২ এপ্রি, ২০১৪

শম্পা বসু

দূরে কোথায় দূরে দূরে
শম্পা বসু



মনটা ভারাক্রান্ত হয়েছিল প্রথম থেকেই। বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজোর উচ্ছ্বাসে গা ভাসাতে পারবো না এবার ! বাড়ির কর্তামশাইটি দেখে শুনে দেবীপক্ষের তৃতীয়ার দিনের টিকিট এনে হাজির। জায়গাটি লোভনীয়। ভূস্বর্গ কাশ্মীর; কিন্তু ওই পুজোর কটা দিনের জন্যেই যে সারা বছর আকুল হয়ে অপেক্ষা করা! তবু ছেলে মেয়ের উজ্জ্বল চোখের আনন্দের কাছে নিজের বাসনাকে বিসর্জন দেওয়াতেই তো সুখ। ওদের আনন্দেই তো মা বাবার জীবনের পূর্ণতা। সঙ্গে যাবেন আরও চার পাঁচজন আত্মীয় পরিজন। বিমান - টিকিট হাতে পাওয়ার পর থেকেই দেখি আমারও যেন শৈশব সুলভ চাপল্য ফিরে এসেছে, ঘিরে ধরেছে আমাকে। এতদিন শুধু ভূগোলেই পড়েছি ডাল লেকের সৌন্দর্যের কথা , কাশ্মীর নাকি ভূস্বর্গ। এবার ইন্টারনেট খুলে দেখতে লাগলাম দ্রষ্টব্য স্থানগুলো। শুধু কি তাই ? ভ্রমণ রসিক স্বামীটিও ছেলে মেয়ের জন্যে খুঁজে খুঁজে ওই পুজোর বাজারের ভিড়ের মধ্যে থেকে কিনে আনতে লাগলেন শীতের পোশাক । মানে প্রস্তুতির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছনোর প্রচেষ্টা ।

যথারীতি এসে পড়ল সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ । চারিদিকে মণ্ডপসজ্জা শেষের মুখে ; আলোকসজ্জাও প্রায় সুসম্পন্ন ; এরই মধ্যে কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে তৃতীয়ার দিন ভোরে পৌঁছলাম দমদম বিমানবন্দরে । প্রথমে দিল্লির উড়ান , তারপর সেখান থেকে শ্রীনগর । দিল্লী থেকে শ্রীনগরের ওই যাত্রাপথটুকু খুব বেশীক্ষণের নয় , কিন্তু জানলার ধারে বসে ওই উচ্চতা থেকে শ্রীনগর শহরটাকে দেখা যে কত রমণীয় হতে পারে , তা অবর্ণনীয় । মেঘের মধ্যে দিয়ে ভেসে যাওয়া , আর নীচে পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে তুষারধবল শিখর দেখে শিহরিত হয়ে ওঠা - আমার কিশোরী মেয়ে আর ছোট ছেলের বিস্ময় - কৌতূহল আমাদের মনকেও ভরিয়ে তুলছিল আনন্দে ।

ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে তুলনা করা হয় সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ।কিন্তু হিমালয় যে আল্পসের চেয়ে কিছু কম নয় ,বেশিই বরং-- এই ভাবতে ভাবতে কখন যে পৌঁছে গেছি শ্রীনগর বিমানবন্দরে , তা খেয়াল করিনি । বাইরে দশজনের সেই দলকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন সদ্য পরিচিত হামিদ ভাই , কিন্তু তাঁর আন্তরিকতায় আমরা তখন মুগ্ধ । ভাবা যায়! হৃদ রোগী আমার ননদ ওই উচ্চতায় উঠে যদি কোন শ্বাসকষ্ট জনিত অসুবিধায় ভোগেন , তাই তিনি ছটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে উপস্থিত । টাটা উইংগারে চলেছি দশজন । ঝাউগাছ আর লতানে গুল্মের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দলের দুই কচি কাঁচা গেয়ে উঠছিল "চেন্নাই এক্সপ্রেস" এর সদ্য জনপ্রিয় বহুল প্রচারিত গানটি ..."কাশ্মীর হ্যায় ", তালে তাল মেলাচ্ছিলাম না কি আমরাও ? চারিদিকে স্লোপিং রুফের বাড়ি, মনে পড়ছিল খবরের কাগজের ছবিতে দেখা তুষারপাতের কথা । পথে চাপদাড়ি যুবক , বোরখা ঢাকা যুবতী আর মোড়ে মোড়ে সি আর পি এর জওয়ানদের ভ্যান গাড়ি দেখে অনুভব করলাম কাশ্মীরের প্রতিকূলতা । পথে পড়ল রাজবারগ পার্ক । ঝিলামকে দেখলাম একঝলক । সেই ঝিলাম , রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন , "সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলামের স্রোতখানি বাঁকা " ...সেই বাঁকা স্রোত দেখিনি তখন , কারণ মধ্যাহ্ন ভোজের তাড়া । পথের ধারেই ধাবাখানা । আমাদের দলের দেড় বছরের বিতান আবার 'চলন্ত" । একটু থামলেই মুশকিল । তাই তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে এলাম ডাল লেকে । সেই স্বপ্নের লেক । বহু প্রতীক্ষিত । এ যে সমুদ্রের চেয়েও বিস্তীর্ণ । আর লেকটির চারিদিকে বিস্তীর্ণ পাহাড় । সে কী বিচিত্র বরণ পর্বতের । কোথাও ধূসর , কোথাও হালকা কৃষ্ণবর্ণ আর তারই কোল ঘেঁষে অসংখ্য হাউসবোট । সেই হাউসবোটে নিয়ে যাবার জন্যে কূলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র শিকারা । তিনটি শিকারা নিয়ে ভাসমান হলাম আমরা । একটাতে শুধু লটবহর , আর দুটিতে আমরা সবাই । হামিদ ভাই হাউসবোটে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন । বাচ্চারা দাপাদাপি করতেই বোট যেন দুলে উঠলো খানিক । মুগ্ধ হয়ে গেলাম তার অন্দরসজ্জায় । আখরোট কাঠ দিয়ে তৈরি অপরূপ আসবাবপত্র। হাত মুখ ধুয়ে শিকারায় চড়ে ডাল লেক ভ্রমণের পালা এবার । শিকারায় উঠে চালক একটু মজা করে নৌকো হেলাতেই আমার পুত্রের মুখে জল টলমল । পাশে এসে গেল আরও দুটি শিকারা । ফটো তোলা ওদের পেশা । ওই শিকারাতেই ওদের সাজসজ্জার উপকরণ । ছেলে মেয়ে তো কাশ্মীরি সাজলোই , দেখতেও লাগছিলো অপূর্ব আর আমরাই বা বাদ যাই কেন ? ঝুপ করে এর মধ্যে নেমে এল অন্ধকার ।

শীতের আমেজ , সেখানে লেকের ওপরেই ভাসমান পোস্ট অফিস , ওষুধের দোকান , আর শাল – ফিরান – কোটের দোকান । পর্যটকরাই ওদের প্রধান ভরসা । তাই সাদর আমন্ত্রণের অভাব নেই । কিন্তু তখন আমরা ক্লান্ত । তাই লেকের কিছুটা ঘুরে আমরা এলাম হাউসবোটে , রাতের বেলা যেন পরী সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে রঙিন আলোর হাউসবোটের পসরা নিয়ে সেই একই ডাল লেক সুন্দরী । মাত্র একদিনের রাত্রিযাপন এখানে , তাই বারান্দায় বসে উপভোগ করছিলাম সেই নিশীথিনীর সৌন্দর্য । কিন্তু ক্লান্তিজনিত ঘুম ডেকে নিল বিছানায় , আর সকালে ঘুম ভাঙ্গল ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দে । ভূস্বর্গ বৃষ্টিস্বর্গে পৌঁছে গেল নাকি ? মেঘের সঙ্গে রোদের লুকোচুরি খেলায় সঙ্গী হয়ে আমরা প্রাতরাশ সেরে রওনা দিলাম পহেলগামের উদ্দেশে । হাল্কা ঠাণ্ডা তখন চিনার বনের মধ্যে । ঝিলামের ধারে ধারে চিনারের এই অভিভাবকত্ব মুঘল আমল থেকে । আর এই চিনারকে নিয়ে কাশ্মীরিদের খুব গর্ব । সবুজতায় আর রাজকীয়তায় পূর্ণ । পরে মনে পড়লো কাশ্মীরি শালে এই চিনার পাতার প্রতিচ্ছায়াই তো লক্ষণীয় ।

যাত্রাপথটিও তো ভারি মনোরম । চারিদিকে সবুজ উপত্যকার মাঝে মেঘ , তারই মধ্যে “আমরা এমনি এসে ভেসে যাই” । টোল বুথে পয়সা ফেলে বেলাবেলি পহেলগামের হোটেল ‘হিভানের’ সামনে যখন গাড়ি এসে থামল তখন মনে হল “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি” । সামনে বইছে খরস্রোতা লিডার নদী । নুড়ি পাথর , পার্বত্য উপত্যকা , সবুজ বনানী তারই সঙ্গে মাঠে চরে বেড়ানো ভেড়ার পাল ---আমার কিশোরী কন্যা তো ভাইকে জড়িয়ে ধরে ঘুরে নিল একপাক । বিকেলবেলা বাকি আমরা কফির আমেজে ডুবে গিয়ে পাহাড়ের কোণে কোণে বরফ খোঁজার একটা বৃথা চেষ্টা করতে লাগলাম। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এত ভাল লাগছিল যে , মনে হল দু’দিন না থেকে আরও কিছুদিন থাকার পরিকল্পনা করলে ভাল হত । ধীরে ধীরে শীতল আবহ নেমে এল চারিদিকে । রাতের প্রকৃতি এখানে গম্ভীর , স্তব্ধ । আর নদীর জলের মৃদু কলধ্বনি সেই স্তব্ধতাকে করে তুলছে আরও গহন, গভীর । কাশ্মীরি ডিনারে সুস্বাদু কাশ্মীরি খানা । গরগরে , মশলাদার মাটন গুস্তাবা আর রিস্তা । সাথে গরম রুটি । কিন্তু মনটা ভারাক্রান্ত হল যখন শুনলাম গুলমার্গ –এ গিয়েও বরফের দেখা মিলবে না ।

কিন্তু পথ যে বড় সুন্দর , যাবার পথে পড়ল আপেল বাগান । যে কাশ্মীরি আপেল কেনার জন্যে মানুষ অপেক্ষা করে থাকে , তা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে ওখানে । গাছ থেকে ফল পেড়ে খাচ্ছে প্রায় সকল পর্যটক ই ।

এরপর এল পৃথিবীর সবথেকে উঁচু গলফ কোর্স । আমাদের গাড়ি সেই পথ পেরিয়ে আরও আরও পাইন আর দেওদারের মধ্যে দিয়ে এসে পৌঁছল মস আর ফার্ন ঘেরা কাঠের হোটেল এর সামনে । কিন্তু গিয়ে শুনলাম সন্ধ্যের আগে সেখানে প্রবেশ করা যাবে না , সেদিনের জন্যে ওখানকার সরকার কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল । কিন্তু আতিথেয়তার কোন ত্রুটি রাখেন নি তারা । একটা ছোট্ট কটেজে কিছুক্ষণের জন্যে থাকতে দিল তারা আমাদের । সঙ্গে গরম চিকেন পকোড়া । চারিদিকে শুধু নির্জনতা আর ধূম অন্ধকার । তারপর সন্ধে নামতে হোটেলের দিকে যাত্রা । উঁচুতে উঠতে আমার ননদ কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় হামিদ ভাইয়ের জোগাড় করা অক্সিজেন কাজে লাগলো এবার । পরের দিন গন্ডোলা যাত্রা । লাইন দিয়ে টিকিট কাটা হল । দুটি টাওয়ার আছে সেই পাহাড়ে । পাহাড়ের নির্জনতা , স্তব্ধতা , গাম্ভীর্য সবই যেন বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে ভ্রমণার্থীদের ফেলে যাওয়া বিস্কুটের প্যাকেট, চিপস এর প্যাকেট, কোল্ড ড্রিঙ্কসের স্ট্র-এর আবর্জনায় । দ্বিতীয় টাওয়ারের একেবারে উঁচুতে গ্লেসিয়ারে কিছু বরফের সন্ধান পাওয়া গেল ; কিন্তু তুষারাবৃত পাহাড়কে দেখতে না পাওয়ার দুঃখ মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। শতবার বলে এলাম তুমি আবার ডাকবে তো? এরপর শ্রীনগর ফেরা । কিছু কেনাকাটা । কবে ভূস্বর্গ তার তুষার ধবল সৌন্দর্য নিয়ে আবার ডাকবে আমায় কে জানে ।

যে জম্মু ও কাশ্মীর মাঝে মাঝেই হয়ে ওঠে অশান্তির বার্তা বাহী, সেই ভূস্বর্গেই এত আন্তরিকতার স্বাদ পেয়েছি সাধারণ মানুষের কাছে, তা না বললে কাশ্মীর ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । বৃষ্টি ভেজা শহরে মীর ও হামিদ ভাই যেভাবে আমাদের উষ্ণ আতিথেয়তায় শহর ঘুরিয়েছে, মেয়ের আবদারে দেখিয়েছে কাশ্মীর ইউনিভার্সিটি, সাদরে নিয়ে গেছে আখরোট কাঠের কারখানায়- কাঠের শিল্পকর্ম সেখানে দেখার মত । গয়নার বাক্স, বালা , চাবির রিং , ট্রে--- কী অপূর্ব শিল্পকর্ম সে সবের ।

“যাবার সময় হল বিহঙ্গের”-যাত্রা শেষের বেলায় আর একবার ডাল লেকের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কোন সীমা যেন নেই তার । “ধ্যানগম্ভীর ভূধর” আর সুবিস্তৃত জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনা করছিলাম শীতকালীন সেই স্থানটির , যখন সাধারণ জনজীবন থেকে তারা হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন । কিন্তু সেই সৌন্দর্য? তা কি শুধু ছবিতেই থাকবে ধরা ? মনে মনে উচ্চারণ করলাম ‘ভূস্বর্গ , তুমি বিচ্ছিন্ন হোয়ো না সুবিশাল ভারতবর্ষের বুক থেকে’। ফের যেন ডাক পাই তোমার।

1 কমেন্টস্:

Pranab Basu Ray বলেছেন...

দারুণ...গল্প বলার ঢঙ--আকর্ষণ বাড়িয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন