বাংলা ও বাঙালি!
শ্রীশুভ্র
নববর্ষ ১৪২০! কালের মাত্রায় নতুন বছর বাংলা ও বাঙালির জীবনে! বাংলা পঞ্জিকা মতে এক হাজার চারশত ঊনিশ বছর অতিক্রম করে বাঙালির নতুন বছরে প্রবেশ! যদিও বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস তারও পুরানো! ইতিহাসের পর্ব থেকে পর্বান্তরের পথরেখা ধরে গড়ে ওঠে দেশ জাতি ও জাতীয়তা!
বাংলার একটা অতীত আছে! আছে মহাভারতসম তার ইতিহাস! সেই ইতিহাসের পথরেখায় গড়ে উঠেছে বাঙালির জাতিসত্ত্বা! আর সেই জাতিসত্ত্বার সূত্রে আজকের খণ্ড বিখণ্ড বাংলা! বস্তুত এক বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার বিবর্তনে গড়ে ওঠা বাঙালির হাতে রূপ পেয়েছে আজকের খণ্ড বিখণ্ড এই বাংলা! বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির পাশে বাঙালি তৈরী করেছে এক অভুতপূর্ব জাতিসত্ত্বার মৌলিক পরিচয়!এক বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার প্রকৃতিগত চারিত্রিক বৈশিষ্টের মৌলিক বিন্যাসে গড়ে উঠেছে আজকের বাঙালি! যে কারনে ১৯৪৭ এর দেশভাগ! যে কারণে বাংলার নেই কোনো অখণ্ড মানচিত্র! যে কারণে বাঙালির নেই কোনো জাতীয় পরিচয়! পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির পরিচয় ভারতীয় হিন্দু এবং ভারতীয় মুসলিম হিসেবে! বাংলাদেশের বাঙালির পরিচয় বাংলাদেশী মুসলিম এবং বাংলাদেশী হিন্দু হিসেবে! ওদিকে ত্রিপুরার বাঙালি হিন্দু ও বরাক উপত্যাকার বাঙালি হিন্দুরাও নিজেদের ভারতীয় পরিচয়ের আশ্রয়েই অধিক স্বচ্ছন্দ! এবং এই বিভিন্ন গোষ্ঠীবদ্ধ বাঙালি মানস পরস্পরকে অনাত্মীয় জ্ঞানে পরস্পরের মধ্যে একটি স্বাভাবিক দূরত্বের, ব্যবধানের পার্থক্য সৃষ্টি করে রাখতে ভালোবাসে!
আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে একই মাতৃভাষা ও ভৌগলিক জলবায়ু এবং দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করেও রাজনৈতিক মানচিত্রের এই রকম খণ্ড বিখণ্ড বিভাজন সম্পূর্ণ অতুলনীয়! অভুতপূর্ব! এর কারণ বহুবিধ হলেও মূলগত বৈশিষ্ট নিহিত বাঙালির নৃতাত্বিক ঐতিহ্যে! সুবিখ্যাত গবেষক চিন্তাবিদ ডঃ আহমদ শরীফের মতে বাঙালি রক্তসঙ্কর জাতি! আনুমানিক সত্তর ভাগ অষ্ট্রিক, বিশভাগ ভোটচীনা, পাঁচ ভাগ নিগ্রো এবং বাকি পাঁচ ভাগ অন্যান্য রক্ত রয়েছে বাঙালি ধমনীতে! এই মিশ্ররক্তপ্রসূত স্বভাব সাঙ্কর্যই তাঁর মতে বাঙালির অনন্যতার কারণ! ফলে বাঙালির রক্তেই রয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব! তাই সে আজও বাঙালি জাতীয়তাবোধে দীক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি!
এই রক্তসাঙ্কর্য বাঙালিকে অভিন্ন জাতিসত্ত্বায় সংহত হতে উদ্বুদ্ধ করেনি! ফলে তার মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ গড়ে ওঠার কোনো স্বাভাবিক পরিসর কোনোদিনও ছিল না! ছিল না জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মানসিকতা! যে কারণে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন বৈদেশিক শাসনের অধীনে কেটে গিয়েছে বাংলার শত শত বছর! ফলে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন বৈদেশিক ধর্ম, সংস্কৃতি, ও ভাষা শাসন করেছে বাংলার জনমানসকে! এই অধীনতা আবার বাঙালির চরিত্রে স্বাধীন আত্মপ্রত্যয় সম্ভূত বাঙালি জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার পক্ষে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছিল! যে কারণে বাঙালির জীবনচেতনায় বৈদেশিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে!
বস্তুত বাংলার ইতিহাসের পটে পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেনদের হাত ধরেই বাংলার সহস্র বৎসর ব্যাপী পরাধীনতার সূচনা! এবং এই পর্বে যে তিনটি বিষয় বাংলার জাতিসত্ত্বায় যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে সেগুলি হল ক্রমান্বয়ে, বল্লাল সেনের আমলের বর্ণভিত্তিক হিন্দু ধর্মের জাতপাতের কড়াকড়ি! মুসলীম বিজয়ের প্রভাবে ইসলামের ব্যাপক প্রসার! বৃটিশের ডিভাই এণ্ড রুল পলিসির আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রতন্ত্রের পত্তন!এই তিনটি প্রভাবের ব্যপকতা এবং তীব্রতায় হাজার বছর ব্যাপী বঙ্গ জীবনে দেশীয় জাতীয়তাবোধের উন্মেষের কোনো সুযোগই ঘটেনি! ফলে বঙ্গজীবনে দেশীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ না হওয়ার কারণ শুধুই নৃতাত্বিক নয়!
বাংলায় দেশীয় জাতীয়তাবোধের উন্মেষ না ঘটার ঐতিহাসিক কারণগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল হিন্দুধর্মের বর্ণভেদ প্রথা! বংশ পরম্পরায় প্রবাহমান এই প্রথা সমজে শ্রেণী বিভাজনকে সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করে অর্থনৈতিক শোষণকে দৃঢ় ও চিরস্থায়ী করেছিল! উচ্চবর্ণের হিন্দুর আধিপত্যে নিম্নবর্গীয় জনসাধারণ বংশপরম্পরায় বঞ্চিত ও শোষিত হতে হতে দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করতে থাকে! এই দুই শ্রেণীর মধ্যে বর্ণহিন্দুদের সৃষ্ট এই দূরোতিক্রম্য ব্যবধান তখনই বাঙালিকে বিভাজিত করে রাখে দুই প্রান্তিক অবস্থানে! শত শত শতাব্দী ব্যাপী এই বিভাজন বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষের পক্ষে প্রথম অন্তরায় হয়ে ওঠে!
সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত শোষিত শ্রেণী পুরুষাক্রমে এই ভাবে বর্ণহিন্দুদের থেকে পৃথক জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়! এরপর মুসলীম বিজয়ের প্রভাবে এই শ্রেণীর বেশিরভাগ মানুষ ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বে আকৃষ্ট হয়ে দিনে দিনে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকলে বঙ্গসমাজ হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ে বিভক্ত হতে থাকে! ইসলাম গ্রহণ অর্থনৈতিক ভাবে তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটাতে না পারলেও ইসলামের সাম্য ও ভাতৃত্বের মধ্যে তারা মানসিক আশ্রয় লাভ করে! কিন্তু বর্ণহিন্দুদের সামাজিক আধিপত্য পুরুষানুক্রমে মুসলিম সমাজকে কোণঠাসাই করে রাখতে সক্ষম হয়, কারণ শিক্ষার অধিকার এবং পেশাগত সুযোগসুবিধে তাদের হাতেই রয়ে যায় বরাবর!
বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় পেশাগত ভাবে নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি বর্ণহিন্দুদের অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য বোধ ধর্মান্তরিত মুসলিম সমাজের সম্বন্ধেও সমান ভাবেই প্রবাহমান থাকে! বস্তুত বাংলায় এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্বের কারণ প্রথমত অর্থনৈতিক পেশাগত শ্রেণী বিভাজনজাত! তার সাথে বৈদেশিক ইসলাম ধর্ম ও তার সংস্কৃতির সাথে সনাতন বর্ণহিন্দু সংস্কৃতির বৈপরীত্য যোগ হয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথমাবধি কোনো আত্মিক সংযোগ সাধন হওয়ার সুযোগই ঘটেনি শতাব্দীর পর শতাব্দী! তবু এই দুই সম্প্রদায় স্ব স্ব গণ্ডীতে আবদ্ধ থেকেও পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করে দেয়!
দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কারণ ছিল মূলত তিনটি! ধর্মান্তরিত মুসলিম সমাজ ঐতিহাসিক ভাবেই বর্ণহিন্দু সমাজের আধিপত্যবাদকে পুরুষানুক্রমে তাদের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিল! এবং জীবন জীবিকার কারণে পেশাগত ভাবে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বর্ণহিন্দুদের উপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আগাগোড়া নির্ভরশীল ছিল!
এদিকে বিদেশাগত মুসলমান সাম্রাজ্যের কাছে রাজনৈতিক পরাধীনতার কারণে বর্ণহিন্দুদেরও মুসলিম সমাজকে মেনে নিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তিপূর্ণ সহবস্থান বজায় রাখতেই হয়েছিল! যদিও মুসলিম ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর বর্ণহিন্দুদের অর্থনৈতিক শোষণ চলতেই থাকে! ফলে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্ত্বার উন্মেষই ঘটল না!
বাংলার সমাজজীবনের এই রকম অবস্থানের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়ের মতোন তাণ্ডব নিয়ে এসে পড়ল প্রবল পরাক্রান্ত বৃটিশ! সুচতুর বৃটিশ যেহেতু মুসলিম সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করে দেশকে পরাধীন করল, তাই তাদের ডিভাইড এণ্ড রুল প্রয়োগ করে তারা মুসলিম সমাজকে রাজনৈতিক ভাবে ব্রাত্য করে বর্ণহিন্দুদেরকে, সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধেসহ অগ্রাধিকার দিতে থাকল! পত্তন হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের! যার সুযোগ গ্রহণ করে সেই বর্ণহিন্দুরাই জমিদার থেকে রায়বাদুর হয়ে উঠল! ওদিকে বাংলার মুসলিম সমাজ যে তিমিরে ছিল, পড়ে থাকল সেই তিমিরেই! বাংলার এই যুগান্তরের পর্বে আর একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল! বৃটিশের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা!
বৃটিশ শাসনের প্রথম যুগে কালাপানি পার হলে বর্ণহিন্দুদের গোবর খেয়ে শুদ্ধ হতে হতো! কিন্তু সেই বর্ণহিন্দুরাই সর্বপ্রথম বৃটিশ প্রবর্তীত আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী গ্রহণ করে! এর কারণও ঐতিহাসিক! বাঙালায় শিক্ষা ব্যবস্থার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ও অধিকার বর্ণহিন্দুদেরই কুক্ষিগত ছিল! যার সুযোগে সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের চর্চা করা সম্ভব হতো! কিন্তু বৃটিশ শাসন কালে ইংরেজী ভাষা ও বৃটিশের দেওয়া ডিগ্রী অর্জন না করলে সেই অধিকারগুলি বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছিল না! তাই তারা শুধু এই শিক্ষাপ্রণালী সাদরে বরণই করল না, অচিরেই বিলেত গিয়ে জাতে উঠতে থাকল! কিন্তু মুসলিম সমাজ বৃটিশের শিক্ষালয় থেকে দূরেই রয়ে গেল প্রথমে!
ফলে বর্ধিষ্ণু বাঙালি হিন্দুরা যখন বৃটিশের প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষায় নিজেদের যুগোপোযগী করে নিতে থাকল, একই সময় বাংলার মুসলিম সমাজের আর্থিক স্বচ্ছল শ্রেণী ধর্ম পুস্তকের মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রাখল! ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণহিন্দুরা দ্রুত এগিয়ে গেল! মুসলিমরা পড়ে থাকল মধ্য যুগীয় অন্ধকারে! এদিকে বর্ণহিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বৃটিশের তৈরী ভারতীয় রাষ্ট্রতন্ত্রে নিজেদের ভারতীয় বলে অনুভব করতে যতটা শিখল, বাঙালি বলে অনুভব করতে শিখল না ততটা! অন্যদিকে বাঙালি মুসলমান তার বাঙালিত্ব ভুলে ইসলামী হয়ে উঠতে স্বচেষ্ট হলো! এবং ভারতীয়তা আর হিন্দুত্ব সমার্থক ভেবে মুসলিম সমাজ ইসলামী জাতিসত্বায় বিশ্বাসী হল!
বাঙালি হিন্দু দিনে দিনে ভারতীয় হিন্দু হয়ে উঠল! বাঙালি মুসলিম আরবের ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মধ্যে নিজেদের শিকড় কল্পনা করে আত্মপ্রবঞ্চনাজাত আত্মপ্রসাদ লাভ করল! ফলে উভয় সম্প্রদায়ই তার মূল বাঙালি ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার বিস্মৃত হয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ব এবং পাকিস্তানী ইসলামী চেতনায় নিজেদের অস্তিত্বের নোঙর ফেলে পরস্পর পরস্পরের বিদেশী হয়ে উঠতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করল! অথচ আর্থিক অনগ্রসর শোষিত বঞ্চিত সমাজের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সামাজিক সহাবস্থান ও পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ তখনো বর্তমান ছিল! কিন্তু সমাজ নিয়ন্ত্রণের চালিকা শক্তি তাদের হাতে না থাকাতে বঙ্গসমাজ কার্যত সুস্পষ্ট ভাবেই দুই সমাজে বিভাজিত হয়ে থাকল!
এই প্রসঙ্গে এটাও স্মরণযোগ্য যে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণ মূলত বর্ণহিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল! তা বাংলার সর্বত্র সর্ব শ্রেণীর মধ্যে আদৌ পরিব্যাপ্ত হয়নি! এবং সেই নবজাগরণ ঘটে মূলত ভারতীয় হিন্দুদের আধুনিক যুগোপযোগী হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই! ফলে সেই নবজাগরণের সূত্রে বর্ণহিন্দুরা ভরতীয় হয়ে উঠে তাদের বাঙালিত্বকে করল গৌণ! পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বাঙালি দেশনেতরা ভারতবর্ষের কথাই ভেবেছেন! বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কথা তাদের চেতনায় উদয় হয়নি! মুসলিম নেতারাও ইসলামী জাগরণের তাগিদে তাদের বাঙালিত্বকে ভুলে পাকিস্তানপন্থী হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করলেন তাদের সম্প্রদায়কে! বাংলা হল উপেক্ষিত!
বাংলার দূর্ভাগ্য বাংলার কোনো মনীষী, দেশনেতাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি! তাঁরা একপক্ষ ভারতীয় ও অপর পক্ষ ইসলামী জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়ে বাঙালির সাম্প্রদায়িক বিভাজনকেই অনিচ্ছাকৃত মদত দিয়ে বাঙালিকে এক পক্ষে ভারতীয়তায় অন্য পক্ষে ইসলামী জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ করলেন! ফলে জাতীয়তা তাদের কাছে হয়ে উঠল স্বধর্মীর সংহতি মাত্র! ডঃ আহমদ শরীফের কথায়, "তাই বাঙালি হিন্দু শিক্ষিত হয়ে হিন্দু হয়েছে, মুসলিম হয়েছে মুসলিম- কেউ বাঙালি থাকেনি!" ১৯৪৭ এ বৃটিশ কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের চক্রান্তে বাংলাকে যখন দুখণ্ড করা হল, বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিভক্ত করা হল, তাতে দুঃখ করার কেউ রইল না!
"দেশ নয়, ভাষা নয়, গোত্র নয়, ধর্মই আজও বাঙালির জাতীয়তার ভিত্তি!" (ডঃ আহমদ শরীফ).
তাই দেশীয় জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতিসত্ত্বায় আজও অধরাই রয়ে গেল! বাঙালি মননে আজও ধরা পড়ল না যে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে দেশ গড়ে ওঠে না! জাতির উন্নতি ঘটাতে পারে না ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ! বাঙালি তিন শতাব্দী ধরে ইউরোপের অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত থাকল, অথচ ইউরোপীয় দেশগুলির অন্তরাত্মার চারিত্রশক্তির সন্ধান পেল না! অনুধাবন করল না তাদের বিপুল উন্নতির মূল চালিকা শক্তি দেশীয় জাতীয়তাবাদ যা গড়ে ওঠে দেশ মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে! ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে নয়! ইউরোপের ৯০% দেশই খৃষ্টান! তবু ইউরোপীয় দেশগুলির দেশীয় জাতীয়তা ভিন্ন! (17)
বঙ্গমনীষা এই মূলসত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ায় তার মূল্য দিতে হল বাংলাকে খণ্ডবিখণ্ড করে! জাতির অন্তরে আজও বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বা দেশীয় ও বাঙালি হয়ে উঠতে পারেনি! ইতিহাসের পথরেখায় বাঙালি আজ ভারতীয় আর বাংলাদেশী, হিন্দু আর মুসলমান! বাঙালি নয়! ইতিহাসের এই ধারা নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহমান! তাই বিশ্বের মানচিত্রে জাতি হিসেবে বাঙালি চতুর্থ বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠী হলেও, বিশ্ব রাজনীতিতে বাঙলা অপাংক্তেও! উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ সহ অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সর্ব বিষয়ে পশ্চাদ্বর্তী! দুঃখের বিষয় হলেও এটাই স্বাভাবিক পরিণতি! আজও বাঙালি তার এই বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে! কিন্তু অনুধাবন করছে না!
বাঙালি যত বেশি শিক্ষিত হয়েছে তত বেশিই সে বাংলার সমাজ জীবন থেকে, বাংলার আবহমান ঐতিহ্য থেকে, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে ক্রমাগত দূরবর্তী করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে! বস্তুত সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপধ্যায় তাঁর বাবু প্রবন্ধে শিক্ষিত বাঙালিদের ছবিটি নিখুঁত বর্ণনা করে গিয়েছেন! ফলে এই শিক্ষিত বাঙালি ক্রমেই সমাজ বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তি জীবনের বৈভব সন্ধানী হয়ে উঠেছে! বাঙালি হিন্দু, অবাঙালি ভারতীয়দের মধ্য নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে স্বচেষ্ট হয়েছে! বাঙালি মুসলমান মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের জাত ভাই হয়ে ওঠার চেষ্টায় প্রবল ভাবে ইসলামকে আকঁড়ে ধরার চেষ্টা করেছে! তাইতো গড়ে ওঠেনি বাঙালির জাতীয় ঐক্য!
আবার নববর্ষ পঞ্জিকার গণনার পথে বাংলার প্রভাত ছুঁয়ে উন্মুখ! উন্মুখ বাঙালির চেতনায় অখণ্ড দেশীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের প্রত্যাশায়! উন্মুখ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে উঠে বাঙালির জাতীয় ঐক্যের বাস্তবায়নের সহস্র বছরের সুপ্ত স্বপ্ন বিভরতায়! উন্মুখ বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে মিলনে! উন্মুখ বিশ্বসভায় আত্মমর্য্যাদায় আত্মপ্রতিষ্ঠার আশায়! উন্মুখ বাঙালির অস্তিত্বের সত্য মূল্যের পূর্ণ উদ্ভাসনে! কিন্তু বাঙালি তার সহস্র বৎসর ব্যাপী বিচ্ছিন্ন জাতিসত্বার নৃতাত্বিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণগুলিকে ব্যর্থ করে বাংলার এই আর্তিকে সত্য করে তুলতে পারবে কি আদৌ? এ শতাব্দীতে না হলেও আগামী শতাব্দীতে? আর এক নববর্ষে ???
নববর্ষ ১৪২০! কালের মাত্রায় নতুন বছর বাংলা ও বাঙালির জীবনে! বাংলা পঞ্জিকা মতে এক হাজার চারশত ঊনিশ বছর অতিক্রম করে বাঙালির নতুন বছরে প্রবেশ! যদিও বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস তারও পুরানো! ইতিহাসের পর্ব থেকে পর্বান্তরের পথরেখা ধরে গড়ে ওঠে দেশ জাতি ও জাতীয়তা!
বাংলার একটা অতীত আছে! আছে মহাভারতসম তার ইতিহাস! সেই ইতিহাসের পথরেখায় গড়ে উঠেছে বাঙালির জাতিসত্ত্বা! আর সেই জাতিসত্ত্বার সূত্রে আজকের খণ্ড বিখণ্ড বাংলা! বস্তুত এক বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার বিবর্তনে গড়ে ওঠা বাঙালির হাতে রূপ পেয়েছে আজকের খণ্ড বিখণ্ড এই বাংলা! বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির পাশে বাঙালি তৈরী করেছে এক অভুতপূর্ব জাতিসত্ত্বার মৌলিক পরিচয়!এক বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার প্রকৃতিগত চারিত্রিক বৈশিষ্টের মৌলিক বিন্যাসে গড়ে উঠেছে আজকের বাঙালি! যে কারনে ১৯৪৭ এর দেশভাগ! যে কারণে বাংলার নেই কোনো অখণ্ড মানচিত্র! যে কারণে বাঙালির নেই কোনো জাতীয় পরিচয়! পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির পরিচয় ভারতীয় হিন্দু এবং ভারতীয় মুসলিম হিসেবে! বাংলাদেশের বাঙালির পরিচয় বাংলাদেশী মুসলিম এবং বাংলাদেশী হিন্দু হিসেবে! ওদিকে ত্রিপুরার বাঙালি হিন্দু ও বরাক উপত্যাকার বাঙালি হিন্দুরাও নিজেদের ভারতীয় পরিচয়ের আশ্রয়েই অধিক স্বচ্ছন্দ! এবং এই বিভিন্ন গোষ্ঠীবদ্ধ বাঙালি মানস পরস্পরকে অনাত্মীয় জ্ঞানে পরস্পরের মধ্যে একটি স্বাভাবিক দূরত্বের, ব্যবধানের পার্থক্য সৃষ্টি করে রাখতে ভালোবাসে!
আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে একই মাতৃভাষা ও ভৌগলিক জলবায়ু এবং দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করেও রাজনৈতিক মানচিত্রের এই রকম খণ্ড বিখণ্ড বিভাজন সম্পূর্ণ অতুলনীয়! অভুতপূর্ব! এর কারণ বহুবিধ হলেও মূলগত বৈশিষ্ট নিহিত বাঙালির নৃতাত্বিক ঐতিহ্যে! সুবিখ্যাত গবেষক চিন্তাবিদ ডঃ আহমদ শরীফের মতে বাঙালি রক্তসঙ্কর জাতি! আনুমানিক সত্তর ভাগ অষ্ট্রিক, বিশভাগ ভোটচীনা, পাঁচ ভাগ নিগ্রো এবং বাকি পাঁচ ভাগ অন্যান্য রক্ত রয়েছে বাঙালি ধমনীতে! এই মিশ্ররক্তপ্রসূত স্বভাব সাঙ্কর্যই তাঁর মতে বাঙালির অনন্যতার কারণ! ফলে বাঙালির রক্তেই রয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব! তাই সে আজও বাঙালি জাতীয়তাবোধে দীক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি!
এই রক্তসাঙ্কর্য বাঙালিকে অভিন্ন জাতিসত্ত্বায় সংহত হতে উদ্বুদ্ধ করেনি! ফলে তার মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ গড়ে ওঠার কোনো স্বাভাবিক পরিসর কোনোদিনও ছিল না! ছিল না জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মানসিকতা! যে কারণে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন বৈদেশিক শাসনের অধীনে কেটে গিয়েছে বাংলার শত শত বছর! ফলে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন বৈদেশিক ধর্ম, সংস্কৃতি, ও ভাষা শাসন করেছে বাংলার জনমানসকে! এই অধীনতা আবার বাঙালির চরিত্রে স্বাধীন আত্মপ্রত্যয় সম্ভূত বাঙালি জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার পক্ষে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছিল! যে কারণে বাঙালির জীবনচেতনায় বৈদেশিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে!
বস্তুত বাংলার ইতিহাসের পটে পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেনদের হাত ধরেই বাংলার সহস্র বৎসর ব্যাপী পরাধীনতার সূচনা! এবং এই পর্বে যে তিনটি বিষয় বাংলার জাতিসত্ত্বায় যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে সেগুলি হল ক্রমান্বয়ে, বল্লাল সেনের আমলের বর্ণভিত্তিক হিন্দু ধর্মের জাতপাতের কড়াকড়ি! মুসলীম বিজয়ের প্রভাবে ইসলামের ব্যাপক প্রসার! বৃটিশের ডিভাই এণ্ড রুল পলিসির আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রতন্ত্রের পত্তন!এই তিনটি প্রভাবের ব্যপকতা এবং তীব্রতায় হাজার বছর ব্যাপী বঙ্গ জীবনে দেশীয় জাতীয়তাবোধের উন্মেষের কোনো সুযোগই ঘটেনি! ফলে বঙ্গজীবনে দেশীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ না হওয়ার কারণ শুধুই নৃতাত্বিক নয়!
বাংলায় দেশীয় জাতীয়তাবোধের উন্মেষ না ঘটার ঐতিহাসিক কারণগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল হিন্দুধর্মের বর্ণভেদ প্রথা! বংশ পরম্পরায় প্রবাহমান এই প্রথা সমজে শ্রেণী বিভাজনকে সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করে অর্থনৈতিক শোষণকে দৃঢ় ও চিরস্থায়ী করেছিল! উচ্চবর্ণের হিন্দুর আধিপত্যে নিম্নবর্গীয় জনসাধারণ বংশপরম্পরায় বঞ্চিত ও শোষিত হতে হতে দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করতে থাকে! এই দুই শ্রেণীর মধ্যে বর্ণহিন্দুদের সৃষ্ট এই দূরোতিক্রম্য ব্যবধান তখনই বাঙালিকে বিভাজিত করে রাখে দুই প্রান্তিক অবস্থানে! শত শত শতাব্দী ব্যাপী এই বিভাজন বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষের পক্ষে প্রথম অন্তরায় হয়ে ওঠে!
সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত শোষিত শ্রেণী পুরুষাক্রমে এই ভাবে বর্ণহিন্দুদের থেকে পৃথক জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়! এরপর মুসলীম বিজয়ের প্রভাবে এই শ্রেণীর বেশিরভাগ মানুষ ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বে আকৃষ্ট হয়ে দিনে দিনে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকলে বঙ্গসমাজ হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ে বিভক্ত হতে থাকে! ইসলাম গ্রহণ অর্থনৈতিক ভাবে তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটাতে না পারলেও ইসলামের সাম্য ও ভাতৃত্বের মধ্যে তারা মানসিক আশ্রয় লাভ করে! কিন্তু বর্ণহিন্দুদের সামাজিক আধিপত্য পুরুষানুক্রমে মুসলিম সমাজকে কোণঠাসাই করে রাখতে সক্ষম হয়, কারণ শিক্ষার অধিকার এবং পেশাগত সুযোগসুবিধে তাদের হাতেই রয়ে যায় বরাবর!
বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় পেশাগত ভাবে নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি বর্ণহিন্দুদের অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য বোধ ধর্মান্তরিত মুসলিম সমাজের সম্বন্ধেও সমান ভাবেই প্রবাহমান থাকে! বস্তুত বাংলায় এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্বের কারণ প্রথমত অর্থনৈতিক পেশাগত শ্রেণী বিভাজনজাত! তার সাথে বৈদেশিক ইসলাম ধর্ম ও তার সংস্কৃতির সাথে সনাতন বর্ণহিন্দু সংস্কৃতির বৈপরীত্য যোগ হয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথমাবধি কোনো আত্মিক সংযোগ সাধন হওয়ার সুযোগই ঘটেনি শতাব্দীর পর শতাব্দী! তবু এই দুই সম্প্রদায় স্ব স্ব গণ্ডীতে আবদ্ধ থেকেও পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করে দেয়!
দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কারণ ছিল মূলত তিনটি! ধর্মান্তরিত মুসলিম সমাজ ঐতিহাসিক ভাবেই বর্ণহিন্দু সমাজের আধিপত্যবাদকে পুরুষানুক্রমে তাদের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিল! এবং জীবন জীবিকার কারণে পেশাগত ভাবে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বর্ণহিন্দুদের উপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আগাগোড়া নির্ভরশীল ছিল!
এদিকে বিদেশাগত মুসলমান সাম্রাজ্যের কাছে রাজনৈতিক পরাধীনতার কারণে বর্ণহিন্দুদেরও মুসলিম সমাজকে মেনে নিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তিপূর্ণ সহবস্থান বজায় রাখতেই হয়েছিল! যদিও মুসলিম ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর বর্ণহিন্দুদের অর্থনৈতিক শোষণ চলতেই থাকে! ফলে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্ত্বার উন্মেষই ঘটল না!
বাংলার সমাজজীবনের এই রকম অবস্থানের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়ের মতোন তাণ্ডব নিয়ে এসে পড়ল প্রবল পরাক্রান্ত বৃটিশ! সুচতুর বৃটিশ যেহেতু মুসলিম সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করে দেশকে পরাধীন করল, তাই তাদের ডিভাইড এণ্ড রুল প্রয়োগ করে তারা মুসলিম সমাজকে রাজনৈতিক ভাবে ব্রাত্য করে বর্ণহিন্দুদেরকে, সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধেসহ অগ্রাধিকার দিতে থাকল! পত্তন হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের! যার সুযোগ গ্রহণ করে সেই বর্ণহিন্দুরাই জমিদার থেকে রায়বাদুর হয়ে উঠল! ওদিকে বাংলার মুসলিম সমাজ যে তিমিরে ছিল, পড়ে থাকল সেই তিমিরেই! বাংলার এই যুগান্তরের পর্বে আর একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল! বৃটিশের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা!
বৃটিশ শাসনের প্রথম যুগে কালাপানি পার হলে বর্ণহিন্দুদের গোবর খেয়ে শুদ্ধ হতে হতো! কিন্তু সেই বর্ণহিন্দুরাই সর্বপ্রথম বৃটিশ প্রবর্তীত আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী গ্রহণ করে! এর কারণও ঐতিহাসিক! বাঙালায় শিক্ষা ব্যবস্থার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ও অধিকার বর্ণহিন্দুদেরই কুক্ষিগত ছিল! যার সুযোগে সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের চর্চা করা সম্ভব হতো! কিন্তু বৃটিশ শাসন কালে ইংরেজী ভাষা ও বৃটিশের দেওয়া ডিগ্রী অর্জন না করলে সেই অধিকারগুলি বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছিল না! তাই তারা শুধু এই শিক্ষাপ্রণালী সাদরে বরণই করল না, অচিরেই বিলেত গিয়ে জাতে উঠতে থাকল! কিন্তু মুসলিম সমাজ বৃটিশের শিক্ষালয় থেকে দূরেই রয়ে গেল প্রথমে!
ফলে বর্ধিষ্ণু বাঙালি হিন্দুরা যখন বৃটিশের প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষায় নিজেদের যুগোপোযগী করে নিতে থাকল, একই সময় বাংলার মুসলিম সমাজের আর্থিক স্বচ্ছল শ্রেণী ধর্ম পুস্তকের মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রাখল! ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণহিন্দুরা দ্রুত এগিয়ে গেল! মুসলিমরা পড়ে থাকল মধ্য যুগীয় অন্ধকারে! এদিকে বর্ণহিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বৃটিশের তৈরী ভারতীয় রাষ্ট্রতন্ত্রে নিজেদের ভারতীয় বলে অনুভব করতে যতটা শিখল, বাঙালি বলে অনুভব করতে শিখল না ততটা! অন্যদিকে বাঙালি মুসলমান তার বাঙালিত্ব ভুলে ইসলামী হয়ে উঠতে স্বচেষ্ট হলো! এবং ভারতীয়তা আর হিন্দুত্ব সমার্থক ভেবে মুসলিম সমাজ ইসলামী জাতিসত্বায় বিশ্বাসী হল!
বাঙালি হিন্দু দিনে দিনে ভারতীয় হিন্দু হয়ে উঠল! বাঙালি মুসলিম আরবের ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মধ্যে নিজেদের শিকড় কল্পনা করে আত্মপ্রবঞ্চনাজাত আত্মপ্রসাদ লাভ করল! ফলে উভয় সম্প্রদায়ই তার মূল বাঙালি ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার বিস্মৃত হয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ব এবং পাকিস্তানী ইসলামী চেতনায় নিজেদের অস্তিত্বের নোঙর ফেলে পরস্পর পরস্পরের বিদেশী হয়ে উঠতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করল! অথচ আর্থিক অনগ্রসর শোষিত বঞ্চিত সমাজের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সামাজিক সহাবস্থান ও পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ তখনো বর্তমান ছিল! কিন্তু সমাজ নিয়ন্ত্রণের চালিকা শক্তি তাদের হাতে না থাকাতে বঙ্গসমাজ কার্যত সুস্পষ্ট ভাবেই দুই সমাজে বিভাজিত হয়ে থাকল!
এই প্রসঙ্গে এটাও স্মরণযোগ্য যে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণ মূলত বর্ণহিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল! তা বাংলার সর্বত্র সর্ব শ্রেণীর মধ্যে আদৌ পরিব্যাপ্ত হয়নি! এবং সেই নবজাগরণ ঘটে মূলত ভারতীয় হিন্দুদের আধুনিক যুগোপযোগী হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই! ফলে সেই নবজাগরণের সূত্রে বর্ণহিন্দুরা ভরতীয় হয়ে উঠে তাদের বাঙালিত্বকে করল গৌণ! পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বাঙালি দেশনেতরা ভারতবর্ষের কথাই ভেবেছেন! বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কথা তাদের চেতনায় উদয় হয়নি! মুসলিম নেতারাও ইসলামী জাগরণের তাগিদে তাদের বাঙালিত্বকে ভুলে পাকিস্তানপন্থী হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করলেন তাদের সম্প্রদায়কে! বাংলা হল উপেক্ষিত!
বাংলার দূর্ভাগ্য বাংলার কোনো মনীষী, দেশনেতাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি! তাঁরা একপক্ষ ভারতীয় ও অপর পক্ষ ইসলামী জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়ে বাঙালির সাম্প্রদায়িক বিভাজনকেই অনিচ্ছাকৃত মদত দিয়ে বাঙালিকে এক পক্ষে ভারতীয়তায় অন্য পক্ষে ইসলামী জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ করলেন! ফলে জাতীয়তা তাদের কাছে হয়ে উঠল স্বধর্মীর সংহতি মাত্র! ডঃ আহমদ শরীফের কথায়, "তাই বাঙালি হিন্দু শিক্ষিত হয়ে হিন্দু হয়েছে, মুসলিম হয়েছে মুসলিম- কেউ বাঙালি থাকেনি!" ১৯৪৭ এ বৃটিশ কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের চক্রান্তে বাংলাকে যখন দুখণ্ড করা হল, বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিভক্ত করা হল, তাতে দুঃখ করার কেউ রইল না!
"দেশ নয়, ভাষা নয়, গোত্র নয়, ধর্মই আজও বাঙালির জাতীয়তার ভিত্তি!" (ডঃ আহমদ শরীফ).
তাই দেশীয় জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতিসত্ত্বায় আজও অধরাই রয়ে গেল! বাঙালি মননে আজও ধরা পড়ল না যে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে দেশ গড়ে ওঠে না! জাতির উন্নতি ঘটাতে পারে না ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ! বাঙালি তিন শতাব্দী ধরে ইউরোপের অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত থাকল, অথচ ইউরোপীয় দেশগুলির অন্তরাত্মার চারিত্রশক্তির সন্ধান পেল না! অনুধাবন করল না তাদের বিপুল উন্নতির মূল চালিকা শক্তি দেশীয় জাতীয়তাবাদ যা গড়ে ওঠে দেশ মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে! ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে নয়! ইউরোপের ৯০% দেশই খৃষ্টান! তবু ইউরোপীয় দেশগুলির দেশীয় জাতীয়তা ভিন্ন! (17)
বঙ্গমনীষা এই মূলসত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ায় তার মূল্য দিতে হল বাংলাকে খণ্ডবিখণ্ড করে! জাতির অন্তরে আজও বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বা দেশীয় ও বাঙালি হয়ে উঠতে পারেনি! ইতিহাসের পথরেখায় বাঙালি আজ ভারতীয় আর বাংলাদেশী, হিন্দু আর মুসলমান! বাঙালি নয়! ইতিহাসের এই ধারা নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহমান! তাই বিশ্বের মানচিত্রে জাতি হিসেবে বাঙালি চতুর্থ বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠী হলেও, বিশ্ব রাজনীতিতে বাঙলা অপাংক্তেও! উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ সহ অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সর্ব বিষয়ে পশ্চাদ্বর্তী! দুঃখের বিষয় হলেও এটাই স্বাভাবিক পরিণতি! আজও বাঙালি তার এই বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বার অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে! কিন্তু অনুধাবন করছে না!
বাঙালি যত বেশি শিক্ষিত হয়েছে তত বেশিই সে বাংলার সমাজ জীবন থেকে, বাংলার আবহমান ঐতিহ্য থেকে, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে ক্রমাগত দূরবর্তী করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে! বস্তুত সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপধ্যায় তাঁর বাবু প্রবন্ধে শিক্ষিত বাঙালিদের ছবিটি নিখুঁত বর্ণনা করে গিয়েছেন! ফলে এই শিক্ষিত বাঙালি ক্রমেই সমাজ বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তি জীবনের বৈভব সন্ধানী হয়ে উঠেছে! বাঙালি হিন্দু, অবাঙালি ভারতীয়দের মধ্য নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে স্বচেষ্ট হয়েছে! বাঙালি মুসলমান মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের জাত ভাই হয়ে ওঠার চেষ্টায় প্রবল ভাবে ইসলামকে আকঁড়ে ধরার চেষ্টা করেছে! তাইতো গড়ে ওঠেনি বাঙালির জাতীয় ঐক্য!
আবার নববর্ষ পঞ্জিকার গণনার পথে বাংলার প্রভাত ছুঁয়ে উন্মুখ! উন্মুখ বাঙালির চেতনায় অখণ্ড দেশীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের প্রত্যাশায়! উন্মুখ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে উঠে বাঙালির জাতীয় ঐক্যের বাস্তবায়নের সহস্র বছরের সুপ্ত স্বপ্ন বিভরতায়! উন্মুখ বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে মিলনে! উন্মুখ বিশ্বসভায় আত্মমর্য্যাদায় আত্মপ্রতিষ্ঠার আশায়! উন্মুখ বাঙালির অস্তিত্বের সত্য মূল্যের পূর্ণ উদ্ভাসনে! কিন্তু বাঙালি তার সহস্র বৎসর ব্যাপী বিচ্ছিন্ন জাতিসত্বার নৃতাত্বিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণগুলিকে ব্যর্থ করে বাংলার এই আর্তিকে সত্য করে তুলতে পারবে কি আদৌ? এ শতাব্দীতে না হলেও আগামী শতাব্দীতে? আর এক নববর্ষে ???
3 কমেন্টস্:
annobaddyo ek informative lekha porlam, kato kichhu ajana yathyo je pelam, bhaba jaai na, aabar kichhu jana tathyokeo natun kore jante parlam...
অত্যন্ত মূল্যবান লেখা । বাঙালি জাতীসত্তার উন্মেষ, গঠন ও বিন্যাস সম্পর্কে অত্যন্ত নির্ভুল ও বিশ্বাসযোগ্য বিশ্লেষণ লেখকের । আমার বিশ্বাস লেখাটি এই পত্রিকার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে । শুভ্রর কবি পরিচয় ছাপিয়ে গেলো গদ্যকার শুভ্র ।
অসাধারণ ও মুল্যবান লেখা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন