২৯ জানু, ২০১৪

সুদীপ নাথ

শিশুর কৈশোরে উত্তরণ ও আমাদের কর্তব্য
সুদীপ নাথ



শিশুর দুর্বলতার প্রতি কঠোর, যুক্তিনিষ্ঠ, খুঁতখুঁতে, সংযমী এবং অসহিষ্ণু হওয়া যতই কঠিন হোক না কেন, তা শিশুত জন্যেই সবচেয়ে আগে প্রয়োজনীয়। বাহ্যিক সংযম এবং নীতিনিষ্ঠতার আড়ালে আন্তরিকতা বজায় রেখে চলা, পূর্ণ যুক্তিনিষ্ঠতা এবং কঠোরতার আড়ালে স্নেহপূর্ণ এবং সাগ্রহ মনোযোগ প্রদান, শিশুর মানবীয় দুর্বলতাগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ এবং সেইসব দুর্বলতাগুলো থেকে তাদের মুক্তিলাভের কার্যকরি সহায়তা প্রদান- ঠিক এইভাবেই মা-বাবাদের নিজেদের শিক্ষামূলক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তি গড়া উচিত। তার কোন বিকল্প আছে কিনা, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। অনেককেই এবিষয়ে শিশুদের প্রতি অবিচার নিয়েও প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। তারা বলে থাকেন যে, এসব অবিচার নাকি আসলে কঠোরতারই নামান্তর, এইসব নাকি শিশুর মনকে শক্ত করে তুলে। আমি কিন্তু এখানে একটা প্রশন তুলবই যে, এসমস্ত সত্যিই শিশুর মনকে শক্ত করে তুলে কিনা। কারণ, শিশুরা সবসময় দুর্বল, বড়দের দাপট এবং ঔদ্ধত্যের সামনে তারা সবসমই অসহায়। বড়রা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই নিষ্ঠুর হয়ে উঠেন বরাবর। দায়িত্বহীনতা প্রয়শই নিষ্ঠূরতার জন্ম দেয়। শিশুদের প্রতি অবিচার খুবই মারাত্মক বিষয়। এসব তাদের কোমল মনকে গভীরভাবে আহত করে এবং তার নৈতিক অনুভুতিকে ক্রমশ বিকৃত করে তুলে। তার ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না। তবে অধিকাংশ ছেলে-মেয়েই বেশ ভালোভাবেই এসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। ঠিকমত পড়াশুনা করে, বাড়ীতে ও স্কুলে ভালো আচরণ করে, পরিশ্রমী হয়। অথচ এমনটিই দেখা যায়, প্রাইমারি স্কুলের সময়ে, যারা বেশ বাধ্য, তারাই কৈশোরে আমাদের জ্বালিয়ে মারে। তখন পরিবর্তনগুলো চোখে পরার মত। কিশোর বয়েসের এইসব আচার আচরণের জন্যে, আমাদের আগাম প্রস্তুতি না থাকলে, পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়। এবার দেখা যাক, আসলে এই সংকটগুলোর সময়ে ঠিক কি কি ঘটে। তখন সবচেয়ে আগে তার সাবালকত্ব আসে। এখন সে আর মাত্র বয়েসের দিক থেকেই বড় হয়নি, সে এখন বড় হয়েছে আত্মিক এবং শারীরিক দিক থেকেও। এই সময়ে, অনেক ছোটবেলার কিছুদিন ধরে চলা একগুঁয়েমি, স্বেচ্ছাচারিতা, আত্মনির্ভরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা আর আত্মনির্ভরতার অবিরাম প্রয়াসের নূতন করে আবির্ভাব ঘটে। তবে এসব শুরু হয় খুবই জটিল ভাবে। এখন তার আত্ম-বিশ্লেষণ খুব তাড়াতাড়িই ঘটে যায়, মা-বাবা ও অন্যদের দিকে সমালোচনামূলক মূল্যায়নের ঝোঁক বাড়ে। কারও প্রতি সে তার মূল্যায়ন ঘন ঘন পরিবর্তিত করে। তার কোন বন্ধু তাকে সাহায্যের হাত বাড়ালে, সে হয়ে উঠে তার কাছে খুব ভাল। কয়েকদিন পর, ঝগড়া বাধলেই বলে দেবে তাকে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না, সে আমার আসল বন্ধু নয়। কোন ছেলে-মেয়েই এই বয়েসে, পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা (contradictory comments) পছন্দ করেনা। তাই মা-বাবাদেরও কম খোঁটা খেতে হয়না। কখনো হয়ত, কোন কথা দিয়েও কথা রাখলেন না, তখনও খোঁটা শুনায়। শিক্ষকদেরও সমালোচনা করতে ছাড়েনা। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের সমালোচনা করে। প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সমালোচনা করে বা তাদের সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে। মনে রাখতে হবে, এসব কিন্তু মামুলি ব্যাপার নয়, বা যুক্তিহীন বিদ্বেষ থেকে আসা বা খেলাচ্ছলে সমালোচনা নয়। সে তখন জীবনকে নূতন ভাবে দেখতে শিখছে, সে অশান্ত ভাবে সমস্ত বিষয়ে তার মনের মত অনুকরণ যোগ্য প্রকৃত বীরকে খুঁজে চলেছে, যা এতোদিন ধরে তাকে সব্বাই মিলে শেখানো হয়েছে। কারণ সে মানুষের মত মানুষ হতে চায়। সে এখন সেই উন্মাদনায় ভুগছে। কিশোর-কিশোরীদের অবাধ্যতাকে অসৎসঙ্গের ফলাফল হিসেবে দেখা অনুচিত। অথবা ক্রমানুবতির লক্ষণ বা শিক্ষিত করে তুলতে না পারার ব্যর্থতা হিসেবেও মনে করা উচিত নয়। ভুলে গেলে চলবেনা, এই সময়েও অনেক বিষয়েই তারা বালকোচিত ধ্যানধারণা নিয়েও চালিত হয়, নাহলে একে আমরা উত্তরণ হিসেবে আখ্যায়িত করতাম না। অনেক সময় কেউ কাওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে আনদ পায়, আর এথেকে অনেক সময় ঘটে যায় দুর্ঘটনা। আবার ছেলেরা মদ খেয়ে ফেলে, আর পরিণামে শুরু হয় মারপিট। ঘরের কাজের জিনিস নষ্ট করে ফেলে। এমন ঘটনাও আকছার ঘটে। এসব ঘটনায় আমরা যেসব যুক্তি খাড়া করি, তা “এমন হবে আগে ভাবতেও পারিনি” বা “আমি তো এমন আশা করিনি” ধরণের। ছেলে-মেয়েরা এই বয়েসে এসবের পরিণাম সম্পর্কে বড়োদের সাবধান বানীগুলোকে অতি বিমূর্ত কোন ব্যাপার বলেই মনে করে। তারা ভাবে যে, এসব ব্যাক্তিগতভাবে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তারা একটা কথাই ভাবে, তা হল, “মা বাবা জানলে রক্ষে নেই”। আর কিছুই তারা ভাবেনা। তারা তাদের আত্মমর্যাদাবোধের জন্যেই এসব কাজ করে ফেলে। অন্য সব পরিণাম তাদের কাছে তুচ্ছ বলেই তারা মনে করে। কিশোর-কিশোরীরা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক বিষয়-আশয় এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আগ্রহী হয়। তাদের বিশ্বানুভুতি সবেমাত্র গড়ে উঠেছে। তাই তারা শৃঙ্খলা ছাড়াই একসাথে অনেক বিষয়ে মেতে উঠতে পারে। এই সমস্ত আগ্রহে ভবিষ্যতের কোন লক্ষ্য প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে।তাতে মজা লাগে- ব্যাস, এইটুকুই। কিশোর-কিশোরীদের মারাত্মকভাবে আকৃষ্ট করে সাবালক জীবনের বাহ্যিক বিষয়গুলো। যেমন, পোষাক-পরিচ্ছদ, চুলের স্টাইল, আঁতর, শ্যাম্পু, মদ, ধূমপান, খইনী, দ্রুত বাইকে চড়া এসব। উপরন্তু তারা তখনও মানবীয় সম্পর্কগুলোও ভালোভাবে চেনেই না। বড়রা যেসব নিয়ম ও বাঁধাধরা নিষেধ মেনে চলেন, তার অনেকগুলোই তাদের কাছে আজগুবি, একঘেয়ে আর অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এসব আচরণ, এমনকি তাদের ছোটোখাটো ব্যাপারেও প্রকাশ পায়। যেমন, সবাইকে নমস্কার করতে বাঁধে। তারা শুধু তাদেরই নমস্কার করতে চায়, যাদের ভালো লাগে। সাবালক জীবনের বাহ্যিক দিকগুলো অনুকরণ করা দিয়েই শুরু হয় তাদের সাবালকত্ব এবং তা সবার ক্ষেত্রেই। আর আত্মনির্ভরতার জন্যে প্রয়াস পর্যবসিত হয় অসংখ্য ভ্রম আর ভুল বোঝাবুঝিতে। এই ধরণের বেশিরভাগ ভুলভ্রান্তি অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সমাজবিরোধী ব্যাপার বলে কখনও বিবেচনা করা উচিত নয়। তবে এইসব ক্রিয়াকলাপের যথাযোগ্য মূল্য দেয়া আক্ষরিক অর্থেই প্রয়োজন। কিশোর-কিশোরী কবে নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে, সাহসিকতা ও ধৃষ্টতা আর স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ফারাক বুঝতে পেরে যাবে, সেই আশায় চুপচাপ বসে থাকলে, মারাত্মক ভুল হবে। এমতাবস্থায় আমাদের কী করণীয় ? একদিকে বলপ্রয়োগ করাও যেমন অনুচিত, ঠিক তেমনি চুপচাপ বসে বসে নিরীক্ষণ করেও চলা যায়না। প্রশ্নটি সত্যি সত্যিই খুব জটিল। আসুন এবার আসল স্থানে দৃষ্টিপাত করা যাক। আগে ছেলেমেয়েদের বলা হত- “এটা করা করা উচিত নয়”। কিন্তু এখন ঠিক এই কথাটিই বলা হয় বেশির ভাগ মা-বাবাদের ক্ষেত্রে। শিশু থেকে বালক, বালক থেকে তারা যখন কৈশোরে পা দেয়, তখন এইসব সঙ্কটজনক পর্বে অনেকেই বলে থাকেন, তাহলে কি তার অর্থ এই যে, তারা মাথায় চড়ে বসবে ? তা নিশ্চয়ই নয়। তবে শিক্ষার উদ্দেশ্য কিন্তু সবসময় দমিয়ে রাখা এবং বাধা-নিষেধের মাধ্যমে নাজেহাল করে তোলা নয়। শিক্ষাদীক্ষার আসল এবং সর্বোপরি উদ্দেশ্যই হচ্ছে, চরিত্রের প্রাথমিক প্রবণতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। এই সংকটজনক পর্বই হচ্ছে আসল সময়। এটাই ঠিক সেই সন্ধিক্ষণ, যার পরেই শুরু হবে, এই শিক্ষা পেয়ে, ভবিষ্যৎ বিকাশের প্রকৃত পথটাকে চিনে নেয়া। আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বজ্ঞা তথা নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি কিন্তু, পুরোপুরিভাবে কিশোর-কিশোরীদের পক্ষকে সমর্থন করতে চাইছি না। তাছাড়া এখানে সমস্ত কিছুই স্বজ্ঞায় নয়। বহু মা-বাবার প্রধান শিক্ষাগত ত্রুটি হচ্ছে এই যে, তারা তাদের সন্তানদের উপর নিজেদের অভিজ্ঞতা লব্ধ এবং মানবজাতির এযাবৎ অর্জিত জ্ঞানের ফলাফল চাপিয়ে দিতে অনবরত চেষ্ঠা করে করেন। কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকে প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রেই, নিজের অভিজ্ঞতার সমস্তকিছুই উপলব্ধি করার অদম্য বাসনা থাকে। সেই জন্যেই প্রস্তুত (readymade) সত্যকে সে গ্রহন করে অনিচ্ছায়, নিস্ক্রিয় ভাবে। এই গ্রহন কার্যকরি effective) হবে কতটুকু, তার প্রশ্ন থেকেই যায়। এসবের দ্বারা সে অনুপ্রাণিত হয় না। তাই দেখা যায়, আমাদের বহু বাধানিষেধ আর হিতোপদেশে কান দিলেও, তাদের নিজে নিজে জানার প্রলোভন থেকেই যায়। তবে আসল কথা হচ্ছে, ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে সক্রিয় কাজকর্মের মধ্য দিয়েই। নিয়ম মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে তা গড়ে উঠে না। তা’ই হচ্ছে তাদের বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটা ভালো করে আমাদের বোঝা উচিত। সে জন্যেই বাস্তবিক ক্ষেত্রে, প্রায়শই তারা মা-বাবার বাধা-নিষেধ অমান্য করে। সাধারণত তা হয় গোপনে, ক্বচিৎ প্রকাশ্যে। গোপনে এসব অমান্য করলেও, পরে অবিশ্যি সবকিছুই খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেবার সাহস দেখায়, এমন কি সবার সামনে পর্যন্ত। কিশোর বয়েসের বৈশিষ্ঠই হচ্ছে এই যে, তখন অনেক নিয়ম লঙ্ঘন করা হয় খোলাখুলিভাবে এমন কি সবার সামনে। তাদের উদারতা, স্বনির্ভরতা ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা পাওয়া উচিত সমস্ত শৈশব কাল ধরেই। কিন্তু কেবল পিতা-মাতা আর শিক্ষকদের উপদেশ স্মরণ রাখার মধ্য দিয়ে তা শেখা যায়না, আত্মস্থ করা যায়না। সর্বাগ্রে পরিবারের দৈনন্দিন জীবনই শিশুর মধ্যে এই গুণগুলো গড়ে তুলে। উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতার অনুভূতি যদি বিকশিত না হয়, তাহলে আত্মনির্ভরতা অর্জনের প্রয়াস সহজেই দ্বায়িত্বহীন বিদ্রোহ আর অর্থহীন হামলার আকার ধারণ করতে পারে, এমন চিত্র প্রায়শই চোখে পরে। এসব কারণেই অনেক ছেলেমেয়ে ঘর ছেড়ে পালায়। কৈশোরে উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতা শেখানো কি সম্ভব ? তখন কি দেরি হয়ে যায় না ? হামেশাই মা-বাবারা এমন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন। না, তখন একেবারেই দেরি হয়ে যায় না। কারণ, মানুষ উদারতার চাহিদা অনুভব করে সারা জীবন ধরেই। আর ন্যায়পরায়ণতা হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শক্তি এবং যুক্তি। এবং যেহেতু তারা এই শক্তিকে শ্রদ্ধা করে এবং পরস্পর-বিরোধীতা (self contradiction) ভালোবাসে না, তাই। তবে আসল কথা হচ্ছে, এই ন্যায়পরায়ণতা অবশ্যই বোধগম্য হয়া উচিত। আর এই ন্যায়পরায়ণতাকে একেবারে সহজ এবং সরল করে তুলেই, তাদের সামনে হাজির করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের জটিল হয়ে ঊঠা তাদের বিশ্বানুভুতি ও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই, মা-বাবা-শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও নিজেদের যুক্তিজালটি বিস্তৃত করেই তোলা উচিত। নাহলে পরিস্থিতি ক্রমশই আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে। সবকিছুই কথার কথাই থেকে যাবে। তাই আবারো বলতে চাই, ছেলেমেয়েদের দুর্বলতার প্রতি কঠোর, যুক্তিনিষ্ঠ, খুঁতখুঁতে, সংযমী এবং অসহিষ্ণু হওয়া যতই কঠিন হোক না কেন, তা তাদের স্বার্থেই সবচেয়ে আগে প্রয়োজনীয়।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন