রবীন্দ্র চেতনায় শিক্ষা
শ্রী শুভ্র
"The strength of the Government lies in the people's ignorance; and the Government knows this; and will therefore always oppose true enlightenment."
- কথা কটি বলেছিলেন টলস্টয় তৎকালীন রাশিয়ান শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে!
পরাধীন বাংলায় জন্মে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন টলস্টয়ের কথাটি সর্বাংশে সত্য! এবং যে হেতু পরাধীন দেশের শাসন ক্ষমতা বৃটিশের কুক্ষিগত, তাই এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল রাজভক্ত চাকুরীজীবি হুকুমদাস তৈরীর উদ্দেশ্যেই! সেই শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সৈনিক রবীন্দ্রনাথ! কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পরও দুই বাংলায় আজও মূলত সেই একই শিক্ষানীতি প্রচলিত আছে! বৃটিশের স্থানে বসেছে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী!বৃটিশের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যের
সাথে দেশ বা জাতির উন্নয়নের কোনো সংযোগ ছিল না! ফলে অসৎ উদ্দেশ্যমূলক, বৃটিশের স্বার্থরক্ষাকারী এই শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রথমাবধি সোচ্চার ছিলেন! তিনিই প্রথম উপলব্ধি করলেন শিক্ষা প্রণালীর সাথে সমাজ জীবনের নাড়ীর সংযোগ না থাকলে সে শিক্ষা মানুষ গড়তে পারে না! তাঁবেদার গড়ে তোলে! উমেদারিতে যাদের জীবন বয়ে যায়! তাঁর মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য বৃটিশের দরবারে চাকরি করা নয়! তিনি বলছেন, "..তুমি যাহা শিক্ষা করিতেছ তাহা হাউইয়ের মতো কোনোক্রমে ইস্কুলমাষ্টারী পর্যন্ত উড়িয়া তাহার পর পেনসনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে!" রবীন্দ্রচেতনায় শিক্ষার সাথে মূলত তিনটি গুরুতর বিষয় জড়িত! প্রথমত মাতৃভাষায় শিক্ষা!
দ্বিতীয়ত প্রকৃতির সাথে জীবনের সংযোগ সাধনের মাধ্যমে শিক্ষা! এবং তৃতীয়ত স্বদেশ ও সমাজের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে সমাজদেহের অন্তরের প্রাণকেন্দ্র থেকে গড়ে ওঠা শিক্ষা! ঐতিহাসিক কারণেই তাঁর সময় বৃটিশ শাসনাধীন পরাধীন দেশে শিক্ষার সাথে এই তিনটি বিষয়েরই কোনো যোগ ছিল না! ফলে তাঁর কথায় বৃটিশের ইস্কুল ছিল শিক্ষা দেবার কল! কবি আক্ষেপ করছেন, "শিক্ষাকে দেয়াল দিয়া ঘিরিয়া, গেটদিয়া রুদ্ধ করিয়া, দারোয়ান দিয়া পাহারা বসাইয়া, শাস্তি দ্বারা কণ্টকিত করিয়া, ঘণ্টা দ্বারা তাড়া দিয়া, মানবজীবনের আরম্ভে এ কী নিরানন্দের সৃষ্টি করা হইয়াছে!"
খুব সহজভাবে পরিস্কার চোখে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় বিশ্বে প্রত্যেকটি উন্নত জাতি যারা জ্ঞান
বিজ্ঞান চর্চায় প্রভূত উন্নতি করেছে, ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, শিল্প সাহিত্যে বাকি বিশ্বকে নিত্যনতুন পথ দেখাচ্ছে; তারা প্রত্যেকে তাদের শিক্ষা প্রণালীর ভরকেন্দ্র করেছে মাতৃভাষাকেই! একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষার সমস্ত শাখাতে মাতৃভাষাকেই করেছে শিক্ষা অর্জনের প্রধানতম মাধ্যম! উল্টোদিকে যেখানেই শিক্ষার্জনের মাধ্যম হয়েছে বিদেশের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া ভাষা; সেখানে কোনো জাতিই আজ পর্যন্ত বিশ্বের দরবারে উন্নত জাতিগুলির সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি! পারবেও না! এ প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ!
কবিই একথা প্রথম বোঝেন!
শিক্ষার-সংস্কার প্রবন্ধে কবি প্রশ্ন করছেন, "আমাদের মন তেরো চোদ্দো বছর বয়স হইতেই জ্ঞানের
আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে; সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার উপর বিদেশী ভাষার ব্যকরণ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলাবৃষ্টিবর্ষণ হইতে থাকে তবে তাহা পুষ্টিলাভ করিবে কী করিয়া?" শিক্ষার এই পুষ্টি লাভের গুরত্বটি, দুঃখের হলেও সত্য যে; দেশের মানুষ সেদিনও অনুধাবন করেনি! আজও করে না! ফলে কবির ভাষায়, "...যাহা শিখি তাহাতে আমাদের অধিকার দৃঢ় হইতেই পারে না! এই ভাবেই দেশে প্রচলিত এই ত্রুটি পূর্ণ শিক্ষা প্রণালীর কলে মুখস্থবিদ নকলনবিশ ডিগ্রীধারী উমেদার আর তাঁবেদার প্রজাতির উদ্ভব হয়! দেশের উন্নতি ব্যহত হয়!
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের সাথে প্রকৃতির নিরন্তর সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা বিশেষ ভাবে অনুভব করেছিলেন কবি! এবং বৃটিশের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় তার নিদারুণ অভাব তাকে প্রবল ভাবেই বিচলিত করেছিল!
বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর মতো করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন!
শিক্ষাসমস্যা প্রবন্ধে কবি বললেন, "শিশুদের জ্ঞানশিক্ষাকে বিশ্বপ্রকৃতির উদার রমণীয় অবকাশের মধ্যে
দিয়া উন্মেষিত করিয়া তোলাই বিধাতার অভিপ্রায় ছিল; সেই অভিপ্রায় আমরা যে পরিমাণে ব্যর্থ করিতেছি সেই পরিমাণেই ব্যর্থ হইতেছি! অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কাছে শিক্ষা জীবন ধারণের মতোই একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যা ইট কাঠ পাথরের মধ্যে পুঁথি পড়ে হয় না!এবং সর্বপরি শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠবে সমাজদেহের অন্তর থেকে! তাকে বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলেশিক্ষার উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না! ইউরোপের প্রসঙ্গ তুলে কবি দেখালেন সেখানে মানুষের শিক্ষাপ্রণালী গড়ে উঠেছে একেবারে সমাজের প্রাণ প্রবাহের ভিতর থেকে! সেখানে ছাত্ররা যে শিক্ষা অর্জন করে সেই বিদ্যাটা সেখাকার লোকসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়! অর্থাৎ দেশীয় লোকসংস্কৃতির ভিতর থেকেই শিক্ষার ভিতটা সেখানে পাকা হয়ে উঠছে! স্কুল বিল্ডিং এর পুঁথির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়! এই দেশীয় ঐতিহ্য ও কৃষ্টির অর্জিত উত্তরাধিকারে প্রবাহমান জীবন চর্চার মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে শিক্ষার বাস্তবতা! ফলে শিক্ষার মাধ্যমে আত্মবিকাশের বড়ো রাজপথটি সেখানে উন্মুক্ত!
"এইজন্য সেখানকার বিদ্যালয় সমাজের সঙ্গে মিশিয়া আছে, তাহা সমাজের মাটি হইতেই রস টানিতেছে এবং সমাজকেই ফলদান করিতেছে!" (শিক্ষাসমস্যা) অথচ আমাদের দেশের চিত্রটি সম্পূর্ণ উল্টো! বিদ্যালয় এখানে সমাজের উপর বৃটিশের চাপিয়ে দেওয়া একটা ভীষণ বোঝা ছিল সেসময়! তারই রেশ চলেছে একালেও! তাই এদেশে শিক্ষা প্রণালী এত শুষ্ক এত নির্জীব! পড়া মুখস্থ আর পরীক্ষায় ভালোনম্বর তুলে চাকুরী পাওয়ার উপযুক্ত ডিগ্রী জোগারের মাধ্যম মাত্র! দেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে এই শিক্ষা প্রণালীর ভিত না থাকার দরুণ আমরা শিক্ষিত হয়ে প্রথমেই সুযোগসন্ধানী হয়ে উঠি! ব্যক্তিগত স্বার্থবোধের আত্মসুখ বিলাসী হয়ে জীবন কাটাই! সমাজ থাকে বাইরে পড়ে!ফলে নিরানন্দ এই শিক্ষাপ্রণালীতে শিক্ষার মধ্যে আনন্দের অভাবে, স্বাভাবিক আত্মবিকাশ হয় বাধাপ্রাপ্ত! নিতান্ত প্রয়োজনীয় বিষয় কণ্ঠস্থ করে কাজ চালানো যায় কিন্তু মৌলিক সৃষ্টি হয় না! তাই শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধে কবি বলছেন, "আমরা যতই বি.এ. এম.এ. পাস করিতেছি, রাশি রাশি বই গিলিতেছি, বুদ্ধিবৃত্তিটা তেমন বেশ বলিষ্ঠ এগং পরিপক্ক হইতেছেনা! তেমন মুঠো করিয়া কিছু ধরিতে পারিতেছিনা, তেমন আদ্যপান্ত কিছু গড়িতে পারিতেছিনা, তেমন জোরের সহিত কিছু দাঁড় করাইতে পারিতেছিনা! আমাদের মতামত কথাবার্তা এবং আচার-অনুষ্ঠান ঠিক সাবালকের মতো নহে!
সেইজন্য আমরা অত্যুক্তি আড়ম্বর এবং আস্ফালনের দ্বারা আমাদের মানসিক দৈন্য ঢাকিবার চেষ্টা করি!ঠিক এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ আবার উল্লেখ করছেন, "আমাদের পাণ্ডিত্য অল্প কিছু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়,আমাদের উদ্ভাবনাশক্তি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে না, আমাদের ধারণশক্তির বলিষ্ঠতা নাই
...আমরা নকল করি, নজির খুঁজি, এবং স্বাধীন মত বলিয়া যাহা প্রচার করি তাহা হয় কোনো না কোনো
মুখস্থ বিদ্যার প্রতিধ্বনি, নয় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার! হয় মানসিক ভীরুতাবশত আমরা পদচিহ্ন
মিলাইয়া চলি, নয় অজ্ঞতার স্পর্ধাবশত বেড়া ডিঙাইয়া চলিতে থাকি!" (শিক্ষা-সংস্কার) ফলে আমাদের
শিক্ষাপ্রণালী আমাদের স্বকীয়তা, মৌলিকতা, মেধার পূর্ণ বিকাশসাধন, এবং পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের পূর্ণ
উদ্বোধনে কোনোরূপ সাহায্য করে না বলেই আমাদের আত্মবিকাশ ঘটে না!
রবীন্দ্রচেতনায় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মনুষ্যত্বের পূর্ণ উদ্বোধন! আর সেই উদ্দেশ্যে তিনি মূল যে তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিলেন সেই তিনটি আবশ্যিক শর্তকে দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ছয় দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আজও আমরা পূরণ করতে পারিনি! বা চাইনি! কারণটা পরিস্কার! মহামতি টলস্টয়ের যে কথাটি দিয়ে এ প্রবন্ধের শুরু, সেই কারণটাই আজও পূর্ণরূপে সক্রিয়! শাসন ক্ষমতায় বৃটিশের স্থানে স্বদেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর শ্রেণী এসে বসেছে শুধু! দেশ শাসনের উদ্দেশ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি তাই বলে! আর দেশের শিক্ষিত সমাজ সেই আবহাওয়ায় ব্যক্তিগত স্বার্থসন্ধানে ব্যস্ত থাকায় কবির সকল প্রয়াস অরণ্যে রোদনেরই সামিল!
"The strength of the Government lies in the people's ignorance; and the Government knows this; and will therefore always oppose true enlightenment."
- কথা কটি বলেছিলেন টলস্টয় তৎকালীন রাশিয়ান শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে!
পরাধীন বাংলায় জন্মে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন টলস্টয়ের কথাটি সর্বাংশে সত্য! এবং যে হেতু পরাধীন দেশের শাসন ক্ষমতা বৃটিশের কুক্ষিগত, তাই এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল রাজভক্ত চাকুরীজীবি হুকুমদাস তৈরীর উদ্দেশ্যেই! সেই শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সৈনিক রবীন্দ্রনাথ! কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পরও দুই বাংলায় আজও মূলত সেই একই শিক্ষানীতি প্রচলিত আছে! বৃটিশের স্থানে বসেছে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী!বৃটিশের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যের
সাথে দেশ বা জাতির উন্নয়নের কোনো সংযোগ ছিল না! ফলে অসৎ উদ্দেশ্যমূলক, বৃটিশের স্বার্থরক্ষাকারী এই শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রথমাবধি সোচ্চার ছিলেন! তিনিই প্রথম উপলব্ধি করলেন শিক্ষা প্রণালীর সাথে সমাজ জীবনের নাড়ীর সংযোগ না থাকলে সে শিক্ষা মানুষ গড়তে পারে না! তাঁবেদার গড়ে তোলে! উমেদারিতে যাদের জীবন বয়ে যায়! তাঁর মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য বৃটিশের দরবারে চাকরি করা নয়! তিনি বলছেন, "..তুমি যাহা শিক্ষা করিতেছ তাহা হাউইয়ের মতো কোনোক্রমে ইস্কুলমাষ্টারী পর্যন্ত উড়িয়া তাহার পর পেনসনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে!" রবীন্দ্রচেতনায় শিক্ষার সাথে মূলত তিনটি গুরুতর বিষয় জড়িত! প্রথমত মাতৃভাষায় শিক্ষা!
দ্বিতীয়ত প্রকৃতির সাথে জীবনের সংযোগ সাধনের মাধ্যমে শিক্ষা! এবং তৃতীয়ত স্বদেশ ও সমাজের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে সমাজদেহের অন্তরের প্রাণকেন্দ্র থেকে গড়ে ওঠা শিক্ষা! ঐতিহাসিক কারণেই তাঁর সময় বৃটিশ শাসনাধীন পরাধীন দেশে শিক্ষার সাথে এই তিনটি বিষয়েরই কোনো যোগ ছিল না! ফলে তাঁর কথায় বৃটিশের ইস্কুল ছিল শিক্ষা দেবার কল! কবি আক্ষেপ করছেন, "শিক্ষাকে দেয়াল দিয়া ঘিরিয়া, গেটদিয়া রুদ্ধ করিয়া, দারোয়ান দিয়া পাহারা বসাইয়া, শাস্তি দ্বারা কণ্টকিত করিয়া, ঘণ্টা দ্বারা তাড়া দিয়া, মানবজীবনের আরম্ভে এ কী নিরানন্দের সৃষ্টি করা হইয়াছে!"
খুব সহজভাবে পরিস্কার চোখে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় বিশ্বে প্রত্যেকটি উন্নত জাতি যারা জ্ঞান
বিজ্ঞান চর্চায় প্রভূত উন্নতি করেছে, ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, শিল্প সাহিত্যে বাকি বিশ্বকে নিত্যনতুন পথ দেখাচ্ছে; তারা প্রত্যেকে তাদের শিক্ষা প্রণালীর ভরকেন্দ্র করেছে মাতৃভাষাকেই! একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষার সমস্ত শাখাতে মাতৃভাষাকেই করেছে শিক্ষা অর্জনের প্রধানতম মাধ্যম! উল্টোদিকে যেখানেই শিক্ষার্জনের মাধ্যম হয়েছে বিদেশের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া ভাষা; সেখানে কোনো জাতিই আজ পর্যন্ত বিশ্বের দরবারে উন্নত জাতিগুলির সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি! পারবেও না! এ প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ!
কবিই একথা প্রথম বোঝেন!
শিক্ষার-সংস্কার প্রবন্ধে কবি প্রশ্ন করছেন, "আমাদের মন তেরো চোদ্দো বছর বয়স হইতেই জ্ঞানের
আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে; সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার উপর বিদেশী ভাষার ব্যকরণ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলাবৃষ্টিবর্ষণ হইতে থাকে তবে তাহা পুষ্টিলাভ করিবে কী করিয়া?" শিক্ষার এই পুষ্টি লাভের গুরত্বটি, দুঃখের হলেও সত্য যে; দেশের মানুষ সেদিনও অনুধাবন করেনি! আজও করে না! ফলে কবির ভাষায়, "...যাহা শিখি তাহাতে আমাদের অধিকার দৃঢ় হইতেই পারে না! এই ভাবেই দেশে প্রচলিত এই ত্রুটি পূর্ণ শিক্ষা প্রণালীর কলে মুখস্থবিদ নকলনবিশ ডিগ্রীধারী উমেদার আর তাঁবেদার প্রজাতির উদ্ভব হয়! দেশের উন্নতি ব্যহত হয়!
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের সাথে প্রকৃতির নিরন্তর সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা বিশেষ ভাবে অনুভব করেছিলেন কবি! এবং বৃটিশের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় তার নিদারুণ অভাব তাকে প্রবল ভাবেই বিচলিত করেছিল!
বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর মতো করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন!
শিক্ষাসমস্যা প্রবন্ধে কবি বললেন, "শিশুদের জ্ঞানশিক্ষাকে বিশ্বপ্রকৃতির উদার রমণীয় অবকাশের মধ্যে
দিয়া উন্মেষিত করিয়া তোলাই বিধাতার অভিপ্রায় ছিল; সেই অভিপ্রায় আমরা যে পরিমাণে ব্যর্থ করিতেছি সেই পরিমাণেই ব্যর্থ হইতেছি! অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কাছে শিক্ষা জীবন ধারণের মতোই একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যা ইট কাঠ পাথরের মধ্যে পুঁথি পড়ে হয় না!এবং সর্বপরি শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠবে সমাজদেহের অন্তর থেকে! তাকে বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলেশিক্ষার উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না! ইউরোপের প্রসঙ্গ তুলে কবি দেখালেন সেখানে মানুষের শিক্ষাপ্রণালী গড়ে উঠেছে একেবারে সমাজের প্রাণ প্রবাহের ভিতর থেকে! সেখানে ছাত্ররা যে শিক্ষা অর্জন করে সেই বিদ্যাটা সেখাকার লোকসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়! অর্থাৎ দেশীয় লোকসংস্কৃতির ভিতর থেকেই শিক্ষার ভিতটা সেখানে পাকা হয়ে উঠছে! স্কুল বিল্ডিং এর পুঁথির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়! এই দেশীয় ঐতিহ্য ও কৃষ্টির অর্জিত উত্তরাধিকারে প্রবাহমান জীবন চর্চার মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে শিক্ষার বাস্তবতা! ফলে শিক্ষার মাধ্যমে আত্মবিকাশের বড়ো রাজপথটি সেখানে উন্মুক্ত!
"এইজন্য সেখানকার বিদ্যালয় সমাজের সঙ্গে মিশিয়া আছে, তাহা সমাজের মাটি হইতেই রস টানিতেছে এবং সমাজকেই ফলদান করিতেছে!" (শিক্ষাসমস্যা) অথচ আমাদের দেশের চিত্রটি সম্পূর্ণ উল্টো! বিদ্যালয় এখানে সমাজের উপর বৃটিশের চাপিয়ে দেওয়া একটা ভীষণ বোঝা ছিল সেসময়! তারই রেশ চলেছে একালেও! তাই এদেশে শিক্ষা প্রণালী এত শুষ্ক এত নির্জীব! পড়া মুখস্থ আর পরীক্ষায় ভালোনম্বর তুলে চাকুরী পাওয়ার উপযুক্ত ডিগ্রী জোগারের মাধ্যম মাত্র! দেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে এই শিক্ষা প্রণালীর ভিত না থাকার দরুণ আমরা শিক্ষিত হয়ে প্রথমেই সুযোগসন্ধানী হয়ে উঠি! ব্যক্তিগত স্বার্থবোধের আত্মসুখ বিলাসী হয়ে জীবন কাটাই! সমাজ থাকে বাইরে পড়ে!ফলে নিরানন্দ এই শিক্ষাপ্রণালীতে শিক্ষার মধ্যে আনন্দের অভাবে, স্বাভাবিক আত্মবিকাশ হয় বাধাপ্রাপ্ত! নিতান্ত প্রয়োজনীয় বিষয় কণ্ঠস্থ করে কাজ চালানো যায় কিন্তু মৌলিক সৃষ্টি হয় না! তাই শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধে কবি বলছেন, "আমরা যতই বি.এ. এম.এ. পাস করিতেছি, রাশি রাশি বই গিলিতেছি, বুদ্ধিবৃত্তিটা তেমন বেশ বলিষ্ঠ এগং পরিপক্ক হইতেছেনা! তেমন মুঠো করিয়া কিছু ধরিতে পারিতেছিনা, তেমন আদ্যপান্ত কিছু গড়িতে পারিতেছিনা, তেমন জোরের সহিত কিছু দাঁড় করাইতে পারিতেছিনা! আমাদের মতামত কথাবার্তা এবং আচার-অনুষ্ঠান ঠিক সাবালকের মতো নহে!
সেইজন্য আমরা অত্যুক্তি আড়ম্বর এবং আস্ফালনের দ্বারা আমাদের মানসিক দৈন্য ঢাকিবার চেষ্টা করি!ঠিক এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ আবার উল্লেখ করছেন, "আমাদের পাণ্ডিত্য অল্প কিছু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়,আমাদের উদ্ভাবনাশক্তি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে না, আমাদের ধারণশক্তির বলিষ্ঠতা নাই
...আমরা নকল করি, নজির খুঁজি, এবং স্বাধীন মত বলিয়া যাহা প্রচার করি তাহা হয় কোনো না কোনো
মুখস্থ বিদ্যার প্রতিধ্বনি, নয় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার! হয় মানসিক ভীরুতাবশত আমরা পদচিহ্ন
মিলাইয়া চলি, নয় অজ্ঞতার স্পর্ধাবশত বেড়া ডিঙাইয়া চলিতে থাকি!" (শিক্ষা-সংস্কার) ফলে আমাদের
শিক্ষাপ্রণালী আমাদের স্বকীয়তা, মৌলিকতা, মেধার পূর্ণ বিকাশসাধন, এবং পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের পূর্ণ
উদ্বোধনে কোনোরূপ সাহায্য করে না বলেই আমাদের আত্মবিকাশ ঘটে না!
রবীন্দ্রচেতনায় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মনুষ্যত্বের পূর্ণ উদ্বোধন! আর সেই উদ্দেশ্যে তিনি মূল যে তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিলেন সেই তিনটি আবশ্যিক শর্তকে দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ছয় দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আজও আমরা পূরণ করতে পারিনি! বা চাইনি! কারণটা পরিস্কার! মহামতি টলস্টয়ের যে কথাটি দিয়ে এ প্রবন্ধের শুরু, সেই কারণটাই আজও পূর্ণরূপে সক্রিয়! শাসন ক্ষমতায় বৃটিশের স্থানে স্বদেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর শ্রেণী এসে বসেছে শুধু! দেশ শাসনের উদ্দেশ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি তাই বলে! আর দেশের শিক্ষিত সমাজ সেই আবহাওয়ায় ব্যক্তিগত স্বার্থসন্ধানে ব্যস্ত থাকায় কবির সকল প্রয়াস অরণ্যে রোদনেরই সামিল!
1 কমেন্টস্:
খুব ভাল লেগেছে, শুভ্র। শুভেচ্ছা রইল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন