(ছোটগল্প)
ভিজিটিং কার্ড
সৌমেন্দ্র লাহিড়ী
পাখী আজ একমাস পর বিউটি পার্লারে গিয়েছিল । আসার সময় লিপষ্টিক নেলপালিশ আরো টুকিটাকি কিনে ফিরেছে । যদিও দেখতে সে খুবই সুন্দর তবুও সবসময়েই সেজেগুঁজে থাকতে ভালবাসে । পাড়ার সবাই তাকে ভালবাসে তনুমাসি তো চোখে হারায় । তাছাড়া পাখী মাত্র পনের বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে, তাই হয়ত সকলের ভালবাসা একটু বেশীই পায় ।
মা চলে যাবার আট বছর হয়ে গেছে । বেশ ছিল ছোটবেলার দিনগুলো মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেত, দুপাশে দুটো ছোট্ট বিনুনি ঝুলিয়ে , সবাই গাল টিপে আদর করত । সারাদিন মায়ের কাছে থাকলেও বিকেলের পর থেকে সে তনুমাসির কাছেই থাকত , তনুমাসিকে পাখীর মাও মাসি ডাকত ।
পাখী ধীরে ধীরে কখন যেবড় হয়ে গেছে বুঝতেও পারে নি । মা - কিএকটা রোগে ভূগে ভূগে চলে গেল । প্রথমে কিছু চিকিৎসা হলেও, পরে বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেছে । ক' দিন খুব কেঁদেছিল পাখী - পৃথিবীতে আপন বলে ঐ একজনই ছিল । কিন্তু পেট বড় দায় - শুরু হলো নতুন জীবন । মায়ের জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয় নি পাখীর । ছোটবেলা থেকেই তো মাকে দেখে এসেছে । যেটুকু অস্বস্তি ছিল তাও তনুমাসির দৌলতে কেটে গেছে । এখন পাখী এ পাড়ার আকর্ষণ- মধ্যমণি ।
দুপুরে খাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নেওয়া অভ্যেস পাখীর - কিন্তু, আজ আর হলো না । কি মনে হলো - মায়ের পুরানো টিনের বাক্সটা খুললো । মায়ের গোলাপী শাড়ীটা এখনও প্রায় নতুন আছে , মাত্র দু একদিন পরেছিল । শাড়ীটা তুলে নিলো , মাকে এই শাড়ীটাতে দারুণ লাগত - আজ এই শাড়ীটাই পরবে । শাড়ীর পাশে সেই পুঁটুলি, যেটা মা যত্ন করে রাখত । খোলার ইচ্ছে হয়নি কোনদিন ,তাছাড়া তেমন প্রয়োজনও হয় নি । পুঁটুলিটা রেখে শাড়ীটা নিয়ে উঠে পড়ল পাখী ।
শাড়ীটা খুব সুন্দর করে পড়ল পাখী । নতুন কেনা গোলাপী নেলপালিশটা যত্ন করে পরল । ফুঁ দিয়ে দিয়ে নেলপালিশটা তাড়াতাড়ি শুকাল পাখী । শুরু করল মেকআপ- ধীরে ধীরে সুন্দর পাখী অপরুপ হয়ে উঠল । আয়নাতে নিজেকে আজ বেশীই ভাল লাগল পাখীর ।
আজ আর বাইরে দাঁড়ানোর দরকার নেই । তনুমাসি সকালেই বলে গেছে । ঘরে বসেই অপেক্ষা করতে লাগল পাখী- কখন দরজায় টোকা পড়ে । বেশীক্ষণ বসতে হলো না - ঠিক সময়েই দরজায় টোকা পড়ল । দরজা খুলে দেখল- তনুমাসি আর এক খদ্দের, বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, ধোপদুরস্ত পোশাক - খুশীই হলো পাখী । এদের কাছে একটু বেশীই পাওয়া যায় । তনুমাসি চলে গেল লোকটা ঘরে ঢুকল ।
অল্প সময়েই পাখী বুঝতে পারল লোকটা একদম আনকোড়া নয় । ঘন্টা দুয়েক সময় কেটে গেল । লোকটা উঠে দাঁড়াল । পাখীও নিজেকে সাব্যস্ত করে তুলল ।
লোকটা পকেট থেকে টাকা বের করে পাখীর হাতে দিল - পাখীও অভ্যস্ত হাতে গুনে দেখল - অন্যদিন যা পায় তার থেকে অনেকবেশীই আছে । লোকটা এবার একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বললো -" তুমি আমায় খুশী করে দিয়েছো, যদি কখনও দরকার পড়ে যোগাযোগ করো" । কার্ড হাতে নিয়ে পাখী দাঁড়িয়ে থাকল- লোকটা ধীরে ধীরে বেড়িয়ে গেল ।
মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল পাখীর - অন্যদিন তো এমন হয় না, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল । টাকাগুলো বালিশের তলায় রেখে ভিজিটিং কার্ডটা ভাল করে দেখতে লাগল । হঠাৎ দেওয়ালে ঝোলানো মাকালীর ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডারের দিকে নজর পড়ল পাখীর - আজ- আজই তো মায়ের মৃত্যুদিন, চোখ থেকে জল চলে এলো । ছুটে গেল পুরানো টিনের বাক্সটার দিকে - মায়ের একটু ছোঁয়া নিতে । বাক্সটা খুলে প্রথমেই নজরে পড়ল পুঁটুলিটার দিকে, তুলে নিয়ে বসল বিছানায় । খুব যত্নে পুঁটুলিটা খুলল - মায়ের একটা পুরানো জরা জীর্ণ ফোটো , একজোড়া রুপোর দূল , একটা ভাঙা নুপুর - ওগুলো বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল ।আরে ছবিটার পেছনে আটকে আছে একটা পুরানো পোষ্টকার্ড । পোষ্টকার্ড খুলে নিল ফোটোর থেকে ।
মায়ের লেখা একটা ছোট্ট চিঠি । ঠিকানা ভূল হওয়ায় ফিরে এসেছিল । লেখা মাত্র কয়েকটা শব্দ - "বাবু তোমার মেয়ে হয়েছে , মা হয়ে আমি চাই না ও এখানে থাকুক ,আপনি এই নরক থেকে ওকে নিয়ে যান , আমার প্রণাম নেবেন । ইতি রমলা" । চিঠিটা পড়েই তাড়াতাড়ি উল্টে দেখল ঠিকানাটা ,কিন্তু - ঠিকানাটাই তো ভূল, নামটা পড়ল - আরে ,এই নামটাই তো একটু আগে লোকটার দেওয়া ভিজিটিং কার্ডে ...................
স্তব্ধ হয়েগেল পাখী । নিঃশব্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল । নিজের নারীত্বকে খুব ঘৃণা হতে লাগল - খুন করতে ইচ্ছা করল নিজেকে, না পেরে নিজের তলপেটে আপ্রাণ ঘুঁষি মারতে শুরু করল ।
দরজায় আবার টোকা - শব্দটা আরো জোরদার হতে লাগল ।
ভিজিটিং কার্ড
সৌমেন্দ্র লাহিড়ী
পাখী আজ একমাস পর বিউটি পার্লারে গিয়েছিল । আসার সময় লিপষ্টিক নেলপালিশ আরো টুকিটাকি কিনে ফিরেছে । যদিও দেখতে সে খুবই সুন্দর তবুও সবসময়েই সেজেগুঁজে থাকতে ভালবাসে । পাড়ার সবাই তাকে ভালবাসে তনুমাসি তো চোখে হারায় । তাছাড়া পাখী মাত্র পনের বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে, তাই হয়ত সকলের ভালবাসা একটু বেশীই পায় ।
মা চলে যাবার আট বছর হয়ে গেছে । বেশ ছিল ছোটবেলার দিনগুলো মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেত, দুপাশে দুটো ছোট্ট বিনুনি ঝুলিয়ে , সবাই গাল টিপে আদর করত । সারাদিন মায়ের কাছে থাকলেও বিকেলের পর থেকে সে তনুমাসির কাছেই থাকত , তনুমাসিকে পাখীর মাও মাসি ডাকত ।
পাখী ধীরে ধীরে কখন যেবড় হয়ে গেছে বুঝতেও পারে নি । মা - কিএকটা রোগে ভূগে ভূগে চলে গেল । প্রথমে কিছু চিকিৎসা হলেও, পরে বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেছে । ক' দিন খুব কেঁদেছিল পাখী - পৃথিবীতে আপন বলে ঐ একজনই ছিল । কিন্তু পেট বড় দায় - শুরু হলো নতুন জীবন । মায়ের জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয় নি পাখীর । ছোটবেলা থেকেই তো মাকে দেখে এসেছে । যেটুকু অস্বস্তি ছিল তাও তনুমাসির দৌলতে কেটে গেছে । এখন পাখী এ পাড়ার আকর্ষণ- মধ্যমণি ।
দুপুরে খাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নেওয়া অভ্যেস পাখীর - কিন্তু, আজ আর হলো না । কি মনে হলো - মায়ের পুরানো টিনের বাক্সটা খুললো । মায়ের গোলাপী শাড়ীটা এখনও প্রায় নতুন আছে , মাত্র দু একদিন পরেছিল । শাড়ীটা তুলে নিলো , মাকে এই শাড়ীটাতে দারুণ লাগত - আজ এই শাড়ীটাই পরবে । শাড়ীর পাশে সেই পুঁটুলি, যেটা মা যত্ন করে রাখত । খোলার ইচ্ছে হয়নি কোনদিন ,তাছাড়া তেমন প্রয়োজনও হয় নি । পুঁটুলিটা রেখে শাড়ীটা নিয়ে উঠে পড়ল পাখী ।
শাড়ীটা খুব সুন্দর করে পড়ল পাখী । নতুন কেনা গোলাপী নেলপালিশটা যত্ন করে পরল । ফুঁ দিয়ে দিয়ে নেলপালিশটা তাড়াতাড়ি শুকাল পাখী । শুরু করল মেকআপ- ধীরে ধীরে সুন্দর পাখী অপরুপ হয়ে উঠল । আয়নাতে নিজেকে আজ বেশীই ভাল লাগল পাখীর ।
আজ আর বাইরে দাঁড়ানোর দরকার নেই । তনুমাসি সকালেই বলে গেছে । ঘরে বসেই অপেক্ষা করতে লাগল পাখী- কখন দরজায় টোকা পড়ে । বেশীক্ষণ বসতে হলো না - ঠিক সময়েই দরজায় টোকা পড়ল । দরজা খুলে দেখল- তনুমাসি আর এক খদ্দের, বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, ধোপদুরস্ত পোশাক - খুশীই হলো পাখী । এদের কাছে একটু বেশীই পাওয়া যায় । তনুমাসি চলে গেল লোকটা ঘরে ঢুকল ।
অল্প সময়েই পাখী বুঝতে পারল লোকটা একদম আনকোড়া নয় । ঘন্টা দুয়েক সময় কেটে গেল । লোকটা উঠে দাঁড়াল । পাখীও নিজেকে সাব্যস্ত করে তুলল ।
লোকটা পকেট থেকে টাকা বের করে পাখীর হাতে দিল - পাখীও অভ্যস্ত হাতে গুনে দেখল - অন্যদিন যা পায় তার থেকে অনেকবেশীই আছে । লোকটা এবার একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বললো -" তুমি আমায় খুশী করে দিয়েছো, যদি কখনও দরকার পড়ে যোগাযোগ করো" । কার্ড হাতে নিয়ে পাখী দাঁড়িয়ে থাকল- লোকটা ধীরে ধীরে বেড়িয়ে গেল ।
মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল পাখীর - অন্যদিন তো এমন হয় না, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল । টাকাগুলো বালিশের তলায় রেখে ভিজিটিং কার্ডটা ভাল করে দেখতে লাগল । হঠাৎ দেওয়ালে ঝোলানো মাকালীর ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডারের দিকে নজর পড়ল পাখীর - আজ- আজই তো মায়ের মৃত্যুদিন, চোখ থেকে জল চলে এলো । ছুটে গেল পুরানো টিনের বাক্সটার দিকে - মায়ের একটু ছোঁয়া নিতে । বাক্সটা খুলে প্রথমেই নজরে পড়ল পুঁটুলিটার দিকে, তুলে নিয়ে বসল বিছানায় । খুব যত্নে পুঁটুলিটা খুলল - মায়ের একটা পুরানো জরা জীর্ণ ফোটো , একজোড়া রুপোর দূল , একটা ভাঙা নুপুর - ওগুলো বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল ।আরে ছবিটার পেছনে আটকে আছে একটা পুরানো পোষ্টকার্ড । পোষ্টকার্ড খুলে নিল ফোটোর থেকে ।
মায়ের লেখা একটা ছোট্ট চিঠি । ঠিকানা ভূল হওয়ায় ফিরে এসেছিল । লেখা মাত্র কয়েকটা শব্দ - "বাবু তোমার মেয়ে হয়েছে , মা হয়ে আমি চাই না ও এখানে থাকুক ,আপনি এই নরক থেকে ওকে নিয়ে যান , আমার প্রণাম নেবেন । ইতি রমলা" । চিঠিটা পড়েই তাড়াতাড়ি উল্টে দেখল ঠিকানাটা ,কিন্তু - ঠিকানাটাই তো ভূল, নামটা পড়ল - আরে ,এই নামটাই তো একটু আগে লোকটার দেওয়া ভিজিটিং কার্ডে ...................
স্তব্ধ হয়েগেল পাখী । নিঃশব্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল । নিজের নারীত্বকে খুব ঘৃণা হতে লাগল - খুন করতে ইচ্ছা করল নিজেকে, না পেরে নিজের তলপেটে আপ্রাণ ঘুঁষি মারতে শুরু করল ।
দরজায় আবার টোকা - শব্দটা আরো জোরদার হতে লাগল ।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন