২ এপ্রি, ২০১৪

মৌ দাশগুপ্তা

নেপথ্য শিকার
মূল কাহিনী : মিকাঈল নাঈমী
অনুবাদ: মৌ দাশগুপ্তা


(মিকাঈল নাঈমী (১৮৮৯-১৯৮৮) : জন্ম মাউন্ট লেবাননের বাসকিনতা শহরে। পশ্চিম ও আরবে তিনি পরিচিত একজন আধ্যাত্মিক দার্শনিক লেখক হিসেবে। তার বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দ্য কুকু ক্লক’ এর মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যকর্মে তিনি আধ্যাত্মিক দার্শনিকতা প্রয়োগ করেন এবং পরবর্তীকালে প্রায় প্রতিটি লেখায় অব্যাহত রাখেন।)

- তুই ঠিকই বলেছিলি, জীবনটা খুব সুন্দর।
- শুধু সুন্দরই নয় আবু, জীবনটা খুব মায়াময়।
- এতদিনে বুঝেছি জীবনটা বাঁচার জন্য। একটাই তো জীবন, প্রাণভরে উপভোগ করাতেই আনন্দ।
- আবু, তোর মুখে এই কথা? তুই তো শখের শিকারী, কতবার বারণ করেছি তোকে ঐ নিরীহ পশুগুলোকে অত নির্মম ভাবে মারিস না। একবারও শুনেছিস আমার কথা? ওদের জীবনটাও তো বাঁচার জন্যই, না কি?
- ‘তোর মনে আছে, কতবার তুই আমাকে শিকার করতে নিষেধ করেছিস?
- মনে নেই আবার? খুব মনে আছে, কিন্তু কি লাভ মনে রেখে বল?

আমার ছোটবেলার বন্ধু আবু মারওয়ান শখের শিকারী হলেও শিকরের ব্যাপারে বেশ নামডাক আছে। বছর চল্লিশেক বয়স,প্রাণোজ্জ্বল হাসিখুশি চেহারা।সবচেয়ে সুন্দর ওর তন্দ্রালু দুটি সবুজ চোখ আর দরাজদিল হাসি। একজন সৎ, উদার, রসিক অথচ মৃদুভাষী ও দয়াশীল ব্যক্তি হিসেবে ওর যথেষ্ট কদর আছে। শিকার নেশা হলে কি হবে জন্তু জনোয়ার পোষা ওর ছোটবেলার শখ ।এখনও ঘরে তিনটে বেড়াল, দুটো কুকুর, পাঁচটা গিনিপিগ,গোটা দশেক মোরগ মুরগী আর গুচ্ছের কিচিরমিচির করা মুনিয়া পাখী আছে। সবার হ্যাপা ও একাই সামলায়। পোষ্যদের ব্যাপারে ওর আচরণকে রীতিমত ছেলেমানুষিই বলা যায়। বেড়ালের পা ভাঙলে তাকে কোল থেকে নামায় না,পোষা মুরগী কক্ষনো জবাই করেও না বা অন্য কাউকে ওর পোষা মুরগীর গায়ে হাতও দিতে দেয়না। কিন্তু কোন মুরগী মরে গেলে তাকে যথাযথ সম্মান ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে গোর দিয়ে এসে এমন কান্নাকাটি করে যে বাড়ীর লোক তিতিবিরক্ত হয়ে যায়।

আমার সবচেয়ে অবাক লাগে যখন দেখি আবু খাওয়ার পাতে একটুকরোও আমিষ খায় না। শুদ্ধ শাকাহারী। বাড়ীর সবাই খেলেও কিন্তু অনেক জোরাজুরি করেও ওকে একটুকরো মাংস খাওয়ানো যায়না, সে ওর শিকার করা হোক বা না হোক। জিজ্ঞেস করলে নিরীহমুখে বলে,

- ‘আল্লাহ্ কসম! যাকে খুন করার জন্য আমার হাত নিশপিশ করে, আমার অন্তরাত্মা তার মাংস খেতে অস্বীকার করে।’

ছোটবেলার বন্ধু হওয়াতে আবু মারওয়ানের স্বভাব-চরিত্র আমার বেশ ভালই জানা আছে। তাই ওর শিকারের চমকপ্রদ কাহিনী আর এমন অদ্ভুত স্ববিরোধী চরিত্র আমাকে খুব অবাক করে।

আবু একদিকে যেমন পোষা মুরগী ও খোঁড়া বিড়ালের জন্য ব্যথায় কাতর হয় আবার অন্য দিকে তিতির, খরগোশ কিংবা হরিণ শিকার করে প্রচন্ড আনন্দ পায়। বার বার আমি ওকে শিকার থেকে নিবৃত্ত করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। ওকে সতর্ক করে বলেছি,

- জীবন ব্যথার বদলে ব্যথা ও আনন্দের বদলে আনন্দ ফিরিয়ে দেয়। সেই পুরনো প্রবাদটা মনে আছে তো? ‘চোখের বদলে চোখ আর দাঁতের বদলে দাঁত।’

ও নির্বিকার হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলত,

- ‘শিকার করা হালাল। তাছাড়া সত্যি বলতে কি জানিস দোস্ত, অন্য কোন খেলায় আমি এত আনন্দ পাইনা।’

আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি,

- শিকারে কি এত আনন্দ পাস রে আবু?

- শিকার কি তোর কাছে কোন শত্রুকে খুঁজে বার করে সম্মুখযুদ্ধে তাকে পরাভূত করার আনন্দ, নাকি এটা এক ধরনের শরীর চর্চা? নাকি এটা দূর্বলের ওপর সবলের পীড়নজনিত আত্মসুখ?

ও আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল,

- না রে দোস্ত, জীবনের দুঃশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া আর মাটি, পাথর, মেঘ ও বাতাসের ঘ্রাণ নেওয়ার মত অসংখ্য অনুভূতি শিকারের মধ্যে কাজ করে। একজন শিকারির কাছে শিকার হল ভোর ও সন্ধ্যার সুর-সুধা পান, নিজের ঘামে স্নান-সুখ লাভ আর শিকারের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের হৃদ-স্পন্দন উপভোগ করা। আহা! শিকারিই কেবল শিকারের আনন্দ বোঝে। ও তুই বুঝবি না।


দীর্ঘদিন পর ‘জীবন বড় সুন্দর, জীবনটা বাঁচার জন্য’ এই সব কথা শুনতে শুনতে আমার পুরনো দিনের আলাপচারিতাগুলো যেন আমার স্মৃতির দুয়ারে কড়া নেড়ে গেল। ওর মধ্যে আমি কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ওকে বললাম,

- ‘আবু মারওয়ান, তোর চোখ কিছু বলতে চাইছে। কি হয়ছে রে? আমি তোর ছোটবেলার বন্ধু, আমাকেও বলবি না?’

থুতনিতে হাত রেখে ও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আমার হাত ধরে প্রায় জোর করেই পাশে বসিয়ে গলা পরিস্কার করে বলল,
- ‘শোন। গতকাল আমি একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, একটা তিতির পাখিকে আমি গুলি করেছি। কিন্তু ওটার কাছে গিয়ে দেখি মরেনি, যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি ছুরি দিয়ে ওটাকে আড়াই পোঁচে জবাই করলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই তিতিরটা একটা গলাকাটা শিশু হয়ে গেল, আর সেটা কে জানিস? আমার ফুয়াদ। তুইতো ওকে দেখেছিস, ওকে ভালও বাসিস। আর এও নিশ্চই বুঝিস, ও আমার কাছে আমার নিজের জীবনের থেকেও দামী। ঈশ্বরের পর ওই আমার একমাত্র আরাধ্য। এই স্বপ্ন দেখার পর সকালে আর শিকারে যেতে পারিনি। অবশ্য এমন মেয়েলীপনার জন্যে আমি নিজের কাছেই খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। তাই দুপুরের খাওয়া সেরেই মনে জোর এনে শিকারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লাম। দরজার কাছে বসে আমার ফুয়াদ খেলছিল আর আমার নানার কাছে দুঃখী শাহজাদী ও চালাক তিতিরের সেই পুরানো রূপকথাটা শুনছিল। আমায় দেখেই ছোট্ট ছোট্ট হাত বাড়িয়ে কোলে উঠে এল।
আমি ওকে কোলে নিয়ে আদর করলাম; ওর চোখ, ওর কপাল আর থুতনিতে চুমু খেলাম। ওকে বললাম, ফিরার সময় তোমার জন্য কী নিয়ে আসবো বাবা! ও দুই হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে বলল, ‘এত্ত বড় একটা তিতির পাখি, সত্যিকারের তিতির পাখি।’ বললে কি তুই বিশ্বাস করবি দোস্ত, সারাটাদিন আমি অতবড় পাহাড়ী অরণ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটাছুটি করেছি কিন্তু একটাও তিতির পাখি মারতে পারিনি। এমন না যে কোন তিতির দেখিনি, আল্লাহ কসম, অনেক তিতির আমার চোখে পরেছে, অন্তত দশটাকে লক্ষ্য করে গুলিও করেছি, কিন্তু বশ্বাস কর, একটাও মরেনি। তুই জানিস, শিকারে আমি কতটা দক্ষ। জানিনা কেন এমন হল, তবে বুঝতে পারছিলাম ঐ স্বপ্নই আমার চিন্তা আর অনুভূতিকে নিষ্ঠুরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, ‘সূর্যের আলো যখন নিবুনিবু তখনও আমার ঝোলায় কোন পাখি ভরতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত সব আশা-ভরসা ছেড়ে দিয়ে আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম। জানিনা কেন, তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম ঐ স্বপ্নই আমার ব্যর্থতার কারণ। এই সব ভাবতে ভাবতে আমি যখন তাড়াহুড়া করে বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছি ঠিক তখনই রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে একটা শিয়াল তীরবেগে আমার সামনে দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেল। আমি সাথে সাথেই ওটাকে গুলি করে মেরে ফেললাম। না শিকরের জন্য নয়, মারলাম নিজর ওপর অন্ধরাগে আর ব্যর্থতায়। মরা শিয়ালটার পাশ কাটিয়ে চলেই আসছিলাম, কিন্তু মুহূর্তেই আমার ঐ রাগ বিরক্তি আর হতাশা পুরোপুরি উবে গিয়ে চরম বিস্ময় ও আনন্দের রূপ নিল, যখন দেখলাম মৃত শিয়ালটির মুখে আধমরা একটি তিতির পাখি ছটফট করছে।’
‘ঐ মুহূর্তের অনুভূতি তুই কল্পনাও করতে পারবি না।’
‘হতেপারে, ঐ শিয়ালটিও হয়ত বাবা…সেও হয়তো তার শয়াল শিশুদের জন্য শিকারে বেরিয়েছিল বা খাদ্য অণ্বেষণে, আমার মত সেও হয়ত আজসারাদিন ঘুরে কোন তিতির পাখি পায়নি। আর যখন পেল তখন আমিও গিয়ে হাজির হলাম তার জীবনটা কেড়ে নেবার জন্য। এক শিয়াল ও তার সন্তানদের মুখের গ্রাস লুট করে নিজের সন্তানকে উপহার দেব বলেই হয়তো এমন নিয়তি!
যাই হোক, মাংস হালাল করার জন্যে আমি যখন তিতিরটার গলায় ছুরি চালালাম তখন ঐ স্বপ্নটা যেন বার চোখের সামনে ফুটে উঠলো। চোখের পলকেই গলাকাটা তিতির আমার ছোট ছেলে ফুয়াদে পরিণত হল। আমার মনে হল আমি জ্ঞান হারাতে যাচ্ছি। যদিও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। তিতিরটা ঝোলায় পুরে বাড়ী ফেরত এলাম।

- তারপর?

- তারপর, রাতে তিতিরটাকে রোস্ট করে আমার স্ত্রী নরম কিছু মাংস ফুয়াদকে দিয়েছিল। খাবার টেবিলে খেতে খেতে হঠাৎ করেই ফুয়াদ চিৎকার শুরু করলো। প্রচন্ড কাশি ও সেই সাথে ওর শ্বাস কষ্ট শুরু হল। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একজন প্রতিবেশি ছিলেন ডাক্তার। তার আপ্রাণ চেষ্টাতেই সে রাতে ওর গলায় বিঁধে থাকা রানের একটা ভাঙা হাড়ের টুকরো মাইনর অপারেশন করে বার করে ফুয়াদকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। এখনো ঐ দৃশ্যের কথা মনে পরলে আমার বুক কেঁপে উঠে, আমি অসুস্থ হয়ে যাই।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ আবু মারওয়ান চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, এই জন্যই বললাম দোস্ত , যে তুই-ই ঠিক বলতি, জীবনটা খুব সুন্দর।

কেমন যেন সন্দেহ হলো, কি বলব ভেবে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

- ‘ তুই শিকার করা ছেড়ে দিয়েছিস কিনা বল তো?’

আবু মারওয়ান মাটির দিকে তাকিয়ে কেমন এক অদ্ভুত গলায় বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল,

- ‘এত কিছু বলবার পরও তুই এমন প্রশ্ন করিস কিভাবে?’


3 কমেন্টস্:

Gautam Sen বলেছেন...

ভাল লাগল, টানটান এক জীবনবোধের এই গল্প। এক সামান্য বিষয়, কিন্তু তার এক গভীর প্রভাব ভাবনায় ছেয়ে গেল। অনুবাদ নিশ্চয় ই সুন্দর, তবু বলি আরও সুন্দর এই গল্প নির্বাচন।

শমীক (জয়) সেনগুপ্তের কবিতারা বলেছেন...

darun

Soumitra Chakraborty বলেছেন...

বাঃ! সুন্দর অনুবাদ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন