১০ এপ্রি, ২০১৩

ছোটগল্প - মানস বিশ্বাস

মরণদশা
মানস বিশ্বাস


সাতসকালে লতিকার কান্নায় অনেকেই আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এসেছে, কিন্তু কান্নার কারনটা এখনও কেউ জানেনা. অনেকে অনেক রকম অনুমান করছে এবং সেইমত ঘাড়টা নীচু করে পার্শ্ববর্তী বা পার্শ্ববর্তিনীকে ফিসফিস করে নিজের ধারণাটা যে সঠিক সেটা বোঝাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কারো ধারনাই কারো কাছে গ্রহনযোগ্য হচ্ছেনা. এমনসময় লতিকা আরো একবার জোরে ডুকরে কেঁদে উঠে বিলাপ করে বললো

-“আমি আর বাঁচবো না – আ-আ- “

উপস্থিত জনতা লতিকার অনেক রকম বিপদ বা ক্ষতির আশঙ্কা করলেও তার জীবন সংশয় নিয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না.লতিকা মধ্যবয়সী একজন গৃহবধূ,শরীরে কোন রোগবালাই নেই, অন্তত এতদিন পর্য্যন্ত কোন উপসর্গের কথা কেউ শোনেনি.স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে স্বচ্ছল সংসার.অতএব তার না বাঁচার আশঙ্কা তো উদ্বেগজনক বটেই.

ক্রমাগত সকলের প্রশ্নের একটু পরে লতিকা সাশ্রুনয়নে শুধু বললো,

-“আমি যে মোষের স্বপ্ন দেখেছি, আমি আর বাঁচবো না. ”

মোষ যে মৃত্যুদেবতা যমরাজের বাহন, একথা সবাই জানে, তাই এরপর প্রায় সকলেই তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজার করে দিতে লাগলো এবং অনতিবিলম্বে সকলেই একমত হল যে ,হ্যাঁ,স্বপ্নে মোষ দেখা মানে মৃত্যু অনিবার্য্য. মোষের স্বপ্ন দেখে একসপ্তাহ থেকে দশদিনের মধ্যে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, দেখা গেল সে সম্বন্ধে প্রায় সকলেরই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা আছে. ওদের কথা শুনে লতিকার মনে হল, একসপ্তাহ না,মৃত্যুদূত বুঝি এখনই ওর শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে.

ভীড়ের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এসে বললো,

-“মোষের স্বপ্ন দেখলে মৃত্যু হয় একথা সত্যি কিন্তু তা থেকে বাঁচার একটা রাস্তাও তো আছে”

কথাটা শুনে লতিকা অশ্রুসজল চোখে নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইলো, আর উপস্থিত জনতা সরবে একযোগে জানতে চাইলো, কি সেই রাস্তা?

-“মোষের স্বপ্ন দেখলে যেমন মৃত্যু হয় আমরা জানি, তেমনি কোন জীবিত লোকের মৃত্যুসংবাদ যদি ভুলবশত প্রচার হয়ে যায় তবে সেই ব্যক্তির পরমায়ূ বেড়ে যায় বলেও আমরা অনেকেই শুনেছি. আর মোষের স্বপ্ন দেখলে যে দোষ হয় সেটা কাটাবার উপায় হচ্ছে তোমার এমন কোন বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছে তোমার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দেওয়া যে তোমাকে খুব ভালোবাসে আর এখান থেকে দূরে থাকে. প্রিয়জনের উদ্বেগ এবং চোখের জলে যে আন্তরিকতা থাকে সে শক্তিই তোমাকে আবার নবজীবন দান করবে.আমি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এমন ঘটনা জানি”.

মুমূর্ষ রোগীকে অক্সিজেন দিলে যেমন চাঙ্গা হয়ে ওঠে, লতিকাও নিমেষের মধ্যে সেরকম চাঙ্গা হয়ে উছে বললো,

-“তা হলে আমার ‘ছোট-জা’ কে শিগ্গীর খবর পাঠাও যে আমি মরে গেছি.‘ছোট-জা’ যখন এখানে ছিল তখন ও যে আমার কি ন্যাওটা ছিল, সে আর কি বলব! আমার ছোট দেওর যখন ট্রান্সফার হয়ে জব্বলপুর চলে যায়, তখন যাবার সময় আমার জায়ের সে কি কান্না! এখানে আমরা ঠিক দু’বোনের মত ছিলাম, আবার বন্ধুর মতও-“

কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে ভদ্রলোক বললেন,

-“তাহলে তোমার জায়ের ঠিকানাটা দাও, আমি আজই একটা পোষ্টকার্ড ছেড়ে দিচ্ছি, ---“

-“না, না, চিঠি যেতে যেতে আমি মরে যাবো, তার চেয়ে ওদের পাশের পাশের বাড়ীতে ফোন আছে, সেখানে একটা ফোন করে দিন.”

ভদ্রলোক নাম্বার নিয়ে ফোন করতে গেলেন, লতিকার কান্নাও বন্ধ হল.

আধঘন্টা পরে সেই ভদ্রলোক ফিরে এসে বললেন,

-তোমার ছোট জা তো সন্তানসম্ভবা, তাই এখন আসতে পারছে না, আর এজন্য বড্ড বেশী কাঁদছিল--- “

অতঃপর ভদ্রলোক যত তার জায়ের কান্নার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, ততই লতিকার মুখটা খুশীতে উজ্জ্ব হয়ে উঠছিল.

আসল কথাটা হল, বড় জায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে ছোট জা বলেছিল ,

-“ ইসস! আমার সাধভক্ষনের দিন বড়দি আমাকে একটা ভালো কাঞ্জীভরম শাড়ী দেবে বলেছিল, সেটা আর পাওয়া যাবে না. “

লতিকা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, এবং অল্পদিন পরেই পুরো ব্যাপারটা জানাজানিও হয়ে গেছে.অতঃপর, হাসাহাসির মধ্য দিয়েই মধুরেন সমাপয়েত.শুধু ছোটজায়ের সেদিনের উক্তিটা লতিকা আজও জানেনা.

বি.দ্র : এটা মোবাইল যুগের গল্প নয়.

1 কমেন্টস্:

moudasgupta বলেছেন...

bastob jiboner chalchitrer ek tukro chhobi jeno vese uthlo chokher samne.. sundar....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন