(গল্প)
ঘরের মধ্যে ঘর
সীমা ব্যানার্জ্জী রায়
গাড়ি থেকে নেমেই ঝড়ের বেগে কল্পতরু ওরফে তুষার বাড়িতে ঢুকল। ব্রীফকেস সোফাসেটে রেখেই …
- মাম্পি ইই...মাম্পি! মা -কে দেখেছি না যে। মা কোথাও গেছেন? কিছু বলে গেছেন তোমাকে?
- -জানি না, কি যে করেন! কোথায় যাবেন, কদিন থাকবেন। কিছুই বলার প্রয়োজন বোধ করেন না । যবে থেকে বিয়ে হয়েছে তবে থেকেই তো দেখে আসছি একই রকম ব্যবহার। “ মাম্পি, আমি বেরোচ্ছি। কদিন পর ফিরবো, বুম্বাকে বলে দিও”- কোথায় যাচ্ছেন? জিগেস করার সাথে সাথেই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। শাশুড়িমা তো কখনোই কিছু বলেন না। না, বলার প্রয়োজন বোধ করেন না। নিজের জেদেই তো থাকেন সর্বদা দেখি। শুনেছিলাম, বাড়ির কর্তারাই এইরকম ব্যবহার করেন? কিন্তু শাশুড়িমা তো একজন আমার মতোই গৃহবধূ-ই ছিলেন একদিন।
এ বাড়িতে মাম্পির আসার কথা নয়। অনেক টালবাহানা , অনেক অশান্তির পর একমাত্র পুত্র কল্পতরুর দুর্দান্ত ভালবাসার কাছে দোর্দন্ড প্রতাপশালী মাকে শেষপর্যন্ত হার মানতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে আমেরিকাবাসী মেয়ের ফোনাঘাত, পত্রাঘাত তো ছিলই। আর ছিল মাম্পির রূপ আর শিক্ষার জৌলুস। এখন সংসার যাত্রার অন্তরালে চলেছে দুই নারীর ব্যক্তিত্বের ঠান্ডা লড়াই। এ লড়াইয়ে তুষার কোনোমতেই সামিল হতে রাজি নয়।
মেয়ে তো আগেই মনের মতো সঙ্গী জুটিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে, স্বামী তারও আগে জীবন থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন স্ত্রীকে পেনসন বরাদ্দ করে। শাশুড়ি মন্দিরা দেবী রাতদিন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলে বৌ কি করছে না করছে দেখার তার সময় নেই। বাড়িটা ওঁর নামে, মোটা পেনসন পান, একটা নিজের নামে গাড়ি আছে। হাতে একটা বাহারি বড় ব্যাগ, একটা ভ্যানিটি ব্যাগ তো থাকেই যেখানেই যান না কেন। চুলে কলপ, বাঁধানো ঝকঝকে দাঁত, এই বয়সে বহু আয়াসে ধরে রাখা টানতান ত্বক , ঈর্ষণীয় ৫৩ কেজি ফিগার, সুন্দর সাজপোশাক, মুখে মানানসই মেক আপ- একটা আলগা ব্যক্তিত্ব আছে মানতেই হবে। তবু কি যেন একটা নেই। বয়স ষাটের দিকে, তবু কচি খুকি সেজে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। সে থাকুন না, খারাপ নয়। কিন্তু ঔদ্ধত্য-টাকে সহ্য করা যায় না। সেখানে তার মা -বড়লোক হওয়া সত্বেও নিজের ব্যাপারে কত উদাসীন। মনে মনে পাশাপাশি দাঁড় করায় দুজনকে। মায়ের প্রসাধণ বলতে শীতে একটু অলিভ ওয়েল আর বোরোলীন। বাবা মারা যাবার আগে, দাদা একটু বড় হতেই রঙীন শাড়ি ছেড়েছেন। বাবা বলতেন, “যৌবনে যোগিনী, যত সব সেকেলেপনা।” কেউ কেউ বলতেন, “সুন্দরীরা যা পড়ে, তাই মানিয়ে যায়।” মা শরৎ চাট্টুজ্জ্যের বিন্দুর কায়দায় বলতেন, “ছিঃ! ছেলে মেয়ে বড় হলে মায়ের সাজের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। ছিঃ কি লজ্জা।”
আগে তুষারদের অবস্থা নাকি মধ্যবিত্ত-দের চেয়েও খারাপ ছিল। তবে এ সংসারের বৃদ্ধির মূলে নাকি শাশুড়িমার বুদ্ধি আর অসাধারণ চালিকা শক্তি। দুই যমজ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বড্ড বেকায়দায় পড়ে যায় মাঝে মাঝে। আর দুজনে হয়েছেও তেমনি দুরন্ত। সবে ওদের অন্নপ্রাশন হয়েছে। শাশুড়িমা থাকলে তাও মাঝে মাঝে ওনার কাছে রেখে আসত মাম্পি। উনি আগেই বলে দিয়েছিলেন যেঃ -বাচ্চা হলে সামলাবে তুমি আর তুষার মিলে। আমি আর এই বয়সে ঝুট ঝামেলা নিতে পারব না মনে থাকে যেন। তখন আবার এইসব নিয়ে কোন রকম অশান্তির সৃষ্টি না হয় , তার জন্য আমি সব আগে থেকেই বলে রাখলাম। -তাও ওনার কাছে দিয়ে আসলে কিছুক্ষণ-এর জন্য তো রেহাই পাওয়া যায়। হাজার হোক নিজের রক্তের সম্পর্ক আর কচি খুদেদের ভালবাসার টান। আঁতুরে থাকতে ভেবেছিল মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে আর বাচ্চাদের ৬ মাস করে তবে আসবে। সে গুড়ে বালি-এক মাস যেতে না যেতেই চলে আসতে হল। বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য একটা আয়া রাখা হল। সেটাও ওনার পছন্দ নয়, বলেন আমার নাতিরা কেন আয়ার কাছে থাকবে? কি সাঙ্ঘাতিক যুক্তি। ওনার হুকুমেই তো সব কিছু চলে। ছেলেকে বোঝালেন যে, বাড়িতে সব কিছুর কাজের লোক আছে, বাচ্চাদের একটু দেখবে তাও পারবে না? তাহলে মা হলো কেন? তুষার মায়ের মুখের ওপর কথা বলে না। জানে, জবাব দিয়ে লাভ নেই, উপরি পাওনা কিছুই হবে না। তার বদলে মায়ের কাছে বোবার মতন গুচ্ছের কথা শোনা ঢের ভালো। ভেবেছিল মা -কে এনে রাখবে, কিন্তু মা সেই আগেকার দিনের পন্থা মেনে চলে, বলেঃ -ছিঃ! জামাইবাড়ি থাকতে নেই।
তুষার-কে বললে বলে,
- -দিভাইকে দেখো, একলা সব কেমন সামলাচ্ছে। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ। কি করে সামলাচ্ছে? আর তুমি ঘরে বসে এটুকু করতে পারছো না?
মাম্পি চুপ হয়ে যায় আজকাল। শুধু মনে মনে বলে
- “ জোর করে তো বিয়ে করলে । আমার কত শখ ছিল পি এইচ ডি করতে বাইরে চলে যাব।
জি আর ই তে খুব ভাল নম্বরও পেয়েছিল। বাবারও তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তুষার তখন বলেছিল যে, সে এখানেই পি এইচ ডি -টা করে ফেলতে পারবে। তার কোন আপত্তি নেই। আর কেউ আপত্তিও করবে না।” অথচ বৌ্দির কি মজা! ওকে দেখে রীতিমত হিংসে হয়। বৌ্দি কি সুন্দর ঝাড়া হাত-পা হয়ে আছে। মা আর ঠাকুমা মিলে কি সুন্দর ভাবে মানুষ করছে পিকাই কে।
- -“হ্যাঁ! আমাদের লেখক শংকর অনেক আগেই ওঁদের 'দশভুজা' সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কিন্তু স্বামী্রা ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর হয়ে ওঁদের সাহায্য না করলে আমাদের মতো দ্বি্ভুজা হয়ে হাত কামড়াতে হত।”
খালি কথায় তো আর সমস্যা মেটে না। একদিন কথা বলতে বলতে দুঃখ করে মাম্পি তুষারকে বললঃ
-তোমার যদি সেই অবিবাহিতা পিসীমা বেঁচে থাকতেন য়াজ, তাহলে আর আমাদের এত চিন্তা করতে হত না। উনি তো তোমাকেও মানুষ করেছিলেন। মা বাবা মরা ভাইকে নিজে মানুষ করে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। আহা! সারাজীবন তোমাদের দেখা শুনা করেই নিজের জীবন কাটিয়ে দিলেন। নিজের বলতে তো তোমরাই ছিলে। বড্ড মনে পড়ে তোমার সেই পাম্মা-র কথা। আগের দিনের মানুষেরা অনেক কিছু মানিয়ে নিতে পারেন। আমার ঠাকুমা তো বিরাশী বছর বয়স। আর কিছু না পারুন, আমার বৌ্দির ছেলেকে কাছ ছাড়া করেন না। -আবার ভেবে বোসো না যেন, যে নিজের সুবিধার জন্য পাম্মা -পাম্মা করছি। এই স্ংসারের রিমোট কন্ট্রোল তোমার মায়ের হাতে। আজ নিজে সব সুখ সুবিধা উপড়ে নিয়েছিলেন পাম্মা-র কাছ থেকে । আর আমার বেলায় উনি ফালতু ঝক্কি সামলাতে পারবেন না, স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। ইশ! আজ যদি তোমার পাম্মা থাকতেন।
মাম্পির কথা শেষ হতে না হতেই তুষার বলে ফেলল,
-আমার পাম্মা তো বেঁচে আছেন, উনি আছেন কাশীতে। বাবা বেঁচে থাকতে কতদিন মাকে লুকিয়ে আমি আর বাবা পোস্টঅফিসে মানি অর্ডার পাঠিয়েছি পাম্মাকে কাশীতে। তারপর এখন আর তোমাদের নিয়ে এতো ঝামেলায় জড়িয়ে পরেছি যে, পাম্মার কথা ভাববার সময় পাই কই? শেষে পাম্মা এলেও এই ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাবেন এই বয়সে? -'
- কি বল্লে, পাম্মা বেঁচে আছেন? অথচ এবাড়িতে তাঁর নামও শুনি না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ, ধিক্কার তোমাদের মানসিকতা-কে। তুমি ভেবো না আজ আমার দরকারের জন্য পাম্মাকে আমি দয়া দাক্ষিণ্য দেখাচ্ছি। একদম না। সবার ধারণা! নারী দুঃখ বহন করে পুরুষদের অত্যাচারে কিন্তু নারী-ই যে নারীর পরম শত্রু তাও জানা হয়ে গেল আমার আজ। -অন্ততঃ তুমি তো আমাকে বিয়ের পর বলতে পারতে। দুজনে হানিমুন থেকে গিয়ে ওনার আশীর্বাদ নিতে- দেখা করতে পারতাম? তোমার মা কি জানতে পারতেন? না, মা-এর মনে দুঃখ হবে ভেবেছিলে? সত্যি ধিক তোমরা। তোমরা আবার সব শিক্ষিত , আপার স্ট্যাটাস এর লোক বলে বড়াই করে বেড়াও। -কাশী বৃন্দাবনে দুঃখী দের কথা খবরের খুব ঘটা করে বেরোচ্ছে। দীপা মেহেতার 'ওয়াটার' তোমাদের গর্বের সমুদ্রকে ঘোলা করে ছেড়েছে। কয়েকদিন আগে টি ভি তে 'জননী দেবী' সিনেমা দেখে লজ্জায় বাঁচি না। তোমরাও ওই কুকর্ম করেছো! ছোটবেলায় 'পথের পাঁচালী' পড়তে গিয়ে ইন্দির ঠাকরুণকে তাড়ানো মেনে নিতে পারি নি। ওদের সংসারে তবু সর্বগ্রাসী অভাব ছিল। আর তিনিও ছিলেন বিধবা, কিন্তু অবিবাহিতা পাম্মা তো সর্বত্যাগী? নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিলেন ছোটবেলায় মা হারা ভাইকে মানুষ করবার জন্য। আর আজ তিনি সেই আশ্রয়টুকু থেকেও বঞ্চিত? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! -অথচ দিভাই বলেন ওদেশে নাকি সিনিয়ার সিটিজেনকে ওরা সম্মান দিচ্ছে। ঘটা করে আন্তর্জাতিক বৃদ্ধবর্ষ পালন করছে। তোমরা তো সব ওদেশের মতো মেনে চলছো তবে এটার বেলায় নয় কেন? সত্যি আমার ভিষণ ঘেন্না করছে তোমাদের এই ব্যবহারটার জন্য।”
- আচ্ছা বাবাঃ আর শোনাতে হবে না। মা যখন নেই এখানে। চলো না আমরা গিয়ে দেখি কি অবস্থা।
-কি অবস্থা মানে? কিসের কি অবস্থা? সোজা চলো পাম্মাকে নিয়ে আসব। কেন তিনি থাকবেন না এই বাড়ীতে। এবাড়ীতে থাকার সম্পূর্ণ অধিকার আছে পাম্মার।
কয়েকদিনপর মাম্পির শাশুড়ি মন্দিরা ফিরে এলেন। মুখে বিজয়ের হাসি। বোনেরা মিলে শলাপরামর্শ করে সব বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। ভাইদের থেকে বিপুল সম্পত্তির ভাগ বাগিয়ে এনেছেন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকেই তো চক্ষু চরখগাছ। মুখের হাসি মুখের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিল- নির্বাসিতা ননদ শেফালিকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। শুধু তাই নয় ওনার কোলে তখন নাতি -নাতনি খেলা করছে। এদিকে তিনি তো ভাই-এর বৌকে দেখে ভয়ে তটস্থ। তাও মুখে একটু ম্লান হাসি এনে বললেনঃ –
- “জানো মন্দিরা! বিশ্বাস করো, আমি আসতে চাই নি, কিন্তু এরা হঠাত আমাকে গিয়ে নিয়ে এসেছে, সাথে আমার আদরের দাদাভাইরা,, মুখগুলো ঠিক আমার সোনা ভাইটার মতন , তাই আর ওদের কথা উপেক্ষা করতে পারলাম না। -আমার ভাই বলো, সন্তান বলো সব ছিল আমার ভাইটু। তাকে শেষ দেখা ও দেখতে পেলাম না, তাই মনে হল ওই যেন আবার এসেছে ছোট্ট নাতি-নাতনিদের মধ্যে, আর আমার দিকে কেমন খালি তাকিয়ে আছে দেখছো?
মন্দিরা দেবী তো মনে মনে অসম্ভব গালাগালি দিচ্ছিলেন ননদকে। কিন্তু মুখে এনে বল্লেন, -
- না না ঠিক আছে , ভালোই তো কদিন থাকুন না আমাদের কাছে , সবার -ই ভালো লাগবে।
মুখে একটু ফোকলা দাঁতে করূন হাসি এনে ননদ বল্লেনঃ –
- মন্দিরা! আমাকে আর ফিরে যেতে বোলো না ওখানে, কদিন আর বাঁচবো? আমার বড্ড কষ্ট সেখানে। এখানে এক কোণে থাকবো । তোমাদের কাউকে আমি কোন অসুবিধা হতে দেবো না। সব সময় কি আর হরিনামে পেট ভরে, বলো? তখন বয়স কম ছিল, ভালো লাগতো। পাপ্পু একটু বড় হবার পরই তো তোমরা রেখে এসেছিলে। কিন্তু একবার যখন তোমাদের পেয়েছি আর হারাতে চাই না, আর কটা দিনই বা বাঁচব!
খয়াটে হয়ে যাওয়া দু চোখ দিয়ে ননদের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। মাম্পি আর তুষার তাড়াতাড়ি পাম্মার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে গলা জড়িয়ে বল্লঃ
- -পাম্মা! তোমাকে একদিন মা তা-র সংসা্রের কর্তৃ থাকাকালিন গিয়ে রেখে এসেছিল, আজ আমরা তোমাকে ফিরিয়ে এনেছি, যেখানে আমরা থাকবো তুমিও সেখানে থাকবে আর আত্মমর্যাদায় থাকবে বাকি জীবন। মা-এর আপত্তি থাকলে মা একা থাকবে এ বাড়িতে। মা জানবে কি ভয়ংকর জীবন এই একা জীবন।
মন্দিরা -র আর মুখে কথা নেই, আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে পা চালালেন। ভাইদের কাছ থেকে যোগ্য পাওনা যে আনন্দ দিতে পারে নি, আজ তার ছেলে -পুত্রবধূ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যোগ্য পাওনা কাকে বলে? মেনে নিলেন তিনি নিজের অক্ষমতার বিচার। বুঝলেন, টাকাটাই সব নয় জীবনে। বুঝিয়ে দিল তারই গর্ভের সন্তান আর তার পুত্রবধূ।
ঘরের মধ্যে ঘর
সীমা ব্যানার্জ্জী রায়
গাড়ি থেকে নেমেই ঝড়ের বেগে কল্পতরু ওরফে তুষার বাড়িতে ঢুকল। ব্রীফকেস সোফাসেটে রেখেই …
- মাম্পি ইই...মাম্পি! মা -কে দেখেছি না যে। মা কোথাও গেছেন? কিছু বলে গেছেন তোমাকে?
- -জানি না, কি যে করেন! কোথায় যাবেন, কদিন থাকবেন। কিছুই বলার প্রয়োজন বোধ করেন না । যবে থেকে বিয়ে হয়েছে তবে থেকেই তো দেখে আসছি একই রকম ব্যবহার। “ মাম্পি, আমি বেরোচ্ছি। কদিন পর ফিরবো, বুম্বাকে বলে দিও”- কোথায় যাচ্ছেন? জিগেস করার সাথে সাথেই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। শাশুড়িমা তো কখনোই কিছু বলেন না। না, বলার প্রয়োজন বোধ করেন না। নিজের জেদেই তো থাকেন সর্বদা দেখি। শুনেছিলাম, বাড়ির কর্তারাই এইরকম ব্যবহার করেন? কিন্তু শাশুড়িমা তো একজন আমার মতোই গৃহবধূ-ই ছিলেন একদিন।
এ বাড়িতে মাম্পির আসার কথা নয়। অনেক টালবাহানা , অনেক অশান্তির পর একমাত্র পুত্র কল্পতরুর দুর্দান্ত ভালবাসার কাছে দোর্দন্ড প্রতাপশালী মাকে শেষপর্যন্ত হার মানতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে আমেরিকাবাসী মেয়ের ফোনাঘাত, পত্রাঘাত তো ছিলই। আর ছিল মাম্পির রূপ আর শিক্ষার জৌলুস। এখন সংসার যাত্রার অন্তরালে চলেছে দুই নারীর ব্যক্তিত্বের ঠান্ডা লড়াই। এ লড়াইয়ে তুষার কোনোমতেই সামিল হতে রাজি নয়।
মেয়ে তো আগেই মনের মতো সঙ্গী জুটিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে, স্বামী তারও আগে জীবন থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন স্ত্রীকে পেনসন বরাদ্দ করে। শাশুড়ি মন্দিরা দেবী রাতদিন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলে বৌ কি করছে না করছে দেখার তার সময় নেই। বাড়িটা ওঁর নামে, মোটা পেনসন পান, একটা নিজের নামে গাড়ি আছে। হাতে একটা বাহারি বড় ব্যাগ, একটা ভ্যানিটি ব্যাগ তো থাকেই যেখানেই যান না কেন। চুলে কলপ, বাঁধানো ঝকঝকে দাঁত, এই বয়সে বহু আয়াসে ধরে রাখা টানতান ত্বক , ঈর্ষণীয় ৫৩ কেজি ফিগার, সুন্দর সাজপোশাক, মুখে মানানসই মেক আপ- একটা আলগা ব্যক্তিত্ব আছে মানতেই হবে। তবু কি যেন একটা নেই। বয়স ষাটের দিকে, তবু কচি খুকি সেজে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। সে থাকুন না, খারাপ নয়। কিন্তু ঔদ্ধত্য-টাকে সহ্য করা যায় না। সেখানে তার মা -বড়লোক হওয়া সত্বেও নিজের ব্যাপারে কত উদাসীন। মনে মনে পাশাপাশি দাঁড় করায় দুজনকে। মায়ের প্রসাধণ বলতে শীতে একটু অলিভ ওয়েল আর বোরোলীন। বাবা মারা যাবার আগে, দাদা একটু বড় হতেই রঙীন শাড়ি ছেড়েছেন। বাবা বলতেন, “যৌবনে যোগিনী, যত সব সেকেলেপনা।” কেউ কেউ বলতেন, “সুন্দরীরা যা পড়ে, তাই মানিয়ে যায়।” মা শরৎ চাট্টুজ্জ্যের বিন্দুর কায়দায় বলতেন, “ছিঃ! ছেলে মেয়ে বড় হলে মায়ের সাজের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। ছিঃ কি লজ্জা।”
আগে তুষারদের অবস্থা নাকি মধ্যবিত্ত-দের চেয়েও খারাপ ছিল। তবে এ সংসারের বৃদ্ধির মূলে নাকি শাশুড়িমার বুদ্ধি আর অসাধারণ চালিকা শক্তি। দুই যমজ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বড্ড বেকায়দায় পড়ে যায় মাঝে মাঝে। আর দুজনে হয়েছেও তেমনি দুরন্ত। সবে ওদের অন্নপ্রাশন হয়েছে। শাশুড়িমা থাকলে তাও মাঝে মাঝে ওনার কাছে রেখে আসত মাম্পি। উনি আগেই বলে দিয়েছিলেন যেঃ -বাচ্চা হলে সামলাবে তুমি আর তুষার মিলে। আমি আর এই বয়সে ঝুট ঝামেলা নিতে পারব না মনে থাকে যেন। তখন আবার এইসব নিয়ে কোন রকম অশান্তির সৃষ্টি না হয় , তার জন্য আমি সব আগে থেকেই বলে রাখলাম। -তাও ওনার কাছে দিয়ে আসলে কিছুক্ষণ-এর জন্য তো রেহাই পাওয়া যায়। হাজার হোক নিজের রক্তের সম্পর্ক আর কচি খুদেদের ভালবাসার টান। আঁতুরে থাকতে ভেবেছিল মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে আর বাচ্চাদের ৬ মাস করে তবে আসবে। সে গুড়ে বালি-এক মাস যেতে না যেতেই চলে আসতে হল। বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য একটা আয়া রাখা হল। সেটাও ওনার পছন্দ নয়, বলেন আমার নাতিরা কেন আয়ার কাছে থাকবে? কি সাঙ্ঘাতিক যুক্তি। ওনার হুকুমেই তো সব কিছু চলে। ছেলেকে বোঝালেন যে, বাড়িতে সব কিছুর কাজের লোক আছে, বাচ্চাদের একটু দেখবে তাও পারবে না? তাহলে মা হলো কেন? তুষার মায়ের মুখের ওপর কথা বলে না। জানে, জবাব দিয়ে লাভ নেই, উপরি পাওনা কিছুই হবে না। তার বদলে মায়ের কাছে বোবার মতন গুচ্ছের কথা শোনা ঢের ভালো। ভেবেছিল মা -কে এনে রাখবে, কিন্তু মা সেই আগেকার দিনের পন্থা মেনে চলে, বলেঃ -ছিঃ! জামাইবাড়ি থাকতে নেই।
তুষার-কে বললে বলে,
- -দিভাইকে দেখো, একলা সব কেমন সামলাচ্ছে। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ। কি করে সামলাচ্ছে? আর তুমি ঘরে বসে এটুকু করতে পারছো না?
মাম্পি চুপ হয়ে যায় আজকাল। শুধু মনে মনে বলে
- “ জোর করে তো বিয়ে করলে । আমার কত শখ ছিল পি এইচ ডি করতে বাইরে চলে যাব।
জি আর ই তে খুব ভাল নম্বরও পেয়েছিল। বাবারও তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তুষার তখন বলেছিল যে, সে এখানেই পি এইচ ডি -টা করে ফেলতে পারবে। তার কোন আপত্তি নেই। আর কেউ আপত্তিও করবে না।” অথচ বৌ্দির কি মজা! ওকে দেখে রীতিমত হিংসে হয়। বৌ্দি কি সুন্দর ঝাড়া হাত-পা হয়ে আছে। মা আর ঠাকুমা মিলে কি সুন্দর ভাবে মানুষ করছে পিকাই কে।
- -“হ্যাঁ! আমাদের লেখক শংকর অনেক আগেই ওঁদের 'দশভুজা' সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কিন্তু স্বামী্রা ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর হয়ে ওঁদের সাহায্য না করলে আমাদের মতো দ্বি্ভুজা হয়ে হাত কামড়াতে হত।”
খালি কথায় তো আর সমস্যা মেটে না। একদিন কথা বলতে বলতে দুঃখ করে মাম্পি তুষারকে বললঃ
-তোমার যদি সেই অবিবাহিতা পিসীমা বেঁচে থাকতেন য়াজ, তাহলে আর আমাদের এত চিন্তা করতে হত না। উনি তো তোমাকেও মানুষ করেছিলেন। মা বাবা মরা ভাইকে নিজে মানুষ করে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। আহা! সারাজীবন তোমাদের দেখা শুনা করেই নিজের জীবন কাটিয়ে দিলেন। নিজের বলতে তো তোমরাই ছিলে। বড্ড মনে পড়ে তোমার সেই পাম্মা-র কথা। আগের দিনের মানুষেরা অনেক কিছু মানিয়ে নিতে পারেন। আমার ঠাকুমা তো বিরাশী বছর বয়স। আর কিছু না পারুন, আমার বৌ্দির ছেলেকে কাছ ছাড়া করেন না। -আবার ভেবে বোসো না যেন, যে নিজের সুবিধার জন্য পাম্মা -পাম্মা করছি। এই স্ংসারের রিমোট কন্ট্রোল তোমার মায়ের হাতে। আজ নিজে সব সুখ সুবিধা উপড়ে নিয়েছিলেন পাম্মা-র কাছ থেকে । আর আমার বেলায় উনি ফালতু ঝক্কি সামলাতে পারবেন না, স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। ইশ! আজ যদি তোমার পাম্মা থাকতেন।
মাম্পির কথা শেষ হতে না হতেই তুষার বলে ফেলল,
-আমার পাম্মা তো বেঁচে আছেন, উনি আছেন কাশীতে। বাবা বেঁচে থাকতে কতদিন মাকে লুকিয়ে আমি আর বাবা পোস্টঅফিসে মানি অর্ডার পাঠিয়েছি পাম্মাকে কাশীতে। তারপর এখন আর তোমাদের নিয়ে এতো ঝামেলায় জড়িয়ে পরেছি যে, পাম্মার কথা ভাববার সময় পাই কই? শেষে পাম্মা এলেও এই ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাবেন এই বয়সে? -'
- কি বল্লে, পাম্মা বেঁচে আছেন? অথচ এবাড়িতে তাঁর নামও শুনি না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ, ধিক্কার তোমাদের মানসিকতা-কে। তুমি ভেবো না আজ আমার দরকারের জন্য পাম্মাকে আমি দয়া দাক্ষিণ্য দেখাচ্ছি। একদম না। সবার ধারণা! নারী দুঃখ বহন করে পুরুষদের অত্যাচারে কিন্তু নারী-ই যে নারীর পরম শত্রু তাও জানা হয়ে গেল আমার আজ। -অন্ততঃ তুমি তো আমাকে বিয়ের পর বলতে পারতে। দুজনে হানিমুন থেকে গিয়ে ওনার আশীর্বাদ নিতে- দেখা করতে পারতাম? তোমার মা কি জানতে পারতেন? না, মা-এর মনে দুঃখ হবে ভেবেছিলে? সত্যি ধিক তোমরা। তোমরা আবার সব শিক্ষিত , আপার স্ট্যাটাস এর লোক বলে বড়াই করে বেড়াও। -কাশী বৃন্দাবনে দুঃখী দের কথা খবরের খুব ঘটা করে বেরোচ্ছে। দীপা মেহেতার 'ওয়াটার' তোমাদের গর্বের সমুদ্রকে ঘোলা করে ছেড়েছে। কয়েকদিন আগে টি ভি তে 'জননী দেবী' সিনেমা দেখে লজ্জায় বাঁচি না। তোমরাও ওই কুকর্ম করেছো! ছোটবেলায় 'পথের পাঁচালী' পড়তে গিয়ে ইন্দির ঠাকরুণকে তাড়ানো মেনে নিতে পারি নি। ওদের সংসারে তবু সর্বগ্রাসী অভাব ছিল। আর তিনিও ছিলেন বিধবা, কিন্তু অবিবাহিতা পাম্মা তো সর্বত্যাগী? নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিলেন ছোটবেলায় মা হারা ভাইকে মানুষ করবার জন্য। আর আজ তিনি সেই আশ্রয়টুকু থেকেও বঞ্চিত? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! -অথচ দিভাই বলেন ওদেশে নাকি সিনিয়ার সিটিজেনকে ওরা সম্মান দিচ্ছে। ঘটা করে আন্তর্জাতিক বৃদ্ধবর্ষ পালন করছে। তোমরা তো সব ওদেশের মতো মেনে চলছো তবে এটার বেলায় নয় কেন? সত্যি আমার ভিষণ ঘেন্না করছে তোমাদের এই ব্যবহারটার জন্য।”
- আচ্ছা বাবাঃ আর শোনাতে হবে না। মা যখন নেই এখানে। চলো না আমরা গিয়ে দেখি কি অবস্থা।
-কি অবস্থা মানে? কিসের কি অবস্থা? সোজা চলো পাম্মাকে নিয়ে আসব। কেন তিনি থাকবেন না এই বাড়ীতে। এবাড়ীতে থাকার সম্পূর্ণ অধিকার আছে পাম্মার।
কয়েকদিনপর মাম্পির শাশুড়ি মন্দিরা ফিরে এলেন। মুখে বিজয়ের হাসি। বোনেরা মিলে শলাপরামর্শ করে সব বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। ভাইদের থেকে বিপুল সম্পত্তির ভাগ বাগিয়ে এনেছেন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকেই তো চক্ষু চরখগাছ। মুখের হাসি মুখের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিল- নির্বাসিতা ননদ শেফালিকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। শুধু তাই নয় ওনার কোলে তখন নাতি -নাতনি খেলা করছে। এদিকে তিনি তো ভাই-এর বৌকে দেখে ভয়ে তটস্থ। তাও মুখে একটু ম্লান হাসি এনে বললেনঃ –
- “জানো মন্দিরা! বিশ্বাস করো, আমি আসতে চাই নি, কিন্তু এরা হঠাত আমাকে গিয়ে নিয়ে এসেছে, সাথে আমার আদরের দাদাভাইরা,, মুখগুলো ঠিক আমার সোনা ভাইটার মতন , তাই আর ওদের কথা উপেক্ষা করতে পারলাম না। -আমার ভাই বলো, সন্তান বলো সব ছিল আমার ভাইটু। তাকে শেষ দেখা ও দেখতে পেলাম না, তাই মনে হল ওই যেন আবার এসেছে ছোট্ট নাতি-নাতনিদের মধ্যে, আর আমার দিকে কেমন খালি তাকিয়ে আছে দেখছো?
মন্দিরা দেবী তো মনে মনে অসম্ভব গালাগালি দিচ্ছিলেন ননদকে। কিন্তু মুখে এনে বল্লেন, -
- না না ঠিক আছে , ভালোই তো কদিন থাকুন না আমাদের কাছে , সবার -ই ভালো লাগবে।
মুখে একটু ফোকলা দাঁতে করূন হাসি এনে ননদ বল্লেনঃ –
- মন্দিরা! আমাকে আর ফিরে যেতে বোলো না ওখানে, কদিন আর বাঁচবো? আমার বড্ড কষ্ট সেখানে। এখানে এক কোণে থাকবো । তোমাদের কাউকে আমি কোন অসুবিধা হতে দেবো না। সব সময় কি আর হরিনামে পেট ভরে, বলো? তখন বয়স কম ছিল, ভালো লাগতো। পাপ্পু একটু বড় হবার পরই তো তোমরা রেখে এসেছিলে। কিন্তু একবার যখন তোমাদের পেয়েছি আর হারাতে চাই না, আর কটা দিনই বা বাঁচব!
খয়াটে হয়ে যাওয়া দু চোখ দিয়ে ননদের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। মাম্পি আর তুষার তাড়াতাড়ি পাম্মার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে গলা জড়িয়ে বল্লঃ
- -পাম্মা! তোমাকে একদিন মা তা-র সংসা্রের কর্তৃ থাকাকালিন গিয়ে রেখে এসেছিল, আজ আমরা তোমাকে ফিরিয়ে এনেছি, যেখানে আমরা থাকবো তুমিও সেখানে থাকবে আর আত্মমর্যাদায় থাকবে বাকি জীবন। মা-এর আপত্তি থাকলে মা একা থাকবে এ বাড়িতে। মা জানবে কি ভয়ংকর জীবন এই একা জীবন।
মন্দিরা -র আর মুখে কথা নেই, আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে পা চালালেন। ভাইদের কাছ থেকে যোগ্য পাওনা যে আনন্দ দিতে পারে নি, আজ তার ছেলে -পুত্রবধূ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যোগ্য পাওনা কাকে বলে? মেনে নিলেন তিনি নিজের অক্ষমতার বিচার। বুঝলেন, টাকাটাই সব নয় জীবনে। বুঝিয়ে দিল তারই গর্ভের সন্তান আর তার পুত্রবধূ।
3 কমেন্টস্:
অসম্ভাব্য সম্ভাব্যতা
অসম্ভাব্য সম্ভাব্যতা
সীমা ব্যানার্জী রায়ের জীবনমুখী লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগল---তবে পড়ে মনে হয় পারিপার্শিকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা েখিকার লেখনীতে এসে ধরা দেয় । --Dr Ashok Deb
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন