৩ সেপ, ২০১৩

কবিতা - শ্রীশুভ্র



বিদ্ধস্ত শৈশব!
শ্রীশুভ্র


 

বড়ো বিস্ময় লাগে! যখন দেখা যায় তিন বছরের শিশু ঘরে বসে হোমটাস্ক করছে মায়ের কাছে, কিংবা শিক্ষকের কাছে! ঠিক যে সময় তার মায়ের সাথে, দাদা দিদির সাথে লুকোচুরি খেলার কথা! যখন ঠাকুমা দিদিমার কাছে রাক্ষোস খোক্ষোস দত্যি দানোর গল্প শোনার কথা! অফিস ফেরত বাবার পিঠে চেপে ঘোড়া চালানোর কথা!



সে সব কিছুই বাদ! পরদিন মর্নিং স্কুল! অতএব সমস্ত হোমটাস্ক করে যেতে হবে ঠিকঠাক! নয়তো মিসের কাছে বকুনি খাওয়ার ভয়! তিন বছরের শিশুর দীক্ষা হতে থাকে সামাজিক অসম্মানের ভয়ের! তিন বছরের শিশুকেও জানতে হয় পাশ ফেলের গল্প! শিশুকে পাশ ফেল শেখাতে গিয়ে আমাদের খেয়াল থাকে না, কখন আমরা জাতি গঠনের দায়িত্বে পুরো ফেল করে বসে থাকি, নিদারুণ ভাবে!



নিজের সন্তানকে দ্রুত শিক্ষিত করতে গিয়ে আমরা খেয়াল করি না, কোন কোন নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি থেকে শিশু ও তার শৈশবকে বঞ্চিত করে ফেলি! গোড়ায় গণ্ডগোলের মতো আমরা ভুলেই যাই যে মানুষ হিসেবে আমরাও সবুজ সজল প্রকৃতিরই অন্যতম বিশিষ্ট প্রকাশ! প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা যত যথাযথ হবে, ততটাই মানবিক হয়ে উঠতে পারবো আমরা! নাগরিক জীবনের পরিসরে আজ যা অকল্পনীয় অবাস্তব বলে প্রতিভাত হয়!

কিন্তু শিশুর শৈশব প্রকৃতির সম্পৃক্ততা আত্মীয়তা দাবি করে প্রবল ভাবেই! অথচ যে সময়ে শিশুর সাথে প্রকৃতির নিত্য পরিণয় ঘটার কথা, হওয়ার কথা প্রতিদিন শুভদৃষ্টির, ঠিক সেই সময়েই আমরা শিশুর শৈশবকে বেঁধে ফেলি স্কুল থেকে হোমটাস্কের রুটীনে!




মনস্তত্বের দিক দিয়ে দেখলে দেখা যায় যত অল্প বয়সে শিশুকে নিয়ম নীতির বেড়াজালে বেঁধে ফেলা যায়, ততই তার মৌলিকতা বিকাশের পথটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে! যতই তাকে আর পাঁচটি শিশুর মত সভ্য ভব্য ফার্স্ট গার্ল কিংবা বয় করে গড়ে তোলা হতে থাকে ততই তার নিজস্বতা গড়ে ওঠার পথটা সংকুচিত হতে থাকে! এই ভাবে আমরা ঘরে বাইরে শিশুর স্বাধীন মৌলিক বিকাশের পথটি বন্ধ করে দিয়ে বসে আছি! শৈশবের প্রয়োজন প্রকৃতির সাথে আত্মিক মেলবন্ধন! স্বাধীন ইচ্ছার মুক্ত পরিসর! প্রতিনিয়ত কল্পনা শক্তির স্ফূরণ! আবেগের বাধাহীন প্রকাশ! এবং এরই সাথে সুস্থ সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে আদর আর স্নেহের যথাযথ বন্টন!



আসলে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরিই বৃটিশের দ্বারা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটা প্রক্রিয়া, যা দেশজ জলবায়ু পরিবেশে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, ঐতিহাসিক সমাজ বিবর্তনের ধারায় গড়ে ওঠেনি সমাজ জীবনের অন্তঃস্থল থেকে! এখানেই ভারতবর্ষ তথা বাংলার কপাল পুড়েছে! দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে কিন্তু সে অর্জিত স্বাধীনতা নয়! ফলে শিক্ষাব্যবস্থাও চলছে পরাধীন যুগের ধারায়! এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল কয়টি ধারা হল মাতৃভাষা বর্জন! বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানের উন্মেষ নয়, মুখস্থ বিদ্যার চর্চায় পরীক্ষায় বেশি নম্বর জোগাড়! মৌলিক চিন্তা শক্তির বিকাশ সাধন নয়, উন্নত বিশ্বের অন্ধ অনুকরণ!

ফলে শিশুর শৈশবের পঠন পাঠনেও এই ধারা চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রথম থেকেই!




যতদিন যাচ্ছে শিশুর উপর লেখাপড়া যেন ততই দমবন্ধ ফাঁসের মতো চেপে বসছে!

পড়া স্কুল হোমটাস্কের বাইরে কার্টুন চ্যানেল ছাড়া শিশুর আজ আর কোনো নিজস্ব জগত নেই! শৈশবের কল্পনার সাম্রাজ্য আজ টিভি আর কম্পিউটার টার্মিনালে সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে! শিশুর খেলার মাঠ ছিনতাই হয়ে গিয়েছে রিয়েল এস্টেটের সর্বগ্রাসী খিদের কাছে! ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা গানের স্কুল, নাচের স্কুল, আঁকার স্কুল, খেলার স্কুল, সাঁতারের স্কুলেও সেই ঘড়িধরা রুটীনে বাধাপ্রাপ্ত শৈশব! শিশুর স্বাধীনতা বাবা মায়ের সামাজিক কম্পিটিশনে নিয়ন্ত্রিত! ভাবতে অবাক লাগে উন্নত বিশ্বের সমকক্ষ হতে গিয়ে আমরা কি অক্ষম হয়ে পড়েছি শিশুর শৈশবকে আনন্দের উৎসব করে গড়ে তুলতে!




পারিবারিক পরিসরেও যে, শিশু সবসময়ে সব ঘরেই তার উপযুক্ত পরিবেশ পায় তাও নয়! অধিকাংশ সংসারে একমাত্র সন্তান হওয়ার জন্যে বাবা মায়ের অতিরিক্ত নজর সামলাতে হিমশিম খায় অবুঝ শৈশব!
পারিবারিক সমস্যাগুলির অনভিপ্রেত অভিঘাত শিশুর উপর সাংঘাতিক কু প্রভাব ফেলে! অধিকাংশ ঘরেই দাদু দিদিমার স্নেহ ছায়ায় এই কু প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার পরিসরটুকুও পায় না আজকের শিশুরা! ফলে ঘরে বাইরে একটা অদ্ভুত খাঁচায় আটকে পড়ে ছটফট করে শিশুর অন্তরাত্মা! যার গভীর প্রভাবে শিশুর অবচেতনে মানবিক প্রত্যয়গুলি ঠিকমত দানা বাঁধার সুযোগ পায় না!

পরবর্তী জীবনে শৈশবের এই ঝড়ঝাপটা অনেকটাই স্বার্থপর করে গড়ে তোলে তাদের! যার দায় কোনোভাবেই তাদের নয়!



আমরা যদি মনে করি, যুগধর্মে এটাই যখন জীবন বাস্তবতা তখন এভাবেই গড়ে তুলতে হবে আমার শিশুর শৈশব, তাহলে মস্তবড়ো ভুল হবে! একথা ঠিক, সমাজ পরিবর্ত্তনের ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই!

দেশের ভ্রান্ত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরেও শিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা সম্ভব নয় কারুর পক্ষে! তবু নিজেদের সাংসারিক পরিসরে শিশুর জন্যে আদর্শ শৈশবের একটা সুস্থ সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতেই পারি আমরা! পারি একটু সচেতন থাকলে! পারি নিজেদের জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরে মানবিক মূল্যবোধগুলিকে যথাযথ ভাবে লালন করলেই! দুঃখের বিষয় অধিকাংশ পরিবারেই অভিভাবকরা নিজেরাই এসব বিষয়ে সচেতন নয় ততটা যতটা দরকার!




তাই অভিভাবকদের ভেবে দেখার সময় এসেছে শিশুকে তার হারানো শৈশব ফিরিয়ে দেওয়া যায় কিনা! পুরোটা না হলেও কতটা? সমাজবিদদের এবং শিক্ষাবিদদের এগিয়ে আসতে হবে! শিক্ষা প্রণালীর খোলনোলচে বদলে দেশজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যে গড়ে তুলতে হবে উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা! উন্নত বিশ্বের দেশগুরির শিক্ষা ব্যবস্থার শক্তির কারণগুলি অনুধাবন করে তার থেকে পুষ্ট করতে হবে এদেশের শিক্ষাক্রম! শিশুশিক্ষার আদর্শ পদ্ধতি হল খেলতে খেলতে খেলার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা দান! শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর এইভাবে শিশুকে তার ভাবরাজ্যের কল্পনার সাম্রাজ্যে পূর্ণ স্বাধীনতায় মানুষ করতে পারলেই শিশু ফিরে পাবে তার হারানো শৈশব! সফল হবে শিশুকে মানবিক দীক্ষায় দীক্ষিত করা!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন