সনাতনের ডায়েরী থেকে:
মৌ দাশগুপ্তা
সময় খুব অলস মন্থর গতিতে চলছে আজকাল, কিছুতেই যেন সময়টা আর কাটতে চাইছে না এখানে। চোখ মেললেই সেই একঘেঁয়ে গাছের পাতা, হলদেটে সবজে ঘাস, দোতলা বাড়ীটার ছাদে ঝুঁকে আসা আমগাছ, সেই কাক শালিখ চড়াইয়ের কূটকাচালি। এখানে সবকিছু ঠিক আমার মতই বুড়ো হয়ে গেছে। কি আর করি। রোদে পিঠ দিয়ে বসে সকাল থেকে অনেকবার পড়া আজকের আনন্দবাজারটাই আবার মেলে ধরি চোখের সামনে। বাসি খবর। বুড়িয়ে যাওয়া খবর। ঘরে এমন কোন বই নেই যেটা পড়া হয়নি। নতুন কেনাও হয়নি বহুদিন, কেই বা যাবে কিনতে! আমার আর সেই পায়ের জোরটাই তো আজকাল টের পাই না। ঘরে কেউ নেই কথা বলার জন্য। টিভিটাও দেখা হয়না চোখ থেকে জল পড়ে বলে। তবে সারা দিনরাত মুড়ির টিনের মত ওটাই কানের কাছে বাজে। জানান দেয় যে আমি পুরোপুরি একা নই।
মাঝে মাঝে সিনেমার কাটা রিলের মতো ছোট ছোট দৃশ্য ফিরে আসে আমায় অলস মনের দেওয়ালে। ঠিক একই ঘর, একই বারান্দা, একই জানালা। তখনো সবকিছু বুড়িয়ে যায়নি। আমার বউ ভবানী আপনমনে গান গাইছে গুনগুনিয়ে করে আর ছাঁকনি দিয়ে চা ঢালছে কাপে। আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে, ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর লাজেরাঙা মুখটা আরকটু মিষ্টি হয়ে উঠলো দুষ্টুমীর ঝিলিকে। কোমরে কাপড় জড়িয়ে উঁচু টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ঝুল ঝাড়ছে, অতিরিক্ত পরিশ্রমে ফরসা মুখটা লাল হয়ে গেছে। এমন সময় কাঁথায় শোওয়া সনত কেঁদে উঠতেই তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। আমিতো ঘাবড়ে গেছি, কার দিকে যাবো? ছেলে না বৌ? সে সব দিনগুলো কত তাড়াতাড়ি যে ফুরিয়ে গেল! ভবানী চলে যাবার পর প্রথম প্রথম আমার ভীষণ কষ্ট হতো,খুব কান্না পেতো, নিজেকে খুব অসহায় মানুষ মনে হতো। বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছিল। সনতটা না থাকলে হয়তো জীবনটা আমার আজ অন্য খাতেই বইত। শুধু ঐ মা মরা ছেলেটার মুখ চেয়েই আজো বেঁচে আছি।
সনতের জীবনটাও কেমন খাপছাড়া হয়ে গেল। কম বয়সে মা মরায় ছেলেটাকে বুকে আগলে মানুষ করেছি। সাধ্যের অতিরিক্ত খরচা করে ভাল স্কুল কলেজে পড়িয়েছি। ছেলেও আমার পড়াশুনায় তুখোড় ছিল। অনায়াসে স্কুল কলেজের পাট মিটিয়ে নিজের ব্যাবসা ফেঁদেছে। কলেজের পট মিটিয়েই নিজে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ওর কলেজের প্রফেসর জে এন মাইতির মেয়ে ঐন্দ্রিলাকে। ওদের বাড়ীর আপত্তি থাকলেও আমি সাদরে দুজনকে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। বেশ চলছিল দিনগুলো। বছর দুয়েক পরে আসলো সন্তু, আমার আদরের নাতি। কিন্তু তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলের ছেলেটাকে আমাদের বাপ-ব্যাটার ওপর ফেলে বৈতরনীর ওপাড়ে পাড়ি জমালো ফুটফুটে মেয়েটা, কদিনেই ছেলের বউ থেকে যেন মেয়ে হয়ে গেছিল আমার, কি মায়াতেই না জড়িয়ে ফেলেছিল। আমার ভাগ্যটাই এইরকম। যম বারবার কুটুম হয়ে আসে আমার বাড়ী, খালি ব্যাটা ঘাটের মরাটা আমাকেই চোখে দেখতে পায় না।
তবে কিনা সে আঘাতও সয়ে গেছি আমার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে, তখন তো আবার আসলের সুদটুকুও ছিলো। আমার সন্তু। ছেলের ঘরের একমাত্র নাতি আমার, বংশপ্রদীপ, আমার কত আদরের,কত প্রশ্রয়ের। আসলে আমি লোকটাই বড় অগোছালো, কিছুই তো জীবনভর ঠিকমত গুছিয়ে করে উঠতে পারলাম না। সনত তো দূর অস্ত, এখন অবসর জীবনে ঘরে বসে থেকেও মা মরা নাতিটাকে মনের মত করে গড়ে তুলতে পারিনি। সবাই বলতো আমার অতি আদরেই নাকি বিগরাচ্ছে ছেলেটা, আর এখন? কেউ আর কিচ্ছুটি বলে না। সন্তুর কথা ভাবলেই নিজেকে কেমন অপরাধী লাগে। ওর মুখটা মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। মাত্র একুশের ছিলো নাতিটা আমার,মাত্র একুশের , আবাগীর ব্যাটা ঐ চিত্রগুপ্ত তখনই ওর নামটা খাতায় তুলে নিল। জীবনটাকে যে ভালোমত চিনতেই পারে নি তার সাথে জীবনের কি যে শত্রুতা ছিল কে জানে। অথচ জীবনের লীলাটা দেখো, আমার নয়নের মনিটাকে, শিবরাত্রির সলতেটাকে রতনবাবুর ঘাটে চিতায় পুড়িয়ে এসেও আমি দিব্যি বেঁচে আছি, খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমচ্ছি, চলছি ফিরছি। বেঁচে তো আছি। যদিও এই ঘাটের মরা হয়ে বেঁচে থাকাটাকে বাঁচা বলে কিনা জানিনা। জীবনের এমনই মহিমা। মুখে যদিও বলি সনতটার কথা ভেবেই মরতে পারি না, কিন্তু সেটা কি সত্যি? আমারই যে কথাটায় বড় ধন্দ লাগে আজকাল। কে জানে বৌ, ছেলের বৌ, নাতি সবার আয়ূ খেয়ে আমি এক একালের যযাতি বেঁচে থাকার আনন্দে বেঁচে আছি কিনা!
গরমের এই দুপুরটা ভুতুড়ে বাড়ির মতই নীরব,রহস্যময় । নিজেকে নিয়ে ভাবার অখন্ড অবসরে পাগল পাগল লাগে।কেন যে মরন আসে না আমার, কেন যে অনর্থক বেঁচে আছি।
আজ সকাল থেকেই বড় অস্থির লাগছে। পুরানো স্মৃতিগুলো বড় ভাবাচ্ছে আমায়। কি যে করি। সনতটা পাগলের মত সারাটা দিন কাজে ব্যস্ত থাকে। রাতে নেশায় চূর হয়ে টলোমলো পায়ে ঘরে ফেরে। সবই দেখি, সবই বুঝি। কিন্তু করার তো কিছু নেই। অন্যদিন কাজের ছেলেটা মানে বিনু থাকে আশেপাশে, আজ ও গেছে বোনের বাড়ী। ফাঁকা ঘরের বিষণ্ণতটা আর সহ্য হচ্ছে না। আকাশ পরিস্কার্, রোদে টইটম্বুর তবু ঘরের ভেতর কেমন গুমট বাতাস পাক খেয়ে যাচ্ছে । আশেপাশে কোথাও ভাঙ্গা ভূতুড়ে গলায় ডাকছে একটা কাক । গাড়ির হর্ন আর রিকশার টুং-টাং ছাড়া কোন আওয়াজ এই বুড়ো কানে শুনে পচ্ছিনা। রাস্তা দিয়ে একটা পুরানো কাগজ কেনার ফেরিওয়ালা ক্লান্ত আলসে সুরে ডাকছে, কা...গ...জ। কা...গ...জ। বেঁচে থাকা নামের প্রহসনটার আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যাক। এভাবে বাঁচার, বেঁচে থাকার কোন মানেই হয়না। এর একটা তাৎক্ষণিক সমাপ্তি আজই চাই আমার, হ্যাঁ, আজই।
সিদ্ধান্তটা নিয়ে একই সাথে অস্থির আর চনমনে বোধ করছি। আত্মহত্যারও কিছু নিয়ম আছে । সে অনুযায়ী প্রথমেই লিখে ফেলতে হবে একটা সুইসাইড নোট।সন্তুর ঘরটায় ওর ছেড়ে যাওয়া টেবিলে বসে কাগজ আর প্রিয় কলমটা টেনে নিয়ে কাঁপা হতে লিখে ফেললাম আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র সুইসাইড । “ আমি জানি আর মানিও, যে, মানুষ বেঁচে থাকে বেঁচে থাকতে চাওয়ার আনন্দে। বাবা মা বেঁচে থাকে সন্তানের জন্য। আর তাঁদের সন্তানরা বেঁচে থাকে তাঁদের সন্তানের জন্য , কিন্তু আমার তো আর সেরকম কোন দায় নেই? তবে আমি কেন বেঁচে আছি? সত্যি বলতে কি, আমার এই ফসিল হয়ে যাওয়া জীবনের মহত্ত্বের ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সন্দিহান।মৃত্যু ভয় আর পরকাল ভীতিকে জয় করা সোজা কথা নয়।আমিও মরতে ভয় পাই,শুধু মরার পরে কি আছে তা জানিনা বলে। কিন্তু আজ অহেতুক ভয় পাবো কেন? আমার জীবন থেকে এক এক করে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজতে হলে তারা যে পথ ধরে এগিয়ে গেছে আমাকেও যে সেই পথেই চলতে হবে। অতএব, এই আত্মহত্যাকে আমি স্বেচ্ছায় জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া বলব। যা একটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়া কিছু নয়।“ সনাতন মুৎসুদ্দি। ২২ শে মে,২০১২।
লেখাটা শেষ করে আমি কেঁদেই ফেললাম ।যদিও আমি জানি, এই ঘর, এই বারান্দা ,বারান্দার পর সিঁড়ি ,তারপর একতলার এই ঘর সেই ঘর করে ফাঁকা বাড়ীতে আমার এই চিৎকার , কান্নার আওয়াজ কারো কানে পৌঁছাবে না। কারোর ঘুম ভাঙ্গাবেনা। কত গ্রীষ্ম- বর্ষা ,শীত – হেমন্ত এলো আর গেলো। কত দিনরাত কাটয়ে দিলাম এই পৃথিবীতে। ভাবতে ভাবতেই মনে হল ঘরে যেন আমি আর একা নই। আমার মা, আমার বাবা, জলে ডুবে অকালে মরে যাওয়া আমার কিশোর ভাইটা, আমার ভবানী, ঐন্দ্রিলা, সন্তু ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমায়। ওদের সবাইকে কেমন ছায়ার হালকা পেলব ছায়র পুতুল মনে হচ্ছে , দেখতে শক্ত মনে হলেও ফুঁ দিলে ঠিক উড়ে যাবে। বস্তুত স্মৃতিচাপা এক বিস্মৃতির পাথরের নিচের রহস্যময় অতীতের অন্ধকার থেকে, পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে মৃত মানুষদের মিছিল। সব কিছু মিলেমিশে সময়ের সুতার জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এক অস্তিত্বহীন সময়ের ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছি আমিও।
পরিশিষ্টঃ
প্রবীন নাগরিক সনাতন মুৎসুদ্দিকে ওনার নিজের বাসভবনে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাড়ীর দোতলা চিলেকোঠার ঘরে টেবিলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহটি প্রথমে নজরে পড়ে বাড়ীর পুরাতন গৃহভৃত্য বিনুর। সনাতন মুৎসুদ্দির হাতে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গেলেও চিকিৎসকের অনুমান অকস্মাৎ সন্নাস রোগেই ওনার মৃত্যু ঘটছে। আমরা ওনার আত্মার চির শান্তি কামনা করে ওনার পরিবারের উদ্দেশে আমাদের আন্তরিক সহমর্মিতা ব্যক্ত করছি।
সময় খুব অলস মন্থর গতিতে চলছে আজকাল, কিছুতেই যেন সময়টা আর কাটতে চাইছে না এখানে। চোখ মেললেই সেই একঘেঁয়ে গাছের পাতা, হলদেটে সবজে ঘাস, দোতলা বাড়ীটার ছাদে ঝুঁকে আসা আমগাছ, সেই কাক শালিখ চড়াইয়ের কূটকাচালি। এখানে সবকিছু ঠিক আমার মতই বুড়ো হয়ে গেছে। কি আর করি। রোদে পিঠ দিয়ে বসে সকাল থেকে অনেকবার পড়া আজকের আনন্দবাজারটাই আবার মেলে ধরি চোখের সামনে। বাসি খবর। বুড়িয়ে যাওয়া খবর। ঘরে এমন কোন বই নেই যেটা পড়া হয়নি। নতুন কেনাও হয়নি বহুদিন, কেই বা যাবে কিনতে! আমার আর সেই পায়ের জোরটাই তো আজকাল টের পাই না। ঘরে কেউ নেই কথা বলার জন্য। টিভিটাও দেখা হয়না চোখ থেকে জল পড়ে বলে। তবে সারা দিনরাত মুড়ির টিনের মত ওটাই কানের কাছে বাজে। জানান দেয় যে আমি পুরোপুরি একা নই।
মাঝে মাঝে সিনেমার কাটা রিলের মতো ছোট ছোট দৃশ্য ফিরে আসে আমায় অলস মনের দেওয়ালে। ঠিক একই ঘর, একই বারান্দা, একই জানালা। তখনো সবকিছু বুড়িয়ে যায়নি। আমার বউ ভবানী আপনমনে গান গাইছে গুনগুনিয়ে করে আর ছাঁকনি দিয়ে চা ঢালছে কাপে। আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে, ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর লাজেরাঙা মুখটা আরকটু মিষ্টি হয়ে উঠলো দুষ্টুমীর ঝিলিকে। কোমরে কাপড় জড়িয়ে উঁচু টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ঝুল ঝাড়ছে, অতিরিক্ত পরিশ্রমে ফরসা মুখটা লাল হয়ে গেছে। এমন সময় কাঁথায় শোওয়া সনত কেঁদে উঠতেই তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। আমিতো ঘাবড়ে গেছি, কার দিকে যাবো? ছেলে না বৌ? সে সব দিনগুলো কত তাড়াতাড়ি যে ফুরিয়ে গেল! ভবানী চলে যাবার পর প্রথম প্রথম আমার ভীষণ কষ্ট হতো,খুব কান্না পেতো, নিজেকে খুব অসহায় মানুষ মনে হতো। বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছিল। সনতটা না থাকলে হয়তো জীবনটা আমার আজ অন্য খাতেই বইত। শুধু ঐ মা মরা ছেলেটার মুখ চেয়েই আজো বেঁচে আছি।
সনতের জীবনটাও কেমন খাপছাড়া হয়ে গেল। কম বয়সে মা মরায় ছেলেটাকে বুকে আগলে মানুষ করেছি। সাধ্যের অতিরিক্ত খরচা করে ভাল স্কুল কলেজে পড়িয়েছি। ছেলেও আমার পড়াশুনায় তুখোড় ছিল। অনায়াসে স্কুল কলেজের পাট মিটিয়ে নিজের ব্যাবসা ফেঁদেছে। কলেজের পট মিটিয়েই নিজে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ওর কলেজের প্রফেসর জে এন মাইতির মেয়ে ঐন্দ্রিলাকে। ওদের বাড়ীর আপত্তি থাকলেও আমি সাদরে দুজনকে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। বেশ চলছিল দিনগুলো। বছর দুয়েক পরে আসলো সন্তু, আমার আদরের নাতি। কিন্তু তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলের ছেলেটাকে আমাদের বাপ-ব্যাটার ওপর ফেলে বৈতরনীর ওপাড়ে পাড়ি জমালো ফুটফুটে মেয়েটা, কদিনেই ছেলের বউ থেকে যেন মেয়ে হয়ে গেছিল আমার, কি মায়াতেই না জড়িয়ে ফেলেছিল। আমার ভাগ্যটাই এইরকম। যম বারবার কুটুম হয়ে আসে আমার বাড়ী, খালি ব্যাটা ঘাটের মরাটা আমাকেই চোখে দেখতে পায় না।
তবে কিনা সে আঘাতও সয়ে গেছি আমার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে, তখন তো আবার আসলের সুদটুকুও ছিলো। আমার সন্তু। ছেলের ঘরের একমাত্র নাতি আমার, বংশপ্রদীপ, আমার কত আদরের,কত প্রশ্রয়ের। আসলে আমি লোকটাই বড় অগোছালো, কিছুই তো জীবনভর ঠিকমত গুছিয়ে করে উঠতে পারলাম না। সনত তো দূর অস্ত, এখন অবসর জীবনে ঘরে বসে থেকেও মা মরা নাতিটাকে মনের মত করে গড়ে তুলতে পারিনি। সবাই বলতো আমার অতি আদরেই নাকি বিগরাচ্ছে ছেলেটা, আর এখন? কেউ আর কিচ্ছুটি বলে না। সন্তুর কথা ভাবলেই নিজেকে কেমন অপরাধী লাগে। ওর মুখটা মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। মাত্র একুশের ছিলো নাতিটা আমার,মাত্র একুশের , আবাগীর ব্যাটা ঐ চিত্রগুপ্ত তখনই ওর নামটা খাতায় তুলে নিল। জীবনটাকে যে ভালোমত চিনতেই পারে নি তার সাথে জীবনের কি যে শত্রুতা ছিল কে জানে। অথচ জীবনের লীলাটা দেখো, আমার নয়নের মনিটাকে, শিবরাত্রির সলতেটাকে রতনবাবুর ঘাটে চিতায় পুড়িয়ে এসেও আমি দিব্যি বেঁচে আছি, খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমচ্ছি, চলছি ফিরছি। বেঁচে তো আছি। যদিও এই ঘাটের মরা হয়ে বেঁচে থাকাটাকে বাঁচা বলে কিনা জানিনা। জীবনের এমনই মহিমা। মুখে যদিও বলি সনতটার কথা ভেবেই মরতে পারি না, কিন্তু সেটা কি সত্যি? আমারই যে কথাটায় বড় ধন্দ লাগে আজকাল। কে জানে বৌ, ছেলের বৌ, নাতি সবার আয়ূ খেয়ে আমি এক একালের যযাতি বেঁচে থাকার আনন্দে বেঁচে আছি কিনা!
গরমের এই দুপুরটা ভুতুড়ে বাড়ির মতই নীরব,রহস্যময় । নিজেকে নিয়ে ভাবার অখন্ড অবসরে পাগল পাগল লাগে।কেন যে মরন আসে না আমার, কেন যে অনর্থক বেঁচে আছি।
আজ সকাল থেকেই বড় অস্থির লাগছে। পুরানো স্মৃতিগুলো বড় ভাবাচ্ছে আমায়। কি যে করি। সনতটা পাগলের মত সারাটা দিন কাজে ব্যস্ত থাকে। রাতে নেশায় চূর হয়ে টলোমলো পায়ে ঘরে ফেরে। সবই দেখি, সবই বুঝি। কিন্তু করার তো কিছু নেই। অন্যদিন কাজের ছেলেটা মানে বিনু থাকে আশেপাশে, আজ ও গেছে বোনের বাড়ী। ফাঁকা ঘরের বিষণ্ণতটা আর সহ্য হচ্ছে না। আকাশ পরিস্কার্, রোদে টইটম্বুর তবু ঘরের ভেতর কেমন গুমট বাতাস পাক খেয়ে যাচ্ছে । আশেপাশে কোথাও ভাঙ্গা ভূতুড়ে গলায় ডাকছে একটা কাক । গাড়ির হর্ন আর রিকশার টুং-টাং ছাড়া কোন আওয়াজ এই বুড়ো কানে শুনে পচ্ছিনা। রাস্তা দিয়ে একটা পুরানো কাগজ কেনার ফেরিওয়ালা ক্লান্ত আলসে সুরে ডাকছে, কা...গ...জ। কা...গ...জ। বেঁচে থাকা নামের প্রহসনটার আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যাক। এভাবে বাঁচার, বেঁচে থাকার কোন মানেই হয়না। এর একটা তাৎক্ষণিক সমাপ্তি আজই চাই আমার, হ্যাঁ, আজই।
সিদ্ধান্তটা নিয়ে একই সাথে অস্থির আর চনমনে বোধ করছি। আত্মহত্যারও কিছু নিয়ম আছে । সে অনুযায়ী প্রথমেই লিখে ফেলতে হবে একটা সুইসাইড নোট।সন্তুর ঘরটায় ওর ছেড়ে যাওয়া টেবিলে বসে কাগজ আর প্রিয় কলমটা টেনে নিয়ে কাঁপা হতে লিখে ফেললাম আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র সুইসাইড । “ আমি জানি আর মানিও, যে, মানুষ বেঁচে থাকে বেঁচে থাকতে চাওয়ার আনন্দে। বাবা মা বেঁচে থাকে সন্তানের জন্য। আর তাঁদের সন্তানরা বেঁচে থাকে তাঁদের সন্তানের জন্য , কিন্তু আমার তো আর সেরকম কোন দায় নেই? তবে আমি কেন বেঁচে আছি? সত্যি বলতে কি, আমার এই ফসিল হয়ে যাওয়া জীবনের মহত্ত্বের ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সন্দিহান।মৃত্যু ভয় আর পরকাল ভীতিকে জয় করা সোজা কথা নয়।আমিও মরতে ভয় পাই,শুধু মরার পরে কি আছে তা জানিনা বলে। কিন্তু আজ অহেতুক ভয় পাবো কেন? আমার জীবন থেকে এক এক করে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজতে হলে তারা যে পথ ধরে এগিয়ে গেছে আমাকেও যে সেই পথেই চলতে হবে। অতএব, এই আত্মহত্যাকে আমি স্বেচ্ছায় জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া বলব। যা একটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়া কিছু নয়।“ সনাতন মুৎসুদ্দি। ২২ শে মে,২০১২।
লেখাটা শেষ করে আমি কেঁদেই ফেললাম ।যদিও আমি জানি, এই ঘর, এই বারান্দা ,বারান্দার পর সিঁড়ি ,তারপর একতলার এই ঘর সেই ঘর করে ফাঁকা বাড়ীতে আমার এই চিৎকার , কান্নার আওয়াজ কারো কানে পৌঁছাবে না। কারোর ঘুম ভাঙ্গাবেনা। কত গ্রীষ্ম- বর্ষা ,শীত – হেমন্ত এলো আর গেলো। কত দিনরাত কাটয়ে দিলাম এই পৃথিবীতে। ভাবতে ভাবতেই মনে হল ঘরে যেন আমি আর একা নই। আমার মা, আমার বাবা, জলে ডুবে অকালে মরে যাওয়া আমার কিশোর ভাইটা, আমার ভবানী, ঐন্দ্রিলা, সন্তু ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমায়। ওদের সবাইকে কেমন ছায়ার হালকা পেলব ছায়র পুতুল মনে হচ্ছে , দেখতে শক্ত মনে হলেও ফুঁ দিলে ঠিক উড়ে যাবে। বস্তুত স্মৃতিচাপা এক বিস্মৃতির পাথরের নিচের রহস্যময় অতীতের অন্ধকার থেকে, পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে মৃত মানুষদের মিছিল। সব কিছু মিলেমিশে সময়ের সুতার জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এক অস্তিত্বহীন সময়ের ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছি আমিও।
পরিশিষ্টঃ
প্রবীন নাগরিক সনাতন মুৎসুদ্দিকে ওনার নিজের বাসভবনে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাড়ীর দোতলা চিলেকোঠার ঘরে টেবিলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহটি প্রথমে নজরে পড়ে বাড়ীর পুরাতন গৃহভৃত্য বিনুর। সনাতন মুৎসুদ্দির হাতে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গেলেও চিকিৎসকের অনুমান অকস্মাৎ সন্নাস রোগেই ওনার মৃত্যু ঘটছে। আমরা ওনার আত্মার চির শান্তি কামনা করে ওনার পরিবারের উদ্দেশে আমাদের আন্তরিক সহমর্মিতা ব্যক্ত করছি।
1 কমেন্টস্:
didi, apni jibon ke je koto kach theke dekhen, ei golpo tari prokash. golper tragedy ta oshadharon vabe prokash korechen. onk onk suvechha divai.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন