এক আত্মপরিক্রমা : বাংলাসাহিত্যের এক অনন্য নারীবাদী কবি,
মল্লিকা সেনগুপ্ত (শেষ পর্ব )
মৌ দাশগুপ্তা
এই পুরাণ আর মহাকাব্যিক চেতনাভূমিতেই কি তৈরি হয়েছে মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিমন? একাধিক কবিতায় বারংবার এসেছে সীতা, দ্রৌপদী, মাধবীর কথা। সেই সব কারণেই হয়তো তাঁকে ‘নারীবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু এই দাগানো ছেঁদো ব্যাপার। এতে কবি এবং কবিতাকেই অসম্মান করা হয়।মল্লিকার কবিতাগ্রন্থগুলির ধারাবাহিক পাঠ থেকে এটা বেশ বোঝা যায় যে দিন যত গিয়েছে কবি ততই চেয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে তাঁর কবিতা কেবল একটি মেয়ের বন্ধুই নয়, হয়ে উঠুক তার হাতিয়ারও, আর কে না জানে হাতিয়ার যতই ধারালো 'ততই কার্যকরী!' মল্লিকা সেনগুপ্তের একটা অনিন্দ্যসুন্দর কবিতার নাম ‘রেডলাইট নাচ’। নাচের মঞ্চে যে কত নারী আসেন, তাঁদের প্রতিটি দেহভঙ্গিমায় যে কত ব্যথা লুকিয়ে আছে, তারা যে সমাজের নিগ্রহ পেরিয়ে এখন মনোরঞ্জনে মত্ত, সেই বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায়।
অসুস্থ অবস্থায় লেখা ‘আমাকে সারিয়ে দাও, ভালবাসা’ বইয়ের ১৩ নম্বর কবিতাটা যেমন।
আমার তো কখনো কখনো মনে হয়েছে সমসাময়িকদের মধ্যে সম্ভবত মল্লিকাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি মহাভারতপ্রাণিত।‘মাধবী’র কথাই ধরা যাক। মহাভারতে মহর্ষি বিশ্বামিত্র তাঁর শিষ্য গালবের কাছে এক কান সাদা, এক কান কালো এক লক্ষ ঘোড়া দক্ষিণা চান। গালব রাজা যযাতির কাছে যান। দানবীর যযাতি তাঁর কন্যা মাধবীকে গালবের হাতে সম্প্রদান করেন। গালব এক-একটি রাজ্যে যান, সেই রাজারা সেই রকম দুষ্প্রাপ্য ২৫ হাজার ঘোড়া দান করেন। বিনিময়ে শুধু মাধবীকে এক বছর তাঁদের সঙ্গে থাকতে হবে, পুত্রের জন্ম দিতে হবে। মল্লিকার কবিতায় প্রথম দিকে মাধবীর চোখের আগুনে ছ্যাঁকা খেতেন গালব। সেই চোখ ক্রমে পানাপুকুরের মতো ঘোলাটে, নিস্তরঙ্গ। কবিতার শেষে গালবের থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে মাধবীর সেই ঘোলাটে চোখ ফেটে রক্ত নামে। ‘সেই রক্ত আজও থাকে নারীর সিঁথিতে।’ কোনও তত্ত্ব বা প্রতিবাদ নয়, আচমকা আজকের সীমন্তিনীদের সঙ্গে সে দিনের মাধবীকে একাকার করে দেওয়া। রাজারা হয়তো নেই। কিন্তু সংসার, চাকরি, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদির লেলিহান আগুনে আজকের মাধবীরাও কি আগুন হারিয়ে ক্রমে ক্রমে হয়ে যান না নিস্প্রভ?
এই ধরনের কবিতাগুলিতে কবিতার ভিতরেই মল্লিকা এক তর্কের উত্থাপন করেছেন, মেয়েদের নির্যাতনের বাস্তবতাকে অশ্রুসজল অক্ষরে বর্ণনা করে হাততালি পেতে চাননি, সেই বাস্তবতাকে, হ্যাঁ, কবিতাতেই, বিশ্লেষণ করে পাঠকের মস্তিষ্ককে আক্রমণ করেছেন৷ইতিহাস আর পুরাণকেই নয়, প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া ক্লাসিক বাংলা কবিতাকেও পুনর্নির্মাণ করেছেন তিনি৷ 'বীরপুরুষের মা ' এই পুনর্নির্মাণের এক সার্থক উদাহরণ৷ রবীন্দ্রনাথের 'বীরপুরুষ'-এ হিরো ছোট্ট ছেলেটি, সেই কেন্দ্রে, মা মার্জিনে৷ মল্লিকার কবিতায় কিন্ত্ত মার্জিন থেকে কেন্দ্রে এসে দাঁড়ান বীরপুরুষের মা৷ ‘মা’ মল্লিকা লেখেন,
নারীর জড়তা ঝেড়ে তিনি হয়ে ওঠেন কেবলি কবি। কিংবা কথামানবী। পাঠক/ পাঠিকার প্রিয় কবি। আশির দশকের বাংলার আধুনিক কবিতার অন্যতম কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত আজ আর আমাদের মধ্যে নেই । গত ২৮শে মে ২০১১ শনিবার ভোর ৫টা ৪৬ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। কথামানবী না থাকলেও রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টি, তাঁর আধুনিক মেয়েলী চুপকথা থেকে রূপকথার স্মরণিকারা।
মল্লিকা সেনগুপ্ত (শেষ পর্ব )
মৌ দাশগুপ্তা
এই পুরাণ আর মহাকাব্যিক চেতনাভূমিতেই কি তৈরি হয়েছে মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিমন? একাধিক কবিতায় বারংবার এসেছে সীতা, দ্রৌপদী, মাধবীর কথা। সেই সব কারণেই হয়তো তাঁকে ‘নারীবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু এই দাগানো ছেঁদো ব্যাপার। এতে কবি এবং কবিতাকেই অসম্মান করা হয়।মল্লিকার কবিতাগ্রন্থগুলির ধারাবাহিক পাঠ থেকে এটা বেশ বোঝা যায় যে দিন যত গিয়েছে কবি ততই চেয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে তাঁর কবিতা কেবল একটি মেয়ের বন্ধুই নয়, হয়ে উঠুক তার হাতিয়ারও, আর কে না জানে হাতিয়ার যতই ধারালো 'ততই কার্যকরী!' মল্লিকা সেনগুপ্তের একটা অনিন্দ্যসুন্দর কবিতার নাম ‘রেডলাইট নাচ’। নাচের মঞ্চে যে কত নারী আসেন, তাঁদের প্রতিটি দেহভঙ্গিমায় যে কত ব্যথা লুকিয়ে আছে, তারা যে সমাজের নিগ্রহ পেরিয়ে এখন মনোরঞ্জনে মত্ত, সেই বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায়।
মেয়েদের দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা, লাঞ্ছনা, উপেক্ষা,সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে বারবার সরব হয়েছে তাঁর লেখনী।কবির নিজের কথায়, ‘আমি কান্না গড়ি, আগুন লিখি, নিগ্রহ দেখি অঙ্গার খাই,লাঞ্ছিত হই, আগুন লিখি।‘মানছি, তাঁর প্রতিটি কবিতা হয়তো শিল্পিত সুষমায় উত্তীর্ণ নয়, সেটি সম্ভবও নয়।‘বীণা সর্দার খালি গলায় এমন গান গেয়ে উঠল যে
মধুসূদন মঞ্চের বাতাস করুন হয়ে এল
তেজী হরিণীর মতো সারা মঞ্চে নেচে বেড়াচ্ছে সে
কে বলবে, তিনবার ওকে বিক্রি করে দিয়েছিল ওর বাবা !
নেপাল বর্ডার থেকে পুলিশ উদ্ধার করে এখানে এনেছে
পুরনো কথার ঘায়ে মাঝে মাঝেই ওর মাথা খারাপ হচ্ছে ।‘
[রেডলাইট নাচ]
গোছের লাইনে চমকও নেই, কবিতাও নেই। এ ভাবেই বহু জায়গায় রান মিস, তবু খেলার দক্ষতায় হাততালি না দিয়ে উপায় নেই। ঠিকঠাক ছন্দ-ব্যবহার না জানলে‘এ ভাবে হাচ থেকে এয়ারটেল হয়ে
আবার রিলায়েন্স স্বামীর ঘর’
-এর মতো লাইন লেখা বেশ শক্ত।‘দিল তো পাগল হ্যায় বাঙালির মনে
গ্লোবাল লোকাল সব কিলবিল করে’
অসুস্থ অবস্থায় লেখা ‘আমাকে সারিয়ে দাও, ভালবাসা’ বইয়ের ১৩ নম্বর কবিতাটা যেমন।
মারণ রোগে দেখতে এসে যারা আহা-উহু করে, তাদের প্রতি বিরক্তি। তারা কোথায় থাকে? সহানুভূতির রসে। মনুষ্যেতর পিঁপড়েদের মতো। সে কারণেই তৎসম ‘উহারা’ শব্দের ব্যবহার। নারীবাদী-টাদীর ঢের আগে মল্লিকা সেনগুপ্ত তাই কবি।‘আমাকে বাঁচতে হবে, যত ভাবি, ততই উহারা
সহানুভূতির রসে চিটচিটে জিভ দিয়ে চাটে।’
মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতায় নারীর প্রতিবাদ আছে, কিন্তু তথাকথিত পুরুষবিদ্বেষ নেই। ‘স্বামীর কালো হাত’ নামে তাঁর একটি কবিতা পড়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। দাম্পত্য সম্পর্কের খুটিনাটি খুনসুটি নিয়ে লেখা ওই কবিতায় মশারী গুঁজে দেওয়ার নৈমিত্তিক ঘটনার বিবরণ চমৎকার ভাষা পেয়েছে। কবিতাটি একটু পড়ে নেওয়া যাক—‘যে ভাবে আদিম নারীরা তোমাকে প্রণাম জানাত, আমি সেই ভাবে
প্রণাম জানাই পুরুষ তোমাকে,’
মল্লিকার কবিতা-র বিষয় হিসেবে এসেছে নানান প্রসঙ্গ। ‘তেভাগার ডায়েরি’ নামের এক কবিতায় শ্রমজীবী নারীর প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে নতুন এক ভাষায়। শ্রমের বিনিময়ে যে নারী পায় কেবল পোকা আলু আর আতপ চাল, সে যে তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য পায় না, তা বলা-ই বাহুল্য। তবু সেই শ্রমজীবী নারী তাঁর খোঁপায় লালফিতে জড়িয়ে নেয়। এই লালফিতা শুধু আর রূপসজ্জার অংশ হয়ে থাকে না, হয়ে উঠে বিপ্লবের প্রতীক। এমনকি কাস্তের ফলকও হয়ে ওঠে তাঁর অলঙ্কার। যে তেভাগায় দুই ভাগ শ্রমিকের আর একভাগ মালিকের কথা বলা হয়েছে, মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতার নারী দেখতে পান, সেখানে দুইভাগ নিয়ে যাচ্ছে ‘গৃহমুষিক’। কিন্তু এটি নারী মেনে নেয় না, সে ‘উনুনের চার পাশে বসে হাত গরম করে’। আর তখনই তাঁর ঘোষণা পল্লবিত হয়।‘মশারি গুঁজে দিয়ে যেই সে শোয় তার
স্বামীর কালো হাত হাতড়ে খুঁজে নিল
দেহের সাপব্যাঙ, লাগছে ছাড় দেখি
ক্রোধে সে কালো হাত মুচড়ে দিল বুক
বলল, শোনো শ্বেতা, ঢলানি করবে না
কখনও যদি ওই আকাশে ধ্রুবতারা
তোমাকে ইশারায় ডাকছে দেখি আমি
ভীষণ গাড্ডায় তুমিও পড়ে যাবে,
শ্বেতার শ্বেত উরু শূন্যে দুলে ওঠে
আঁকড়ে ধরে পিঠ, স্বামীর কালো পিঠ ।‘
সাদামাটা উপকরণে যে কত উপাদেয় কবিতা-অস্ত্র তৈরি করা যায়, মল্লিকা তা নিজ হাতে করে দেখালেন।'অর্ধেক পৃথিবী' গ্রন্থটির প্রথম কবিতা 'আপনি বলুন মার্কস'৷ ইতিহাসকে প্রশ্ন করতে করতেই মল্লিকা পৌঁছে গিয়েছিলেন নিজস্ব বীক্ষায়।মার্কসবাদী ও নারীবাদী তাত্ত্বিকরা অনেকেই হয়তো এই কবিতাটিতে মল্লিকার অবস্থানটিকেও প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারেন,দূরের চাষিকে শালপাতা মুড়ে খবর পাঠাও
আনো কেরোসিন, যদি দরকার হয় আগুন জ্বালাব
[তেভাগার ডায়েরি]
'আপনি বলুন মার্কস'-এর পরে বার বার তত্ত্বের সঙ্গে এই বোঝাপড়া মল্লিকার কবিতার কেন্দ্রে জায়গা পেয়েছে৷ 'ফ্রয়েডকে খোলা চিঠি'-তে তিনি লিখেছেন,কখনো বিপ্লব হলে
পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাস্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী
হবে ?
(আপনি বলুন, মার্কস…মল্লিকা সেনগুপ্ত)
অক্ষর নিয়ে হেলায় ছেলেখেলা করে গেছেন কবি। একটি উদাহরনের লোভ সামলাতে পারলাম না।'পুরুষের দেহে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ /
দিয়েছে শাশ্বত শক্তি, পৃথিবীর মালিকানা তাকে /
ফ্রয়েডবাবুর মতে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্য থাকে /
পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা করে পৌরুষের প্রতি৷ '
আবার এই কবিই 'ছেলেকে হিস্ট্রি পড়াতে গিয়ে' কবিতায় জানিয়ে দেন হিস্ট্রি আসলে 'হিজ স্টোরি', লেখেন, 'আসলে হিজড়ে ছিল ইতিহাসবিদ'৷অয় অজগর আসছে তেড়ে
ছোট্ট মেয়ের স্বপ্ন ঘেরে
আমার তোমার সবার চোখে
ময়াল সাপের মতন ও কে ?
ইঁদুর ছানা ভয়েই মরে
ধর্ষিত সে ভীষণ ঝড়ে
ঈগল পাখি দ্বিতীয় ভয়
থানা পুলিশ কোর্টে রয়
উট চলেছে উল্টোপুরাণ
মধ্যযুগে সে অভিযান
ঊনো জমির দুনো ফসল
বঙ্গদিশি মেয়ের দল
ঋতুবেলায় অশুচি নারী
অন্য সময় ঠেলবে হাঁড়ি
৯-কার কেমন ডিগবাজি খায়
লুপ্ত হওয়ার লাজ শঙ্কায়
একুশ থেকে ইচ্ছা-পোশাক
যে দেখে তার চক্ষু টাটাক
ঐ দেখো ওর ঘোমটা খোলা
বোরখা খোলা আপন ভোলা
ওল খেও না ধরবে গলা
ময়ালকে তা মিছে বলা
ঔষধে যে ময়াল মরে
সে ঔষধ কি আছে ঘরে..
(স্বরবর্ণ)
আমার তো কখনো কখনো মনে হয়েছে সমসাময়িকদের মধ্যে সম্ভবত মল্লিকাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি মহাভারতপ্রাণিত।‘মাধবী’র কথাই ধরা যাক। মহাভারতে মহর্ষি বিশ্বামিত্র তাঁর শিষ্য গালবের কাছে এক কান সাদা, এক কান কালো এক লক্ষ ঘোড়া দক্ষিণা চান। গালব রাজা যযাতির কাছে যান। দানবীর যযাতি তাঁর কন্যা মাধবীকে গালবের হাতে সম্প্রদান করেন। গালব এক-একটি রাজ্যে যান, সেই রাজারা সেই রকম দুষ্প্রাপ্য ২৫ হাজার ঘোড়া দান করেন। বিনিময়ে শুধু মাধবীকে এক বছর তাঁদের সঙ্গে থাকতে হবে, পুত্রের জন্ম দিতে হবে। মল্লিকার কবিতায় প্রথম দিকে মাধবীর চোখের আগুনে ছ্যাঁকা খেতেন গালব। সেই চোখ ক্রমে পানাপুকুরের মতো ঘোলাটে, নিস্তরঙ্গ। কবিতার শেষে গালবের থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে মাধবীর সেই ঘোলাটে চোখ ফেটে রক্ত নামে। ‘সেই রক্ত আজও থাকে নারীর সিঁথিতে।’ কোনও তত্ত্ব বা প্রতিবাদ নয়, আচমকা আজকের সীমন্তিনীদের সঙ্গে সে দিনের মাধবীকে একাকার করে দেওয়া। রাজারা হয়তো নেই। কিন্তু সংসার, চাকরি, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদির লেলিহান আগুনে আজকের মাধবীরাও কি আগুন হারিয়ে ক্রমে ক্রমে হয়ে যান না নিস্প্রভ?
এই ধরনের কবিতাগুলিতে কবিতার ভিতরেই মল্লিকা এক তর্কের উত্থাপন করেছেন, মেয়েদের নির্যাতনের বাস্তবতাকে অশ্রুসজল অক্ষরে বর্ণনা করে হাততালি পেতে চাননি, সেই বাস্তবতাকে, হ্যাঁ, কবিতাতেই, বিশ্লেষণ করে পাঠকের মস্তিষ্ককে আক্রমণ করেছেন৷ইতিহাস আর পুরাণকেই নয়, প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া ক্লাসিক বাংলা কবিতাকেও পুনর্নির্মাণ করেছেন তিনি৷ 'বীরপুরুষের মা ' এই পুনর্নির্মাণের এক সার্থক উদাহরণ৷ রবীন্দ্রনাথের 'বীরপুরুষ'-এ হিরো ছোট্ট ছেলেটি, সেই কেন্দ্রে, মা মার্জিনে৷ মল্লিকার কবিতায় কিন্ত্ত মার্জিন থেকে কেন্দ্রে এসে দাঁড়ান বীরপুরুষের মা৷ ‘মা’ মল্লিকা লেখেন,
এই রকম পংক্তি রচনার জন্য বাংলা কবিতার মল্লিকা সেনগুপ্তকে, কবি হিসেবে তাঁর সাহস, ধী ও দক্ষতাকে, প্রয়োজন ছিল৷ এভাবেই মল্লিকা সেনগুপ্ত হয়ে ওঠেন সমাজসচেতন এক কবির নাম।'একলা মা আর একলা ছেলে
ডাকাতগুলো দেখতে পেলে
কী হবে বল্ বীরপুরুষ খোকা?
তুই করবি যুদ্ধ, আর আমি রইব বোকা !
স্পষ্ট বলছি তা হবে না আর
তুই ওদের তির ছুঁড়লে আমিও দেব মার৷'
নারীর জড়তা ঝেড়ে তিনি হয়ে ওঠেন কেবলি কবি। কিংবা কথামানবী। পাঠক/ পাঠিকার প্রিয় কবি। আশির দশকের বাংলার আধুনিক কবিতার অন্যতম কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত আজ আর আমাদের মধ্যে নেই । গত ২৮শে মে ২০১১ শনিবার ভোর ৫টা ৪৬ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। কথামানবী না থাকলেও রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টি, তাঁর আধুনিক মেয়েলী চুপকথা থেকে রূপকথার স্মরণিকারা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন