২০ জুল, ২০১৩

প্রবন্ধ - মৌ দাশগুপ্তা

কবিতার রহস্য : বনলতা সেন
মৌ দাশগুপ্তা


“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।“
'বনলতা সেন' কবিতাটি সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বহুল পঠিত কবিতাগুলোর একটি। কবিতাকে ভালবাসেন অথচ এই বনলতা সেন কবিতা পড়েননি এমন মানুষ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।বনলতা সেন আমাদের স্বপ্ন হয়ে আসে, বনলতা সেন আমাদের গান হয়ে আসে, বনলতা সেন নাটকের চরিত্র হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। প্রেমিকের কাছে তার প্রেমিকা বনলতা, প্রেমিকার নিজের কাছে সে নিজে বনলতা।


বনলতা সেন কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় আশ্বিন ১৩৪২/ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে। কবিতাটি তৎকালীন ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়, সে সময় কবিতা’র সম্পাদক ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে দেখা যায়, কবিতাটি লেখা হয়েছিলো ১৯৩৪ সনে।এটি একটি ক্ষুদ্র-অবয়ব কবিতা। কবিতার চরণ সংখ্যা ১৮ এবং ব্যবহৃত শব্দ সংখ্যা ১৩৫ টির মতো। এই ক্ষুদ্র আয়তনের কবিতাটিতে সৃষ্ট রহস্য এতো গভীর, এতো ব্যাপক যে এনিয়ে কাব্য-বোদ্ধাদের খননকার্য আজো অব্যাহত রয়েছে।

প্রকাশের পর থেকেই বনলতা সেনকে নিয়ে সাহিত্যপ্রেমী মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় সাকুল্যে তিনবার বনলতা সেনের নাম নিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ।

· প্রথম স্তবকের শেষ চরণঃ "আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন" ;

· দ্বিতীয় স্তবকের শেষ চরণঃ "পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন" ; এবং

· তৃতীয় স্তবকের শেষ চরণঃ "থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন" ।


'বনলতা' কে ছিলেন

বনলতা সেনের চুলকে তুলনা করা হয়েছে বিদিশা নগরীর আঁধারের রহস্যময়তার সাথে, মুখশ্রীকে তুলনা করা হয়েছে শ্রাবস্তী’র কালজয়ী শিল্প উপাদান হিসেবে। বনলতা’র চোখ পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়দাত্রী, ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়া। মধ্যযুগের শিল্প-ঐশ্বর্য্যের ধারক বিদিশা’র অমোঘ আকর্ষণের মতো তার চুলের নেশা, শ্রাবস্তীর হাজারো স্থাপত্য আর লাখো শিল্পীর সযত্ন-মনসিজ মুখচ্ছবির মতো তার রূপ। সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ পেছনে ফেলে পাখি যেমন সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে তৃপ্তি পায়, বনলতা’র চোখ তেমনি।

কে এই নারী? কী তার পরিচয়? বনলতা সেন বইটি হাতে নিয়ে গোপালচন্দ্র রায় একবার কবিকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, ‘দাদা, আপনি যে লিখেছেন নাটোরের বনলতা সেন, এই বনলতা সেনটা কে? এই নামে সত্যি আপনার পরিচিত কেউ ছিল নাকি?’ প্রশ্ন শুনে শুধু মুচকি মুচকি হেসেছেন কিন্তু কোনো উত্তর দেননি কবি। বনলতা সেন বিষয়ে আজীবন এই নীরবতা বজায় রেখেছেন কবি, অজান্তেও কখনো কোনো প্রিয়জনের কাছে বনলতার কোনো কাহিনী বর্ণনা করেননি। তবে কবি নীরব থাকলেও গবেষকেরা কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি, বনলতা সেনের অন্বেষণে প্রাণান্ত করেছেন। গবেষকদের কাছে বনলতা সেন রয়ে গেছেন এক রহস্যময়ী নারী।

১। কেউ কেউ মনে করেন বনলতা সেন নামটির ভেতর তার পরিচয় লুকিয়ে আছে। নামটির দু’টি অংশ বনলতা আর সেন। বনলতা প্রকৃতি আর সেন নারী। জন্মলগ্ন থেকেই মানবজাতি নারী আর প্রকৃতির কাছেই একমাত্র শান্তি খুঁজে পেয়েছে কবির মূল বক্তব্য এটিই। এই বিষয়টি স্পষ্ট করতেই কবি এই নামটি বেছে নিয়েছেন, সমসাময়িক আধুনিক নারীর নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে কবি তার স্বভাবজাত রোমান্টিকতার আড়াল তৈরি করেছেন মাত্র।

২। বিশিষ্ট আমলা আকবর আলী খান তার 'পরার্থপরতার অর্থনীতি' বইয়ে বনলতা সেনের 'সেন' উপাধি আর তার বাসস্থান নাটোর এই দুইয়ের সংযোগে আরেকটি ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। আকবর আলী খানের মতে 'নাটোর' শব্দটির ব্যবহার শুধু বনলতা সেনের ঠিকানা নির্দিষ্ট করতে নয়, তার পেশা নির্দিষ্ট করতেও। দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায় এ শতাব্দীর প্রথমদিকে নাটোর কাঁচাগোল্লার জন্য নয়, বিখ্যাত ছিলো রূপোপজীবিনীদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে। 'সেন' শব্দটি তার বংশের পরিচয় বহন করছে, পেশা গ্রহণ করবার পর 'বনলতা' নামের আড়ালে সে তার নিজের আসল নাম গোপন করেছে। ‘দু’দণ্ড শান্তি’ কথাটির মূল অর্থ আদিম অভিসার, আর এই কবিতায় আরোপিত 'অন্ধকার' বলে দেয়, বনলতা সেন’দের আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে পাওয়ার সুযোগ নেই। 'অন্ধকারে মুখোমুখি বসবার' স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে পাখির মতোই ঘরে ফিরে যেতে হয়; যেখানে অপেক্ষা করে সাধারণ নারী’।

৩। জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি উদ্ধারক ডা. ভূমেন্দ্র গুহ কবির 'লিটেরেরি নোটস' গবেষণায় জানা যায় কবির ডায়েরিতে লিটারেরি নোটস্‌ হিসেবে Y নামে এক মেয়ের নাম লেখা আছে। জীবনানন্দ তার নিজের হস্তাক্ষরে লিখে রেখেছেন Y=শচী; এই ‘শচী’ জীবনানন্দের গল্প ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’র শচী। ডায়েরির অন্যান্য পৃষ্ঠা বিবেচনায় ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, বাস্তবে সে শোভনা - কবির এক কাকা অতুলান্ত দাশের মেয়ে - যার ঘরোয়া নাম বেবী। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ কবি এই শোভনা মজুমদারকে উৎসর্গ করেছেন। অর্থাৎ ভূমেন্দ্র গুহের বিবেচনায় বনলতা সেন নিখাদ প্রেমের কবিতা।

৪। বনলতা সেন রচনার পচাত্তর বছর পূর্তিতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অশোক মিত্র জানাচ্ছেন তিনি নিজে কবি জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘বনলতা সেন’ কে? কবি বনলতা সেন কে এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেন নি। শুধু বলেছেন, বনলতা সেন নামটি কবি পেয়েছিলেন পত্রিকা থেকে। সে সময় নিবর্তক আইনে বনলতা সেন নামে এক একজন রাজশাহী জেলে বন্দিনী ছিলেন। সেখান থেকেই কবি এই নামটি গ্রহণ করেন। এই বনলতা সেন পরে কলকাতার কলেজে গণিতের শিক্ষকতা করতেন।

গবেষকেরা বনলতা সেনকে রহস্যময়ী মানবী হিসেবে চিত্রিত করলে কী হবে; নাটোরের মানুষের কাছে কিন্তু বনলতা রক্তমাংশের মানুষ, পরম আপনজন। এমনকি তাঁকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে কয়েকটি কাহিনী। যদিও এসব কাহিনী ইতিহাসের কোনো সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয়নি। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই কাহিনীর নায়িকা একজনই, নাটোরের বনেদি সুকুল পরিবারের তারাপদ সুকুলের ম্যানেজার ভুবন সেনের বিধবা বোন, বনলতা সেন।কবির সাথে তার ক্ষণিকের সাক্ষাৎ কিন্তু সদ্যবিধবা নতমুখী কিশোরী কবির মনে এক গাঢ় বিষণ্নতার ছাপ রেখে যান। তারই অবিস্নরণীয় প্রকাশ নাকি ‘থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’।

‘বনলতা সেন’ কবিতায় তিনবার উচ্চারণে বনলতা সেনের প্রতি মোহ কবির কাটে নি। কবির আরো কবিতা-গল্পে বনলতা সেন এসেছে নারী চরিত্ররূপে। এমনকি বনলতা সেন কবিতা প্রকাশ হবার আগেই কবি তার একটা গল্পে বনলতার রূপের বর্ণনা দেন, তার মোহগ্রস্ততার প্রকাশ ঘটান, কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা প্রকাশ করেন নি কারো কাছে।১৯৩২ খৃস্টাব্দে লিখিত এবং প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল অন্তরালবাসী কারুবাসনা নামীয় উপন্যাসে প্রথম 'বনলতা সেন' নামটি পাওয়া যায়। অধিকন্তু 'হাজার বছর ধরে খেলা করে', 'একটি পুরোনো কবিতা' এবং 'বাঙালি পাঞ্জাবী মারাঠি গুজরাটি' শীর্ষক আরও তিনটি কবিতায় এ নামটি আছে।

১। (কারুবাসনা, রচনাকাল-১৯৩৩)

সেই বনলতা-আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত। কুড়ি-বাইশ বছর আগের সে এক পৃথিবীতে...আচঁলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকেই আসছিল। কিন্তু কি যেন অন্যমনস্ক নত মুখে মাঝপথে গেল থেমে, তারপর খিরকির পুকুরের কিনারা দিয়ে, শামুক-গুগলি পায়ে মাড়িয়ে, বাঁশের জঙ্গলের ছায়ায় ভিতর দিয়ে চলেগেল সুনিবিড় জামরুল গাছটার নিচে একবার দাঁড়াল, তারপর পৌষের অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

অনেকদিন পরে সে আবার এল; মনপবনের নৌকায় চড়ে, নীলাম্বরী শাড়ি পরে, চিকন চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আবার সে এসে দাঁড়িয়েছে; মিষ্টি ঠাণ্ডানির্জন দুখানা হাত, ম্লান ঠোঁট, শাড়ির ম্লানিমা। সময় থেকে সময়ান্তর, নিরবিছিন্ন, হায় প্রকৃতি, অন্ধকারে তার যাত্রা।

২। (একটি পুরনো কবিতা: অগ্রন্থিত)

আমরা মৃত্যু থেকে জেগে উঠে দেখি
চারদিকে ছায়া ভরা ভিড়
কুলোর বাতাসে উড়ে ক্ষুদের মতন
পেয়ে যায়-পেয়ে যায়-অণুপরমাণু শরীর।

একটি কি দুটো মুখ-তাদের ভিতরে
যদিও দেখিনি আমি কোনো দিন-তবুও বাতাসে
প্রথম গার্গীর মতো-জানকীর মতো হয়ে ক্রমে
অবশেষে বনলতা সেন হয়ে আসে।

৩। (বাঙালি পাঞ্জাবি মারাঠি গুজরাটি: অগ্রন্থিত)

বনলতা সেন
তুমি যখন নদীর ঘাটে স্নান করে ফিরে এলে
মাথার উপর জলন্ত সূর্য তোমার,
অসংখ্য চিল, বেগুনের ফুরের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ
তখন থেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনো দিন
কোনো প্রেম কোনো স্বপ্ন কোনো দিন মৃত হয় না
আমরা পথ থেকে পথ চলি শুধু-ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে-
আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি শুধু, মুখোমুখি দাঁড়াই;
তুমি আর আমি।

৪। (শেষ হল জীবনের সব লেনদেন: অগ্রন্থিত)

শেষ হল জীবনের সব লেনদেন
বনলতা সেন।

কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
তুমি নাই বনলতা সেন।

৫। (হাজার বছর শুধু খেলা করে: বনলতা সেন)

হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;
বালির উপরে জ্যোৎস্না-দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: দ্বারকার;-দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।
শরীরে ঘুমে ঘ্রাণ আমাদের- ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;
মনে আছে? শুধাল সে-শুধালাম আমি শুধু 'বনলতা সেন?'

বনলতা সেন। ‘নাটোরের বনলতা সেন’। ‘বনলতা সেন’ কে ছিলেন, কী ঘটনা ছিল কবিতার পটভূমিতে সে বিষয়ে অস্পষ্টতা বিরাজমান, তবে সেসব অস্পষ্টতায় ভেতর আলো সন্ধানের প্রয়োজনীয় চাবিটিও কবিতার ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দিয়ে গেছেন কবি। ফলে আলো-আঁধারির সীমানাহীন মায়াবী প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছে কবিতাটি। এই আলো-আঁধারি কবিতাটির ফুরিয়ে-না-যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। কবি বেঁচে থাকেন তার কবিতায়। আর কাব্য চর্চায় মধ্যদিয়ে কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখেন স্বয়ং কবি। ‘বনলতা সেন’ বাংলা সাহিত্যের রহস্যময়ী নায়িকা হয়েই চির অমর থাকুন।।


2 কমেন্টস্:

SAYAN,blogbuster! বলেছেন...

লেখাটা অসম্ভব ভাল ও তথ্যপূর্ন হয়েছে তাই তারিয়ে উপভোগ করলাম

moudasgupta বলেছেন...

Anek dhannyobaad Sayan

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন