১ অক্টো, ২০১৩

ধারাবাহিক - অলভ্য ঘোষ

পর্নমোচী
অলভ্য ঘোষ



(এক)

কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রোগা ছিপছিপে এক যুবক । পরনে চুস জিন্সের প্যান্ট , গায়ে বাদামী সাট , চোখে গোল্ডেন গোল ফ্রেমের চশমা ।হাতে ডাইঅ্যারি । উদাসিন চোখ চেয়ে আছে সিঁড়ির দিকে । যেন খরাগ্রস্হ ভূমি বুক পেতে চোখ উনমুক্ত করে আকাশের পানে ।



বেল বেজে উঠলো । সহসা একদল ছেলে মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে । তাদের পেছনে সাদা সালোয়ার কামিজ আর নীল ওড়না বেষ্টিত বহু আকাক্ষ্মীত সেই বৃষ্টির বিন্দু । যার একহাতে মুঠকরা ছোট্ট এক টুকরো কাগজ । অন্যহাতটা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের হ্যান্ডেল টা শক্তকরে আঁকরে ধরে । চোখ দুটো রক্তবর্ন ।

এতো বৃষ্টিনয় । ঝঞ্জা অথবা সক্রিয় আগ্নেয় গিরি । এক মহা প্রলয়ের পূর্বাভাষ !

মোহনার কাছে এসে পড়া ক্লান্ত নদীর মত যুবক সোজা হয়ে দাঁড়ালো । দৃষ্টি অপরিবর্তিত । হৃদয় প্লাবন যেন বিস্তৃন্ন সমুদ্র বক্ষের আস্বাদ গ্রহনে অধিক মাত্রয় উৎসুখ ।

কিন্তু এ সাধ যে মিষ্টি নয় লবনাক্ত । সে যাইহোক ছোঁকরাটি যে এ লবনেই জাড়িত এ কথা বলবার আর বোধয় প্রয়জন পড়েনা । একটা দলাকরা কগজের টুকরো প্রত্যাখিত হয়ে এসে পড়লো তার মুখের ওপর । তার পর একটা চর । নদীর অভিমুখে যে বাঁধ সদম্ভে দন্ডায়িত হলো তা আকাক্ষ্মীত না হলেও অসহেষ্ণু নয় । কারন ছেলেটি অতলান্ত গভীরতার মোহাক্রান্ত । তাই এ বাঁধ ভাংতে তাকে হবেই । Geotropism এর প্রভাবে উদ্ভীদ মূলের মাটি ছোঁয়ার মতো ছেলেটি নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রোইল ।

হটাৎ করে কলেজ গেটের ব্যাস্ত পরিবেশে নেমেএল আপেক্ষিক স্তব্ধতা । যে ঝঞ্জা এতোখন এগিয়ে আসছিল তা আছড়ে পড়ে তরীৎ গতীতে প্রস্হান করেছে । তার এই আগমন ভূকম্পন এবং প্রস্হান ছেলেটার হৃদয়ে কতটা ঘা দিয়েগেল বুঝে ওঠার আগেই ব্যপারটা অবগত করার জন্য সবাই ছোট কাগজের টুকরো টার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো লুটের বাতাসা কুড়বার মতো ।

অপ্রত্যাসিত হলেও অধ্যাপক পি.কে পাল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে । হাতে এটেনডেন্স খাতা চক ডাস্টার । কন্ঠো গমম্ভীর ।

- " দেখি কাগজ টা । "

আবার স্তব্ধতা । কারও কারও মুখে মিচকি হাঁসি । কাগজের টুকরোটায় কি লেখা আছে ; কারও অনুমান করতে অসুবিধা হয় না । নিশ্চীৎ ওটা প্রেম পত্র । প্রেমিক মহাশয় রূপম বাঘিনী নামে

কলেজ খ্যাত মিতা কে অর্পন করে ছিল এবং মিতা তা সক্রোধে প্রত্যাখ্যান করেছে । প্রেম পত্রের আদান প্রদান এ কলেজে নতুন নয় তব প্রত্যাখ্যান পর্বটি অভিনব ।

প্রত্যাখ্যান পর্বের সমস্ত দৃশ্যটাই ওপর থেকে লক্ষ করেছেন অধ্যাপক পি কে পাল । তাই ছাত্রদের রসভজ্ঞন করে এগিয়ে এসে মন্টুর হাত থেকে কেড়ে নিলেন চিঠি টা ।

মন্টু মাথা চুলকাতে লাগলো । সবাই চেয়ে রইলো একে অপরের মুখের দিকে ।

পি কে পাল চশমার ওপরের ফাঁকা থেকে চোখ বাড়ালো কাগজের টুকরো টার ওপর । অতি পরিচিত ইংরেজী তিনটে ভালভাসার শব্দ প্রত্যেক মানুষোই কোননা কোন বয়সে কার না কার উদ্দেশ্যে তা উচ্ছারন করে । সোনালী কালিতে লেখা শব্দগুলো অভ্র আর জরীর ভেতর উজ্জবল ;পি কে পাল দেখলেন তার নিচে রূপমের নাম টা লেখা । চিঠি টা থেকে ফুরফুর করে মিষ্টি একটা সেন্টের গন্ধ বেড়চ্ছিল । সে গন্ধ অ্যাপক ছাড়াও পাচ্ছিল আসপাশের ছেলে মেয়েরা । চিঠি টা হাতের মুঠোয় সবুত প্রমান হিসাবে কড়ায়ত্ব হতেই । রূপমের দিকে আবর্তিত হলো মোটা কাঁচের পেছনের বড় দেখান পি কে পালের ডেবা ডেবা চোখ দুটো ।

-" তোমাকে ভাল ছেলে বলেই জানতাম । প্রিন্সিপাল মহাশয় তো তোমার প্রসংসায় পঞ্চমুখ । তুমি নাকি গোবরে পদ্ম্যফুল । এত দেখছি পদ্মও নয় শ্যাপলাও নয় জলার পানা কচুরী । কলেজ টাকে বিন্দাবন বানিয়ে ছেড়েচ । "

সবাই হোহোকরে হেসে উঠলো রূপম আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো অবনত ভাবে ।

পি কে পাল পা বাড়ালেন টিচার্স রুমের দিকে ;যাবার সময় শেষ কথাটি বললেন ;

-" রসায়নের বদলে এবার আমি তোমাদের রোমান্সের ক্লাস নেব ।"

প্রিন্সিপাল রুমের দরজার কাছে এসে মিতা থেমে গেল । রুমের ভেতর যেন বাজ পড়ছে । যার এদিক ওদিক ছিটকে পড়া শব্দ গুলো মিতাকেও কাঁপিয়ে তুললো ।

_" তোমাকে নিয়ে আমার আনেক আশাছিল সব আশা মাটিতে মিশিয়ে দিলে । তোমার মতো ছেলেকে রাস্টিকেট করে কলেজ থেকে তাঁড়িয়ে দেওয়া উচিত দিতাম ও তাই । নেহাত সব প্রফেসারেরা আমার কাছে আবেদন করেছে তোমাকে যেন একটা সুযোগ দেওয়া হয় ; তাই এ যাত্রায় বেঁচে গেলে । পারলে নিজেকে সুধরে নিও না হলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে।"

একটু থেমে দীর্ঘ নিশ্বাসের সাথে সাসপেন্ট লেটার টা রুপমের দিকে এগিয়ে দেন প্রিন্সিপাল ।

-"তিন মাস এ কলেজের ক্লাসরুম ,লাইব্যেরি ,কমোনরূম কোনকিছুই তুমি ব্যবহার করতে পারবে না । "

মিতা এবার এগিয়ে আসে ;

-"মে আই কামিন স্যার ? "

প্রিন্সিপল তার বাজখাই গলায় বললেন ;

-" ইয়েস কামিন ।"

প্রিন্সিপাল মহাশয়ের টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল মিতা । টেবিলের অপর প্রান্তে এখন আসামীর মতো মাথা নিচুকরে দাঁড়িয়ে রুপম । চোখ দুটো তার লাল ; এসব ছেলেদের অপমান লজ্জা স্পর্শ করে কিনা জানানেই মিতার ।

প্রিন্সিপাল এবার রুপমের দিকে তাকালেন :

-"তোমার কিছু বলার আছে ?"

ইঙ্গিতটা এমন এবার তুমি আসতে পার ।

হলকা মাথা নেড়ে রুপম জানালো -"না ।"

তারপর প্রন্সিপাল মহাশয়ের টেবিলের ওপর থেকে প্রিন্সিপালের চিঠি খানানিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বেড়িয়ে যায় । এক বারো সে তাকায় না মিতার দিকে ।

মিতার দৃষ্টি এতখোন আবদ্ধছিল টেবিলের এক কোনায় অপমান বোধ তাকেও যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে । কলেজ ময় তাকে নিয়ে হোইহট্টোগোলের অন্তনেই । নিজেকে ভীষন ছোট মনেহচ্ছে তার । একটা সামান্য চিঠি নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি না করলেই বোধয় ভালহতো । কত মেয়েকেই তো মিতা দেখেছে এমন চিঠির শিকার হতে । এইতো সেদিন বিকাশের প্রানবন্ত সেন্টদেওয়া একখানা চিঠি মিতার ডেক্সের পাশদিয়ে ক্লাস চলাকালিন পৌঁছাল মৌসুমীর ডেক্সে । মিতা বড় বড় চোখে তাকিয়েছে । কিন্তু মৌসুমি কে সে দেখেছে ব্যাপার টা বেস উপভোগ করছে সে । মিতা পারেনা ওদের মতো নিজেকে মেলে ধরতে ।

প্রিন্সিপল বললেন ;

- "কলেজের কোন ছেলের গায়ে অমন করে হাত তোলা তোমার ঠিক হয়নি । চিঠি টা নিয়ে আমার কাছে আসা উচিৎ ছিল। "

মিতা চুপ করে থাকে । চিঠি টা পাবার পর কিযে হলো মাথা ঠিক রাখতে পারেনি সে । একটা অবগ্যা অপমান ছিল চিঠিটার অন্তকরনে । কিসের অপমান মিতাও ঠিক ভালভাবে জানেনা চিঠির কোন শব্দটা তাকে অপমান করছিল । তবে ভালবাসা সম্পর্কে মিতার ব্যাক্তিগত মত হল এটি মেকি ,জোচুরি ,নোংরা অভিসন্ধী ।

প্রিন্সপল রুমের দরজা অতিক্রম করার পূর্বে প্রিন্সিপল বললেন;

-" কলেজের আনাচে কানাচে কমোন রুমে এখন অনেকে অনেক কথা বলবে কান দিয়না ওসবে । "

ক্লাশ শুরু হয়নি ছড়িয়ে ছিটিয়ে জটলা বেঁধে আলোচনার ঝড় বইছিল ক্লাশ রুমে । মিতাকে দেখে কে যেন ফিস ফিস করে বলে উঠলো

_"ঐ যে বাঘিনী এসেগেছে ।"

ছাত্র ছাত্রীরা আড়ালে আপডালে তাকে এ নামেই ডেকে থাকে । মিতার গম্ভীর ভাবমূর্তিই এ নামকরনের উৎস । রুমা মিতার একমাত্রী বান্ধবী । স্কুল থেকে সে তার সহপাঠিনি । একি পাড়ায় থাকে সে । ক্লাস রুমে রোজকার মতো সেই একান্ত বান্ধবী টির পাশে এসে বসলো মিতা ।

রুমা বলল ;

-"কিরে আসার পথে আজ আমার জন্য দাঁড়ালি না । "

মিতা বলে;

-"দিদুন বলল তোর শরীর খারাপ । তাই ভাবলাম তুই বুঝি কলেজে আসবি না । "

ক্লাসরুমের ছোট ছোট জটলা গুলো তখন এক হয়ে গিয়েছিল । প্রিয়ঙ্কা গুছিয়ে বসল ডেক্সের ওপর । মিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল :

-" না এমন সুযোগ পেলে আমি লাইন মারতে ছাড়তাম না । কলেজের সমস্ত মেয়ে যার জন্য পাগল ;তাকে পেয়ে refuse; impossible ......!"

কাকলি কর্কোস কন্ঠ্যে আরো সংযোজন করল ;

-"বেশী সতী পানা । "

দেবু হাসতে হাসতে বলল ;

-"ছেলেটাও কি মাইরী ;বাপের এত টাকা ইচ্ছে করলে হাজার টা মেয়ে চড়াতে পারে । শেষে কিনা প্রেমে পড়লো একটা unsocial শাকচুর্নীর ।"

বিকাশ এই যঞ্জে ঘি ছিটালো ।

-"প্রেম কী আর যে সে প্রেম । দেবদাসের মত ঘন্টার পর ঘন্ট্যা ক্লাসের পর ক্লাস নায়ক নায়িকার দিকে চেয়ে বসে আছে । নায়িকার সে দিকে ভুরুক্ষেপ ও নেই । "

মন্টু বলল তার গুঠকা খাওয়া লাল দাঁত বাড়করে ।

-"শেষ পর্যন্ত মনের কথাটা ছোট্ট কাগজের টুকরোয় ট্রান্সফার হল নায়িকার ডায়েরিতে । "

রিন্টু চেঁচিয়ে ওঠে ;

-"বেশ কেলেঙ্কারী । "

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো ।

মিতার মুখের চারিপাশে ঘন ঘামের বিন্দ্যু জমতে শুরু করেছিল । অশান্তির আসংখা অনুভব করে মিতা বলে ;

-"আজ আর ক্লাস করতে হবে না । চল বাড়ি যাই । "

রুমা যে কটাক্ষ করে বুঝিয়ে দিল যতসব বাজে ছেলে মেয়ে এ কলেজে জুটেছে । এটা আর কার বুঝতে অসুবিধা হলো না । বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়তেই কোন একটি ছেলে মেয়েলি গলা করে বলল:

-"বাবা বাঘিনীর সাথে থেকে ছ্যুচটাও গর্জন করছে রে ।"

মিতা থমকে ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালে তার হাত ধরে ক্লাস রুমের বাইরে নিয়ে যায় রুমা ।



(দুই)

কিছুক্ষন আগে বজবজগামী শেষ লোকাল টা রাতের নিশতব্দতাকে ভঙ্গকরে সবকিছু কাঁপিয়ে সাসা বেগে চলেগেল । অন্ধকারে ডুবে থাকা দূরের বস্তির ঝুপরি গুলো থেকে যৎসামান্য আলো ফাঁক ফোঁকর ফুরে উকি মারছে । লাইনের ওপাড়ে একটা ব্যালকনিতে কারা যেন দাঁড়িয়ে । পুতুলের মত দেখাচ্ছে তাদের । সমস্ত পাড়া নিশতব্ধ । শীতের আমেজ রাত বারটাকে যেন আর গভির করে তুলেছে । মিতার মামি এঁটোবাসন বাইরে গুছিয়ে রেখে ; স্বামী কন্যাকে নিয়ে সুখনির্দাচ্ছন্ন । দিদুন এখন বাড়ি ফেরেনি । মিতার পড়ার খরচ চালাবার জন্য সেলাই করে সে । মিতার মা চিলেকোটার ঘরে বিড়াল বাচ্ছা গুলকে কাঁকেনিয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমচ্ছে ।

মিতা মায়ের কাছে গিয়েছিল ;দিদুনের একটা ছেঁড়া শাড়ি আর কিছু টুকরো বাতিল কাপড় দিয়ে মায়ের জন্য একটা কাঁথা বানিয়েছে সে । মায়ের গায়ে ঢেকে দিয়েছে সেটা । হাত বুলিয়েছে মায়ের মাথায় । ঘুমন্ত মায়ের হাতটা নিজের মাথায় রেখে বলেছে ;

-" আমাকে আদর করবে মা । "

ওরবড় ইচ্ছেকরে ঐ বেড়াল বাচ্ছাগুলোর মতো মায়ের কোলে মাকে জড়িয়ে ঘুমাতে । মা হাত টেনে নিয়েচে ঘুমের ঘোরে । আশ্রয়হিনতার যন্ত্রনায় মিতার চোখ বেয়ে এসেছে জল । রোজ রাতে সবার চোখের অলক্ষে সে তার মাকে দেখতে আসে ; অন্ধকার এই চিলেকোটার সরু পায়রার খোপের মত ঘর টায় । এখানে কুকুর বিড়ালের মত তার মা বেঁচে আছে । সারা দিনে এই ক্ষুদ্র সময় টুকুর জন্য সে তার মাকে কাছে পায় ।

এমনি এক রাতে বিছানা থেকে উঠে মাকে আদর করতে এসেছিল মিতা । বুঝতে পারেনি মা জেগে ;গলা চেপে ধরেছিল তার । দমআটকে আসছিল ; চিৎকার করে কেঁদে ফেলেছিল মিতা !দিদুন,মামা,মামি বাড়ি শুদ্ধু সবার ঘুম যায় ভেঁঙে । মায়ের হাত থেকে মামা মিতাকে ছাড়িয়ে সজোরে চর কষিয়ে ছিল ।

-" রাতের বেলা এই পাগলিটার কাছে আদিখ্যেতা করতে এসেছিস । "

দিদুন কে গালিগালাজ করে বলেছিল ;

-" তুমি মেয়েটার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছ । "

অবশেষে সারা রাত বিছানায় দিদুনকে আঁকরে ধরে কেঁদেছিল মিতা । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বার বার বলেছিল -"ঐ পাগলী টা আমার মা দিদুন । আমার মা......."

ফাঁকা ছাদের রেলিংয়ে চিবুক রেখে মিতা চেয়ে আছে দূরে রেল লাইনের অবিচলিত স্হীর ল্যাম্প পোস্ট গুলোর দিকে । ঝড়-বৃষ্টি,শীত-গ্রীষ্ম সকল দূর্যোগ মাথায় নিয়ে ও গুলো কেমন ভাবলেস ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে । মিতা চায় ঠিক অমনি ভাবে তার দুঃক্ষ -কষ্ট ,অবগ্যা -আবহেলা,প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সব কিছুকে উপেক্ষা করে ওদের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে । অসমতল,অস্বচ্ছ এই জীবন পথে চির অটল অনড় ভাবে।

কখনো কখনো তার দৃঢ়তায় ভাঁঙ্গন চলে । মিতা অসহায় বোধ করে । কৈসর কেটে গেছে মামির ফাইফরমাইস খেটে । সদ্য প্রাপ্ত যৌবনেও তার জীবনে কোন রসসিক্ত পরিবর্তন আসেনি । তার একাকিত্বতা আরো চেপে ধরেছে তাকে । হোই হুল্লর ,সিনেমা সিরিয়াল,গান বাজনা কিছুই ভাল লাগে না তার । মা বাপের স্নেহের দুলালী হয়ে উঠতে পারেনি সে আর দশজনের মতো । দিদুন ছাড়া কাছের বলতে তার আর কেউ নেই । দিদুনের কিছু হয়েগেলে একদম একা হয়ে যাবে মিতা । কথটা ভাবলেই ভাড়ি হয়ে ওঠে মিতার মোন ।

মিতার মাথায় তেল মাখানোর সময় ;দিদুন সমস্ত আশির্বাদ ভালবাসার প্রলেপের সাথে ঢেলেদিয়ে বলে ;-"তোমারে বড় হতে হইব । মানুষ হতে হইব । কেডা কয় তোমার কেউনাই !তোমার মা আসেনা ;তারে তোমারে দেখতে হইব । আমি আর কদিন ।"

-"না দিদুন ও কথা বলনা । "

দিদুনের গালে চুমু খেয়ে এ কথাটা বললেই ছোটবেলা থেকে গলা জড়িয়ে ধরে মিতা । আদর করার ও আদর পাবার তার একমাত্র সম্বল এই দিদুন ।

পাড়ার রাস্তার আবছা অন্ধকার ভেদকরে খয়েরি চাদরে মোড়া সেই বুড়িটা এগিয়ে আসছে এই বাড়িটার দিকে । কিছু ক্ষন পরে ছাদের ভেজান দরজাটা সানডে সাসপেন্সর ভুতের বাড়ির সদর দরজার মত কেঁচকেঁচ আওয়াজে খুলে গেল । মিতা শুনতে পেল অতিপরিচিত দিদুনের আদুরে গলার ডাক ;

-"কেডারে ওহানে ? মিতু ? "

-"হ্যাঁ দিদুন ।"

চাঁপা বসাগলায় উত্তর দিল মিতা ।

-"গলাটা এমন বসলো কি কইরা ? ঠান্ডা লাগায়েছস । কি দরকার ঠান্ডায় ছাদে দাঁড়ায়ে থাকনের ?"

রোজয়ি দিদুন প্রশ্নটা ছুড়েদেয় মিতা কে । কিন্তু সে কোন উত্তর না করে দিদুনের হাত ধরে ঘরে ঢোকে। তারপর ঢেকে রাখা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমতে যায় ।

আজ মিতার নিয়মানুবর্তিতায় দিদুন ফরাক অনুভব করল । তেমন প্রানোচ্ছল অব্যরথনা ছিলনা তার ব্যবহারে । দিদুনের খাবার বেড়ে চৌকির ওপর উঠে মোশারির কোনগুলো টাঙাতে ব্যাস্ত হয়ে উঠলো সে । ছাদে ধুয়ে আসা ভিজে হাত খানা গামছায় মুছতে মুছতে এ সমস্ত কিছু দেখে দিদুন বুঝতে পারে মিতার মন টা ভাল নেই । মিতার জীবনের সব কম্পন;সব অনুভূতি দিদুনের সদা সহানুভূতিশীল হৃদয়ের রিক্টার স্কেলে ধরাপরে ছোটবেলা থেকে নিজের হাতে নেড়েচেড়ে মানুষ করেছে তাকে ।

- "কি হইছে ;তোরে কেউ কিছু কইছে ? "

মিতা মশারি গুজতে গুজতে থেমে যায় । মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে না বলে ।

দিদুন আবার প্রশ্ন করে ।

-"মায়ের শরীর খারাপ করছে । "

মিতা আবার মাথা নেড়ে না বলে বালিশের ওয়ার ঠিক করতে থাকে ।

দিদুন তবুও মিতার কথায় আশ্বস্ত হতে পারেন না ।

-"তোরে এমন মন মরা দেখাইতেছে কেন ?"

মিতা ম্লান মুখটায় একটা চেষ্টাকৃত হাসি আনার চেষ্টাকরে বলে ;

-"কই কিছু হয়নিতো । "

এই সামান্য কথাটুকু বলতে গিয়ে তার গলা ধরে আসে ।

দিদুন বিছানায় বসে মিতাকে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন । মিতাকে হালকা করার এ প্রন্হা সতের বছর ধরে অবলম্বন করে চলেছে সে । এ ভালবাসায় যেন লোহাও গলে জল হয়ে যায় ।

-" আমারে লুকাস ক সোইনামনি কে তোরে আঘাত কইরেছে !"

অতিরিক্ত আদরের সময় মিতাকে দিদুন সোনামনি বলে । কেঁদে ফেলে মিতা ।

দিদুনের বুকে মুখ গোঁজে ।

-"আচ্ছা দিদুন আমি কারো সাথে মিশতে পারি না কেন বলত !"

দিদুন আর যত্নকরে মিতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ;

-"কেডা কয় এ সব ;তার মুহে ঝাঁটার বাড়ি । আহলে তুই গায়ে ঢলাঢলি পিরিত পছন্দ করোস না তাই ওরা হিংসায় মরে । চতো খেয়ে নিবি চ । "

গ্রাস আর ওঠে না মিতার মুখে । একটা প্রশ্ন মিতা কে তোলপাড় করছে । তার কঠিন রূঢ় দৃঢ় যে আদর্শ যে চেহারা তার তলায় কী চাপা পড়েনেই এক কোমল সরল সাদাসিদে মেয়ে !আর দশটা মেয়ের মতো যে জীবনের রূপ , রস ,গন্ধ্য প্রকৃতির রোদ্রুরে মেলে ধরে সালোকসংশ্লেষের মত উপলব্ধী করতে চায় জীবন কে । মিতা বুঝতে পারে ;তার দূর্ভেদ্য আদর্শের জটলা গুলো বিধাতা স্হাপন করেছেন নিপুন ভঙ্গীমায় । এক দগ্ধ মায়ের জীবনচরিত মেয়ের জীবনের রন্ধে রন্ধে পৌঁছে সদ্য বিকশিত কিশোরী হৃদয়কে করে তুলেছে পৌড়া । সকলের চোখের অলক্ষে তাই তার মোন কাঁদে যৌবন ফিরে পেতে ।

রাতের উচ্ছিষ্ট খাবার বিড়াল দের ভোগ্য করে এঁটো বাসন ধুয়ে গুছিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় প্রবেশ করে মিতা । হাত জড়ো করে ভগবানের কাছে তার নিত্য নৈমিত্যের গুরু প্রর্থনা সেড়ে ততোখনে দিদুন ও বিছানায় পিঠ ঠেঁকিয়ে ছিল । তার চোখে দিন ক্লান্তিতে ছেয়ে আসছিল ঘুমের কোঁয়াসা । মিতার মনে তোলপাড় করছিল জিঞ্জাসার ঢেউ । হৃদয় ভেদকরে মুখমন্ডল থেকে পিছলে এবার সেই ঢেউয়ের একফালি স্পর্শকরে দিদুন কে ।

- "আচ্ছা দিদুন তুমি কখন কাউকে ভালবেসেছো ?"

দিদুনের অবসন্ন ঘুমাচ্ছন্ন চোখ দুটিতে ; মিতার প্রশ্নটা সরষের তেলের ঝাঁজের মতো ঘুম কেড়ে নিল । কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে প্রতিদিন কার মত বেড সুইচ টিপে লাইট অফ্ করে সে । তারপর মিতার কথাটা এড়িয়ে যাবার ভঙ্গীতে সে বলে ;

-" ঘুমিয়ে পড় । "

দিদুন তখন ভাসছে স্মৃতির ভেলায় ।

গ্রামের সান বাঁধান পুকুর ঘাটে বসে বছর চৌদ্দর একটি মেয়ে । সূর্য লাল বর্নের হয়ে পশ্চিমের পুকুড় পাড়ের হিজল , তেঁতুল গাছ গুলোর মাথা চুইয়ে দূরে কোথায় লুকিয়ে পড়ছে কেউ জানে না । লজ্জায় রাঙা নব বধূর মতো সূর্যটার আলতা রঙ্গে ; পুকুড়ের জল ও রক্তিম হয়ে উঠেছে । পাখিরা বাসায় ফিরছে সাড়ি বেঁধে । ঘাটে বসা মেয়েটার লাল ডোরা শারীর কোঁচরে বাঁধা একরাশ নুড়ি থেকে একটা একটা করে ছূড়ে মারছে সে । নুড়ি জলো স্পর্শ করে তলিয়ে যাবার আগে সৃষ্টি করে যাচ্ছে তরঙ্গ । একটা তরঙ্গ মিলতে না মিলতে আর একটা তরঙ্গের সৃষ্টি করে মেয়ে টা । বিন্দু থেকে তরঙ্গ গুলো ছড়িয়ে পরছে পর্যায় ক্রমে কতগুলো চক্রে ।

সহসা একটা ছেলে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে । পেছন থেকে চোখ চেপে ধরে মেয়েটার ।

এ স্পর্শানুভূতি মেয়েটার অপরিচিত ছিল না । নিজের চোখ দুটোকে স্বাধীন করে তরিৎ গতীতে অভিমানের ভঙ্গীতে দুধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে ঘাটের পাড়ের দিকে ওঠে মেয়ে টা ।

-"তোমার লগে আমার কোন কথা নাই কামাল দা । সেই দুপুর থেইকা বয়ে আছি তোমার আয়নের সময় হয় না । "

কামাল সহানুভূতির ভঙ্গীতে মেয়েটির কাছে এগিয়ে এলে চোখ থেকে ফোটা ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে মেয়েটার ।

-"কাল ফরিদ পুরের মামা বাবু আইসেন । আমারে ফরিদপুর লয়ে যাইবে । ওহানে মামার বাসায় আমার বিয়া দেবে। পাত্রর ইস্কুল মাস্টার । মামাগো গ্রেরামেই থাহে । জোয়ান মদ্দ তুমি দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে দেহ খালি । "

মেয়েটির হাত চেপে ধরে কামাল । এবার আর চোখের জল বারন শোনেনি । কামালের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বলেছিল ।

- "তোমারে না পাইলে আমি বিষ খাইয়া নেব । "

মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কামাল বলেছিল ;

-" অমন কথা কইতে নাই মালতী । "

চোখের জল মুছতে মুছতে মালতী মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল কামালের দিকে ।

-"কামাল দা চল আমরা কোহাও পালায়ে যাই । "

কামাল খুব শান্ত ভাবে বলেছিল ;

-"কোহায় পালামু । শেষমেষ কি শেয়াল কুকুরের ভোগ্য করুম তোরে । "

কামালের কয়েক সপ্তা না কাচা শতো তাপ্পি মারা সুতির জামাটা মালতী চেপে ধরে ছিল গায়ের জোড়ে ।

-"যদি বাসাই না দিতে পারবা কেন বাসা বাঁধনের স্বপ্ন দেখাইছিলে । "

কামাল ম্লান মুখে মাথা নিচু করে নিয়েছিল ।

-"আব্বা গো ধইরে বসে আছেন হিদুর মেয়ে কাফের । আব্বারে আমার ডর নাই ;ডর গ্রাম ছাড়নের কোহায় যামু কেমনে তোরে রাখুম । "

কামাল কে ধাক্কা মেরে দু পা পেছনে সড়ে দাঁড়িয়ে ছিল মালতী ।

-"হাতে চুড়ি পড়ো গে । পুরুষ হয়ে জন্মেছো একটা মাইয়া মানষের রক্ষা করনের ক্ষমতা নাই ।


(চলবে)

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন