বিপ্র বিমল
ফোনটা রেখে দেয় মৌমিতা। রিসিভারটা রেখেই আনমনা হয়ে যায় মৌমিতা। কাজল-দা খুব অসুস্থ। লিভারে সমস্যা। বাঁচার সম্ভাবনা প্রায়ই নেই। আজ নয়দিন ধরে ঢাকার একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। কাজল-দা খুব করে বলায় ওখানকার একজন নার্স ফোন করে জানালো মৌমিতাকে। কাজল-দা নাকি ঘুমের মধ্যে বারবার আমার নাম বলছে। কি নাম বলছে সে? কাজল-দা'তো আমাকে কখনো নাম ধরে ডাকেনা ! তাহলে কি কাজল-দা শেষ সময়ে.... নাহ নাহ এসব কি অলক্ষুণে কথা ভাবছে সে। কাজল-দা মরতেই পারেনা।
মা মারা যাওয়ার পর থেকে কেমন জানি হয়ে গেছে কাজল-দা। আগে তো সে সিগারেটও খেতনা। এখন নাকি সব জাতীয় নেশা চলে। শুনেছিলাম,কোন এনজিওতে জানি চাকরী করত। এখনো করে কিনা জানিনা।
কাজল-দা তাকে দেখতে চায়। মানুষ মরার সময় তার খুব আপনজনকে এভাবে দেখতে চায়। আমি কি কাজল-দার খুব আপন কেউ !! গা কাঁটা দিয়ে উঠে মৌমিতার।
মৌমিতা না গেলে কাজল-দা তাকে কি ভাববে সে আর ঐসব ভাবতে চায়না। এখন তার স্বামী আছে,সংসার আছে। রুবেল (তার স্বামী) তাকে খুব ভালবাসে। খুব বিশ্বাস করে। কাজল-দার ঐসব ভালবাসা রুবেলের ভালবাসা,বিশ্বাসের কাছে সামান্য। মৌমিতা আটকে যায়, আসলেই কি কাজল-দার ভালবাসা সামান্য? কাজল-দার ভালবাসার কি কোন দাম নেই? এতোটাই ক্ষুদ্র? তাহলে এই কাজলের জন্যেই বা কেন এতো ভাবনা,চিন্তা তার?
স্কুলে,কলেজ জীবনে এই কাজল-দা'কে এক মুহূর্ত দেখার জন্য কি না করত মৌমিতা। স্কুল ছুটি হলেই বই খাতা নিয়ে দৌড় দিত কাজল-দা'দের বাসায়। কাজল-দা তখন কলেজে পড়ত। মৌমিতা কে দেখে হাসতে হাসতে বারান্দায় এসে বসত। আর বলত, 'কিরে মোমবাতি,এলি? স্কুলে পড়া বুঝিসনি? আয়.. আয়!
মৌমিতা এক দৌড়ে কাজল-দার রুমে চলে যেত। আর কাজল-দার দেয়ালে বাই-সাইকেলে চড়া কেপ পরা ঝুলন্ত কাজল-দাকে বারবার দেখত।
পড়া না পারলেও, না বুঝলেও কাজল-দা কখনো মারতোনা, বকাও দিতো না কখনো।
একদিন পিথাগোরাসের উপপাদ্য বুঝাতে গিয়ে কোনমতেই বুঝতে পারছিলনা মৌমিতা। কাজল-দার রাগ ধরে যায়। কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। বাইরে উঠোনে মৌমিতার মা আর কাজল-দা'র মা বসে গল্প করছিলেন। হঠাৎ কাজল-দা উঠোনের দিকে মুখ করে চিৎকার করে বলে, ' বুঝলে মাসিমা, আমাদের মোম খুব স্বামী সোহাগী হবে। অনেক বড়লোক স্বামী হবে গো তার।'
লজ্জায় লাল হয়ে যায় মৌমিতা।
বাইরে দু'জনে হাসতে হাসতে মৌমিতার মা জিজ্ঞেস করলেন, 'তুই আবার জ্যোতিষ হলি কবেরে, কাজল?'
-' বুঝি, বুঝি মাসিমা। এইসব পড়ালেখায় অকাজের মেয়েরা বড়লোক স্বামীই পায়।'
এবার রাগ ধরে যায় মৌমিতার। একদিন রাতে খাওয়ার সময় মৌমিতার বাবা বলেছিল কাজল-দা'রা গরীব, তাই মেধাবী হয়েও বাইরে,শহরে ভাল কলেজে পড়তে পারেনি।
সেদিন থেকেই বড় লোকদের ঘৃণা করতো মৌমিতা। এই বড়লোকদের কেউ একজন তার কাজল-দা'র সিট দখল করে আছে ভাবলেই কষ্ট হত তার।
এখনো পিথাগোরাস বুঝেনা মৌমিতা। এখন আর খারাপ লাগেনা, বরং সেদিন কার কথা ভেবে নিজেকে খুব বোকা ভেবে কিছুটা লজ্জা পায় সে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার এখন সারা বাড়ীটা। কারেন্ট কখন চলে গেছে খেয়াল নেই মৌমিতার। সে মোমবাতি জ্বালাতে বেড রুমে আসে। মোমবাতিটা হাতে নেয় সে।
কাজল-দা তাকে মোমবাতি বলে ডাকতো। কেন ডাকতো সে কথা মৌমিতা আজও জানেনা। কোনদিন জানতেও চায়নি সে। কিন্তু মনে মনে খুব ভাল লাগত তার। অন্য কেউ এই নামে তাকে ডাকলে সে রেগে যেতো। আর এমন সব কাণ্ড করত যেন কেউ আর এই নামে তাকে ডাকতে না পারে।
মৌমিতা ড্রেসিং টেবিলে রাখা মোমবাতিটা জ্বালায়। সাদা, নরম মোমবাতিটা জ্বলে ওঠে। চারপাশ আলোময় হয়ে ওঠে। মোমবাতির আলোতে মৌমিতার ছায়া,ড্রেসিং এর আয়নায় যে তার প্রতিচ্ছবি এসব কিছু খুব মেকি লাগে তার কাছে। কি এক রকমের ঘৃণা আসে তার নিজের প্রতি।
নাহ...কাল কাজল-দা'কে একবার দেখতে যাবে সে। কিন্তু নিজেকে কি ধরে রাখতে পারবে মৌমিতা?
এখন রুবেলের ফেরার সময়। মৌমিতা উঠে দাঁড়ায়।
টেবিলে মোমবাতিটা তখনো আলো দিচ্ছে। কিন্তু এ মোমবাতি কাজল-দা'র নয়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন