২৬ ফেব, ২০১৪

অশোক কুমার লোধ

আলোয় ফেরা
অশোক কুমার লোধ



কথা ফুরিয়ে যাওয়া দুটি মানুষ , একটি বিবাহিতা নারী ও একটি বিবাহিত পুরুষ । ওরা পরস্পরের সহকর্মী । একই অফিসের একাধিক বিভাগে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পাশাপাশি টেবিলে । স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময়ের পালা শেষ হতেই যে যার মত কাজে ব্যস্ত । দুজনেই কিছুটা অস্বাভাবিক অন্যদের চোখে । কারণে অকারণে ওদের হা হা হি হি নেই , নেই অহেতুক উচ্ছ্বাস , অফিসের চলতি হাওয়ায় বেজায় বেমানান । আসলে রুচিতে বাধে আলোচনার বিষয়বস্তুতে -- কে কার সাথে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে ইদানীং অতি উৎফুল্ল , এই মুহূর্তে কি তার রগরগে রসায়ন , কিম্বা কার শাশুড়ি কত বজ্জাত , কে কার বরকে কেমন বাধ্য ছাগল বানাতে পারদর্শী , কিছু মেয়েলি ন্যাকামি বা কিছু পুরুষালী আস্ফালন ও অসভ্যতা – অফিসের এই চলতি রসালাপ বড় বিচিত্র ও বিরক্তিকর । এসবের থেকে দূরে সরে থাকা মানেই অনেকের কাছে তারা অহংকারী , দেমাকি , অসহ্য ।

তমালি সেন , বয়েস ৩০ + , গড়নে গড়পড়তা বাঙ্গালী নারী । চমৎকার কণ্ঠস্বর , কথা শুনলে কানের আরাম হয় । চোখে পরার মতো দুটি গভীর চোখ চশমার আড়ালে , চরম উদাসীন চাউনি । কাজের ক্ষেত্রে যদিও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ , সহযোগিতা চাইলে সহজেই মেলে । সর্বদাই ইয়ার-ফোনে গান শোনেন বা অন্য কিছু শুনতে ব্যস্ত , কে জানে কি শোনেন ! তবে কীবোর্ডে আঙ্গুল চলে ঝড়ের গতিতে , অদ্ভুত এক যন্ত্র - মানবী না কি বিষাদ প্রতিমা !

দিগন্ত রায় , বয়েস ৩৫ + , সুখী সুখী চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত দুটি অপলক অচঞ্চল চোখ । কাজের অবসরে মুখ গুঁজে থাকেন কোনও বইয়ের পাতায় । কখনো উপন্যাস কখনো বা গল্প , কবিতায় ! কাজের ক্ষেত্রে এনার দিকেও আঙ্গুল তোলার কোনও অবকাশ নেই , কাজের কথা ছাড়া অবশ্য অন্য কোনও কথাই বলেন না তেমন ! অদ্ভুত এক নিঃস্পৃহ নিস্তরঙ্গ জীবনে অভ্যস্ত দুর্বোধ্য মানুষটি ।

এহেন দুটি মানুষের প্রাত্যহিক দেখা সাক্ষাৎ কালের নিয়মে । উভয়েই উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল , সেটা কথায় না বললেও বোঝা যায় , বুঝে যান দুজনেই । এভাবেই বইতে থাকে সময় , চলতে থাকে নিয়মমাফিক কাজ , সাজতে থাকে নীরব কথামালা দুটি মানুষের অন্তরে অন্তরে । একজনের হঠাৎ অনুপস্থিতি অপরজনকে বিচলিত করে , মন খারাপ হয়ে যায় , ফাঁকা ফাঁকা লাগে । আবার ব্যক্তিগত কারণ জানতে চাওয়াও তো স্বভাববিরুদ্ধ । পরস্পরের প্রতি এই যে অদৃশ্য টান , এই সামান্য চাওয়া পাওয়ার কি কোনও বৈধতা আছে ? মুগ্ধতা কি কোনও বৈধতার ধার ধারে কখনো ? না বোধ হয় । এভাবেই কিছু না হ্যাঁ হয়ে যায় , ভেঙ্গে যায় সংযমের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ।

কথা ফুরিয়ে যাওয়া দুটি মানুষ অনেক কথা বলতে চেয়ে ছটফট করতে থাকে । শুরু হয় ছোট ছোট সংলাপ , পরস্পরের চোখে চোখ রাখা , দুজনেই পড়ে নিতে চায় না বলা কথাদের , দুটি হাত ছুঁতে চায় কিছু উষ্ণতা , নীরবতা হারায় মুখরতায় । শুরু হয় একসাথে আসা ও যাওয়া । জানা হয়ে যায় পরস্পরের পছন্দ অপছন্দের লম্বা তালিকা , কিছু আলো কিছু ফেলে আসা অন্ধকারের মুহূর্ত ।

তমালি – “ আপনি অনেকটাই আমার মতো ! কু-সংস্কার মুক্ত , বিজ্ঞান - মনস্ক , যুক্তিবাদী , খানিক কাজ পাগলও বটে ! ” দিগন্ত – “ হ্যাঁ , তা বলতে পারেন , আমাদের দুজনেরই রুচি ও সংস্কৃতি-গত মিল থাকায় এই অফিসে আমরা ভীষণ বেমানান । ফাঁকি দিয়ে সরকারী টাকা পকেটে পুরতে বিবেকে বাধে । ” তমালি – “ সে তো একশবার কিন্তু এত দুঃখবিলাস কেন আপনার ? কেনই বা অমন গুটিয়ে রাখেন , আড়ালে রাখেন নিজেকে ? ” দিগন্ত – “ ওই একই প্রশ্ন তো আমারও আপনার কাছে ! ” তমালি – “ কি হবে জেনে ? সব অঙ্কের ভাগফল মেলে না কি ? কিছু ভাগশেষ থেকেই যায় ! ” দিগন্ত – “ জীবনের গণিতে আমিও বড়ই কাঁচা , হিসেবের খাতা ভুলে ভরা । ভালোবাসায় প্রতারিত হয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত বদল বাবা মায়ের অবুঝ আবদার মেটাতে , না কোনও শঠতা আমি করিনি , তাদেরই পছন্দের একটি মেয়েকে সমস্ত অতীত ইতিহাস জানিয়ে বিয়ে করে বুঝেছি তার মধ্যে কোনও প্রেম নেই , গান নেই , কবিতা নেই , আছে শুধু প্রবল আত্মসুখ , সন্দেহ আর অকারণ অবিশ্বাস । আমি কিন্তু আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার । গড়পড়তা সাদামাটা মানুষ ও চালাকির মুখোশ আমাকে ক্লান্ত করে । বহুদিন পরে আপনাকে পেলাম আমারই মতন সংসার বিমুখ , উদাসীন । ” তমালি – “ বিশ্বাস করুন , আমিও খুব সাধারণ একটি সংসার চেয়েছিলাম নিজের । যেখানে আমার আমির মর্যাদা থাকবে , সুর তাল গান থাকবে জীবনের ছন্দে । আমার বিয়ে করা পুরুষটির স্বরূপ ধরা পড়লো বিয়ের পরে , যে বিয়ের আগে আমার গান শুনে আহ্লাদে গদগদ হয়েছিল , এখন সে চায় না আমি গান করে সময় নষ্ট করি ! আমার চাকরির টাকাটি তার প্রয়োজন , প্রয়োজন সংসারে বিনামূল্যে যাবতীয় কাজ এবং ভোগ করার জন্যে একটি শরীর মর্জিমাফিক , মনের কোনও স্থান নেই সেখানে , এর বাইরে নারীর আর কোনও জগত থাকা অনুচিত বলেই মনে করে যে মানুষ , তাকে মানুষ ভাবতেও ঘেন্না হয় । ”

বোবা কান্নারা মুক্তি চায় অচেনা পাটিগণিতে । জীবনের অঙ্কে হিসেব মেলে না বেহিসাবি সময়ের হাতছানিতে । একাধিক চোখ প্রত্যহ মেপে চলে দুটি মানুষের আচরণ । দিগন্ত ও তমালি দুজনেই বেশ বুঝতে পারে তারা ক্রমশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে । অথচ কে কি জানে ? আর কতটুকুই বা জানে ? না জানা গল্পটিও অল্প অল্প করে অনেক বড় হয়ে যায় । এই বিড়ম্বনা এড়াতে দুজনেরই চাই কিছুটা সময় আর অকপটে কথা বলার , কাছে আসার নির্জনতা ।

অবশেষে একদিন একসাথে দুজনেই পৌঁছে যায় অচেনা অজানা কোনও এক মড়া নদীর মোহনায় , একটি নির্জন কটেজে । আগল ভেঙ্গে পাগলপারা দুটি শরীর মন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বাধাহীন স্বতঃস্ফূর্ততায় । ঠিক পুরুষের সাথে সঠিক নারীর মিলন হ’লো ফুরিয়ে আসা গোধূলির আলোয় । সম্পূর্ণ হ’লো দুটি অসম্পূর্ণ জীবন এবং একটি শপথ নিলো দুজনেই – “ এই দিনটির পুনরাবৃত্তি আর নয় । ” বিকেলের আলো ফুরিয়েছে অনেক আগেই , আকশে জমতে থাকা মেঘের কালো কখন যে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরতে শুরু করেছে টের পায়নি কেউই । এরপর বৃষ্টি এলো খুব জোরে । কাকভিজে দুটি মানুষ ফিরে যায় যে যার ঘরে ।

1 কমেন্টস্:

Unknown বলেছেন...

khub sundor ekti golpo upohar dilen Ashok da. shuvechcha nirontor. valo thakun o r o likhun. :)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন