২৯ অক্টো, ২০১৩

ধারাবাহিক উপন্যাস - অলভ্য ঘোষ

পর্ণমোচী
অলভ্য ঘোষ



প্রথম পর্বের পর……..


কামাল কে ধাক্কা মেরে দু পা পেছনে সড়ে দাঁড়িয়ে ছিল মালতী । -"হাতে চুড়ি পড়ো গে । পুরুষ হয়ে জন্মেছো একটা মাইয়া মানষের রক্ষা করনের ক্ষমতা নাই । তবে জেনেরাই-খ তোমারে নাপাইলে আমি বিষ খাব । "

কামালকে ঝাঁকিয়ে কামালের শত-ছিদ্র জামাটা মুঠ থেকে মুক্ত করে কাঁদতে কাঁদতে দ্রুতগতিতে ছুটে পালিয়ে ছিল মালতী। পেছনে পুকুর ঘাটে পড়েছিল মালতীর কৈশোর;কামাল আর তার গ্রাম । দিনের শেষে সন্ধে রাতের অন্ধকারের আধিপত্য বিস্তার করে বসছিল তিলে তিলে ।

সানাই এর সুর তখনো অনুরণিত হয়ে চলেছিল মালতীর কর্ণ গহ্বরে । দুই হাতে কান চেপে অভিজাত বনেদি একটি গৃহের সুসজ্জিত ফুলাচ্ছাদিত বিছানার এক পাশে বসেছিল মালতী । পরনে লাল বেনারসি । চোখ দুটো অশ্রু প্লাবনে ফোলা । দরজার কপাটের আঘাত হল । বাইরে থেকে প্রায় ধাক্কা খেয়েই ঘরে প্রবেশ করেছিল বিপিন । বিপিন মালতীর বর । একদিন আগে সবে এদের নব দাম্পত্য জীবনের শুভ সূচনা হয়েছে । সোহাগ রাত ;মালতী সঙ্কুচিত । সে কামালের কথা ভাবছিল । হটাৎ তার ভাবনার প্লাবন ভেঙে হয়েছিল বিপিনের সে ঘরে প্রবেশ ; দরজায় খিলের আওয়াজ টা বুকে বেজেছিল বাজ পড়ার মত। মালতীর বুক ধড়পড় করছিল । তার খুব কাছে এসে বসেছিল বিপিন । বিপিন যত চাইছিল দূরত্ব কমাতে । মালতীর ততো ইচ্ছে করছিল মৃত্যু তার সহসা উপস্থিত হোক । এক মাত্র মৃত্যুই কার নিমন্ত্রণ রক্ষা করে না । আত্মহনন করতে গেলেও মানুষ ব্যর্থ হয় । যদি মৃত্যু না স্বেচ্ছায় হননকে উপসর্গ করে আসে । বিপিনের হাতে অপসারিত ঘোমটার আড়ালে মালতীর লক্ষ্মী মূর্তির মত মুখ খানা উন্মোচিত হতেই ; মালতীর সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল ;হাতের মুঠো আলগা হয়ে সবুজ তুঁতের ডেলাটা খসে পড়েছিল বিছানায় । মালতী চোখ বুজে নিলে রাঙ্গা ঠোঁট দুটো তার আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল ভয়ে । শিকারির করপুটে বন্দি কবুতরের মত তার বুক ধড়পড় করছিল তখনো ।

-"আমারে দেইখো ।" প্রথমটা লজ্জা পেলেও ;প্রস্ফুটিত কুড়ির মত চোখ মেলে তাকাতে হয়েছিল মালতীকে । কৃষ্ণবর্ণ বছর পঁচিশের বলিষ্ঠ যুবক বিপিন সোহাগ রাতের প্রেমালাপের বাইরে বেড়িয়ে ছোট্ট মেয়ে মালতীকে সংসারে তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য গুলো সম্পর্কে মাস্টারের মত জ্ঞান দিয়ে চলেছিল। আর কোনে বৌ মালতী বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নেড়ে সায় দিতে দিতে এক সময় ঘুমে ঢুলছিল । গার্হস্থ্য জীবনের মালতী তখন কিছুই বোঝে না । বোঝার কথাও না । তবে এটুকু বুঝেছিল তার স্বামী বাবাজীবনটি কামালদার মত গোবেচারা নয় রাশভারী গম্ভীর ।বাবা মায়ের কনিষ্ঠ পুত্র বিপিন । সে চাইছিল যে সুখ,স্বাচ্ছন্দ্য,সেবা তার বাবা মা তাদের পুত্রবধূর কাছে প্রত্যাশা করে বসে আছেন তা থেকে যেন বঞ্চিত না হন । সংসারের নিয়ম কানুন ;নীলের বাতি,শিবরাত্রি, বিপদ তারিণী একের পর এক শৃঙ্খলে সেদিন থেকেই আবদ্ধ হয়েছিল মালতী । লক্ষ্মী ; লক্ষ্মী প্রতিমা । কুমোরপাড়ায় অর্ডার দিয়ে যেমন টি মনগড়া মেলে । মালতীকে ঠিক তেমনটি হতে হয়েছিল । পান থেকে চুন খসলেই ছিল শাশুড়ির মুখ ঝামটা । রাতে তার লোকটা আদর করতো খুব ;ঘাসের গায়ে ভোরের শিশির যেমন সূর্যের প্রকটতায় উবে যায় তেমনি কামালের প্রেম উবে যাচ্ছিল মালতীর জীবনে বিপিনের উষ্ণতায়।

সমস্ত ঘরটা অন্ধকার । ঘর ঠিক বলা যায় না ঝুপড়ি । চেঁচাড়ি,বাঁকারি,টিন,টালি,ইট বহুবিধ উপকরণের সমন্বয়ে নির্মিত মাথা ছাওয়ার জায়গা । একটা ছোট্ট তক্তপোশ ,কয়েকটা বড় বড় পুটলি ,একটা টিনের বাক্স ,দেওয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডার ,ঘরের এক কোনে রাখা কালো পোড়া মাটির ছোট্ট একটা খাবার জলের কুঁজো । ঘরে আসবাবপত্র কম হলেও সব কিছু বেশ পরিকল্পনা মাফিক রাখাছিল ।শিশু কন্যা সহ মালতী ঘুমচ্ছিল তক্ত পোষের ওপর । কোয়া বিন্যস্ত কাঁঠালের গন্ধে মাছি যেমন ভনভন করতে করতে ছুটে আসে ;তেমনি ফিসফিস কথোপকথনে ;ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজে পিচের ড্রামের তৈরি বন্ধ দরজা ফাঁক করে ;মোমবাতি হাতে অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করেছিল স্ফীত কায় মাঝ বয়সী এক ভদ্রমহিলা সহ গিলেকরা পাঞ্জাবী পরিহিত এক বাবু গোচের ভদ্রলোক । মেয়ের গায়ের ওপর থেকে মালতীর অবশ হাত সরিয়ে ঘুমাচ্ছন্ন তার মেয়েকে মোমবাতি মাঝেতে রেখে ঝুঁকে পোড়ে কোলে তুলে নিয়েছিল মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা । মালতী বিন্দু মাত্র বুঝতে না পেরে পাশ ফিরে শুয়েছিল । আঁচল টা বুক থেকে খসে পড়ায় রংচংয়ে গাজনের সং এর মতো বাবুটি একদৃষ্টি সে দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল । বাচ্চা কোলে সেদিকে তাকিয়ে গলা খাঁকড়ানি দিয়ে স্ফীত মহিলা টি বলেছিল; -"কই টাহাটা দাও দেখি । " লোকটা গেঁটের থেকে টাকা বাড় করেদিলে ;ভদ্রমহিলাটি অদ্ভুত এক নিপুণ ভঙ্গিতে বাচ্চা কোলে টাকা গুনে কমতি অনুভব করায় আর দশ টাকা বকশিস না ঘর ভাড়া দাবি করেছিল। মুখের সামনে কাবাব ; বাবুটি দরাদরিতে না গিয়ে আর দশ টাকা বারকরে দিলে ;তুষ্ট হয়ে টাকা আঁচলে বেঁধে মেঝে থেকে মোমবাতি টা তুলে বাচ্চা কোলে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিল মহিলা টি । বিছানার ওপর ছিল শিকার । টিনের দরজায় ছিটকানি এঁটে বাবুটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ক্ষুধার্ত হায়েনার মত মালতীর ওপরে । ঘুম ভাঙ্গা মালতী অন্ধকারে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা ছোবল মারতে শুরু করেছিল । ঘন নিশ্বাসের আওয়াজের সাথে তক্তপোষের ক্যাচ ক্যাচ ভেঙ্গে পড়ার সঙ্গত যখন ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করেছিল বাবুটির গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বাবুর শরীরের কোন নরম স্থানে কামর বসিয়ে দিয়েছিল মালতী ।

অর্ধ অবচেতন ;অনাবৃত বস্ত্র,এলোমেলো চুল,রক্তাক্ত শরীর মালতী হেঁটে চলেছিল নিস্তব্ধ গ্যাস পোস্টের আলোছায়া ঘন বড় রাস্তা ধরে । দিশেহারা !কোথায় কোনদিকে কেন হাঁটছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না মালতী । সহসা একরাশি আলো তার মুখ স্পর্শকরে ;মালতী মাথা ঘুরে লুটিয়ে পড়েছিল রাস্তায় । একটা মোটর কার সবেগে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে ছিল তার সামনে । কার থেকে নেমে এসেছিল এক বয়স্ক ভদ্রলোক চোখে চশমা,মুখে কাঁচা পাকা এক রাশ দাঁড়ি । -"কে মা তুমি ?" লোকটা মালতীর বাঁ হাত তুলে হৃদস্পন্দন খুঁজেছিল । মারা যায় নি মালতী তখন জ্ঞানশূন্য । জনশূন্য রাতের রাস্তায় লোকের অনুসন্ধান করে ব্যর্থ হলে উপায়ন্তর না দেখে ভদ্রলোক মালতী কে চাগিয়ে তুলেছিল নিজের মোটরে ।

ভোরের আলো সবে মাত্র ফুটেছিল । রাতের বড় রাস্তার মোটর গাড়ী টা এসে থেমেছিল কালীঘাটের এক বস্তি পাড়ার মুখে। কার থেকে সেই বুড় ভদ্রলোকটির সাথে নেমে দাঁড়িয়ে ছিল মালতী । চোখ মুখ তখনো উসকো খুসকো কেবল পোশাকের পরিবর্তন হয়েছিল তার । গায়ে ছিল একটা দামী শাড়ি । যা কেনার ক্ষমতা তার ছিলনা; ভাবার ও অবকাশ ছিলনা সেটা তাকে মানাচ্ছে কিনা । মালতীর সাথের ভদ্রলোক চারিদিকে চেয়ে বুঝে গিয়েছিল যে আচরণ মালতীর ওপর করা হয়েছিল তা সে পাড়ায় ছিল খুবই স্বাভাবিক । নিষিদ্ধ পল্লীটির আনাচে কানাচে সেই সকালেও কয়েকটা মেয়ে তীর্থের কাকের মত ছিল দাঁড়িয়ে । রাস্তার কলে স্নান করা অর্ধ-নগ্ন পুরুষদের ভিড়ে কোন কোন মেয়ে মুখে দাঁতন নিয়ে অপেক্ষা করছিল মুখ ধোবার জন্য । মালতী আগে আগেই যাচ্ছিল । তার পেছনের বাবুটির দিকে দেখছিল সকলে । একটা ঝুপড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরেছিল মালতী । বালতি হাতে মেদপূর্ন বেঁটে গোছের গত দিনের রাতের দালাল মহিলাটি এগিয়ে এলে মালতী বলেছিল ; -"আমার পোলাপান কই ।"

মালতীর সাথের ভদ্রলোকটির দিকে রহস্যপূর্ণ ভাবে তাকিয়ে মহিলাটি জিজ্ঞেস করেছিল ।

-"ইনি কেডা । বাবু নাকি ?" –

- "আমি ডক্টর চিন্তামণি সরকার । আপনি নিশ্চয়ই মেঘমায়া দেবী ?" –

"আপনার চিন্তে ভুল হয় নাই চিন্তামণি বাবু । তবে আপনার সঙ্গের মাইয়াটারে কতটা চেনেন ?" -"কাল রাতে একটা পেসেন্ট দেখে ফেরার পথে এই মেয়েটা আমার গাড়ীর সামনে পড়ে ;প্রথমটা আন্দাজ করেছিলাম পরে ওর কাছ থেকে বুঝেছি ওর ওপর নির্যাতন করা হয়েছে । "

মালতীর চিবুক বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছিল । কত মেয়ের অশ্রু রাশিতে সিক্ত এ পাড়া তার খবর কোন দিনই জানতে পারেনা মালতীর মত মেয়েরা ।বাঁকা চাউনিতে চেয়ে মেঘমায়া বলেছিল ।

-"আর কী জানেন । "

কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে চিন্তামণি সরকার মালতী সম্পর্কে যা জেনেছিল এক এক করে বলে যাচ্ছিলেন । ওপার বাংলা থেকে পাঁচ বছরের ছেলে ও ছয় মাসের শিশু কন্যাকে নিয়ে সবে মাত্র কলকাতার মাটি ছুঁয়েছিল মালতী । তার স্বামীর ;মালতীর কন্যা সন্তান জন্মাবার কয়েক দিন আগেই দাঙ্গায় প্রাণ যায় । বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল দাঙ্গাবাজরা । লুট করেছিল ধানের গোলা । প্রাণের তাড়নায় এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে;কাঁটাতার টপকে মালতী ইন্ডিয়াতে ঢুকেছে চোরের মত । দূরসম্পর্কের মাসি মেঘমায়া দাসের বাড়ি কলকাতায় ছুটে এসেছিল একটু আস্তানার অভিলাষে । চিন্তামণি গড় গড় করে বলে যাচ্ছিলেন ।

-"আর আপনি তাকে দিয়ে......"

মেঘমায়া বলেছিল; -"ব্যবসা করায়েছি । " –

"আপনার লজ্জা করছেনা বলতে ।" –

"লজ্জা করনের তো কিছুনাই । এইডা ভদ্র পাড়া নয় । এইহানে মাইয়ারা দেহ বেইচাই গ্যালনের জোগাড় করে । ওর মত মাগী এইহানে অনেক আছে কেউ পালায় নাই সতী হতি । "

রাগে চিন্ময় সরকারের ফরসা মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল । -

"জানেন আপনাকে আমি পুলিশে দিতে পারি । " –

"ওটি কইরবেন না লাভ হইব না । " –

"ওর ছেলে আর মেয়েটাকে দিন । আমি এখান থেকে নিয়ে যাব ওদের ।" –

"দেহেন চিন্তামণি বাবু রাগ করেন কেন । মাথা ঠাণ্ডা করেন । " ঠোঁট টাকে দাঁতে চেপে মেঘ মায়া দেবী স্বভাব সিদ্ধ ঢংয়ে ফিস ফিস করে বলেছিলেন ; -"সাদ লওয়ার বাসনা জাগিসে তা নেন না । মাইয়াটারে ভাগায়ে আমার ব্যবসা ডোবান কেন। "

প্রবল বজ্রবেগে ধমক দিয়ে উঠেছিল ডাক্তার চিন্তামণি । মহিলা না হলে চর কষিয়ে দিতেও হয়ত দ্বিধা করতেন না । মেঘমায়ার মেদাক্ত কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছিল ;এটুকু বুঝতে তার আর অসুবিধা ছিলনা যে এ বাবু টি এ পড়ায় দেহের সওদা করতে আসেনি । এসেছে এক প্রবল মানবিক টানে । চিৎকার চেঁচামেচি তে আসে পাশে বেস কিছু লোক জমে গিয়েছিল । মেঘ মায়া বোধয় বিপদের আসংখ্যা করছিলেন । ভয় পাচ্ছিলেন শেষ মেষ মেয়ে পাচারের দায়ে বুড়ো বয়সে হাজত বাসের । তাই হাঁক পেড়েছিলেন;

-" মেনকা ....ও মেনকা ও দুটারে লইয়া আন । "

মেনকা আবির্ভূত হয়েছিল তার কোলে মালতীর ছয়-সাত মাসের শিশু কন্যাটি মায়ের অনুপস্থিতি তে নির্দ্বিধায় পুপসি বোতলে দুধ খাচ্ছিল । মেনকার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে ফেল ফেল করে সবার মুখের দিকে দেখ ছিল মালতীর হাড় জিরজিরে নাক থেকে সিকনি ঝরে চলা ছেলে টা । মালতী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে প্রায় ছো মেরে ছিনিয়ে নিয়েছিল মেয়েটাকে ;বিশ্বাস , আস্থা ,ভালবাসা,স্নেহ ,মমতা বাংলাদেশের দাঙ্গাবাজ লোক গুলোর মত মালতীর মাসির হৃদয়ে ছিটে ফোটা নেই ;এক রাত্রির ব্যবধানে মালতী বুঝে গিয়েছিল । সদ্যজাত বাছুর কে গাই যেমন চেটে চেটে মাতৃত্বের স্নেহে সুরক্ষার অনুভূতি প্রদান করেন ;তেমনি মেনকার অসুরক্ষিত আঁচল ছাড়িয়ে বসে পড়ে বাঁ হাতে নিজের ছেলেকে বুকে চেপে ধরে তার শুষ্ক মুখে চোখের জল আর চুম্বনের রেখায় মালতী মাতৃত্বের স্পর্শ তুলে দিচ্ছিল। চির মাতৃত্বের পূজারী ভারত বর্ষ যে খবরের পাতায় পাতায় ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের আখরা হয়ে উঠেছে সে কথা ভেবে শিউরে উঠছিল চিন্তামণি । ভোগ যত বাড়বে ;মানুষ ততোই পণ্য হবে ; হবে বিপন্ন । বুঝতে পেরেছিলেন তিনি । যে প্রগাঢ় তীব্র স্নেহ মালতী তার সন্তান দ্বয় কে প্রদান করছিল তা অনেক কঠিন হৃদয় কেই গলিয়ে দেয় চক্ষু সজল হয়ে ওঠে । কিন্তু মেঘ মায়ার মায়া বর্জিত কসাই হৃদয়ে মালতীর এই সন্তান প্রীতি বিন্দু মাত্র মমতার সঞ্চার করতে পারছিল না । তার বাঁকা হাসি টি এ সব কিছুকেই ঢং বলে চিহ্নিত করে চলেছিল ।

মালতীর শেষ সম্বল হয়েছিল ডাক্তার চিন্তামণি কর । দেবদূতের মত এগিয়ে এসে মালতীর মাথায় হাত রেখে নিজের বাবার মত মালতী কে বলেছিলেন ; -"চল মা । "

এ হাত সকলের কপালে জোটে না । জুটলে এ পৃথিবীর অনেক অসহায় মানুষের সাহারা জুটে যেত ;অনেক বেদনার ভার হতো লাঘব ।

চারটের ঘণ্টাটা ঢং ঢং করে বেজে উঠলো । দূরে নামাজ পাটের আওয়াজ দিদুন কে নিত্যদিনের মত বিছানা ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। দিদুন চোখ মেলে তাকাল । ভেন্টিলেটর থেকে কয়েক ফোটা আলো চুইয়ে ঢুকছে ঘরে। ক্ষীণ হলেও দিনের আভাস টুকু প্রদানের ক্ষমতা এর যথেষ্ট । দিদুনের দুচোখ ভেজা । কাল রাতে মিতার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পুড়ন অ্যালবামের ঘোলাটে ছবি গুল স্মৃতির পৃষ্ঠা উলটে পালটে দেখেছে সে । বিছানায় পিঠ রাখার আর উপায় নেই । দেরি হয়ে যাবে । জল তুলে দুধ আনতে যেতে হবে দিদুন কে । বাজার টা ছেলেই করে । বৌমার রান্নার যোগার করে স্নান সেরে ঠাকুরের জল বাতাসা দিয়ে আহ্নিক করে কাজে বেড়য় দিদুন। একটা প্রাইমারী স্কুলে বাচ্চা দেখা শোনার কাজ করে সে। স্কুল থেকে ফেরার পথে সেলাই । টালিগঞ্জের এই দোতলা বাড়ির ছাদ আর স্কুলের কাজটা ডাক্তার চিন্তামণির দৌলতেই দিদুনের পাওয়া । চিন্তামণি সরকার আজ আর এ পৃথিবীতে নেই । বছর কুড়ি হল মারা গেছেন । দিদুনের মাথার ওপর তার সাদা কালো আবছা অস্পষ্ট ছবিটা বাঁধাই ফটো ফ্রেমে ঝুলছে । ছবিটাকে রোজকার মত ঘুম থেকে উঠে প্রণাম করেন দিদুন । নিজের বাবার মত শ্রদ্ধা করতেন দিদুন চিন্তামণি সরকারকে । ছবির ওপর শুকনো একটা রজনীগন্ধার মালা রূপ-রস ,যৌলশ হারিয়ে মাকড়সার সাম্রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত । দিদুন বিছানা ছেড়ে ঘরের দরজা খোলে । ভোরের আলো দ্বারস্থ অতিথির মত অভ্যর্থনা পেয়েই আসন গেড়ে বসল । অস্পষ্ট ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । দিদুন এগিয়ে যায় ছবিটার দিকে । কত চড়াই উতরাই পেড়িয়ে সেদিনের গ্রাম্য মেয়ে মালতী আজ মিতার দিদুন হয়েছে । শুকনো মালাটার মত সে শুকিয়েছে । তবু ঝড়ে পড়েনি । মাকড়সার জালের মত তাঁকে ধরে রেখেছে ছেলে ,মেয়ে ,বৌমা ,নাতনি এ সংসারের জটিল জটলাগুলো ।

গভীর দৃষ্টিতে দিদুন ছবিটার দিকে চেয়ে থাকে । একটা সুখ স্মৃতি জেগে ওঠে । - সর্বহারা মালতীর মাথায় হাত রেখে ছবির মধ্যকার ভদ্রলোকটি । তার স্নেহ আপ্লুত কথায় পিতৃ প্রেমের আভাস ।

-" তুই নাই বা হোলি আমার ঔরসজাত । তবু-তো আমি তোর নব জন্মদাতা । আমাকে তুই বাবা বলে ডাকতে পারবিনা-মা ! "

মালতী চোখের জল আর সামলে রাখতে পারেনি । -"বাবা..." বলে কাঁদতে কাঁদতে নব পিতার দু পা জড়িয়ে ধরেছিল ।

ভগবান তাকে ধন ঐশ্বর্য কিছুই দেননি দিয়েছেন চোখের জল । সুখে দুখে মনি মাণিক্যের মত তাই মালতী ও গুলোই খরচা করে । অন্যের কাছে তার চোখের জল সামান্য হতে পারে তুচ্ছ হতে পারে ;তবে মালতীর কাছে তা হৃদয় নিংড়ানো এক মাত্র সম্বল ।

দিদুনের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে মিতার ঘুম ভেঙ্গে যায় । বিছানা ছেড়ে পিছন থেকে দিদুনের কাঁধ স্পর্শ করে সে । ঠিক সেই সময় শিয়ালদাগামী প্রথম লোকালটা রেফারির মতো হুইসেল বাজাল । মিতার দিকে ঘুরে তাকায় দিদুন । সে বুঝতে পারে বেলা হয়েছে ;আর সময় নষ্ট করলে দেরি হয়ে যাবে স্কুলে ।

(চলবে)

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন