হারুকি মুরাকামি-র “দ্য মিরর” গল্পের অনুবাদ :
বর্ষার রাত,ঝমঝমিয়ে
বৃষ্টি, সাথে সোনায় সোহাগা বেহায়া
এলোপাথারি হাওয়া। প্রচন্ড ঠান্ডা, বাইরে
বার হবার উপায় নেই। আমরা জনকয়েক বিভিন্ন বয়সের লোক অলস আড্ডায় ব্যস্ত। কথায় কথায়
এসে পড়ল ভুতের প্রসঙ্গ। কেউ মানে তো কেউ মানে না। তর্ক থেকে কথা কাটাকাটি, কথা কাটাকাটি থেকে বচসা, বচসা থেকে হাতাহাতির উপক্রম।
তখনই আমাদের মধ্যে কেউ আগুনের পাশে বসা নিশ্চুপ দর্শক হামিমাতো বুড়োকে ডেকে বললো,
-
আঙ্কেল, বলো তো ভুত আছে কি নেই।
বুড়ো তখন চোখ বুজে কাঠের পিঠ বাঁকা চেয়ারে আপনমনে দুলছিল, দুলুনী থামিয়ে খানিক ভেবে
বললো,
-
আছে কি নেই জানিনা, তবে তোমরা শুনতে রাজী থাকলে আমি একটা আমর দেখা
একটা কাহিনী বড়োজোর বলতে পারি।
-
হ্যা আঙ্কেল বলো, তোমার গল্পই শুনি আজ।
আগ্রহী দর্শকমন্ডলীর ওপর নজর ঘুরিয়ে নিয়ে গলা ঝেড়ে নিয়ে
কাঁপাগলায় বুড়ো বলতে শুরু করলো।
-
“আমাদের
গালগল্পগুলো সাধারনত দু’ধরনের
হয়। মানে, হয় তারা আমাদের রোজকার দেখা
বাস্তবিক জগত থেকে উঠে আসে, নয়ত
ভুত প্রেত, প্রেতাত্মা টেতাত্মা গোছের
মৃত্যু পরবর্তী অজানা জগতের কল্পিত চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।এখন ব্যাপারটা
হোল, কেউ এসব ভুত প্রেতাত্মা
আত্মা ইত্যাদি মানেন, তাই তারা এসব উপলব্ধিও করেন ,অনুভবও করেন। আর যারা গোড়া
থেকেই ‘ভুত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি’ গোছের মানসিকতা নিয়ে চলেন
এইসব ভুত প্রেতাত্মা অশরীরিরা কেন জানিনা তাদের ত্রিসীমানাও মাড়ান না।
আমার মত কিছু লোক আবার মধ্যপন্থা নিয়েও বেঁচে আছি। ভুতের গল্প
পড়তে বা শুনতে মন্দ লাগে না কিন্তু এই সত্তর বছর বয়সেও একটা গোটাগুটি ভুত স্বচক্ষে
দেখার মত সৌভাগ্য হয়নি। অথচ ভুত আমি খুব মানি,একলা নির্জন জায়গা দিয়ে অন্ধকারে যেতে হলে গা ছমছম করে বইকি। তবু সামনাসামনি
একবারও ভুত দেখতে পাইনি। আসলে
হয়ত পুরো
চোখের ভুল বা দেখার ভুল অথবা কষ্টকল্পিত আর রহস্যময়। কিন্তু মোদ্দাকথা একই রইল, আমার ভূত
দেখাটা আর হয়ে ওঠেনি।“
আমাদের ভুতের গল্প শুনতে আগ্রহী মুখগুলো তখন চুপসে গেছে, সেটা অনুভব করেই মুচকী হেসে খানিক দম
নিয়ে বুড়ো বললো,
-
“কিন্তু একবার, হ্যাঁ, শুধু একবার আমি এমন এক ঘটনার মুখোমুখি
হয়েছিলাম যা আমাকে রীতিমত ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।এটাও ধরো সে প্রায় বছর দশেক আগে ঘটেছিল
এবং আমি আজ অবধি কাউকে এসম্পর্কে বলিনি। আমার মনে হত যদি আমি কারো সাথে এটা শেয়ার
করি তাহলে হয় লোকে হাসবে নয় আমাকে ভীতু ভাববে তাই আমিও পুরো ঘটনা চেপে গেছিলাম।
কিন্তু আজ তোমরা তোমাদের ভুতূরে অভিজ্ঞতাগুলো আমার সাথে শেয়ার করেছ, কাজেই আমাকে ত কিছু একটা বলতেই হয়, তাই না? আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঐ ঘটনা আজ তোমাদের সাথে শেয়ার করেই রাত পার করে দেব।
১৯৬০ সালের শেষের দিকে যখন আমি হাইস্কুল পাশ করি তখন জাপানে
ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে ছিল। আমি ছিলাম ওই নির্বিরোধী কচ্ছপ স্বভাবের, ঝুটঝামেলা পোষাতো না তাই কলেজে যাওয়াই পুরোপুরি ছেড়ে দিই। ওই পেট
চালানোর জন্য খুটখাট কিছু কজ করতাম বটে তবে স্থায়ী কোন কাজ পাইনি। এইভাবে বছর খানেক কাটালাম, দ্বিতীয় বছর কয়েক মাসের
জন্য আমি একটা
স্কুলে নৈশপ্রহরীর চাকরিতে যোগ দেই। ছোট শহরের ছোট একটা স্কুল। চাকরিও
আহামরি কিছু না। দিনের বেলায় ঘুমিয়ে নিয়ে রাতে পুরো স্কুল ঘুরেঘুরে দেখতে
হত। মাঝের সময়টা কাটাতাম গান শুনে, লাইব্রেরীতে
বই পড়ে অথবা একা একা স্কুলের বাস্কেটবল কোর্টে বাস্কেটবল খেলে। সত্যি বলতে
কি ঐ আঠারো ঊনিশ বছর বয়সেও স্কুলে একা রাত কাটানো কিন্তু আমার খুব একটা খারাপ লাগত
না, আসলে ঐ বয়সে কোন কিছুকেই ভয়
পায়না কেউ।স্কুলটা নতুন বানানো হয়েছিল আর ১৮-২০ টার মতো বড় বড় হলঘর টাইপের ছিল। আমার কাজ
হলো সব দেখাশোনা করা। কাজের সুবিধার্থে আমি ২০ পয়েন্ট এর একটা নোটশীট মতো বানিয়ে নিয়েছিলাম। প্রতিটা রুম দেখে নেয়ার পর ঐ রুমের নামের পাশে
ঠিক চিহ্ন ঠুকে দিতাম।
আমার বামহাতে সবসময় টর্চ থাকত আর ডানহাতে কাঠের হাতলওয়ালা
খাটো জাপানি তলোয়ার। হাইস্কুলে থাকতে আমি তলোয়ার চালানো শিখেছিলাম তাই ওটা দিয়ে
কাওকে কুপোকাত করে দেবার আত্মবিশ্বাস ও আমার ছিল। যাহোক সে রাতে ঝড়ো হাওয়া বইছিল।
তখন অক্টোবর মাস। বছরের ঐ সময়টাতে ঝড় আসার কথা না। বাতাসের ধাক্কায় সুইমিংপুলের
গেট ভেঙে যায় আর খুব শব্দ করতে থাকে। একবার ভাবলাম ওটা ঠিক করে আসি, কিন্তু সেদিনটা খুবই অন্ধকার
ছিল। আকাশে চাঁদের চিহ্নমাত্রও ছিলোনা। রাতের
খাওয়া শেষ করে রাত ন'টায় প্রতিটা ঘর ঘুরে দেখে
আসলাম। সবকিছু ঠিকঠাক। সব দরজাই তালাবদ্ধ ছিল। অস্বাভাবিক কোন কিছুই চোখে পড়েনি। আমি আমার ঘরে ফিরে গিয়ে রাত তিনটায় এলার্ম দিয়ে
ঘুমিয়ে পড়ি।
রাতে এলার্মের শব্দ শুনে যখন ঘুম ভাঙে, আমার অন্যরকম এক অনুভূতি
হলো। যা আগে কখনো হয় নি। এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমার মনে কেউ যেন আমায় জোর
করে বিছানায় চেপে ধরে রেখেছে, উঠতে
দিচ্ছেনা।আমি মনের জোর গায়ের জোর এক করে নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুললাম, সুইমিংপুলের ভাঙা গেট তখনো
ছান্দিক গতিতে শব্দ করে যাচ্ছিল।কিন্তু আগেরবার থেকে ভিন্ন।সম্পূর্ণ ভিন্ন
শব্দ।অদ্ভুত কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে, আমার
মন থেকে একটা বিপদঘন্টি আমায় সতর্ক করে দিচ্ছিল।
-
ওদিকে যেও না হামিমাতো, ওখানে ভয়ংকর কিছু একটা আছে। (আমি নিজেকে নিজের
কর্তব্যপরায়ণতা স্মরণ করিয়ে দিলাম।) দেখো
হামিমাতো, ভয় পেয়ো না। তুমি যদি একবার
কাজ ফাঁকি দেওয়ার চক্রে ঢুকে পড় তাহলে এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেনা।
আমি টর্চ আর তলোয়ার খুঁজে নিয়ে অনিচ্ছুকপায়ে জোরকদমে বেরিয়ে
পড়লাম। বাইরে অস্বাভাবিক জোরে এলোপাথরি বাতাস বইছিল।রাজ্যের ধুলো উড়ে এসে ছুঁচের
মত বিঁধছিল মুখে, আমার মুখ চুলকানি শুরু করায়
সামনের দিকে তাকাতে কষ্ট হচ্ছিল।আমি প্রথমে জিম এবং পর্যায়ক্রমে অডিটোরিয়াম আর
সুইমিংপুল দেখে আসব ঠিক করলাম। স্কুলের ভেতরে সবকিছু সঠিক অবস্থানে ছিল। আমি আমার
চেকবুক অনুসারে প্রতিটা ঘর দেখে নেওয়ার পর ঠিক চিহ্ন দিয়ে মার্ক করে রাখছিলাম।
চেকবুক অনুসারে শেষে যা দেখার বাকি ছিল
সেটা হলো ক্যাফেটেরিয়ার সামনে বিল্ডিংয়ের
পূর্বদিকের চুল্লিঘর।এর মানে হলো আমাকে দীর্ঘ হলঘরের ভেতর দিয়ে যেতে হবে।আকাশে
চাঁদ থাকলে হলঘরে কিছুটা আলো থাকে। কিন্তু ঐ রাতে চাঁদ যেন নিজেকে লুকিয়ে রাখার
আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। মেঘের টুকরোর আড়াল থেকে ক্ষনিকের জন্য বেরিয়ে এসে, আবার ঢুকে যাচ্ছিল।আমি টর্চ
জালিয়ে হলঘরের ভেতর দিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকলাম।আমার বাস্কেটবল জুতোর তলা মেঝের
উপর কিচমিচ শব্দ করে যাচ্ছিল। ওটা ছিল তেল চিটচিটে শ্যাওলাপড়া মেঝে। হলঘর ধরে
স্কুলের প্রবেশপথে যেতেই আমি হতভম্ব। আমার মনে হলো আমি অন্ধকারে কিছু একটা দেখেছি। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তলোয়ারটা শক্ত করে ধরলাম।
আমার জন্য আরো অদ্ভুত জিনিশ অপেক্ষা করছিল।দেয়ালে টর্চের আলো পড়তেই দেখি একটা
আয়না। পুরোপুরি চমকে যাই আমি। এত বড় আয়না!এবং ওটাতে আমার প্রতিবিম্ব। গতরাতে তো এখানে
কোন আয়না ছিলনা। তাহলে নিশ্চয়ই এটা নতুন কেনা হয়েছে, আমি নিজেকে বললাম। আয়না দেখে আমার মন কিছুটা
শান্ত হল। নিজেকে বোকা ভেবে হাসিও পেলো।
-
এটা তো স্রেফ একটা আয়না, এত ভয় পাওয়ার কি হলো হে? সত্যি হামিমাতো, তুমি একটা নিরেট বোকা আর
নির্বোধ।
নিজেকে এসব শুনাতে শুনাতে টর্চ নিচু করে একটা সিগারেট
ধরালাম।সিগারেটের ধোয়া বাতাসে ছেড়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের উপর একবার দৃষ্টি
বুলিয়ে নিলাম। বাইরে থেকে আসা একটা দূর্বল আলো আয়নায় প্রতিফলিত হলো। আমার পেছন দিক
থেকে ভাঙা গেট তখনো শব্দ করে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর মনে হলো, নাহ, ওটা
আসলে আমি নই। আমার মতো অবিকল হলেও প্রতিবিম্ব টা আমার নয়।ওটা আমিই ছিলাম, তবে অন্য 'আমি', যার কখনোই অস্তিত্বলাভ করা উচিত নয়।আমি জানিনা
কিভাবে এটাকে ব্যখ্যা করতে হবে। কিছুক্ষনের জন্য আয়নার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।সিগারেট হাত থেকে পড়ে যায়।আয়নার ভেতরের
ছায়ার সিগারেট ও একইভাবে পড়ে যায়। আমরা দুজন একে অপরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে
থাকি।আমার মনে হলো আমি কোন কিছুতে আটকা পড়েছি।কেউ আমার হাত পা এত শক্ত করে বেধে
রেখেছে যে আমি নড়তে পারছি না। অতঃপর তার হাত নড়ে উঠে, ডানহাতের আঙুল দিয়ে সে তার থুতনি স্পর্শ করে।
তারপর, ধীরে ধীরে, হ্যা, ছারপোকার মতো ওগুলো তার
মুখের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে যেতে থাকে। আমি হঠাৎ উপলব্ধি করলাম যে আমিও একই কাজ করছি।
বিষয়টা পুরো উল্টে গেল। আয়নার ভিতরের 'আমি'র প্রতিবিম্ব হয়ে গেলাম আমি।
সে আমাকে নিয়ন্ত্রন করছে। বোঝা মাত্র আমি সতর্ক হয়ে আমার তাবৎ শক্তি দিয়ে ক্রুদ্ধ
গর্জন করে উঠি। যে বন্ধন আমাকে আটকে রেখেছিল সেটা ভেঙে যায়। তলোয়ার তুলে নিয়ে আমি
সমস্ত শক্তি দিয়ে আয়নায় আঘাত করি এবং নিজের ঘরটায় ছুটে চলে আসি। পেছনে আয়না ভেঙে
পড়ার শব্দ শুনতে পাই। দ্রুত রুমে এসে আমি দরজা বন্ধ করে দেই আর তোষকের নিচে শুয়ে
পড়ি। কাঠের মেঝেতে পড়ে যাওয়া সিগারেট নিয়ে আমার চিন্তা হয়, কিন্তু ওখানে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় ছিলনা। সাহসt+ই হচ্ছিল না আমার। বাতাস যেন
পাগলের মত গর্জন করছিল সে রাতে, সুইমিংপুলের
ভাঙা গেটও ভোর হবার আগে পর্যন্ত ঢকাংঢক ঢকাংঢক এলোমেলো শব্দ করে গেছিল, একফোঁটা ঘুমাতে পারিনি, ভয়ে কাঠ হয়ে এক অজানা বিপদের
আশঙ্কায় প্রতি মুহুর্ত কিভাবে যে কাটিয়েছিলাম তা ভাবতে গেলে আজও শিউরে উঠি
বোধকরি এতক্ষনে তোমরা গল্পের শেষটা ধরে ফেলেছ।ওটা কোন আয়না
ছিলনা অবশ্যই না। সূর্য উঠার আগেই ঝড় থেমে যায়।এত সুন্দর ঝলমলে দিন দেখে বুঝার
উপায়ই নেই যে গতরাতে এখানে টাইফুন আঘাত হেনেছে।আমি ঐ স্থানে যাই, সিগারেট টা মেঝেতে পড়া
অবস্থাতেই ছিল, তলোয়ার টাও। কিন্তু কোন আয়না
ছিলনা। আমি যা দেখেছি সেটা কোন ভূত নয়। সহজভাবেই সেটা ছিলাম 'আমি'। তোমরা দেখে থাকবে আমার ঘরে কোন আয়না নেই। আয়না
ছাড়া শেভ করা কিন্তু সহজ কাজ নয়, সত্যি
বলছি।“
কথা শেষ করে হামিমাতো বুড়ো আবার চোখ বন্ধ করে গুড়িশুড়ি মেরে
বসা অবস্থায় দুলতে থাকে, আর
আমরা বিমূঢ় হয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন