কথা দেয়া ছিল
ফারহানা খানম
সকাল সকাল এই দৃশ্যটা অকল্পনীয় আর অসহ্য ,অদিতি রাগ করবে না দেখবে ভেবে পেলো না অগত্যা চা এর কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রইলো ।এসময় ভাইয়া এলো তিনিও নির্বাক ,কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যা যা বলে চেঁচিয়ে উঠলেন । অদিতি বলল কি করলে ভাইয়া ? ইসশ পাখিটা ধরা যেতনা ? এসময় চোখ মুছতে মুছতে মিমিও এসে পড়েছে ,সে শুধু দেখলো ৪/৫টা সবুজ টিয়া উড়ে যাচ্ছে , তার বায়না ওটা চাই । এই হৈ চৈ এ পাশের বাড়ির দোতালায় মুকুল গান থামিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে ...মুকুল চেঁচিয়ে বলল ভাইয়া আমি ছবি তুলেছি , এদিক থেকে অনিক বলল যাক তুমি দুর্লভ দৃশ্যটা ধরে রেখেছ তাহলে ? আমায় দিও ছবিটা ।
রোজ ভোরে নামাজ শেষ করে খালি পায়ে বাগানে হেঁটে হেঁটে অদিতি আর অনিক চা খায় , গাছগুলো দেখে পানি দেয় পরিচর্যা করে পুরনো ফুল তুলে নেয় ঘর সাজায় এ সময় পাশের বাড়ির মুকুলের বোন মৌ আসে , ওপাশের দোতালা বাড়ির শানু চার তালার মামুন তিন তলার রুপা এসে ফুল নিয়ে যায় ।, তারপর ওরা পড়তে যায় ।
বাগানটা ওদের দুই ভাইবোনের নিজের হাতে করা কোন মালী নেই ,অদিতি আর অনিক দুজনে দেশী -বিদেশী ফুলের গাছ লাগায় যত্ন করে আবার পরের মৌসুমে লাগাবে বলে বীজ রাখে যত্ন করে । শরতে শিউলি গাছটার নিচে যখন রাশি রাশি শিউলি পরে থাকে সবুজের বুকে শিশির জড়ানো শিউলি কি যে অপূর্ব দেখায়!কিংবা জ্যোৎস্না রাতে যখন চন্দ্রমল্লিকা বা হাসনাহেনা ফোটে কি সুন্দর যে দেখায় ফুলগুলো যেন এক একটা নক্ষত্র !
তা আজ যে ঘটনা অদের যুগপৎ অবাক আর রাগান্বিত করেছে তা হল বারান্দার ধারের যে বেড তাতে সূর্যমুখীর ১২ টা গাছ তাতে বিরাট বিরাট খয়েরী -হলুদ সূর্যমুখী ফুটে ছিল । ত সকালে নিয়ম মাফিক অদিতি চা এর কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দেখল ৩/৪ টা টিয়ে পাখি সূর্যমুখী ফুলের বুকে বসে ফুলের খয়েরী বীজ খুঁটে খাচ্ছে পাপড়িগুলো তছনছ হয়ে আছে , এ দৃশ্য অকল্পনীয় আবার নির্মম সুন্দর, অদিতির মনে হচ্ছিল যেন পাখিগুলো ওর বুকে ঠোকর দিচ্ছে! তখন ভাইয়াও এসে নির্বাক তাকিয়ে থাকে ।ঠিক এই সময় প্রতিদিন মুকুল বারান্দায় বসে রেওয়াজ করে সে প্রথম বারান্দায় এসেই এ দৃশ্য দেখতে পায় দৌড়ে গিয়ে মোবাইল নিয়ে এসে ঘর ছবি তুলতে তৈরি হয় আর একটা ছবি তুলতেই নিচে গোলমাল বেঁধে যায় । মিমি পাখির জন্যে কান্না জুড়ে দেয় ।
ধীরে ধীরে রঙ পাল্টাচ্ছে আকাশে নীল কমে গাড় হচ্ছে সাদা আর সোনালী আভা । কয়েকটা প্রজাপতি উড়ছে ফুলে ফুলে। সুন্দর ঝির ঝিরে হাওয়া । বেশ কিছু নতুন ফুল ফুটেছে অদিতি আর অনিক বাগানে নেমে গেল গাছের পরিচর্যা করতে হবে ফুল নিয়ে সাজাতে হবে । । অদিতি পড়ে ক্লাস টেনে অনিক ভার্সিটিতে পড়ছে ২য় বর্ষে ।অদিতি ফুল তুলতে থাকে মৌ কে কিছু ফুল দিল, সে নিজে কিছু গাঁদা ফুল নিয়ে উঠে পড়লো । মুকুল ওপর থেকে বলল আমার জন্যে কিন্তু ৩ টে গোলাপ দিও অদিতি ,৩ টি গোলাপ দিয়ে দিল তুলে । ফুটন্ত গোলাপগুলো পাপড়ি মেলে ফুটে আছে সেগুলো সে ধরল না , বাকী যে কটা আছে ধরলেই ঝরে যাবে । উঠে এল ওরা বাগান থেকে বেলা বাড়ছে ঝকঝকে রোদ কিন্তু বার বার মনে পড়ছে ক্ষতবিক্ষত ফুলগুলোর কথা ।
নাস্তার টেবিলে মা জিজ্ঞেস করেন কিরে সকালে কি নিয়ে এত গোলমাল হলরে ? মিমি মহা উৎসাহে ঘটনা বর্ণনা করে এও বলে তার একটা টিয়া পাখি আজই চাই , মিমি পড়ে ক্লাস সিক্স এ ।বাবা হেসে বলেন বেশ তো রুনু তুমি কাঁটাবন থেকে ভালো দেখে একটা পাখি কিনে দাও ওকে তবে হ্যাঁ মামনি পাখিটাকে কিন্তু তুমি কথা শেখাতে হবে ।মিমি বলে শেখাবো । সবাই হাসতে থাকে ।
অদিতি নিজের ঘরে এসে পড়তে বসে। মৌ আর অদিতি একই স্কুলে পড়ে একটু পড়েই ওরা স্কুলে যাবে এসময় মুকুল আসে এ বাড়িতে ওদের আর ওই বাড়িতে এদের অবাধ যাতায়াত । কেউ কিছু মনে করেনা ,মুকুল এসে বলে
---আমার গোলাপ কই?
----কেন সকালেই ত দিলাম মৌ এর হাতে ,
---কেন তুমি নিজে দিতে পারনি ? অদিতির সারা মনে অদ্ভুত এক আলোড়ন নিজেকে শান্ত রেখে বলে একই ত কথা আপনি ফুল চেয়েছেন আমি দিয়েছি ,
----এক কথা নয় কাল থেকে তুমি দেবে আমি নিচে নেমে হাত বাড়িয়ে নেব ।
অদিতি বলে বেশ দেব । মুকুল যায় অনিকের ঘরে একটা বই নিতে এসেছিল সে , তারপর মনে হল অদিতিকে একটু ঘাবড়ে দিই ,এমনি অদিতি খুব শান্ত মেয়ে ওর সাথে দুষ্টুমি করতে বেশ লাগে ।ও খুব শান্ত আর দেখতে শ্যামলা মিষ্টি । আর খুব ভিতু ।
অদিতি আর মৌ রেডি স্কুলে যাবে অনিক চলে গেছে ওর পরীক্ষা মা বলেন মুকুল আমার হাতে অনেক কাজ একটা রিক্সা ঠিক করে দাও ওদের দেখো রিক্সা ওয়ালা যেন বুড়ো আর ভাল হয় ,মুকুল হাসতে হাসতে বলে
----বুড়ো কি ওদের টানতে পারবে খালা ?এক এক জনের যে ওজন ।হেসে ফেলে মা বলেন
--- বাবা দুষ্টুমি রাখো দেরি হয়ে যাচ্ছে ওদের ।
ওরা বেড়িয়ে পড়ে । ওদের বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে বড় পুকুর , এর ধার ঘেঁষে বড় বড় গাছ আর শান বাঁধানো ঘাটে সারাবেলা কেউ না কেউ গোসল করে ,কাপড় কাঁচে গল্প করে ,মোটের ওপর লোকের আনাগোনা থাকেই । গাছগুলো সুন্দর তুমুল হাওয়া দেয় পানিতে সাতার কাটে রাজ হাঁস আর হাঁস ।
পুকুর পাড়টা পেড়িয়ে একটা গলি ,ভাগ্য প্রসন্ন না হলে গলির মোড়ে না গিয়ে রিক্সা পাওয়া যায় না । ওরা গলিটা পার হওয়ার সময় দুটো বখাটে ছেলে কি যেন বলে ওদের লক্ষ্য করে মুকুল ভীষণ রেগে কিছু বলতে যায় লোকজন থামায় ওকে তবে সেও সাবধান করে দেয় কোনোদিন যেন এ পাড়ায় না দেখা যায় ওদের । এরপর মুকুল ওদের রিক্সা ঠিক করে দিয়ে সেও চলে যায় ভার্সিটিতে সে এবার প্রথম বর্ষের ছাত্র তার বিষয় গণিত ,ভীষণ রসকষহীন মনে হয় তার ।
ক্লাস শেষে বাসায় এসে মুকুল ভাবতে বসে অদিতিকে তার শুধু ভাল না বেশ ভালো লাগে কিন্তু কথাটা বলার সময় এখনো আসেনি সামনে ওর এস এস সি পরীক্ষা এসময় এই কথা বলে ওকে ভাবিয়ে তোলা ঠিক হবে না ,অথচ না বলতে পেরে সে ছটফট করে রাত দিন ।একটা ভয়ও কাজ করে যদি অদিতি ওকে না বলে ? না ওকে তেমন অপছন্দ করে বলে ত মনে হয়না।
অদিতি খুব সরল একটা মেয়ে ছোট থেকে ওকে দেখছে ,বই পড়া আর বাগান করা এই নিয়েই মেতে থাকে সারাক্ষণ । মুকুলের খুব অপছন্দ ওদের গানের মাষ্টার কে ,ওরা তিনজন মানে অদিতি মৌ আর মিমি যখন গান শিখতে বসে ,মুকুল খেয়াল করে দেখেছে মাষ্টার যেন অদিতির দিকে একটু বেশি মনোযোগ দেয় , আর বেছে বেছে প্রেমের গানগুলোই ওকে শেখাবে বড় রাগ হয় তার , এসময় মা খেতে ডাকেন ।
ফাগুনের এই দুপুরগুলো দুর্বিসহ! কি মন উদাস করে ...পুকুর পার থেকে আসা হাওয়া কি যেন বলতে চায় , বার্তা টা ঠিক ধরতে পারেনা মুকুল ,আমের মুকুলের গন্ধ অন্যরকম আবেশ ছড়ায় কাউকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে ,তখনই ভেসে উঠে অদিতির মুখটা । বাগানের দোলনায় নির্জন দুপুরে অদিতি যখন আনমনে দোল খায় আর গেয়ে ওঠে ' কত যে কথা ছিল ,কত যে ছিল গান...' মনে হয় ওর জন্যেই গানটা গাইছে ... অদিতির হাতে থাকে বই এলোমেলো চুল, কি অপরূপ যে লাগে ওকে দেখতে যেন ফুলপরী ।পথ ভুল করে থেকে গেছে যেতে পারেনি নিজের দেশে ... অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য ।
আচ্ছা অদিতি কি কিছুই বুঝতে পারেনা ওকে ? অদিতির জন্মদিনে মুকুল চুপি চুপি ওকে ছাদে ডেকে এনে গোলাপ আর প্রেমের গানের সি ডি উপহার দিল তবুও কি মেয়েটা বুঝল না ? না কি বুঝেও বুঝতে চায় না ?
লাল কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে মুকুল ভাবে আর নয় কালই ওকে বলবে যদি অন্য কেউ এরই মধ্যে ওর জীবনে এসে পড়ে ।ওই গানের মাস্টারটা যদি এসে পড়ে ওদের মাঝে ? না দেরী করবে না মুকুল কিছুতেই না ।
কিছু দিন কেটে গেল নিজের নিয়মে দিন শেষে রাত নামলো বেশ কয়েকটি অমাবস্যা পূর্ণিমাও এলো গেলো কিন্তু অনিকের আর বলা হোল না। কি এক সঙ্কোচে । সে খুব ব্যস্ত এখন গানের প্রতি খুব ঝোঁক বেড়েছে আর সামনে পরীক্ষা ।
দিন কাট তে থাকে অদিতিও ব্যস্ত পড়ালেখায় সামনে পরীক্ষা মুকুলেরও ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলছে সেও ব্যস্ত , বাগানটার দায়িত্ব এখন অনিকের আর মিমির ।
অদিতির পরীক্ষা গান শেখা বাদ । পুরোদমে লেখাপড়া করছে রুটিন মেনে ।স্যার আসেন পড়িয়ে যান কোচিং যায় মায়ের সাথে মাঝে মাঝে মিমি আর ভাইয়ার সাথে খুনসুটি , মিমির টিয়াটা নিয়ে দুষ্টুমি , এভাবেই কাটছে তার সময় , পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খুব মনে পড়ে মুকুলের কথা ও কি এত ব্যস্ত অর মনেও পড়েনা ওর কথা ? এখনো রোজ ভোরে অদিতি বাগানে হাঁটে তারপর পড়তে বসে আর মুকুল তখন রেওয়াজ করে বারান্দায় একবারও ত তাকায় না ওর দিকে , বুক চিরে কান্না আসে অভিমান হয় না আর ভাববে না সে মুকুলের কথা ।
আসলে মুকুল ঠিকই খেয়াল করে অদিতিকে কিন্তু মনে হয় অদিতি কেন নিজে থেকে একটা কথাও বলে না ? এত অহংকার কিসের ? আবার এও ঠিক মুকুল ভীষণ ব্যস্ত পরীক্ষা নিয়ে এর মধ্যে ঠিক প্র্যাক্টিক্যল পরীক্ষার আগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ,অথচ বসে থাকলে চলবে না অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে হবে পেপারস রেডি করা অনেক কাজ এগিয়ে আসে বন্ধুরা সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে অন্তরা ।
মাঝে মাঝে অদিতির মুখটা খুব বেশী মনে পড়ে , সেদিন ও এসেছিল বাগানের গোলাপ নিয়ে মুকুল কে দেখতে ,কিন্তু অভিমানে মুকুল কথা বলেনি কেন এত দেরীতে এল ও ? অদিতি মুখ ভার করে চলে এসেছে ওর চোখের কোনে কান্না জমেছিল । না ওকে কাল ক্ষমা চেয়ে নেবে ভাবলও সে । কিন্তু ব্যস্ততার কারণে মনেই থাকলো না সে কথা ।
সেদিন রাতে খুব সুন্দর জ্যোৎস্না ছিল ,বাগানে হাসনাহেনা ফুটেছে গন্ধে পাড়া মাতাল রাত তখন বারটা প্রায় মুকুল গাইছিল ' কাজলও নদীর জলে , ভরা ঢেউ উচ্ছল ছলে ...' এই গানটা, অদিতি নিজের অজান্তেই বাগানে এসে বসে , মনে হয় মুকুল ওর উদ্দেশেই গানটা গাইছে কাল যেভাবেই হোক সে জানাবে মুকুল কে তার ভালোবাসার কথা ।
মুকুল ভাবে অদিতি শুনতে পাচ্ছে ত ?
এসময় বাগানে আসে অনিক ও বলে তুই একটা গান কর নারে ? অদিতি গায় ''চাদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে ...' বাবা মাও এসে বসেন ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান শোনে মুকুল মৌ আর খালা খালু ।
কি সুন্দর গাইল ও বুকটা কেমন করে উঠলো অনিকের না ওকে বলতেই হবে কাল 'ভালোবাসি ' ।
এদিকে ভয়াবহ রক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করে আছে মুকুল জানত না জানলো দুদিন পর খাবার টেবিলে বাবা বললেন আমাকে রাজশাহী বদলী করা হয়েছে এ মাসেই যেতে হবে । সবাই খুব অবাক হয় অথচ করার কিছু নেই সরকারি চাকুরী বদলী করলে যেতেই হবে । মা বলেন মৌ এর জন্য ভাল স্কুল পাবো ত ? এই ক্লাস নাইনের বছরটা খুব জরুরী সময় । বাবা বলেন পাবে সরকারী স্কুলেই ওকে নিয়ে নেবে এটা নিয়ম ।এখন গোছগাছ করতে থাকো আমি আগে যাই তোমারা দুমাস পর এসো , সেভাবেই গোছগাছ চলতে থাকে ।মুকুল হলে সিট যোগার করে নেয় । দুমাস পর মৌ রা ঢাকা ছেড়ে চলে যায় । যাবার সময় খুব কান্নাকাটি করে সবাই ।
যাবার দুই দিন আগে অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে খালা বলেন ভালো করে পরীক্ষা দিশ , তুই যে আমার বউমা হবি ।
খালার কথাটা কানে বাজতে থাকে আনন্দ শিহরণ খেলে দেহ মনে । খালা আরও বলেন এত তাড়াতাড়ি বলতাম না কিন্তু বলার ত সময় পাবনা তাই বলা তোর মায়ের সাথে কথা হয়ে আছে তুই আমার ছেলের বউ হবি ,মুকুল ও জানে তোকেও বলে রাখলাম । তবে এও বলি তোর যদি এতে মত না থাকে বা মুকুলের যদি মত না থাকে আমরা জোর করবো না । মুকুলের খুব পছন্দ তোকে এখন তোর মত বল । সামনে মা আর খালা দুজনেই দাঁড়িয়ে ভীষণ লজ্জা করে অদিতির ,সে অস্ফুটে বলে আপনাদের মতই আমার মত সেদিন থেকেই সে ভাবতে শুরু করে ওর বিয়ে হয়ে গেছে মুকুল ওর স্বামী । মনে তখন আনন্দের বন্যা । চলে গেলেন খালারা। সব কেমন খালি খালি লাগছে মৌ নেই মুকুল নেই । দুপুর বেলায় মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায় খুব কান্না পায় ।
খালারা যাওয়ার পর মুকুল হল থেকে মাঝে মাঝে আসে । আগে ২/১ দিনের ছুটি হলে এসে রাতে থেকে যেত ,সেই দিনগুলো খুব আনন্দের হত সারাদিনই হৈ চৈ গান । মা ভালমন্দ রান্না করতেন ,ইদানীং ও আসেনা বললেই চলে , ভাইয়ার সাথে দেখা হয় হয়ত কিন্তু ভাইয়ার কাছে জানতে চাইতে খুব লজ্জা করে অথচ কি কষ্ট যে হয় মনে মনে । অদিতির পরীক্ষা শেষ হাতে অফুরন্ত সময় । এখন মুকুলের দেখা নেই । একদিন হঠাৎ এল মুকুল কেমন যেন দূর দূর ভাব রাতে থাকতে খুব অনুরোধ করলো মা থাকলোনা সে ,এক সময় অদিত ও বলল আজ থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে ? মুকুল বলল হবে পড়াশুনার খুব চাপ ।
মুকুলের মনে তখন তোলপাড় একদিকে অদিতি অন্য দিকে অন্তরা । ও অদিতিকে ভুলতে পারছেনা অন্তরাকেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না বরং অন্তরার ছায়া গাড় হয়ে উঠছে ওর মনে । অন্তরা অদিতির চেয়ে অনেক বেশী পরিপক্ব , সাবলীল , ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে মুকুল, অনেক বিষয় নিয়েই যা অদিতির সাথে বলা যায় না ।
অদিতি এখনো ছেলে মানুষ । লজ্জাবতী লতার মত ছুঁয়ে দিলেই নেতিয়ে পরে, যা বলে মুকুল সেটাই মেনে নেয় ভালো বলে । নিজের মতামত দিতে পারেনা ।সিদ্ধান্ত নিতে শেখেনি । ও অবুঝ ।
অন্তরা তা নয় ও সিদ্ধান্ত দিতে ও নিতে জানে মুকুলকে অনেক বিষয়ে পরামর্শ দেয় সে ।
অদিতি কে কথা দেওয়া আছে এখন সে কি করবে ? ভেবে ভেবে রাতের ঘুম হারাম হয়েছে ওর ।
এখনো সে অন্তরাকে বলেনি অদিতির কথা আর অদিতিকে ত বলার প্রশ্নই আসেনা অন্তরার কথা বলার । আরো ভাবতে হবে তাকে ।
দিন দিন জায়গা করে নিচ্ছে মুকুলের অন্তরার সাথেই আজ কাল অনেকটা সময় কাটে ওর ।পড়াশুনা সব কিছুতেই অন্তরা তাকে খুব সাহায্য করে ।ওদের দুজনকে প্রায়ই একসাথে এখানে ওখানে বেড়াতে দেখা যায় । ব্যাপারটা অনিকের ও জানতে বাকী থাকে না ।কিন্তু এই মুহূর্তে সে অদিতিকে কাঁদাতে চায় না তাই ওকে কিছু বলবে না বলেই ঠিক করে ।
সেদিন একা ঘরে মুকুল মা কে প্রশ্ন করে
-----কেন কথা দিয়েছিলে মা? এখন যে আমার বোনটা কষ্ট পাবে বুঝতে পারছ ? সে সব খুলে বলে মাকে, মা চুপ হয়ে যান একদম ,ভাবেন এ কি করলাম আমরা ? মুকুল বলতে থাকে
--- ভাবলে না একবারও বড় হলে মানুষের ইচ্ছেও বদলে যেতে পারে ? ওদের নিজেদের ইচ্ছে অনিচ্ছা থাকতে পারে?
----মা বলেন ওদের ত সব জানিয়েছি । তাও মুকুল এমন করতে পারলো ?
-----অদিতি জানে কথা দেওয়া আছে ?
----কেন মা ওকে জানালে ? ও নিশ্চয় মুকুলকে অনেক স্বপ্ন দেখছে ,তুমি বুঝতে পারছ ওর এই বয়সে স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট কত তীব্র হবে ?
মা চুপ করে কাঁদতে থাকেন । এখন মুকুল কেউ ত দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই এ হল মনের ব্যাপার । রাতে অদিতির বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলবেন ঠিক করেন ।তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন ,অদিতিকে বোঝাতে হবে ,মন ভাল রাখতে হবে ।
সেদিন থেকে অনিক খুব মনোযোগী হয়ে ওঠে অদিতির প্রতি বাগানের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন উদ্যমে । কলেজে ভর্তির জন্য পড়তে বলে বেড়াতে নিয়ে যায় । অদিতি সব বুঝতে পারে সে এতদিনে জেনে গেছে কি হয়েছে ?অনেক আগেই আঁচ করেছিল এখন সন্দেহমুক্ত হয়েছে ।
মায়ের অনুরোধে নিজের মুখ রক্ষার খাতিরে এখনো মুকুল কে যেতে হয় ওই বাসায় , একদিন দুপুরে অদিতি যখন এলোচুলে বাগানে দোলনায় বসে বই পড়ছিল আসলে ও কিছুই পড়ছিল না বই হাতে নিয়ে ভাবছিল ... দুপুরের নির্জনতায় খুব মন খারাপ ছিল তার সে শুনছিল মৌমাছির গুনগুন দেখছিল প্রজাপতির উড়ে যাওয়া দুটো শালিক হাঁটছে শিউলি গাছের ছায়ায়। এসময় মুকুল এল গেট দিয়ে ঢুকতেই অদিতি ডাক দেয়,-এদিকে আসুন ও তাকে আপনিই বলে ,মুকুল অপরাধী মুখে থমকে দাঁড়ায় ...কাছে আসে অদিতি যায়গা করে দিয়ে
---বলে বসুন খুব সংকোচে ওর পাশে বসে মুকুল অথচ ছয় মাস আগেই এই সংকোচ ছিল না তার ।
একটু চুপ থেকে নিজেকে সামলে নেয় অদিতি তারপর বলে এত ভাবছেন কেন বলুন তো ? আপনার অন্য কাওকে ভাল লেগেছে লাগতেই পারে তার জন্য এত দ্বিধা কেন ? আপনি আমাকে বললেই তো মিটে যায় সব । আপনি মুক্ত আমি ত আপনাকে কোনদিন কথা দিই নি বলিনি ভালোবাসি তাহলে কিসের বন্ধন আপনার ? যাকে ভাল লেগেছে তার কাছে ফিরে যান ...বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে মুকুল প্রশ্ন করে তুমি জানলে কি করে ?
---সেটা কোন দরকারি বিষয় নয় যা দরকারি ছিল বলেছি ।
---না তবুও বল কি করে জানলে ? আর তুমি কি করে এভাবে সমস্যার সমাধান করে দিলে তুমি জানোনা আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ।
----জানি সব জানি কিন্তু জোর করে পেতে চাইনা । কথা দিয়েছিলেন আমাদের দুজনের বাবা -মা তাই না । আজ আপনার একজন কে ভালো লেগেছে ,কাল আমার ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে তাই এ কথা দেয়া নেয়ার মূল্য আর নেই ।
-----তুমি বড়দের মত করে ভাবতে শিখলে কবে অদিতি ?এভাবে দুই মিনিটে সমস্যার সমাধান করে দিলে তুমি কি করে? কষ্ট হল না তোমার ? আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব কষ্ট পাবে এসব শুনলে ।
-----না হল না কষ্ট .. আর এসব কথা কি লুকিয়ে রাখা যায় ?.ভাবনার কথা বলছেন ? পরিস্থিতি আমাকে এভাবে ভাবিয়েছে ,আপনি যতটা অবুঝ ভাবেন আমি তত অবুঝ নই মুকুল । কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ ও নেই আপনি ভেতরে যান মা আছেন ।
--- আচ্ছা এখন বল তুমি কি করে জানলে ?
-----বলতেই হবে ? তবে শুনুন সেদিন আপনি একটা খাতা ফেলে গিয়েছিলেন সেখানে লেখা ছিল আপনার এই ভাললাগার কথা । আর আপনার আচরণেই প্রকাশ পাচ্ছিল আপনার দ্বিধার কথা , ইদানীং খুব এড়িয়ে চলছিলেন আমাকে যাই হোক , খাতাটা আমি রেখে দিয়েছি নিয়ে যাবেন আজ ।আর খালা খালুকে বলবেন এই বিয়েতে আমার মত নেই।
----বেশ তাই হবে বলে উঠে যায় মুকুল আর অদিতি তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ...
বাগানে শিউলি গাছের ছায়ায় এতক্ষণ দুটো শালিক ছিল এখন একটা একা মনের সুখে ঘুরছে ।অদিতি ভাবে আজ থেকে আমিও ওর মতো একাই উড়বো মনের আকাশে ............
অনেক বছর পর অদিতি তখন ডাক্তারি পাশ করে চাকরী করছে এতদিনে মিমি কলেজে পড়ছে মৌ এর বিয়ে হয়েছে সে বিদেশে থাকে বরের সাথে । অদিতির দেখা হল মুকুলের সাথে এয়ারপোর্টে অদিতি ট্রেনিং এ যাচ্ছে ইংল্যান্ড আর মুকুল যাচ্ছে অফিসের কাজে সে বেশীর ভাগ সময় ওই দেশেই থাকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে এসে ওরা থমকে দাঁড়ায় ,মুকুলের চুলগুলো সাদা , চালচলনে বেশ ভারিক্কি ভাব , বলে
----কেমন আছ অদিতি ?
-----ভালো ।আপনি একা যে ?
---তুমিও ত একা ?
অমিত সবসময় একাই ছিলাম একাই আছি কিন্তু আপনি একা কেন ?
---- অন্তরা নেই ।আমাদের প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে ...
---মেয়ে কোথায় থাকে কেমন আছে ? বয়স কত ?
---বলছি দাঁড়াও মেয়ে এতিম খানায় মা মারা যাবার পর ওকে দেখার কেউ ছিল না বয়স ৩ বছর ।
----কেন অর নানা - নানু নেই
---না তারা এই বিয়ে মেনে নেননি ওর সন্তানের দায়ভার কেন নেবেন ? আমিই বা কেন দেব?
---তাই বলে এতিম খানায় বড় হবে ও ?
--- হা উপায় কি বল অণুর যে কেউ নেই আর । আমি থাকি ব্যস্ত কে দেখবে ওকে ? মৌ টাও বিদেশে ।একবার মনে হয়েছিল তোমার কাছে যাই পরে ভাবলাম কোন মুখে যাবো ? আজ আরও অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে তুমি বিয়েই করলে না । আমার জন্য তোমার জীবন ও নষ্ট হল।
কোন কথা বলল না অদিতি শুধু মনে মনে ভাবল বিয়ে তো হয়েছিল সেই ছোট বেলায় আর ভেঙেও গেল তখনি । পুরো জার্নিতে অদিতি কোন কথা বলল না । প্লেন ল্যান্ড করবে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইক্রোফোনে তার ঘোষণা আসছে সিট বেল বাঁধতে বলা হচ্ছে ,
--- তখন অদিতি বলে একটা কিছু চাইবো দেবেন ?
---কি দেব বল ? আমার দেবার মত কিছুই নেই আর ...তবুও যদি থাকে দেব বল তুমি ।কিছুক্ষণ চুপ থেকে অদিতি বলে ,
----অণুকে চাই আমিও বড় একা , আমি ওর দায়িত্ব নেব মানুষ করবো ।ও জানবে আমি ওর খালা । ওর কোন অযত্ন হবে না ,এখনো মা আছেন ,আমরা দুজনে ঠিক ওকে দেখে রাখবো ।
----- দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মুকুল বলে বেশ তাই হবে ,ফিরে এসে ওকে তোমাদের ওখানে রেখে আসবো ,তোমার কাছে আমি হেরে গেলাম চিরকাল । ওর চোখে ভেসে ওঠে সেই ক্ষতবিক্ষত সূর্যমুখী ফুলটা একদিন নিজে সে ছবিটা তুলেছিল।
অদিতি মনে মনে বলে তোমার জন্যই আমার ঘর বাঁধা হোল না সংসার করা হোল না , জগতের স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের কাছে আমি কবেই হেরে বসে আছি চোখের সামনে ভেসে ওঠে উড়ে যাওয়া সেই টিয়া পাখিটা ।
প্লেন তখন লন্ডনের মাটি স্পর্শ করল মাত্র ।
সকাল সকাল এই দৃশ্যটা অকল্পনীয় আর অসহ্য ,অদিতি রাগ করবে না দেখবে ভেবে পেলো না অগত্যা চা এর কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রইলো ।এসময় ভাইয়া এলো তিনিও নির্বাক ,কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যা যা বলে চেঁচিয়ে উঠলেন । অদিতি বলল কি করলে ভাইয়া ? ইসশ পাখিটা ধরা যেতনা ? এসময় চোখ মুছতে মুছতে মিমিও এসে পড়েছে ,সে শুধু দেখলো ৪/৫টা সবুজ টিয়া উড়ে যাচ্ছে , তার বায়না ওটা চাই । এই হৈ চৈ এ পাশের বাড়ির দোতালায় মুকুল গান থামিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে ...মুকুল চেঁচিয়ে বলল ভাইয়া আমি ছবি তুলেছি , এদিক থেকে অনিক বলল যাক তুমি দুর্লভ দৃশ্যটা ধরে রেখেছ তাহলে ? আমায় দিও ছবিটা ।
রোজ ভোরে নামাজ শেষ করে খালি পায়ে বাগানে হেঁটে হেঁটে অদিতি আর অনিক চা খায় , গাছগুলো দেখে পানি দেয় পরিচর্যা করে পুরনো ফুল তুলে নেয় ঘর সাজায় এ সময় পাশের বাড়ির মুকুলের বোন মৌ আসে , ওপাশের দোতালা বাড়ির শানু চার তালার মামুন তিন তলার রুপা এসে ফুল নিয়ে যায় ।, তারপর ওরা পড়তে যায় ।
বাগানটা ওদের দুই ভাইবোনের নিজের হাতে করা কোন মালী নেই ,অদিতি আর অনিক দুজনে দেশী -বিদেশী ফুলের গাছ লাগায় যত্ন করে আবার পরের মৌসুমে লাগাবে বলে বীজ রাখে যত্ন করে । শরতে শিউলি গাছটার নিচে যখন রাশি রাশি শিউলি পরে থাকে সবুজের বুকে শিশির জড়ানো শিউলি কি যে অপূর্ব দেখায়!কিংবা জ্যোৎস্না রাতে যখন চন্দ্রমল্লিকা বা হাসনাহেনা ফোটে কি সুন্দর যে দেখায় ফুলগুলো যেন এক একটা নক্ষত্র !
তা আজ যে ঘটনা অদের যুগপৎ অবাক আর রাগান্বিত করেছে তা হল বারান্দার ধারের যে বেড তাতে সূর্যমুখীর ১২ টা গাছ তাতে বিরাট বিরাট খয়েরী -হলুদ সূর্যমুখী ফুটে ছিল । ত সকালে নিয়ম মাফিক অদিতি চা এর কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দেখল ৩/৪ টা টিয়ে পাখি সূর্যমুখী ফুলের বুকে বসে ফুলের খয়েরী বীজ খুঁটে খাচ্ছে পাপড়িগুলো তছনছ হয়ে আছে , এ দৃশ্য অকল্পনীয় আবার নির্মম সুন্দর, অদিতির মনে হচ্ছিল যেন পাখিগুলো ওর বুকে ঠোকর দিচ্ছে! তখন ভাইয়াও এসে নির্বাক তাকিয়ে থাকে ।ঠিক এই সময় প্রতিদিন মুকুল বারান্দায় বসে রেওয়াজ করে সে প্রথম বারান্দায় এসেই এ দৃশ্য দেখতে পায় দৌড়ে গিয়ে মোবাইল নিয়ে এসে ঘর ছবি তুলতে তৈরি হয় আর একটা ছবি তুলতেই নিচে গোলমাল বেঁধে যায় । মিমি পাখির জন্যে কান্না জুড়ে দেয় ।
ধীরে ধীরে রঙ পাল্টাচ্ছে আকাশে নীল কমে গাড় হচ্ছে সাদা আর সোনালী আভা । কয়েকটা প্রজাপতি উড়ছে ফুলে ফুলে। সুন্দর ঝির ঝিরে হাওয়া । বেশ কিছু নতুন ফুল ফুটেছে অদিতি আর অনিক বাগানে নেমে গেল গাছের পরিচর্যা করতে হবে ফুল নিয়ে সাজাতে হবে । । অদিতি পড়ে ক্লাস টেনে অনিক ভার্সিটিতে পড়ছে ২য় বর্ষে ।অদিতি ফুল তুলতে থাকে মৌ কে কিছু ফুল দিল, সে নিজে কিছু গাঁদা ফুল নিয়ে উঠে পড়লো । মুকুল ওপর থেকে বলল আমার জন্যে কিন্তু ৩ টে গোলাপ দিও অদিতি ,৩ টি গোলাপ দিয়ে দিল তুলে । ফুটন্ত গোলাপগুলো পাপড়ি মেলে ফুটে আছে সেগুলো সে ধরল না , বাকী যে কটা আছে ধরলেই ঝরে যাবে । উঠে এল ওরা বাগান থেকে বেলা বাড়ছে ঝকঝকে রোদ কিন্তু বার বার মনে পড়ছে ক্ষতবিক্ষত ফুলগুলোর কথা ।
নাস্তার টেবিলে মা জিজ্ঞেস করেন কিরে সকালে কি নিয়ে এত গোলমাল হলরে ? মিমি মহা উৎসাহে ঘটনা বর্ণনা করে এও বলে তার একটা টিয়া পাখি আজই চাই , মিমি পড়ে ক্লাস সিক্স এ ।বাবা হেসে বলেন বেশ তো রুনু তুমি কাঁটাবন থেকে ভালো দেখে একটা পাখি কিনে দাও ওকে তবে হ্যাঁ মামনি পাখিটাকে কিন্তু তুমি কথা শেখাতে হবে ।মিমি বলে শেখাবো । সবাই হাসতে থাকে ।
অদিতি নিজের ঘরে এসে পড়তে বসে। মৌ আর অদিতি একই স্কুলে পড়ে একটু পড়েই ওরা স্কুলে যাবে এসময় মুকুল আসে এ বাড়িতে ওদের আর ওই বাড়িতে এদের অবাধ যাতায়াত । কেউ কিছু মনে করেনা ,মুকুল এসে বলে
---আমার গোলাপ কই?
----কেন সকালেই ত দিলাম মৌ এর হাতে ,
---কেন তুমি নিজে দিতে পারনি ? অদিতির সারা মনে অদ্ভুত এক আলোড়ন নিজেকে শান্ত রেখে বলে একই ত কথা আপনি ফুল চেয়েছেন আমি দিয়েছি ,
----এক কথা নয় কাল থেকে তুমি দেবে আমি নিচে নেমে হাত বাড়িয়ে নেব ।
অদিতি বলে বেশ দেব । মুকুল যায় অনিকের ঘরে একটা বই নিতে এসেছিল সে , তারপর মনে হল অদিতিকে একটু ঘাবড়ে দিই ,এমনি অদিতি খুব শান্ত মেয়ে ওর সাথে দুষ্টুমি করতে বেশ লাগে ।ও খুব শান্ত আর দেখতে শ্যামলা মিষ্টি । আর খুব ভিতু ।
অদিতি আর মৌ রেডি স্কুলে যাবে অনিক চলে গেছে ওর পরীক্ষা মা বলেন মুকুল আমার হাতে অনেক কাজ একটা রিক্সা ঠিক করে দাও ওদের দেখো রিক্সা ওয়ালা যেন বুড়ো আর ভাল হয় ,মুকুল হাসতে হাসতে বলে
----বুড়ো কি ওদের টানতে পারবে খালা ?এক এক জনের যে ওজন ।হেসে ফেলে মা বলেন
--- বাবা দুষ্টুমি রাখো দেরি হয়ে যাচ্ছে ওদের ।
ওরা বেড়িয়ে পড়ে । ওদের বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে বড় পুকুর , এর ধার ঘেঁষে বড় বড় গাছ আর শান বাঁধানো ঘাটে সারাবেলা কেউ না কেউ গোসল করে ,কাপড় কাঁচে গল্প করে ,মোটের ওপর লোকের আনাগোনা থাকেই । গাছগুলো সুন্দর তুমুল হাওয়া দেয় পানিতে সাতার কাটে রাজ হাঁস আর হাঁস ।
পুকুর পাড়টা পেড়িয়ে একটা গলি ,ভাগ্য প্রসন্ন না হলে গলির মোড়ে না গিয়ে রিক্সা পাওয়া যায় না । ওরা গলিটা পার হওয়ার সময় দুটো বখাটে ছেলে কি যেন বলে ওদের লক্ষ্য করে মুকুল ভীষণ রেগে কিছু বলতে যায় লোকজন থামায় ওকে তবে সেও সাবধান করে দেয় কোনোদিন যেন এ পাড়ায় না দেখা যায় ওদের । এরপর মুকুল ওদের রিক্সা ঠিক করে দিয়ে সেও চলে যায় ভার্সিটিতে সে এবার প্রথম বর্ষের ছাত্র তার বিষয় গণিত ,ভীষণ রসকষহীন মনে হয় তার ।
ক্লাস শেষে বাসায় এসে মুকুল ভাবতে বসে অদিতিকে তার শুধু ভাল না বেশ ভালো লাগে কিন্তু কথাটা বলার সময় এখনো আসেনি সামনে ওর এস এস সি পরীক্ষা এসময় এই কথা বলে ওকে ভাবিয়ে তোলা ঠিক হবে না ,অথচ না বলতে পেরে সে ছটফট করে রাত দিন ।একটা ভয়ও কাজ করে যদি অদিতি ওকে না বলে ? না ওকে তেমন অপছন্দ করে বলে ত মনে হয়না।
অদিতি খুব সরল একটা মেয়ে ছোট থেকে ওকে দেখছে ,বই পড়া আর বাগান করা এই নিয়েই মেতে থাকে সারাক্ষণ । মুকুলের খুব অপছন্দ ওদের গানের মাষ্টার কে ,ওরা তিনজন মানে অদিতি মৌ আর মিমি যখন গান শিখতে বসে ,মুকুল খেয়াল করে দেখেছে মাষ্টার যেন অদিতির দিকে একটু বেশি মনোযোগ দেয় , আর বেছে বেছে প্রেমের গানগুলোই ওকে শেখাবে বড় রাগ হয় তার , এসময় মা খেতে ডাকেন ।
ফাগুনের এই দুপুরগুলো দুর্বিসহ! কি মন উদাস করে ...পুকুর পার থেকে আসা হাওয়া কি যেন বলতে চায় , বার্তা টা ঠিক ধরতে পারেনা মুকুল ,আমের মুকুলের গন্ধ অন্যরকম আবেশ ছড়ায় কাউকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে ,তখনই ভেসে উঠে অদিতির মুখটা । বাগানের দোলনায় নির্জন দুপুরে অদিতি যখন আনমনে দোল খায় আর গেয়ে ওঠে ' কত যে কথা ছিল ,কত যে ছিল গান...' মনে হয় ওর জন্যেই গানটা গাইছে ... অদিতির হাতে থাকে বই এলোমেলো চুল, কি অপরূপ যে লাগে ওকে দেখতে যেন ফুলপরী ।পথ ভুল করে থেকে গেছে যেতে পারেনি নিজের দেশে ... অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য ।
আচ্ছা অদিতি কি কিছুই বুঝতে পারেনা ওকে ? অদিতির জন্মদিনে মুকুল চুপি চুপি ওকে ছাদে ডেকে এনে গোলাপ আর প্রেমের গানের সি ডি উপহার দিল তবুও কি মেয়েটা বুঝল না ? না কি বুঝেও বুঝতে চায় না ?
লাল কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে মুকুল ভাবে আর নয় কালই ওকে বলবে যদি অন্য কেউ এরই মধ্যে ওর জীবনে এসে পড়ে ।ওই গানের মাস্টারটা যদি এসে পড়ে ওদের মাঝে ? না দেরী করবে না মুকুল কিছুতেই না ।
কিছু দিন কেটে গেল নিজের নিয়মে দিন শেষে রাত নামলো বেশ কয়েকটি অমাবস্যা পূর্ণিমাও এলো গেলো কিন্তু অনিকের আর বলা হোল না। কি এক সঙ্কোচে । সে খুব ব্যস্ত এখন গানের প্রতি খুব ঝোঁক বেড়েছে আর সামনে পরীক্ষা ।
দিন কাট তে থাকে অদিতিও ব্যস্ত পড়ালেখায় সামনে পরীক্ষা মুকুলেরও ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলছে সেও ব্যস্ত , বাগানটার দায়িত্ব এখন অনিকের আর মিমির ।
অদিতির পরীক্ষা গান শেখা বাদ । পুরোদমে লেখাপড়া করছে রুটিন মেনে ।স্যার আসেন পড়িয়ে যান কোচিং যায় মায়ের সাথে মাঝে মাঝে মিমি আর ভাইয়ার সাথে খুনসুটি , মিমির টিয়াটা নিয়ে দুষ্টুমি , এভাবেই কাটছে তার সময় , পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খুব মনে পড়ে মুকুলের কথা ও কি এত ব্যস্ত অর মনেও পড়েনা ওর কথা ? এখনো রোজ ভোরে অদিতি বাগানে হাঁটে তারপর পড়তে বসে আর মুকুল তখন রেওয়াজ করে বারান্দায় একবারও ত তাকায় না ওর দিকে , বুক চিরে কান্না আসে অভিমান হয় না আর ভাববে না সে মুকুলের কথা ।
আসলে মুকুল ঠিকই খেয়াল করে অদিতিকে কিন্তু মনে হয় অদিতি কেন নিজে থেকে একটা কথাও বলে না ? এত অহংকার কিসের ? আবার এও ঠিক মুকুল ভীষণ ব্যস্ত পরীক্ষা নিয়ে এর মধ্যে ঠিক প্র্যাক্টিক্যল পরীক্ষার আগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ,অথচ বসে থাকলে চলবে না অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে হবে পেপারস রেডি করা অনেক কাজ এগিয়ে আসে বন্ধুরা সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে অন্তরা ।
মাঝে মাঝে অদিতির মুখটা খুব বেশী মনে পড়ে , সেদিন ও এসেছিল বাগানের গোলাপ নিয়ে মুকুল কে দেখতে ,কিন্তু অভিমানে মুকুল কথা বলেনি কেন এত দেরীতে এল ও ? অদিতি মুখ ভার করে চলে এসেছে ওর চোখের কোনে কান্না জমেছিল । না ওকে কাল ক্ষমা চেয়ে নেবে ভাবলও সে । কিন্তু ব্যস্ততার কারণে মনেই থাকলো না সে কথা ।
সেদিন রাতে খুব সুন্দর জ্যোৎস্না ছিল ,বাগানে হাসনাহেনা ফুটেছে গন্ধে পাড়া মাতাল রাত তখন বারটা প্রায় মুকুল গাইছিল ' কাজলও নদীর জলে , ভরা ঢেউ উচ্ছল ছলে ...' এই গানটা, অদিতি নিজের অজান্তেই বাগানে এসে বসে , মনে হয় মুকুল ওর উদ্দেশেই গানটা গাইছে কাল যেভাবেই হোক সে জানাবে মুকুল কে তার ভালোবাসার কথা ।
মুকুল ভাবে অদিতি শুনতে পাচ্ছে ত ?
এসময় বাগানে আসে অনিক ও বলে তুই একটা গান কর নারে ? অদিতি গায় ''চাদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে ...' বাবা মাও এসে বসেন ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান শোনে মুকুল মৌ আর খালা খালু ।
কি সুন্দর গাইল ও বুকটা কেমন করে উঠলো অনিকের না ওকে বলতেই হবে কাল 'ভালোবাসি ' ।
এদিকে ভয়াবহ রক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করে আছে মুকুল জানত না জানলো দুদিন পর খাবার টেবিলে বাবা বললেন আমাকে রাজশাহী বদলী করা হয়েছে এ মাসেই যেতে হবে । সবাই খুব অবাক হয় অথচ করার কিছু নেই সরকারি চাকুরী বদলী করলে যেতেই হবে । মা বলেন মৌ এর জন্য ভাল স্কুল পাবো ত ? এই ক্লাস নাইনের বছরটা খুব জরুরী সময় । বাবা বলেন পাবে সরকারী স্কুলেই ওকে নিয়ে নেবে এটা নিয়ম ।এখন গোছগাছ করতে থাকো আমি আগে যাই তোমারা দুমাস পর এসো , সেভাবেই গোছগাছ চলতে থাকে ।মুকুল হলে সিট যোগার করে নেয় । দুমাস পর মৌ রা ঢাকা ছেড়ে চলে যায় । যাবার সময় খুব কান্নাকাটি করে সবাই ।
যাবার দুই দিন আগে অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে খালা বলেন ভালো করে পরীক্ষা দিশ , তুই যে আমার বউমা হবি ।
খালার কথাটা কানে বাজতে থাকে আনন্দ শিহরণ খেলে দেহ মনে । খালা আরও বলেন এত তাড়াতাড়ি বলতাম না কিন্তু বলার ত সময় পাবনা তাই বলা তোর মায়ের সাথে কথা হয়ে আছে তুই আমার ছেলের বউ হবি ,মুকুল ও জানে তোকেও বলে রাখলাম । তবে এও বলি তোর যদি এতে মত না থাকে বা মুকুলের যদি মত না থাকে আমরা জোর করবো না । মুকুলের খুব পছন্দ তোকে এখন তোর মত বল । সামনে মা আর খালা দুজনেই দাঁড়িয়ে ভীষণ লজ্জা করে অদিতির ,সে অস্ফুটে বলে আপনাদের মতই আমার মত সেদিন থেকেই সে ভাবতে শুরু করে ওর বিয়ে হয়ে গেছে মুকুল ওর স্বামী । মনে তখন আনন্দের বন্যা । চলে গেলেন খালারা। সব কেমন খালি খালি লাগছে মৌ নেই মুকুল নেই । দুপুর বেলায় মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায় খুব কান্না পায় ।
খালারা যাওয়ার পর মুকুল হল থেকে মাঝে মাঝে আসে । আগে ২/১ দিনের ছুটি হলে এসে রাতে থেকে যেত ,সেই দিনগুলো খুব আনন্দের হত সারাদিনই হৈ চৈ গান । মা ভালমন্দ রান্না করতেন ,ইদানীং ও আসেনা বললেই চলে , ভাইয়ার সাথে দেখা হয় হয়ত কিন্তু ভাইয়ার কাছে জানতে চাইতে খুব লজ্জা করে অথচ কি কষ্ট যে হয় মনে মনে । অদিতির পরীক্ষা শেষ হাতে অফুরন্ত সময় । এখন মুকুলের দেখা নেই । একদিন হঠাৎ এল মুকুল কেমন যেন দূর দূর ভাব রাতে থাকতে খুব অনুরোধ করলো মা থাকলোনা সে ,এক সময় অদিত ও বলল আজ থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে ? মুকুল বলল হবে পড়াশুনার খুব চাপ ।
মুকুলের মনে তখন তোলপাড় একদিকে অদিতি অন্য দিকে অন্তরা । ও অদিতিকে ভুলতে পারছেনা অন্তরাকেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না বরং অন্তরার ছায়া গাড় হয়ে উঠছে ওর মনে । অন্তরা অদিতির চেয়ে অনেক বেশী পরিপক্ব , সাবলীল , ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে মুকুল, অনেক বিষয় নিয়েই যা অদিতির সাথে বলা যায় না ।
অদিতি এখনো ছেলে মানুষ । লজ্জাবতী লতার মত ছুঁয়ে দিলেই নেতিয়ে পরে, যা বলে মুকুল সেটাই মেনে নেয় ভালো বলে । নিজের মতামত দিতে পারেনা ।সিদ্ধান্ত নিতে শেখেনি । ও অবুঝ ।
অন্তরা তা নয় ও সিদ্ধান্ত দিতে ও নিতে জানে মুকুলকে অনেক বিষয়ে পরামর্শ দেয় সে ।
অদিতি কে কথা দেওয়া আছে এখন সে কি করবে ? ভেবে ভেবে রাতের ঘুম হারাম হয়েছে ওর ।
এখনো সে অন্তরাকে বলেনি অদিতির কথা আর অদিতিকে ত বলার প্রশ্নই আসেনা অন্তরার কথা বলার । আরো ভাবতে হবে তাকে ।
দিন দিন জায়গা করে নিচ্ছে মুকুলের অন্তরার সাথেই আজ কাল অনেকটা সময় কাটে ওর ।পড়াশুনা সব কিছুতেই অন্তরা তাকে খুব সাহায্য করে ।ওদের দুজনকে প্রায়ই একসাথে এখানে ওখানে বেড়াতে দেখা যায় । ব্যাপারটা অনিকের ও জানতে বাকী থাকে না ।কিন্তু এই মুহূর্তে সে অদিতিকে কাঁদাতে চায় না তাই ওকে কিছু বলবে না বলেই ঠিক করে ।
সেদিন একা ঘরে মুকুল মা কে প্রশ্ন করে
-----কেন কথা দিয়েছিলে মা? এখন যে আমার বোনটা কষ্ট পাবে বুঝতে পারছ ? সে সব খুলে বলে মাকে, মা চুপ হয়ে যান একদম ,ভাবেন এ কি করলাম আমরা ? মুকুল বলতে থাকে
--- ভাবলে না একবারও বড় হলে মানুষের ইচ্ছেও বদলে যেতে পারে ? ওদের নিজেদের ইচ্ছে অনিচ্ছা থাকতে পারে?
----মা বলেন ওদের ত সব জানিয়েছি । তাও মুকুল এমন করতে পারলো ?
-----অদিতি জানে কথা দেওয়া আছে ?
----কেন মা ওকে জানালে ? ও নিশ্চয় মুকুলকে অনেক স্বপ্ন দেখছে ,তুমি বুঝতে পারছ ওর এই বয়সে স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট কত তীব্র হবে ?
মা চুপ করে কাঁদতে থাকেন । এখন মুকুল কেউ ত দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই এ হল মনের ব্যাপার । রাতে অদিতির বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলবেন ঠিক করেন ।তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন ,অদিতিকে বোঝাতে হবে ,মন ভাল রাখতে হবে ।
সেদিন থেকে অনিক খুব মনোযোগী হয়ে ওঠে অদিতির প্রতি বাগানের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন উদ্যমে । কলেজে ভর্তির জন্য পড়তে বলে বেড়াতে নিয়ে যায় । অদিতি সব বুঝতে পারে সে এতদিনে জেনে গেছে কি হয়েছে ?অনেক আগেই আঁচ করেছিল এখন সন্দেহমুক্ত হয়েছে ।
মায়ের অনুরোধে নিজের মুখ রক্ষার খাতিরে এখনো মুকুল কে যেতে হয় ওই বাসায় , একদিন দুপুরে অদিতি যখন এলোচুলে বাগানে দোলনায় বসে বই পড়ছিল আসলে ও কিছুই পড়ছিল না বই হাতে নিয়ে ভাবছিল ... দুপুরের নির্জনতায় খুব মন খারাপ ছিল তার সে শুনছিল মৌমাছির গুনগুন দেখছিল প্রজাপতির উড়ে যাওয়া দুটো শালিক হাঁটছে শিউলি গাছের ছায়ায়। এসময় মুকুল এল গেট দিয়ে ঢুকতেই অদিতি ডাক দেয়,-এদিকে আসুন ও তাকে আপনিই বলে ,মুকুল অপরাধী মুখে থমকে দাঁড়ায় ...কাছে আসে অদিতি যায়গা করে দিয়ে
---বলে বসুন খুব সংকোচে ওর পাশে বসে মুকুল অথচ ছয় মাস আগেই এই সংকোচ ছিল না তার ।
একটু চুপ থেকে নিজেকে সামলে নেয় অদিতি তারপর বলে এত ভাবছেন কেন বলুন তো ? আপনার অন্য কাওকে ভাল লেগেছে লাগতেই পারে তার জন্য এত দ্বিধা কেন ? আপনি আমাকে বললেই তো মিটে যায় সব । আপনি মুক্ত আমি ত আপনাকে কোনদিন কথা দিই নি বলিনি ভালোবাসি তাহলে কিসের বন্ধন আপনার ? যাকে ভাল লেগেছে তার কাছে ফিরে যান ...বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে মুকুল প্রশ্ন করে তুমি জানলে কি করে ?
---সেটা কোন দরকারি বিষয় নয় যা দরকারি ছিল বলেছি ।
---না তবুও বল কি করে জানলে ? আর তুমি কি করে এভাবে সমস্যার সমাধান করে দিলে তুমি জানোনা আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ।
----জানি সব জানি কিন্তু জোর করে পেতে চাইনা । কথা দিয়েছিলেন আমাদের দুজনের বাবা -মা তাই না । আজ আপনার একজন কে ভালো লেগেছে ,কাল আমার ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে তাই এ কথা দেয়া নেয়ার মূল্য আর নেই ।
-----তুমি বড়দের মত করে ভাবতে শিখলে কবে অদিতি ?এভাবে দুই মিনিটে সমস্যার সমাধান করে দিলে তুমি কি করে? কষ্ট হল না তোমার ? আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব কষ্ট পাবে এসব শুনলে ।
-----না হল না কষ্ট .. আর এসব কথা কি লুকিয়ে রাখা যায় ?.ভাবনার কথা বলছেন ? পরিস্থিতি আমাকে এভাবে ভাবিয়েছে ,আপনি যতটা অবুঝ ভাবেন আমি তত অবুঝ নই মুকুল । কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ ও নেই আপনি ভেতরে যান মা আছেন ।
--- আচ্ছা এখন বল তুমি কি করে জানলে ?
-----বলতেই হবে ? তবে শুনুন সেদিন আপনি একটা খাতা ফেলে গিয়েছিলেন সেখানে লেখা ছিল আপনার এই ভাললাগার কথা । আর আপনার আচরণেই প্রকাশ পাচ্ছিল আপনার দ্বিধার কথা , ইদানীং খুব এড়িয়ে চলছিলেন আমাকে যাই হোক , খাতাটা আমি রেখে দিয়েছি নিয়ে যাবেন আজ ।আর খালা খালুকে বলবেন এই বিয়েতে আমার মত নেই।
----বেশ তাই হবে বলে উঠে যায় মুকুল আর অদিতি তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ...
বাগানে শিউলি গাছের ছায়ায় এতক্ষণ দুটো শালিক ছিল এখন একটা একা মনের সুখে ঘুরছে ।অদিতি ভাবে আজ থেকে আমিও ওর মতো একাই উড়বো মনের আকাশে ............
অনেক বছর পর অদিতি তখন ডাক্তারি পাশ করে চাকরী করছে এতদিনে মিমি কলেজে পড়ছে মৌ এর বিয়ে হয়েছে সে বিদেশে থাকে বরের সাথে । অদিতির দেখা হল মুকুলের সাথে এয়ারপোর্টে অদিতি ট্রেনিং এ যাচ্ছে ইংল্যান্ড আর মুকুল যাচ্ছে অফিসের কাজে সে বেশীর ভাগ সময় ওই দেশেই থাকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে এসে ওরা থমকে দাঁড়ায় ,মুকুলের চুলগুলো সাদা , চালচলনে বেশ ভারিক্কি ভাব , বলে
----কেমন আছ অদিতি ?
-----ভালো ।আপনি একা যে ?
---তুমিও ত একা ?
অমিত সবসময় একাই ছিলাম একাই আছি কিন্তু আপনি একা কেন ?
---- অন্তরা নেই ।আমাদের প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে ...
---মেয়ে কোথায় থাকে কেমন আছে ? বয়স কত ?
---বলছি দাঁড়াও মেয়ে এতিম খানায় মা মারা যাবার পর ওকে দেখার কেউ ছিল না বয়স ৩ বছর ।
----কেন অর নানা - নানু নেই
---না তারা এই বিয়ে মেনে নেননি ওর সন্তানের দায়ভার কেন নেবেন ? আমিই বা কেন দেব?
---তাই বলে এতিম খানায় বড় হবে ও ?
--- হা উপায় কি বল অণুর যে কেউ নেই আর । আমি থাকি ব্যস্ত কে দেখবে ওকে ? মৌ টাও বিদেশে ।একবার মনে হয়েছিল তোমার কাছে যাই পরে ভাবলাম কোন মুখে যাবো ? আজ আরও অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে তুমি বিয়েই করলে না । আমার জন্য তোমার জীবন ও নষ্ট হল।
কোন কথা বলল না অদিতি শুধু মনে মনে ভাবল বিয়ে তো হয়েছিল সেই ছোট বেলায় আর ভেঙেও গেল তখনি । পুরো জার্নিতে অদিতি কোন কথা বলল না । প্লেন ল্যান্ড করবে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইক্রোফোনে তার ঘোষণা আসছে সিট বেল বাঁধতে বলা হচ্ছে ,
--- তখন অদিতি বলে একটা কিছু চাইবো দেবেন ?
---কি দেব বল ? আমার দেবার মত কিছুই নেই আর ...তবুও যদি থাকে দেব বল তুমি ।কিছুক্ষণ চুপ থেকে অদিতি বলে ,
----অণুকে চাই আমিও বড় একা , আমি ওর দায়িত্ব নেব মানুষ করবো ।ও জানবে আমি ওর খালা । ওর কোন অযত্ন হবে না ,এখনো মা আছেন ,আমরা দুজনে ঠিক ওকে দেখে রাখবো ।
----- দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মুকুল বলে বেশ তাই হবে ,ফিরে এসে ওকে তোমাদের ওখানে রেখে আসবো ,তোমার কাছে আমি হেরে গেলাম চিরকাল । ওর চোখে ভেসে ওঠে সেই ক্ষতবিক্ষত সূর্যমুখী ফুলটা একদিন নিজে সে ছবিটা তুলেছিল।
অদিতি মনে মনে বলে তোমার জন্যই আমার ঘর বাঁধা হোল না সংসার করা হোল না , জগতের স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের কাছে আমি কবেই হেরে বসে আছি চোখের সামনে ভেসে ওঠে উড়ে যাওয়া সেই টিয়া পাখিটা ।
প্লেন তখন লন্ডনের মাটি স্পর্শ করল মাত্র ।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন