২৯ জানু, ২০১৪

শ্রীশুভ্র

স্বাধীনতার অষ্টপ্রহর
শ্রীশুভ্র



বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারতের পথচলা সাতদশক অতিক্রমের পথে! মধ্যবর্তী সময়ে নানান ঘটনার ঘনঘটার ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষ আধুনিক যুগে পা রেখে দাঁড়িয়ে! কিন্তু প্রশ্ন জাগে আমরা ভারতীয়রা কতটা আধুনিক হতে পেরেছি? পেরেছি কি স্বাধীনতার মর্য্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে? পেরেছি কি আধুনিক উন্নত বিশ্বের সমগোত্র হয়ে উঠতে! বিশ্বসভায় তাদের সাথে একাসনে বসতে? পরিসংখ্যানতত্ব অনুযায়ী হয়ত পারিনি! কিন্তু ভেবে দেখার সময় এসেছে না পারার মূল কারণগুলি ঠিক কি কি? বিশেষ করে এই একই সময়সীমায় চীনের তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত প্রভূত উন্নতি! যুদ্ধ বিদ্ধস্ত জাপানের বিস্ময়কর ঘুরে দাঁড়ানো! প্রভৃতি বিষয়গুলি আমাদের যথেষ্ট অস্বস্তি দেয় না কি?

স্বাধীনতার স্বরূপ ও বিকাশ সকল দেশেই একভাবে সম্ভব হয় না! হয়ওনি! অন্তত ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই সেটা অনুধাবন করা অসম্ভব নয়! কিন্তু তবু ভারতবর্ষের মতো সুপ্রাচীন এবং উন্নত সভ্যতার একটি দেশ সম্বন্ধে আশার মাত্রাটি তীব্র হওয়ারই কথা! বিশেষ করে ভারতবর্ষ এবং চীনের প্রাচীনত্বের ঐতিহাসিকতা প্রায় সমান্তরাল যেখানে! আর ঠিক এই জায়গাতেই অনুসন্ধান করা প্রয়োজন কোন কোন বিষয়ে আমাদের দূর্বলতা রয়ে গিয়েছে আজও! যে যে বিষয়গুলি আমাদের কাম্য সমৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রবলভাবে! দূর্ভাগ্যের বিষয় ভোট সর্বস্ব রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে আমাদের অবস্থা হয়েছে, থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোরের মতোই!

বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট, এটি একটি দেশ নয়! অনেক দেশের সমাহার! বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার শাসন ও শোষনের সুবিধার্থে ভারতবর্ষকে একটি শাসনতন্ত্রে বেঁধে ছিল! এই যে এত বিভিন্ন জাতি সংস্কৃতি ভাষা সমন্বিত এতগুলি দেশ মিলে ভারতবর্ষ, তাকে একটি সাধারণ শাসনতন্ত্রের অধীনে একটি দেশের রূপ দিলে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় জাতীয়তাবাদী স্বরূপটি ঠিকমতো গড়ে উঠতেই পারে না! বিশ্বে কোনো কালেই এমন নজীর নেই কোথাও! ফলে সবাই যে যার আখের গুছিয়ে নিতেই ব্যস্ত! যে কোনো দেশ একজাতি এক সংস্কৃতি এক ভাষা না হলে, তার কোনো জাতীয়তাবাদী দেশীয় চরিত্র গড়ে ওঠে না! এটাই ভারতবর্ষের মূল প্রতিবন্ধকতা!

জাতীয়তাবোধের এই উৎসরণ ব্যাতীত স্বাধীনতার সুফল দেশের সর্ব শ্রেণীর জনগণের জন্য সুনিশ্চিত করা যায় না! যেতে পারে না! বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশগুলির উন্নয়ণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বাজাতির প্রতি প্রীতি ও ভালোবাসাই দেশীয় উন্নতির ভিত্তি সরূপ! আর সেই স্বাজাত্য প্রেমই পারে গোটা জাতিকে এক সূত্রে বেঁধে রাখতে! ঠিক এইখানেই পিছিয়ে পড়েছে ভারতবর্ষ! এতগুলি স্বতন্ত্র জাতি তাদের স্বাতন্ত্রতা অতিক্রম করে ভারতীয় জাতীয়তার মোহ কল্পনায় ঐক্যবদ্ধ হবে, সে নেহাতই কষ্টকল্পনা! স্বভাবতঃই তা হয়ওনি! আর সেই একতাবোধের অভাবেই ভারতীয় জাতিসমূহে দূর্নীতির প্রাদুর্ভাব! দুঃখের বিষয়, এই সরল সত্যটি আমরা আজও বুঝি না!

স্বাধীনতার পর গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে এই যে দূর্নীতির ব্যাপক বিকাশ তার মূলে এই কারণগুলিই মূল নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে! একদিকে দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অন্যদিকে এক শ্রেনীর বিত্তশালীর হাতে দেশের সম্পদের উপর একচ্ছত্র অধিকার! আর সেই অধিকার চর্চার জন্যই সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা! দেশের সার্বিক বিকাশের পক্ষে যা প্রধান অন্তরায়! ফলে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সহ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি আজও সুরক্ষিত নয়! আজও প্রতিটি ভারতীয়র শিক্ষার অধিকার, সুস্বাস্থের অধিকার, জীবিকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সুরক্ষিত নয়! সামাজিক সুরক্ষার ধারণা এদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি! গড়ে ওঠেনি নাগরিক দায়িত্ব ও কর্ত্তব্যবোধের সুনিশ্চিত ধারণাও!

মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির পাশা খেলা স্বাধীন ভারতবর্ষের মূখ্য চরিত্র! যেহেতু কোনো জাতীয়তাবাদী চরিত্র গড়ে ওঠেনি স্বাধীন ভারতের পরিসরে, তাই রাজনৈতিক দলগুলির অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধ করার মতো উপযুক্ত শক্তি গড়ে উঠতে পারে না দেশের মর্মমূল থেকে! এটাই গ্রেট ইণ্ডিয়ান ট্র্যাজেডী! এবং এখানেই ভারতবর্ষের প্রধান দূর্বলতা! রাজনৈতিক দলগুলিকে হাত করে দেশীয় সম্পদের উপর বৈদেশিক স্বার্থের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা ঠিক এই কারণেই সহজ! বস্তুত বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদের ধূয়ো তুলে এই কাজটিই বর্তমানে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেচে! উন্নততর ভারতের নকল ফেস্টুনের আড়ালে!

ফলত স্বাধীন ভারতের প্রজাতন্ত্রদিবস যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল দেশের আপামর জনসাধারণের মনে, তা যে আজও অধরাই রয়ে যাবে, সে তো কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়! এটাই ঘটার ছিল! কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি করব? ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে এই অন্ধকার ভারতবর্ষই কি উপহার দিয়ে যাব? না কি আমাদের নাগরিক কর্ত্তব্য বোধের মানবিক তাগিদে, অন্ধকারের উৎসের দূর্বলতাগুলি দূর করে আমাদের সাধ্যমত আলো প্রজ্জ্বলনের প্রয়াসে সামিল হব যৌথ উদ্যোগের ঐক্যসূত্রে! সামাজিক পরিসর থেকে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সকল স্তরে এই বোধ সম্ভূত আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ না নিলে, ইতিহাস হয়তো আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না কোনোদিনই!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন