৩ সেপ, ২০১৩

ছোটগল্প - সৈয়দ রায়হান বিন ওয়ালী



ভাঙ্গনের নিগুঢ়ে কাঙ্ক্ষিত আগামী
সৈয়দ রায়হান বিন ওয়ালী


অনেক ভেবেচিন্তে এবং দীর্ঘদিন নিজের সাথে বোঝাপড়া শেষে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দীপান্বিতা। তীব্র আবেগের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে অকস্মাৎ নেয়া সিদ্ধান্ত এটি নয়।

আশেপাশে একটাও রিক্সা নেই। হাতের ব্যাগটাকে অনেক বেশী ভারী মনে হচ্ছে। তেমন কিছুই তো নেয়নি সে সাথে। তবুও এত কষ্ট হচ্ছে। শরীরটা আসলেই অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।

বড় রাস্তার মাথায় একটা রিক্সা দেখা যাচ্ছে, এতোটা কাছে নয় যে ডাক দিলে শুনতে পাবে। দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করলো দীপান্বিতা। ট্রেনটা মিস করলে ঝামেলা হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আর কি কোনদিন এই সাহস তাকে পথে নামাতে পারবে? হয়তো আর কোনদিনও এমন সাহস দেখানোর সাহস করা তার হয়ে উঠবে না। ভাবতে ভাবতে সে বড় রাস্তার মাথায় এসে দাঁড়াল। ট্রেন ষ্টেশন যাবেন? তাড়া সূচক প্রশ্ন ছুড়ে দিল সামনের খালি রিক্সাটার চালককে লক্ষ্য করে? রিকশাচালক মাথা কাঁত করে হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই ব্যাগ হাতে রিক্সায় চেপে বসল দীপান্বিতা রিক্সা ভাড়া না মিটিয়েই। রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালা কে বলল, ভাই একটু তাড়াতাড়ি চালাবেন, নইলে ট্রেনটা ধরতে পারবো না। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। কোন উত্তর না দিয়ে রিক্সা চালতে শুরু করলো যুবক রিকশাওয়ালা।

ফের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নীল দীপান্বিতা। পারবে কি এই রিকশাওয়ালা তাকে দশ মিনিটের ভেতর স্টেশনে পৌঁছে দিতে? ঠিক ঠিক আটটায় যে ট্রেনটা ছেড়ে যায়। রিকশাওয়ালাটা তার কথামত বেশ জোরেই রিক্সা টানছে। আকাশ পাতাল ভাবনা চলছে দীপান্বিতার মাথার ভেতর। ছেলেটার কথা চিন্তা করেই বারে বারে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তাকে ছাড়া ছেলেটা চলবে কি করে? সেটাই তাকে বেশী ভাবাচ্ছে এবং পাশাপাশি কষ্টও দিচ্ছে। ছেলেটার জন্যই তো দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠছে তার যাত্রা পথ। অনেক স্মৃতি মনে পরে যাচ্ছে। কত স্মৃতি! কত স্মৃতি! এক যুগেরও অধিক সময় মানুষটার সাথে ঘর করলো সে অথচ মানুষটা কোনদিন তাকে তার নিজস্ব পরিচয়ে বেড়ে উঠতে দিতে চাইলো না। এই বিংশ-শতাব্দীতে, এত পাশ দেয়া অথচ এত পশ্চাৎপদ ভাবনা চিন্তার মানুষও থাকে! আশ্চর্য! তার স্বামীর বেড়ে ওঠা সঙ্ক্রান্ত কোন বিষয়ে সে তো কখনও বাঁধা দিতে যায়নি! তবে কেন সে এমন? সব পুরুষেরাই কি এমন? নারীকে সারাজীবন তারা পদানত করে রাখতে চায়? নারী কি পুরুষের ব্যবহার্য কোন পণ্য? না কি পোষ মানে এমন কোন গৃহপালিত পশু? প্রচণ্ড ক্ষোভে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে তার অন্তর। মানুষটার এই হীনতা আর বিজাতীয় গোঁড়ামির কারণেই আজ তার প্রাণের সন্তানের মায়া ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। মানুষটাকে সে কোনদিন ও কোন কিছুর বিনিময়েও ক্ষমা করবে না। মানুষটা তার জীবন টাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিয়েছে।

কত সখ ছিল তার পড়ালেখা শেষ করবে, ভালো চাকরি করবে, আর সব নিজের পায়ে দাঁড়ানো স্বনির্ভর নারীদের মত। অথচ এই মানুষটাই তার কোমল ও মমতা প্রবণ তরুণী মনের সুযোগ নিয়ে তাকে তার পড়ালেখা টা পর্যন্ত শেষ করতে দেয়নি অথচ নিজে ঠিকই পড়ালেখা শেষ করে, ধীরে ধীরে নিজের পেশাগত সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে। কিসের কমতি ছিল তার। লেখাপড়ায় তো সে একদম খারাপ ছিল না, আর সব মেয়েদের চেয়ে তার সাধারণ জ্ঞান ঈর্ষা করার মতই ঋদ্ধ ছিল। ছিল গান শেখার সহজাত ক্ষমতা আর সৃষ্টি কর্তা প্রদত্ত সুরেলা ধ্রুপদী কণ্ঠস্বর। ছিল নরম কাদামাটির মত সুগন্ধে ভরা এক জ্ঞান পিপাসু হৃদয়। আফসোস! কিছুই সে কাজে লাগাতে পারেনি। না ভুল, লোকটা কাজে লাগাতে দেয়নি। ভালবাসার দোহাই দিয়ে, ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করে ঘরে নিয়েছিল। ভালবাসা! ভালবাসার অর্থ বোঝে সে, না বোঝার কোনদিন চেষ্টা করেছে?

এতোটা বছর কিভাবে সে সংসার করেছে কেউ কি জানে সব! কেউ কি বোঝে একটি তরুণী কি ধরনের লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা নিয়ে এই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর ও অকৃতজ্ঞ মানুষটার সাথে এত দিন ঘর করেছে সে! না জানে না। জানে না আর বোঝে না বলেই অনেকে তাকে ভুল বোঝে। ভুল বুঝেই তার বিরুদ্ধে বলে নানান অকথা কুকথা।

পুনরায় হাত ঘড়িটার দিকে তাকাল সে। পথ টা প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে এসেছে। রিকশাওয়ালা টা বেশ জোরেই টেনে চলেছে রিকশা। সকাল আটটা বাজতে আর মাত্র ছয় মিনিট বাকী আছে। ট্রেনটা ধরতে না পারলে সত্যি অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। পরের ট্রেন সেই রাত দশটা। ট্রেনটা মিস করলে এতক্ষণ সময় সে কাটাবে কোথায়? এই ভেবে অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলো দীপান্বিতা।

আর কতক্ষণ লাগবে। আবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকাল দীপান্বিতা। আর মাত্র দুই মিনিট বাকী। ডান দিকে বাঁক নিচ্ছে রিক্সাটা, ষ্টেশনে প্রায় পৌঁছে গেছে সে। হটাৎ তীক্ষ্ণ আর বিকট আওয়াজের সাথে সাথে পেছন থেকে প্রচণ্ড ধাক্কায় রিকশা থেকে ছিটকে রাস্তায় আছড়ে পড়ল সে । মাথার পেছনে কে যেন হাতুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত করলো। মাথার পেছনে তীব্র বেদনা ও দু চোখে অন্ধকার নিয়ে জ্ঞান হারাল দীপান্বিতা।

... ... ...


মা, ও মা, কি, কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? কি হয়েছে তোমার? কাঁদ কাঁদ গলায় প্রশ্ন করে চলে ঋদ্ধ। ধড়মড়িয়ে এবং প্রায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে উঠে বসে দীপান্বিতা। তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশ দেখে নিয়ে, আতংকিত ও বিহবলিত কণ্ঠে প্রায় স্বগতোক্তির মত বলে উঠে, আমি, আমি এখানে কেন? পরোক্ষনেই ঋদ্ধকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করে উঠে, কিরে, কি হয়েছে তোর, তুই কাঁদছিস কেন? এবং প্রায় সাথে সাথেই, আবার জিজ্ঞেস করে, আমি, মানে আমি হসপিটালে কেন? তীব্র উত্তেজনা প্রশ্নমালা শেষ হবার আগেই, বিদ্যুৎ ঝলকের মত দীপার মনে পড়ে যায় সব কথা। ঢাকা যাচ্ছিল সে। রেল স্টেশনে পৌঁছে যাবার একেবারে শেষ মিনিটে রিকশাটা যখন স্টেশনে ঢোকার জন্য ডান দিকে বাঁক নিচ্ছিল ঠিক তখনই পেছন থেকে একটি দ্রুত গতির কোন একটি কিছু এসে তাদের রিকশাকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দেয়। আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত প্রচণ্ড ধাক্কার কারণে তার শরীর উল্টে প্রথমে পিঠ ও মাথার পেছনের অংশ পিচ ঢালা কঠিন রাস্তায় সরাসরি আছড়ে পড়ে। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। শুধু একটি কিশোর মুখের ছবি মনের গহীনে ভেসে উঠতে না উঠতেই দপ করে সব কালো হয়ে যায়।

... ... ...


এখন কটা বাজে রে ঋদ্ধ? তোর বাবা কোথায়? সুস্থির হয়ে কিছুটা ক্লান্ত গলায় এক সাথে দু দুটো প্রশ্ন করে বসে ঋদ্ধকে দীপান্বিতা। ঋদ্ধ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, রাত এগারোটার কাছাকাছি। আর বাবা ডিউটি ডাক্তারের সাথে দেখা করে বাসায় গেছে। তোমার জন্য খাবার ও দাদু কে নিয়ে আসতে। রাতে তো কাউকে থাকতে হবে, নাকি?

কে নিয়ে এলো আমাকে এখানে? একই রকম ক্লান্ত গলায়, আবারও প্রশ্ন করে ঋদ্ধকে দীপান্বিতা। রাস্তার কয়েকজন লোক তোমাকে তোমার ব্যাগ ও মোবাইলসহ এই হসপিটালের ইমারজেন্সি কক্ষে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। পরে বাবা এসে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে তোমাকে এই কেবিনে ভর্তি করিয়েছে, বলে ঋদ্ধ থামল।

আচ্ছা ঋদ্ধ, আমি যে রিকশায় যাচ্ছিলাম সেই রিকশা চালকের অবস্থা কি? তার কি বড় কোন ক্ষতি হয়েছে?

ঋদ্ধ জানালো, সে এ ব্যাপারে কিছু জানে না। তারপর প্রায় আঁতকে উঠে বলে উঠলো, ওহো তোমাকে তো একটি বিষয় জানাতে ভুলেই গেছি। মা, এক আংকেল এসেছিল। সেই আংকেল টা যার কথা তুমি আমাকে বলেছিলে। তোমার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায় অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করে এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। যাওয়ার সময় এই প্যাকেট টা দিয়ে গেছে। এই কথা বলে বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিল থেকে একটি প্যাকেট হাতে নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দিল ঋদ্ধ।

চমকে উঠলো দীপান্বিতা। তবে কি উনিই চলে এসেছে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে তাকে দেখতে, সেই সুদূর ঢাকা থেকে? যার উপর ভরসা করে সে এই অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করেছিল। যার যুক্তি আর অনুপ্রেরণা তাকে তার অর্গল ভাঙ্গার সাহস দেখিয়েছিল। কার কাছে তার দুর্ঘটনার খবর জানলেন উনি। আর কিভাবেই বা জানলেন যে আমি এখানে? একগাদা প্রশ্ন জেগে উঠলো তার মনে।

প্যাকেটটা হাতে নিয়েই দীপান্বিতা বুঝে গেলো যে এর ভেতরে কোন বই আছে। তবে কি সেই বইটি, যে বইটির কোথা সেই মানুষটি খুব বলতেন? দ্রুত হাতে প্যাকেটটা খুলে ফেললো। ঠিক তাই, সে যা ধারণা করেছিল। সেই বইটি, “মার্জিনে মন্তব্য”, লেখক সৈয়দ শামসুল হক। আর একটা খাম। খামটাও খুলল দীপান্বিতা। একটা চিঠি আর কিছু টাকা। বই, টাকা আর চিঠি দেখে চোখে জল এসে গেল দীপান্বিতার। আশ্চর্য মানুষ তো উনি এমন সময়েও ঠিক ঠিক তার প্রিয় জিনিসগুলোর কথা মনে রেখেছে। চিঠি পড়তে শুরু করলো দীপান্বিতা।

সে লিখেছে,

প্রিয় দীপা,

যাকে সামনাসামনি কখনও দেখা হয়নি তাকে প্রথমবার দেখার অজানা আনন্দে মনটা বিভোর ছিল সেই মধ্যরাত থেকে, তাকে যে হেমন্তের এই সন্ধ্যায় এভাবে এমন অসহায়ভাবে দেখতে হবে ভাবিনি। ট্রেনে উঠেই আমাকে ফোন দেয়ার কথা ছিল তোমার। তুমি জানিয়েছিলে, তোমার ট্রেন সকাল আটটায়। তাই সকাল সোয়া আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন ফোন পেলাম না তখন কেন যেন অজানা আশঙ্কায় মনটা দুলে উঠলো। তোমাকে ফোন করলাম, একবার, দুবার, ধরলে না তুমি। অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। আবার ফোন করলাম। এবার অপরিচিত লোক ফোন ধরল। তাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে হড়বড় করে তোমার দুর্ঘটনার কথা জানালো এবং বলল তারা তোমাকে একটি হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করতে ঐ লোকটি বলল যে তুমি অজ্ঞান অবস্থায় আছো আর তোমার মাথার পেছন থেকে একটু একটু রক্ত ঝরছে। কি যেন কি হারানোর আশঙ্কায় ফের জিজ্ঞেস করলাম তোমার পরিবারের কাউকে খবর দেয়া হয়েছে কিনা লোকটি জানালো যে, সে এ ব্যাপারে কিছু জানেনা। আমি লোকটির কাছে হসপিটালটার নাম জিজ্ঞেস করে ফোন কেটে দিলাম। ফোন কেটে দিয়েই তোমার স্বামীকে ফোন দিয়ে জানালাম যে তুমি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছ এবং এখন তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। উনি আতঙ্কে আঁতকে উঠলেন, আমার পরিচয় জানতে চাইলে পুনরায় ফোন কেটে দেয়ার আগে তাকে শুধু বললাম, প্লিজ, তাড়াতাড়ি হসপিটালে যান নয়তো দীপার বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। বাসার কাউকে কিছু না বলে তোমার জন্য যে বইটি কিনে রেখে দিয়েছিলাম সেটা, কিছু টাকা, আর আমার ব্যাবহারের কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাগে ভরে সোজা বাস ধরে তোমার এখানে। হসপিটালে পৌঁছে দেখি তোমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেবার পর ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। মাথা ছাড়া আর কোথাও তেমন চোট লাগেনি আর মাথার আঘাতটাও গুরুতর কিছু নয়। ভাবছ এত খবর কিভাবে পেলাম? রিসেপশন থেকে তোমার কেবিন নাম্বার সহ সবকিছু জেনে নিয়েছিলাম। জেনে নিয়েছিলাম ডিউটি ডাক্তার কোথায় বসে। ডিউটি ডাক্তার কে বলেছিলাম আমি তোমার আত্মীয়,আত্মীয় তো নাকি? ডিউটি ডাক্তার সব খবর জানালো। কেবিনে গিয়ে দেখি তোমার ছেলে মুখ অন্ধকার করে তোমার বিছানার পাশের চেয়ারে বসে আছে। তোমার স্বামীকে কোথাও দেখলাম না। তোমার ছেলের কাছে আমার পরিচয় দিলাম, দেখলাম ও আমাকে চেনে। হয়তো তুমিই আমাকে ওর কাছে পরিচিত করিয়ে রেখেছিলে।

সন্ধ্যার একটু আগেই আমি এখানে পৌঁছেছি। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হোল। তুমি ঘুমচ্ছ আর আমি লিখছি। আমার কাছে, তোমার অনেক দিনের আবদার ছিল আমি যেন তোমাকে একটি চিঠি লিখি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। আজ এই অবেলায় অসময়েই সেই সময়টা হয়ে গেল। হসপিটালের ক্যাফেটেরিয়ার এক কোনে বসে, মন খারাপ নিয়ে লিখছি। ভয় হচ্ছে এই ভেবে, দীর্ঘ দিনের লাঞ্ছনা গঞ্জনার ভেতর দিয়ে জন্ম নেয়া যে আত্মউপলব্ধি তোমার ভেতর পুরাতন, জীর্ণ অস্বাস্থ্যকর অর্গল ভাঙ্গার সাহস দেখিয়েছিল, এই আঘাত তোমাকে সেই চেতনা থেকে বিচ্যুত করবে কিনা, থাকবে কিনা চারিত্রিক সেই দৃঢ়তা যা তুমি আমাকে বিভিন্ন সময় জানিয়েছিলে। দীপা, তোমার এই আত্মউপলব্ধিজাত চেতনা ও দৃঢ়তাই যে তোমার কাঙ্ক্ষিত আগামীর গড়ে তোলার মূল শক্তি, তা কি তুমি জান? আজকের এই আঘাতের মানসিক ও শারীরিক দখল পার হয়ে তুমি কি পারবে তোমার স্বপ্নের আগামীর জন্য পুনরায় যাত্রা করার সাহস দেখাতে। কে জানে। পারাটাই উচিৎ, কিন্তু এটাও তো সত্য কত উচিৎই আমাদের আর করা হয়ে উঠে না। যে কোন অর্গল ভাঙ্গা যে সত্যি কঠিন দীপা, সত্যি কঠিন ...। তোমাকে দেব দেব বলে অনেক দিন ধরে যে বইটি আমি তোমার জন্য আগলে রেখেছি সেই বইটি আজ তোমাকে দিয়ে গেলাম, সঙ্গে কিছু টাকা, হয়তো তোমার কাজে লাগবে। খরচ করতে সংকোচ বোধ করো না। প্রয়োজনে আয় করে দিয়ে দিবে, কি বল? একটু আগেই আবার দেখে এলাম তুমি এখনো ঘুমচ্ছ, ঘুমোও। তোমার সত্যি একটি লম্বা ঘুম দরকার।

আমি রাতের ট্রেনেই ফিরে যাব। সারা রাস্তায় এই ভাবতে ভাবতে যাব যে তুমি তোমার সব অর্গল ভেঙে ঠিকই একদিন বেরিয়ে আসবে। হয়তো, এমনি সারা রাত কোন এক ট্রেনের কোন একটি কেবিনে কোন এক সুদূর অজানা যাত্রায় আমরা একজন আরেকজনকে আরও গভীরভাবে জানার সুযোগ পাব। সেই অপেক্ষায় রইলাম। আজ এই পর্যন্তই। ভালো থাকার চেষ্টা কর।

ইতি

সুহৃদ

চিঠি পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো দীপান্বিতা। ঋদ্ধ জিজ্ঞেস করলো, মা তোমার কি খারাপ লাগছে। কোন উত্তর দিল না দীপান্বিতা, বলল আমাকে ধরে একটু বারান্দায় নিয়ে যাবি বাবা। ঋদ্ধ একটু অবাক হলেও কিছু না বলে বলল, ঠিক আছে ওঠো, তোমাকে ধরছি আমি। বিছানা থেকে নেমে, ঋদ্ধর হাত ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল দীপান্বিতা। রাত কটা বাজলো? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো সে। তার ট্রেন কি শহর ছেড়ে চলে গেছে? হসপিটালের পেছনের দিক দেখা যাচ্ছে বারান্দা দিয়ে। একটু দুরেই ফসলের মাঠ। বাইরে কি আজ জ্যোৎস্না নাকি। অগ্রাহায়ন মাসের কয় তারিখ আজ? পূর্ণিমা নিশ্চয় নয়। আলো আঁধারি পরিবেশ চারপাশে। হটাৎ বিপ বিপ শব্দে বেজে উঠলো বিছানার উপর মোবাইলটা। ঋদ্ধ কে মোবাইলটা আনতে বলল দীপান্বিতা। ঋদ্ধ বিছানা থেকে মোবাইলটা এনে মার হাতে দিল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঋদ্ধ কে ঘরে যেতে বলল দীপান্বিতা। ঋদ্ধ ঘরে চলে গেল। মেসেজটা পড়তে শুরু করলো সে। মেসেজে লেখা আছে... কিছুক্ষণ আগেই তোমার শহর ছেড়ে আমার শহরের দিকে যাত্রা করেছে ট্রেনটা। এখন প্রায় মধ্যরাত, বাইরে কেমন অস্পষ্ট জ্যোৎস্না। তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। একটি ফলন্ত ফসলের মাঠের বুক চিরে আমাদের ট্রেনটি ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। আমদের দুজনের কি কোন গন্তব্য আছে, দীপা...

কলিং বেল বেজে উঠল। কেবিনের দরজা খুলে দিল ঋদ্ধ। ঘরে ঢুকল ঋদ্ধর বাবা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দীপাকে বারান্দায় দেখে, শিরিষ কাগজের মত শুষ্ক ও ধারালো কণ্ঠে বলে উঠলো, ওখানে কি করছ দীপা, ঘরে এসো শরীর খারাপ করবে। চোখ মুছে ফের বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো দীপান্বিতা ঢুকে পড়ল রুমে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন