সেই গানের মানুষটা
অনুপ দত্ত
তার সাথে পরিচয়ের কথা ঠিক মনে নেই I ওর সঙ্গে গানের আসরে যেতাম ৷I মাথার ভেতরে আমার তখন গানের পাগল যেন উলঙ্গ হয়ে নাচে --গাইত সে খুব ভালো I অবধারিত তার ডাক আসতো সবার শেষে ৷i আমার লাভ হতো তার ষ্টেজে উঠার গে,মাঝে মাঝে তার সাথে কথা বলা আর অন্যের গান শোনা I আমরা দুজনে কথা বলা মানে গল্প করতাম ৷ তবে গল্প বেশি হতো তার অন্য পরিচিত নামকরা লোকজনের বা তার অনুপ্রানিত সখী অথবা সখার এক অভাবনীয় গল্প গাঁথা নিয়ে৷I বেশির ভাগ সময়ে সে প্রণব সরকার কথা বা মালবিকা খানের গান গাইবার কথা বলত I তাদের সঙ্গীত জীবনের সাধনার কথা -- প্রনবদার উদ্দাত্ত কন্ঠে রবি ঠাকুরের গান বা লুপ্তপ্রায় বাংলা ভজন গাইবার কথা I কখনো কখনো মালবিকার সুরেলা নজরুলের গান গাইবার কথা বলত I প্রনবদা তো আর বেচে নেই.. তবে তার গান আজও আমার কানে লেগে আছে I মালবিকার কথা জানিনা অনেকদিন...সেই বালুরঘাট ছাড়ার পর থেকে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই I
আমার পাগলপনা গানের মন ভরে যেত যখন তার সঙ্গ পেতাম, আর তার গান শুনতে পেতাম একেবারে খালি গলায় I আহা ...অমন উদ্দাত্ত গলা অনেকদিন আমি শুনিনি I তার সাথে কথা বলে এক অদ্ভুত শুন্যতা নজরে পড়ত I সে এত কথা বলত আমাকে কিন্তু নিজের বিষয়ে বা নিজের ছেলেবেলার কথা কখনো বলত না I কখনো আমার ক্রমাগত অনুরোধে --সে চুপ করে থাকত তারপর এক বিনম্র হেঁসে অন্য কথায় সুর বদলে দিত I কৌতহল হতো আমার I আবার তাকে জোরাজুরি করে দুঃখের ভাগী হতেও মন চাইত না I
একবার শীত জাঁকিয়ে পড়ার আগে তার সাথে অনেক দুরে অনুষ্ঠান করেতে যাবার সুযোগ হলো.....জায়গাটা শিলিগুড়ি I তখনও বালুরঘাটে ট্রেন আসেনি I হবার কথা চলছিল তা প্রায় ২৫/৩০ বছর ধরে I রাজনৈতিক মতবিরোধের এক অনন্য নাজির আর কি I
আমাদের জায়গা থেকে শিলিগুড়ি প্রায় ৭/৮ ঘন্টার রাস্তা হবে বাসে ৷i আমি তো বেশ তৈরী ছিলাম I এমন সুযোগ কি হাত ছাড়া করা যায় I সকালের বাস ...আমাদের পাশা পাশিপাশি সীট পড়েছিলো I সব ঠিক থাক চলছিল ..খুশির মেজাজে... স্বর্গ যেন একেবারে নিচে নেবে এসেছিল ....গর্বের ভেতরে সবকিছু নিয়ে একেবারে হাতের মুঠোয় I
ঘটনাটা ঘটল একটু অন্য রকম ..বাসের ভেতরে এক ১০/১২ বছরের ছেলের সঙ্গে বাস কন্ডাকটারের অভাবনীয় ব্যবহারে তাকে আমি প্রথম দেখলাম বেশ উত্তেজিত হতে I টিকিট কাটতে পারছিল না বলে কন্ডাক্টার ছেলেটাকে বেশ জোরে চড় থাপ্পর মারছিল ....ছেলেটা বার বার বলছিল..
- বাবু..... পয়সা নেই..বাবু.........
- পয়সা নেই..বাবু..........
- খেতে পাই নি আজ দুদিন....শহরে যাচ্ছি কাজের আশায়...যদি কিছু করে খেতে পাই..."
দৃশ্যটা এমন কিছু নতুন নয় এমন ঘটে এবং দেখা যায় সর্বত্র I কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত ছিল I অবাক হবার পালা আমার,যখন দেখলাম সে উঠে গিয়ে কন্ডাকটারের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত ঘষে বলছে....
- ওকে চড় থাপ্পর মারার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে ? আপনার ঘরে কি নিজের ছেলে পুলে নেই..... আপনি কি মানুষ, না কি ? কত ভাড়া হয়েছে আমায় বলুন ..আর আমাদের সাথে ওর একটা টিকিট কেটে দিন শিলিগুড়ি অবধি, ও আমাদের সঙ্গে যাবে I
পরের সমস্ত সময় একেবারে চুপচাপ I
আর একটা কথাও হলো না....বাস শিলিগুড়ি পৌছনো পর্যন্ত i আমি বুঝতে পারছিলাম ---কোথাও একটা ছন্দ পতন তার মনে ---কিন্তু কোথায় ?
শিলিগুড়ি এসে গেলে, ছেলেটা বাস থেকে নেবে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করাতে...সে তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, কোনো কথা তার মুখ থেকে বেরোলো না ..এক গভীর দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটার মাথায় হাত খালি বুলিয়ে দিলো I
আমি এত গভীর দৃষ্টি তার ছোখে দেখিনি কখনো আগে... সে দেখার ভেতরে কি এক মায়া ..এক আশ্বাস ...আর কি এক প্রতিবাদের ছায়া তার চোখে দেখতে পেলাম i ডাকবাংলোতে ঠাই হয়েছিল আমাদের I অনুষ্ঠান ছিল শিলিগুড়ি কলেজের ২৫ বছর পূর্তি রজত জয়ান্তি উত্সব পালনের I
যথা সময়ে আমরা কলেজ অনুষ্ঠানে পৌছে গেলাম ....... যথারীতি আবার সেই অপেক্ষা I তার নাম বার বার ঘোষক বলে চলেছে ....
- উনি এসে গাছেন আমাদের মাঝে ..একটু ধৈর্য ধরুন ..নবীনদের হয়ে গেলে উনি স্টেজে আসবেন...একটু সহযোগিতা করুন ...
তখন প্রায় রাত দশটা হবে... অত নিয়ম কানুন ছিল না তখন, যে রাত দশটা বাজলে মাইকে বন্ধ করে দিতে হবে বা পুলিশের পারমিশন লাগবে I তার ডাক আসার দেরী দেখে ..সাহসে শুধাই ...
- কি হোল তোমার আজ..কিসের অভাব মনে হচ্ছে তোমার...আমার কি কোনো অন্যায় হয়েছে ? এত চুপচাপ কেনো ? কথা বলছ না যে....
আমার দিকে তাকালো সে......সেই দীর্ঘ দীঘল চোখের চাউনি দেখতে পেলাম I যেমনটা দেখেছিলাম বাসের ভেতরে...তফাতটা শুধু এখন এক বিন্দু জল চোখে I ভয় হলো আমার ..কোথাও কি আমি আবার আঘাত করলাম তাকে হঠাট সে আমার হাতটা চেপে ধরল .......দেখলাম তার চোখে বেশ জল... প্রায় গড়িয়ে পড়ল বলে ..স্টেজের আলোতে চিক চিক করেছে যেন I এবার বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি I ভেজা চোখ তুলে আমার দিকে চাইল সে -
- মানুষ এত নিষ্টুর হয় কেনরে ৷ I কেন এই সমতার অভাব ? জানিস,বাসের সেই ছেলেটা আজ আমায় আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়িয়ে দিলো...এক সময় ওই রকমটা কেটেছে আমার I৷ খাবার ছিল না..,, পকেটে পয়সা ছিল না, দোরে দোরে ভিক্ষা করে বেড়িয়েছি ৷I কেউ ছিল না আমার ৷I বাবা মাকে হারিয়েছি হিলি বর্ডারে , যখন বাংলাদেশের সঙ্গে গুলি গোলা চলছিল ....রাজনৈতিক মতনৈক্য দুই দেশের ভেতরে ...মরলো কিছু নিরপরাধ লোকজন ৷ I বাবা মা গিয়েছিলেন সেখানে এক কাকার বাড়িতে...আমাকে রেখে গিয়েছিলেন মাসিমার বাড়িতে ,খাদিমপুর পাড়ায় I আর ফিরে আসেন নি তারা....এমনকি আমি তাদের আর চোখের দেখাও দেখতে পাইনি আমার বয়েস তখন ওই ছেলেটার মতন হবে I তারপর সংগ্রাম. আর সংগ্রাম ..জীবনের অর্থ কিছু ছিল না আমার কাছে ..যেমনটা হয় রুপোলি পর্দার গল্পের মত ৷ I কি করেছি...আর কি করিনি আজ আমার আর মনে নেই I মনে করতে চাইলে মনেও পড়ে না আর....মনে করতেও চাইনে এখন আমিI৷ শুধু মনে পড়ে.........মনের ভেতরে...মনের আধারে গান ছিল I সুরের মায়াজাল মনের ভেতরে কি এক অপার শান্তি বিস্তার করতো......................
কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলো সে I দেখলাম চেহারাটা অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে ..বোধহয় কথা গুলো বলতে পেরে I আবার আমার হাতটা টেনে নিল হাতে বল্লে ...
- স্থান কাল, না বিচার না করে শুধু সুরের সাধনা করেছি আর মনে রেখেছি এক অদ্ভুদ প্রতিবাদের জ্বালা ..অন্যায় বা অনাচারের বিরুধ্যে I
দেখ ভাই , আমি তো আর তোমার মত লম্বা আর বলবান নয় যে দরকার পড়লে দুটো ঘা লাগিয়ে দিলাম আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ..........আমি মনকে জোর দিয়েছি, জুড়েছি কথা আর সুরের মোড়ে.......
আমি অবক হয়ে শুনছিলাম তার কথা ...এ কোন মানুষ ? কবে থেকে ঘুরছি তার সঙ্গে ..কোনো হদিস পানি তার..দেখছিলাম কেমন করে গুটিয়ে থাকে মানুষ তার নিজের খোলের ভেতরে I আবার যখন জল পায় কেমন নিজেই আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে ..কি তোমার খেলা হে অন্তর্যামী ...হঠাট এক শব্দে বাধা পরলো আমার চিন্তাধারা ..
- এই যে স্যার ..আসুন..দয়া করে.. সেই ঘোষক এসে প্রায় তাকে টেনে তুলে নিয়ে যায় আরকি I
গল্পটা ছেদ পড়ল বলে দুঃখ হলো মনে...সে ষ্টেজে উঠলো ...হাত তালিতে গম গম করে উঠলো সমস্ত আসর i অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম আজ....সে সাধারণত বসে এবং নিজে যন্ত্রের সঙ্গে গান গায়...i আজ দেখলাম সে মাইকম্যানকে ডেকে কি যেন আদেশ দিলো I স্টেজ ঠিক দু মিনিটের মধ্যে সাজিয়ে দিলো তারা....সে মাইক হাতে নিয়ে আজ প্রথম গাইল...আজ তার মুখে এক নতুন গান শুনলাম I জানি কথা তার মনে লেখা..সুর তো তার মনের ভেতরে কবে থেকে গুমড়ে গুমড়ে প্রকাশের অভাবে কাঁদছিল ........... আজ বাঁধ ভাঙ্গা জলের মত সে গাইলো........
ওরে মন..যা জেনে যা...
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়
প্রতিবাদে কর প্রতিভূ জয় I
ওরে মন..যা জেনে যা...
দিস না ছেড়ে নিজের আশা
বাঁধিস না ভয় মনে বাসা I
ওরে মন..যা জেনে যা...
দেখবি রে তোর জয়ের ধ্বজা
আকাশে উড়ে দশ ভুজা I
ওরে মন..যা জেনে যা........
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়
প্রতিবাদে কর প্রতিভূ জয় I
ওরে মন..যা জেনে যা........
তার সাথে পরিচয়ের কথা ঠিক মনে নেই I ওর সঙ্গে গানের আসরে যেতাম ৷I মাথার ভেতরে আমার তখন গানের পাগল যেন উলঙ্গ হয়ে নাচে --গাইত সে খুব ভালো I অবধারিত তার ডাক আসতো সবার শেষে ৷i আমার লাভ হতো তার ষ্টেজে উঠার গে,মাঝে মাঝে তার সাথে কথা বলা আর অন্যের গান শোনা I আমরা দুজনে কথা বলা মানে গল্প করতাম ৷ তবে গল্প বেশি হতো তার অন্য পরিচিত নামকরা লোকজনের বা তার অনুপ্রানিত সখী অথবা সখার এক অভাবনীয় গল্প গাঁথা নিয়ে৷I বেশির ভাগ সময়ে সে প্রণব সরকার কথা বা মালবিকা খানের গান গাইবার কথা বলত I তাদের সঙ্গীত জীবনের সাধনার কথা -- প্রনবদার উদ্দাত্ত কন্ঠে রবি ঠাকুরের গান বা লুপ্তপ্রায় বাংলা ভজন গাইবার কথা I কখনো কখনো মালবিকার সুরেলা নজরুলের গান গাইবার কথা বলত I প্রনবদা তো আর বেচে নেই.. তবে তার গান আজও আমার কানে লেগে আছে I মালবিকার কথা জানিনা অনেকদিন...সেই বালুরঘাট ছাড়ার পর থেকে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই I
আমার পাগলপনা গানের মন ভরে যেত যখন তার সঙ্গ পেতাম, আর তার গান শুনতে পেতাম একেবারে খালি গলায় I আহা ...অমন উদ্দাত্ত গলা অনেকদিন আমি শুনিনি I তার সাথে কথা বলে এক অদ্ভুত শুন্যতা নজরে পড়ত I সে এত কথা বলত আমাকে কিন্তু নিজের বিষয়ে বা নিজের ছেলেবেলার কথা কখনো বলত না I কখনো আমার ক্রমাগত অনুরোধে --সে চুপ করে থাকত তারপর এক বিনম্র হেঁসে অন্য কথায় সুর বদলে দিত I কৌতহল হতো আমার I আবার তাকে জোরাজুরি করে দুঃখের ভাগী হতেও মন চাইত না I
একবার শীত জাঁকিয়ে পড়ার আগে তার সাথে অনেক দুরে অনুষ্ঠান করেতে যাবার সুযোগ হলো.....জায়গাটা শিলিগুড়ি I তখনও বালুরঘাটে ট্রেন আসেনি I হবার কথা চলছিল তা প্রায় ২৫/৩০ বছর ধরে I রাজনৈতিক মতবিরোধের এক অনন্য নাজির আর কি I
আমাদের জায়গা থেকে শিলিগুড়ি প্রায় ৭/৮ ঘন্টার রাস্তা হবে বাসে ৷i আমি তো বেশ তৈরী ছিলাম I এমন সুযোগ কি হাত ছাড়া করা যায় I সকালের বাস ...আমাদের পাশা পাশিপাশি সীট পড়েছিলো I সব ঠিক থাক চলছিল ..খুশির মেজাজে... স্বর্গ যেন একেবারে নিচে নেবে এসেছিল ....গর্বের ভেতরে সবকিছু নিয়ে একেবারে হাতের মুঠোয় I
ঘটনাটা ঘটল একটু অন্য রকম ..বাসের ভেতরে এক ১০/১২ বছরের ছেলের সঙ্গে বাস কন্ডাকটারের অভাবনীয় ব্যবহারে তাকে আমি প্রথম দেখলাম বেশ উত্তেজিত হতে I টিকিট কাটতে পারছিল না বলে কন্ডাক্টার ছেলেটাকে বেশ জোরে চড় থাপ্পর মারছিল ....ছেলেটা বার বার বলছিল..
- বাবু..... পয়সা নেই..বাবু.........
- পয়সা নেই..বাবু..........
- খেতে পাই নি আজ দুদিন....শহরে যাচ্ছি কাজের আশায়...যদি কিছু করে খেতে পাই..."
দৃশ্যটা এমন কিছু নতুন নয় এমন ঘটে এবং দেখা যায় সর্বত্র I কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত ছিল I অবাক হবার পালা আমার,যখন দেখলাম সে উঠে গিয়ে কন্ডাকটারের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত ঘষে বলছে....
- ওকে চড় থাপ্পর মারার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে ? আপনার ঘরে কি নিজের ছেলে পুলে নেই..... আপনি কি মানুষ, না কি ? কত ভাড়া হয়েছে আমায় বলুন ..আর আমাদের সাথে ওর একটা টিকিট কেটে দিন শিলিগুড়ি অবধি, ও আমাদের সঙ্গে যাবে I
পরের সমস্ত সময় একেবারে চুপচাপ I
আর একটা কথাও হলো না....বাস শিলিগুড়ি পৌছনো পর্যন্ত i আমি বুঝতে পারছিলাম ---কোথাও একটা ছন্দ পতন তার মনে ---কিন্তু কোথায় ?
শিলিগুড়ি এসে গেলে, ছেলেটা বাস থেকে নেবে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করাতে...সে তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, কোনো কথা তার মুখ থেকে বেরোলো না ..এক গভীর দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটার মাথায় হাত খালি বুলিয়ে দিলো I
আমি এত গভীর দৃষ্টি তার ছোখে দেখিনি কখনো আগে... সে দেখার ভেতরে কি এক মায়া ..এক আশ্বাস ...আর কি এক প্রতিবাদের ছায়া তার চোখে দেখতে পেলাম i ডাকবাংলোতে ঠাই হয়েছিল আমাদের I অনুষ্ঠান ছিল শিলিগুড়ি কলেজের ২৫ বছর পূর্তি রজত জয়ান্তি উত্সব পালনের I
যথা সময়ে আমরা কলেজ অনুষ্ঠানে পৌছে গেলাম ....... যথারীতি আবার সেই অপেক্ষা I তার নাম বার বার ঘোষক বলে চলেছে ....
- উনি এসে গাছেন আমাদের মাঝে ..একটু ধৈর্য ধরুন ..নবীনদের হয়ে গেলে উনি স্টেজে আসবেন...একটু সহযোগিতা করুন ...
তখন প্রায় রাত দশটা হবে... অত নিয়ম কানুন ছিল না তখন, যে রাত দশটা বাজলে মাইকে বন্ধ করে দিতে হবে বা পুলিশের পারমিশন লাগবে I তার ডাক আসার দেরী দেখে ..সাহসে শুধাই ...
- কি হোল তোমার আজ..কিসের অভাব মনে হচ্ছে তোমার...আমার কি কোনো অন্যায় হয়েছে ? এত চুপচাপ কেনো ? কথা বলছ না যে....
আমার দিকে তাকালো সে......সেই দীর্ঘ দীঘল চোখের চাউনি দেখতে পেলাম I যেমনটা দেখেছিলাম বাসের ভেতরে...তফাতটা শুধু এখন এক বিন্দু জল চোখে I ভয় হলো আমার ..কোথাও কি আমি আবার আঘাত করলাম তাকে হঠাট সে আমার হাতটা চেপে ধরল .......দেখলাম তার চোখে বেশ জল... প্রায় গড়িয়ে পড়ল বলে ..স্টেজের আলোতে চিক চিক করেছে যেন I এবার বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি I ভেজা চোখ তুলে আমার দিকে চাইল সে -
- মানুষ এত নিষ্টুর হয় কেনরে ৷ I কেন এই সমতার অভাব ? জানিস,বাসের সেই ছেলেটা আজ আমায় আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়িয়ে দিলো...এক সময় ওই রকমটা কেটেছে আমার I৷ খাবার ছিল না..,, পকেটে পয়সা ছিল না, দোরে দোরে ভিক্ষা করে বেড়িয়েছি ৷I কেউ ছিল না আমার ৷I বাবা মাকে হারিয়েছি হিলি বর্ডারে , যখন বাংলাদেশের সঙ্গে গুলি গোলা চলছিল ....রাজনৈতিক মতনৈক্য দুই দেশের ভেতরে ...মরলো কিছু নিরপরাধ লোকজন ৷ I বাবা মা গিয়েছিলেন সেখানে এক কাকার বাড়িতে...আমাকে রেখে গিয়েছিলেন মাসিমার বাড়িতে ,খাদিমপুর পাড়ায় I আর ফিরে আসেন নি তারা....এমনকি আমি তাদের আর চোখের দেখাও দেখতে পাইনি আমার বয়েস তখন ওই ছেলেটার মতন হবে I তারপর সংগ্রাম. আর সংগ্রাম ..জীবনের অর্থ কিছু ছিল না আমার কাছে ..যেমনটা হয় রুপোলি পর্দার গল্পের মত ৷ I কি করেছি...আর কি করিনি আজ আমার আর মনে নেই I মনে করতে চাইলে মনেও পড়ে না আর....মনে করতেও চাইনে এখন আমিI৷ শুধু মনে পড়ে.........মনের ভেতরে...মনের আধারে গান ছিল I সুরের মায়াজাল মনের ভেতরে কি এক অপার শান্তি বিস্তার করতো......................
কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলো সে I দেখলাম চেহারাটা অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে ..বোধহয় কথা গুলো বলতে পেরে I আবার আমার হাতটা টেনে নিল হাতে বল্লে ...
- স্থান কাল, না বিচার না করে শুধু সুরের সাধনা করেছি আর মনে রেখেছি এক অদ্ভুদ প্রতিবাদের জ্বালা ..অন্যায় বা অনাচারের বিরুধ্যে I
দেখ ভাই , আমি তো আর তোমার মত লম্বা আর বলবান নয় যে দরকার পড়লে দুটো ঘা লাগিয়ে দিলাম আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ..........আমি মনকে জোর দিয়েছি, জুড়েছি কথা আর সুরের মোড়ে.......
আমি অবক হয়ে শুনছিলাম তার কথা ...এ কোন মানুষ ? কবে থেকে ঘুরছি তার সঙ্গে ..কোনো হদিস পানি তার..দেখছিলাম কেমন করে গুটিয়ে থাকে মানুষ তার নিজের খোলের ভেতরে I আবার যখন জল পায় কেমন নিজেই আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে ..কি তোমার খেলা হে অন্তর্যামী ...হঠাট এক শব্দে বাধা পরলো আমার চিন্তাধারা ..
- এই যে স্যার ..আসুন..দয়া করে.. সেই ঘোষক এসে প্রায় তাকে টেনে তুলে নিয়ে যায় আরকি I
গল্পটা ছেদ পড়ল বলে দুঃখ হলো মনে...সে ষ্টেজে উঠলো ...হাত তালিতে গম গম করে উঠলো সমস্ত আসর i অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম আজ....সে সাধারণত বসে এবং নিজে যন্ত্রের সঙ্গে গান গায়...i আজ দেখলাম সে মাইকম্যানকে ডেকে কি যেন আদেশ দিলো I স্টেজ ঠিক দু মিনিটের মধ্যে সাজিয়ে দিলো তারা....সে মাইক হাতে নিয়ে আজ প্রথম গাইল...আজ তার মুখে এক নতুন গান শুনলাম I জানি কথা তার মনে লেখা..সুর তো তার মনের ভেতরে কবে থেকে গুমড়ে গুমড়ে প্রকাশের অভাবে কাঁদছিল ........... আজ বাঁধ ভাঙ্গা জলের মত সে গাইলো........
ওরে মন..যা জেনে যা...
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়
প্রতিবাদে কর প্রতিভূ জয় I
ওরে মন..যা জেনে যা...
দিস না ছেড়ে নিজের আশা
বাঁধিস না ভয় মনে বাসা I
ওরে মন..যা জেনে যা...
দেখবি রে তোর জয়ের ধ্বজা
আকাশে উড়ে দশ ভুজা I
ওরে মন..যা জেনে যা........
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়
প্রতিবাদে কর প্রতিভূ জয় I
ওরে মন..যা জেনে যা........
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন