১ অক্টো, ২০১৩

সুক্তগদ্য - সীমা ব্যানার্জী রায়

ওগো! তুমি যে আমার...।
সীমা ব্যানার্জী রায়



আমার আদরিণী শতরূপাঃ

লিখতে বসেছি চিঠি-

হয়ত হবে না শেষ লেখা-

ভাবনার সাঁকো মনে ভিড় করে

পরিয়ে নতুন বেশ

কলমের পলি হয়নি নিথর

পরিশেষে খুব শ্রান্ত.........

এই দেখো কবিতা লিখে ফেললাম, তুমি থাকলে ঠিক বলতে- “আদিখ্যেতা! বুড়ো বয়সে প্রেম করা হচ্ছে।”

আচ্ছা, তোমাকে নিয়ে লিখব না তো... কাকে নিয়ে লিখব বল? তুমি-ই তো আমার প্রথম আর একমাত্র প্রেম! আর জানো তো বুড়ো বয়সেই প্রেমটা আরো জোরালো হয়, তাই তো আজ সুন্দর একটা দিনে তোমাকে আমি মনে প্রাণে শুধু আমার করে চাইছি, শুধু আমার।

কাল রাতের বরফগুলো আজ সোনালী রৌদ্র মেখে কেমন চকচক করছে। এত বরফের মধ্যেও নিষ্পাপ লাল, সাদা, হলুদ গোলাপগুলো কেমন সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে, দেখ।

জানলা দিয়ে দেখি, শিস দেওয়া দমকা হাওয়ায় দুটো কার্ডিনাল পাখি পাশাপাশি বসে নিজেদের মধ্যে কতকিছু আলোচনা করছে আর আমি বড় একা আজ।

এত রূপ, এত আলো

লাগে না যে কিছু ভালো

বয়ে শুধু কিছু বেলা

কেন খেলি একা খেলা......তবু দেখি তুমি চুপ, আমি চুপ...।

ভাবছি অনেক লিখি, কিন্তু কি লিখি তোমায়-বল তো? আমার হাত নিশপিশ করছে লেখার জন্য -কিন্তু লেখা কই? কোথায় আছো, কেমন আছো কিছুই তো জানি না। চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই, যত রকমের ব্যবস্থা আছে করে চলেছি। নিঃস্ব্তা হল আমার দুই পাশ ঠিক এই মূহুর্তে।

আজ এই দিনে তোমাকে বড় বেশী করে মনে পড়ছে। তোমার হাতের ছোঁয়া চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবাই তোমার রুচির প্রশংসা করছে রূপা। তোমার বিয়ের আগের এই হলুদ শাড়ী পরা ছবিটা বড্ড মায়াময়ী। তুমি মানা করা সত্ত্বেও আমি বড় করে বাঁধিয়ে রেখেছিলাম। এই ছবিটা যে দেখে সেই বলে যেন জীবন্ত মায়াময়ী মূর্তি। তুমি শুনে বলতেঃ “বড্ড বেশি বলে সবাই।” সব একে একে মনে পড়ছে এখন।



আমার কথা বাদ দাও। কি নিয়েই বা আছি তোমার চৈত্ররথে? তোমার মেয়ে আজ নামকরা ডাক্তার। কাগজে কাগজে তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠছে। তাই আজ আমি সবাইকে ডেকেছি রূপা~ তোমার বাড়ীতে। তুমি তো সব সময় বলতে, “কি হবে এই বিশাল বাড়ি নিয়ে। মেয়ে একদিন পরের বাড়ী চলে যাবে। তখন তো শুধু আমরা বুড়োবুড়ির দল।”

তুমি বুড়ি! আমি ভাবতেই পারছি না, বিশ্বাস কর। তোমার আদর্শে গড়া তোমার ডুপ্লিকেট তৈরী হয়েছে তোমার মেয়ে। জান তো তোমার -আমার মতন সেও লেখে। আর তার লেখার যোগ্য সম্মান ও পাচ্ছে। তোমার ছবিতে হাসিমাখা জ্বলজ্বলে মুখখানা আমি দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। তুমি যেন কি বলতে চাইছ, কিন্তু কে যেন বাধা দিচ্ছে তোমাকে......জানিনা এটা আমার কল্পনা কিনা।

মেয়েই ঠিক করে দিল এই দিনটা, বিশ্বাস কর। আত্মীয় স্বজনে ঘর ভরে গেছে। মা কেও আজ দেখছি কত সাবলীল। তোমার দাদারা, দিদিরা, বৌ্দিরা আর ভাইপো ভাইঝিদের ভিড়ে বাড়ী সরগম। তুমি যে সবার কত আদরের তা, আজ না দেখলে তুমি বুঝতে পারবে না। শুনেছি মুম্বাই থেকে তোমার এক মাসতুতো দিদি, জামাইবাবুও এসেছেন ।

ইশ! তুমি থাকলে আজ কত মজা হত ভাব তো! ওগো, তুমি যে আমার...শুধু তুমি যে আমার। আজ মনে হচ্ছে সব গল্প। গল্পই তো আমাদের জীবন। গল্পই তো আমাদের স্মৃতি।তাই সবার থেকে সরে এসে আড়ালে তোমার ফটোর সাথে কথা বলছি। মনে হচ্ছে তুমি সব শুনেও চুপ করে আছো!

দেশে আমার মাসিমারা, মামা, মামিমারা, মেসোরা এমন কি বাড়ির কাজের মেয়েগুলোও তোমাকে খোঁজে সব সময় রূপা।

কোথায় চলে গেলে কাউকে না বলে? তোমায় কি কেউ অভিমান করার কথা বলেছিল? কত খুঁজেছি তোমায়। সবার এক কথা, “অপেক্ষা করতে হবে-ঠিক ওর সন্ধান পাব আমরা”।

হু হু করে এক্স-ওয়াই ফ্যাক্টর দিন ও রাত কেটে যাচ্ছে। এখন আমি বড় ক্লান্ত, আমার আর কিচ্ছুটি ভাল লাগে না।

মেয়ে হয়েছিল বলে মা তোমাকে সোনার কঙ্গন দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। কারণ মায়ের যে খুব মেয়ের সখ ছিল তাই। তোমার মতন দেখতে হয়েছিল বলেই না মা, নাম রেখেছেন শ্রীরূপা।

মা-ই তো তোমার নাম রেখেছেন শতরূপা। তোমার আসল নামটা অতীত কি বল? জানি হাসছ আমার পাগলামি দেখে, তাই না? হাসো! আর আমি এদিকে তোমাকে খুঁজে চলেছি অহরহ। আমাকে আর মাকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাও নি একা, কিন্তু গতবছর, এই দেখ! তোমার ছ'য়মাসের যাওয়াকে আমি এখনই গত করে দিয়েছি। তোমাকে জোর করে মাসীমার ছেলের বিয়েতে পাঠালাম কারণ আমার একটা বিরাট জরুরি সেমিনার ছিল।

এত উপরে উঠিয়ে তুমি কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেলে, বল তো? কিছুই ভালো লাগে না আজকাল, কিচ্ছুটি না।

তুমি আমাকে আসবার দিন ফোনও করেছিলে যে, তুমি কাস্টমস চেক করে লাউঞ্জে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করছ। মা-এর শরীর খারাপের জন্য তুমিই তো মা-কে নিয়ে গেলে না। সাত দিনের জন্য তুমি গেলে কিন্তু এ তো দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে রূপা। তোমাকে খুঁজে পাব বলে সব রকম ব্যবস্থা করে যাচ্ছি।

সেদিন এখানকার ফেডারাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেসন-এও তোমার জন্য বলেছি। তারাও সব রকম ব্যবস্থা নেবে বলেছে কারণ , তুমি তো আমেরিকান সিটিজেন, কাজেই তাদেরও কর্তব্য তোমাকে খুঁজে বার করা। মন খালি বলছে তুমি ঠিক আসবে, তোমাকে আসতেই হবে।

সত্যি বলছি, কি করে বোঝাই তোমাকে যে, কিছুই ভাল লাগছে না আর। এ যেন কোনরকমে দিনগত পাপক্ষয়-কোথায় বা কবে যে তোমাকে পাবো জানি না। অফিসে কাজেও সব ভুল করে ফেলছি তারা অবশ্য বুঝতে পারছে আমার মনের অবস্থা......

আজ আমি এত খ্যাতির শিখরে কার জন্য, বলতো? আমার আর কিচ্ছু চাই না। তুমি ফিরে এসো... প্লি...জ।

আজ এত লোকের ভিড় একদম ভাল লাগছে না। বিশ্বাস কর, তাই তোমার প্রিয় ঘরটাতে বসে তোমাকে লিখছি। যদি কোনদিনও আস, জানি তুমি আসবে, তখন দেখবে আমার লেখা এই চিঠি । আমি তোমাকে কত যে হারাই দিনে রাতে তার হদিশ পাবে।

মনে পড়ে বেশ সেদিনের কথা, মা আমার বিয়ের জন্য আশিটা মেয়ে দেখেছিলেন। শেষে তোমাকে হঠাৎ দেখা স্টেশনের কথা আমি আমার মা-কে বলেছিলাম। পরে আমার বন্ধু প্রসূনের কাছে জেনেছিলাম তুমি তার বোন।

আজ আর বলতে দ্বিধা নেই। তখন মা যতই মেয়ের ফটো আনছিলেন আমি-ই নাকচ করে দিচ্ছিলাম। তার সাথেও মা-ও। কারণ ছোটবেলা থেকেই আমার আর মা –এর পছন্দ একরকম ছিল।

মা বলেছিলেন, “আগে বলবি তো? প্রসূনের বোন আছে? ঠিক আছে কাল –ই প্রসূন কে বলব ওর বোনের কথা”।

মা বলাতে প্রসূন একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল, জানো তো? কারণ তোমার বয়স তখন নাকি মাত্র সতেরো। কি সুন্দর রোগা রোগা শরীর, আপেলের মতন গায়ের রঙ, এক পিঠ ঢেউ খিলানো কোঁকড়া কালো চুল। আর ছিল একজোড়া মিস্টি চোখ, যে চোখে আমি হারিয়ে গেছিলাম, পালাবার পথ খুঁজে পাই নি। লাজুক মতন ছিলে।

মা আর মাসিমা দেখে–ই কথা দিয়ে এসেছিলেন। এসেই আমাকে জড়িয়ে বলেছিলেন মা যে,- “শতরূপা-কে দেখে এলাম। আমি এমনি মেয়েই খুঁজছিলাম রে বহুদিন। মর্ত্যের কুসুম দিয়ে যেন স্বর্গে্র লক্ষী সাজানো। থাক, আর বলব না বেশী। আমার কপাল তো।”



জানো রূপা ? মা আমার বড় দুঃখী। তোমাকে বলতে বারণ করেছিলেন, মা! কিন্তু আজ আমি আর থাকতে পারছি না, তাই তোমাকে সব জানিয়ে একটু হালকা হতে চাই।



সেই ২২ বছর বয়সেই বাল্যবিধবা হয়েছিলেন আমাকে নিয়ে। আমাকে নিয়ে মায়ের তাই অনেক স্বপ্ন ছিল। কাকারা মা-কে এক বস্ত্রে বের করে দিয়েছিলেন বাড়ী থেকে ‘অলুক্ষুণে’ নামের ঘোমটা পড়িয়ে। আমার সেই ছোট্ট-খাটো মা দাদুর হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছিলেন দাদুর সংসারে। দাদুর বাড়িতে মানুষ হচ্ছি বলে মা সব সময় রান্না ঘরে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতেন। তাই মা আমার ছিল বড় প্রিয়, বড় আদরের। আমি শপথ করেছিলাম যে, মা-কে কোনদিন দুঃখ দেব না।

তাই আমার জীবনের দুই প্রিয় নারী- তোমাকে আর মাকে- নিয়ে চলে এসেছিলাম সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে, 'শান্তিনীড়' গড়ব বলে......

মা বলেছিলেন, “তোরা এখন দুটিতে যা, আমি যা পাই নি জীবনে, তোরা যেন তা থেকে বঞ্চিত না হোস এই প্রার্থনা করি আমার ঠাকুরের কাছে।” এই ছিল আমার আদরের মা!



তুমি কান্না ধরলে, একা আসবে না আমার সাথে। আমি আড়াল পেয়ে তোমাকে বলেছিলাম, “আমি কি তোমাকে যত্ন করতে পারব না? চলো না; মাকে পরে নিয়ে যাব।”

তুমি এত কম কথা বলতে যে, হ্যাঁ কি না! কি বলতে চাও জানা গেল না। তখন আমি আরো ছুটির ব্যবস্থা করে তোমাকে আর মা কে নিয়ে এলাম সাথে করে।



সে কি আনন্দের দিন ছিল রূপা, মনে আছে? কত যায়গায় গেছি বল। মায়ের মুখে সব সময় দেখতাম আত্মতুষ্টি। সত্যি তোমাকে পেয়ে আমি আড়ালে তোমার ঠাকুরকে বলতাম যে, “ তোমায় কি দিয়ে পূজো করলে তোমার ঋণ শোধ করা যাবে ঠাকুর।”

তোমাকে কিন্তু আমি রাগাতাম যে, “ধ্যুস! কি রাতদিন পূজো করো, বলো তো? আমাকে পেয়েছো তো, আবার কি চাই? হাসছি জানোতো”। তুমি হাসতে আমার কথা শুনে। হাসলে তোমার ঠোঁটের দুপাশে কি সুন্দর দুটো ছোট্ট টোল খেলত। লিপ্সটিকও তোমাকে লাগাতে হতো না, কেন বলত?

হা! হা! হা! আমেরিকান বন্ধুরা কি বলত তোমাকে দেখে? তুমি সব জানো; তাও লিখছি এইজন্য যে, সবাই জানুক আমার আদরিণী রূপা কত সুন্দরী ছিল।



২.

তুমি যেখানেই থাকো রূপুসোনা ফিরে এস, নয়ত বল কি করলে আমিও তোমার কাছে যেতে পারি? তোমার কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাও প্লিজ। মা যে বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন, সেটা কি তুমি জানো? মেয়েও তো কেমন চুপচাপ থাকে আজকাল, আগের মতন সে আর গান গায় না। আর সেই যে তোমার ছেলে “টমি” সে তো সব সময় জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা তাও বলে বোঝাতে পারি কিন্তু একটা অবলা জীব কত কষ্ট পাচ্ছে তা তুমি নিজের চোখে না দেখলে বুঝতে পারবে না।

লিখতে লিখতে কোথায় যে হারিয়ে গেছিলাম কে জানে।

হঠাৎ করে ভেজানো দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে যা দেখলাম তা তো বিশ্বাসযোগ্য না। চমকে উঠে নিজেকেই চিমটি কেটে বললামঃ” আমি সজ্ঞানে না অজ্ঞানে? এ আমি কাকে দেখছি? এ কি সত্য না কাল্পনিক।”

-“এই দেখো কি দেখছ ? এসো! সবাই মেয়ের বাবাকে খুঁজছে আর তুমি এখানে বসে আছো দরজা বন্ধ করে? মেয়ে কেমন শাড়ি পড়েছে আজ প্রথম, দেখবে এসো।”

আমি অবাক- বাকরুদ্ধ- স্ট্যাচু হয়ে গেছি। আমি মনে মনে ভাবছি আমি কি বেঁচে আছি? না, না তা হয় না। আমি বেঁচে আছি আর রূপা শোনো! তোমার জন্যই বেঁচে আছি। ছুটে তোমাকে ধরতে ইচ্ছে করছিল আবার ভাবছিলাম কি জানি আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? তাও আমি সরিয়ে ফেললাম আমার পান্ডুলিপি। তুমি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলে একটিবার কাছে এলে না, এখনও সেই নতুন বিয়ের মতন লজ্জায় থাকো।

আস্তে আস্তে বললেঃ “ সবাই অপেক্ষা করছে, পরে সব কথা হবে। এখন দেরী হলে সবাই কি ভাববে, ছিঃ! লজ্জা করে না বুঝি? তুমি না কি?”- তোমার এই রূপটাই সবচেয়ে পছন্দ আমার।

তাও হতবাক হয়ে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তোমার পিছু পিছু এসে দাঁড়ালাম সবার মাঝে। সবাই আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠে বলল, “তোমার সারপ্রাইজ গিফট এনেছি, দেখেছ।” আমি কিন্তু তখনও ঘোরের মধ্যে আছি মনে হল।

সব কিছুই একটা স্ব্প্নের, সিনেমার প্লটের মতো মনে হল। হঠাত করে এ আমি কাকে দেখছি? আমার যায়গায় যে কেউ থাকবে সেই ভাববে। এটাই তো স্বাভাবিক। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুল না, শুধু নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি এসে আমাকে বললে সেই হাসি দিয়েঃ

“~ এই তো আমি! বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

ঐ দেখ আমার তানিয়াদিদি আর তুহিন জামাইবাবু। ওদের সাথে আমি এসেছি মুম্বাই থেকে দুদিন আগে। মেয়ে আমাকে দেখে এই দিনে পার্টির ব্যবস্থা করেছে, জান তো? এত চিন্তা কেন করছিলে? আমি তো কিছুদিন আগেই গেছিলাম।”

তখনও আমার ঘোর কাটে নি। হঠাত করে এই দিনেই কি করে সে এল? অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। মনে হল ও কোথায় ছিল এতদিন; ওর হয়ত মনে নেই। মা-র কথায় আবার আমি স্বাভাবিক চেতনায় ফিরে এলাম। মা আমাকে বললেন, “এই দ্যাখ আমার রূপা আবার ফিরে এসেছে। আমাদের ছেড়ে ও কোথায় যাবে বল তো! ঠাকুর আমাদের পরীক্ষা করছিলেন আমরা সবাই পাশ করেছি বলে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।”

‌যাই হোক, হৈ হট্টগোল এর মধ্যে দিয়ে কেটে গেল শুভ মূহুর্ত। সেদিন আবার আমাদের বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। এরা কি তবে প্ল্যান করে সব করেছে? আমাকে সত্যি সারপ্রাইজ দেবে বলে রূপাকে এরাই লুকিয়ে রেখেছিল? এতদিন ধরে কেন তারা আমাকে আর মাকে কষ্ট দেবে? না...না! তা হয় না; এরা যে আমাকেও ভালবাসে খুব। আর আমার মা তো তার ছেলেকে উদাস দেখতে চান নি ।

এতদিন না এসে হঠাত করে এলই বা কি করে? অন্য কোথাও কি ছিল একটা বিরাট সারপ্রাইসড দেবে বলে, এদেরই কি সবার প্ল্যান? হাজার প্রশ্ন ভিড় করতে শুরু করেছে। রূপার তানিয়াদিদিরাই বা হঠাত আসলেন কেন এত পয়সা খরচ করে?

ফাঁক খুঁজে রুপার তুহিন জামাইবাবুকে জিগেস করতে যাব আর তুমি এসে হাজির, আমাকে হিরহির করে টেনে নিয়ে গেলে সবার মাঝে। কিন্তু একটা প্রশ্ন খালি মনের মধ্যে সাপের মত কিলবিল করতে লাগল। তারই টানাপোড়েনে মন বুনে চলেছে তখন বালুচরী আঁচলার নকশা।

সুযোগমত সবার আড়ালে তানিয়াদিকে জিগেস করলে উনি বললেন, “ সময় মত সব কথা জানতে পারবে। ইটস দি টাইম টু এনজয়। সো এনজয় নাও।”

ফাঁকা হতে লাগল বাড়ী। খালি আত্মীয় স্বজন গুলতানিতে মেতে উঠল।

তারপর একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। আমাদের মেয়ে তাতা ওরফে শ্রীরূপা আমাদেরও শুয়ে পড়তে বলল।

রূপা স্বাভাবিক ভাবে রাতের পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে বিছানায় শুতে... শুতে বললঃ “আজ বড় আনন্দের দিন ছিল, কি বল? এস দাঁড়িয়ে কেন? কি ভাবছ বল তো?” আমি বিছানায় গিয়ে শুলে ও আমার হাত ওর বুকের কাছে নিয়ে এক নিমেষে ঘুমিয়ে পড়ল। আর আমি অবাক হয়ে আমার গরবিনী রূপাকে দেখতে লাগলাম। কি প্রশান্ত মূর্তি আমার রূপার। কি সব বাজে বাজে চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছিল। দুষ্টু সন্দেহও তো মনের কোণে উঁকি মেরেছিল।

পরের দিন সুযোগ মত তুহিন জামাইবাবুর কাছে যা শুনলাম আমার অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না.........

রূপাকে নাকি পুনার গনেশ খিন্ড রোড -এর আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম থেকে খুঁজে পেয়েছেন ওনারা। ওখানে জিগেস করাতে আশ্রমবাসীরা কিছু বলতে পারে নি। রূপা নাকি কোথা থেকে এসেছে তাও বলতে পারে নি আশ্রমে। শেষে ওনারা পুলিশে খবর দেন এবং পুলিশ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। সেই কাগজে ছবি দেখে তানিয়া আর তুহিন গিয়ে নিয়ে আসে রূপাকে। খবর পেয়েই তারা আটল্যান্টায় তাদের খবর পাঠায়, কিন্তু ফোন ধরে তাতা। তারপর শশধরের মাসীমাদের খবর দেয়। কিন্তু তানিয়া ওনাদের বলে দেয় যে, শশধর যেন জানতে না পারে। তাকে সারপ্রাইজড দেওয়া হবে, সেই মতন কথা হয়ে আছে তাতার সাথে।

সব শুনে মেয়ে শ্রীরূপা তখন তানিয়াদের আসবার টিকিট পাঠায়। কারণ মেয়ে ভাবে , “মা-এর একা আসা নিরাপদ নয়।” শ্রীরূপা ওরফে তাতাই ঠিক করে এই পার্টির। বাবাকে বলে যে, মায়ের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কাজেই পার্টির আয়োজন কর। তার বাপিকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয় নি সে তার মায়ের ফিরে আসার খবর।

মনে শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন বাসা বেঁধেছিল তখন.........।।!

তাহলে কি রূপাকে কেউ হিপ্নোটিজম করেছিল, না কেউ তাকে নিয়ে গিয়ে জোর করে আশ্রমবাসী করতে চেয়েছিল, রূপা কি কারুর সাথে আলাপ হওয়ার পর আনন্দময়ী মায়ের সম্বন্ধে জানতে পেরে কৌতূহলবশতঃ আশ্রমে গিয়ে উঠেছিল......কে বলে দেবে এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর। রুপাকেও তো জিগেস করা ঠিক না। আর কিভাবেই বা জিগেস করবে!

যদিও দরকার নেই তবুও সন্দিগ্ধ মনটা বড্ড বেয়াদপী করে। একটু অবাক লাগছে যে, তুমি এসে থেকে অবধি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছ, সাজগোজ অনেক কমে গেছে। আগের মতন সেই ম্যাচ করে জামা কাপড় আর পড়ছ না তো। সব কেমন যেন ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে।

যাই হোক, যখন এসে গেছো তোমার নিজের বাসায়, তখন তোমার আসার পর থেকেই না হয় আমি আমার লেখার অর্দ্ধেক শেষ করবো ঠিক করেছি। এ তো ঠিক সিনেমা তিনঘণ্টার গল্পের মতন।

সময়ের ভেলা কেড়ে নেয় বেলা

দিগন্তে আসে ঢেউ

মাতলামো জাগে লেখা লেখা খেলা

জানে না যে আর কেউ

টাইম ক্যপ্স্যুলে ভরা আছে তব

মিস্টি হাসির ঢেউ...

জানোতো! আমি আমার লেখার এই শেষের অংশটা লুকিয়ে লুকিয়ে লিখছি যাতে তুমি জানতে না পারো। তুমি এখন নিচে আত্মীয় স্বজন-এর খাবার দাবার এর ব্যবস্থা কোরছ যেটা সব চেয়ে প্রিয় তোমার জীবনের। তুমি মনে কর “মানুষকে আদর করে খাওয়ানোটাই সব চেয়ে প্রয়োজন, নারায়নরূপী মানুষ-ই ভগবান।”

ও যাজ্ঞসেনী আমার- গভীর রাতের তটে ঠিক জোনাকী আলোর মত মসৃণ আলো দিও,

সন্ধ্যার মাস্তুলে কোথাও আগুন যেন জ্বেলো না, অরুন্ধতী চোখ ইশারায় আবার করে খুনসুটি করো ......

আজ আমি সত্যি খুব হাসছি দেখো। হা হা হা হা। শুনতে পাচ্ছো, রূপা ? সারা বাড়ী প্রতিধ্ব্নি শুনছে। সারা বাড়ী হাসছে আজ তোমার আসাতে। তুমি চিরদিন তোমার সাজানো বাড়ীতে থেকো রূপা। তোমার যেমনভাবে থাকতে ইচ্ছে হয় থেকো। কোথাও আর হারিয়ে যেও না। তোমাকে যে আমাদের সবার খুব প্রয়োজন। মেয়ে কি বলে জানো তো!

বলে, “বাপি! লেখো না তোমাদের জীবনের ভালবাসা। সেই লেখাটাই হবে আমার জীবনের ধ্রুবতারা। তোমাদের প্রেমের গল্প নিয়ে দেখবে একদিন সিনেমা হবে। আমি তার ব্যবস্থা করব বাপি। সব লোকে জানবে ভালবাসার দ্ব্যর্থক নেই।”

আমি যে তোমাকে মিস কোরতাম আমাদের মেয়ে সেটা ভালভাবেই বুঝত, কিন্তু মুখে কিছু বলত না, ঠিক তোমার মতন। আজ আমি বড় সুখী। আমি একটুও বিশ্বাস করি না- ভালবাসা কেবলি যাতনাময় ! বিশ্বাস করি-ভালবাসা সুখেরও কখনও হয়। আমরা, তথাপি, সরব ও রঙ্গীন করে তুলতে চাই আমাদের গল্পগুলোকে, আর সত্যের রাংতা, এতোই ঝকমকি ও প্রতিরোধ্য যে, এমনকি, তোয়াক্কাও করে না কোন নৈ্তিকতার।

এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না!!!

রূপা! আমার ইহকাল পরকালের সব ভালবাসা তোমার জন্য গচ্ছিত রাখলাম।

1 কমেন্টস্:

Unknown বলেছেন...

আসলে আপনার লেখাটা জরুরি...অন্তত মানুষের মানসিক প্রশান্তি পেতেই আপনার লেখা উচিত বার বার....আশিস বিশ্বাস, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন