ফেয়ারওয়েল - গী দ্য মোপাসাঁ
মূল নামঃ গী দ্য মোপাসাঁ ছদ্ম নামঃ জোসেফ প্রুনিয়ের, গী দ্য ভলম্যান্ট, মফ্রিনিউস ইত্যাদি।
জন্মঃ ৫ই অগাস্ট ১৮৫০, শাতো দে মেরোমেসনিল, ফ্রান্স ,প্রতিভাবান এই লেখক ৬ই জুলাই ১৮৯৩ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্যাসি, ফ্রান্সে আত্মহত্যা করেন।
অনুবাদক - মৌ দাশগুপ্তা
দুই বন্ধুর রাতের খাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো ততক্ষণে। রেস্তোরাঁর কাঁচের জানালা দিয়ে তারা দেখতে পাচ্ছিলো বাইরের রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা, জনসমাগম। প্যারিস শহরের কোনও এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাস এসে আলতো পরশ বোলাচ্ছিলো তাদের গায়ে। এমন সন্ধ্যায় মন চায় লাগমাড়া আনন্দে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়াতে গাছের তলায় কিংবা নদীতীরে চাঁদের আলোয় বসে ফড়িং, ঘাসপোকা আর লার্ক পাখির সাথে সময় কাটাতে …
দুই বন্ধুর একজন, হেনরী সিমন,(বছর পঁয়তাল্লিশেক বয়স,একমাথা টাক এবং ভারী স্বাস্থ্য ), বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি যেন ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো---
- “নাহ...পিয়েরে, বুঝলে দিনদিন কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কি দুঃখের ব্যাপার বলো দেখি। আগে এমন আনন্দময় সন্ধ্যায় নিজেকে আমার কত চনমনে মনে হতো, অথচ এখন, কেন যেন নিজেকে বড্ড বুড়োটে লাগে। ...আমাদের জীবনটা আসলে খুবই ছোট”!
অপর বন্ধুটি- পিয়েরে গার্নিয়ার, সে ছিলো বয়সে কিছু বড় কিন্তু চেহারায় অনেকটা রোগাপাতলা এবং তুলনামূলক ঝকঝকে চেহারার। সে অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিলোঃ
- “দ্যাখো ভাই, বয়স তো আমারও হয়েছে কিন্তু নিজে সেটা বুঝতেই পারিনি।তুমি তো জানো, আমি চিরকালই বেশ হাসিখুশি, ছটফটে বিন্দাস স্বভাবের ছিলাম। মানুষ প্রত্যেক দিন নিজেকে আয়নায় দ্যাখে তো, তাই নিজের চেহারার পরিবর্তনটা সে চট করে ধরতে পারে না--- কারণ এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটা প্রতিদিন, ২৪ ঘন্টা ধরেই হয়,কিন্তু খুব ধীর গতিতে। যদি নেহাতই কেউ টের পেতে চায় তাহলে তাকে অন্তত পাক্কা ৬ মাস আয়নার দিকে তাকানো বন্ধ করে দিতে হবে। তারপর যেদিন আয়নার সামনে দাঁড়াবে সেদিন... ওহ, সে এক নাটক হবে বটে! এই মেয়েদের কথাই ভাবো না একবার। কি কাঁদোকাঁদো দশা হবে তখন এদের! মেয়েদের তো আবার সব আনন্দ, ক্ষমতা এবং মনোযোগের উৎস হলো তাদের রূপ, সারাটা জীবন এদের শুধু কাটে নিজের রূপের চিন্তা করে, অথচ তাদের রূপ সাকূল্যে টেঁকে কতদিন বলো ? ৫ বছর? ১০ বছর, ? তো যেমনটি বলছিলাম , আমি বুড়ো হয়েছি নিজেও বুঝতে পারিনি, ৫০বছরেও আমি নিজেকে যুবকই ভাবতাম। কিন্তু সত্যি যখন বুড়ো হয়ে যাওয়ার উপলব্ধিটা হলো, আমি প্রায় ৬ মাস সেই ভয়ঙ্কর বোধটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।আসলে উপলব্ধিটাই হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। ব্যাপারটা তাহলে তোমায় খুলেই বলি।
হেনরী সিমন আগ্রহভরে ঝুঁকে এলো টেবিলের ওপর।পিয়েরে গার্নিয়ার, পানর গ্লাসটা শেষ রে চেয়রে হেলান দিয়ে মোটা চুরুটটা জ্বালাতে একটু সময় নিল, হয়ত গল্পটা বলার মত করে কথাগুলোকে সাজিয়ে নিলো, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে কড়িকাঠের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে ছড়তে গল্প বলার ভঙ্গীতে মৃদু স্বরে বলতে থাকলোঃ
- আর দশটা পুরুষ মানুষের মত আমিও প্রেমে পড়েছি। সত্যি বলতে কি, পড়েছি তো অনেকবারই কিন্তু তার মধ্যে একটাই সত্যিকারের প্রেমে পড়া। ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ ইত্রেতাত নামক এক সমুদ্রতীরে, সেও ধরো প্রায় বছর বারো আগের কথা।
জায়গাটা ছোটখাট, আকারে খানিকটা ঘোড়ার খুরের মত, চারদিকে ছোটবড় পাহাড়ে ঘেরা, সে পাহাড়গুলো আবার রহস্যময় গুহামুখে ঠাসা থাকতো। দুটো বড়ো পাহাড় ছিলো সেখানে, তার মধ্যে একটা অনেকখানি লম্বা হয়ে সমুদ্রের ভেতরে চলে এসেছিলো , আরেকটা ছিলো অনেক নিরেট ধরণের কিন্তু বালিয়াড়ী পেড়িয়ে বেশীদূর এগোয়নি। মহিলারা সকালে স্নানের সময়ে বড় বড় উঁচু উঁচু পাথরের খাঁজে , রং বেরংয়ের ছাতার তলায় , বালুবেলায়, জলের নাগাল বাঁচিয়ে তাদের নানা রঙের স্নানের পোশাকগুলো রঙীন ফুলের মত করে সাজিয়ে রাখতো। যখন প্রখর রোদ এসে সমুদ্রের নীল-সবুজ জলে ঝিকমিক করে উঠতো , প্রকৃতি ও যেন হেসে উঠতো আপনমনে। স্নানের রোব পরে মেয়েরা একে একে আসতো, তারপর জলে নেমে ঠিক ঢেউয়ের ফেনার কাছাকাছি এসে আলতো করে সেটা খুলে ছুঁড়ে দিতো... তারপর ছোট ছোট পা ফেলে সমুদ্রের জল ছুঁয়ে খানিকটা দৌড়ে যেতো , কিছুক্ষণ জলের সাথে খেলা করে তারপর ফিরে আসতো হাঁপাতে হাঁপাতে। একা একা জলের ধারে বসে আপনমনে স্নানরতাদের দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। সেই ভীড়েই ওকে প্রথম দেখি।
বুঝলে হেনরী, প্রথম যখন সেই সুযৌবনা মেয়েটিকে আমি জলের মধ্যে দেখলাম, আমার এত তীব্র একটা ভালোলাগার অনুভব হল যে আশেপশের বাকি সব স্বল্পবেশী সুন্দরীরা যেন ম্রিয়মান হয়ে গেল। মৎসকন্যার মত ওর জলের সাথে মাতামাতি দেখতে দেখতে কি যে এক আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিলো যে কি বলবো,... আমি তো একেবারে যাকে বলে কিনা বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে একসময় তার সাথে আমার পরিচয় হলো, আর পরিচয় হওয়ার পরেই আমি ওর প্রেমে একদম ঘাড় মুচড়ে পড়লাম। এমন বেহাল দশা তাও একটা বিবাহিত মহিলার জন্য আমার আগে আর কখনও হয়নি! সকাল হলেই আমার মনটা একটি বার ওকে দেখতে কি কথা বলতে বড় ছটফট করতো। এভাবে দাসনুদাসের মত একজন রমণীর বশ্যতা স্বীকার করার অনুভূতিটা খুব বেদনাদায়ক তো বটেই তবে আবার ভালোও লাগতো। ওর মাখনরঙা শরীর, নীল চোখ,ওর কাঁচভাঙা খিলখিলে হাসি, হাওয়ায় ওড়া সোনালী চুল, এমনকি ওর শরীরটার সামান্যতমও বিভঙ্গও আমাকে এক অনির্বচনীয় আনন্দ দিতো, আমাকে যেন পাগল করে দিতো, আমার ভেতরটা কেমন যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগার সম্মোহনে ছেয়ে ফেলতো।ওর অঙ্গভঙ্গী, ওর হাঁটাচলা,কথাবলা, ওর অপাঙ্গে মুচকি হেসে তাকানো, এমনকি ওর পোশাকগুলোও, যেন আমাকে প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলছিলো। ওর মাথার স্কার্ফ, হাতের গ্লাভস, গাউন,মাথার টুপি সব মিলেমিশে এক নতুন নেশায় ভরিয়ে তুলেছিল আমায়। মোহাবিষ্টের মত আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।এর আগে যেন কোনও মহিলার রূপ-রঙ-শালীনতা-মেধা-লাবণ্য-সৌন্দর্য- কমনীয়তা-বুদ্ধিমত্তা একই সাথে এত গভীরভাবে আমায় নাড়া দিয়ে যায় নি।এর আগে কখনও কোন মেয়ের গালের টোল, কমলালেবুর মত ঈর্ষনীয় নরম ঠোঁটের ওঠানামা, ফরসা কানের লতির গোলাপি আভা, বাঁশীর মত নাকের সামান্য একটা ভাঁজ, কপালের পাশে সোনালী চুলের গোছা আমাকে এমন মাতাল করে দেয়নি।
সে বিবাহিতা ছিলো,ছুটি কাটাচ্ছিলো বান্ধবীদের সাথে। তবে ওর স্বামী শুধুমাত্র শনিবারে আসতো আবার সোমবারেই চলে যেতো। জানি না কেন ওই উদ্ভুটে লোকটার ওপর আমার এুকুও হিংসা হতো না। ভগবানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে নিজের করে পেয়েও হেলায় হারানোর জন্য লোকটাকে খানিকটা করুণাই করতাম। কেমন হীন, ভাগ্যহত বলে মনে হতো। আর তার চুলবুলে বউটাকে আমি কি পাগলের মত ভালোই না বাসতাম! আমার কাছে ও ছিলো ঠিক সৌন্দর্যের দেবী, কামদেবীর মূর্ত প্রতিভূ। । এমনি ভাবে কোথা দয়ে যে তিন তিনটে মাস কেটে গেলো বুঝতেই পারিনি। আমার ছুটীর মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। চাকরী তো আর ছাড়া সম্ভব নয়, রুটিরুজির ব্যাপার, অতএব আমার মনহারিনীকে ছেড়ে আমাকে বিষাদক্লান্ত হৃদয়ে, ভারাক্রান্ত মনে পাড়ি দিতে হলো সুদূর আমেরিকার উদ্দেশ্যে। চলে এলাম ঠিকই কিন্তু তার স্মৃতি আমার হৃদয়ে পাকাপাকিভাবে বাসা বেঁধেনিলো। বছরের পর বছর কেটে গেলো, তবু আমি তাকে একটুও ভুলতে পারলাম না। ওর সেই অসাধারণ রূপের ছটা, তীব্র রসবোধ, কিশোরীসুলভ অভিমানী ভালোবাসা যেন আমার চোখের এবং মনের পরিসরে চিরকালের মত আসন করে নিয়েছিলো। কত মেয়েই তো এলো,গেলো, আমার জীবনে কিন্তু ওর মত দ্বিতীয় কাউকে পেলাম না যাকে মনের মানুষ ভেবে ভালবাসায় সোহাগে আদরে ভরিয়ে দিতে পারি। ১২ বছর মোটেও এমন কোনও দীর্ঘ সময় নয়। মানুষ চট করে বুঝতেও পারে না যে কোথা দিয়ে এতটা সময় চলে গেলো। সত্যিই আমার একেকসময় মনে হতো যেন ১২ বছর নয়, ইত্রেতাতের সেই মায়াবী সোনালী বালুতট যেন আমি ছেড়ে এসেছি মাত্র কয়েক মাস হলো। এরপর শোনো আসল কাহিনী, এই গেলো বসন্তে কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে মেজোঁ-লাফিত এ খাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। তো ট্রেনে চড়েছি, ঠিক ট্রেনটা ছাড়বে ছাড়বে করছে তখন একজন মোটাসোটা লালমুখের স্থূলকায়া মহিলা চারটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমার বগিতে হাঁপাতে হাঁপাতে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো। স্বভাবতই আমি মহিলার মুখের দিকে একবার তাকালাম, ইয়া বড় চাঁদপানা মুখ, বড় সাইজের তরমুজের মত মাথাটকে বহু কষ্টে একটা রিবনওয়ালা টুপির মধ্যে সেঁধানো হয়েছে। বেচারী হাসফাঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো, তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠতে গিয়ে তার প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসার মত অবস্থা।চোখমুখ টকটকে লাল। চর্বির ভারে দরদর করে ঘামছে। মহিলাটি ধপাস করে জানলার ধারে বসে পড়ে খাবি খাওয়া মাছের মত গোল মুখ করে শ্বাস নিতে লাগলো, সঙ্গের বাচ্চাগুলো কলকলিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করলো। আমি বিরক্তমুখে খবরের কাগজটা খুলে পড়তে লাগলাম।খেয়াল করলাম মহিলাটি বারবার আড়চোখে আমার দিকে দেখছেন কিন্তু আমি সেই বিগতযৌবনার মধ্যে মহিলাসুলভ কোন কমনীয়তা, সৌন্দর্য বা যৌন আকর্ষন পেলামনা যে দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখবো। অতএব নিপাট ভদ্রলোকের মত মুখের সামনে খবরের কাগজটা তুলে ধরে পড়ার ভান করতে লাগলাম। অ্যাসনিয়েরেস পার হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ আমার সেই প্রতিবেশিনী আমার দিকে ফিরে বললেন
- যদি কিছু মনে না করেন... আপনি... মঁসিয়ে গার্নিয়ের নন?
অবাক হয়ে বললাম,
- হ্যাঁ, আমিই।
আমার কথা শুনে সে হেসে ফেললো। আনন্দের হাসি নয়, ক্লান্ত বিষণ্ণ হাসি।
- তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারোনি! ...
আমার একটু সংকোচ হচ্ছিলো। মুখখানা এতোক্ষনে বেশ খানিকটা চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো, নীল চোখ, কমলা ঠোঁট, কিন্তু কবে দেখেছি বা কোথায় দেখেছি কিছুই মনে করতে পারছিলাম না।তাই উত্তর দিলামঃ
- হ্যাঁ, মানে... না... আমি আপনাকে দেখেছি নিশ্চয়ই... কিন্তু নামটা ঠিক... মনে করতে পারছি না।
সে একটু লজ্জা পেয়ে বললো
- আমি মিসেস জুলি লেফেরে!
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এই কিনা সে! মোটাসোটা লালমুখের বেঢপ দেহের স্থূলকায়া মহিলা ! শেষবার যখন আমি তাকে দেখি তখনও সে মা হয়নি। ছিপছিপে চুলবুলী তন্বী তরুনী , এখন চার চারটি বাচ্চার মা, বাচ্চাগুলোও বেশ বড় হয়ে গেছে এতদিনে।তার সেই উষ্ণদেশীয় কোমল সৌন্দর্য আর কিশোরীসুলভ কমনীয়তার ছিঁটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই এখন। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো যেন এই তো গতকালই আমি তাকে দেখেছি আর আজ আবার দেখছি, অথচ এত পার্থক্য! এও কি সম্ভব! হতবিহবল হয়ে আমি আবার তাকালাম ওর দিকে। নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে এলো আমার। আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া দিন, সেই ফুরিয়ে যাওয়া যৌবনের জন্য কান্না পাচ্ছিল আমার। শুধু মনে হচ্ছিলো এই ফ্সীতকায়া বেপথু মহিলাটিকে আমি চিনি না। সেও কেমন স্তম্ভিত ভঙ্গীতে আমার মাথা থেকে পা অবধি বারবার দেখছিল। একসময় জলভরা বিষণ্ণ চোখে একটু থেমে থেমে বললোঃ
- আমি একেবারে বদলে গেছি, না? কি আর বলি তোমায়, সবকিছুরই একটা সময় থাকে, তাই না, বলো? তুমি যখন আমায় চিনতে তখন আমি সদ্যতরুনী,বিবাহিত কিন্তু বউ-বউ ভাবটাও আসেনি তখন, আজ দ্যাখো, আমি মা হয়েছি...শুধু একজন ভালো মা! আর যা কিছু ছিলো আমার জীবনে তার সবকিছুকে বিদায় জানিয়েছি। তবু তোমায় কিন্তু ভুলতে পারিনি। কোনদিন ভাবিই নি, আমাদের এভাবে আবার দেখা হবে, ওহ... আমিই ভুল ভেবেছিলাম যে এতবছর পরও তুমি আমাকে দেখলেই চিনতে পারবে। তুমিও তো অনেক বদলে গেছো। এটা সত্যিই তুমি কিনা, আমার কোনও ভুল হচ্ছে কিনা সেটা ধরতেই আমার অনেক সময় লেগে গেছে। তোমার চুলও তো অনেক পেকে গেছে! খয়েরী গোঁফেও পাকা চুলই বেশী দেখা যাচ্ছে, চিবুকে দুই থাক ভাঁজ এসেছে, গায়ের রঙটাও রোদে পুড়ে তামাটে, মুখে বলীরেখা দেখা দিচ্ছে, আসলে ১২টা বছর হরিয়ে গেছে জীবন থেকে ... ভেবে দ্যাখো, ১২ বছর! আমার বড় মেয়েটার বয়সই এখন ১০!
আমি ওর বড় মেয়েটার দিকে তাকালাম। তার মধ্যে আমি তার মায়ের সেই সৌন্দর্যের কিছু ছোঁয়া খুঁজে পেলাম কিন্তু তখনও সেই সৌন্দর্যের মধ্যে খানিকটা বালিকাসুলভ অপূর্ণতা ছিলো, জীবনটা আমার কাছে জোর গতিতে ছুটে চলা একটা ট্রেনের মতই মনে হচ্ছিলো তখন। ততক্ষণে আমরা মেজোঁ-লাফিত এ পৌঁছে গেছি। আমি আমার সেই পুরনো বান্ধবীটির হাতে চুমু খেলাম আলতো ভাবে, কিন্তু কোন কথা বলতে পারলাম না। আসলে সেই মুহূর্তে আমি আমার কথা বলার শক্তিই প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম।তারপর অনেক রাতে, নিজের ঘরে ফিরে, শোবার ঘরের পূর্নদৈর্ঘ্যের আয়নাটার সামনে দাঁড়ালাম।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজেকে। সাইডটেবিলে রাখা আমার অল্পবয়সের ছবিটার দিকে নজর গেলো। তখনই আবিষ্কার করলাম আমি ঠিক কতটা বদলে গেছি, কতোটা সময়ের ছাপ পড়েছে আমার শরীরে, কতোটা বুড়ো হয়ে গেছি আমি। বুঝলাম আমার যুবাকালের সময়, আমার যৌবন আমাকে বিদায় জানিয়েছে।
মূল নামঃ গী দ্য মোপাসাঁ ছদ্ম নামঃ জোসেফ প্রুনিয়ের, গী দ্য ভলম্যান্ট, মফ্রিনিউস ইত্যাদি।
জন্মঃ ৫ই অগাস্ট ১৮৫০, শাতো দে মেরোমেসনিল, ফ্রান্স ,প্রতিভাবান এই লেখক ৬ই জুলাই ১৮৯৩ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্যাসি, ফ্রান্সে আত্মহত্যা করেন।
অনুবাদক - মৌ দাশগুপ্তা
দুই বন্ধুর রাতের খাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো ততক্ষণে। রেস্তোরাঁর কাঁচের জানালা দিয়ে তারা দেখতে পাচ্ছিলো বাইরের রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা, জনসমাগম। প্যারিস শহরের কোনও এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাস এসে আলতো পরশ বোলাচ্ছিলো তাদের গায়ে। এমন সন্ধ্যায় মন চায় লাগমাড়া আনন্দে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়াতে গাছের তলায় কিংবা নদীতীরে চাঁদের আলোয় বসে ফড়িং, ঘাসপোকা আর লার্ক পাখির সাথে সময় কাটাতে …
দুই বন্ধুর একজন, হেনরী সিমন,(বছর পঁয়তাল্লিশেক বয়স,একমাথা টাক এবং ভারী স্বাস্থ্য ), বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি যেন ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো---
- “নাহ...পিয়েরে, বুঝলে দিনদিন কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কি দুঃখের ব্যাপার বলো দেখি। আগে এমন আনন্দময় সন্ধ্যায় নিজেকে আমার কত চনমনে মনে হতো, অথচ এখন, কেন যেন নিজেকে বড্ড বুড়োটে লাগে। ...আমাদের জীবনটা আসলে খুবই ছোট”!
অপর বন্ধুটি- পিয়েরে গার্নিয়ার, সে ছিলো বয়সে কিছু বড় কিন্তু চেহারায় অনেকটা রোগাপাতলা এবং তুলনামূলক ঝকঝকে চেহারার। সে অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিলোঃ
- “দ্যাখো ভাই, বয়স তো আমারও হয়েছে কিন্তু নিজে সেটা বুঝতেই পারিনি।তুমি তো জানো, আমি চিরকালই বেশ হাসিখুশি, ছটফটে বিন্দাস স্বভাবের ছিলাম। মানুষ প্রত্যেক দিন নিজেকে আয়নায় দ্যাখে তো, তাই নিজের চেহারার পরিবর্তনটা সে চট করে ধরতে পারে না--- কারণ এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটা প্রতিদিন, ২৪ ঘন্টা ধরেই হয়,কিন্তু খুব ধীর গতিতে। যদি নেহাতই কেউ টের পেতে চায় তাহলে তাকে অন্তত পাক্কা ৬ মাস আয়নার দিকে তাকানো বন্ধ করে দিতে হবে। তারপর যেদিন আয়নার সামনে দাঁড়াবে সেদিন... ওহ, সে এক নাটক হবে বটে! এই মেয়েদের কথাই ভাবো না একবার। কি কাঁদোকাঁদো দশা হবে তখন এদের! মেয়েদের তো আবার সব আনন্দ, ক্ষমতা এবং মনোযোগের উৎস হলো তাদের রূপ, সারাটা জীবন এদের শুধু কাটে নিজের রূপের চিন্তা করে, অথচ তাদের রূপ সাকূল্যে টেঁকে কতদিন বলো ? ৫ বছর? ১০ বছর, ? তো যেমনটি বলছিলাম , আমি বুড়ো হয়েছি নিজেও বুঝতে পারিনি, ৫০বছরেও আমি নিজেকে যুবকই ভাবতাম। কিন্তু সত্যি যখন বুড়ো হয়ে যাওয়ার উপলব্ধিটা হলো, আমি প্রায় ৬ মাস সেই ভয়ঙ্কর বোধটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।আসলে উপলব্ধিটাই হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। ব্যাপারটা তাহলে তোমায় খুলেই বলি।
হেনরী সিমন আগ্রহভরে ঝুঁকে এলো টেবিলের ওপর।পিয়েরে গার্নিয়ার, পানর গ্লাসটা শেষ রে চেয়রে হেলান দিয়ে মোটা চুরুটটা জ্বালাতে একটু সময় নিল, হয়ত গল্পটা বলার মত করে কথাগুলোকে সাজিয়ে নিলো, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে কড়িকাঠের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে ছড়তে গল্প বলার ভঙ্গীতে মৃদু স্বরে বলতে থাকলোঃ
- আর দশটা পুরুষ মানুষের মত আমিও প্রেমে পড়েছি। সত্যি বলতে কি, পড়েছি তো অনেকবারই কিন্তু তার মধ্যে একটাই সত্যিকারের প্রেমে পড়া। ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ ইত্রেতাত নামক এক সমুদ্রতীরে, সেও ধরো প্রায় বছর বারো আগের কথা।
জায়গাটা ছোটখাট, আকারে খানিকটা ঘোড়ার খুরের মত, চারদিকে ছোটবড় পাহাড়ে ঘেরা, সে পাহাড়গুলো আবার রহস্যময় গুহামুখে ঠাসা থাকতো। দুটো বড়ো পাহাড় ছিলো সেখানে, তার মধ্যে একটা অনেকখানি লম্বা হয়ে সমুদ্রের ভেতরে চলে এসেছিলো , আরেকটা ছিলো অনেক নিরেট ধরণের কিন্তু বালিয়াড়ী পেড়িয়ে বেশীদূর এগোয়নি। মহিলারা সকালে স্নানের সময়ে বড় বড় উঁচু উঁচু পাথরের খাঁজে , রং বেরংয়ের ছাতার তলায় , বালুবেলায়, জলের নাগাল বাঁচিয়ে তাদের নানা রঙের স্নানের পোশাকগুলো রঙীন ফুলের মত করে সাজিয়ে রাখতো। যখন প্রখর রোদ এসে সমুদ্রের নীল-সবুজ জলে ঝিকমিক করে উঠতো , প্রকৃতি ও যেন হেসে উঠতো আপনমনে। স্নানের রোব পরে মেয়েরা একে একে আসতো, তারপর জলে নেমে ঠিক ঢেউয়ের ফেনার কাছাকাছি এসে আলতো করে সেটা খুলে ছুঁড়ে দিতো... তারপর ছোট ছোট পা ফেলে সমুদ্রের জল ছুঁয়ে খানিকটা দৌড়ে যেতো , কিছুক্ষণ জলের সাথে খেলা করে তারপর ফিরে আসতো হাঁপাতে হাঁপাতে। একা একা জলের ধারে বসে আপনমনে স্নানরতাদের দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। সেই ভীড়েই ওকে প্রথম দেখি।
বুঝলে হেনরী, প্রথম যখন সেই সুযৌবনা মেয়েটিকে আমি জলের মধ্যে দেখলাম, আমার এত তীব্র একটা ভালোলাগার অনুভব হল যে আশেপশের বাকি সব স্বল্পবেশী সুন্দরীরা যেন ম্রিয়মান হয়ে গেল। মৎসকন্যার মত ওর জলের সাথে মাতামাতি দেখতে দেখতে কি যে এক আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিলো যে কি বলবো,... আমি তো একেবারে যাকে বলে কিনা বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে একসময় তার সাথে আমার পরিচয় হলো, আর পরিচয় হওয়ার পরেই আমি ওর প্রেমে একদম ঘাড় মুচড়ে পড়লাম। এমন বেহাল দশা তাও একটা বিবাহিত মহিলার জন্য আমার আগে আর কখনও হয়নি! সকাল হলেই আমার মনটা একটি বার ওকে দেখতে কি কথা বলতে বড় ছটফট করতো। এভাবে দাসনুদাসের মত একজন রমণীর বশ্যতা স্বীকার করার অনুভূতিটা খুব বেদনাদায়ক তো বটেই তবে আবার ভালোও লাগতো। ওর মাখনরঙা শরীর, নীল চোখ,ওর কাঁচভাঙা খিলখিলে হাসি, হাওয়ায় ওড়া সোনালী চুল, এমনকি ওর শরীরটার সামান্যতমও বিভঙ্গও আমাকে এক অনির্বচনীয় আনন্দ দিতো, আমাকে যেন পাগল করে দিতো, আমার ভেতরটা কেমন যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগার সম্মোহনে ছেয়ে ফেলতো।ওর অঙ্গভঙ্গী, ওর হাঁটাচলা,কথাবলা, ওর অপাঙ্গে মুচকি হেসে তাকানো, এমনকি ওর পোশাকগুলোও, যেন আমাকে প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলছিলো। ওর মাথার স্কার্ফ, হাতের গ্লাভস, গাউন,মাথার টুপি সব মিলেমিশে এক নতুন নেশায় ভরিয়ে তুলেছিল আমায়। মোহাবিষ্টের মত আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।এর আগে যেন কোনও মহিলার রূপ-রঙ-শালীনতা-মেধা-লাবণ্য-সৌন্দর্য- কমনীয়তা-বুদ্ধিমত্তা একই সাথে এত গভীরভাবে আমায় নাড়া দিয়ে যায় নি।এর আগে কখনও কোন মেয়ের গালের টোল, কমলালেবুর মত ঈর্ষনীয় নরম ঠোঁটের ওঠানামা, ফরসা কানের লতির গোলাপি আভা, বাঁশীর মত নাকের সামান্য একটা ভাঁজ, কপালের পাশে সোনালী চুলের গোছা আমাকে এমন মাতাল করে দেয়নি।
সে বিবাহিতা ছিলো,ছুটি কাটাচ্ছিলো বান্ধবীদের সাথে। তবে ওর স্বামী শুধুমাত্র শনিবারে আসতো আবার সোমবারেই চলে যেতো। জানি না কেন ওই উদ্ভুটে লোকটার ওপর আমার এুকুও হিংসা হতো না। ভগবানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে নিজের করে পেয়েও হেলায় হারানোর জন্য লোকটাকে খানিকটা করুণাই করতাম। কেমন হীন, ভাগ্যহত বলে মনে হতো। আর তার চুলবুলে বউটাকে আমি কি পাগলের মত ভালোই না বাসতাম! আমার কাছে ও ছিলো ঠিক সৌন্দর্যের দেবী, কামদেবীর মূর্ত প্রতিভূ। । এমনি ভাবে কোথা দয়ে যে তিন তিনটে মাস কেটে গেলো বুঝতেই পারিনি। আমার ছুটীর মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। চাকরী তো আর ছাড়া সম্ভব নয়, রুটিরুজির ব্যাপার, অতএব আমার মনহারিনীকে ছেড়ে আমাকে বিষাদক্লান্ত হৃদয়ে, ভারাক্রান্ত মনে পাড়ি দিতে হলো সুদূর আমেরিকার উদ্দেশ্যে। চলে এলাম ঠিকই কিন্তু তার স্মৃতি আমার হৃদয়ে পাকাপাকিভাবে বাসা বেঁধেনিলো। বছরের পর বছর কেটে গেলো, তবু আমি তাকে একটুও ভুলতে পারলাম না। ওর সেই অসাধারণ রূপের ছটা, তীব্র রসবোধ, কিশোরীসুলভ অভিমানী ভালোবাসা যেন আমার চোখের এবং মনের পরিসরে চিরকালের মত আসন করে নিয়েছিলো। কত মেয়েই তো এলো,গেলো, আমার জীবনে কিন্তু ওর মত দ্বিতীয় কাউকে পেলাম না যাকে মনের মানুষ ভেবে ভালবাসায় সোহাগে আদরে ভরিয়ে দিতে পারি। ১২ বছর মোটেও এমন কোনও দীর্ঘ সময় নয়। মানুষ চট করে বুঝতেও পারে না যে কোথা দিয়ে এতটা সময় চলে গেলো। সত্যিই আমার একেকসময় মনে হতো যেন ১২ বছর নয়, ইত্রেতাতের সেই মায়াবী সোনালী বালুতট যেন আমি ছেড়ে এসেছি মাত্র কয়েক মাস হলো। এরপর শোনো আসল কাহিনী, এই গেলো বসন্তে কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে মেজোঁ-লাফিত এ খাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। তো ট্রেনে চড়েছি, ঠিক ট্রেনটা ছাড়বে ছাড়বে করছে তখন একজন মোটাসোটা লালমুখের স্থূলকায়া মহিলা চারটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমার বগিতে হাঁপাতে হাঁপাতে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো। স্বভাবতই আমি মহিলার মুখের দিকে একবার তাকালাম, ইয়া বড় চাঁদপানা মুখ, বড় সাইজের তরমুজের মত মাথাটকে বহু কষ্টে একটা রিবনওয়ালা টুপির মধ্যে সেঁধানো হয়েছে। বেচারী হাসফাঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো, তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠতে গিয়ে তার প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসার মত অবস্থা।চোখমুখ টকটকে লাল। চর্বির ভারে দরদর করে ঘামছে। মহিলাটি ধপাস করে জানলার ধারে বসে পড়ে খাবি খাওয়া মাছের মত গোল মুখ করে শ্বাস নিতে লাগলো, সঙ্গের বাচ্চাগুলো কলকলিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করলো। আমি বিরক্তমুখে খবরের কাগজটা খুলে পড়তে লাগলাম।খেয়াল করলাম মহিলাটি বারবার আড়চোখে আমার দিকে দেখছেন কিন্তু আমি সেই বিগতযৌবনার মধ্যে মহিলাসুলভ কোন কমনীয়তা, সৌন্দর্য বা যৌন আকর্ষন পেলামনা যে দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখবো। অতএব নিপাট ভদ্রলোকের মত মুখের সামনে খবরের কাগজটা তুলে ধরে পড়ার ভান করতে লাগলাম। অ্যাসনিয়েরেস পার হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ আমার সেই প্রতিবেশিনী আমার দিকে ফিরে বললেন
- যদি কিছু মনে না করেন... আপনি... মঁসিয়ে গার্নিয়ের নন?
অবাক হয়ে বললাম,
- হ্যাঁ, আমিই।
আমার কথা শুনে সে হেসে ফেললো। আনন্দের হাসি নয়, ক্লান্ত বিষণ্ণ হাসি।
- তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারোনি! ...
আমার একটু সংকোচ হচ্ছিলো। মুখখানা এতোক্ষনে বেশ খানিকটা চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো, নীল চোখ, কমলা ঠোঁট, কিন্তু কবে দেখেছি বা কোথায় দেখেছি কিছুই মনে করতে পারছিলাম না।তাই উত্তর দিলামঃ
- হ্যাঁ, মানে... না... আমি আপনাকে দেখেছি নিশ্চয়ই... কিন্তু নামটা ঠিক... মনে করতে পারছি না।
সে একটু লজ্জা পেয়ে বললো
- আমি মিসেস জুলি লেফেরে!
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এই কিনা সে! মোটাসোটা লালমুখের বেঢপ দেহের স্থূলকায়া মহিলা ! শেষবার যখন আমি তাকে দেখি তখনও সে মা হয়নি। ছিপছিপে চুলবুলী তন্বী তরুনী , এখন চার চারটি বাচ্চার মা, বাচ্চাগুলোও বেশ বড় হয়ে গেছে এতদিনে।তার সেই উষ্ণদেশীয় কোমল সৌন্দর্য আর কিশোরীসুলভ কমনীয়তার ছিঁটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই এখন। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো যেন এই তো গতকালই আমি তাকে দেখেছি আর আজ আবার দেখছি, অথচ এত পার্থক্য! এও কি সম্ভব! হতবিহবল হয়ে আমি আবার তাকালাম ওর দিকে। নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে এলো আমার। আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া দিন, সেই ফুরিয়ে যাওয়া যৌবনের জন্য কান্না পাচ্ছিল আমার। শুধু মনে হচ্ছিলো এই ফ্সীতকায়া বেপথু মহিলাটিকে আমি চিনি না। সেও কেমন স্তম্ভিত ভঙ্গীতে আমার মাথা থেকে পা অবধি বারবার দেখছিল। একসময় জলভরা বিষণ্ণ চোখে একটু থেমে থেমে বললোঃ
- আমি একেবারে বদলে গেছি, না? কি আর বলি তোমায়, সবকিছুরই একটা সময় থাকে, তাই না, বলো? তুমি যখন আমায় চিনতে তখন আমি সদ্যতরুনী,বিবাহিত কিন্তু বউ-বউ ভাবটাও আসেনি তখন, আজ দ্যাখো, আমি মা হয়েছি...শুধু একজন ভালো মা! আর যা কিছু ছিলো আমার জীবনে তার সবকিছুকে বিদায় জানিয়েছি। তবু তোমায় কিন্তু ভুলতে পারিনি। কোনদিন ভাবিই নি, আমাদের এভাবে আবার দেখা হবে, ওহ... আমিই ভুল ভেবেছিলাম যে এতবছর পরও তুমি আমাকে দেখলেই চিনতে পারবে। তুমিও তো অনেক বদলে গেছো। এটা সত্যিই তুমি কিনা, আমার কোনও ভুল হচ্ছে কিনা সেটা ধরতেই আমার অনেক সময় লেগে গেছে। তোমার চুলও তো অনেক পেকে গেছে! খয়েরী গোঁফেও পাকা চুলই বেশী দেখা যাচ্ছে, চিবুকে দুই থাক ভাঁজ এসেছে, গায়ের রঙটাও রোদে পুড়ে তামাটে, মুখে বলীরেখা দেখা দিচ্ছে, আসলে ১২টা বছর হরিয়ে গেছে জীবন থেকে ... ভেবে দ্যাখো, ১২ বছর! আমার বড় মেয়েটার বয়সই এখন ১০!
আমি ওর বড় মেয়েটার দিকে তাকালাম। তার মধ্যে আমি তার মায়ের সেই সৌন্দর্যের কিছু ছোঁয়া খুঁজে পেলাম কিন্তু তখনও সেই সৌন্দর্যের মধ্যে খানিকটা বালিকাসুলভ অপূর্ণতা ছিলো, জীবনটা আমার কাছে জোর গতিতে ছুটে চলা একটা ট্রেনের মতই মনে হচ্ছিলো তখন। ততক্ষণে আমরা মেজোঁ-লাফিত এ পৌঁছে গেছি। আমি আমার সেই পুরনো বান্ধবীটির হাতে চুমু খেলাম আলতো ভাবে, কিন্তু কোন কথা বলতে পারলাম না। আসলে সেই মুহূর্তে আমি আমার কথা বলার শক্তিই প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম।তারপর অনেক রাতে, নিজের ঘরে ফিরে, শোবার ঘরের পূর্নদৈর্ঘ্যের আয়নাটার সামনে দাঁড়ালাম।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজেকে। সাইডটেবিলে রাখা আমার অল্পবয়সের ছবিটার দিকে নজর গেলো। তখনই আবিষ্কার করলাম আমি ঠিক কতটা বদলে গেছি, কতোটা সময়ের ছাপ পড়েছে আমার শরীরে, কতোটা বুড়ো হয়ে গেছি আমি। বুঝলাম আমার যুবাকালের সময়, আমার যৌবন আমাকে বিদায় জানিয়েছে।
1 কমেন্টস্:
অনবদ্য !!!! এটা একটা মুল্যবান সম্পদ !!!!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন