২৯ জানু, ২০১৪

মৌ দাশগুপ্ত

প্রজাতন্ত্র দিবস ও কিছু ভাবনা
মৌ দাশগুপ্ত



বিগত ২৬শে জানুয়ারী সারা ভারতে ৬৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হল। প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে রাজধানী দিল্লী সহ সারা ভারত জুড়েই নানা রকম জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল,যেমনটি প্রতিবার হয় আর কি। তারপর, আরও কিছু কমন ফ্যক্টরও যথাবিহিত মর্য্যাদা সহকারে পুনঃপ্রদর্শিত হল, যেমন,সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ সহ নানা ধরনের সামরিক যন্ত্রপাতি সর্ব সাধারনের জানার জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শিত হল, আমরা জানলাম আমাদের সামরিক শক্তি কতটা, আমাদের বিভিন্ন স্কুলের বাচ্চারা প্রজাতন্ত্র কতটা বোঝে এবং নাচগান করে অন্যকেও বোঝানোর চেষ্টা করে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকাল আবার 'হ্যাপী রিপাব্লিক ডে' বলে শুভেচ্ছা জাননোটাও সভ্যজনের এটিকেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে ঢেলে বিকোচ্ছে 'হ্যাপী রিপাব্লিক ডে' গ্রীটিংস কার্ড। স্বাধীনতা দিবসের মত বছরের এইদিনেও সারা ভারতের সরকারী অফিস-আদালত, জেলখানা থেকে পাগলাগারদ সব জায়গাতেই একটা খুশির আমেজ দেখা যায়। ব্যক্তিগত উদ্দোগ্যে ভাল খাবার-দাবার,কখনো সখনো নতুন পুরানো জামাকাপড়, শীতবস্ত্র পরিবেশন করা হয় অনাথাশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম, কিছু হাসপাতাল, অর্থনৈতিক অনগ্রসর মহল্লায়। সুবেশা মহিলারা সেজে-গুজে অমুকবাবু তমুকবাবুর সাথে হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দান-ধ্যান করেন ও মিডিয়াকে জানান দেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ চমকায়। পরেরদিন খবরের কাগজ জানায় ২৬শে জানুয়ারীতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত ‘যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৬৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করেছে’ এবং এই উপলক্ষ্যে ‘সারা ভারতে এক অপরিসীম আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে’।

রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করা হলেও ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কাশ্মীরে। বেশকিছু আঞ্চলিক গোষ্ঠী এই দিনটাকে 'প্রজাতন্ত্র দিবস' মানতে চায় না, তাদের ন্যায্য বা অন্যায্য দাবীদাওয়া সরকারীভাবে মানা না হলে তারা 'প্রজাতন্ত্র দিবস' উদযাপন বয়কট করে এবং এইভাবে চেষ্টা করে তাদের দাবী বাস্তবায়ন করার। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ও কাশ্মীরে ২০টির বেশি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন’ স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন করে যাচ্ছে। এ কারণে তারা প্রতিবছরই স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবসে সব ধরনের সরকারি কর্মসূচি বয়কটের ঘোষণা করে, এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

তা সে উৎসব জিনিষটাই এমন। ইচ্ছা হলে আনন্দ করে অংশ নাও নয়ত মুখগোমড়া করে নিজের মনে নিজে থাকো। নো প্রবলেম। ছোটবেলা থেকেই জানি প্রজাতন্ত্র দিবস মানেই একটা গোটা ছুটীর দিন।ইচ্ছামত চলার দিন, পিকনিক , থিয়েটার,কি সিনেমা দেখার দিন,তাছাড়াও আছে পাড়ার মোড়ে, স্কুলের মাঠে, তেরঙ্গা পতাকা তোলার ভীড়ে দাড়াঁলেই একটা কমলা,দুটো লজেন্স, কি একমুঠো বোঁদে,সাথে ফ্রী ভাষণ। অঘোষিত স্বঘোষিত এবং ঘোষিত নেতা নেত্রীদের খুচরো ভাষণ, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা আজাদি-র ভাবসম্প্রসারন,নেতাজী, গান্ধী, জহরলালের ছবিতে টাটকা ফুলের মালা।প্রভাত ফেরী, বাচ্চাদের মুখোশ নাটক,বসে আঁকো প্রতিযোগীতা, বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, পথনাটিকা। খবরের কাগজের বিশেষ ক্রোড়পত্র, বাচ্চাদের হাতে তিনরঙ্গা ফেস্টুন,বাবা- কাকার শার্টে সেফটিপিনে আটকানো কাগজের তেরঙ্গা,প্রজাতন্ত্র দিবস মানেই মাইকে বা টিভিতে তারস্বরে দেশভক্তির গান বা সিনেমা ,এছাড়াও আছে লালকেল্লার সরকারী অনুষ্ঠান, সামরিক বা বেসামরিক কুচকাওয়াজ, স্কুল বা বিভিন্ন ক্লাব প্রতিষ্ঠানের তরফে প্যারেড। আমার কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দেয়, সেটা হল, একদিন মাইক বাজিয়ে আর প্যারেড করে কি সত্যিই প্রজাতন্ত্র উদযাপন করা যায়? আরে বাবা নাচাগানা তো শোনপুর মেলাতেও হয়, অমুকবাবু তমুকবাবু হাতে মাইক পেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও রক্ত গরম করা ভাষণ দিয়ে পাশ ফিরে নাক ডাকাতে পারেন,তারজন্য ‘প্রজাতন্ত্র’দিবসে’র বাহানাটা খুব জরুরী কি?

'জনগণমন' ইস্কুল থেকে শুনতে শুনতে মনের ওপর এমন ঘূণধরা এফেক্ট করেছে যে এখন গানটা বাজলে আমাদের মধ্যে কতজন হাতের কাজ ফেলে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ার সৌজন্যটুকু দেখান সেটাও প্রদীপ হাতে খুঁজে দেখতে হয়।বন্দেমাতরম গানটাই বা আজকাল আমাদের মনে কতোটা এফেক্ট করে? ছোটবেলায় রেডিওতে যে বন্দেমাতরম-র সুর শুনে বড় হয়েছি তার থেকে এ.আর.রহমানের 'মা তুঝে সালাম' –এর বন্দেমাতরমের সুর আজকের প্রজন্মকে বেশি আবেগাপ্লুত করে না কি? বিতর্কিত বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু আরো বিতর্কিত বিষয় হল, প্রজাতন্ত্র বাপারটা কি? খায় না মাথায় দেয়?দেশ প্রজাতান্ত্রিক হলে প্রজা থুড়ি দেশবাসীর টা লেজ গজায় এই সব কূট প্রশ্নের উত্তর পাই কোথায়? ...লেট করে ঘুম থেকে উঠে টিভিতে দেশাত্মবোধক সিনেমা বা ‘ডান্স ইন্ডিয়া ডান্স’,কি ‘সারেগামাপা’র রিপাব্লিক ডে স্পেশাল দেখা, পাড়ার মোড়ে, ক্লাবে, ইস্কুলে কর্নবিদারী মাইকে সোচ্চারে বাছাবাছা কিছু গানের রিপিটেশন শোনার (ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়ে) মত পাড়াতুতো দেশপ্রেমের ইনফ্লুয়েন্সে পা মিলানো ছাড়া বিশেষ কী করছে আপামর ভারতের জ ন সা ধা র ণ ? আম জনতা? পাতাকা উত্তোলন? লজেন্স বোঁদে জিলিপি বিলি? পিকনিক? পিকেটিং? গেট-টুগেদার? জমাটি মজলিস? ছুটীর দিনের আড্ডা? দুপুরে মাংসভাত শেষে জমাটি দিবানিদ্রা? পতাকা তুলে জাতীয় সঙ্গীত? নতুন জেনারেশানের মধ্যে দেশাত্ববোধ জাগে এই উপায়ে? জানি না। ঠিক যেমন জানি না ইতিহাস বইয়ের পাতা ছাড়া সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আর কোথায় আছে?

এখন এই প্রজাতন্ত্র জিনিষটা ঠিক কি? খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে পড়েছি বটে, কিন্তু সম্যক ধারনা নেই। একটু দেখা যাক। প্রথমেই সর্বজ্ঞানের ভান্ডার গুগল কি বলে দেখা যাক। “একটি প্রজাতন্ত্র হল এমন একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে জনগণ বা জনগণের একাংশ। ইংরেজি ভাষায় "প্রজাতন্ত্র" শব্দের প্রতিশব্দ "republic" এসেছে লাতিন শব্দবন্ধ res publica শব্দবন্ধটি থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ "জনগণ-সংক্রান্ত একটি বিষয়"।“ সাধারণত রাজশক্তি-বিহীন রাষ্ট্রকেই প্রজাতন্ত্র বলা হয়।ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত ভারত ‘হিন্দুস্তান’ (ভারত) ও ‘পাকিস্তান’ (বর্তমান বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল) এই দুই সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান প্রণীত হয় এবং এটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই থেকে দিনটি আমাদের দেশের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।প্রজাতন্ত্র দিবস, মানে যে দিন ভারত এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণ করেছিল স্বাধীনতা লাভের পর তার প্রথম সংবিধান, তার মানে ভারতীয় সংবিধানের জন্মতিথিই হল ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। যাক এতটুকু তো ক্লিয়ার হল, কিন্তু এরপর?


সংবিধান কি? এই প্রসঙ্গে নিজের কথা না লিখে কবীর সুমনের একটা উদ্ধৃতি দিই।

“সংবিধান? নীতিমালার সেই কাঠামো যা এক রাজনৈতিক রাষ্ট্রের বনিয়াদ? নাকি ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, পশ্চিম ভারতের সেই ‘অস্পৃশ্য’ (বন্ধু, এই দেশে জন্মে তুমি আমি এই ‘শব্দটি’ জেনেছি, আমাদের সংবিধান চেয়েছে তা মুছে দিতে, কিন্তু…) জাতির মানুষটি, যিনি ছেলেবেলায় ‘উঁচু জাতির’ হিন্দু সহপাঠীদের মুখে-হাতে লাঞ্ছিত হতেন, যিনি বরোদার গায়াকওয়াড়ের দেওয়া বৃত্তি পেয়ে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন, যিনি বরোদা পাবলিক সার্ভিসে যোগ দিয়ে আবার সেই ‘উঁচু জাতির’ হিন্দু সহকর্মীদের মুখে-হাতে লাঞ্ছিত হয়ে ওকালতি ও শিক্ষকতায় যান, যিনি দলিতদের নেতা হয়ে ওঠেন, ১৯৪৭-এ হয়ে ওঠেন ভারত সরকারের আইনমন্ত্রী, যিনি ভারতের সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন (যে সংবিধানে ‘অস্পৃশ্যদের’ বিরুদ্ধে বৈষম্য আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু…) যিনি তার পর বিরক্ত হয়ে ইস্তফা দেন, সংবিধানে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও সমাজের প্রাত্যহিকতায় দলিতদের বিরুদ্ধে বৈষম্য যে আগের মতোই চলেছে এটা দেখে যিনি ১৯৫৬ সালে দুই লক্ষ দলিত অনুগামীকে নিয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন? এই দীর্ঘ বাক্যটি পড়ে তুমি কি ক্লান্ত, বন্ধু? আমরা কেউ কেউ, কি তার চেয়েও ঢের বেশি ক্লান্ত নই সংবিধানে যা যা লেখা আছে, বাস্তবে অনেক সময় তার উল্টোটাই দেখে দেখে?
আমাদের দেশের মতো এত উদার সংবিধান কটা দেশের আছে? এর নীতিমালার একটি ভগ্নাংশও যদি ফলিয়ে দেওয়া যেত, বন্ধু? আহা, জানি, তুমি কী বলতে চাও। সেই নীতিমালার পরিসরেই তো আইন প্রণয়ন হচ্ছে। সব মানুষ সমান। শিক্ষার অধিকার সকলেরই আছে। সব নবজাতকের আছে বাঁচার অধিকার। এ-সংবিধান এ-দেশের সকলের জন্য সুবিচার, স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্ব কায়েম করতে চায়।

(কবীর সুমন - সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ১৫ মাঘ ১৪১২ রবিবার ২৯ জানুয়ারি ২০০৬)

কোনো দেশের একটি হলো ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক সত্তা এবং আরেকটি হলো রাজনৈতিক অবস্থা। যে ভূখণ্ডে আজকের ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠিত, সেই ভুখন্ডটি হাজার হাজার বছর ধরে ভৌগোলিকভাবে গঠিত হয়েছে। তারপর সেখানে গড়ে উঠেছে জনবসতি। এটি হলো প্রাকৃতিক ভারতবর্ষ। তা আগেও ছিল, ১৯৪৭-এর পরও ছিল এবং থাকবে আরও হাজার হাজার বছর—যদি পৃথিবী থাকে। কিন্তু এক নতুন রাজনৈতিক ভারতের , সার্বভৌমিক প্রজাতান্ত্রিক ভারতের, এবং এক নতুন ভারতীয় জনসত্ত্বার জন্ম হয় ২৬শে জানুয়ারী ১৯৫০ সালে। ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। সেটাকে বলা হয় ক্ষমতা হস্তান্তর। ব্রিটিশরা চলে গেল, ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা দিয়ে গেল। শাসনক্ষমতা পাওয়া মানেই দেশটি রিপাবলিক হওয়া নয়। ভারতকে ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে ঘোষণা করে শাসনতন্ত্র গৃহীত হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। সেই শাসনতন্ত্র কার্যকর হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। সেটা ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়। শুধু একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, পতাকা ও সরকার থাকলেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হয় না। তার একটি নিজস্ব সংবিধান বা সর্বোচ্চ আইন থাকা অপরিহার্য। ওই সর্বোচ্চ আইনের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়—কারও ইচ্ছামতো নয়, কোনো দেশের বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নির্দেশমতোও নয়। একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও সংবিধান অবিচ্ছেদ্য।

আজ সুবিধাবাদ হয়ে উঠেছে জাতীয় বৈশিষ্ট্য, সুবিধাবাদ পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। “গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র ও বান্ধবতন্ত্রের এমনই লীলা। না, না, সংবিধানে এ সব লেখা নেই। আছে রং-বিধানে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে লিখতে পেরেছিলেন— ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে।’ গণতন্ত্রে কি আর ‘সবার রঙ’ বলে কিছু থাকতে পারে? এক এক পক্ষের, দলের এক এক রং। সুকুমার রায়ের জবান একটু বদলে দিয়ে বলা যায়:’ রঙের আমি রঙের তুমি রঙ দিয়ে যায় চেনা’। রঙে রঙে রঙাক্কার, রঙে রঙে ঠোকাঠুকি, ধাক্কাধাক্কি, রঙের ওপর রঙের টেক্কা, পাঁচ বছর ধরে এ রঙের শাসন বা ‘রংবাজি’ এবং অন্য রংগুলির আপত্তি বা পাল্টা রংবাজি, পাঁচ বছর পর আবার রঙে রঙে লড়াই, গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় এ রং ও রঙের প্রচার, চুপচাপ কোনও একটি বিশেষ রঙে ছাপ, পরে ছাপ গোনা, যোগ-বিয়োগ করে জেতা-রং নির্ণয়, আবার পাঁচ বছর। সংসদীয় রাজনীতির বা রংনীতির এই হল মূল গল্প।“ যে কথা আমাদের পূর্বপ্রজন্মের স্বাধীনতাকামীদের কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি।

রাজধানী দিল্লী হোক কি প্রত্যন্ত কামদুনী বা মধ্যমগ্রাম), ধনিকশ্রেনী আর পুঁজিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্তন করবে, বিদেশী (পড়ুন, বিদেশিনী) শক্তি চালনা করবে দেশ, দেশীয় নেতারা অভিনয়কেই রাজনীতির পাশা করে নিজের কোলে ঝোল টানবেন, অশিক্ষা, অপুষ্টি, অরাজকতা দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে তা-ও তাঁদের ধারণায় ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকেই প্রতিটি সরকার তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তার লক্ষ্যে, কিছু ভোট বেশি পাওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সুবিধাবাদের দিকে ধাবিত করছে। ব্যক্তিগত সততা ও মেধা হয়ে পড়ছে মূল্যহীন। একটি শক্তিশালী জাতি গঠনের পথে যা হিমালয়ের মতো বাধা। এসব করে আমরা স্বাধীনতার, গনতন্ত্রের, প্রজাতন্ত্রের স্বপ্নটাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছি।আদতে, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি যে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, আজ তা ‘গুটিকয়তন্ত্র’: রাষ্ট্র জনগণের নয়, অল্প কয়েকজনের।


তবু ঐ যে কথায় বলে না ‘আশায় মরে চাষা’, আমাদেরও সেই হাল, সবই জানি, বুঝি, অনুভব করি, তবু বছরের পর বছর ‘কলুর বলদের’ মত ঠুলিপরা চোখে একই বৃত্তাকার পথে ঘুরে চলেছি,সেই নির্বাচন, সেই প্রহসন, সেই একই ট্রাডিশনের পুনরাবৃত্তি, সেই একই ভাবে আরেকটু ভালোর আশায় থাকা, আরেকটু জাতীয় স্বাচ্ছ্বন্দ্যকে অনুভব করতে চাওয়া। বাঙ্গালী/ গুজরাটি/ বিহারী / ওড়িয়া প্রাদেশিকতা বা হিন্দু / ক্রিশ্চান/ মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভেদ ভুলে ‘চক দে ইন্ডিয়া’র মত অন্তত একবার নিজেকে ‘শুধু ভারতীয়’ ভাবা । প্রারম্ভিকভাবে এটাই না হয় আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসের চাহিদা হোক। তাতেই বা মন্দ কি?


জাতীয় ফুলটা হাতে চটকালেও সম্প্রীতির গন্ধ আর বের হয় না ,
সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক ভারত’ শব্দটা রয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।
পতাকার ভাঁজে দামিনীদের চিৎকার ,নারীমাংসভোজীর উল্লাস,
কন্যাভ্রূন বিসর্জনের আর সতীদাহের নিদারুন কাহিনী,
জাতপাত,ভোটযুদ্ধে বা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে নিহতদের রক্তের দাগ ,
সীমান্ত বা সীমান্তের ভেতরে উর্দিপরা,উর্দিছাড়া দেশপ্রেমিকদের বলিদানের গল্প,
সব বুকে বয়েও আকাশে সগৌরবে উড়ছে জাতীয় পতাকা।
দিনের শুরুতে স্বচ্ছ নীল আকাশের বুকে উদীয়মান সূর্য লাল রং ছড়াচ্ছে,
সেই লাল রঙ সর্বাঙ্গে মেখেও কিন্তু আমাদের জাতীয় পতাকা তেরঙ্গাই আছে।‘

ভালো থাকুন সবাই, ভালো রাখুন, কাব্যলক্ষ্মীর সংস্পর্শে আনন্দে থাকুন।আপনাদের সবাইকে আমার শুভ আত্মসমালোচনা দিবসের শুভেচ্ছা।।

1 কমেন্টস্:

Unknown বলেছেন...

মন ছুঁয়ে গেলেন।।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন