(গল্প)

প্রতিবিম্ব ...
লাভলী ভট্টাচার্য্য
মাঝেই রিয়ার মনে হয়...সেই একলা বারান্দায় যখন বসে , সব কাজের শেষে , রাই তখন ঘুমে আচ্ছন্ন ,তার সাত বছরের মেয়ে । এই সময় টুকু শুধু রিয়ার নিজস্ব , একদম একা ,কিন্তু তবুও বহু চরিত্র তার আসে পাশে । বেশ অনেকটা বছর কেটে গেলো , বিদেশে । এবার আর নয় , ফিরে যাবে সে তার পৈতৃক বাড়ীতে । এখানে আর কিছু নেই ।
...... কলেজে বরাবরই খুব ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করতো রিয়া ।আর মা বাবার একমাত্র মেয়ে , রূপে গুণে অনন্যা ,বাবার টাকা পয়সার অভাব ছিলনা ,তাই সবাই একটু অন্য নজরে দেখত তাকে , বন্ধুত্ত্ব করতে এগিয়ে আসা বন্ধুও কম ছিলনা ।কিন্তু রিয়া এড়িয়ে চলতো সবাইকে । শুধু ভালো লাগতো তার অনু কে । খুব সাধারণ পরিবারের মেয়ে হয়েও এতো অসাধারণ কি করে হতে পারে ,অনু, সেটাই ছিল তার কৌতুহল । কলেজে আসার পথে , মাঝরাস্তায় তার নিজস্ব গাড়ি থেকে নেমে পড়তো রিয়া । এগিয়ে আসতো অনুর দিকে , হাঁটাপথে অনেক কথা হোতো দুজনে । কিন্তু রোজ খেয়াল করতো কলেজ ছুটির পর ,অনুর কথায় যেন যাওয়ার এক বিষম তাড়া ।একদিন রিয়া বায়না করে, "অনু, আজ আমাকেও নিয়ে চল "। অনু ...হেসে উত্তর দিতো , "তোর মাথা খারাপ ? মেসোমশাই জানতে পারলে তোর কি হবে ভাবতে পারিস ? তোর গানের ক্লাস আছে , তুই যা "। মন খারাপ করে ফিরে আসতো রিয়া ।
......একদিন রিয়া প্রায় রাগারাগি করেই অনুর সঙ্গ নেয় । অনু সেদিন আর বাধা দেয়নি । যখন ওরা পৌঁছল ,তখন প্রায় সন্ধ্যে । কি অপূর্ব পরিবেশ , কত নিষ্পাপ শিশুর প্রাণখোলা হাসি মুখ । ওদের কেউ নেই...মানসিক আর শারীরিক ভাবে ওরা অসুস্থ । ওদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে অনু রিয়াকে নিয়ে গেলো ,সেখানেই এক বিশাল চিত্র প্রদর্শনী দেখতে । রিয়া মুগ্ধ হয়ে দেখেই গেলো , কি অপূর্ব সব ছবি ,সব ছবির নীচে লেখা "সৌম্য" । রিয়া অনেক গুলো ছবি কিনে নিয়ে সেদিন ফিরে এলো । সব কটা ছবিতে কত রূপে সাজানো নারীর মুখ , অসামান্য ...দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার ঠিক নেই । সকালে মনে হল একবার সেই চিত্রকর কে তার প্রশংসা জানানো উচিৎ ।কালকের কাগজ টা খুলে ...সৌম্য নামের পাশে তার নম্বর টা চোখে পড়লো , কথা হল ...কি অপূর্ব তার কথা বলার ভঙ্গী ।প্রায় সমবয়সী ওরা ,তাই দুদিনেই আপনি থেকে তুমি হল , কাজের ফাঁকে ,পড়ার ফাঁকে অনেকটা সময় কথা হোতো ।এক অদ্ভুত আকর্ষণ রিয়া অনুভব করলো । রিয়া একদিন বলেই ফেলে ,"আমাকে তো দেখনি, পারবে একদিন দেখা হলে ,সবার মাঝে চিনতে ?" সৌম্য হেসে উত্তর দেয় ..."যে আমার এতোগুলো ছবি একদিনে কিনে নিয়ে যেতে পারে ,তাঁকে দেখার ইচ্ছে আমার হয়েছিল বলেই, সেদিন দূর থেকে তোমাকে আমি দেখেছি "।
...অবশেষে কলেজের সমাপ্তি । রিয়ার ইচ্ছে হয় অনুর সাথে ওখানে যদি সেও পড়াতে পারতো ?? কিন্তু মা বাবা রাজী হবেন না ।সৌম্য কে যদি সারাজীবনের জন্যে সঙ্গি করতে পারতো ??না, তাও মা বাবা দেবেন না। ও তো বড়লোক নয় , ও শুধু আঁকে । মায়ের কাছে আজ সে বলে দেখবে । যদি............
প্রতিবিম্ব ... ২...
কলেজের শেষ দিন ,সবার সাথে আড্ডার পর , রিয়া বাড়ি ফিরল ...আজ সে মায়ের কাছে খাওয়ার টেবিলে কিছু মনের কথা জানাবে । কিছুক্ষণ পর মায়ের সেই ডাক ,মামনি খেতে আয় ।রিয়া বসে, একসাথে ।
মা...রিয়া , আজ একটা দারুণ খবর আছে ,তোর বাবা একটু আগে ফিরেছেন ।আমরা কলকাতা ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছি ।বাকি জীবন ওখানেই কাটাবো ।
রিয়া...মা ,আমার কিছু বলার ছিল ।আমি এখানেই থাকতে চাই ,নিজে কিছু করতে চাই ।
মা...সে হয়না, তুই আমাদের একমাত্র সন্তান ।তোকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারলেই আমাদের শান্তি ।তখন ওখানে না হয় কিছু করিস নিজের ইচ্ছে মতন ।বাবা কোনও কথা শুনবেন না।আর তোর জন্যে সুপাত্র বাবা ঠিক করে ফেলেছেন।ছেলেও বিদেশে থাকে ।আর কোনও কথা শুনতে চাইনা ।
রিয়া এক বুক ব্যথা নিয়ে ঘরে ফেরে ।না আর নয় ।আজকেই সে সব খুলে বলবে সৌম্য কে ।
রিয়া ...হ্যালো ,সৌম্য , আমি কাল তোমার সাথে দেখা করতে চাই ।এখনও তুমি একদিনও দেখা করনি। আমি তোমাকে ভালবাসি আর কাওকে না জানিয়ে আমি তোমার সাথে চলে যেতে চাই ।বল ,আমার দায়িত্ত্ব নিতে পারবে কিনা ?
সৌম্য ...রিয়া ,পাগল হয়ে গেলে নাকি ? তুমি জানো কি বলছ ? আমার টাকা চাই ,অনেক অনেক , আমার সামনে অনেক কাজ ।আমাকে ভুলে যেও , সুখে থেকো ,অনেক ভালো থেকো ।কোনোদিন সুযোগ হলে আমার সেই স্বপ্নের প্রতিমা তোমাকে নিশ্চয়ই দেখাবো ।
রিয়া বাকরুদ্ধ ।তারপর একটা কথাও বলেনি। শুধু সৌম্যর পেইন্টিং গুলোর দিকে একবুক ঘেন্না নিয়ে তাকিয়ে থাকে ।
অবশেষে নতুন জায়গায় নতুন জীবন । সুমিতের সাথে বিয়ে হয়ে যায় ,রিয়ার । অনেক সম্পতির মালিক সুমিত । কিন্তু সেকি ,তার কল্পনার সংসার বাস্তবে কোথায় ? সুমিত সারাদিন ব্যস্ত , সময় নেই ।রিয়াকেও পার্টি যেতে হয় অনিচ্ছা সত্ত্বে । হারিয়ে গেলো রিয়া ,এক নতুন জগতে । মা বাবার কাছে যাওয়ার ইচ্ছেটাও যেন কোথায় হারিয়ে যায় ।এভাবেই কটা বছর , শুধু নিজেকে হারিয়ে বেঁচে থাকা ।অবশেষে একদিন রিয়ার জীবনে আলো করে এলো আরও একটি জীবন ...রাই ।রিয়ার নতুন করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা । জন্মের পর অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেও রাই কাঁদেনি ।ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন , রাই আর কথা বলবে না। মেনে নিতে হয় ।ঐটুকু মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরে রাই কে। আস্তে আস্তে রাই বড় হয় ,কিন্তু নাহ , এখানেও বিধাতা একটু বেশী পরিহাস করে ফেলেছিলেন হয়তো । অন্য বাচ্চাদের মত বোঝার ক্ষমতা হয়না রাই এর ।নিয়তির পরিহাস কষ্ট হলেও মেনে নিতে হয় রিয়াকে । সুমিত এর জন্যে দায়ী করে রিয়া কে ।আর বোধহয় মানসিক জোর ছিলনা রিয়ার । শেষ পর্যন্ত আইন আদালত ।বাবার বাড়ি তে ফিরে আসে রিয়া , মা বাবা দুবছর আগেই চলে গেছেন , রিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করে , পরলোকে ।......বৃষ্টির শব্দে ঘোর কাটে রিয়ার । অনেক রাত হল ।।কাল সকালেই বেরোতে হবে ... কলকাতা ফিরবে । একদিন যেই ইচ্ছে ছিল অনেক বাচ্চার মাঝখানে থেকে ,আজ হয়তো ভগবান তার মেয়ের মধ্যে সেই অসুস্থতা দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন , দেখতে চাইলেন রিয়ার সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা , লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ...
কলকাতা ...অনেক কিছুর সাক্ষী ।বাড়িতে ফেরে রিয়া , সাথে রাই । কি বিশাল বাড়ি , কেউ নেই , কি করে থাকবে রিয়া এতো বড় বাড়িতে একা ... একটা ফোন করলে হয়না অনুকে ? অনু ফোন ধরে , আজ একটু একটু করে সব কথা জানতে পারে অনু রিয়ার কাছ থেকে । ভরসা দেয় ,"তোর রাই কথা বলবেই ,আমি এক জায়গায় নিয়ে যাবো ,যেখানে অনেক বাচ্চা আজ সুস্থ ।আমি শান্তিনিকেতন আছি , এখানেই থাকি, তুই চলে আয় কাল ।"
রিয়া ...কিন্তু আমার যে অনেক টাকার দরকার রাই এর জন্যে । আমাকে একটা ছোট বাড়ি দেখে দে ,এখানে আমি হাফিয়ে উঠেছি একদিনেই ।আমি এই বাড়ি বিক্রি করে দেবো ।
অনু ...তুই এখানে এলে বুঝতে পারবি , রিয়া ,এখানে ওর চিকিৎসা করাতে কোনও খরচা লাগবে না । তুই কাল চলে আয় ।
রিয়া পরদিন শান্তিনিকেতন চলে আসে । অনুর সাথে অনেকদিন পর দেখা ,ওরা দুজনেই শিক্ষকতা করে ।ওদের সুখী পরিবার দেখে রিয়া খুব খুশী হয়।
রিয়া এবার আসল কথায় চলে আসে ..."অনু ,আমার একটা চাকরি খুঁজে দিতে পারিস , এই ধর তোর স্কুলে । আর রাই এর জন্যে একটা ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা ..."
অনু পরদিন রিয়াকে নিয়ে যায় তার সেই প্রতিষ্ঠানে । ঘুরে দেখায় ...অনেকটা জায়গা জুড়ে এই প্রতিষ্ঠান ।অনুর ক্লাস ছিল, তাই রাই এর ফর্ম ফিলআপ করতে রিয়াকে একাই যেতে হয় । রিয়া দরজা খুলে ভেতরে যায় ,সুন্দর সাজানো একটা ঘর । দেওয়ালে কারও মা বাবার ছবি । পাশে দুয়েকটা পেইন্টিং ।একটা নাম ...লেখা সৌম্য সুন্দর রায় । চমকে ওঠে রিয়া । বেরিয়ে আসতে চায় তখনই ...কিন্তু চোখ আটকে যায় ,সামনে রাখা পেইন্টিং এ , সেই লাল শাড়িটা , সেদিন গিয়েছিলো সে , সৌম্যর ছবি কিনতে । দুটো পা রিয়ার কাঁপতে থাকে ।এমন সময় , সৌম্য ,..." বোসো , আমি অনুর কাছে সব শুনেছি, তোমার রাই কথা বলবে , ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক জীবন । আমি কথা দিচ্ছি , আর তোমার অনেক প্রশ্ন তাইনা ? এই পেইন্টিং টা সেদিন এঁকে ছিলাম , যেদিন প্রথম তোমায় দেখেছিলাম , এই আমার মানস প্রতিমা । আমার বা দিকের কলম টা একটু এনে দেবে ? কোনোদিনও কাওকে আনতে বলিনি , কারণ আমি স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে চেয়েছিলাম , আমার বা হাত টা অচল , আজ বহুদিন , আমি কি করে তোমাকে দুহাত বাড়িয়ে দিতাম বল তো ? আমার টাকার দরকার ছিল, হ্যাঁয় , এই সব বাচ্চাদের জন্যে , যেখানে সবাই নিজের মত , একদম সুস্থ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে । আমাকে তুমি ক্ষমা কর ।"
রিয়া কিছু বলতে পারেনি , সেই মুহূর্তে ...শুধু নিজের পেইন্টিং টায় হাত বুলিয়ে নিলো কিছুক্ষণ , হয়তো সেই রিয়া কে একবার খুঁজে পেতে । তারপর বলে ফেলে , "সৌম্য , এখানে একটা চাকরি করে দিতে পারো আমার , আমি আমার বাড়ি বিক্রি করে দেবো । একটা থাকার ব্যবস্থা হতে পারে ?? এদের মাঝখানে ?? আমি যে শারীরিক বিকলাঙ্গ নই , মানসিক বিকলাঙ্গ ।" সৌম্য ...মুখে কিছু বলেনি , চোখের ভাষায় জানিয়ে দেয় , তার সম্মতি ।
......অনুর বারান্দায় আজ রিয়া ,আবারও একা । কিন্তু মানসিক কোনও ভার নেই , এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ শান্তিনিকেতনের , রবি ঠাকুর তাই এখানে হয়তো এতো কাব্যের সৃষ্টি করেছিলেন। একবার মনেহল , রিয়ার , পুরনো আবৃত্তির সিডি টা , কলেজে পড়া কালীন যেটা করেছিল , একবার শুনলে মন্দ হয়না ।
চলতে শুরু করে , বাইরে আবছা আঁধার , আধখোলা জানালা...।
..."গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
"কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, "বলব।"
মাঝপথেই লোডশেডিং , ভালো লাগলো রিয়ার ......বাকীটুকু নিজেই বলে ফেলে আপন মনে ..।।
"আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।"
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, "থাক্, এখন যাও ও দিকে।"
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশন.
আমি চললেম একা"..
...না একা নই ,আমার রাই এর মাঝে জাগিয়ে তুলবো আরেক রিয়া কে ...আমার রাই মানুষ হবে , রিয়ার মত হারিয়ে যাবেনা ...যেতে দেবনা কোনোদিন ... ...আমি নতুন করে বাঁচবো ........