২৩ মে, ২০১৪

শ্রীশুভ্র

যখন সময় থমকে দাঁড়ায়
শ্রীশুভ্র


কোথায় যেন তাল কেটে গেছে জীবনের আটপৌরে ছন্দে। মাঝে মাঝেই ঠিক এমনই যেন মনে হয়। জীবন শুরুর যুগে সাধারণ ভাবেই বিশ্বাস আর ভরসার অনুভবটা অনেক সহজলোভ্য ছিল, কিন্তু প্রতিদিনের নিয়মিত ব্যস্ততায় এই দুটি অনুভবের অস্তিত্ব ক্রমশই যেন ফিকে হয়ে চলেছে। ব্যাক্তিগত সম্পর্কের সুতোগুল দিনে দিনে কতই আলগা হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক পরিসরে তার প্রভাব পরছে সুদূরপ্রসারী। কর্মক্ষেত্রের জগতে তো কথাই নেই, সন্দেহ আর সংশয় সাবধানে পা ফেলতে সাহায্যই করে এক দিক দিয়ে। কিন্তু এই যে সংশয় আর সন্দেহ, আমাদের রোজকার জীবনে ওতোপ্রতো ভাবেই জড়িয়ে আছে আমাদেরকে, আমাদেরকেই তা যেন ভেতরে ভেতরে দীর্ন করে দেয়, বিচ্ছিন্ন করতে থাকে অন্যদের কাছ থেকে। আর তখনই খুব একলা হয়ে পড়ি আমরা চলমান সমাজ জীবন থেকে।

কবি বলেছিলেন “বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো” আর আমরা চলেছি ঠিক তারই উলটো অভিমুখে। খুব গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, দাম্পত্য সম্পর্কই আমাদের জীবনের মূল ভরকেন্দ্র। যেখান থেকে পারিবারিক জীবনের পরিসর গড়ে ওঠে; সমাজজীবনের ভিত প্রস্তুত হয়। আর যে সমাজের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে রাষ্ট্রের কাঠামোটা। ফলে আমাদের ভালোমন্দ সবকিছুর পেছনেই দাম্পত্য সম্পর্কের একটা অভিঘাত আছেই। ফলে ব্যক্তিজীবনে এই সম্পর্কের প্রভাব আমাদের প্রকৃতিকে অনেক অংশেই নিয়ন্ত্রণ করে। এই সম্পর্কের সুস্থতা আমদের বিশ্বাসী হতে সাহায্য করে। উল্টোটা ঘটলেই আমরা সবকিছুর সম্বন্ধেই বড়ো বেশি সন্দিহান হয়ে পড়ি। যে সন্দেহ আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। আমদেরকে সবকিছুর সম্বন্ধেই সংশয়াতুর করে তোলে, কোনোকিছুর উপরেই যেন আর ভরসা রাখতে পারি না। আর তখনই কবির কথা মতো সকলের সাথে চলার যে অভিমুখ, সেটাই গড়ে ওঠে না আমাদের সমাজজীবনের পরিসরে ব্যক্তিজীবনের দোটানায়। ঠিক তখনই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকি চলমান জীবনের মূলস্রোত থেকে।

কিন্তু কেন এই সংশয়, এই সন্দেহ? বিশ্বাস আর ভরসার এই একান্ত অভাব আমাদের ব্যক্তিজীবনের পরিসরে? কেন এত দোটানায় ভুগতে হয় আমাদেরকে? কেন পারি না নিঃসংশয় হতে নিজেরই প্রিয়তম মানুষটির সম্বন্ধে? আসলে আমরা আমাদের অহং আর লোভের প্রবৃত্তিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকি অধিকাংশ সময়েই। তাই সবসময়ই সভয়ে থাকি এই বুঝি আমার সব হারিয়ে গেল। এই বুঝি আমার ভাগে আমার প্রাপ্যটুকু কম পড়ল বিশেষ করে। এই বুঝি আমার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হতে হল আমাকে, এই বুঝি ঠকে গেলাম আমিই। অথচ ভেবে দেখিনা আমরা নিজেরা কতটা ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পেরেছি অন্যের, কতটা নিঃসংশয়ে রাখতে পেরেছি আর একজনকে। আর সেইটি করতে গেলে নিজের যে অহংটিকে বিসর্জন দিতে হয়, নিজের যে লোভগুলির অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে হয় নিজেকে; সে সম্বন্ধে কোনোই হূঁশ থাকেনা আমদের নিজেদেরই।

ঠিক তখনই অন্যের স্বাধীনতাতেই সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত থাকি আমরা। খর্ব করতে চাই অপরের স্বাধীনতার পরিসরটিকেই। আশা করি তাহলেই বুঝি কোনভাবে ঠকে যাওয়ার হাত থেকে পরিত্রাণ পাব। আমার ইচ্ছাদীন করে রাখতে চাই আর একজনকে, হয়ত সবচেয়ে যাকে ভালবাসি বলে দাবী করি, তাকেই এই ভাবে নিজের আয়ওত্তাধীন রাখার মধ্যেই নিশ্চিন্তি খুঁজি আমরা। ঠিক এইভাবেই নিজের অজান্তেই নিজের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরটিকে সংশয়াচ্ছন্ন করে তুলি আমাদেরই অহং আর লোভের প্রবল তাড়নায়। পারস্পরিক বিশ্বাস আর ভরসার সুতগুলো এভাবেই আলগা হতে থাকে দাম্পত্যের পরিসরে, যার প্রভাব পরে পরিবারের অন্যন্য সম্পর্কগুলির উপরেও। সমাজের ঘরে ঘরে যখনই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখনই আলগা হয়ে পড়ে সমাজের ভিতটাই। রাষ্ট্রও বাদ যায় না এর প্রভাব থেকে। আর সেই সামগ্রিক অবিশ্বাসের বাতাবরণে, সংশয়ের অন্ধকারে জীবনের সব আনন্দই যেন ম্লান হয়ে ধরা পরে মনের আয়নায়। তখনি আমরা ক্রমশই একলা হতে থাকি আমাদের পরিপার্শ্ব থেকে। তখনি মনে হয় কোথায় যেন তাল কেটে গেছে জীবনের আঙ্গিনায়। সমাজের সর্বস্তরেই যখন এই ঘটনা ঘটতে থাকে, তখন স্বভাবতই সৃষ্টি হয় এক সামাজিক অবক্ষয়ের। যার সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়ে শিশু কিশোরদের বেড়ে ওঠার উপরে। ফলে তাদের প্রকৃতির বিকাশই হতে থাকে এক সংশয়দীর্ণ অবিশ্বাসের বাতাবরণের মধ্যে দিয়ে। এইভাবেই দূর্বল হতে থাকে মানুষের সাথে মানুষের স্বাভাবিক প্রীতির পরিসরটুকুও। পারস্পরিক সৌজন্য বিনিময়ের হাসিটুকুও আর অম্লান থাকে না, থাকে না তাতে প্রাণের আন্তরিক ছোঁয়াটুকুর সম্প্রীতির পরশ। কেবলই লৌকিক কৃত্তিমতার খোলসে ঢুকে পড়ি আমরা প্রত্যেকেই। প্রানের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ অবরুদ্ধ করে আমরা কেবলই অভিজ্ঞতার তিক্ততায় জীবনের ছন্দকে উষর করে তুলি। হয়ত আধুনিক সভ্যতার এটাই বাস্তব ফলশ্রুতি। কিন্তু এখান থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। তবে তাদের জন্য একটা প্রথমিক পথের হদিশ রেখে যেতে হবে কিন্তু আমাদেরকেই, নয়ত অসম্ভব হবে তাদের পক্ষে স্রোতের উলটো অভিমুখে দাঁড় টানা। আর তখন সময় শুধুই থমকে দাঁড়াবে না, ব্যর্থ করে তুলবে মানুষের মূল অভিপ্রায়কেই, যেখানে মানুষের বড়ো পরিচয় মনুষত্যের উদবোধনেই।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন