১০ এপ্রি, ২০১৩

ছোটগল্প - তুষ্টি ভট্টাচার্য

বাবা
তুষ্টি ভট্টাচার্য


দ্যাখ্‌ দ্যাখ্‌ এই যে দেখছিস আমার গলার দাগটা – এটা আমার গত জন্মের ফল । মানে ? কি বলছ তুমি বাবা – গত জন্মের কি?? পূর্বজন্মে আমি বিশ্বাসী নই । তুই জানিস না – গত জন্মে আমি গিরীশ ঘোষ ছিলাম । স্বয়ং রামকৃষ্ণের ক্যানসার আমি গলায় ধারণ করেছিলাম । এভাবেই আমি পাপমুক্ত হয়েছি । আমি তখন ছিলাম বেশ্যাসক্ত এক মদ্যপ । রামকৃষ্ণের দয়ায় আমি হয়ে উঠেছিলাম নির্ভার খাঁটি মানুষ । তাঁর দয়ায় আমার মুক্তি হয়েছিল । সেই ক্যানসার চিহ্ন আমি আজও বহন করছি । জানি বাবা জানি, তুমি সত্যি একজন মুক্ত পুরুষ । তোমাকে মানি । এই দেখো , তুমি যখন মাকালীর ক্যালেন্ডারের সামনে কিম্বা বিষ্ণুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ওঁদের সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বল , তখন একমাত্র আমিই বুঝি তুমি কত খাঁটি । তুমি গিরীশ তুমি রামকৃষ্ণ তুমিই বিষ্ণুর অবতার ।

লাইন ক্লিয়ার হলে তুমি বোতাম টিপলে , সবুজ সিগনাল বোর্ডে ডিসপ্লে হল । মাইকে ঘোষণা শুরু হল – পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে , দয়া করে লাইনের ধার থেকে সরে দাঁড়ান । হু হু করে ট্রেন চলে গেলে তুমি আর একবার ডিসপ্লে বোর্ডে চোখ বুলিয়ে নাও । ইষ্ট কেবিন থেকে আবার কোন বার্তা এসে , তুমি একের পর এক ট্রেন পাস করাও । বাড়ি ফেরার পথে বুকস্টল থেকে আমার জন্য আনন্দমেলা নিয়ে ফেরো ।

বাংলা সিনেমার এক জনই নায়ক ছিলেন , তিনি হলেন উত্তম কুমার । বলতে বলতে তুমি গেয়ে ওঠো – দোলে রাই দোলে ঝুলনায় , দোলে কৃষ্ণ দোলে ঝুলনায় ......... আমি জানি বাবা এ গান তুমি যখন গাও তখন তুমি মানবেন্দ্র নও , তুমি আমার বাবা নও , তখন তুমি উত্তম হয়ে যাও । তুমি তখন শুধুই উত্তম । ওই যে তুমি ওথেলোর বেশে বলছ – ইট ইস দ্য কজ্‌ , ইট ইস দ্য কজ্‌ ...... তোমার কণ্ঠে তখন উৎপল দত্ত নেই , তুমি নেই , উত্তম ভর করেছেন । ওই যে তুমি চকচকে চাকু হাতে ডেসডেমিনকে খুন করতে চলেছ ......... উফ্‌ কি ভয়ংকর দেখাচ্ছে তোমায়......... কিন্তু তুমি তো পারলে না । শেষ পর্যন্ত থেমে গেলো তোমার হাত , স্তব্ধ বিস্ময়ে অপলক চেয়ে আছো তুমি মহা নায়িকার দিকে । এবার দেখছি তুমি টেবিল চাপরে বলছ – আই উইল বি দ্য টপ্‌ , আই উইল বি দ্য টপ্‌......... আমি জানি বাবা তুমিই আমার নায়ক , আমার মহানায়ক , তুমি সবার ওপরেই থাকবে ।

লাস্ট ট্রেন চলে গেল , স্টেশনে বেঞ্চের তলায় গুটিসুটি মেরে কয়েকটা কুকুর শুয়ে আছে , শেডের নীচে একসাথে কতগুলো ভিখিরি পরিবার আরামসে ঘুমোচ্ছে । দুজন হকার লাস্ট ট্রেন ফেল করেছে বলে ঝুরির ওপর মাথা দিয়ে বেঞ্চে ঘুমোচ্ছে । বাবা , তুমি তখন ঘুম তাড়ানোর জন্য স্টেশনে পায়চারী করছ , তোমার মাথার ওপর একদল মশা উড়তে উড়তে তোমার সাথে চলেছে । তোমার এখন আর ঘুম পাচ্ছে না । সাড়ে তিনটের সময় ফার্স্ট ট্রেন ঢুকবে , বাজারের ঝাঁকা নিয়ে চলে আসবে হাটুরের দল । তুমি সূর্যকে ডেকে আনবে এরপর । নাইট ডিউটি শেষে বাড়ি ফিরে এসে এক কাপ গরম দুধ খেয়ে ঘুমোতে যাবে । তুমি মনে করে দেখো এসময়ে আমি কক্ষনও তোমাকে বিরক্ত করি নি । তোমার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার ঈশ্বরকে দেখেছি ।

ইন্ডিয়া টিমকে পাঁক থেকে কে তুলে এনেছিল ? কে বিদেশে গিয়ে সিরিস জয় করতে পেরেছিল , কার ছিল এতখানি বুকের পাটা ?? আমাদের বাংলার সোনার ছেলে – সৌরভ । অফ স্ট্যাম্পের জাদুকর সৌরভ । ওর মত এত বড় ক্যাপ্টেন আর জন্মাবে না কোনোদিন । আমি জানি বাবা - ওই যে মাঠে হাত তুলে নির্দেশ দিচ্ছে , ওই দ্যাখো অফ স্ট্যাম্প দিয়ে বল গলিয়ে দিলো , বল চলে গেল সোজা মাঠের বাইরে ...... চার !!!! সারা মাঠ তোমায় কুর্ণিশ জানাচ্ছে , তুমি টুপিটা হাতে নিয়ে অভিবাদন করছ । হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো সৌরভ নয় , সে তো তুমিই । সৌরভের সমস্ত রেকর্ড আমি মুখস্ত করেছি প্রাণপণে , ডোনার নাচের স্কুলের নাম , মেয়ে কোন স্কুলে ভর্তি হল , সব আমি কণ্ঠস্থ করে রেখেছি । দ্যাখো বাবা –

মাইনে পেয়ে তুমি শামিমের দোকান থেকে মাংস কিনে আনবে , লাল - লাল ঝাল - ঝাল ঝোলে আঙুল ডুবিয়ে আগে একটা আলু তুলে খাবো আমি । তুমি তাই দেখে হা হা করে হেসে বলবে – বোকা মেয়ে , মাংস ফেলে আলু খাচ্ছিস ! আমি তোমার সত্যিই বোকা মেয়ে , বাবা - । তুমি যেমন একটার পর একটা ট্রেন পাস করিয়ে গেলে নির্ভুল ভাবে , আমি কই তেমনটি তো পারলাম না !

2 কমেন্টস্:

moudasgupta বলেছেন...

poricchanno bhabna, sabolil lekhani, lekhikaar uddeshye roilo anek shubhokamona...

Soumitra Chakraborty বলেছেন...

কবি যখন গল্প লেখেন, তখন ছাপিয়ে যান সব কারুকৃত।অনবদ্য দক্ষতায় তুষ্টি লিখেছেন, পড়তে পড়তে সময় হারিয়ে গেল, সাদাকালো ছবিতে একের পর এক দৃশ্যকল্প তৈরী হল। একজন মানুষ পৃথিবীর তাবৎ নায়ককের মাথা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেলেন সমগ্র আকাশে।
আসম্ভব ভালোলাগা তৈরী করলেন।
অভিনন্দন গল্পকার কে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন