৩ সেপ, ২০১৩

ছোটগল্প - ইন্দ্রজিৎ চ্যাটার্জী



উৎসব - বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে
ইন্দ্রজিৎ চ্যাটার্জী


১)
একরাশ কাশ ফুটেছে নেত্রাবতি নদীর পাড়ে। শেষ বর্ষার ঘোলাজলে দাঁড়িয়ে অনল ঐ কাশের সারিতেই খুঁজতে থাকে তার রূপসী বাংলাকে। তার কানে যেন বেজে ওঠে অষ্টমীর ঢাক।

মুম্বাই থেকে আগ্রার দিকে দৌড়ে যাওয়া হাইওয়েটা এখানে একটু থমকে আছে। নাসিক শহরের থেকে অনেকটা দূরে নেত্রাবতি নদীর ওপর নতুন সেতু তৈরির কাজটা শেষ হলে, ভারতবর্ষ আরও গতি পাবে। সেই সেতুবন্ধের কাজেই কন্সট্রাকশন কোম্পানি কলকাতার এই তরুন ইঞ্জিনিয়ার অনলকে এনে ফেলেছে।

ক্যেলেন্ডারে অক্টোবর। অথচ এখানে দশেরা ছাড়া ছুটি নেই। সপ্তাহে সাত দিনই পাথর- সিমেন্ট- স্টিলের বাঁধুনি শক্ত করার কঠিন ব্রতে লেগে থাকা। এখানে পুজোর গন্ধ নেই, আলো নেই, বাজনা নেই। নেই সপ্তমীর কলাবৌ, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধি পুজোর আরতি। নেই পায়ে পায়ে হাতিবাগান থেকে কলেজ স্কোয়ার আর বাবুবাগান থেকে মুদিয়ালি। নেই পুজো পরিক্রমার অনন্ত আনন্দের ফাঁকে রাতজাগা চোখে কোনও কিশোরীর রিদয়-মিশাইলের আকস্মিক আক্রমন।

বাস্তবে ফিরে আসে অনল। আঙুর আর বাজরার খেতের সীমানা পেরিয়ে কংক্রিটের পিলার উঠছে। মেধা আর শ্রমের নিপুণ সমন্বয়ে মাথা তুলছে নতুন ভারতবর্ষ। অনলের মনে পড়ে, "...জয়ং দেহি, যশ দেহি...।। "

২)
যোশীমঠের এক চায়ের দোকানে দেখা বরুনের সঙ্গে। সেলফোনে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার সময়েই হয়তো আমার বঙ্গভাষণ শুনেছিল। কাজেই দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারি ভ্যান থেকে এগিয়ে এসে আলাপ জমালো জলপাই উর্দি পরা যুবক। রানাঘাটে বাড়ি ওর। অন্য কোনও চাক্রির সুজগ-সুবিধে না হওয়ায় অ্যাথালিট বরুন একদিন ভারতীয় সৈন্যদলে নাম লিখিয়েছিল। তারপর বছর সাতেক এদিক-ওদিক ঘুরে এখন বদ্রিনাথ থেকে ৩ কি.মি দূরে মানাগ্রামে ওর ক্যাম্প। বাবা-মা-বন্ধু-পরিজন ছেড়ে বাংলার ছেলে আজ ভারতবর্ষকে রক্ষা করার দৃঢ় ব্রতে অটল।

মিষ্টিমধুর তানে সুর তুলে নীচে বয়ে যাচ্ছিল অলকানন্দা নদী। আর সেদিকে তাকিয়েই বরুন বলছিল, " জানেন, শুধু পুজোর সময় এলেই মনটা কেমন হয়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙালি টুরিস্ট দেখি এই যোশীমঠ আর বদ্রির পথে। আর আমি ভাবি, রানাঘাটে আমাদের ফুটবল মাঠের কোনে রঙিন কাপড়ের ঘেরাটোপে পাঁচদিনের আনন্দ জেগে উঠছে। শুধু আমিই সেখানে নেই। আমাদের সাবেকী দুর্গাপ্রতিমার সামনে ভোগদানের পর দুপুরে যখন একসাথে ওরা সবাই খেতে বসবে, হুল্লোড় করবে কিম্বা নবমীর রাতে মেতে উঠবে ধুনুচি নাচের তালে, আমাকে কি মনে পড়বে? এখানকার এই বরফ হিম হাওয়ায় ইন্দ্রিয় সজাগ রাখার নিত্য অনুশীলনের মাঝেও বরুনের মন যেন ঐ কটা দিন ওর মফস্বলি শহরের যাবতীয় উৎসবেই ফিরে যায় বারবার। মিলিটারি ভ্যানটায় ফিরে যাবার আগে বলে, "বাবা-কাকাকে তো পাবনা। বিজয়ার একটা এডভান্স প্রনাম আপ্নাকেই সেরে নিই।" আমি তাড়াতাড়ি বুকে টেনে নিই ভারতবর্ষের এই অতন্দ্র প্রহরীকে।

৩)
" শুক্তো তো আছেই, আজ আলু-পোস্তও হয়েছে। নেবেন তো?" টেবিলে ভাতের থালা এগিয়ে দিতে দিতে রবি বলে।
চেন্নাই এগমোর স্টেশনের কাছেই এই হোটেলটা বাঙালি খাদ্যরসিকদের খুব প্রিয়। কাজের ফাঁকে মধ্যান্যভোজ সারতে এসে এখানেই বাঁকুড়ার জয়ক্রিস্নপুরের রবীন্দ্রনাথ বাগের সাথে আলাপ। তবে হোটেল বয়ের নাম তো আর রবীন্দ্রনাথ হয়না; তাই লোকমুখে রবি।

" কি রবি? পুজোয় দেশে যাচ্ছ তো? " প্রশ্ন শুনেই রবির চোখ গোলগোল হয়ে যায়। ডাল- শুক্তো- মাছ- চাটনির গামলা পেরিয়ে ওর মন হাঁটা লাগিয়েছে রাঢ় বাংলায়। সেখানে চক্রবর্তীদের ভাঙা দালানে ওদের পাড়ার একমাত্র দুর্গাঠাকুর রাংতার সাজে অপরূপা; নতুন ফ্রক, চুড়িদার আর শাড়ীর সাজে গ্রামের লক্ষ্মী-সরস্বতীরা কেমন অচেনা; শিউলিফুলের গন্ধে ম ম করছে মণ্ডলদের পুকুরপাড়, সোনাদি আর নতুন বৌঠান কত যত্ন করে নারকেল নাড়ু গড়ছে নৈবিদ্যে সাজাবে বলে; ধুপ- ধুনো- ঢাক- ঢোলের চারদিন পার করে দ্বারকেস্বর নদের বুকে দুর্গতিনাশিনীর আবার ফিরে যাওয়া।

নাঃ, গত দু'বছরের মতো এবারেও পুজোয় বাড়ি ফিরবেনা রবি। একজন চেনা লোকের হাতে মা আর বোনের নতুন শাড়ি কেনার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। আর এখন আবার টাকা জমাছছে সামনের বছর বোনটার বিয়ে দেবে বলে। পুজোর ছুটিতে চেন্নাই শহরেও অনেক টুরিস্ট। তাই, টিপস এর টাকাও মন্দ জম্বে না ।

চিরন্তন ভারতবর্ষে ভাইয়ের দায়িত্ববোধ কি কম !!


৪)
পুজো এসে গেছে। ঢাক- ঢোল- কাঁসির সমবেত বাদ্যে জেগে উঠছে আমার বাংলা। জ্বলে উঠছে একশো আট প্রদীপের ঝাড়। আমার মহানগরী কত সহস্র মানুষকে আপন করে কাছে টেনে নিয়েছে উৎসবের রঙ চেনাবে বলে। আবালবৃদ্ধবনিতা পায়ে পায়ে মিশে যাচ্ছে সেই আলোর উৎসবে। আর এই অপূর্ব মায়াবী আলো থেকে বহুদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কতসব অনল, বরুন আর রবি। চোখ বুজলেই তারা দেখছে, প্রানের উৎসব থেকে বহুদূরে উড়ে যাচ্ছে এক নীলকণ্ঠ পাখি ।।

1 কমেন্টস্:

ritu4U বলেছেন...

tomar golpo bhison mon chhunlo indrajit..khub bhalo...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন