১৪ মে, ২০১৩

রবীন্দ্রশ্রদ্ধার্ঘ - হরপ্রসাদ রায়

প্রসঙ্গঃ রবীন্দ্রনাথ ও সমকাল
হরপ্রসাদ রায়



সময় টা ছিল ১৮৭৪ । উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে তখন আধুনিক বলে পরিচিত হয়েছে। আর এই সময় রবীন্দ্রনাথের নাটকীয় প্রবেশ ‘তত্ত্ববোধিনী’ তে তাঁর অস্বাক্ষরিত কবিতা “অভিলাষ” দিয়েই । তার পর প্রায় চার দশকের সময় পরিব্যাপ্তিতে কবি যখন বাংলাসাহিত্যে পরিনত ব্যাক্তিত্ব তখনই পশ্চিম তার দ্বার খুলে স্বীকৃতি জানাল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ঘোষিত পুরস্কারটি কবির হাতে তুলে দিয়ে । কবির কবি মনীষার বিশ্বায়নে অধিবাস হল নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে ১৯১৩ তে। বলা যেতে পারে, বিশ-শতকের শুরু বাংলা সাহিত্যের বিশ্ব সাহিত্যে নিজের জায়গাকে সর্বসম্মত অনুমোদনে চিহ্নিত করার এক বিশেষ পর্ব সেটা। তারপর থেকে সময়টা প্রায় অলক্ষ্যে জুড়ে গেল একটা নামের সাথে, সময়ের একটা মানদণ্ড তৈরী হল কবিকে ঘিরে । যুগের রূপরেখা আঁকা হল ‘রবীন্দ্রযুগ’ শিরোনামে, আর সাহিত্যে পেল এক নতুন সমসাময়িকতার পরিচয় পত্র ।

১৯১৫ র ‘ঘরে বাইরে’ কবির সমসাময়িক বিশ্বচেতনার সামজিক কথাচিত্র এবং বিশ্লেষণ। তিনি এতে যেমন ভারতীয় সামাজিক মূল্যবোধের পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপরেখা এঁকেছেন তেমনি সমকালীন প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর মানব সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। এতে যে শুধু পরম্পরাগত সামাজিক মুল্যবোধের দৃষ্টিকোণ গুলি নির্দেশিত হয়েছে তা নয় উন্মোচিত হয়েছে বিভিন্ন নতুন ক্ষেত্র আর অঙ্কিত হয়েছে তার ভবিষ্যৎ রূপরেখা। তার অনেকটাই ঘটেছে সমসামিক সময়ের প্রভাবে হয়ত কবির বৃহত্তর মননের গভীর থেকে। নব জাতকের ‘সুচনা’ তে রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন যে ‘আমার লেখা অনেক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে যেমন প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তন হয়। তার অধিকাংশই ঘটেছে আমার অজান্তেই। এই পরিবর্তন প্রাকৃতিক পরিবর্তন কে অনুসরন করেছে, এ পুরোপুরি প্রাকৃতিক কোন সচেতন মনের কাজ নয়। আর এ হয় লেখকের অজ্ঞাতেই’ (সংকলিত)।

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রবিশারদ অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য বলেনঃ
“When one considers the versatile creativity of Tagore and the staggering range of his thoughts and writings over a period of over sixty years, those words seem to hold the key to any attempt to comprehend his work as a totality.”

১৯১২ ‘গীতাঞ্জলী’ আর ১৯১০ গোরা সমসাময়িক কালের এক বিস্তৃত পটভূমি তৈরী করে দেয় আর রবীন্দ্রনাথ কে প্রতিষ্ঠা করে কালদ্রষ্টা হিসেবে।

তারপর থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত সময়ে ছিল রাবীন্দ্রিক সমপ্রেক্ষিতা ছিল এক রকম অবিসংবাদিত। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের কল্লোল পত্রিকার ছত্রছায়ায় কল্লোলযুগের কবিরা প্রথম সোচ্চার হলেন সাহিত্যে রাবীন্দ্রিক আবেশের মুখমুখি দাঁড়িয়ে। পরিবর্তনের স্রোত প্রবল ভাবে দুকুল ছাপিয়ে জন্ম দিল এক সমান্তরাল ধারার । যে মনীষা বাংলা সাহিত্যে তাঁদের বিশেষ স্বতন্ত্রতার ছাপ রাখেন তাঁদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, মহিতলাল মজুমদার, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ ছিলেন প্রথম সারিতে। লক্ষনীয় ভাবে পুরো প্রতিবাদী আন্দোলনটি বাস্তবে ছিল রবীন্দ্রনাথের একছত্র প্রভাবকে অস্বীকার করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সুচনা করা । মনে হয়েছিল যে কল্লোল পরবর্তী যুগ সত্যিই এক আলাদা ধারা তৈরিতে সক্ষম হবে। আপতঃ দৃষ্টিতে তাই মনে হলেও ১৯৫০ এর পর থেকে আবার শিথিল হতে থাকে পরিবর্তনের ওই স্রোত। অথচ সাবলীল গতিতে লক্ষ্যে অলক্ষ্যে প্রবাহমান থেকেছে রাবীন্দ্রিক সাহিত্য ও দর্শনের ধারাপ্রবাহ একরকম সময়ের যতি চিহ্ন অগ্রাহ্য করেই ।

রবীন্দ্র সাহিত্য ও দর্শনের প্রভাব আজও বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ পরিলক্ষিত ধারা বলা যেতে পারে সমকালীন ধ্রুবক।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর উৎসর্গ (১২) তে বলেনঃ
“আমি বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো
তবু শিশির টুকুরে ধরা দিতে পারি
বাসিতে পারি যে ভালো...”

মনে হয় কবিতায় নিজের অজান্তেই নিজেকে বিবৃত করেছেন এভাবে আর হয়ে উঠেছেন চিরকালীন সমকালীন ।

****

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন