৪ ডিসে, ২০১৩

ছোটগল্প - সঞ্জয় চ্যাটার্জ্জী

সবার উপর মানুষ সত্য
সঞ্জয় চ্যাটার্জ্জী


জানিনা কখন নিদ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলাম। অকস্মাৎ এক আবেগ স্পর্শ অনুভূত হল মননে, কোনো এক রমনীয় ছলাকলায় উদ্বেলিত শিরা ধমনীতে পেলাম আকর্ষণ। এ কোন চেতনা ধাবিত হয় আমার অঙ্গে অঙ্গে? ঘুম ভেঙ্গে গেল নিদারুণ উত্তেজনায় !

চোখ মেলে দেখি কোথাও নেই তো কিছুই আমি ছাড়া ! অন্ধকারে একলা ঘরে সেই তো বিছানায় আমি একাই ! তবে কি কেবল স্বপ্ন দোষেই আক্রান্ত ছিলাম নিদ্রায়? হয়তো তাই ! খোলা জানালায় একফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে যেন মুচকি হাসে। ঝিরি ঝিরি বাতাস বয়ে আনছে কোনো ফুলের বাস, দূরে কোথাও এফ এম রেডিওতে বাজছে কোনো স্বর্ণ গান, নিস্তব্ধ প্রকৃতি যেন আমায় দেখে খিলখিলায় ! কেন জানিনা এ রাত্রি আমায় সর্পিল এক আবেগ মাখায় ! আবার ঘুম আসে...নিজের মনেই মুচকি হেসে সব ঝুট বলে চোখ বন্ধ করি।

জানিনা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, ঘুম ভেঙ্গে গেল এক নারী কন্ঠে। কে যেন বলছে ডেকে, "কেমন আছ !" চোখ মেলে চাইলাম, আবার সেই শূণ্যতা ~ বিছানা, আমি, অন্ধকার, আর সেই খোলা জানালা। এখন আকাশে চাঁদ নেই, ঢেকে গেছে কোনো বারিদ পিছে; হাওয়াও এখন তাল মিলিয়ে আনছে না বয়ে সুরভি। কেমন যেন গুমোট মার্কা বিশ্রী এক প্রকৃতি ! নিরানন্দ, ঘোর নিরানন্দ ! মন ছেয়ে যায় বিষন্নতায়, কে ডাকলো তবে? উঠে পরলাম বিছানা ছেড়ে, জ্বলন্ত সিগারেট আঙ্গুলে জড়িয়ে জানালা ভরিয়ে দিলাম ধোঁয়ায়। কিন্তু সেটা বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আবার সেই রমনীয় কন্ঠস্বর ! "কেমন আছ?" সচকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম, অন্ধকার, প্রবল অন্ধকার ! কম্পিত কলেবর হতে ভাঙ্গা ধ্বনি নির্গত হল, "কে? কে ওখানে?" দরজার কাছে অনুভূত হল আবছা কোনো নারী মূর্তি ! হিম হয়ে এলো দেহ, একি ! কে এ !! "ভয় পাচ্ছ?" "ভয় কিসের?" "আমি তো মানুষ নই !" "তবে শঙ্কা কেন মনে?" "শান্ত হও। কোনো ক্ষতি করব না তোমার। ক্ষতি তো মানুষে করে, আমরা তো কেবল নিরাকার হয়ে ঘুরে বেড়াই।"

ততক্ষণে ভয়ে সিঁধিয়ে গেছি, হাতের সিগারেট কখন জ্বলে নিভে গেছে, আমতা স্বরে বললাম, " ক-কে তুমি?" সে বলল, " তোমারই মত মানুষের পৈশাচিক শিকার আমি। আমি দামিনী। একদিন আমিও মানুষ ছিলাম। হেসে খেলে ঘুরে বেড়াতাম তোমাদের সমাজে। আমারও একটি পরিবার ছিল, একটি ছোট ভাই ছিল, এক বিধবা মা ছিল। তোমারই মত আমার এক সাথীও ছিল। আজ শুধু ছিলটাই আছে, আমি আর নেই !"

"কী হয়েছিল তোমার?" জানিনা আমার অস্পষ্ট ভাষণ সে শুনতে পেল কিনা ! একটা নীরবতা, এক তিমির অন্ধকার, তারপরে সে বলল, "পাড়ায় ছিল কুখ্যাত কিছু কালো হাত, পথে ঘাটে চলতে গেলেই উড়ে আসতো তাদের শ্লেষাক্ত বাণী। একদিন এক রাত্রে ফিরছিলাম কলেজ শেষে, আমি ও আমার সাথী। মদ্যপ কুচক্রীরা জানতাম না থাকবে সেদিন ওঁত পেতে, জানতাম না তাদের লালসার শিকার হতে হবে সেদিন আমাকে ! জানতাম না সাত আট জনের পৈশাচিক অঙ্গ আমায় করবে এফোঁড় ওফোঁড় ! জানতাম না নগ্ন হতে হবে আমায় সেদিন কতগুলো নোংরা চোখের সামনে ! হাজার ক্রন্দন, কাকুতি, মিনতিও সেদিন করতে পারে নি তাদের ক্ষান্ত ! সঙ্গীর আমার মুণ্ডহীন দেহ রইলো পরে রাস্তার 'পরে। যখন তাদের পৈশাচিক তাণ্ডব চলছে আমায় ঘিরে, দেখেছিলাম চেয়ে খেলছে তারা মুণ্ড নিয়ে ফুটবল খেলা ! অকস্মাৎ আঁধার ঘনিয়ে এলো আমার চোখের তারায়, দুহাত জুড়ে মিনতি করেছি, ওগো তোমরা এবার ছেড়ে দাও ! অট্টহাস্যে উঠলো চেঁচিয়ে সেই পিশাচের দল, "তোকে ছেড়ে দেবো আমরা ভেবেছিস কি করে. তোর ভবলীলা সাঙ্গ করে তবেই আমাদের শান্তি !" অকস্মাৎ কঁকিয়ে উঠেছিলাম এক তীব্র যন্ত্রণায়, দেখি চেয়ে ফিনকি দিয়ে ছুটছে শোনিত আমার অঙ্গ চিরে ! কোনো এক লৌহ শলাকা ঢুকছে তার মধ্যে ! অবশেষে নির্বাপিত হল আমার জীবনদীপ, শেষবারের মত মাকে আমার ডেকেছিলাম সেদিন আমি, জানিনা সে বাণী পৌঁছালো কিনা আমার মায়ের কানে !"

ভয় ভীতি দূর হয়ে গেছিল নিজেরই অজান্তে, সেই অশরীরীর নীরব যন্ত্রণা মুহুর্মুহু আঘাত হানছিল আমার বুকে ! তার কান্নায় ধ্বনিত হচ্ছিল "এর বিহিত করো ! বিচার করো এর !" ধীরে ধীরে ভোরের আলো ঘরের মেঝেতে এসে পড়ল, কখন রাত কেটে ভোর হয়ে গেল জানতেও পারি নি। চোখ উঠিয়ে দেখি ঘর শূণ্য, বললাম "আছ?" "দামিনী?" কোনো সাড়া নেই, জানিনা কখন সে চলে গেছে ! মনে পড়ল সেই কথাটা, "সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই !"

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন