অংকন নন্দী (সাতকাহন)
পরীক্ষার নাম শুনলেই আমার হৃৎকম্প দিয়ে জ্বর আসে।
তবু, পরীক্ষা আসার কোন বিলম্ব নেই। যতই লুকিয়ে থাকি আর চক্ষু কর্ণ বুজে থাকার চেষ্টা করি, তবু সে ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করে আর ক্যাঁক করে ঘাড় চেপে ধরে বলে, কই যাবা চান্দু? আমি আসিয়াছি। চল গিয়া হলে বসি আর তোমার মগজ ধোলাইকার্য সম্পাদন করি।
কেন রে বাবা, আমাকে না গুঁতলে কি তার পেটের ভাত হজম হয়না! সবার পরীক্ষা নেয়ার কোন দরকার আছে। ওই যে কতগুলো গুডি গুডি টাইপস ছেলে সারাদিন নাকখানা বইয়ের পাতায় গুঁজে রাখে আর বাসক পাতার রস খেয়ে মগজ পরিষ্কার করে,তাদের পরীক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট থাক না।প্রয়োজনে আমাদেরটাও ওদের কাছ থেকে নে। তবুও আমাদের রেহাই দিলেই হয়।
তার কোন যো নেই, আর ফলস্বরূপ আমি বর্তমানে পরীক্ষার হলে বসে ফ্যানের বাতাসেও দরদর করে ঘামছি আর মনের সুখে কলম চিবিয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি।
আজকের পরীক্ষা বাংলা দ্বিতীয় পত্র। পরীক্ষা তো পরীক্ষা, যমের সাক্ষাৎ বড়ভাই, তার উপর আবার প্রথম দ্বিতীয় লাগিয়ে গোঁদের উপর বিষফোঁড়া। যেন আছাড় একটা মেরে খেদ মিটে নি, তাই মাথায় তুলে দ্বিতীয় আছাড়।
বড় আশা করে এসেছিলাম ইংরেজি অংকে তো প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে টাসকি খেয়ে বজ্রাহতের মত বসে বসে এইসব প্রশ্নের অসাড়তা চিন্তা করা ছাড়া কিছুই করার থাকেনা। এটা তো বাংলা,তাই আজ সাধ মিটিয়ে লিখব, মনের খেদ মিটিয়ে নেব আজ। কিন্তু বাংলা প্রশ্ন দেখেও আমি তথৈবচ! বাংলা হরফে মনে হচ্ছে কিসব গ্রীক ভাষা লেখা! এর সমাধান আমার কর্ম নয়। তাই পুনর্বার কলম চিবাইতে চিবাইতে আকাশ পাতাল চিন্তাভাবনা।
চিন্তা করতে করতেই হঠাৎ মনে পড়ল বাপজানের কথা।
গতবার সব বিষয়ে ডাব্বা মারার পর আমাকে পেয়ারার ডাল দিয়ে তার স্নেহাশীষ দিতে দিতে বলেছিলেন, কেমন ছেলে তুই, একটা বিষয়েও কি তোর পাশ করতে নেই! পুনরায় সে কাহিনীর রিক্যাপ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই। সে বার পিঠের কোন জায়গা তিনি তার আদরের আওতার বাইরে রাখেন নি, এবার না পুরো শরীর জুড়েই শুরু করে দেন। তাই অন্তত: কিছু লেখার চেষ্টা করা উচিত।
পুরো প্রশ্নপত্রে আবার চোখ বুলালাম। সেই আবার অপিনিহিতি-হ্রেষা-বিসমিল্লায় গলদ-আর কলুর বলদ দেখতে দেখতে আরো একবার টাসকি খেলাম। এইসব হাতুড়িপেটা কথার কি সব মানে কে জানে! শুনলেই মাথা ঝনঝন করে।
অবশেষে এক জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল আর কিছুটা অন্তত: আশার আলো দেখতে পেলাম।
ভাব সম্প্রসারণ কর- “ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়।”
এটা নিয়ে কিছু লেখা গেলেও যেতে পারে। আমি শুরু করে দিলাম-
ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়।
কথাটা কিছুক্ষেত্রে ঠিক হলেও সবক্ষেত্রে ঠিক নয়। ইচ্ছা থাকলেও কোন কোন সময় উপায় হয়না, আবার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও কোন কোন সময় উপায় হয়ে যায়।
এই যেমন আমার এখন খুব ইচ্ছা করছে ওই ভারি বাইফোকাল চার চোখ লাগানো ডেঁপো ফার্স্ট বয় থেকে খাতাটা কেড়ে নিয়ে দেখে দেখে আমার খাতায় কপি মারি। কিন্তু হরিদাশ স্যারের খবরদারিতে সে হবার উপায় নাই। আবার কোন সময় নলিনীবাবুর আমগাছ থেকে পাকা আম পেড়ে খাবার বিপুল ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও পেটমোটা মালী ভজহরির দৌরাত্ম্য তা হওয়া মুস্কিল।
আবার ধরা যাক পাশের বাড়ীর মাধবীর সাথে হঠাৎ কথা বলতে ইচ্ছে হল। কিন্তু তার মা শচীদেবীর হাঁক এড়িয়ে কি করে তা সম্ভব তা আমার মাথায় ঢোকে না। তাই ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয় না।
কিন্তু ইচ্ছা না থাকিলেও উপায় হয়ে যায় বেশির ভাগ সময়।
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছের ছেলের খাতা থেকে টুকলি করার সময় কামরুল স্যারের হাতে কানমলা খেয়ে বের হতে বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে করেনি আমার, তবু স্যারের ঠ্যাঙানির হাত এতই ভাল যে পালিয়ে বাঁচার যো নেই। গতবার পূজোয় দাদুর চেয়ার তলে পটকা ফাটিয়ে তার দায়ে সারা বিকেল কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে শুটকিশুকানো হতে বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে হয়নি আমার ,তবু বাবার গরু পেটানো লাঠির ভয়ে নড়নচড়নের উপায় নেই।
মাধবীকে চিঠি দিতে গিয়ে জানলা গলে ছোঁড়া চিঠি গিয়ে পড়ে ওর দিদির কোলে, ব্যস প্রেমর সলিল সমাধি না হয়ে আর উপায় কি?
তাই, সুধীজনের জন্য ইচ্ছামতন উপায় হইলেও আমজনতার ইচ্ছা না থাকিলেই উপায় হয় ।।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন