মাতৃভাষার আন্তর্জাতিকতাঃ
UNESCO-র ২১শে ফেব্রুয়ারি উৎযাপন
সায়ন দে
গবেষণা সহায়ক,
ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা
শুরুতেই আমার কয়েকজন বাংলাদেশী বন্ধুর একটা আক্ষেপের কথা বলি যা বোধহয় সকল বাংলাভাষী মানুষেরই আক্ষেপ, তা হল–বাংলাদেশের যে রক্তঝরা ভাষা আন্দোলন ও আত্মবলিদানের ইতিহাসকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রসংঘ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে প্রতিবছর, সেই ইতিহাসকে স্বয়ং রাষ্ট্রসংঘ তথা বাংলার বাইরের মানুষনাকি খুব একটা মনে রাখেনি। কথাটা খুব যে মিথ্যে তা কিন্তু নয়। সংঘের ওয়েবসাইট ও প্রচারপত্রগুলিতে কোথাও ১৯৫২সালের সেই আত্মত্যাগের ইতিহাস বিস্তারিতভাবে বিধৃত নেই। তবে বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখলে দেখা যাবে,এই ইতিহাস বোধহয় বাইরের দেশের কাছে ভিতর থেকে অনুধাবিত হয়েছে ও বিশ্বের কাছে মাতৃভাষার গুরুত্বকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। আর সে কাজে কাণ্ডারি অবশ্যই রাষ্ট্রসংঘ।
এতদিন ধরে অনেক জায়গায়, অসংখ্য লেখায় একুশে আন্দোলন ও ভাষা দিবসের ইতিহাস, গুরুত্ব, ব্যাপ্তি ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানা আঙ্গিকে বহু আলোচনা হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রসংঘ তথা পশ্চিমী দুনিয়া যেভাবে বাংলার ভাষা আন্দোলনের মর্মার্থটাকে বিশ্বের দরবারে প্রয়োগ করেছে, যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে বাংলার সাথে সাথে সকল মাতৃভাষাকে, যেপথে বিশ্বজুড়ে সে আন্দোলন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উৎযাপনের মধ্যে বেঁচে রয়েছে, সে নিয়ে আমরা খুব একটা আলোচনা করিনা সাধারণত। এই কথিকায় আমি তথ্যের আলোকে মূলত রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (UNESCO) কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের ক্রমপর্যায়গুলো তুলে ধরে মাতৃভাষার জন্যে আবদুল, রফিক, বরকত, সালামদের লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক সার্থকতার জায়গাগুলো দেখানোর চেষ্টা করেছি।
একথা বলাই যায়, ১৯৫২র আন্দোলন থেকে ২০০০তে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি - অনেকটা সময় লেগেছিল বিশ্বের কাছে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বকে মেলে ধরতে ও ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। দেশে বিদেশে বেশ কয়েকজন বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা নেতৃদের মিলিত উদ্যোগে রাষ্ট্রসংঘের সংস্থা UNESCO-র অধিবেশনে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর পাশ হয়েছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের ঐতিহাসিক প্রস্তাব যা খোদ পাকিস্তান সহ মোট ১৮৮টি দেশর সমর্থন লাভ করেছিল।আর তারপর ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখটা UNESCOপৃথিবী জুড়ে সকল মাতৃভাষার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুভাষাবাদ(Multilingualism)-এর গুরুত্বকে উৎসাহ দিতে ‘আন্তর্জাতিকমাতৃভাষাদিবস’হিসাবে পালন করে। ভাষা তার ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বিভিন্নতা সত্বেও আন্তর্জাতিক স্তরে মানুষের পরিচিতি, যোগাযোগ, শিক্ষা ও সামাজিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাই রাষ্ট্রসংঘ শুরু থেকেই চেয়েছে ভাষাগত বৈচিত্র্যকে উৎসাহ দিতে। সেখানে একসাথে ইংরাজি ও ফরাসী কাজের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পাশাপাশি চিনা, আরবি, রুশ ও স্পেনীয় ভাষাকেও একযোগে সরকারী ভাষার মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রসংঘ বহুভাষাবাদকে আন্তর্জাতিক সংহতির ধারক-বাহক করে তুলতে সচেষ্ট হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও বহু মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আত্মত্যাগ রাষ্ট্রসংঘকে তার ভাবনার পরিপূরক একটা তাগিদ প্রদান করেছিল, যা রাষ্ট্রভাষার গণ্ডি পেরিয়ে আঞ্চলিক ও মাতৃভাষা বৈচিত্র্যের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঐক্যের দিশারীহয়ে ওঠার স্বপ্ন জাগিয়েছিল সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে।
স্বপ্ন সত্যির পথে UNESCO প্রত্যেক বছর ২১শে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবস উৎযাপনকে হাতিয়ার করে বিশ্বে মাতৃভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝে নিতে চায়। তাদের সামনে উঠে আসে সেই সংক্রান্ত একাধিক সমস্যার কথা যা তারা তাদের সীমানায় দাঁড়িয়েই সমাধানের চেষ্টা করে থাকে। ২০০০ সাল থেকে এই কর্মযজ্ঞ শুরু হবার পর, ২০০২ সালে এক সমীক্ষায় পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৬০০০ মাতৃভাষার মধ্যে ৩০০০এরও বেশি ভাষার বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি এই শ্লোগান তোলা হয় মাতৃভাষা দিবসের দিন – “In the galaxy of languages, every word is a star”. ২০০৩ সালে চতুর্থ মাতৃভাষা দিবস পালন উৎসবে UNESCO মাতৃভাষায় শিক্ষা, প্রচার ও অগ্রগতির জন্যে সকল প্রকার উৎসাহ দানের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। ২০০৪ সালের উৎযাপনে মাতৃভাষায় শিশু শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া হয় ও সংস্থার সকল কার্যালয়গুলোতে আয়োজন করা হয় শিশুদের তাদের বিদ্যালয়ে নিজ মাতৃভাষায় লেখা খাতার অনবদ্য প্রদর্শনী। পরের বছরে এই উৎসবের মূল সুরটাই নিবদ্ধ থাকে দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষদের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ ব্রেল ও নানা সাংকেতিক ভাষার প্রচার ও প্রসারের ওপর।UNESCO, The World Blind UnionওThe World Federation of the Deaf যৌথভাবে আয়োজন করে প্রদর্শনীও। ২০০৬ সালে বিশ্বের প্রায় ৬০০০ ভাষায় কথা বলা ও লেখা মানুষ একযোগে ভাষাগত বিভিন্নতা, বহুভাষাবাদী শিক্ষা ও সাইবার দুনিয়ায় ব্যবহৃত ভাষার প্রয়োগকে সামনে রেখে পালন করে সপ্তম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পরের বছরে, ২০০৭ সালের২১শে ফেব্রুয়ারি উৎসবের থিম ঠিক হয় মাতৃভাষা ও বহুভাষাবাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন। এ বছরেই রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় ২০০৮ সালকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা বর্ষ’ (International Year of Languages) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
'Languages matter'শ্লোগান তুলে UNESCO২০০৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক ভাষা বর্ষ’ তথা মাতৃভাষা দিবস পালন শুরু করে প্যারিসে।সংস্থার প্রধান পরিচালক কইচিরো মাতসুরা বললেন, সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণ হল ভাষা, যা মানুষকে, তার গোষ্ঠী ও ব্যক্তিত্বকে চিনতে শেখায় ও তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ প্রশস্ত করে। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সব শ্রেণিকে এগিয়ে এসে পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষাকে রক্ষা ও বিকশিত করতে হবে। মাতৃভাষার বিপদ বলতে কি বোঝায় তা তথ্যের মাধ্যমে তুলে ধরে বলা হয়, মোট ৭০০০এরও বেশি ভাষার মধ্যে ৯৬% ভাষায় কথা বলেন মোট জনসংখার মাত্র ৪% মানুষ। আর গড়ে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে ভাষা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে, কারণ সেই ভাষায় আর মানুষ কথা বলছেনা। আর এই হারে চলতে থাকলে অচিরেই অর্ধেক মাতৃভাষার অপমৃত্যু ঘটে যাবে অগোচরে। তাই এই বছর মাতৃভাষা বাঁচানোর জন্যে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।এছাড়াও দ্বিভাষা তথা বহুভাষাবাদে সহায়ক এমন শিক্ষা ও সেখানে মাতৃভাষার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ, এ ধরণের শিক্ষার প্রশিক্ষন দান, স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রসার, ভাষাগত বিভক্ত বিভিন্ন এলাকার বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসা, ভাষাগত বাধা অতিক্রম করার জন্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার, অনুবাদ প্রকল্প চালু, দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতিতে দেশীয় ভাষার ভূমিকাকেস্বীকৃতি প্রদান সহ একাধিক অনুষ্ঠান ও কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষাবর্ষ উৎযাপন করা হয়।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উৎসবে UNESCO স্থানীয় ভাষা সংরক্ষণে প্রযুক্তি কতটা সহায়ক হবে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। সঙ্গে সার্বিয়া প্রজাতন্ত্রের কোভাকিকা নামক একটি গ্রামে যেখানে একাধিক সংখ্যালঘু মানুষ বহু ভাষায় কথা বলে, সেখানে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভার এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন সার্বিয়ার সব বিদ্যালয়ে একটা পাঠ মাতৃভাষায় নেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়। মাতৃভাষার বিকাশে এভাবে উৎসাহ প্রদান কর্মসূচীর এখানেই শেষ হয়ে যায়নি।২০১১ সালে UNESCO বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২১শে ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের জন্য একসাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই হিসাবে জিম্বাবয়ে, মরক্ক, কম্বোডিয়া, পর্তুগাল, নেপাল, রাশিয়া, সার্বিয়া প্রভৃতি একাধিক এলাকায় নানান কর্মশালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। এ বছরের থিম ছিলঃ ভাষা ও ভাষাগত বৈচিত্র্য প্রসারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার। ২০১২ সালে আরও বিস্তৃত ভাবে মাতৃভাষার গুরুত্বকে সামনে আনতে থিম ঠিক করা হয়- “Mother tongue instruction and inclusive education”. UNESCOবিশেষ ভাবে শিক্ষার অধিকারের অংশ হিসেবে মাতৃভাষার উপযোগিতা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও বেশি করে মাতৃভাষার প্রয়োগকে জোর দেয় এই বছর। ২০১৩ সালে চতুর্দশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস গোটা বিশ্বের সঙ্গে UNESCO তেও পালিত হয় মহা সমারোহে। থিম ছিল-‘স্থানীয় ভাষায় পুস্তক ও ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার’। আঞ্চলিক স্তরে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় তথা প্রচারমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে মাতৃভাষার গরিমাকে সুদৃঢ় ভাবে উদ্ভাসিত করার কাজে কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণের চেষ্টা করা হয় এবার।‘Books for Mother tongue education’ শ্লোগান তুলে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রসারের তাগিদে আঞ্চলিক ভাষায় পুস্তক যোগানের গুরুত্বকে সামনের সারিতে রেখে শেষ হয় এ বছরের কর্মসূচী।এ বছর ভারতের পাঞ্জাবী ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ২০১৪ সালেও নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে এই দিনটি পালিত হবার কথা, যেখানে তুর্কি মাতৃভাষা দিবস পালনেরও পরিকল্পনা রয়েছে। প্রত্যেক বছরের বিশেষ পদক্ষেপের সঙ্গে নিয়মিত ভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষাবাদের ওপর অবদানের নিরিখে প্রদান করা হয় লিঙ্গুয়াপ্যাক্স পুরস্কার। ২০১১ সালে এই পুরস্কারে ভূষিত হন এদেশের উপজাতি ভাষা ও লৌকিক ঐতিহ্য চর্চায় নিয়োজিত প্রাণ গুজরাত নিবাসী গণেশ এন. দেবী।
এই ভাবে বছরের পর বছর UNESCOতার নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রধান ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষাকে প্রান্তিক অবস্থা থেকে সামনের সারিতে আনার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই সকল উদ্যোগ ঠিক কতটা কার্যকর হয়েছে বা হচ্ছে সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। তবে মাতৃভাষার ওপর গুরুত্ব আরোপ ও তার ব্যবহারের সপক্ষে সচেতনতা বৃদ্ধির মাত্রা রাষ্ট্রসংঘের তরফ থেকে দিন দিন যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তাতে আশার আলো দেখতেই পারি আমরা। আর সেই সঙ্গে এই গর্বও অনুভব করতে পারি, ১৯৫২ সালের সেই রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস পৃথিবী ভুলে যায়নি, বরং সেই ইতিহাস UNESCO-র হাত ধরে আন্তর্জাতিক স্তরে মাতৃভাষার তাৎপর্যকে কুর্নিশকরবার পথ দেখিয়ে চলেছে আজও।
1 কমেন্টস্:
lekha ti select korbar jonnyo many many thanks.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন