয় দখতি।" _____ শাহ্ বাজ্ গঢ়ী শিলালিপি-১।

সংস্কৃত রুপান্তর :- ইয়ং ধর্মলিপিঃ দেবানাং প্রিয়েণ রাজ্ঞো লেখিতা। ইহ ন কশ্চিৎ জীবঃ আলভ্য প্রহোতব্যঃ। ন অপি চ সমাজঃ কর্তব্য। বহুকান্ হি দোষান্ সমাজস্য দেবোপ্রিয়ঃ প্রিয়দর্শী রাজা পশ্যতি।

বাংলা রুপান্তর :- এই ধর্মলিপি দেবতাদের প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা কতৃক খোদাই করা হয়েছে। এখানে কোন প্রাণীকে বলি দেওয়া উচিৎ নয়, কিংবা কোন উৎসব উপলক্ষে ভিড় করাও উচিৎ নয়। কারন দেবতাদের প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা এই রকমের সামাজিক উৎসবে অনেক দোষ দেখতে পান।


২/ দক্ষিন পশ্চিমা= এই প্রাকৃতের পরিবর্তন হয়েছিলো সবচেয়ে কম। তার ফলে এই প্রাকৃতটি সবচেয়ে প্রাচীনতাধর্মী, প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বৈদিকের উত্তরাধিকার এতে সবচেয়ে বেশী। গুজরাতের জুনাগড়ে প্রাপ্ত গীর্ণার অনুশাসনে এই প্রাকৃতের নিদর্শন পাওয়া যায়।

যেমন :- " ইয়ং ধংমলিপী দেবানং প্রিয়েন প্রিয়দসিনা রাঞা লেখাপিতা। ইধ ন কিংচি জীবং আরাভিৎপা প্রজূহিতব্যং। ন চ সমাজো কতব্যো। বহুক হি দোসং সমাজম্ হি পসতি দেবানাং প্রিয়ো প্রিয়দসি রাজা।।" _____ গীর্ণার শিলালিপি-১।

( সংস্কৃত ও বাংলা অনুবাদ ১/ এর অনুরুপ)



৩/ মধ্য প্রাচ্যা= এই প্রাকৃতের নিদর্শন পাওয়া গেছে মুসৌরি থেকে ষোল মাইল দূরে কালসি গ্রামে প্রাপ্ত অশোকের একটি অনুশাসনে এবং দিল্লিতে প্রাপ্ত অন্য তোপরা অনুশাসনে।

যেমন :- " ইয়ং ধংমলিপি দেবানাং পিয়েনা পিয়দসিনা লেখিতা হিদা নো কিছি জিবে আলভীতু পজোহিতবিয়ে নো পি চা সমাজে কটবিয়ে। বহুকা হি দোসা সমাজসা দেবানাং পিয়ে পিয়দসি লাজা দখতি"। _____কালসী শিলালিপি-১। (সংস্কৃত ও বাংলা অনুবাদ ১/ এর অনুরুপ)



৪/ প্রাচ্যা= এই প্রাকৃতের নিদর্শন রয়েছে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের কছে ধৌলি গ্রামে প্রাপ্ত অনুশাসনে এবং গঞ্জাম থেকে আঠেরো মাইল দূরে জৌগড়ে প্রাপ্ত অনুশাসনে। প্রাচ্যা-মধ্যা ও প্রাচ্যার ভৌগলিক নৈকট্যের জন্য এই দুটো প্রাকৃতের মধ্যে সামঞ্জস্য খুব বেশী।

যেমন :- " ইয়ং ধংম লিপী খেপিংগলির পবতসি দেবানাং পিয়েন পিয়দসিনা লাজিনা লিখাপিতা। হিদ নো কিছি জীবং আলভিতু পজোহিতবিয়ে নো পি চ সমাজে কটবিয়ে। বহুকং হি দোসং সমাজসি দখতি দেবানাং পিয়ে পিয়দসী লাজা"। ____ জৌগড় শিলালিপী-১।

(সংস্কৃত ও বাংলা অনুবাদ ১/ এর অনুরুপ)



কিছু মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক।



পালি ভাষাঃ- পালি বলতে এখন সাধারণত প্রথম স্তরের একটি মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাকে বুঝায়।কিন্তু এই ভাষা কোথা থেকে সৃষ্টি হল আর কেমন করেই বা এটি বর্তমান অর্থের বাহক হয়ে গেলো এটা নিশ্চিত করা কঠিন। কেউ কেউ বলেন পাল ধাতু অর্থাৎ পালন করা থেকে পালি শব্দের উৎপত্তি। ভগবান বুদ্ধের বাণী এই ভাষা ধারন ও পালন করে চলেছে বলে একে পালি বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন পল্লী শব্দ থেকে পালি শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থগত সঙ্গতিও আছে বলে মনে করা হয়, কারন ভারতে ওই সময় বৃহত্তর জনজীবনই ছিল মুলত পল্লীবাসী।আর এদের মধ্যেই বুদ্ধের বাণী প্রচারের জন্য পালি ভাষার মাধ্যমটি গৃহীত হয়েছিলো। 'পালি' ভাষার নামটির উৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। কেউ বলেন যে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের কাছে উদয় গিরি পাহাড়ের হাতিগুম্ফা নামক গুহার ভিতরে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর রাজা খারবেলের যে অনুশাসন পাওয়া গেছে সেই ভাষার সাথে পালি ভাষার বিশেষ মিল পাওয়া যায়। এর ওপর ভিত্তি করে জার্মান পণ্ডিত ওল্ডেনবার্গ ও মূল্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে উড়িষ্যার আঞ্চলিক ভাষার ওপর ভিত্তি করে পালি ভাষার সৃষ্টি, অর্থাৎ উড়িষ্যাই হল পালি ভাষার আদি জন্মস্থান। অনেকে আবার পালি ভাষাকে মাগধীরই একটি রূপ মনে করেন। পরবরতী কালে পালি ভাষার প্রচলন শুধুমাত্র দক্ষিন ভারতের হীনযান বৌদ্ধদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছিল। তবু এই ভাষার জন্ম কিন্তু হয়েছিলো উত্তর ভারতেই এটা স্পষ্ট। পালি ভাষার কাল সীমা হল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত, তবুও এই ভাষার অঙ্কুরোদগম থেকে পরিণতি পর্যন্ত ধরলে ব্যাপক অর্থে পালি ভাষার বিস্তার কাল হল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত।

পালি ভাষার নিদর্শন :- "ন পরেসং বিলোমানি ন পরেসং কতাকতং। অত্তনো ব অবেকখেয্য কতানি অকতানি চ।।"

অর্থাৎ :- পরের দোষ দেখবে না, পরের কর্তব্য- অকর্তব্য বিচার করবে না। নিজেরই কর্তব্য- অকর্তব্য বা নিজের কৃত ও অকৃত কর্ম বিচার করে দেখবে।

বৌদ্ধ বা মিশ্র সংস্কৃতঃ- আমরা জানি বৌদ্ধধর্মের মূল গ্রন্থ ত্রিপিটক পালি ভাষাতেই রচিত।এবং বৌদ্ধবেদের জন্মস্থান উত্তরাপথেই তবুও পরবরতীকালে উত্তরাপথের মহাযানী বৌদ্ধরা তাদের আলোচনায় পালি ভাষা ব্যাবহার করতেন না।তারা তাদের গ্রন্থ রচনায় সংস্কৃত ও প্রাকৃতের এক মিশ্রনে তৈরি এক কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা ব্যাবহার করতেন। এই ভাষাই হল বৌদ্ধ সংস্কৃত বা মিশ্রসংস্কৃত। এই ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় 'মহাবস্তু অবদান' সময় কাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী। 'ললিত বিস্তার' সময়কাল খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী, 'দিব্যাবদান' ও 'অবদানশতক' সময়কাল খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দী প্রভৃতি রচনায়।এই ভাষার ব্যাবহার অবশ্য কুষাণ রাজাদের অনুশাসনেও পাওয়া যায়।

নিয়া প্রাকৃতঃ- চিনের অন্তর্গত তুর্কীস্থানে শানশান রাজ্যের প্রান্তে নিয়া নামক অঞ্চলে খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা কিছু প্রত্নলিপি পাওয়া গেছে। এগুলি অবশ্য ধর্ম বিষয়ক নয়,শাসনকার্য ও ব্যাবসা সংক্রান্ত। এগুলির ভাষাই নিয়া প্রাকৃত নামে পরিচিত। এই ভাষার সময় কাল ছিল খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত। ভারতের বাইরে পাওয়া গেলেও ভারতীয় আর্য ভাষার নিদর্শন হিসেবে এই ভাষা গ্রহন করার কারন হল উত্তর পশ্চিমা প্রাকৃতের কিছু উত্তরাধিকার এতে লক্ষ্য করা যায় এবং অনুমান করা হয় এই ভাষারও আদিভুমি ছিল উত্তর পশ্চিম ভারতের পেশোয়ার অঞ্চল।

মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতঃ- মাহারাস্ট্রী যদিয়ও মনে করা হয় শৌরোসেনীর পরবর্তী এবং কেউ কেউ মনে করেন শৌরোসেনী থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তখন মাহারাষ্ট্রীয়কেই আদর্শ ভাষার মর্যাদা দেওয়া হত। সংস্কৃত নাটকে এই ভাষার ব্যাপক বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। যেমন খৃস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত 'গাহাসত্তসঈ', খ্রিস্টীয় পঞ্চম- ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত প্রবর সেনের 'সেতুবন্ধ', খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী তে রচিত বাকপতি রাজের 'গউডবহো' এই সব পূর্ণাঙ্গ রচনায় ও এই ভাষার ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়।

মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত ভাষার নিদর্শন :- "উল্ললই দব্ ভকবলং মঈ পরিচ্চত্তণচ্চণা মোরী ওসরিঅ- পন্দ-বত্তা মুঅন্তি অংসূইং ব লঅও"। ________ অভিজ্ঞান শকুন্তল, চতুর্থঅঙ্ক,

অনুবাদঃ- মৃগী তার তৃণের গ্রাস উদ্গীরন করে দিচ্ছে, ময়ূর তার নৃত্য পরিত্যাগ করেছে, লতাগুলি থেকে পাণ্ডুবর্ণ পাতাগুলি খসে পড়ছে- যেন তারা অশ্রুবর্ষণ করছে।

শৌরসেনীঃ-শৌরসেনী প্রাকৃত হল সাহিত্যিক প্রাকৃত গুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং ভারতীয় আর্য ভাষার কাছাকাছি। সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান পশ্চিম ভারতের মধ্যদেশ ছিল এই প্রাকৃতেরও পীঠস্থান।মাহারাষ্ট্রী ছিল আদর্শ ভাষা কিন্তু এই ভাষার পরেই শৌরসেনীর সম্মানিত স্থান স্বীকৃত ছিল। সংস্কৃত নাটকে শিক্ষিত রমনী, রাজপুরুষ - কর্পূরমঞ্জরী নাটকের সংলাপে শৌরসেনী প্রাকৃত ব্যাবহার করা হয়। কেউ কেউ বলেন যে মাহারাষ্ট্রী ও শৌরসেনীর মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু এই দুই প্রাকৃতের মধ্যে কিছু গুরুত্ব পূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়।

যেমনঃ- " তক্ খনং সো মম পুত্ত- কিদও মঅ- সাবও উবখিদো। তদো তএ অঅং দাব পঢমং পিবদু ত্তি অনুকম্পিনা উবচ্ছন্দিদো। ন উণ দে অবরিচিদসস হত্থাদো উদঅং অবগদো পাদুং। পচ্ছা তসসিন জ্জেব উদএ মএ গহিদে কদো তেণ পণও। _______________________________ অভিজ্ঞান শকুন্তল, পঞ্চম অঙ্ক।

অর্থাৎঃ- সেই সময়ে আমার পালিত পুত্র হরিনশিশুটি সেখানে উপস্থিত হল। আপনার কাছে জলপান করবে ভেবে আপনি তাকে আদর করতে লাগলেন। কিন্তু আপনি তার অপরিচিত বলে সে আপনার হাত থেকে জলপান করতে চাইল না। তারপর আমি সেই জল নিজের হাতে নিয়ে এলে আমার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে লাগলো।

অর্ধমাগধীঃ- অর্ধমাগধীর নিদর্শন আমরা অশ্বঘোষের নাটকে পাই তবে বলা যেতে পারে অর্ধমাগধীর পূর্বরূপ প্রাচ্য মধমার নিদর্শন আছে ।ভাসের নাটকেও এই প্রাকৃতের প্রাচ্যরূপ দেখা যায়। কিন্তু আসল অর্ধমাগধীর সম্মানিত ক্ষেত্র হল জৈন ধর্ম সাহিত্য।অর্ধমাগধী যদিও পরবর্তী কালে জৈন সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠায় কোন ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি তবু এর উৎপত্তি প্রাকৃত প্রাচ্য মধ্যমার জন্মভুমি হল অযোধ্যা বা কোশল রাজ্যে।

যেমনঃ- " পোলাসপুরে নাম নয়রে সহস্ সম্বব উজ্জণে জিয়সত্তুরায়া। তথ্থণং পোলাসপুরে নয়রে সদ্দালপুত্তে নামং কুম্ভকারে অজীবিওবাসএ পরিবসই"।

অনুবাদঃ- পলাশপুর নামে এক নগরে সহস্রাম্রবন নামক বাগানে জিতশ্ত্রু রাজা ছিলেন। সেই পলাশপু নগরে শব্দাল নামে অজীবিক- সম্প্রদায়ভুক্ত অর্থাৎ ভিক্ষুক উপাসক এক কুম্ভকার বাস করতেন।

মাগধীঃ- মাগধীর নিদর্শন সংস্কৃত নাটকে অশিক্ষিত নিম্নশ্রেনীর চরিত্রের ভাষায় পাওয়া যায়।এই নামের সাথে মগধের দক্ষিন বিহারের যোগ আছে। যদিও মাগধী ছিল মূলত সাহিত্যেরই ভাষা এবং সাহিত্যে এর ব্যাবহার হত হাস্যরস সৃষ্টির জন্য তবুও মাগধী নামের মধ্যে মগধের অর্থাৎ দক্ষিন বিহারের কথ্য ভাষার একটা যোগ রয়েছে বলেই মনে করা হয়। সম্রাট অশোক নিজেকে মগধের ভাষায় বলেছেন, কালিদাস মাগধী ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখায়। মাগধী যেন মগধের গৌরবিণী এক রাজকন্যা। মাগধ শব্দটির অর্থ হল শ্রুতি পাঠক অর্থাৎ গায়ক। এই সব থেকে আমরা বুঝতে পারি যে মগধ ছিল এক গর্বিত ও সংস্কৃতিবাণ জাতিতে পূর্ণ।এই ভাষার প্রাচীনতম রূপের নিদর্শন রয়েছে সুতনুকা প্রত্নলিপিতে।

" ধীবরকঃ- (ভীতিনাটিকেতন) পশীদন্তু ভাবমিশশা। ণ হগে ঈদিশশশ অকয্যশশ কালকে। একঃ- কিং ণু ক্ খু শোহনে বম্ হণে শি ত্তি কদুঅ লঞ্ ঞা দে পলিগ্ গহে দিন্নে। ধীবরকঃ- শুণব দাব। হগে ক্ খু শক্কাবদালবাশী ধীবলে। ____________ অভিজ্ঞান শকুন্তল, চতু্র্থ অঙ্ক

অনুবাদঃ- ধীবর- (ভয়ের অভিনয় করে) মহাশয়েরা প্রসন্ন হোন। আমি এই রকম অকর্ম করিনি। একজনঃ- তবে তুই কি সদ্ ব্রাহ্মন যে তোকে রাজা এটা দান করেছেন? ধীবরঃ- আপনারা সব কথা শুনুন। আমি শক্রাবতার- বাসী ধীবর।

পৈশাচীঃ- সাহিত্যিক প্রাকৃতগুলির মধ্যে সাহিত্যিক নিদর্শনের সবথেকে দীন হল পৈশাচী প্রাকৃত। এই প্রাকৃতে রচিত অনেক গল্প কথার একটি সংকলন হল 'বৃহৎকথা' নামক গ্রন্থে। কিন্তু সেটি এখন বিলুপ্ত, তাঁর গল্প কাহিনী শুধু রাখা আছে সংস্কৃতের বিভিন্ন রচনায়। পৈশাচী প্রাকৃতের কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীন বৈয়াকরণ ও আলংকারিক দের রচনায় অ উদ্ধৃতিতে। তখন উত্তর- পশ্চিমার অর্থাৎ গান্ধার ছিল পৈশাচীর জন্মস্থান। কিন্তু পরবর্তী কালে মধ্যভারতেও এর প্রচলন ছিল।

এই প্রাকৃতের নিদর্শন হলঃ- " নচ্চন্তসস য লীলাপাতুক্ খেবেন কম্পিতা বসুধা- উচ্ছয়ন্তি সমুদ্দা সইলা নিপতন্তি তং হলং নমথ"। অনুবাদঃ- যার নৃত্য করার সময় চঞ্চল পদক্ষেপে পৃথিবী কম্পিত হয়, সমুদ্র উচ্ছ্বসিত হয়, পর্বত ধ্বসে পড়ে, সেই হলধর কে প্রণাম করো।
(পরবর্তী অংশ তৃতীয় অধ্যায়ে)

(কপিরাইট আইন অনুসারে রিয়া দাশগুপ্তা র রচিত এই লেখা বিনা অনুমতি তে কোথাও প্রকাশ আইনত দন্ডনীয়)

ইন্দ্রানী সরকার

0 কমেন্টস্
কলমকে লেখা চিঠি
ইন্দ্রানী সরকার



হে আমার আশ্চর্য কলম,
তোমাকে নিয়ে যখন সাদা পাতা
আখরে ভরিয়ে দিই, কি অদ্ভুত এক
প্রশান্তিতে মন ভরে যায় |

সমস্ত গ্লানি দূর হয়ে শুধু
গির্জার ঘন্টার মত পবিত্র অগণিত
মন্ত্রপূত কাহিনীর সৃষ্টি হয় |
মন বলে এই জন্যই ত' বাগ্দেবী
বর্ণমালার সৃষ্টি করেছেন |

যেমন করে মহাবৃক্ষে গুল্মরাজি
নিশিন্তি আশ্রয়ে বিরাজমান,
শুক্তি ও ঝিনুক সমুদ্রের আশ্রয়ে সুষুপ্ত,
সাদা মেঘ নীল আকাশে আনন্দচিত্তে ভাসমান,
তেমনি হে কলম, তোমার অনন্ত শক্তি
মনে দেয় আনন্দের সঙ্কুলান|

তন্ময় কর্ম্মকার

0 কমেন্টস্
অনুকবিতা
তন্ময় কর্ম্মকার



একথা সেকথার ফাঁকে,
তুমি ও বলে গেলে না
তুমি জীবিত না কি মৃত?
তোমাকে ভাবতে গেলেই
এক আকাশ মনখারাপ,
ছোটবেলা থেকে আজও।

সুরজিৎ চক্রবত্তী

0 কমেন্টস্
বেঁচে থাকা
সুরজিৎ চক্রবত্তী



আয়নার সামনে দাঁড়ালে
আজকাল কেমন পাথর পাথর লাগে
মোটা ঠোঁট, থ্যাবড়া নাক, ক্লান্ত চোখ,
অজস্র বলিরেখামুখ ভরা পাথর নাকি পাথরের মুখ।


অসহিষ্ণুরা জুটেছে একসাথে –
কাল মন্দির হবে পবিত্র স্থানে
আজ তাই প্রদিপের আগুনে আলু পোড়াচ্ছে
লাল, নীল, সবুজ আর অবিশ্বাসীদেরও,
এরপর শনি মঙ্গলবারের পুজা অথবা পিরের সিন্নি
কেমন পাথর পাথর লাগে।


দুটো খারাপের মধ্যে
কম খারাপটাকেই তো বেছেছিলাম আমি
কিন্তু খেলাটা হল বাইনারি মেথডে
একঘেয়ে ক্লান্তিহীন একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকের মত শূন্য
আর এক, এক আর শূন্যশূন্য আর এক, এক আর শূন্য............
কেমন পাথর পাথর লাগে।


দশটা মুখ থাকলে সহজ নিয়মে
কুড়িটা চোখতার কিছু বন্ধ আর কিছু অন্ধ,
লন্ডন তৈরির নব্বই ভাগ শেষখালি
কিছু বর্ষার বেয়াড়া জল ফুটপাত পেরিয়ে
খাটের উপর উঠে পড়তে চায়
চোখের কোনে জল আর জল জমতে জমতে পাথর।


রাস্তার মোড়ে মোড়ে নিয়নের বিজ্ঞাপণ,
টিভি ক্যামেরার দাপাদাপি নিভুর্ল জানাচ্ছে
নিরন্তর ভোট চুক্তির জন্য পেট চুক্তি
নেতারা বলেছেন “ দশ টাকায় ভরপেট খাওয়া যায় আজও ...... ”
নেতাদের মুখ ভরা পাথর।


কেউ যদি বলত মন খারাপ ভাবতাম মুড অফ্,
এক আকাশ তারা কে সাক্ষী
রেখে কতো নাজির উজির মেরেছি,
পূর্নিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি বলে মনে হয় নি কখনোআমার
শিরদাঁড়া দিয়ে কর্কটক্রান্তির ঋজুতা
“ ইনক্লাব জিন্দাবাদ, লেলিনের পথ ই আমার পথ ......... “


বর্ষার গা ঘেঁসে রদ্দুর দাঁড়িয়ে থাকে তখনও।
তোমাকে পাওয়ার জন্য ভাল হতে পারিনি
তোমাকে পাওয়ার পর ভাল হতে পারতাম
তোমার দেওয়া কথা গুলোও বিলিয়ে দিয়েছি বোবাদের মধ্যে ...


তারপর এল তুষার ঝরার দিন –
সাদা সাদা থোকা থোকা বরফে ঢেকে গেল
গাছপালা, ঘরবাড়ি সমেত আমার পুরো পৃথিবীটাই।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে
সেদিন প্রথম দেখলাম বরফ জমে জমে পাথর .....


সেই থেকে পাথর চোখ, পাথর নাক, পাথর ঠোঁঠ এমন কি ......
দিব্বি বেঁচে আছি আমি ।

জয় শমীক সেনগুপ্ত

0 কমেন্টস্
মাধুকরী বিদ্রোহ
জয় শমীক সেনগুপ্ত



ঠোঁটে ঠোঁট রেখে করে যাব বিদ্রোহ-
যদি শতায়ু হবার বরদান পেয়ে থাকি।
এখন ত মাধুকরী করি প্রেম;
অতলস্পর্শী শব্দ ছোঁয়া বাকি।
ছেঁড়াপাতা যত পেয়েছিল কিছু আলো!
তারাও দেখছি ভিড়ের চাপেতে
কোথায় হারিয়ে গেল?
সব কথা যদি বলে যেতে পারি তবে-
শরীর জুড়ে নিখাত সন্ধ্যা হবে।
তারপর হবে বিষ্ফোরনের গান,
পয়দল যাব আনাচে কানাচে
ঠোঁটে চোখে অভিমান।
একটা শতক সত্যি ভীষণ ছোট-
চিন্তার গতি ডানা পেয়েছিল বলে,
এখন আমরা নিত্য নতুন ভাবি।
তবু এই মুখ জড়তা আকঁড়ে চলে!
যদি নির্বাসিত হই,
তবে বিদ্রোহে কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ শুষে
আমিও নাম নেব রক্তগোলাপ।
বিপ্লবের চুমুর মাঝে পাপড়ি মেলে কত শত ফুল-
কত রঙ ফিকে হয়ে যায়,
সময় তার হিসেব রাখেনা।। 


জয়তী ভট্টাচার্য

0 কমেন্টস্
কিছু কথা থাক তবে না বলাই
জয়তী ভট্টাচার্য



সব কথা বলা হলে
কথা থেকে ব্যথা ঝরে যায়,
কিছু কথা না বলাই
থাক তবে হৃদয়ের আঁধার ছায়ায়
সব কথা নাই হল বলা ~

রয়ে যাক না বলাই কিছু কথা
জমে থাক অশ্রুবাষ্পটুকু,
মেঘ হয়ে ভেসে থাক,মনের আকাশে,
নাই হল ঝরে পড়া রিমঝিম,
একা বসে বয়ে যাক অভিমানী বেলা !!

অলভ্য ঘোষ

0 কমেন্টস্
বিড়ম্বনা
অলভ্য ঘোষ



চেতনার শিরা উপশিরা ;
খুঁজে ফেরে সেলুলয়েড হয়না রা ।
নিস্তব্ধে সিঁড়িটিতে পোড়ে শম্ভু মিত্র ।
বাইপাসের ধারে পাঁচ তাঁরা ঘরে-
অনেকেই পালটায় গোত্র ।
বামে ডানে হাসে ;
অ্যাকাডেমি টিবি রোগে কাশে ।
দাঁড়ি গোঁফ বাড়ে
প্রগতির ধরে ।
হয়তো বা লালবাতি সাইরেন ওলা
দেবে মালা ।
শুধু একরাশ ছাই উড়ন্ত বাতাসে
থাকবে না দৃঢ় গলা ।

সৌমিত্র চক্রবর্তী

0 কমেন্টস্
অপমৃত্যু
সৌমিত্র চক্রবর্তী



চোখ লাল হয়েছিল
নিঃশব্দে দুফোঁটা জল
নেমে এসেছিল দুই কোনে।
সমস্ত শরীরে প্রতি ইঞ্চি
নিজেরই কোষ মেতেছিল
অবাধ্য হুকুম অমান্যে,
কিন্তু আশ্চর্য মস্তিষ্ক তখনো
টালমাটাল হয়েও চলছিল
টিক টিক ঠিক ঠিক!
রক্তকণিকারা দল বেঁধে
উঠে আসছিল পায়ের পাতা
থেকে হাঁটু, উরু থেকে পেট।
পেটের অন্দরমহল কে
নাকি ম্যাজিক বক্স বলে!
আসল ম্যাজিক বক্স তো
লুকোনো সেই লাল মেরুন
পানপাতা বাক্সের গোপন
কোনায় সোনালি রেখাচিত্রে,
প্রত্যেক বল্লমের খোঁচার
মূহুর্ত পরেই সাদা দাগ
চিনচিনে ইলেকট্রিক শক
দেখতে দেখতে আঁকা হয়
সূর্যাস্ত রেখারঙে বিন্দু
টপ টপ টপ টপ।
বাজারী ক্রেতা বিক্রেতা
পুঞ্জনিবেশে রক্তের রং
বদলায় কখনো?
মস্তিষ্ক তখনো দিপ দিপ
হৃদয় তখনো বিপ বিপ
শুধু চেতনাই রাস্তা হারিয়ে
অন্ধকূপ হাতড়ে মরে।
বিদ্রোহ করেছে সবাই
হাত ঠোঁট চোখের কালোরং
যে মনি একদিন ভাসিয়েছিল
উচ্ছসিত কত না হাসি,
একসাথে এক হাম্বর আঘাতে
হঠাৎই অন্ধকার সর্বব্যাপী,
সঞ্চিত সব অভিমান নিয়ে
চুপ শান্ত নিথর নিঝ্ঝুম-
মস্তিষ্কে রাত্রি নেমে আসে।

অলক বিশ্বাস

0 কমেন্টস্
ইচ্ছে
অলক বিশ্বাস



তোমার ডাকে দাঁড়িয়ে বাঁকে
মাতাল হাওয়া বেলা
মেঘ যাচ্ছে নিরুদ্দেশে
বৃষ্টি অবেলা ।

ঘূর্ণিপাকে এদিক ওদিক
উদ্ভ্রান্ত খেয়া
কোথায় তুমি হৃদয় আমার
ইচ্ছে একটু ছোঁয়া !

আয় বৃষ্টি সাঁতার দেবো
ভিজছি চোখের জলে
স্বপ্ন ফুঁড়ে কন্যে ওগো
ডুববো স্থলে ।



হরিশঙ্কর রায়

0 কমেন্টস্
এক কবি,দুটি কবিতা
হরিশঙ্কর রায়



আত্মরঙ


বর্ণ, রূপ ভুলে খুঁজেছি
পরিমল
ভুল নাম ও ভুল ঠিকানায়
এসে জেনেছি,
যে সুর-তন্ত্রিতে বেজেছিল
কাটছাঁট করে ছুঁড়ে মারলাম
তিস্তার জলে--
তরঙ্গে তরঙ্গে ভেসে গেল।

জন্ম-জন্মান্তরের খেয়ায়
আমার রসায়ন, যোজন-বিয়োজন,
আমার অষ্টপ্রহর,
আমার যৌবন নির্বিকার।

অবশেষে--
শুদ্ধতম রঙে
গোধুলির ডাক
আমি, আমি ক্রিয়াহীন
ভুল বর্ণ-গোত্রে এপার-ওপার
জলের বর্ণ খুঁজি।


পরিযায়ী

হৃদ-গহীনে এসো,
দু'টো কথা বলো !
তারপর...
উড়ান সীমাহীন নীলে !

আমার সুখিত আঁখি
বাঁধিতে কি পারে !
তুমি পরিযায়ী পাখি
এক শীতে নয়,
বারবার এসো আমায় ভালোবেসে ।

সুমন কুমার সাহু

0 কমেন্টস্
কবিতায় তুমি
সুমন কুমার সাহু



কবিতা তোমাকে
জব্দ করেছি আমি
ছন্দ শিকলে বেঁধেছি
তোমার ই হৃদয় খানি ।

তুমি ছট পট করো
খুলতে বাঁধনের দড়ি
এ বাঁধন শব্দের বন্ধন
কেমনে পালাবে তুমি ।

তবু নিজেই কেন পালিয়ে বেড়াই
নীল নীলিমা অন্তরালে
অনুভুতি গুলো আসেনা আর
কেটে গেছে জীবনের ছন্দে ।

হ্যাঁ, আমি আজ ছন্দ হারিয়ে
ভাব লেশহীন
সব-ই তো দিয়েছি তোমায়
তুমি অমলিন ।

তোমায় বাঁধতে নিজেই হেরেছি
হয়েছি জব্দ অজান্তে
তুমি-ই তো রয়েছো সবার প্রানে
আমি আজ নির্বাসনে!



রাফসান জানী

0 কমেন্টস্
খুনসুটি
রাফসান জানী



বলেছি ভালোবাসি, শুনতে পারনি ?
কথামালার খুনসুটিতে সব।
আপন হয়েছি সে তো জানি,
শুধু এতোটুকু জানিয়ে দিও,
বিশ্বাস হৃদয়ের কতোটা জুড়ে।

গান শুনিয়েছি। কান পাতনি ?
মন বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছি শুধু তোমার জন্য।
ব্যাথার বেহালায় বাজা কথাগুলো
সুরে সুরে একমনে বলেছে ভালোবাসি, ভালোবাসি।
হা হা হা দেখো, ওপরের কথা গুলো
কিংবা প্রাণে বাজা গানের প্রতিটা শব্দ
খুনসুটিতে ভরা।
আমায় খুঁজে দেখো নয়তো প্রেম...



অনিমেষ সিংহ

0 কমেন্টস্
সময় ও সময়
অনিমেষ সিংহ


পাশ দিয়ে নদী চলে যাচ্ছে বিদ্যুতের বেগে।
আমার সামনে উস্কোখুস্কো চুল এক , বৃহৎ অরন্য...!
এ নিয়েই আমার সময় ,
পাখিদের ডিম দেখি
ক্রমশ নীল হয়ে উঠছে তার কুসুম ,
আমিও ডিমে তা দি !
সময় ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে আর এক সময় ,
উটের মতন হাঁটে !
উটের মতন শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসে
অথবা উঠতে থাকে রক্ত জল আর শোস্যাল সাইট ।

কুয়াসা সরিয়ে মাঝে মাঝে
তোমাকে দেখে নিতে মন করে ,
কিন্তু ব্যস্ততার মাঝে আর যাওয়া হয় না ক্লিওপেট্রা ।
তোমাদের সার্কাস ময়দানে বড় বেশী জোকার ।
সিজারের মাথা কেটে ফেলে বারে বারে , বারে বারে জুড়ে দেয় !
শুয়োরের প্রজন্ম চারিদিকে শুধু ডাস্টবিন করে রেখেছে । 

ইমেল নাঈম

0 কমেন্টস্

সবিনয়ে নিবেদন
ইমেল নাঈম


একটি হাত থাকে এখানে অন্যটি পকেটে
যদিও সর্বত্র লেগেছে দুশ্চিন্তার ছাপ
বহতামান রক্তের পচনে শীর্ণ দেহ
সুখের অন্বষণে পেরোয় একেকটি দিন ।
সুখ ? সেতো সোনার হরিণ !
তাকে খুঁজতে গিয়ে পেরিয়ে গেলাম
অজস্র শাল মোহরের বন
প্রতিদিন সেগুন বাগিচার সামনে
মত্ত থাকে এক ঝাঁক প্রজাপতি ,
তারাও আজ উদাসী ।
আগামীর ভোরে যে সূযে উদিত
তার নিচেই যেন আশ্রয় পায়
শান্তির পায়রা
প্রকৃতির বিচিত্র অবক্ষয়ে না পুড়ে সংসার ।


 

অনুপ দত্ত

0 কমেন্টস্
সেই গানের মানুষটা
অনুপ দত্ত



তার সাথে পরিচয়ের কথা ঠিক মনে নেই I ওর সঙ্গে গানের আসরে যেতাম ৷I মাথার ভেতরে আমার তখন গানের পাগল যেন উলঙ্গ হয়ে নাচে --গাইত সে খুব ভালো I অবধারিত তার ডাক আসতো সবার শেষে ৷i আমার লাভ হতো তার ষ্টেজে উঠার গে,মাঝে মাঝে তার সাথে কথা বলা আর অন্যের গান শোনা I আমরা দুজনে কথা বলা মানে গল্প করতাম ৷ তবে গল্প বেশি হতো তার অন্য পরিচিত নামকরা লোকজনের বা তার অনুপ্রানিত সখী অথবা সখার এক অভাবনীয় গল্প গাঁথা নিয়ে৷I বেশির ভাগ সময়ে সে প্রণব সরকার কথা বা মালবিকা খানের গান গাইবার কথা বলত I তাদের সঙ্গীত জীবনের সাধনার কথা -- প্রনবদার উদ্দাত্ত কন্ঠে রবি ঠাকুরের গান বা লুপ্তপ্রায় বাংলা ভজন গাইবার কথা I কখনো কখনো মালবিকার সুরেলা নজরুলের গান গাইবার কথা বলত I প্রনবদা তো আর বেচে নেই.. তবে তার গান আজও আমার কানে লেগে আছে I মালবিকার কথা জানিনা অনেকদিন...সেই বালুরঘাট ছাড়ার পর থেকে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই I



আমার পাগলপনা গানের মন ভরে যেত যখন তার সঙ্গ পেতাম, আর তার গান শুনতে পেতাম একেবারে খালি গলায় I আহা ...অমন উদ্দাত্ত গলা অনেকদিন আমি শুনিনি I তার সাথে কথা বলে এক অদ্ভুত শুন্যতা নজরে পড়ত I সে এত কথা বলত আমাকে কিন্তু নিজের বিষয়ে বা নিজের ছেলেবেলার কথা কখনো বলত না I কখনো আমার ক্রমাগত অনুরোধে --সে চুপ করে থাকত তারপর এক বিনম্র হেঁসে অন্য কথায় সুর বদলে দিত I কৌতহল হতো আমার I আবার তাকে জোরাজুরি করে দুঃখের ভাগী হতেও মন চাইত না I

একবার শীত জাঁকিয়ে পড়ার আগে তার সাথে অনেক দুরে অনুষ্ঠান করেতে যাবার সুযোগ হলো.....জায়গাটা শিলিগুড়ি I তখনও বালুরঘাটে ট্রেন আসেনি I হবার কথা চলছিল তা প্রায় ২৫/৩০ বছর ধরে I রাজনৈতিক মতবিরোধের এক অনন্য নাজির আর কি I



আমাদের জায়গা থেকে শিলিগুড়ি প্রায় ৭/৮ ঘন্টার রাস্তা হবে বাসে ৷i আমি তো বেশ তৈরী ছিলাম I এমন সুযোগ কি হাত ছাড়া করা যায় I সকালের বাস ...আমাদের পাশা পাশিপাশি সীট পড়েছিলো I সব ঠিক থাক চলছিল ..খুশির মেজাজে... স্বর্গ যেন একেবারে নিচে নেবে এসেছিল ....গর্বের ভেতরে সবকিছু নিয়ে একেবারে হাতের মুঠোয় I

ঘটনাটা ঘটল একটু অন্য রকম ..বাসের ভেতরে এক ১০/১২ বছরের ছেলের সঙ্গে বাস কন্ডাকটারের অভাবনীয় ব্যবহারে তাকে আমি প্রথম দেখলাম বেশ উত্তেজিত হতে I টিকিট কাটতে পারছিল না বলে কন্ডাক্টার ছেলেটাকে বেশ জোরে চড় থাপ্পর মারছিল ....ছেলেটা বার বার বলছিল..

- বাবু..... পয়সা নেই..বাবু.........

- পয়সা নেই..বাবু..........

- খেতে পাই নি আজ দুদিন....শহরে যাচ্ছি কাজের আশায়...যদি কিছু করে খেতে পাই..."



দৃশ্যটা এমন কিছু নতুন নয় এমন ঘটে এবং দেখা যায় সর্বত্র I কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত ছিল I অবাক হবার পালা আমার,যখন দেখলাম সে উঠে গিয়ে কন্ডাকটারের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত ঘষে বলছে....

- ওকে চড় থাপ্পর মারার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে ? আপনার ঘরে কি নিজের ছেলে পুলে নেই..... আপনি কি মানুষ, না কি ? কত ভাড়া হয়েছে আমায় বলুন ..আর আমাদের সাথে ওর একটা টিকিট কেটে দিন শিলিগুড়ি অবধি, ও আমাদের সঙ্গে যাবে I

পরের সমস্ত সময় একেবারে চুপচাপ I

আর একটা কথাও হলো না....বাস শিলিগুড়ি পৌছনো পর্যন্ত i আমি বুঝতে পারছিলাম ---কোথাও একটা ছন্দ পতন তার মনে ---কিন্তু কোথায় ?



শিলিগুড়ি এসে গেলে, ছেলেটা বাস থেকে নেবে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করাতে...সে তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, কোনো কথা তার মুখ থেকে বেরোলো না ..এক গভীর দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটার মাথায় হাত খালি বুলিয়ে দিলো I

আমি এত গভীর দৃষ্টি তার ছোখে দেখিনি কখনো আগে... সে দেখার ভেতরে কি এক মায়া ..এক আশ্বাস ...আর কি এক প্রতিবাদের ছায়া তার চোখে দেখতে পেলাম i ডাকবাংলোতে ঠাই হয়েছিল আমাদের I অনুষ্ঠান ছিল শিলিগুড়ি কলেজের ২৫ বছর পূর্তি রজত জয়ান্তি উত্সব পালনের I



যথা সময়ে আমরা কলেজ অনুষ্ঠানে পৌছে গেলাম ....... যথারীতি আবার সেই অপেক্ষা I তার নাম বার বার ঘোষক বলে চলেছে ....

- উনি এসে গাছেন আমাদের মাঝে ..একটু ধৈর্য ধরুন ..নবীনদের হয়ে গেলে উনি স্টেজে আসবেন...একটু সহযোগিতা করুন ...

তখন প্রায় রাত দশটা হবে... অত নিয়ম কানুন ছিল না তখন, যে রাত দশটা বাজলে মাইকে বন্ধ করে দিতে হবে বা পুলিশের পারমিশন লাগবে I তার ডাক আসার দেরী দেখে ..সাহসে শুধাই ...

- কি হোল তোমার আজ..কিসের অভাব মনে হচ্ছে তোমার...আমার কি কোনো অন্যায় হয়েছে ? এত চুপচাপ কেনো ? কথা বলছ না যে....

আমার দিকে তাকালো সে......সেই দীর্ঘ দীঘল চোখের চাউনি দেখতে পেলাম I যেমনটা দেখেছিলাম বাসের ভেতরে...তফাতটা শুধু এখন এক বিন্দু জল চোখে I ভয় হলো আমার ..কোথাও কি আমি আবার আঘাত করলাম তাকে হঠাট সে আমার হাতটা চেপে ধরল .......দেখলাম তার চোখে বেশ জল... প্রায় গড়িয়ে পড়ল বলে ..স্টেজের আলোতে চিক চিক করেছে যেন I এবার বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি I ভেজা চোখ তুলে আমার দিকে চাইল সে -

- মানুষ এত নিষ্টুর হয় কেনরে ৷ I কেন এই সমতার অভাব ? জানিস,বাসের সেই ছেলেটা আজ আমায় আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়িয়ে দিলো...এক সময় ওই রকমটা কেটেছে আমার I৷ খাবার ছিল না..,, পকেটে পয়সা ছিল না, দোরে দোরে ভিক্ষা করে বেড়িয়েছি ৷I কেউ ছিল না আমার ৷I বাবা মাকে হারিয়েছি হিলি বর্ডারে , যখন বাংলাদেশের সঙ্গে গুলি গোলা চলছিল ....রাজনৈতিক মতনৈক্য দুই দেশের ভেতরে ...মরলো কিছু নিরপরাধ লোকজন ৷ I বাবা মা গিয়েছিলেন সেখানে এক কাকার বাড়িতে...আমাকে রেখে গিয়েছিলেন মাসিমার বাড়িতে ,খাদিমপুর পাড়ায় I আর ফিরে আসেন নি তারা....এমনকি আমি তাদের আর চোখের দেখাও দেখতে পাইনি আমার বয়েস তখন ওই ছেলেটার মতন হবে I তারপর সংগ্রাম. আর সংগ্রাম ..জীবনের অর্থ কিছু ছিল না আমার কাছে ..যেমনটা হয় রুপোলি পর্দার গল্পের মত ৷ I কি করেছি...আর কি করিনি আজ আমার আর মনে নেই I মনে করতে চাইলে মনেও পড়ে না আর....মনে করতেও চাইনে এখন আমিI৷ শুধু মনে পড়ে.........মনের ভেতরে...মনের আধারে গান ছিল I সুরের মায়াজাল মনের ভেতরে কি এক অপার শান্তি বিস্তার করতো......................

কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলো সে I দেখলাম চেহারাটা অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে ..বোধহয় কথা গুলো বলতে পেরে I আবার আমার হাতটা টেনে নিল হাতে বল্লে ...

- স্থান কাল, না বিচার না করে শুধু সুরের সাধনা করেছি আর মনে রেখেছি এক অদ্ভুদ প্রতিবাদের জ্বালা ..অন্যায় বা অনাচারের বিরুধ্যে I

দেখ ভাই , আমি তো আর তোমার মত লম্বা আর বলবান নয় যে দরকার পড়লে দুটো ঘা লাগিয়ে দিলাম আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ..........আমি মনকে জোর দিয়েছি, জুড়েছি কথা আর সুরের মোড়ে.......

আমি অবক হয়ে শুনছিলাম তার কথা ...এ কোন মানুষ ? কবে থেকে ঘুরছি তার সঙ্গে ..কোনো হদিস পানি তার..দেখছিলাম কেমন করে গুটিয়ে থাকে মানুষ তার নিজের খোলের ভেতরে I আবার যখন জল পায় কেমন নিজেই আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে ..কি তোমার খেলা হে অন্তর্যামী ...হঠাট এক শব্দে বাধা পরলো আমার চিন্তাধারা ..



- এই যে স্যার ..আসুন..দয়া করে.. সেই ঘোষক এসে প্রায় তাকে টেনে তুলে নিয়ে যায় আরকি I



গল্পটা ছেদ পড়ল বলে দুঃখ হলো মনে...সে ষ্টেজে উঠলো ...হাত তালিতে গম গম করে উঠলো সমস্ত আসর i অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম আজ....সে সাধারণত বসে এবং নিজে যন্ত্রের সঙ্গে গান গায়...i আজ দেখলাম সে মাইকম্যানকে ডেকে কি যেন আদেশ দিলো I স্টেজ ঠিক দু মিনিটের মধ্যে সাজিয়ে দিলো তারা....সে মাইক হাতে নিয়ে আজ প্রথম গাইল...আজ তার মুখে এক নতুন গান শুনলাম I জানি কথা তার মনে লেখা..সুর তো তার মনের ভেতরে কবে থেকে গুমড়ে গুমড়ে প্রকাশের অভাবে কাঁদছিল ........... আজ বাঁধ ভাঙ্গা জলের মত সে গাইলো........

ওরে মন..যা জেনে যা...
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়
প্রতিবাদে কর প্রতিভূ জয় I
ওরে মন..যা জেনে যা...

দিস না ছেড়ে নিজের আশা
বাঁধিস না ভয় মনে বাসা I
ওরে মন..যা জেনে যা...

দেখবি রে তোর জয়ের ধ্বজা
আকাশে উড়ে দশ ভুজা I
ওরে মন..যা জেনে যা........

কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়
প্রতিবাদে কর প্রতিভূ জয় I
ওরে মন..যা জেনে যা........

সৌমেন্দ্র লাহিড়ী

0 কমেন্টস্
কফি হাউস
সৌমেন্দ্র লাহিড়ী



অফিস থেকে বেড়োতে আজ অনেকটা দেরী হয়ে গেছে । বাড়ীতে নিশ্চয়ই এতক্ষনে চিন্তা শুরু হয়ে গেছে, কিছু করার নেই, রাজুর বইটা কিনে নিয়ে যেতেই হবে । বাসটাও ঢিমেতালে চলছে, কলেজ ষ্ট্রীট আসলে নেমে পড়লাম । আমার ভাই রাজু এবার মাধ্যমিক দেবে, আজই টেষ্ট পেপার বেড়িয়েছে, বইটা নিয়েগেলে ওর উপকার হবে । ওই তো আমার একমাত্র ভরসা । বাবাকে সেই ছোট বেলাতেহারিয়েছি, মা চির অসুস্থ, আমি , আমার বোন ,ভাই । বাবার মৃত্যুর পর বাবার জমান টাকা কখন ফুটো কলসীর থেকে জল বেরিয়ে মত শেষ হলো বুঝতেও পারিনি । আমার বোন একজন বিধর্মীকে বিয়ে করে সুখে আছে । আমি হয়ত বিধর্মী হতে পারলাম না বলেই সমস্ত দুঃখের বোঝা বয়ে চলেছি । মাকে ঠিক বুঝতে পারি না কখনও বলে তোর বিয়ে দেওয়া উচিৎ - কখনও বলে তোর বিয়ে হলে আমাদের কি হবে ? কখনও আমিও ভাবি আমার কি হবে? নাঃ - জানি না এর উত্তর আমার জানা নেই ।

বাব্বা ,টেষ্ট পেপার নেওয়ার জন্যও লাইন । লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম, দেশটার কি যে হলো ,সর্বত্র লাইন । অনেকদিন কফি হাউসে যাওয়া হয় নি । তখনও স্বপ্ন দেখতাম কিছু করার ,আর, মাঝে মাঝেই এসে কফির টেবিলে ঝড় তুলতাম । মনে হলো এক কাপ কফি আসলে কেমন হয় ,নাঃ মনটা খারাপ হয়ে গেল । যাব না কফি হাউস । বইটা নিয়ে টাকা দিয়ে, মানিব্যাগটা ভ্যানিটি ব্যাগে রাখতে রাখতে দোকান থেকে বেড়িয়ে আসলাম । আরে রণজয় না -কেমন চেহারা, উসকো খুসখো চুল , গালে ক'দিনের না কামান দাড়ি । ডাকলাম- রণজয় , রণজয় শুনতে না পেয়ে চলে যাচ্ছিল । আবার ডাকলাম ,এবার দাঁড়িয়ে পড়ে চারদিকে খুঁজতে লাগল ,এগিয়ে গিয়ে বললাম - কি হলো রণজয় চিনতে পারছ না ? নাকের উপর চশমাটা ঠিক করে নিয়ে ভাল করে দেখল -আরে মোহিনী !

-যাক চিনতে পারলে তা হলে ,আমি তো ভেবেছিলাম চিনতেই পারবে না । -আসলে অনেকদিন পরে দেখা ,কেমন আছ মোহিনী ? -ভালো তুমি কেমন আছো ? -মন্দ নয় অনেক কথা জমে আছে, চল একটু কফি হাউসে আমার দিকে তাকিয়ে রণজয়ের কথা শেষ হল না । কিন্তু আমার তো অনেক কথা বলার আছে, তাই আমিই বললাম -হ্যঁা ,চল খানিকক্ষন কফি হাউসে গিয়ে বসি । কফির টেবিলে দুটো কফির অর্ডার দিয়ে আমরা বসলাম । কিছু সময় নিঃশব্দে কেটে গেল । আজ থেকে আট বছর আগে ঐ কোনের টেবিলটায় পাক্কা দুঘন্টা একজনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম , বাড়ী ফিরে গিয়ে তার প্রত্যাখানের চিঠি পেয়েছিলাম কারন - আমি আমার মা , ভাইবোনেকে চিরদিনেজন্য ছাড়তে পারব না বলে- আসলে শর্ত ছিল- গরীব মা ভাইবোনের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে না ।

-কিছু বলো রণজয় , এভাবে চুপচাপ বসা যায় না । -কেন ? এর আগে তো কফির টেবিলে মধ্যমনি তো তুমিই থাকতে । - সে মোহিনী অনেক পাল্টে গেছে সেটা তো তুমি জান রণজয় । মুখ তুলে আমার দিকে দেখল তারপর চোখ সরিয়ে নিল , -জান মোহিনী, আমি খুব কষ্টে আছি - কিসের কষ্ট তোমার রণজয় ,তোমাদের মত বড়লোক সারা কলকাতায় কজন আছে গুণে বলতে পারা যাবে । - আর্থিক কষ্ট নয় মোহিনী, মানসিক কষ্ট -আমরা তো গরীব , আমার সামান্য আয়েই সংসার চলে ,তাই আমাদের কাছে কষ্ট হলো অর্থাভাব । রণজয় তীক্ষ্ণ নজরে আমার দিকে তাকাল তারপর মাথা নিচু করে টেবিলের ওপর জড়ো করে রাখা হাত দুটোর উপর রেখে বলতে লাগল - - আজ আমি প্রত্যাখ্যাত । রুবি আমাকে ছেড়েচলে গেছে, জান মোহিনী ও বলেছিল আমার কবিতা লেখা সিগারেট খাওয়া ওর পছন্দ নয় । কবিতা সিগারেট নয়ত রুবিকে যেকোন একটা ছাড়তে হবে বলে জানিয়েছিল । সেদিন এক কবি সম্মেলন থেকে বেড়োতে দেরী হয়ে যায় বলে রুবি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় ,তারপর আর ওর দেখা পাই নি, আমাকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে । পরশু বিকালে এস এম এসে বলেছে ওকে ভূলে যেতে । আমি কি করব মোহিনী ?

রণজয়ের উসকো খুসকো চুলে হাত বুলাতে ইচ্ছে করল । কিন্তু না....... - গোলাপ যদি নিতে চাও কাঁটা সাথে নাও সুখ যিদ পেতে চাও দুঃখ সাথে নাও ভালবাসা যদি পেতে চাও বিরহ সাথে নাও আলো যদি পেতে চাও অন্ধকার সাথে নাও কিছু যদি পেতে চাও তবে কিছু দাও । রণজয় মুখ তুলেদেখল -এখনও তোমার মনে আছে? - একথা গুলি আমি কখনই ভুলতে পারব না রণজয় ,বার বার মনে করতে করতে শব্দ গুলি আমার মনে স্থায়ী বাসা বেঁধে ফেলেছে । -মোহিনী তুমি আমায় ক্ষমা করতে পার না ? -ক্ষমা ,দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসল একটা -আমি তো তোমাকে ক্ষমা অনেকদিন আগেই করেছি । -তবে ফিরে এস মোহিনী আমায় গ্রহন কর ।

রণজয় ,তুমি আজ প্রত্যাখ্যাত বলেই কি আমাকে পেতে চাও? তুমি যে কারনে আমাকে প্রত্যাখান করে ছিলে, তা এখনও ভীষন ভাবে বর্তমান । সংসারের গুরুদ্বায়িত্ব এখনও আমার কাঁধে ,যা আমি অস্বীকার করতে পারিনা । সব জেনেও কেন দীর্ঘ আট বছর পর ফিরেএলে ? তোমাকে এখনও ভালবাসী রণজয় , তোমাকে পেলেই আমি সবচেয়ে খুশী হবো । তবু, তোমার ডাকে সাড়া দেবার ক্ষমতা আজ আমার মধ্যে বিলীন হয়েছে,স্যরি রণজয় পারলাম না তোমায় আপন করতে ।

ম্লান হাসি হাসলাম - - কোণের ঐ টেবিলটার থেকে আজ এই টেবিলে দীর্ঘ আটবছর সময় বয়ে গেছে ।আমার বেড়েছে আরও দ্বায়িত্ব । কিন্তু, জীবনের এই অমুল্য আটবছরের মুল্য কে দেবে রণজয় ?

- প্লিজ মোহিনী আমাকে একটা চান্স দাও । আমি সমস্ত দোষ স্খালন করতে চাই ।

ভ্যানিটি ব্যাগ তুলে দাঁড়িয়ে পড়লাম-চলি রণজয়,মা চিন্তা করছে, বাড়ী ফিরে রান্না করতে হবে ।

চেয়ার সরিয়ে টেবিলে ছেড়ে বেড়িয়ে আসলাম , রণজয় উঠতে গিয়েও বসে পড়ল । এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম সেই টেবিলে একটা মেয়ে একা বসে আছে , হয়ত কারো প্রতীক্ষায় আমারই মতো । কফি হাউস ছেড়ে রাস্তায় নামলাম ,যেন বুকের উপর থেকে একটা ভারী ওজন সরে গেল ।

অভিলাষা দাশগুপ্তা আদক

0 কমেন্টস্
পাথর খেলা
গুজরাটি ভাষায় মূল রচনা : দিলীপ জাভেরী
বাংলায় অনুবাদ : অভিলাষা দাশগুপ্তা আদক



দিলীপ জাভেরী গুজরাটের অন্যতম প্রসিদ্ধ কবি ও নাট্যকার। ওনার লেখা প্রহসনধর্মী সঙ্কলন “অবাক কান্ড” থেকে বর্তমান কবিতাটি ( পাথর খেলা, STONE PLAY ) নেওয়া হয়েছে। কবিতাটি ১৯৯২ সালের অযোধ্যা কান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা।


পাথর জমে পাহাড় ছিল বন্ধ্যা মাটির কোলে,
কলির শ্রীরাম ভেঙে দিলেন নিছক খেলার ছলে।

ভাঙাচোরা ইঁটপাথর সব জমছে রাশি রাশি
ভাঙা আয়নায় বহুরূপী মুখ দেখছে শশী।
চাষের জমি শূণ্যগর্ভা,নষ্ট বীজের সারি,
উড়ো পালক ধূলোর সাথে দিচ্ছে আকাশ পাড়ি।
ওমনিতর খুঁজছি ডানা আমিও যাবো উড়ে,
শ্মশান হল দেশ যে আমার,আমি ভবঘুরে।
আকাশ মাটি পাথরকুচি, তান্ডবে নটরাজ,
রাগের আগুন লাভা হয়ে বইছে যেন আজ।

সেতুবন্ধে পাথর ছিল বানরসেনা হাতে,
ঘরভাঙানি পাথর নিয়ে দানবসেনা মাতে,
রামরাজ্যে প্রান পেত যে পাষাণ অহল্যায়,
রামের নামে কলির অহল্যা পাথর হয়ে যায়।

ছাই হচ্ছে বসতভিটা,জল নেই কোনখানে,
রক্ত জমে হচ্ছে পাথর,এইখানে সেইখানে।
কুমোর চাকে মাটির ঢেলা নিচ্ছে সৈন্যসাজ,
বালির দেশে মৃত্যুমিছিল মরছে মানুষ আজ,
নিভল আগুন,উড়লো যে ছাই,ভাঙলো মিলনমেলা,
খেলবে এসো কলির শ্রীরাম পাথরছোঁড়ার খেলা।।