১৩ এপ্রি, ২০১৩

প্রবন্ধ - প্রদীপ কুমার দাস

নাস্তিক ও সন্ন্যাসী
প্রদীপ কুমার দাস



দিনটি ছিল ১৫ই অক্টোবর ১৮৯২, বেলগাম শহরের নামকরা আইনজীবি সদাশিব বালকৃষ্ণা ভাটের অতিথি হয়ে এলেন এক যুবক সন্ন্যাসী। আগন্তুক সন্ন্যাসী নিজের পরিচয় জানিয়ে মহারাজা কোল্হাপুরের ব্যক্তিগত সচিব রাওসাহেব লক্ষ্মণরাও গোল্ভাল্কারের লেখা একটা চিঠি ভাটে সাহেবের হাতে দিলেন। ভাটে সাহেব তার বাড়িতে বেলগামের সব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এলেন, এই সন্ন্যাসীর দর্শন করার জন্য। ব্যতিক্রম একমাত্র তত্কালীন সাব ডিভিসানাল ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্র।

হরিপদ মিত্র বিশ্বাস করতেন সব সন্ন্যাসীরা ভন্ড এবং ঠগ, এরা প্রচন্ড কুঁড়ে, কোনো কাজ করতে নারাজ তাই এরা পেশা হিসাবে সন্ন্যাসকেই বেছে নেয়। ভাটে সাহেব হরিপদ বাবুর এই ধারণার কথা খুব ভালভাবেই জানতেন। কিন্তু, তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এই তরুণ সন্ন্যাসীর সঙ্গে যদি হরিপদবাবুর দেখা হয় তাহলে তার সন্ন্যাসী সম্বন্ধে সমস্ত ধারণা বদলে যাবে। ১৮ তারিখ সন্ধ্যাবেলা হরিপদবাবু তার বৈঠকখানায় এসে দেখেন ভাটে সাহেব এক তরুণ সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ভাটে সাহেব খুব উচ্ছসিত হয়ে আলাপ করিয়ে দিলেন, “ইনি হলেন একজন উচ্চশিক্ষিত বাঙালি সন্ন্যাসী, তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন”। হরিপদবাবু দেখলেন আগন্তুক সন্ন্যাসীর পরণে গেরুয়া পোশাক, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, পায়ে কোল্হাপুরি চপ্পল, দাড়ি খুব পরিষ্কার করে কামানো এবং দুই চোখ থেকে যেন এক অদ্ভুত দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে। হরিপদবাবু যদিও একটু সময়ের জন্য সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্বে আকর্ষিত হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু তার মনে একটা সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছিল। “এই বাঙালি সন্ন্যাসীকে নিয়ে তার বন্ধু কেন এসেছে? তবে কি সন্ন্যাসীর তার মারাঠি বন্ধুর বাড়িতে থাকতে অসুবিধা বলে এখানে থাকার মতলব?” এই ভেবে তিনি সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মশাই কি ধুমপান করেন? আমি কায়স্থ, আমার একটি হুঁকা আছে, যদি আপনার কোনো অসুবিধা না থাকে তাহলে আপনি সেটি দিয়ে ধুমপান করতে পারেন, আমি তাহলে আপনার জন্য তামাক সাজিয়ে দিতে পারি।” সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি বিড়ি, সিগারেট বা হুঁকা যা পাই তাই দিয়েই ধুমপান করি। আর আপনার হুঁকা থেকে ধুমপান করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই’।

হরিপদবাবু সন্ন্যাসীর জন্য তামাক সাজিয়ে এনে আলাপ করতে বসলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার আর বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না যে এই সন্ন্যাসী অন্যান্য সন্ন্যাসীর থেকে কত আলাদা। তিনি সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্বে এতটাই আকর্ষিত যে তিনি তাকে তার বাংলোতে থাকার অনুরোধ করলেন। সন্ন্যাসী মৃদু হেসে অসম্মতি জানালেন।

পরেরদিন ভাটেসাহেবের বাড়ি গিয়ে তিনি দেখেন বেলগামের সমস্ত বুদ্ধিজীবী পরিবেষ্টিত হয়ে সন্ন্যাসী উঠানে বসে আছেন আর সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।

ইতিমধ্যে, সম্মানীয় এক আইনজীবি প্রশ্ন করলেন, “আমরা আমাদের সকাল এবং সন্ধ্যাবেলার প্রার্থনার জন্য যে মন্ত্রোচ্চারণ করে থাকি, সেগুলো সব সংস্কৃত ভাষায় হবার জন্য আমরা তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারি না। এমন মন্ত্রোচ্চারণের কি উপকারিতা?” সন্ন্যাসী উত্তরে বললেন, “ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। আপনি ইচ্ছা করলে অনায়াসে ওই কয়েকটা মন্ত্রের মানে শিখতে পারেন। আর সেটা যদি না করতে পারেন, তাহলে তার জন্য কাকে দায়ী করা উচিত আপনি বলুন? আর যদি মন্ত্রের মানে নাও জানেন, তবু, যখন আপনি প্রার্থনা করতে বসেন, তখন আপনার মনের মধ্যে একটা পবিত্র কাজ করার ভাবনা আসে, যেটা সম্পূর্ণ পাপমুক্ত। যদি কারো মনে কিছু ভালো চিন্তা কাজ করে তাহলে সেই চিন্তা প্রসুত ফল ও ভালো হবে”।

কোনো একজন বললেন, “ধর্মীয় আলোচনা বিদেশী ভাষায় করা উচিত নয় কারণ আমাদের পুরাণ এর অনুমতি দেয় না”। উত্তরে সন্ন্যাসী বললেন,”ধর্মীয় আলোচনা এত পবিত্র, যে কোনো ভাষা একে অপবিত্র করতে পারেনা। বেদে এর উল্লেখ আছে। হাইকোর্টের রায় কি লোয়ার কোর্ট খারিজ করতে পারে?”

সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলে হরিপদবাবু আকর্ষিত হলেও তার মনে যে সন্ন্যাসীদের প্রতি এক তিক্ততা ছিল, সেটা পুরোপুরি চলে যায়নি। তিনি সন্ন্যাসীকে জিগ্গেস করলেন, সন্ন্যাসীরা এমন অলস জীবনযাপন করে কেন? কেনই বা তারা অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যের প্রত্যাশী হয়ে থাকে? তারা কেন এমন কোনো কাজ করেনা, যাতে সমাজ লাভবান হয়?

সন্ন্যাসী বললেন, “দেখুন, এই যে আপনি এত পরিশ্রম করে এত অর্থোপার্জন করছেন এর সামান্য এক অংশই আপনি নিজের জন্য খরচা করে থাকেন, এর বেশ কিছুটা অংশ যাদের আপনি নিজের মনে করেন তাদের জন্যে খরচা করে থাকেন। অথচ, আপনি তাদের জন্যে যা করছেন তার কৃতজ্ঞতাও তারা স্বীকার করেন না, বা তাদের প্রাপ্তিতে তারা পরিতৃপ্তও নয়। বাকি যেটা সারা জীবন ধরে সঞ্চয় করছেন, সেটা শুধু যক্ষের মত রক্ষা করে যাবেন, উপভোগ করতে পারবেন না। যখন আপনার মৃত্যু হবে, অন্য কেউ এসে সেই সঞ্চয় শুধু যে ভোগ করবে তা নয়, উপরন্তু আপনাকে গালাগালি দেবে, আরো কিছু বেশি সঞ্চয় না করে যাবার জন্য। অথচ একজন সন্ন্যাসী হয়ে কিছুই করিনা, যখন খিদে পায়, আমি ইশারায় অন্যকে জানাই আমার খিদে পেয়েছে, কিছু খাবার প্রয়োজন; যা পাই তাই খাই। আমি সংঘর্ষও করিনা আবার সঞ্চয়ও করিনা। এবারে আপনি বলুন কে বেশি বিজ্ঞ? আমি নাকি আপনি?”

এই ভাবে তিনি একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে থাকেন আর সন্ন্যাসী তার উত্তর দিতে থাকেন। এমনি করে নয়টি দিন দেখতে দেখতে চলে গেল। এর মধ্যে হরিপদবাবু সপরিবারে দীক্ষা নিলেন। জীবনে এই প্রথম হরিপদবাবু কারো চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলেন।

বলাবাহুল্য এই তরুণ সন্ন্যাসীটি স্বামী বিবেকানন্দ। বেলগাম থেকে তিনি ট্রেনে মারগাঁও এর উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেন। কর্নাটক সরকার ২০০০ সালে হরিপদ বাবুর সেই বাংলো এবং সংলগ্ন জমি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করেছেন। আজ সেই বাংলো সংরক্ষণ করে সংলগ্ন জমিতে বেলগাম রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপিত হয়েছে। বেলগাম অবস্থান কালে হরিপদ মিত্র বিবেকানন্দের একটি ছবি তোলানোর ব্যবস্থা করেন। সেই ছবিটি ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তিনি কোল্হাপুরি চপ্পল পরে আছেন।

1 কমেন্টস্:

moudasgupta বলেছেন...

Kato je ei rakhan na jana kahinir muktodana chhoriye aachhe e desher e pranto theke o prante, ke jane... asankhyo dhnnyobaad Pradip, ei rakam na jana ekti kahini jananor jannye...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন