২ এপ্রি, ২০১৪

কাশীনাথ গুঁই

2 কমেন্টস্
আমাদের দু’ চার কথা
কাশীনাথ গুঁই


কেটেই গেল শীতের জড়তা। বাসন্তী বাতাস আসতে খানিক দেরী হল এবার। তাতে কি আর ফুল ফোটা আটকায় - সে ফুটেছে আপন খেয়ালেই।ভোটের দামামা আর চিরন্তন নাটকেও সেই ট্র্যাডিশন সমানেই চলেছে। চলেছে অবাধ সামাজিক অপরাধ - সেও আপন গতিতেই-তার মাঝেই এল 'আন্তর্জাতিক নারীদিবস'। গাল ফুলিয়ে এই একটা দিনেই নারিমঙ্গলের কত বুলি কাঁপালো সভাঘর,ঈথার। সেদিনে কি ঘটেনি কোথাও নির্যাতন, কে রাখে তার হিসেব। তবুও দিনপালনের এই খেলা চলবেই- সারা মাস ধরে,বছর ধরে ঢক্কানিনাদে যেন ভুলে থাকা ছাড়া সমস্যা মেটানোর পথই নেই!

প্রকৃতি এসবের ধার ধারেনা তাই তার লীলা চলমান। তাই আবীরে রাঙাবো তোমা সবে - মনের মাতোয়ারা হবার আড়ালেই জমে উঠবে আরেক খেলাওরব - নিশা অবসানে পত্রিকার কলমে বা হেডলাইনে গড়ব অন্য ইতিহাস।

না, বড়ই নেতিবাচক হয়ে গেল এবারের কলম। কিন্তু চোখ ঢেকেও যে কান্নার শব্দ শুনি তা এড়াই কিভাবে!

চলুন সেই পথটাই খুঁজি আবার সুস্থ সৃষ্টির অবয়বে। যা নজর আর মনকে মুক্তি দেবে আমাদের এই অন্তর্জাল পত্রিকার সুস্থ সমাজের স্বপ্ন দেখার কারিগরদের কলমে উদ্ভাসিত।

ভাল থাকুন,ভাল রাখার শপথে মেতে উঠুন আবিরের সুগন্ধে।



আপনাদের ভালবাসা ধন্য -

কাশীনাথ গুঁই।

সৌমিত্র চক্রবর্তী

4 কমেন্টস্
অতিথি সম্পাদকের কলম
সৌমিত্র চক্রবর্তী


আয় বসন্ত, বোস বসন্ত, থাক বসন্ত আমার ঘরে।

যাই যাই করেও বারবার ফিরে তাকিয়ে, নাকের জলে-চোখের জলে পরিপার্শ্ব ভিজিয়ে, ভয়ানক অনিচ্ছায় শীত কিছুতেই যেতেই চাইছিল না। আর বসন্তও তার লাজুক স্বভাবের পেটেন্ট নেওয়া লালিত্য ছেড়ে ঠেলেঠুলে শীতকে তাড়িয়েও ঢুকে তার নির্ধারিত সময়ে মৌরসীপাট্টা গড়ে তুলতে পারছিল না।

তবুও সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী, যেতে হয় সবাইকেই একদিন। ব্রহ্মান্ডের এই সারসত্য মেনে নিয়েই টুক করে মিষ্টি রোদটা লাফিয়ে পড়লো ধানমাঠের ভিজে ভিজে আলে, শহরের রোমান্টিক পাইথন রঙা রাজপথের পিঠে। আর অমনি তাকে খপ করে ধরে ওই উঁচু শপিংমলের আয়না জানলা ঠিকরে ছুঁড়ে ফেললো মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়া সারা বছর কুঁকড়ে মুকড়ে থাকা মানুষগুলোর মাঝে।

কান্ড দেখে সদ্য ঘুম ভাঙা পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া ফিকফিক করে মুচকি হেসে বাসন্তিক শো এর জন্যে তৈরী হতে শুরু করলো। উছলে লাফিয়ে উঠলো ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়ির ক্ষুদের দল, মাটির বাড়ির ক্ষুদের দল, সামনের সানাই এর প্রতীক্ষায় থাকা লাল-সবুজ জীবন্ত বসন্তের দল। ওদের যে আপাত পরীক্ষা শেষ।

খুব বড়দের ধারেকাছে সেই রোদ্দুর ঘেঁষে না। ওদের যে ইচ্ছে করলেই, দেখা হলেই ভ্যালেন্টাইনস্ ডে। ওদের যে বসন্তের উচ্ছলতার মাঝেও হিসেব নিকেশ শেষ হয়না।

তাই বলে কি রোদ্দুরের মনখারাপ হয়না? হয় বৈকি, তারও মনখারাপ হয়। যে ছেলেটা কোনোদিন নিজের খালি গা ঢাকতে পারেনি একটাও নতুন জামায়, যে মেয়েটা শুধুমাত্র একটু বিশ্বাসের ভুলে বিক্ষত শরীর নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে, যে লোকটার দাদন শোধ হয়নি বলে নবান্ন হয়নি কিম্বা অপ্রতিরোধ্য ক্ষয় নিয়েও যাকে রোজকার বোঝা মাথায় তুলে টালমাটাল পায়ে এগিয়ে যেতে হয়, তাদের জন্যে চিকচিক করে করে তারও চোখের কোল।

তখন আকাশে কালো হয়ে আসে মেঘ। রাগে নিস্ পিস্ করতে করতে একসময় হা হা শব্দে হেসে উঠে পাগলের মত মাথা নাড়তে শুরু করে সে। আর ওমনি শুরু হয় কালবৈশাখী।

ব্যাস! শুধু এই নাচাওয়া টুকু বাদ দিলেই স্যাঁতস্যাঁতে ছায়া ছায়া অন্ধকার উধাও। ভালোলাগা জড়িয়ে একে একে আসে রঙবাহার হোলি, উত্তেজনার চড়ক। আর ভালোলাগার মানুষ বা মানুষীর আড়চোখের চাউনি যদি মিশে যায় তারমাঝে! তাহলে পৃথিবী শান্ত হয় নিস্পাপ অনুরাগে।

প্রেরণার সব পাঠক বন্ধুদের ফাগুয়া ভালোলাগা-ভালোবাসা-শুভেচ্ছা।

ভালো থাকুন সবাই বাসন্তী রঙে।

বিজয় ঘোষ :

0 কমেন্টস্
(অনুকবিতা)

মানচিত্র

বিজয় ঘোষ :


কোথাও কিছু নেই ...
বসন্তের ঘোষণা হলো !
এবার প্রতিস্রোতে নৌকো চলবে
নদী ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় মানচিত্র ।

সেখ সাহেবুল হক

1 কমেন্টস্
অসমাপ্ত
সেখ সাহেবুল হক


প্রেমে পুরুষেরা দেবত্ব খোঁজে বলেই
তোমার নাম দিয়েছিলাম দেয়াসিনি...
কাঁচের বোতলে জোনাকি পুষে
নীল রঙে ভরা মেহফিল
শেষরাতে পানপাত্রের নাম সূর্যশিশির...
পৌষের সকালে রোদ খুঁজতে গিয়ে দেখছি
ঘাসের শিশিরে তোমার চলে যাওয়া।
এঁদো পুকুরের আলোআঁধারিতে
কচুরিপানার স্তন খামচে ধরে ফড়িং -
ছাতিমছায়া ভেজা মন্দিরে পাথরের বিগ্রহ হয়েছি।
নিঃশব্দতা মাড়িয়ে জয়োল্লাসের পালকিতে
লাল শাড়ি প্রেম আসেনা -
প্রেমে অনেক দেবতারা পাথর হয়ে বাঁচেন
অভিশপ্ততা দাঁড়িয়ে থাকে স্থাপত্যের বুকে...
ভালবাসতে না জানা কৃষ্ণচূড়ার পায়ে সাজানো
একটি বসন্তও চাইবো না।
বাবলা ফুল নদীর বুকে ঝরে -
চশমার ফ্রেমে দেখা পরিযায়ী ডানায়
শহর গল্প বলে...
তোমার প্রিয় পঙক্তিরা শেষ লিখতে শেখেনি।

অনিমেষ সিংহ

1 কমেন্টস্
সুচরিতা
অনিমেষ সিংহ




সুচরিতা কোথায় আছো তুমি !
দশটা-চারটা বুড়ো আঙ্গুল নিয়ে
বারো পেরিয়ে যায় আমাদের হোররোজ,
বারোয়ারী !
রাতের শরীরে আর একটা রাত।
পাঁকের ভেতর মৃদু মৃদু আমার চেতনায়
পদ্ম পদ্ম মুখ দেখিনি কতোকাল।
জনক দুহীতা আজও মাটির ভেতর কি করো !
চুল বাঁধো ?
এতো আঁধার এতো আঁধার
এতো আঁধার বাইরেই ছিলে ?
এলে নাতো।
গত কাল গত পরশু গত যুগে
ইজ্জত পড়ে ছিলো নির্জলা।
রক্তাক্ত।মৃত।
কেউ খুঁটে খায়নি।
স্পর্শকাতর !
এতোটাই স্পর্শকাতর ছুঁলে খান খান
জুঁই ফুল ছড়িয়ে পড়ে অরণ্যে পাহাড়ে নদীতে।
সুচরিতা সেই গল্পের খাতা নিয়ে এসো
যত রাত হোক ঘর বাঁধব।

অনুপ দত্ত

2 কমেন্টস্
মুক্ত বেনী পিঠে সে মেয়ে
অনুপ দত্ত


মার মমতা স্বচ্ছলতা মাখা মুখ
সে মেয়ে৷
অজন্তা ইলোরা প্রথিত শ্যামাতন্বী
সে মেয়ে৷
ময়নাপাড়া মাঠে মুক্তবেনী পিঠে
সে মেয়ে৷

ভালবাসা কি জানে নির্ভুল কি যাচে
সে মেয়ে৷
কত হবে তার,কুড়ি বা অজন্তা হাজার
সে মেয়ে৷
ভালবাসা ভাঙ্গে বেদনা সে কি জানে
সে মেয়ে৷
ঘুনধরা একসমাজ কতটুকু জানে
সে মেয়ে৷

মু্ক্তবেনী পিঠের পরে ময়নাপাড়া হাটে
এখন যে আর হাট বসেনা৷
দিঘীর কোনে মেঘ জমেনা৷
কাঠ পিঠাতে আছাড় পেরে
ধান ভাঙ্গে না পল্লীবালা৷
চৈত্রমাসে শিং ফোঁটেনা পিঠের চামে৷
কেঁচো দিয়ে বঁড়শী ছিপে মাছ ওঠেনা এখন জলে৷
বনভোজনে চুরি করা মাংস খাওয়া মারামারি বন্ধু মিলে৷
আম করালী তেঁতুলছড়া শাড়ী কোঁছায় গুছিয়ে রাখা৷

এসব এখন মেলে না যে৷
সত্যি কি, এসব জানে কি
সে মেয়ে৷



কাশীনাথ গুঁই

1 কমেন্টস্
ট্রাপিজ
কাশীনাথ গুঁই


সার্কাসের ক্লাউনটা মাতিয়েছে এরিনাটা।
হাততালির বহরে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে অক্লেশে-
মাষ্টার খেলোয়ারও মাথা নিচু ক’রে দেখে।

পয়সা উসুলে মরিয়া দর্শকরা যাচ্ছে ভুলে-
ওরও শরীর আছে আমাদের মত রক্তেই ভ’রে।
ওর মনটাও ভালবাসতে জানে ভালবাসা খোঁজে।

পাদপ্রদীপের আলো যখন বিশ্রাম নিল
তাঁবুর কোনে ওর আগামীর প্রস্তুতি ঘুমটা কেড়েছে তখনও।

নতুন কায়দাতে লোক হাসাতে হবে নাহলে মজুরী কমবে।
নতুন শিহরনের জোগান দিতে ঝুঁকির পাহাড়ে চড়ে-
বিনা জালে ট্রাপিজের কসরতে শ্বাসরুদ্ধ করে দর্শক মজাতে হবে।

একচুল ভুলে জীবন সমাপ্ত হলে হবে তবু এগোতে হবে-
রাতে মদিরা মাংস তবেই মুফতসে মিলবে নারীদেহের সাথে।



গৌতম সেন

0 কমেন্টস্
একটি নিরুদ্দেশ কাহিনী
গৌতম সেন


যখন স্কুলের গন্ডিটা সসম্মানে উতরানো গেল
জীবনের গায়ে তখন নতুন জামার গন্ধ,
কৈশোর চুপিচুপি শুরু করেছে প্রেম-ভালবাসা
যৌবনের সাথে, ভাঙন ও ধরল কখন কে জানে
শুরু হল একা যৌবনের রাজ,
কিশোর আমি হারিয়ে গেলাম কখন অজান্তেই।
প্রলম্বিত এ জীবনযাত্রায় কেউ চিরসাথী নয়,
এভাবেই চলা আমার চলতে থাকল,
নতুন নতুন পথে, নিত্য নতুন পাথেয়র সাথে।
যা ছিল চলার নেশা, চলার আকর্ষণ –
বহুদিন পরে বোঝা গেল সে খুড়োর কল।
যতিচিহ্নর অবকাশহীন এই চড়ৈবতি নীতি
একে একে নিয়ে চলে গেছে বিনা অনুমতিতেই
শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক আমাকে- ধাপে ধাপে।
একমুখী এই রাস্তায় চলা যদি জীবন হয়
ফিরে আসা যায় না তো অতীতের কোনও প্রিয়ক্ষণে আবার,
বড় জোর ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে একটু চেয়ে দেখা।
পথ এগিয়ে চলে, পিছনে কুজ্ঝটিকা ঘন থেকে ঘনতর হয়।

অন্তিমের প্রতিক্ষালয়ে আজও এই রোমন্থন
জীবনের এক চিরন্তন নিরুদ্দেশ কাহিনী। 

প্রণব বসুরায়

4 কমেন্টস্
গুচ্ছকবিতা
প্রণব বসুরায়


( এক )
আঁচ উথলোয় মনে থাক,
সুপ্ত অভিজ্ঞানে...
ডাক এলো যেই বনে উতলা জংশনে ......
বৃষ্টি ভিজল তক্ষুণি, সেই ক্ষণে

ঈষৎ বাতাস বহে ফিসফিসিয়ে কহে...
ফিরলো কি কেউ ঘরে আলোর অন্ধকারে !

( তিন )
খুব হাঁকাহাঁকি শুনে,
সে, ধীর পায়ে দরজা খুলল।
নেমে এল উঠোনে।
দাঁড়াল লোকটির দিকে না তাকিয়ে।
মুখ নিচু করে।
শুনল সব, নিজে থাকল নিরুচ্চার।
দম নিতেই হয়ত, হাঁকাহাঁকিতে ক্ষণ-বিরতি নামল।
সে, আবার ধীর পায়ে উঠোন মাড়িয়ে,
সিঁড়ি মাড়িয়ে ঘরে উঠে গেল।
আগল দিল না---

( চার )
পুড়িয়েছি গা জলে ঢেকেছিও বল্কলে...
আঁধার নিকষ কালো মন্দ কি?
তা-ও ভালো
সূর্য ওঠার আগে দন্ড সাজাই ভাগে...
সজ্জা যে চাই নিজেরও বাহ্য সাজাই, ভিতরও

( পাঁচ )
আমাকে এ ঘরে একলা বসিয়ে
সে চলে যায় হাওয়া-পথে,
তবু টের পাই খুব,
ছায়া ছায়া...
আছি, যদি থাকা বলো একে
আরও কিছু শব্দের কারুকাজ বাকি থেকে গেল—
থাক...
ততটা সম্পন্ন আমি নই



দেবেশ ঠাকুর

1 কমেন্টস্
গণিত
দেবেশ ঠাকুর

হিসাব কিতাব নিয়েই বসো দিনের শেষে মনফকিরা
আজকে কিন্তু ত’বিল খাতায় কেউ লেখেনা রামপ্রসাদী
যেটুকু যার পাওনা গণ্ডা সবাই বোঝে , নিখুঁত বোঝে
কিছু কিছু অঙ্ক মেলান শুভঙ্করী , কিছু লালন

তুমি চাইলে একটি টাকা- ষোলো আনা – বস্তুগত
কৃষ্ণ দিলেন কাম ক্রোধাদি ছয়টি টাকা না চাইতেই
অসময়ে অস্থানে যা খরচ হল ফালতু খরচ
বৃষ্টি ধারায় কাঁদলে হবে রিপুর ছাতায় আতান্তরে?
বললে গণিত চর্চা আছে। বললে হবে খরচা আছে।

পাঁচ ইন্দ্রিয় ত্বক নাসাদি গুণিতকের পদক্ষেপে
আট কুঠুরি নয় দরোজায় ঢুকতে হবে সময় মেপে
বেঁচে থাকার জ্যামিতি আর টিকে থাকার নিপুণ গণিত
বুঝলে তুমি আর্কিমিডিস , না বুঝলেই হের হিটলার

ফুল ফোটানোর গণিত দিয়ে পটাতে যাও বান্ধবীকে
জানতে নাকো ঋতুচক্র চান্দ্রমাসে সমীকরণ
এবার তবে হিসেব নিয়ে অঙ্ক করো মনফকিরা।


হরিশঙ্কর রায়

0 কমেন্টস্
কালো
হরিশঙ্কর রায়



গত জীবনের আশীর্বাদে
যে আলো চোখে ফোটে
খুঁজি অহর্নিশ তাঁরে
প্রেমালাপটুকু শেষ হলে
দেখি অন্ধকার ।


ফাঁক থেকে যায় তালে
তবু হাতড়িয়ে ছুঁতে চাই
এই বুঝি তুঁমি !
নাহ্, আলো আসবে কী !

কালো থেকে কালোর কিনারেও

যেতে পারিনি ।

জয় (শমীক) সেনগুপ্ত

2 কমেন্টস্
বাংলা আমার
জয় (শমীক) সেনগুপ্ত

(A Tribute to My 1st Poem)



কতটা পথ পেড়িয়ে এলাম তোমায় ভুলে-
মনের কোনে অহংকারে পরকে নিয়ে মাতি;
তবু একুল ওকুল ছাপিয়ে দেখি স্বপ্ন ভাসে তুমি হয়ে !

ও মেয়ে দলামলা -

তুই মেয়ে আমার লক্ষ্মীর ছাপ তুলসীতলায়,
তুই আমার পিদিম জ্বালা সাঁঝ..
বারোমাসের খেরোর খাতায় তুমি
করে চল কাজ-ভোলাবার কাজ।
তুমি আমার মনের শুষ্ক কোনে
হঠাত করেই মায়ের গন্ধ আনো !
ও মেয়ে জোয়ারভাঁটায়
কবিতা হয়ে ধরা দিয়েও আমার হও না কেন?
তোমায় বেসে ভালো আমি কাঙাল হই রোজ,
খুঁজে না পাই থই !!

ও মেয়ে, তুই কি এখন রোজ গঙ্গার ঘাটে
সাঁতার কাটা ভিড়ের মাঝে ভিড়িস ?
এখনো কি সকালবেলার রোদে
মিঠে শিশিরের বুজকুরি সব ধরিস!!
এখনো কি ভরা আশ্বিন মেঘে শিউলি মেলে
আমায় ডাকিস তুই -
একটু কথার ছোঁয়া বাঁচিয়ে আমি
রোজই তোকে অনেক কথায় ছুঁই।

পড়ার ফাঁকেতে অপাঠ্যের এক চিলতে ফাঁকি-
আদর করেই সে সুখটাকে তোর নামেতে ডাকি;
আবার কখনো আগুন জ্বালানো ছারখার করা প্রাণ-
বারবার তোকে ঠোঁটেতে জড়িয়ে মৃত্যুকে করে দান
পূর্ণতা ।
মায়া মানবীর শরীরে খাঁজেতে তোমার কোমলতা
ভিজিয়েছে মন নিরালা গদ্যে,উচাটান করে হৃদি-
তুমি ছিলে তাই বৃষ্টি ঝরায় কবিতা নিরবধি।

তুমি ছিলে তাই একরাশ মুড়ি আড্ডায় হল সারা-
তোর জন্যই ভালবাসা-বাসি, যৌবন দিশেহারা।
শতরূপে আস মানবী বা দেবী, তণ্বী সুদর্শণা-
হারানো সে কথা আজ আবার বলি "তোমাকে ত ভুলবোনা.."
স্মৃতি-বিস্মৃতি স্বপ্ন-পরতে মানসী হয়ো গো তুমি,
বাংলা আমার জন্ম-মৃত্যু,আমার স্বর্গভূমি।।



ইন্দ্রানী সরকার

1 কমেন্টস্



দুই কবিতা
ইন্দ্রানী সরকার


(১)
রঙিন বসন্ত


রঙিন বসন্ত
শীত বিষণ্নতার
হাওয়া সরিয়ে দিয়ে
এলো ফাগুন
আমার ঘরের দুয়ারে ।

কোকিলের কুহু ডাকে
আকাশ বাতাস মুখরিত
আর মনের আকাশেও
রঙিন বসন্ত বিহারে ।

গাছে গাছে নব কিশলয়,
সবুজের সমারোহ
আনে আমার মনে সজীবতা,
চঞ্চল মন হল উদাসী ।

মহুয়া বনে অলি গুনগুন
দুই পায়ে নূপুরের নিক্কন
আনন্দে ভরে এই তনুমন
ভালোবাসার পৌর্ণমাসী ।

আকাশে ফাগুনের রঙ
বাতাসে তোমার বাঁশি
তোমারি রঙে রেঙে
তোমায় আমার পাওয়া |

মিলিয়ে নাও সব রঙ
চেয়ে নাও আরো রঙ
গুনে নাও যত স্বপ্ন
মনে তোমার ছোঁয়া ||

(২)
জোছনায় নামে ঝর্ণা


কাল রাতে গৃহত্যাগী জোছনা .....
ওই যে গো সেই কবিতাটা পড়নি ?
হ্যাঁ তাই বলছিলাম,
কাল রাতে গৃহত্যাগী জোছনা
নেমে এল আমার ব্যালকনি বেয়ে |
অস্পষ্ট তার মুখ ঘোমটায় ঢাকা
তার বুকে যেন পাহাড়ি শুন্যতা
আমি দরজা খুলে দিই,
একরাশ আলো নিয়ে সে ঢুকে পড়ে
ঘোমটা খুলে দেয়,
আমি অবাক চেয়ে থাকি !
জোছনা বেয়ে নেমে আসে পাহাড়ি ঝর্ণা |
আমি সেই গানটা গেয়ে উঠি,
‘ঝর্ণা, ঝর্ণা, সুন্দরী ঝর্ণা তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!’



শ্রীশুভ্র

0 কমেন্টস্
নারীজন্ম ও ব্যক্তিস্বাধীনতা
শ্রীশুভ্র



আধুনিক সমাজ সভ্যতায় নারীর অবস্থান সব দেশেই অল্পবিস্তর দিত্বীয় সারিতে। দিত্বীয় সারি কারণ আবিশ্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সংসার থেকে সামাজিক পরিকাঠামোয় এবং রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক স্তরে সর্বত্রই পুরুষতন্ত্রের হাতেই মূল কর্তৃত্বের চাবিকাঠি। ব্যক্তি নারীকে এই পরিসরেই তার ব্যক্তিস্বাধীনতাকে রচনা করে নেবার জন্য নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হয় আজীবন। ঘরে বাইরে সর্বত্রই তাকে এই পুরুষতন্ত্রের চোখ রাঙানির আশংকাকে মাথায় রেখেই চলাফেরা করতে হয় নিজের ব্যাক্তিস্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়েই। ফলে নিজের ব্যাক্তিস্বাধীনতাকে নিজের ইছামতো কার্যকর করা সম্ভব হয় না অধিকাংশ নারীর পক্ষেই। এই পরিসরেই সম্বচ্ছর নারীদিবস পালিত হচ্ছে বিশ্বজুরে কিন্তু এখন প্রশ্ন হল প্রতি বছর নারীদিবসের এই আনুষ্ঠানিকতায় নারীর ব্যাক্তি জীবনে কতটুকু সুফল ফলেছে। বা ফলেছে কিনা আদৌ?

অনেকেই বলবেন কেন ঘরে ঘরেই তো এযুগের নারীরা যথেষ্ঠই স্বাধীনতা ভোগ করে চলেন। এখানে একটা বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করার আছে। ‘যথেষ্ঠ স্বাধীনতা’ আর ‘ভোগ করে চলেন’। যথেষ্ঠ অর্থাৎ সম্পূর্ণ নয়। সম্পূর্ণ নয় কেন? কারণ এটা অর্জিত স্বাধীনতা নয়। পুরুষতন্ত্র স্বাধীনতার যতটুকু পরিসর যখন যেমন যেখানে যেমন দিয়েছে বা দিচ্ছে নারীকে, ঠিক ততটুকুই। তার বেশি নয় মোটে। এবং দ্বিতীয় যে কথাটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় সেটি হল ঐ ‘ভোগ করে চলেন’ যেন এটা তাদের ভোগ করার কথা নয়, অথচ সমাজ এখন তাদের এটা ভোগ করতে দিচ্ছে। এই দেওয়ার মধ্যে সমাজের যেন একটা বদান্যতাই প্রকাশ পাচ্ছে। লক্ষণীয় হল এইটাই যে এইটিই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন। আমাদের গোটা সমাজটাই নারীস্বাধীনতার বিষয়ে অল্পবিস্তর এই মনোভভাব পোষণ করে। আর ঠিক এই জায়গাতে এসেই ঠোক্কোর খায় নারীস্বধীনতার মূল বিষয়টি।

আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ঘর সংসারের পরিধিতেই নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার বাস্তব প্রেক্ষাপটটি তৈরী হয়ে যায়। গৃহস্থলীর পরিসরেই শৈশব থেকেই শিশুর ধারণায় পিতা মাতার ব্যক্তিস্বাধীনতার পৃথক ধরণটি মনের মধ্যে গেঁথে যায়। এবং বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথেই সেই ধারণাগুলি আরো পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে চেতন অবচেতন মনের চৌহদ্দিতে। যার থেকে আমরা সহজে আর বেরতেই পারি না। ফলে প্রেম বিবাহ ঘরসংসার সন্তান মানুষ করা থেকে সমাজ সংসারের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই ধারণাগুলিই আমাদের পরিচালিত করতে থাকে, কি নারী কি পুরুষকে।

বস্তুত আমাদের ব্যক্তিজীবনে পুরুষ তার ব্যক্তিগত মনোবৃত্তির আঙিনায় তার ভালোবাসার নারীকে, সে তার স্ত্রী কিম্বা কন্যা যাই হোক এমনকি জননী হলেও, যতখানি ভালোবাসতে পারে, ততখানিই স্বাধীনতা দিয়ে থাকে। অর্থাৎ বর্তমান যুগে নারীর ব্যাক্তিস্বাধীনতার প্রাথমিক পরিসরটিই নিয়ন্ত্রিত হয় তারই ভালোবাসার পিতা কিম্বা স্বামী এমনকি পুত্রের হাতে। আর এখানেই নারীর ব্যাক্তিস্বাধীনতার ধারণাটি সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খায়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাধীনতাটি যে ঘরের পুরুষের নিয়ন্ত্রানাধীন বা ইছাধীন সেকথা আমাদের অনেকেরই খেয়াল থাকে না স্বভাবতই। সমাজচর্চিত নারীবাদের অসারতার এইটি একটি দুঃখজনক দিক। দুঃখজনক কেননা নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাটি তার ঘরেই সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হতে থাকে। অথচ ওপর থেকে আমরা টের পাইনা তেমন। হ্যাঁ যে সব সংসারে নারী দৃশ্যতই অবরূদ্ধ, সরাসরি পুরুষের অঙ্গুলি হেলনে ওঠা বসা করতে বাধ্য হয় প্রতিনিয়ত, তাদের কথা আলাদা, সেখানে নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাবটি স্পষ্টতই ধরা পরে। বোঝা যায়। কিন্তু তথাকথিত প্রাগ্রসর পরিবারেও নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার সুতোটি যে ঘরের পুরুষদেরই হাতে থাকে সেকথা খোলা চোখে ধরা পরে না অধিকাংশ সময়েই।

আন্তর্জাতিক নারীদিবসের আবিশ্ব প্রচার ও উন্মাদনাতেও আমাদের ঘরগেরস্থলীতে নারীর ব্যাক্তিস্বাধীনতার পরিসরটি যেখানে যেমন, সেখানে ঠিক তেমনই দাঁড়িয়ে থাকে। তাতে আমাদের বিন্দুবিসর্গও কোনো পরিবর্ত্তন হয় না। না মনে না চেতনায়, না জীবনবোধের দীপ্তিতে না কর্ম পদ্ধতিতে। ফলে ঘরসংসারের চৌহদ্দিতেই আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে নারীদিবসের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। এই ধারণাটিকে আনুষ্ঠানিকতার বাইরে বের করে নিয়ে এসে আমাদের মন মনন মানসিকতার পরিবর্ত্তনের কাজে লাগাতে হবে অত্যন্ত সদর্থক ভাবে। মনে রাখতে হবে আমাদের চেতনার আমুল পরিবর্ত্তন ব্যাতিরেখে নারীদিবসের প্রাসঙ্গিকতা সার্থক করে তলা যাবে না কিছুতেই।

এখন কিভাবে সম্ভব চেতনার এই আমুল পরিবর্ত্তন? শুরু করতে হবে সেই ঘরগেরস্থলী থেকেই। শুরু করতে হবে শিশুর শৈশবের পরিসর থেকেই। শিশুর সামনে পিতা মাতার সমান ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসরটিকে প্রথমাবধি নিশ্চিত করতে হবে। পারস্পরিক নির্ভরতার সৌহার্দ্যের বাতাবরণটি পারস্পরিক শ্রদ্ধার বেদীমুলে যত দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, তত সুন্দর ভাবেই গড়ে উঠবে শিশুর চেতনায় পিতা মাতার সমান ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাটি। শৈশবের এই পরিবেশের প্রভাব শিশুর চেতনায় যে স্থায়ী প্রভাব ফেলবে, তার ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে তার ঐ মন মনন মানসিকতার ভিত, যার উপর দাঁড়িয়ে থাকবে তার পরবর্তী জীবনের নারীস্বাধীনতার চেতনার মুল ধারাটি। ঘরে ঘরে এই ভাবে শৈশব থেকেই চেতনার বিকাশ সংঘটিত হলেই সামাজিক পরিসরের অনেক বড়ো গণ্ডিতেই সার্থক হয়ে ওঠার সুযোগ থাকবে নারীদিবসের প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি।

ফলে ভবিষ্যতের নাগরিকদের সঠিক ভাবে গড়ে তোলার মধ্যে দিয়েই নারীর ব্যাক্তিস্বাধীনতার বিষয়টি সুনিশ্চিত হতে পারে। এখন দেখতে হবে কিসের উপর ঘর গেরস্থলীর চৌহদ্দিতে নারী পুরুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টি নির্ভরশীল? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ঘর সংসারের আর্থিক ব্যায়ভারের দায়িত্বটি যেদিন থেকে পুরোপুরি পুরুষের কাঁধে ন্যাস্ত হয়েছিল মূলত সেইদিন থেকেই নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টি গুরত্বহীন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সাংসারিক আর্থিক স্বাধীনতা পুরুষের করতলগত হওয়াই নারীর ব্যাক্তিস্বাধীনতার পরিসরটিকে সংকুচিত করে দেওয়ার মূল কারণ। আর এই কারণেই মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সচ্ছ্বল পাত্রের খোঁজ পড়ে এত বেশি। এটাই ধরে নেওয়া হয় সংসারের আর্থিক ব্যায়ভার পুরুষের এক্তিয়ার ভুক্ত, আর ঘরগেরস্থলী সামলানোর দায়িত্ব নারীর। কিন্তু জীবন ধারণের জন্য আর্থিক স্বনির্ভরতা যেহেতু সবচেয়ে বড়ো বিষয়, সেইহেতু সংসারে পুরুষের একাধিপত্য নারীর ব্যাক্তিস্বাধীনতার পরিসরটিকেই সংকুচিত করে দেয়। বর্তমানে দিন অনেক বদলিয়েছে। ঘরে ঘরেই স্বামীস্ত্রী উপার্জনশীল, কিন্তু পুরুষ একাধিপত্যের চিত্রটি কিন্তু এতটুকু বদলায়নি। তার আরো দুইটি কারণ রয়েছে। প্রথমত দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামীর রোজগার স্ত্রীর রোজগারের থেকে বেশি ফলে সংসারের নীতি নির্ধারণ থেকে সংসার পরিচালনা, গুরুত্বপুর্ণ সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহন, সব বিষয়েই স্ত্রী স্বামীর উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল, যার ফলে স্ত্রীর ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসর স্ত্রীর নিজের গরজেই সংকুচিত। দ্বিতীয়ত, সামাজিক পরিসরে পুরুষ একাধিপত্যের প্রভাবে এবং আজন্ম লালিত চেতনায়, আর্থিক ভাবে বলশালী পুরুষ না্রীর ব্যক্তিসাধীনতাকে স্বীকার করতেই রাজী নয়। ফলত এই বিষম ব্যাক্তিস্বাধীনতার পরিসরটিকে দ্রুত বদলাতে না পারলে সমাজ সংসারের পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন সম্ভবই নয়।

সুনন্দা চক্রবর্তী

1 কমেন্টস্
আমরা যারা
সুনন্দা চক্রবর্তী



সেই মেয়েবেলা থেকেই শুনি-
নারী শরীরের বর্ণনা,মাপ,রংগ কত কিছু-
সুতনু,মোমের মত গায়ের রংগ,
কালো হরিণ চোখ,মেঘ বরণ কেশ. সব-
পদ্মিনি,শন্খিনী,কামিনী.
আর আমরা যারা মেয়েরা-
ফিগার নিয়ে মাথা ঘামাইনা,
রোজ ত্বক মার্জনা করিনা,কালো-কেলো- রূপের সাগর নই
-তাদের নিয়ে কেউ তো তোলেনা লেখনী.
আমরা যারা কথায় কথায ঝগড়া,তর্কে,যুক্তি তে মেতে উঠি,
লেখা লেখি করি,
স্বামীকে প্রভুত্ব করতে দিই না-বন্ধু মানি.
হাতে,সারিতে হলুদ ছোপ –
সেই রমনীর কথা কেউ বলোনি.
আমরা যারা তোমাদের হাতে হাতে মিষ্টি সংসার গড়ে তুলি,
কত কষ্টে সন্তানের জন্ম দি,
তাদের বড় করে তুলি-
নিজেকে ভুলে যাই.
তাদের পুরোপুরি কেউ বোঝোনি. 


মামনি দত্ত

1 কমেন্টস্
অভিমান
মামনি দত্ত


এক অধ্যায়ের শেষ প্রান্তে এসে_
আমার দুচোখ থেকে চেয়েছো অতীত বেলা।
অনন্তে মিলিয়েছি আলোর কথা,
এখন অন্তস্রোত নির্দিষ্ট অন্ধকার বোঝে।
সন্ধ্যামেঘ বুকে রেখে-ছুটে বেড়িয়েছি
অফিস পাড়া, মেডিক্যাল হোম, টিউশনি –
আরও কতো জায়গা।
প্রকৃতি কর্তব্য বোধ মুক্তির পথ চেনায় নি আজন্ম কাল।
আজ তোমার হাতে অহেতুক জড়িয়ে যাবে
উজ্জ্বল নয় এমন কথাগুলো !
তবুও তুমি এক অসম্ভবের কাছে দুহাত বাড়িয়ে রেখেছো --
দ্যাখো –
গত কয়েক শতাব্দী ধরে,
ভোরের স্নিগ্ধতায় অজস্র তেতো অশৌচ ঢেলে দিয়েছে ওরা,
নাগরিক সভ্যতায় যারা বহুরূপী কিন্তু মানুষ নামের অপচয়।
এ মন দ্যাখো –
এই ক্ষয়ে যাওয়া দ্যাখো –
স্তব্ধতার গায়ে শিশিরের আল্পনা দ্যাখো –
এ উৎসর্গ দ্যাখো – এ
নিবেদন দ্যাখো -
সম্পর্কের বুননে জাগিয়ে চাইছো –
ভোর, চাঁদ, জোছনাময়ী সময়।
হে পুরুষ!
এমন মায়াময় বেলায় তুমি শুধু অতীতমুখী হয়েই থেকোনা। 


মনোজিৎ দত্ত

0 কমেন্টস্
নারী
মনোজিৎ দত্ত


আমি -
পৃথিবীর সবচেয়ে স্রোতস্বী নদী
তোমায় উৎসর্গ করলাম
তুমি -
দুঃখ ভাসিয়ে দিও
সবচেয়ে গম্ভীর পাহাড়
আজ থেকে তোমার
তুমি ওখানে সুখ এঁকে রেখো
আমার প্রিয় হলুদ পাখীটা
আজ তোমার নামে ছাড়লাম
ওর পাতলা নরম ঠোঁটে
তোমার স্বপ্ন গুঁজে দিও।
এর পর তুমি এসো ...

নারী জানতে চাইলো ... কোথায়?

ঐখানে -
যেখানে ... পাহাড়
নদীর সঙ্গে কথা বলে ... একান্তে
যেখানে আমার হলুদ পাখী
টুপটাপ ডুব দেয় নদীতে ...

নারীতো বিষ্ময়ে হতবাক ...
তবে কেন নয় এখন?

পুরুষ হেসে উঠে ...
জানো না বুঝি ...
নারীরা সুখ-দুঃখ-স্বপ্নহীন
হলেই ... বেশী রমনীয় হয়

অতঃপর নারী আসলো
নদীতে ডুব দিলো –
দুঃখ গায়ে মাখলো আবার ...

পুরুষ স্তম্ভিত ... একি!

নারী -
জল-রঙে ছল ছল হেসে উঠে
... সুখ – স্বপ্ন তোমায় দিলাম
... দুঃখটা আমারই থাক



পূর্বা

0 কমেন্টস্
নারীদিবসের গান
পূর্বা



কাকভোরে উঠে পড়া, কাক স্নানে অশুচি স্খালন
হুটোপুটি রান্নাঘর; হুটোপুটি সংসার পালন।
ভিড় ঠেসে বাস ট্রেন, অঙ্গ ঠেসে কেউ চাখে সুখ
কর্মক্ষেত্রে কেউ কেউ 'গভীরে যাও' শোনাতে উন্মুখ।

এ ঘটনা রোজকার, মাঝে একটি-দুটি অঘটন
মোমবাতির বিক্রি বাড়ে, ঘরে বাড়ে তীর্যক বচন।
তিন'শ চৌষট্টি দিন নাড়ী বয় নরকের টানে
নারীদিবসের গান জানি না কি মানা বয়ে আনে।



রীতা ঘোষ

0 কমেন্টস্
নারী
রীতা ঘোষ


তুমি বিদুষী , তুমি মহীয়সী , তুমি রূপসী
বিধাতার অদ্ভুত সৃষ্টি , তুমি নারী ।
তুমি শান্ত , তুমি স্নিগ্ধ , তুমি শর্মিলী
মহিষাসুরমর্দিনী , তুমি চণ্ডী , তুমিই কালী ।
তুমি সীতা , তুমি সাবিত্রী , তুমিই বেহুলা
মাতা কুন্তী , স্ত্রী গান্ধারী , অভাগী ঊর্মিলা ।
তুমি দুহিতা , তুমি ঘরণী , তুমিই মাতা
তুমি বন্ধু , তুমি ভগিনী , প্রিয়তমা ।
তুমি দেবদাসী , তুমি ধর্ষিতা , তুমি পতিতা
তবু তোমার ভিটের মাটিতেই মায়ের আস্থা ।
তুমি প্রেম , তুমি পূজা , তুমি অনন্যা
তোমায় পেয়ে সমাজ সংসার ধন্যা ।

তোমার রূপেই আঁধার ঘুচে আলো
তোমার গুণেই খারাপ যত ভালো ।
তোমার পুণ্যে সুখের প্রদীপ জ্বলে
তোমার পাপে ধরা রসাতলে ।
তোমার বিচার , তোমার বুদ্ধিমত্তা
তোমার শক্তি , যুক্তি, তর্ক , স্বত্বা ।
তোমার হাসিতে লুকোনো বোবা কান্না
তোমার ছোঁয়ায় ভালোবাসার বন্যা ।

পুষ্প যেমন অপরের তরে নিজেরে বিলায়
তোমার জীবন উৎসর্গ স্নেহ মমতায় ।
উজাড় করে সর্বস্ব ভরাও সংসার
তোমার গর্ভেই নড়েচড়ে উত্তরাধিকার ।
তোমার সহ্য , তোমার ধৈর্য , আদর - যত্ন
হায় ! পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে আজও পণ্য ।
লাঞ্ছনা , গঞ্জনা , অবহেলা , অনাদর
তবুও সফল যাত্রাপথে উন্নত তব শির ।

ক্ষমা , ত্যাগ , আহিংসা , সত্য প্রচারে তোলো আওয়াজ
তোমার পদক্ষেপই আনবে বিপ্লব , বদলে দেবে সমাজ ।

তুষ্টি ভট্টাচার্য

2 কমেন্টস্
নারী দিবস
তুষ্টি ভট্টাচার্য


নারী দিবসে একটা গোলাপ দিও কেউ
কাঁটা বেছে সুক্তো করব খানিক
নারী দিবসে একটা চাবুক দিও কেউ
পুরনো দাগটা ফিকে হয়েছে অনেক
নারী দিবসে একটা কবিতা দিও কেউ
ঘুম পারানি গান শিখে নেব
নারী দিবসে একটা শিকল দিও কেউ
নূপুর করে পায়ে বেঁধে নেব ...

রিয়া

2 কমেন্টস্
এই দেশ আমার দেশ
রিয়া



দেশ এগোচ্ছে, এগোচ্ছি আমরাও।তবে মধ্যযুগীয়ও লেজ কিন্তু ছাড়িনি এখনও।আজও আমরা কন্যাভ্রুনের রক্তনিয়ে হোলী খেলি,আজও কন্যারা বিক্রি হয়, জোগায় বাবার নেশার টাকা, আর আজও ধর্মের দোহাই দিয়ে বিয়ে হয় পাথরের সাথে, গাছের সাথে।এরপর হয় ক্রীতদাসী, দেবদাসী, যোগিনী।তারপর কোন নাম না জানা নিষিদ্ধপল্লির চামেলি বাই।দেশ তো এগোচ্ছে, এগোচ্ছি তো আমরাও।

মিছিলে মিটিং-এ সৃজনে, ছন্দে মুখর আমরা,চায়ের কাপে তুফান তুলে আধুনিক আমরা। কিন্তু মেয়েদের যে ইচ্ছে ডানাগুলো , তাদের যে গোপন ব্যাথা? তার কি কোন যায়গা নেই এই আধুনিক সমাজে?যখনই তারা একটু মুক্তির আশায় আকাশের নীল খুঁজে বেড়িয়েছে, ঠিক তখনই নীল আকাশকে পুড়তে দেখেছে, আকাশের গায়ে আগুণ দিয়ে লিখেছে 'স্বাহা'। এখানে মুক্তো ভাবে ওড়ার কোন আকাশ নেই। যেখানে সতীর দেহ ফালা ফালা করে একান্নপীঠ হয়, সেখানে পুকুরে, নদীতে লাঞ্ছিতাদের লাশ ভেসে উঠবেই। ক্ষমতা, রাষ্ট্র, হিংস্রতা যে হাতধরেই পথ চলে।

সভত্যা যদি এই রকম হয়, তবে দিকে দিকে গৃহযুদ্ধ বাধুক। পলাশ, শিমুলের হাত ছেড়ে দিকে দিকে গাইতে হবে সত্যিকারের সভ্যতার গান। রাষ্ট্র আর পিতৃতন্ত্রের গর্ভগৃহ উপড়ে ফেলে গাইতে হবে শিকল ভাঙার গান।

" বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙে দাও..."

সীমা ব্যানার্জ্জী রায়

3 কমেন্টস্
(গল্প)

ঘরের মধ্যে ঘর
সীমা ব্যানার্জ্জী রায়



গাড়ি থেকে নেমেই ঝড়ের বেগে কল্পতরু ওরফে তুষার বাড়িতে ঢুকল। ব্রীফকেস সোফাসেটে রেখেই …

- মাম্পি ইই...মাম্পি! মা -কে দেখেছি না যে। মা কোথাও গেছেন? কিছু বলে গেছেন তোমাকে?

- -জানি না, কি যে করেন! কোথায় যাবেন, কদিন থাকবেন। কিছুই বলার প্রয়োজন বোধ করেন না । যবে থেকে বিয়ে হয়েছে তবে থেকেই তো দেখে আসছি একই রকম ব্যবহার। “ মাম্পি, আমি বেরোচ্ছি। কদিন পর ফিরবো, বুম্বাকে বলে দিও”- কোথায় যাচ্ছেন? জিগেস করার সাথে সাথেই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। শাশুড়িমা তো কখনোই কিছু বলেন না। না, বলার প্রয়োজন বোধ করেন না। নিজের জেদেই তো থাকেন সর্বদা দেখি। শুনেছিলাম, বাড়ির কর্তারাই এইরকম ব্যবহার করেন? কিন্তু শাশুড়িমা তো একজন আমার মতোই গৃহবধূ-ই ছিলেন একদিন।

এ বাড়িতে মাম্পির আসার কথা নয়। অনেক টালবাহানা , অনেক অশান্তির পর একমাত্র পুত্র কল্পতরুর দুর্দান্ত ভালবাসার কাছে দোর্দন্ড প্রতাপশালী মাকে শেষপর্যন্ত হার মানতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে আমেরিকাবাসী মেয়ের ফোনাঘাত, পত্রাঘাত তো ছিলই। আর ছিল মাম্পির রূপ আর শিক্ষার জৌলুস। এখন সংসার যাত্রার অন্তরালে চলেছে দুই নারীর ব্যক্তিত্বের ঠান্ডা লড়াই। এ লড়াইয়ে তুষার কোনোমতেই সামিল হতে রাজি নয়।

মেয়ে তো আগেই মনের মতো সঙ্গী জুটিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে, স্বামী তারও আগে জীবন থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন স্ত্রীকে পেনসন বরাদ্দ করে। শাশুড়ি মন্দিরা দেবী রাতদিন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলে বৌ কি করছে না করছে দেখার তার সময় নেই। বাড়িটা ওঁর নামে, মোটা পেনসন পান, একটা নিজের নামে গাড়ি আছে। হাতে একটা বাহারি বড় ব্যাগ, একটা ভ্যানিটি ব্যাগ তো থাকেই যেখানেই যান না কেন। চুলে কলপ, বাঁধানো ঝকঝকে দাঁত, এই বয়সে বহু আয়াসে ধরে রাখা টানতান ত্বক , ঈর্ষণীয় ৫৩ কেজি ফিগার, সুন্দর সাজপোশাক, মুখে মানানসই মেক আপ- একটা আলগা ব্যক্তিত্ব আছে মানতেই হবে। তবু কি যেন একটা নেই। বয়স ষাটের দিকে, তবু কচি খুকি সেজে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। সে থাকুন না, খারাপ নয়। কিন্তু ঔদ্ধত্য-টাকে সহ্য করা যায় না। সেখানে তার মা -বড়লোক হওয়া সত্বেও নিজের ব্যাপারে কত উদাসীন। মনে মনে পাশাপাশি দাঁড় করায় দুজনকে। মায়ের প্রসাধণ বলতে শীতে একটু অলিভ ওয়েল আর বোরোলীন। বাবা মারা যাবার আগে, দাদা একটু বড় হতেই রঙীন শাড়ি ছেড়েছেন। বাবা বলতেন, “যৌবনে যোগিনী, যত সব সেকেলেপনা।” কেউ কেউ বলতেন, “সুন্দরীরা যা পড়ে, তাই মানিয়ে যায়।” মা শরৎ চাট্টুজ্জ্যের বিন্দুর কায়দায় বলতেন, “ছিঃ! ছেলে মেয়ে বড় হলে মায়ের সাজের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। ছিঃ কি লজ্জা।”

আগে তুষারদের অবস্থা নাকি মধ্যবিত্ত-দের চেয়েও খারাপ ছিল। তবে এ সংসারের বৃদ্ধির মূলে নাকি শাশুড়িমার বুদ্ধি আর অসাধারণ চালিকা শক্তি। দুই যমজ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বড্ড বেকায়দায় পড়ে যায় মাঝে মাঝে। আর দুজনে হয়েছেও তেমনি দুরন্ত। সবে ওদের অন্নপ্রাশন হয়েছে। শাশুড়িমা থাকলে তাও মাঝে মাঝে ওনার কাছে রেখে আসত মাম্পি। উনি আগেই বলে দিয়েছিলেন যেঃ -বাচ্চা হলে সামলাবে তুমি আর তুষার মিলে। আমি আর এই বয়সে ঝুট ঝামেলা নিতে পারব না মনে থাকে যেন। তখন আবার এইসব নিয়ে কোন রকম অশান্তির সৃষ্টি না হয় , তার জন্য আমি সব আগে থেকেই বলে রাখলাম। -তাও ওনার কাছে দিয়ে আসলে কিছুক্ষণ-এর জন্য তো রেহাই পাওয়া যায়। হাজার হোক নিজের রক্তের সম্পর্ক আর কচি খুদেদের ভালবাসার টান। আঁতুরে থাকতে ভেবেছিল মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে আর বাচ্চাদের ৬ মাস করে তবে আসবে। সে গুড়ে বালি-এক মাস যেতে না যেতেই চলে আসতে হল। বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য একটা আয়া রাখা হল। সেটাও ওনার পছন্দ নয়, বলেন আমার নাতিরা কেন আয়ার কাছে থাকবে? কি সাঙ্ঘাতিক যুক্তি। ওনার হুকুমেই তো সব কিছু চলে। ছেলেকে বোঝালেন যে, বাড়িতে সব কিছুর কাজের লোক আছে, বাচ্চাদের একটু দেখবে তাও পারবে না? তাহলে মা হলো কেন? তুষার মায়ের মুখের ওপর কথা বলে না। জানে, জবাব দিয়ে লাভ নেই, উপরি পাওনা কিছুই হবে না। তার বদলে মায়ের কাছে বোবার মতন গুচ্ছের কথা শোনা ঢের ভালো। ভেবেছিল মা -কে এনে রাখবে, কিন্তু মা সেই আগেকার দিনের পন্থা মেনে চলে, বলেঃ -ছিঃ! জামাইবাড়ি থাকতে নেই।

তুষার-কে বললে বলে,

- -দিভাইকে দেখো, একলা সব কেমন সামলাচ্ছে। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ। কি করে সামলাচ্ছে? আর তুমি ঘরে বসে এটুকু করতে পারছো না?

মাম্পি চুপ হয়ে যায় আজকাল। শুধু মনে মনে বলে

- “ জোর করে তো বিয়ে করলে । আমার কত শখ ছিল পি এইচ ডি করতে বাইরে চলে যাব।

জি আর ই তে খুব ভাল নম্বরও পেয়েছিল। বাবারও তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তুষার তখন বলেছিল যে, সে এখানেই পি এইচ ডি -টা করে ফেলতে পারবে। তার কোন আপত্তি নেই। আর কেউ আপত্তিও করবে না।” অথচ বৌ্দির কি মজা! ওকে দেখে রীতিমত হিংসে হয়। বৌ্দি কি সুন্দর ঝাড়া হাত-পা হয়ে আছে। মা আর ঠাকুমা মিলে কি সুন্দর ভাবে মানুষ করছে পিকাই কে।

- -“হ্যাঁ! আমাদের লেখক শংকর অনেক আগেই ওঁদের 'দশভুজা' সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কিন্তু স্বামী্রা ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর হয়ে ওঁদের সাহায্য না করলে আমাদের মতো দ্বি্ভুজা হয়ে হাত কামড়াতে হত।”

খালি কথায় তো আর সমস্যা মেটে না। একদিন কথা বলতে বলতে দুঃখ করে মাম্পি তুষারকে বললঃ

-তোমার যদি সেই অবিবাহিতা পিসীমা বেঁচে থাকতেন য়াজ, তাহলে আর আমাদের এত চিন্তা করতে হত না। উনি তো তোমাকেও মানুষ করেছিলেন। মা বাবা মরা ভাইকে নিজে মানুষ করে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। আহা! সারাজীবন তোমাদের দেখা শুনা করেই নিজের জীবন কাটিয়ে দিলেন। নিজের বলতে তো তোমরাই ছিলে। বড্ড মনে পড়ে তোমার সেই পাম্মা-র কথা। আগের দিনের মানুষেরা অনেক কিছু মানিয়ে নিতে পারেন। আমার ঠাকুমা তো বিরাশী বছর বয়স। আর কিছু না পারুন, আমার বৌ্দির ছেলেকে কাছ ছাড়া করেন না। -আবার ভেবে বোসো না যেন, যে নিজের সুবিধার জন্য পাম্মা -পাম্মা করছি। এই স্ংসারের রিমোট কন্ট্রোল তোমার মায়ের হাতে। আজ নিজে সব সুখ সুবিধা উপড়ে নিয়েছিলেন পাম্মা-র কাছ থেকে । আর আমার বেলায় উনি ফালতু ঝক্কি সামলাতে পারবেন না, স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। ইশ! আজ যদি তোমার পাম্মা থাকতেন।

মাম্পির কথা শেষ হতে না হতেই তুষার বলে ফেলল,
-আমার পাম্মা তো বেঁচে আছেন, উনি আছেন কাশীতে। বাবা বেঁচে থাকতে কতদিন মাকে লুকিয়ে আমি আর বাবা পোস্টঅফিসে মানি অর্ডার পাঠিয়েছি পাম্মাকে কাশীতে। তারপর এখন আর তোমাদের নিয়ে এতো ঝামেলায় জড়িয়ে পরেছি যে, পাম্মার কথা ভাববার সময় পাই কই? শেষে পাম্মা এলেও এই ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাবেন এই বয়সে? -'

- কি বল্লে, পাম্মা বেঁচে আছেন? অথচ এবাড়িতে তাঁর নামও শুনি না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ, ধিক্কার তোমাদের মানসিকতা-কে। তুমি ভেবো না আজ আমার দরকারের জন্য পাম্মাকে আমি দয়া দাক্ষিণ্য দেখাচ্ছি। একদম না। সবার ধারণা! নারী দুঃখ বহন করে পুরুষদের অত্যাচারে কিন্তু নারী-ই যে নারীর পরম শত্রু তাও জানা হয়ে গেল আমার আজ। -অন্ততঃ তুমি তো আমাকে বিয়ের পর বলতে পারতে। দুজনে হানিমুন থেকে গিয়ে ওনার আশীর্বাদ নিতে- দেখা করতে পারতাম? তোমার মা কি জানতে পারতেন? না, মা-এর মনে দুঃখ হবে ভেবেছিলে? সত্যি ধিক তোমরা। তোমরা আবার সব শিক্ষিত , আপার স্ট্যাটাস এর লোক বলে বড়াই করে বেড়াও। -কাশী বৃন্দাবনে দুঃখী দের কথা খবরের খুব ঘটা করে বেরোচ্ছে। দীপা মেহেতার 'ওয়াটার' তোমাদের গর্বের সমুদ্রকে ঘোলা করে ছেড়েছে। কয়েকদিন আগে টি ভি তে 'জননী দেবী' সিনেমা দেখে লজ্জায় বাঁচি না। তোমরাও ওই কুকর্ম করেছো! ছোটবেলায় 'পথের পাঁচালী' পড়তে গিয়ে ইন্দির ঠাকরুণকে তাড়ানো মেনে নিতে পারি নি। ওদের সংসারে তবু সর্বগ্রাসী অভাব ছিল। আর তিনিও ছিলেন বিধবা, কিন্তু অবিবাহিতা পাম্মা তো সর্বত্যাগী? নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিলেন ছোটবেলায় মা হারা ভাইকে মানুষ করবার জন্য। আর আজ তিনি সেই আশ্রয়টুকু থেকেও বঞ্চিত? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! -অথচ দিভাই বলেন ওদেশে নাকি সিনিয়ার সিটিজেনকে ওরা সম্মান দিচ্ছে। ঘটা করে আন্তর্জাতিক বৃদ্ধবর্ষ পালন করছে। তোমরা তো সব ওদেশের মতো মেনে চলছো তবে এটার বেলায় নয় কেন? সত্যি আমার ভিষণ ঘেন্না করছে তোমাদের এই ব্যবহারটার জন্য।”

- আচ্ছা বাবাঃ আর শোনাতে হবে না। মা যখন নেই এখানে। চলো না আমরা গিয়ে দেখি কি অবস্থা।

-কি অবস্থা মানে? কিসের কি অবস্থা? সোজা চলো পাম্মাকে নিয়ে আসব। কেন তিনি থাকবেন না এই বাড়ীতে। এবাড়ীতে থাকার সম্পূর্ণ অধিকার আছে পাম্মার।

কয়েকদিনপর মাম্পির শাশুড়ি মন্দিরা ফিরে এলেন। মুখে বিজয়ের হাসি। বোনেরা মিলে শলাপরামর্শ করে সব বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। ভাইদের থেকে বিপুল সম্পত্তির ভাগ বাগিয়ে এনেছেন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকেই তো চক্ষু চরখগাছ। মুখের হাসি মুখের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিল- নির্বাসিতা ননদ শেফালিকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। শুধু তাই নয় ওনার কোলে তখন নাতি -নাতনি খেলা করছে। এদিকে তিনি তো ভাই-এর বৌকে দেখে ভয়ে তটস্থ। তাও মুখে একটু ম্লান হাসি এনে বললেনঃ –

- “জানো মন্দিরা! বিশ্বাস করো, আমি আসতে চাই নি, কিন্তু এরা হঠাত আমাকে গিয়ে নিয়ে এসেছে, সাথে আমার আদরের দাদাভাইরা,, মুখগুলো ঠিক আমার সোনা ভাইটার মতন , তাই আর ওদের কথা উপেক্ষা করতে পারলাম না। -আমার ভাই বলো, সন্তান বলো সব ছিল আমার ভাইটু। তাকে শেষ দেখা ও দেখতে পেলাম না, তাই মনে হল ওই যেন আবার এসেছে ছোট্ট নাতি-নাতনিদের মধ্যে, আর আমার দিকে কেমন খালি তাকিয়ে আছে দেখছো?

মন্দিরা দেবী তো মনে মনে অসম্ভব গালাগালি দিচ্ছিলেন ননদকে। কিন্তু মুখে এনে বল্লেন, -

- না না ঠিক আছে , ভালোই তো কদিন থাকুন না আমাদের কাছে , সবার -ই ভালো লাগবে।

মুখে একটু ফোকলা দাঁতে করূন হাসি এনে ননদ বল্লেনঃ –

- মন্দিরা! আমাকে আর ফিরে যেতে বোলো না ওখানে, কদিন আর বাঁচবো? আমার বড্ড কষ্ট সেখানে। এখানে এক কোণে থাকবো । তোমাদের কাউকে আমি কোন অসুবিধা হতে দেবো না। সব সময় কি আর হরিনামে পেট ভরে, বলো? তখন বয়স কম ছিল, ভালো লাগতো। পাপ্পু একটু বড় হবার পরই তো তোমরা রেখে এসেছিলে। কিন্তু একবার যখন তোমাদের পেয়েছি আর হারাতে চাই না, আর কটা দিনই বা বাঁচব!

খয়াটে হয়ে যাওয়া দু চোখ দিয়ে ননদের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। মাম্পি আর তুষার তাড়াতাড়ি পাম্মার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে গলা জড়িয়ে বল্লঃ

- -পাম্মা! তোমাকে একদিন মা তা-র সংসা্রের কর্তৃ থাকাকালিন গিয়ে রেখে এসেছিল, আজ আমরা তোমাকে ফিরিয়ে এনেছি, যেখানে আমরা থাকবো তুমিও সেখানে থাকবে আর আত্মমর্যাদায় থাকবে বাকি জীবন। মা-এর আপত্তি থাকলে মা একা থাকবে এ বাড়িতে। মা জানবে কি ভয়ংকর জীবন এই একা জীবন।

মন্দিরা -র আর মুখে কথা নেই, আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে পা চালালেন। ভাইদের কাছ থেকে যোগ্য পাওনা যে আনন্দ দিতে পারে নি, আজ তার ছেলে -পুত্রবধূ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যোগ্য পাওনা কাকে বলে? মেনে নিলেন তিনি নিজের অক্ষমতার বিচার। বুঝলেন, টাকাটাই সব নয় জীবনে। বুঝিয়ে দিল তারই গর্ভের সন্তান আর তার পুত্রবধূ।

লাভলী ভট্টাচার্য্য

0 কমেন্টস্
(গল্প)

প্রতিবিম্ব ...
লাভলী ভট্টাচার্য্য



মাঝেই রিয়ার মনে হয়...সেই একলা বারান্দায় যখন বসে , সব কাজের শেষে , রাই তখন ঘুমে আচ্ছন্ন ,তার সাত বছরের মেয়ে । এই সময় টুকু শুধু রিয়ার নিজস্ব , একদম একা ,কিন্তু তবুও বহু চরিত্র তার আসে পাশে । বেশ অনেকটা বছর কেটে গেলো , বিদেশে । এবার আর নয় , ফিরে যাবে সে তার পৈতৃক বাড়ীতে । এখানে আর কিছু নেই ।
...... কলেজে বরাবরই খুব ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করতো রিয়া ।আর মা বাবার একমাত্র মেয়ে , রূপে গুণে অনন্যা ,বাবার টাকা পয়সার অভাব ছিলনা ,তাই সবাই একটু অন্য নজরে দেখত তাকে , বন্ধুত্ত্ব করতে এগিয়ে আসা বন্ধুও কম ছিলনা ।কিন্তু রিয়া এড়িয়ে চলতো সবাইকে । শুধু ভালো লাগতো তার অনু কে । খুব সাধারণ পরিবারের মেয়ে হয়েও এতো অসাধারণ কি করে হতে পারে ,অনু, সেটাই ছিল তার কৌতুহল । কলেজে আসার পথে , মাঝরাস্তায় তার নিজস্ব গাড়ি থেকে নেমে পড়তো রিয়া । এগিয়ে আসতো অনুর দিকে , হাঁটাপথে অনেক কথা হোতো দুজনে । কিন্তু রোজ খেয়াল করতো কলেজ ছুটির পর ,অনুর কথায় যেন যাওয়ার এক বিষম তাড়া ।একদিন রিয়া বায়না করে, "অনু, আজ আমাকেও নিয়ে চল "। অনু ...হেসে উত্তর দিতো , "তোর মাথা খারাপ ? মেসোমশাই জানতে পারলে তোর কি হবে ভাবতে পারিস ? তোর গানের ক্লাস আছে , তুই যা "। মন খারাপ করে ফিরে আসতো রিয়া ।
......একদিন রিয়া প্রায় রাগারাগি করেই অনুর সঙ্গ নেয় । অনু সেদিন আর বাধা দেয়নি । যখন ওরা পৌঁছল ,তখন প্রায় সন্ধ্যে । কি অপূর্ব পরিবেশ , কত নিষ্পাপ শিশুর প্রাণখোলা হাসি মুখ । ওদের কেউ নেই...মানসিক আর শারীরিক ভাবে ওরা অসুস্থ । ওদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে অনু রিয়াকে নিয়ে গেলো ,সেখানেই এক বিশাল চিত্র প্রদর্শনী দেখতে । রিয়া মুগ্ধ হয়ে দেখেই গেলো , কি অপূর্ব সব ছবি ,সব ছবির নীচে লেখা "সৌম্য" । রিয়া অনেক গুলো ছবি কিনে নিয়ে সেদিন ফিরে এলো । সব কটা ছবিতে কত রূপে সাজানো নারীর মুখ , অসামান্য ...দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার ঠিক নেই । সকালে মনে হল একবার সেই চিত্রকর কে তার প্রশংসা জানানো উচিৎ ।কালকের কাগজ টা খুলে ...সৌম্য নামের পাশে তার নম্বর টা চোখে পড়লো , কথা হল ...কি অপূর্ব তার কথা বলার ভঙ্গী ।প্রায় সমবয়সী ওরা ,তাই দুদিনেই আপনি থেকে তুমি হল , কাজের ফাঁকে ,পড়ার ফাঁকে অনেকটা সময় কথা হোতো ।এক অদ্ভুত আকর্ষণ রিয়া অনুভব করলো । রিয়া একদিন বলেই ফেলে ,"আমাকে তো দেখনি, পারবে একদিন দেখা হলে ,সবার মাঝে চিনতে ?" সৌম্য হেসে উত্তর দেয় ..."যে আমার এতোগুলো ছবি একদিনে কিনে নিয়ে যেতে পারে ,তাঁকে দেখার ইচ্ছে আমার হয়েছিল বলেই, সেদিন দূর থেকে তোমাকে আমি দেখেছি "।
...অবশেষে কলেজের সমাপ্তি । রিয়ার ইচ্ছে হয় অনুর সাথে ওখানে যদি সেও পড়াতে পারতো ?? কিন্তু মা বাবা রাজী হবেন না ।সৌম্য কে যদি সারাজীবনের জন্যে সঙ্গি করতে পারতো ??না, তাও মা বাবা দেবেন না। ও তো বড়লোক নয় , ও শুধু আঁকে । মায়ের কাছে আজ সে বলে দেখবে । যদি............

প্রতিবিম্ব ... ২...
কলেজের শেষ দিন ,সবার সাথে আড্ডার পর , রিয়া বাড়ি ফিরল ...আজ সে মায়ের কাছে খাওয়ার টেবিলে কিছু মনের কথা জানাবে । কিছুক্ষণ পর মায়ের সেই ডাক ,মামনি খেতে আয় ।রিয়া বসে, একসাথে ।
মা...রিয়া , আজ একটা দারুণ খবর আছে ,তোর বাবা একটু আগে ফিরেছেন ।আমরা কলকাতা ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছি ।বাকি জীবন ওখানেই কাটাবো ।
রিয়া...মা ,আমার কিছু বলার ছিল ।আমি এখানেই থাকতে চাই ,নিজে কিছু করতে চাই ।
মা...সে হয়না, তুই আমাদের একমাত্র সন্তান ।তোকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারলেই আমাদের শান্তি ।তখন ওখানে না হয় কিছু করিস নিজের ইচ্ছে মতন ।বাবা কোনও কথা শুনবেন না।আর তোর জন্যে সুপাত্র বাবা ঠিক করে ফেলেছেন।ছেলেও বিদেশে থাকে ।আর কোনও কথা শুনতে চাইনা ।
রিয়া এক বুক ব্যথা নিয়ে ঘরে ফেরে ।না আর নয় ।আজকেই সে সব খুলে বলবে সৌম্য কে ।
রিয়া ...হ্যালো ,সৌম্য , আমি কাল তোমার সাথে দেখা করতে চাই ।এখনও তুমি একদিনও দেখা করনি। আমি তোমাকে ভালবাসি আর কাওকে না জানিয়ে আমি তোমার সাথে চলে যেতে চাই ।বল ,আমার দায়িত্ত্ব নিতে পারবে কিনা ?
সৌম্য ...রিয়া ,পাগল হয়ে গেলে নাকি ? তুমি জানো কি বলছ ? আমার টাকা চাই ,অনেক অনেক , আমার সামনে অনেক কাজ ।আমাকে ভুলে যেও , সুখে থেকো ,অনেক ভালো থেকো ।কোনোদিন সুযোগ হলে আমার সেই স্বপ্নের প্রতিমা তোমাকে নিশ্চয়ই দেখাবো ।
রিয়া বাকরুদ্ধ ।তারপর একটা কথাও বলেনি। শুধু সৌম্যর পেইন্টিং গুলোর দিকে একবুক ঘেন্না নিয়ে তাকিয়ে থাকে ।
অবশেষে নতুন জায়গায় নতুন জীবন । সুমিতের সাথে বিয়ে হয়ে যায় ,রিয়ার । অনেক সম্পতির মালিক সুমিত । কিন্তু সেকি ,তার কল্পনার সংসার বাস্তবে কোথায় ? সুমিত সারাদিন ব্যস্ত , সময় নেই ।রিয়াকেও পার্টি যেতে হয় অনিচ্ছা সত্ত্বে । হারিয়ে গেলো রিয়া ,এক নতুন জগতে । মা বাবার কাছে যাওয়ার ইচ্ছেটাও যেন কোথায় হারিয়ে যায় ।এভাবেই কটা বছর , শুধু নিজেকে হারিয়ে বেঁচে থাকা ।অবশেষে একদিন রিয়ার জীবনে আলো করে এলো আরও একটি জীবন ...রাই ।রিয়ার নতুন করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা । জন্মের পর অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেও রাই কাঁদেনি ।ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন , রাই আর কথা বলবে না। মেনে নিতে হয় ।ঐটুকু মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরে রাই কে। আস্তে আস্তে রাই বড় হয় ,কিন্তু নাহ , এখানেও বিধাতা একটু বেশী পরিহাস করে ফেলেছিলেন হয়তো । অন্য বাচ্চাদের মত বোঝার ক্ষমতা হয়না রাই এর ।নিয়তির পরিহাস কষ্ট হলেও মেনে নিতে হয় রিয়াকে । সুমিত এর জন্যে দায়ী করে রিয়া কে ।আর বোধহয় মানসিক জোর ছিলনা রিয়ার । শেষ পর্যন্ত আইন আদালত ।বাবার বাড়ি তে ফিরে আসে রিয়া , মা বাবা দুবছর আগেই চলে গেছেন , রিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করে , পরলোকে ।......বৃষ্টির শব্দে ঘোর কাটে রিয়ার । অনেক রাত হল ।।কাল সকালেই বেরোতে হবে ... কলকাতা ফিরবে । একদিন যেই ইচ্ছে ছিল অনেক বাচ্চার মাঝখানে থেকে ,আজ হয়তো ভগবান তার মেয়ের মধ্যে সেই অসুস্থতা দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন , দেখতে চাইলেন রিয়ার সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা , লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ...

কলকাতা ...অনেক কিছুর সাক্ষী ।বাড়িতে ফেরে রিয়া , সাথে রাই । কি বিশাল বাড়ি , কেউ নেই , কি করে থাকবে রিয়া এতো বড় বাড়িতে একা ... একটা ফোন করলে হয়না অনুকে ? অনু ফোন ধরে , আজ একটু একটু করে সব কথা জানতে পারে অনু রিয়ার কাছ থেকে । ভরসা দেয় ,"তোর রাই কথা বলবেই ,আমি এক জায়গায় নিয়ে যাবো ,যেখানে অনেক বাচ্চা আজ সুস্থ ।আমি শান্তিনিকেতন আছি , এখানেই থাকি, তুই চলে আয় কাল ।"
রিয়া ...কিন্তু আমার যে অনেক টাকার দরকার রাই এর জন্যে । আমাকে একটা ছোট বাড়ি দেখে দে ,এখানে আমি হাফিয়ে উঠেছি একদিনেই ।আমি এই বাড়ি বিক্রি করে দেবো ।
অনু ...তুই এখানে এলে বুঝতে পারবি , রিয়া ,এখানে ওর চিকিৎসা করাতে কোনও খরচা লাগবে না । তুই কাল চলে আয় ।
রিয়া পরদিন শান্তিনিকেতন চলে আসে । অনুর সাথে অনেকদিন পর দেখা ,ওরা দুজনেই শিক্ষকতা করে ।ওদের সুখী পরিবার দেখে রিয়া খুব খুশী হয়।
রিয়া এবার আসল কথায় চলে আসে ..."অনু ,আমার একটা চাকরি খুঁজে দিতে পারিস , এই ধর তোর স্কুলে । আর রাই এর জন্যে একটা ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা ..."
অনু পরদিন রিয়াকে নিয়ে যায় তার সেই প্রতিষ্ঠানে । ঘুরে দেখায় ...অনেকটা জায়গা জুড়ে এই প্রতিষ্ঠান ।অনুর ক্লাস ছিল, তাই রাই এর ফর্ম ফিলআপ করতে রিয়াকে একাই যেতে হয় । রিয়া দরজা খুলে ভেতরে যায় ,সুন্দর সাজানো একটা ঘর । দেওয়ালে কারও মা বাবার ছবি । পাশে দুয়েকটা পেইন্টিং ।একটা নাম ...লেখা সৌম্য সুন্দর রায় । চমকে ওঠে রিয়া । বেরিয়ে আসতে চায় তখনই ...কিন্তু চোখ আটকে যায় ,সামনে রাখা পেইন্টিং এ , সেই লাল শাড়িটা , সেদিন গিয়েছিলো সে , সৌম্যর ছবি কিনতে । দুটো পা রিয়ার কাঁপতে থাকে ।এমন সময় , সৌম্য ,..." বোসো , আমি অনুর কাছে সব শুনেছি, তোমার রাই কথা বলবে , ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক জীবন । আমি কথা দিচ্ছি , আর তোমার অনেক প্রশ্ন তাইনা ? এই পেইন্টিং টা সেদিন এঁকে ছিলাম , যেদিন প্রথম তোমায় দেখেছিলাম , এই আমার মানস প্রতিমা । আমার বা দিকের কলম টা একটু এনে দেবে ? কোনোদিনও কাওকে আনতে বলিনি , কারণ আমি স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে চেয়েছিলাম , আমার বা হাত টা অচল , আজ বহুদিন , আমি কি করে তোমাকে দুহাত বাড়িয়ে দিতাম বল তো ? আমার টাকার দরকার ছিল, হ্যাঁয় , এই সব বাচ্চাদের জন্যে , যেখানে সবাই নিজের মত , একদম সুস্থ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে । আমাকে তুমি ক্ষমা কর ।"
রিয়া কিছু বলতে পারেনি , সেই মুহূর্তে ...শুধু নিজের পেইন্টিং টায় হাত বুলিয়ে নিলো কিছুক্ষণ , হয়তো সেই রিয়া কে একবার খুঁজে পেতে । তারপর বলে ফেলে , "সৌম্য , এখানে একটা চাকরি করে দিতে পারো আমার , আমি আমার বাড়ি বিক্রি করে দেবো । একটা থাকার ব্যবস্থা হতে পারে ?? এদের মাঝখানে ?? আমি যে শারীরিক বিকলাঙ্গ নই , মানসিক বিকলাঙ্গ ।" সৌম্য ...মুখে কিছু বলেনি , চোখের ভাষায় জানিয়ে দেয় , তার সম্মতি ।
......অনুর বারান্দায় আজ রিয়া ,আবারও একা । কিন্তু মানসিক কোনও ভার নেই , এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ শান্তিনিকেতনের , রবি ঠাকুর তাই এখানে হয়তো এতো কাব্যের সৃষ্টি করেছিলেন। একবার মনেহল , রিয়ার , পুরনো আবৃত্তির সিডি টা , কলেজে পড়া কালীন যেটা করেছিল , একবার শুনলে মন্দ হয়না ।
চলতে শুরু করে , বাইরে আবছা আঁধার , আধখোলা জানালা...।
..."গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
"কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, "বলব।"
মাঝপথেই লোডশেডিং , ভালো লাগলো রিয়ার ......বাকীটুকু নিজেই বলে ফেলে আপন মনে ..।।
"আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।"
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, "থাক্‌, এখন যাও ও দিকে।"
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশন.
আমি চললেম একা"..

...না একা নই ,আমার রাই এর মাঝে জাগিয়ে তুলবো আরেক রিয়া কে ...আমার রাই মানুষ হবে , রিয়ার মত হারিয়ে যাবেনা ...যেতে দেবনা কোনোদিন ... ...আমি নতুন করে বাঁচবো ........

সৌমেন্দ্র লাহিড়ী

0 কমেন্টস্
(ছোটগল্প)

ভিজিটিং কার্ড

সৌমেন্দ্র লাহিড়ী



পাখী আজ একমাস পর বিউটি পার্লারে গিয়েছিল । আসার সময় লিপষ্টিক নেলপালিশ আরো টুকিটাকি কিনে ফিরেছে । যদিও দেখতে সে খুবই সুন্দর তবুও সবসময়েই সেজেগুঁজে থাকতে ভালবাসে । পাড়ার সবাই তাকে ভালবাসে তনুমাসি তো চোখে হারায় । তাছাড়া পাখী মাত্র পনের বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে, তাই হয়ত সকলের ভালবাসা একটু বেশীই পায় ।

মা চলে যাবার আট বছর হয়ে গেছে । বেশ ছিল ছোটবেলার দিনগুলো মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেত, দুপাশে দুটো ছোট্ট বিনুনি ঝুলিয়ে , সবাই গাল টিপে আদর করত । সারাদিন মায়ের কাছে থাকলেও বিকেলের পর থেকে সে তনুমাসির কাছেই থাকত , তনুমাসিকে পাখীর মাও মাসি ডাকত ।


পাখী ধীরে ধীরে কখন যেবড় হয়ে গেছে বুঝতেও পারে নি । মা - কিএকটা রোগে ভূগে ভূগে চলে গেল । প্রথমে কিছু চিকিৎসা হলেও, পরে বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেছে । ক' দিন খুব কেঁদেছিল পাখী - পৃথিবীতে আপন বলে ঐ একজনই ছিল । কিন্তু পেট বড় দায় - শুরু হলো নতুন জীবন । মায়ের জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয় নি পাখীর । ছোটবেলা থেকেই তো মাকে দেখে এসেছে । যেটুকু অস্বস্তি ছিল তাও তনুমাসির দৌলতে কেটে গেছে । এখন পাখী এ পাড়ার আকর্ষণ- মধ্যমণি ।

দুপুরে খাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নেওয়া অভ্যেস পাখীর - কিন্তু, আজ আর হলো না । কি মনে হলো - মায়ের পুরানো টিনের বাক্সটা খুললো । মায়ের গোলাপী শাড়ীটা এখনও প্রায় নতুন আছে , মাত্র দু একদিন পরেছিল । শাড়ীটা তুলে নিলো , মাকে এই শাড়ীটাতে দারুণ লাগত - আজ এই শাড়ীটাই পরবে । শাড়ীর পাশে সেই পুঁটুলি, যেটা মা যত্ন করে রাখত । খোলার ইচ্ছে হয়নি কোনদিন ,তাছাড়া তেমন প্রয়োজনও হয় নি । পুঁটুলিটা রেখে শাড়ীটা নিয়ে উঠে পড়ল পাখী ।


শাড়ীটা খুব সুন্দর করে পড়ল পাখী । নতুন কেনা গোলাপী নেলপালিশটা যত্ন করে পরল । ফুঁ দিয়ে দিয়ে নেলপালিশটা তাড়াতাড়ি শুকাল পাখী । শুরু করল মেকআপ- ধীরে ধীরে সুন্দর পাখী অপরুপ হয়ে উঠল । আয়নাতে নিজেকে আজ বেশীই ভাল লাগল পাখীর ।

আজ আর বাইরে দাঁড়ানোর দরকার নেই । তনুমাসি সকালেই বলে গেছে । ঘরে বসেই অপেক্ষা করতে লাগল পাখী- কখন দরজায় টোকা পড়ে । বেশীক্ষণ বসতে হলো না - ঠিক সময়েই দরজায় টোকা পড়ল । দরজা খুলে দেখল- তনুমাসি আর এক খদ্দের, বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, ধোপদুরস্ত পোশাক - খুশীই হলো পাখী । এদের কাছে একটু বেশীই পাওয়া যায় । তনুমাসি চলে গেল লোকটা ঘরে ঢুকল ।

অল্প সময়েই পাখী বুঝতে পারল লোকটা একদম আনকোড়া নয় । ঘন্টা দুয়েক সময় কেটে গেল । লোকটা উঠে দাঁড়াল । পাখীও নিজেকে সাব্যস্ত করে তুলল ।

লোকটা পকেট থেকে টাকা বের করে পাখীর হাতে দিল - পাখীও অভ্যস্ত হাতে গুনে দেখল - অন্যদিন যা পায় তার থেকে অনেকবেশীই আছে । লোকটা এবার একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বললো -" তুমি আমায় খুশী করে দিয়েছো, যদি কখনও দরকার পড়ে যোগাযোগ করো" । কার্ড হাতে নিয়ে পাখী দাঁড়িয়ে থাকল- লোকটা ধীরে ধীরে বেড়িয়ে গেল ।

মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল পাখীর - অন্যদিন তো এমন হয় না, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল । টাকাগুলো বালিশের তলায় রেখে ভিজিটিং কার্ডটা ভাল করে দেখতে লাগল । হঠাৎ দেওয়ালে ঝোলানো মাকালীর ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডারের দিকে নজর পড়ল পাখীর - আজ- আজই তো মায়ের মৃত্যুদিন, চোখ থেকে জল চলে এলো । ছুটে গেল পুরানো টিনের বাক্সটার দিকে - মায়ের একটু ছোঁয়া নিতে । বাক্সটা খুলে প্রথমেই নজরে পড়ল পুঁটুলিটার দিকে, তুলে নিয়ে বসল বিছানায় । খুব যত্নে পুঁটুলিটা খুলল - মায়ের একটা পুরানো জরা জীর্ণ ফোটো , একজোড়া রুপোর দূল , একটা ভাঙা নুপুর - ওগুলো বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল ।আরে ছবিটার পেছনে আটকে আছে একটা পুরানো পোষ্টকার্ড । পোষ্টকার্ড খুলে নিল ফোটোর থেকে ।


মায়ের লেখা একটা ছোট্ট চিঠি । ঠিকানা ভূল হওয়ায় ফিরে এসেছিল । লেখা মাত্র কয়েকটা শব্দ - "বাবু তোমার মেয়ে হয়েছে , মা হয়ে আমি চাই না ও এখানে থাকুক ,আপনি এই নরক থেকে ওকে নিয়ে যান , আমার প্রণাম নেবেন । ইতি রমলা" । চিঠিটা পড়েই তাড়াতাড়ি উল্টে দেখল ঠিকানাটা ,কিন্তু - ঠিকানাটাই তো ভূল, নামটা পড়ল - আরে ,এই নামটাই তো একটু আগে লোকটার দেওয়া ভিজিটিং কার্ডে ...................

স্তব্ধ হয়েগেল পাখী । নিঃশব্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল । নিজের নারীত্বকে খুব ঘৃণা হতে লাগল - খুন করতে ইচ্ছা করল নিজেকে, না পেরে নিজের তলপেটে আপ্রাণ ঘুঁষি মারতে শুরু করল ।

দরজায় আবার টোকা - শব্দটা আরো জোরদার হতে লাগল ।

মনোজিৎ দত্ত

0 কমেন্টস্
(অনুগল্প)

ছেলে
মনোজিৎ দত্ত



এ নিয়ে তিন নম্বর। তিনটাই মেয়ে। প্রতিবারই মায়ের কপালে অশান্তি ... দূর্ভোগ। গালিগালাজ। নবাগতা অযত্নে - অবহেলায় ... মায়ের শুকনো বুকে যতটা দুধ আছে - তা দিয়েই বড় হয়ে উঠা। অপুষ্টি চোখে মুখে। ছেলে ছেলে করে তিন তিনটি মেয়েকে ন্যুনতম সময়ের ফারাকে পেটে ধরে মায়ের অবস্থাও একই রকম। বাবার তবুও নিদেন পক্ষে একটা ছেলে চাই। তৃতীয় বারের পর দুবছরের মাথায় আবার একজন এল পেটে। আসা মাত্রই চেঁচামিচি - হুঙ্কার শুরু। এবার ছেলে না হলে রক্ষে নেই। ডাক্তার বাবু যে বারবারই বুঝিয়ে আসছেন -... ছেলে-মেয়ে সমান... কিংবা লিঙ্গ নির্ধারণে ক্রোমোজোমের খেলায় পুরুষরাই দায়ী ... বাবা তা মানতে রাজী নন। শেষ চেষ্টা ... বাবাকে জিততেই হবে।


অবশেষে এল সেই দিন। অপেক্ষা আর কিছুক্ষণের। মার কাছে প্রসব বেদনার চেয়েও ভারী হয়ে উঠে বাবার ফরমান - এবারে রক্ষে নেই। ছেলেই হল। মার মুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস। হাসি উবে গেছে কবে ... তবুও স্বামীর একটু হাসি দেখবেন। যত্নের অভাব হল না - ছেলের। এবারে অ -আ-ক-খ নয় ... এ-বি-সি-ডি ... করে করে .. এম. টেক্ ছেলে এখন আমেরিকায় ... মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ... স্বপ্ন সফলের দৌড়ে ছক্কা মারছে।


বড় মেয়েটা ভালবাসার টানে ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। মা ওপারে গেছেন অনেক আগেই। ছেলে কয়টা টাকা পাঠিয়ে বলেছিল ... টেক ক্যায়ার। মেয়েরা কেঊ কলেজের চৌকাঠ দেখেনি। পেনশনের টাকা বাবার ওষুধের তলেই যায়। চালের জন্য মেয়ে দুটির বাড়ি বাড়ি অ -আ-ক-খ বিক্রী করতে হয়। মাঝে মাঝে ছেলে ক’টা টাকা পাঠিয়ে ম্যাসেজ করে ... টেক ক্যায়ার।।

শম্পা বসু

1 কমেন্টস্
দূরে কোথায় দূরে দূরে
শম্পা বসু



মনটা ভারাক্রান্ত হয়েছিল প্রথম থেকেই। বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজোর উচ্ছ্বাসে গা ভাসাতে পারবো না এবার ! বাড়ির কর্তামশাইটি দেখে শুনে দেবীপক্ষের তৃতীয়ার দিনের টিকিট এনে হাজির। জায়গাটি লোভনীয়। ভূস্বর্গ কাশ্মীর; কিন্তু ওই পুজোর কটা দিনের জন্যেই যে সারা বছর আকুল হয়ে অপেক্ষা করা! তবু ছেলে মেয়ের উজ্জ্বল চোখের আনন্দের কাছে নিজের বাসনাকে বিসর্জন দেওয়াতেই তো সুখ। ওদের আনন্দেই তো মা বাবার জীবনের পূর্ণতা। সঙ্গে যাবেন আরও চার পাঁচজন আত্মীয় পরিজন। বিমান - টিকিট হাতে পাওয়ার পর থেকেই দেখি আমারও যেন শৈশব সুলভ চাপল্য ফিরে এসেছে, ঘিরে ধরেছে আমাকে। এতদিন শুধু ভূগোলেই পড়েছি ডাল লেকের সৌন্দর্যের কথা , কাশ্মীর নাকি ভূস্বর্গ। এবার ইন্টারনেট খুলে দেখতে লাগলাম দ্রষ্টব্য স্থানগুলো। শুধু কি তাই ? ভ্রমণ রসিক স্বামীটিও ছেলে মেয়ের জন্যে খুঁজে খুঁজে ওই পুজোর বাজারের ভিড়ের মধ্যে থেকে কিনে আনতে লাগলেন শীতের পোশাক । মানে প্রস্তুতির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছনোর প্রচেষ্টা ।

যথারীতি এসে পড়ল সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ । চারিদিকে মণ্ডপসজ্জা শেষের মুখে ; আলোকসজ্জাও প্রায় সুসম্পন্ন ; এরই মধ্যে কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে তৃতীয়ার দিন ভোরে পৌঁছলাম দমদম বিমানবন্দরে । প্রথমে দিল্লির উড়ান , তারপর সেখান থেকে শ্রীনগর । দিল্লী থেকে শ্রীনগরের ওই যাত্রাপথটুকু খুব বেশীক্ষণের নয় , কিন্তু জানলার ধারে বসে ওই উচ্চতা থেকে শ্রীনগর শহরটাকে দেখা যে কত রমণীয় হতে পারে , তা অবর্ণনীয় । মেঘের মধ্যে দিয়ে ভেসে যাওয়া , আর নীচে পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে তুষারধবল শিখর দেখে শিহরিত হয়ে ওঠা - আমার কিশোরী মেয়ে আর ছোট ছেলের বিস্ময় - কৌতূহল আমাদের মনকেও ভরিয়ে তুলছিল আনন্দে ।

ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে তুলনা করা হয় সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ।কিন্তু হিমালয় যে আল্পসের চেয়ে কিছু কম নয় ,বেশিই বরং-- এই ভাবতে ভাবতে কখন যে পৌঁছে গেছি শ্রীনগর বিমানবন্দরে , তা খেয়াল করিনি । বাইরে দশজনের সেই দলকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন সদ্য পরিচিত হামিদ ভাই , কিন্তু তাঁর আন্তরিকতায় আমরা তখন মুগ্ধ । ভাবা যায়! হৃদ রোগী আমার ননদ ওই উচ্চতায় উঠে যদি কোন শ্বাসকষ্ট জনিত অসুবিধায় ভোগেন , তাই তিনি ছটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে উপস্থিত । টাটা উইংগারে চলেছি দশজন । ঝাউগাছ আর লতানে গুল্মের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দলের দুই কচি কাঁচা গেয়ে উঠছিল "চেন্নাই এক্সপ্রেস" এর সদ্য জনপ্রিয় বহুল প্রচারিত গানটি ..."কাশ্মীর হ্যায় ", তালে তাল মেলাচ্ছিলাম না কি আমরাও ? চারিদিকে স্লোপিং রুফের বাড়ি, মনে পড়ছিল খবরের কাগজের ছবিতে দেখা তুষারপাতের কথা । পথে চাপদাড়ি যুবক , বোরখা ঢাকা যুবতী আর মোড়ে মোড়ে সি আর পি এর জওয়ানদের ভ্যান গাড়ি দেখে অনুভব করলাম কাশ্মীরের প্রতিকূলতা । পথে পড়ল রাজবারগ পার্ক । ঝিলামকে দেখলাম একঝলক । সেই ঝিলাম , রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন , "সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলামের স্রোতখানি বাঁকা " ...সেই বাঁকা স্রোত দেখিনি তখন , কারণ মধ্যাহ্ন ভোজের তাড়া । পথের ধারেই ধাবাখানা । আমাদের দলের দেড় বছরের বিতান আবার 'চলন্ত" । একটু থামলেই মুশকিল । তাই তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে এলাম ডাল লেকে । সেই স্বপ্নের লেক । বহু প্রতীক্ষিত । এ যে সমুদ্রের চেয়েও বিস্তীর্ণ । আর লেকটির চারিদিকে বিস্তীর্ণ পাহাড় । সে কী বিচিত্র বরণ পর্বতের । কোথাও ধূসর , কোথাও হালকা কৃষ্ণবর্ণ আর তারই কোল ঘেঁষে অসংখ্য হাউসবোট । সেই হাউসবোটে নিয়ে যাবার জন্যে কূলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র শিকারা । তিনটি শিকারা নিয়ে ভাসমান হলাম আমরা । একটাতে শুধু লটবহর , আর দুটিতে আমরা সবাই । হামিদ ভাই হাউসবোটে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন । বাচ্চারা দাপাদাপি করতেই বোট যেন দুলে উঠলো খানিক । মুগ্ধ হয়ে গেলাম তার অন্দরসজ্জায় । আখরোট কাঠ দিয়ে তৈরি অপরূপ আসবাবপত্র। হাত মুখ ধুয়ে শিকারায় চড়ে ডাল লেক ভ্রমণের পালা এবার । শিকারায় উঠে চালক একটু মজা করে নৌকো হেলাতেই আমার পুত্রের মুখে জল টলমল । পাশে এসে গেল আরও দুটি শিকারা । ফটো তোলা ওদের পেশা । ওই শিকারাতেই ওদের সাজসজ্জার উপকরণ । ছেলে মেয়ে তো কাশ্মীরি সাজলোই , দেখতেও লাগছিলো অপূর্ব আর আমরাই বা বাদ যাই কেন ? ঝুপ করে এর মধ্যে নেমে এল অন্ধকার ।

শীতের আমেজ , সেখানে লেকের ওপরেই ভাসমান পোস্ট অফিস , ওষুধের দোকান , আর শাল – ফিরান – কোটের দোকান । পর্যটকরাই ওদের প্রধান ভরসা । তাই সাদর আমন্ত্রণের অভাব নেই । কিন্তু তখন আমরা ক্লান্ত । তাই লেকের কিছুটা ঘুরে আমরা এলাম হাউসবোটে , রাতের বেলা যেন পরী সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে রঙিন আলোর হাউসবোটের পসরা নিয়ে সেই একই ডাল লেক সুন্দরী । মাত্র একদিনের রাত্রিযাপন এখানে , তাই বারান্দায় বসে উপভোগ করছিলাম সেই নিশীথিনীর সৌন্দর্য । কিন্তু ক্লান্তিজনিত ঘুম ডেকে নিল বিছানায় , আর সকালে ঘুম ভাঙ্গল ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দে । ভূস্বর্গ বৃষ্টিস্বর্গে পৌঁছে গেল নাকি ? মেঘের সঙ্গে রোদের লুকোচুরি খেলায় সঙ্গী হয়ে আমরা প্রাতরাশ সেরে রওনা দিলাম পহেলগামের উদ্দেশে । হাল্কা ঠাণ্ডা তখন চিনার বনের মধ্যে । ঝিলামের ধারে ধারে চিনারের এই অভিভাবকত্ব মুঘল আমল থেকে । আর এই চিনারকে নিয়ে কাশ্মীরিদের খুব গর্ব । সবুজতায় আর রাজকীয়তায় পূর্ণ । পরে মনে পড়লো কাশ্মীরি শালে এই চিনার পাতার প্রতিচ্ছায়াই তো লক্ষণীয় ।

যাত্রাপথটিও তো ভারি মনোরম । চারিদিকে সবুজ উপত্যকার মাঝে মেঘ , তারই মধ্যে “আমরা এমনি এসে ভেসে যাই” । টোল বুথে পয়সা ফেলে বেলাবেলি পহেলগামের হোটেল ‘হিভানের’ সামনে যখন গাড়ি এসে থামল তখন মনে হল “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি” । সামনে বইছে খরস্রোতা লিডার নদী । নুড়ি পাথর , পার্বত্য উপত্যকা , সবুজ বনানী তারই সঙ্গে মাঠে চরে বেড়ানো ভেড়ার পাল ---আমার কিশোরী কন্যা তো ভাইকে জড়িয়ে ধরে ঘুরে নিল একপাক । বিকেলবেলা বাকি আমরা কফির আমেজে ডুবে গিয়ে পাহাড়ের কোণে কোণে বরফ খোঁজার একটা বৃথা চেষ্টা করতে লাগলাম। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এত ভাল লাগছিল যে , মনে হল দু’দিন না থেকে আরও কিছুদিন থাকার পরিকল্পনা করলে ভাল হত । ধীরে ধীরে শীতল আবহ নেমে এল চারিদিকে । রাতের প্রকৃতি এখানে গম্ভীর , স্তব্ধ । আর নদীর জলের মৃদু কলধ্বনি সেই স্তব্ধতাকে করে তুলছে আরও গহন, গভীর । কাশ্মীরি ডিনারে সুস্বাদু কাশ্মীরি খানা । গরগরে , মশলাদার মাটন গুস্তাবা আর রিস্তা । সাথে গরম রুটি । কিন্তু মনটা ভারাক্রান্ত হল যখন শুনলাম গুলমার্গ –এ গিয়েও বরফের দেখা মিলবে না ।

কিন্তু পথ যে বড় সুন্দর , যাবার পথে পড়ল আপেল বাগান । যে কাশ্মীরি আপেল কেনার জন্যে মানুষ অপেক্ষা করে থাকে , তা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে ওখানে । গাছ থেকে ফল পেড়ে খাচ্ছে প্রায় সকল পর্যটক ই ।

এরপর এল পৃথিবীর সবথেকে উঁচু গলফ কোর্স । আমাদের গাড়ি সেই পথ পেরিয়ে আরও আরও পাইন আর দেওদারের মধ্যে দিয়ে এসে পৌঁছল মস আর ফার্ন ঘেরা কাঠের হোটেল এর সামনে । কিন্তু গিয়ে শুনলাম সন্ধ্যের আগে সেখানে প্রবেশ করা যাবে না , সেদিনের জন্যে ওখানকার সরকার কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল । কিন্তু আতিথেয়তার কোন ত্রুটি রাখেন নি তারা । একটা ছোট্ট কটেজে কিছুক্ষণের জন্যে থাকতে দিল তারা আমাদের । সঙ্গে গরম চিকেন পকোড়া । চারিদিকে শুধু নির্জনতা আর ধূম অন্ধকার । তারপর সন্ধে নামতে হোটেলের দিকে যাত্রা । উঁচুতে উঠতে আমার ননদ কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় হামিদ ভাইয়ের জোগাড় করা অক্সিজেন কাজে লাগলো এবার । পরের দিন গন্ডোলা যাত্রা । লাইন দিয়ে টিকিট কাটা হল । দুটি টাওয়ার আছে সেই পাহাড়ে । পাহাড়ের নির্জনতা , স্তব্ধতা , গাম্ভীর্য সবই যেন বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে ভ্রমণার্থীদের ফেলে যাওয়া বিস্কুটের প্যাকেট, চিপস এর প্যাকেট, কোল্ড ড্রিঙ্কসের স্ট্র-এর আবর্জনায় । দ্বিতীয় টাওয়ারের একেবারে উঁচুতে গ্লেসিয়ারে কিছু বরফের সন্ধান পাওয়া গেল ; কিন্তু তুষারাবৃত পাহাড়কে দেখতে না পাওয়ার দুঃখ মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। শতবার বলে এলাম তুমি আবার ডাকবে তো? এরপর শ্রীনগর ফেরা । কিছু কেনাকাটা । কবে ভূস্বর্গ তার তুষার ধবল সৌন্দর্য নিয়ে আবার ডাকবে আমায় কে জানে ।

যে জম্মু ও কাশ্মীর মাঝে মাঝেই হয়ে ওঠে অশান্তির বার্তা বাহী, সেই ভূস্বর্গেই এত আন্তরিকতার স্বাদ পেয়েছি সাধারণ মানুষের কাছে, তা না বললে কাশ্মীর ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । বৃষ্টি ভেজা শহরে মীর ও হামিদ ভাই যেভাবে আমাদের উষ্ণ আতিথেয়তায় শহর ঘুরিয়েছে, মেয়ের আবদারে দেখিয়েছে কাশ্মীর ইউনিভার্সিটি, সাদরে নিয়ে গেছে আখরোট কাঠের কারখানায়- কাঠের শিল্পকর্ম সেখানে দেখার মত । গয়নার বাক্স, বালা , চাবির রিং , ট্রে--- কী অপূর্ব শিল্পকর্ম সে সবের ।

“যাবার সময় হল বিহঙ্গের”-যাত্রা শেষের বেলায় আর একবার ডাল লেকের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কোন সীমা যেন নেই তার । “ধ্যানগম্ভীর ভূধর” আর সুবিস্তৃত জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনা করছিলাম শীতকালীন সেই স্থানটির , যখন সাধারণ জনজীবন থেকে তারা হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন । কিন্তু সেই সৌন্দর্য? তা কি শুধু ছবিতেই থাকবে ধরা ? মনে মনে উচ্চারণ করলাম ‘ভূস্বর্গ , তুমি বিচ্ছিন্ন হোয়ো না সুবিশাল ভারতবর্ষের বুক থেকে’। ফের যেন ডাক পাই তোমার।

মৌ দাশগুপ্তা

3 কমেন্টস্
নেপথ্য শিকার
মূল কাহিনী : মিকাঈল নাঈমী
অনুবাদ: মৌ দাশগুপ্তা


(মিকাঈল নাঈমী (১৮৮৯-১৯৮৮) : জন্ম মাউন্ট লেবাননের বাসকিনতা শহরে। পশ্চিম ও আরবে তিনি পরিচিত একজন আধ্যাত্মিক দার্শনিক লেখক হিসেবে। তার বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দ্য কুকু ক্লক’ এর মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যকর্মে তিনি আধ্যাত্মিক দার্শনিকতা প্রয়োগ করেন এবং পরবর্তীকালে প্রায় প্রতিটি লেখায় অব্যাহত রাখেন।)

- তুই ঠিকই বলেছিলি, জীবনটা খুব সুন্দর।
- শুধু সুন্দরই নয় আবু, জীবনটা খুব মায়াময়।
- এতদিনে বুঝেছি জীবনটা বাঁচার জন্য। একটাই তো জীবন, প্রাণভরে উপভোগ করাতেই আনন্দ।
- আবু, তোর মুখে এই কথা? তুই তো শখের শিকারী, কতবার বারণ করেছি তোকে ঐ নিরীহ পশুগুলোকে অত নির্মম ভাবে মারিস না। একবারও শুনেছিস আমার কথা? ওদের জীবনটাও তো বাঁচার জন্যই, না কি?
- ‘তোর মনে আছে, কতবার তুই আমাকে শিকার করতে নিষেধ করেছিস?
- মনে নেই আবার? খুব মনে আছে, কিন্তু কি লাভ মনে রেখে বল?

আমার ছোটবেলার বন্ধু আবু মারওয়ান শখের শিকারী হলেও শিকরের ব্যাপারে বেশ নামডাক আছে। বছর চল্লিশেক বয়স,প্রাণোজ্জ্বল হাসিখুশি চেহারা।সবচেয়ে সুন্দর ওর তন্দ্রালু দুটি সবুজ চোখ আর দরাজদিল হাসি। একজন সৎ, উদার, রসিক অথচ মৃদুভাষী ও দয়াশীল ব্যক্তি হিসেবে ওর যথেষ্ট কদর আছে। শিকার নেশা হলে কি হবে জন্তু জনোয়ার পোষা ওর ছোটবেলার শখ ।এখনও ঘরে তিনটে বেড়াল, দুটো কুকুর, পাঁচটা গিনিপিগ,গোটা দশেক মোরগ মুরগী আর গুচ্ছের কিচিরমিচির করা মুনিয়া পাখী আছে। সবার হ্যাপা ও একাই সামলায়। পোষ্যদের ব্যাপারে ওর আচরণকে রীতিমত ছেলেমানুষিই বলা যায়। বেড়ালের পা ভাঙলে তাকে কোল থেকে নামায় না,পোষা মুরগী কক্ষনো জবাই করেও না বা অন্য কাউকে ওর পোষা মুরগীর গায়ে হাতও দিতে দেয়না। কিন্তু কোন মুরগী মরে গেলে তাকে যথাযথ সম্মান ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে গোর দিয়ে এসে এমন কান্নাকাটি করে যে বাড়ীর লোক তিতিবিরক্ত হয়ে যায়।

আমার সবচেয়ে অবাক লাগে যখন দেখি আবু খাওয়ার পাতে একটুকরোও আমিষ খায় না। শুদ্ধ শাকাহারী। বাড়ীর সবাই খেলেও কিন্তু অনেক জোরাজুরি করেও ওকে একটুকরো মাংস খাওয়ানো যায়না, সে ওর শিকার করা হোক বা না হোক। জিজ্ঞেস করলে নিরীহমুখে বলে,

- ‘আল্লাহ্ কসম! যাকে খুন করার জন্য আমার হাত নিশপিশ করে, আমার অন্তরাত্মা তার মাংস খেতে অস্বীকার করে।’

ছোটবেলার বন্ধু হওয়াতে আবু মারওয়ানের স্বভাব-চরিত্র আমার বেশ ভালই জানা আছে। তাই ওর শিকারের চমকপ্রদ কাহিনী আর এমন অদ্ভুত স্ববিরোধী চরিত্র আমাকে খুব অবাক করে।

আবু একদিকে যেমন পোষা মুরগী ও খোঁড়া বিড়ালের জন্য ব্যথায় কাতর হয় আবার অন্য দিকে তিতির, খরগোশ কিংবা হরিণ শিকার করে প্রচন্ড আনন্দ পায়। বার বার আমি ওকে শিকার থেকে নিবৃত্ত করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। ওকে সতর্ক করে বলেছি,

- জীবন ব্যথার বদলে ব্যথা ও আনন্দের বদলে আনন্দ ফিরিয়ে দেয়। সেই পুরনো প্রবাদটা মনে আছে তো? ‘চোখের বদলে চোখ আর দাঁতের বদলে দাঁত।’

ও নির্বিকার হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলত,

- ‘শিকার করা হালাল। তাছাড়া সত্যি বলতে কি জানিস দোস্ত, অন্য কোন খেলায় আমি এত আনন্দ পাইনা।’

আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি,

- শিকারে কি এত আনন্দ পাস রে আবু?

- শিকার কি তোর কাছে কোন শত্রুকে খুঁজে বার করে সম্মুখযুদ্ধে তাকে পরাভূত করার আনন্দ, নাকি এটা এক ধরনের শরীর চর্চা? নাকি এটা দূর্বলের ওপর সবলের পীড়নজনিত আত্মসুখ?

ও আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল,

- না রে দোস্ত, জীবনের দুঃশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া আর মাটি, পাথর, মেঘ ও বাতাসের ঘ্রাণ নেওয়ার মত অসংখ্য অনুভূতি শিকারের মধ্যে কাজ করে। একজন শিকারির কাছে শিকার হল ভোর ও সন্ধ্যার সুর-সুধা পান, নিজের ঘামে স্নান-সুখ লাভ আর শিকারের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের হৃদ-স্পন্দন উপভোগ করা। আহা! শিকারিই কেবল শিকারের আনন্দ বোঝে। ও তুই বুঝবি না।


দীর্ঘদিন পর ‘জীবন বড় সুন্দর, জীবনটা বাঁচার জন্য’ এই সব কথা শুনতে শুনতে আমার পুরনো দিনের আলাপচারিতাগুলো যেন আমার স্মৃতির দুয়ারে কড়া নেড়ে গেল। ওর মধ্যে আমি কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ওকে বললাম,

- ‘আবু মারওয়ান, তোর চোখ কিছু বলতে চাইছে। কি হয়ছে রে? আমি তোর ছোটবেলার বন্ধু, আমাকেও বলবি না?’

থুতনিতে হাত রেখে ও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আমার হাত ধরে প্রায় জোর করেই পাশে বসিয়ে গলা পরিস্কার করে বলল,
- ‘শোন। গতকাল আমি একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, একটা তিতির পাখিকে আমি গুলি করেছি। কিন্তু ওটার কাছে গিয়ে দেখি মরেনি, যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি ছুরি দিয়ে ওটাকে আড়াই পোঁচে জবাই করলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই তিতিরটা একটা গলাকাটা শিশু হয়ে গেল, আর সেটা কে জানিস? আমার ফুয়াদ। তুইতো ওকে দেখেছিস, ওকে ভালও বাসিস। আর এও নিশ্চই বুঝিস, ও আমার কাছে আমার নিজের জীবনের থেকেও দামী। ঈশ্বরের পর ওই আমার একমাত্র আরাধ্য। এই স্বপ্ন দেখার পর সকালে আর শিকারে যেতে পারিনি। অবশ্য এমন মেয়েলীপনার জন্যে আমি নিজের কাছেই খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। তাই দুপুরের খাওয়া সেরেই মনে জোর এনে শিকারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লাম। দরজার কাছে বসে আমার ফুয়াদ খেলছিল আর আমার নানার কাছে দুঃখী শাহজাদী ও চালাক তিতিরের সেই পুরানো রূপকথাটা শুনছিল। আমায় দেখেই ছোট্ট ছোট্ট হাত বাড়িয়ে কোলে উঠে এল।
আমি ওকে কোলে নিয়ে আদর করলাম; ওর চোখ, ওর কপাল আর থুতনিতে চুমু খেলাম। ওকে বললাম, ফিরার সময় তোমার জন্য কী নিয়ে আসবো বাবা! ও দুই হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে বলল, ‘এত্ত বড় একটা তিতির পাখি, সত্যিকারের তিতির পাখি।’ বললে কি তুই বিশ্বাস করবি দোস্ত, সারাটাদিন আমি অতবড় পাহাড়ী অরণ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটাছুটি করেছি কিন্তু একটাও তিতির পাখি মারতে পারিনি। এমন না যে কোন তিতির দেখিনি, আল্লাহ কসম, অনেক তিতির আমার চোখে পরেছে, অন্তত দশটাকে লক্ষ্য করে গুলিও করেছি, কিন্তু বশ্বাস কর, একটাও মরেনি। তুই জানিস, শিকারে আমি কতটা দক্ষ। জানিনা কেন এমন হল, তবে বুঝতে পারছিলাম ঐ স্বপ্নই আমার চিন্তা আর অনুভূতিকে নিষ্ঠুরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, ‘সূর্যের আলো যখন নিবুনিবু তখনও আমার ঝোলায় কোন পাখি ভরতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত সব আশা-ভরসা ছেড়ে দিয়ে আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম। জানিনা কেন, তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম ঐ স্বপ্নই আমার ব্যর্থতার কারণ। এই সব ভাবতে ভাবতে আমি যখন তাড়াহুড়া করে বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছি ঠিক তখনই রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে একটা শিয়াল তীরবেগে আমার সামনে দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেল। আমি সাথে সাথেই ওটাকে গুলি করে মেরে ফেললাম। না শিকরের জন্য নয়, মারলাম নিজর ওপর অন্ধরাগে আর ব্যর্থতায়। মরা শিয়ালটার পাশ কাটিয়ে চলেই আসছিলাম, কিন্তু মুহূর্তেই আমার ঐ রাগ বিরক্তি আর হতাশা পুরোপুরি উবে গিয়ে চরম বিস্ময় ও আনন্দের রূপ নিল, যখন দেখলাম মৃত শিয়ালটির মুখে আধমরা একটি তিতির পাখি ছটফট করছে।’
‘ঐ মুহূর্তের অনুভূতি তুই কল্পনাও করতে পারবি না।’
‘হতেপারে, ঐ শিয়ালটিও হয়ত বাবা…সেও হয়তো তার শয়াল শিশুদের জন্য শিকারে বেরিয়েছিল বা খাদ্য অণ্বেষণে, আমার মত সেও হয়ত আজসারাদিন ঘুরে কোন তিতির পাখি পায়নি। আর যখন পেল তখন আমিও গিয়ে হাজির হলাম তার জীবনটা কেড়ে নেবার জন্য। এক শিয়াল ও তার সন্তানদের মুখের গ্রাস লুট করে নিজের সন্তানকে উপহার দেব বলেই হয়তো এমন নিয়তি!
যাই হোক, মাংস হালাল করার জন্যে আমি যখন তিতিরটার গলায় ছুরি চালালাম তখন ঐ স্বপ্নটা যেন বার চোখের সামনে ফুটে উঠলো। চোখের পলকেই গলাকাটা তিতির আমার ছোট ছেলে ফুয়াদে পরিণত হল। আমার মনে হল আমি জ্ঞান হারাতে যাচ্ছি। যদিও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। তিতিরটা ঝোলায় পুরে বাড়ী ফেরত এলাম।

- তারপর?

- তারপর, রাতে তিতিরটাকে রোস্ট করে আমার স্ত্রী নরম কিছু মাংস ফুয়াদকে দিয়েছিল। খাবার টেবিলে খেতে খেতে হঠাৎ করেই ফুয়াদ চিৎকার শুরু করলো। প্রচন্ড কাশি ও সেই সাথে ওর শ্বাস কষ্ট শুরু হল। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একজন প্রতিবেশি ছিলেন ডাক্তার। তার আপ্রাণ চেষ্টাতেই সে রাতে ওর গলায় বিঁধে থাকা রানের একটা ভাঙা হাড়ের টুকরো মাইনর অপারেশন করে বার করে ফুয়াদকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। এখনো ঐ দৃশ্যের কথা মনে পরলে আমার বুক কেঁপে উঠে, আমি অসুস্থ হয়ে যাই।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ আবু মারওয়ান চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, এই জন্যই বললাম দোস্ত , যে তুই-ই ঠিক বলতি, জীবনটা খুব সুন্দর।

কেমন যেন সন্দেহ হলো, কি বলব ভেবে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

- ‘ তুই শিকার করা ছেড়ে দিয়েছিস কিনা বল তো?’

আবু মারওয়ান মাটির দিকে তাকিয়ে কেমন এক অদ্ভুত গলায় বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল,

- ‘এত কিছু বলবার পরও তুই এমন প্রশ্ন করিস কিভাবে?’