২৩ মে, ২০১৪

শম্পা বসু

লুপ্তরত্ন
শম্পা বসু


নববর্ষ-নতুন বছর। পুরাতনকে ভুলে গিয়ে নয় তবে অবশ্যই নতুন আশা-আকাঙ্খার ভেলায় চেপে বসা। তবে স্মৃতি এক নাছোড়বান্দা, কাপড়ের খুঁট ধরে টানে।

পয়লা বৈশাখ – বাংলা বছরের প্রথম দিন । ছোটবেলায় স্কুলে “গ্রীষ্মকাল” নিয়ে রচনা লিখতে দেওয়া হত। গুরুজনদের কাছে শুনেছিলাম রচনার মধ্যে উদ্ধৃতি দিলে দিদিমণিরা নাকি বেশি নম্বর দিয়ে থাকেন। তাই খুব মনোযোগ দিয়ে মুখস্থ করেছিলাম , ‘এসো হে বৈশাখ , এসো এসো , তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’-- এই মুমূর্ষু বানান শিখতে কম মেহনত করতে হয়েছে? বার বার যখন ভুল হবার উপক্রম, তখন মা-ই শিখিয়েছিলেন সহজ রাস্তা । দুপাশে হ্রস্ব – উ , মাঝখানে দীর্ঘ ঊ । এখন আমি ছাত্রীদের শেখাই মুমূর্ষু বানান। যাই হোক, বৈশাখ মাস মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব , পঁচিশে বৈশাখ – রবীন্দ্র জন্মলগ্ন, কাজেই বৈশাখ মাস এলেও মনে বসন্তের রেশটা থেকেই যেত যেন । একদিকে দর্জির দোকানের ছিটের জামার আনকোরা নতুন গন্ধ, তখন তো আর ‘ড্রেস মেটেরিয়াল’ চলতি ছিল না, আড়াই তিন মিটারের ছিটের কাপড়ে তৈরি নতুন জামা পড়েই যার – পর – নাই খুশি আর রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের অনুশীলন। সে এক অনাবিল উত্তেজনা, আনন্দের অনুভব-- এই নিয়েই কেটেছে ছেলেবেলা।

কিশোরী বয়সে আর এক অনুভব । আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে পয়লা বৈশাখের দিন একটা রঙ্গিন ক্রোড়পত্র, নতুন সব সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটছে, লেখার প্রতি একটা আগ্রহ গড়ে উঠছে ক্রমশ। মনে পড়ে, সেই পত্রিকা মা’র হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তোষকের তলায় (তখন কার্ল অন প্রচলিত ছিল না) লুকিয়ে রাখা , দুপুরের অবসরে কোন এক মহানুভবতায় মায়ের হাতে তা তুলে দেওয়া আর সন্ধ্যাবেলায় বাবা নয়, মায়ের সঙ্গেই ভাইকে নিয়ে হালখাতার নিমন্ত্রণ রক্ষা করা। আসল লক্ষ্য ক্যালেন্ডারে নয়, মিষ্টির প্যাকেটে; দু তিনটে দোকান ঘুরে একটা করে আইসক্রিম খেয়ে সন্ধ্যের দিকে বাড়ি ফিরে আসা । মা’র কাছে জেনেছিলাম কেউ নিমন্ত্রণ করলে তা রক্ষা করতে হয় । স্থূল জগতের প্রতি আকর্ষণ গড়ে ওঠেনি তখনো ।

বিবাহোত্তর জীবন। আর পাই না ক্রোড়পত্রটা হস্তগত করতে । বাড়িতে অনেক সদস্য সংখ্যা । পড়ুন বা না পড়ুন, সেটা থাকতো শাশুড়িমা বা ভাসুর ঠাকুরের জিম্মায়। দিনের শেষে কিংবা পরের দিন যখন তা হাতে পেতাম, তার মধ্যে আর থাকতো না পয়লা বৈশাখের সকালের সেই ওম , সেই সদ্য গরম কাগজের গন্ধ । তবে এর অন্য একটা দিকও ছিলো। শাশুড়ি মা যখন হাতে একটা নতুন শাড়ি দিয়ে বলতেন , আজকের দিনে এটা একটু গায়ে ঠেকাবি , তখন দূর থেকে অনুভব করতাম আমার মায়ের সেই মমতার স্পর্শ; ভাই, বাবার জন্যে মন কেমন করে ওঠা । দিন যায়, বছর গড়ায়। হালখাতার দিনে কোন কোন বছর স্বামী হাতে করে এনে দেন স্বর্ণ সম্পদ । আস্তে আস্তে লক্ষ্য করতে থাকি প্রত্যাশা কেমন যেন বেড়েই চলেছে । কাগজে সোনার গয়নার রঙ্গিন বিজ্ঞাপনে চোখ চলে যায় অজান্তে, পরক্ষণেই ভাবি ,এত লোভ , স্থূলতা এল কোথা থেকে? ছোটবেলার সেই কিশোরী মেয়েটি বদলেই গেল নাকি! জীবনের সূক্ষ্ম তারগুলো একেবারেই কি ছিঁড়লো? আবার ভাবি, সবাই যে বলে , মেয়েদের তো শাড়ি গয়নার ওপর অমোঘ আকর্ষণ। তখন তাকেই জীবনের ধর্ম বলে মেনে নিয়ে অন্য পাতায় চোখ রাখি। আরে, লোভের আকর্ষণ তো খবরের কাগজের পাতায় পাতায়! ‘ষোল আনা বাঙালি’ , ‘তের পার্বণ’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ভজহরি মান্না’ হারিয়ে যাওয়া বাঙালি পদ নিয়ে আহ্বান করছে সাড়ম্বরে । আমরা বড়রা,সেই খাদ্য গ্রহণে উদ্যোগ আয়োজন করলেও ছেলে মেয়েরা বাদ সাধে । ও, পরবর্তী প্রজন্ম যে। তাদের কাছে তো পয়লা বৈশাখ একটা পার্বণ নয় , একটা উৎসব । বিশ্বায়ন ঘটে গেছে । তাই তারা খোঁজে চাইনিজ অথবা মোগলাই । তাই মোচা-থোড়-পাবদা মাছ নয় , চল ‘মেনল্যান্ড চায়না’ অথবা ‘ওহ ক্যালকাটা’। অতঃপর হালখাতার ভিড় ঠেলতে ঠেলতে চল পয়লা বৈশাখ উদযাপনে । ওঃ , বাংলা সালটা মনে আছে তো? কেউ যদি জিজ্ঞেস করে বসে!

আর একটা জিনিস বাদ পড়ে গেল যে ! সকাল থেকে , এমনকি আগের দিন রাত বারোটার পর থেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস বাংলা নববর্ষের ; আর যত বেলা বাড়তে থাকে , লাইকের পরিমাণও বাড়তে থাকে ততটাই। যার স্ট্যাটাসে যত বেশি ‘ লাইক’, ভেতরে ভেতরে তার গর্ববোধ ততই বাড়তে থাকে ‘দেখেছ, আমার সোশ্যাল নেটওয়ার্ক কত জোরালো’ । আর সেলিব্রেটি হলে তো কথাই নেই।

বড়দের প্রণাম জানানো উঠেই গেল বোধহয় । টাচ স্ক্রীন মোবাইলে একটা এস-এম-এস ছুঁড়ে দিলেই তো কেল্লা ফতে। কম্পিউটার আপডেট করতে থাকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া অনুভূত হয় । বেচারা সহস্রাধিক টাকার জামা পড়ে জানতেই পারলো না ছিটের জামারও একটা সুঘ্রাণ আছে , পয়লা বৈশাখ মানে যে কাঁচা আমের সুবাস আর রবীন্দ্র জয়ন্তী – তাও সেভাবে টের পেল না , সোনু নিগম ,এ , আর ,রহমত-ই যে সঙ্গীত জগতের গুরু , সেই ভেবেই আনন্দে বিভোর , আর সসে ডোবানো চিলি চিকেন আর সেঁকা কাবাবের কারসাজির আড়াল থেকে প্রাণ কাড়া ছ্যাঁচড়ার গন্ধ আর কচি পাঁঠার ঝোলের সুদূর ডাক তেমন করে অনুভব করল কই? কবির কথাটাই যেন বড় বেশি সত্য হয়ে দাঁড়ায় “মাথার মধ্যে দৃশ্য নানা /স্মৃতির মধ্যে অজস্র ফুল / তার সুবাসেই দেখতে পাচ্ছি বুকের কাছে”।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন