৪ ডিসে, ২০১৩

ছোটগল্প - শ্রীশুভ্র

ডায়েরীর শেষ পাতা
শ্রীশুভ্র


এ পথ দিয়ে তো প্রায়ই যাই. কিন্তু এতদিন খেয়াল করিনি. আশ্চর্য্য! একে বারেই সামনা সামনি. অথচ এমন সুন্দর একটি দৃষ্টিনন্দন দোতলা বাড়ি আগে কোনোদিন চোখেই পড়েনি. আমার অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝেমধ্যেই এই শর্টকার্ট রাস্তাটা ধরি. রাস্তাটা ঠিক ঐ সুন্দর বাড়িটার সামনে এসেই পুরো ডানদিকে বেঁকে গিয়েছে. বাঁকের ঠিক মুখেই সেদিন হঠাৎ খেয়াল হল! খেয়াল হল, সুন্দর আর্কিটেকচারের ঘন পদ্মরঙের একটি দোতালা বাড়ি, আর অবিস্মরণীয় গভীর কালো দুটি চোখ! দোতলার ঝুল বারান্দায় সোনালী পাড়ের ঘন কালো রঙের শাড়িতে দীর্ঘাঙ্গী তন্বী একহারার একটি মেয়ে সোজা আমারই দিকে তাকিয়ে! স্থির নিষ্পলক অন্তরভেদী অনন্ত দৃষ্টি!

সেই অনন্ত গভীর কালো দুটি চোখের সম্মোহনী দৃষ্টির ছোঁয়া নিয়েই বাড়ি ফিরতে হল সেদিন. সেদিনের সন্ধ্যাটি আর অন্য কিছুতেই মনোনিবেশ করা গেল না. কেবলই ঐ অপরূপ দুটি চোখ আমার মনোরাজ্য অধিকার করে বসল.পরের দিন কি একটা ঘোরের মধ্যে দিন শুরু হল. জানি না আর সুযোগ ঘটবে কিনা, ঐ দৃষ্টির মুখোমুখি হওয়ার. সারাদিন কেবলই একটা অজানা আশঙ্কায় পেয়ে বসল, যদি আর না দেখা হয়! হাসিও পেল অচেনা অজানা সম্পূর্ণ অপরিচিত কাউকে নিয়ে এতটা ভাবনা চিন্তা করার জন্যে. আসলে সম্পূর্ণ নিস্তরঙ্গ ব্যাচেলার লাইফ. এ শহরে নতুন বদলি হয়ে এসেছি সদ্য. আলাপ পরিচয় যৎসামান্য. সারাদিন অফিস আর বাসা. এরই মধ্যে হঠাৎ গতকালের এই ঘটনা.

অফিস ফেরত যথারীতি শর্টকাট রাস্তায় পা বাড়ালাম, মনের মধ্যে আশঙ্কা নিয়েই. কিন্তু কি আশ্চর্য্য! সেই একই গভীর দৃষ্টি মেলে দোতলার ঝুলবারান্দায় আমার গতকালের সেই স্বপনচারিনী! এবং আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে তার দৃষ্টি আমাকেই অনুসরণ করে গেল গোটা পথটা. অথচ সৌজন্যবশতঃ আমার সহাস্য দৃষ্টিবিনিময়ের কোনো প্রত্যুত্তর এল না দোতলার ঝুলবারান্দা থেকে. একটু অপ্রতিভ হয়েই বাকি পথটা পেড়িয়ে এলাম মনের মধ্যে একরাশ বিস্ময়ের বোঝা নিয়ে. আজ যেন মনে হল, ঐ দৃষ্টির মধ্যে কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই! নেই কোনো স্বপ্নের চলাচল! পার্থিব বাস্তবতার উর্দ্ধে ধ্যানমগ্ন, কোনো আকাশভ্রষ্ট স্বপ্নপরীর অতলান্ত নির্বাক নিরবধি অনন্ত দৃষ্টি শুধু.

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে. কেটে গেছে প্রথম কয়েকটা দিনের সেই ঘোরও. কারণ আমার ফেরার পথে রোজই সেই একই দুটি চোখের অনিমেষ দৃষ্টির নিস্পন্দন অনুসরণ ছাড়া অন্যতর কোনো রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি. গড়ে ওঠেনি রোজকার দেখা হওয়া স্বাভাবিক পরিচিত দৃষ্টিবিনিময়ের সৌজন্য সম্পর্ক! প্রথম দিকে কিছুটা অবাক হলেও ভেবেছি বড়োলোক বাড়ির সুন্দরী মেয়ের অহংবোধ ছাড়া আর কিছু নয়. আমি সামান্য সরকারী চাকুরে! হাঁটা পথে বাড়ি ফিরি. এটাই স্বাভাবিক. কিন্তু তবু সেই দুটি চোখের অমোঘ টান এড়াতেও পারিনি. পারিনি বলেই, মাঝে মধ্যে বাড়ি ফেরার শর্টকাট রাস্তাটি আমার নিত্যদিনের ফিরতি পথ হয়ে উঠল. তবু সেই গভীর দৃষ্টির নীরবতায় আনন্দের সুর-লহরি বেজে উঠল না.

রোজই একটা আশঙ্কা থাকে, আজও কি সে ঝুলবারান্দায় দাঁড়াবে! আজও কি তার সেই দীঘল কালো চোখের নিথর দৃষ্টি অনুসরণ করবে আমার গোটা পথ. দেখে যেন মনে হয়, সেও যেন ঐ ঝুলবারান্দারই অংশ. ঐভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কেটে যায় তার সারাটাদিন, পথচারীর পথচলা দেখে দেখে. আবার ভাবি আমিও কেমন বেহায়া! কেমন কাঙালের মতো এই পথ ধরে ফিরি. অথচ সেই নিস্পন্দন দৃষ্টিতে নেই কোনো সাড়া! এসব ভাবতে ভাবতেই পথটুকু পেড়িয়ে যাই. কিন্তু সেদিন কি হল, হটাৎই হোঁচট খেয়ে সামান্য টাল খেয়ে গেলাম. আর টাল সামলিয়ে উঠতেই দেখি ঝুলবারান্দা দিয়ে হাসি গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণার মতো! হাসি যে এমন অপরূপ হতে পারে, এত স্নিগ্ধ এত অনুপম আমার জানা ছিল না সত্যি!

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে এরপর. মাঝের এই কয়টি দিন আমাদের দেখা সাক্ষাৎ আর পাঁচজনের মতোই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল. সে দেখায় প্রাণের স্পন্দন ফুটে উঠত রোজকার দেখাসাক্ষাতের স্বাভাবিক পরিচিত ভঙ্গিমাতেই. সেই অতলান্ত গভীর দৃষ্টির সাথে শুধু যোগ হয়েছিল অমন সুমধুর হাসির নীরব ঝর্ণাধারা. কিন্তু আলাপ হয়নি আমাদের তখনো. আলাপ চলত দুজনের মনোবীণায় পরস্পরের কল্পনায়. সত্যি বলতে কি দিনটা যে কোথা দিয়ে কেটে যেতো বোঝা যেত না. সারাদিনের কাজকর্মে ধরা দিল সুন্দর একটা ছন্দ. শেষ বিকেলের আলোয় আমাদের সেই পরস্পরকে দেখার মধ্যে গড়ে উঠেছিল ভালোলাগার অনুরণন. তাকে ভালোবাসা বলা না গেলেও অপেক্ষা ছিল একান্ত, সুদূরের কল্পনাপ্রবণ আলপনায়.

সেদিও এ পথেই ফিরছিলাম. কিন্তু কি আশ্চর্য্য ঝুলবারান্দা খালি! কি হল? এরকম তো হয় না! ভালো করে এধার ওধার তাকিয়েও কোনো সুরাহা হল না. কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়েই ফেরার পথে পা বাড়ালাম. কিন্তু থামতে হল মোড় ঘোরার আগেই. বাড়ির লোহার গেট ঠেলে এক সৌম্য সুদর্শন ভদ্রলোক বেড়িয়ে এলেন. নিজের পরিচয় দিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন একবার ওনাদের আতিথ্য নিতে. বিশেষ করে ওনার মায়ের নাকি আমার সাথে আলাপ করার খুব ইচ্ছে. বেশ বিস্মিত হলেও মনের উচ্ছ্বাস গোপন করে অন্য একদিন আশার আশ্বাস দিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরলাম. ঠিকই, সেদিন সারারাত জেগেই কেটে গেল. সম্ভব অসম্ভব সব মধুর কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে কেটে গেল একটা রাত. ঐ চোখ ঐ হাসি ছেয়ে রইল সারা মন.

দিনকয়েক বাদে ফিরতি পথে একদিন সত্যি সত্যিই ওনাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম. খুবই অমায়িক সদালাপী ভদ্রলোক. এবং শৌখিন! গোটা বাড়ি জুড়েই আভিজাত্যের ছাপ.পরিচয় হলো ওনার মায়ের সাথেও. বৈধব্যের মাঝেও রূপের ঐশ্বর্য্যের স্বকীয় দ্যূতি ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যকে যেন আলোকিত করে রেখেছে. কিন্তু আমি অধীর হয়ে যার কথা ভাবছিলাম তার তখনো দেখা নেই. আর ঠিক তখনোই ঘরে ঢুকলো সে. হালকা নীল শাড়িতে সেই আকাশভ্রষ্ট পরী! সেই দুটি অপরূপ চোখ আর অতলান্ত দৃষ্টির নিমগ্ন অভিসার. এত কাছ থেকে এই প্রথম দেখা. সে তো এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা.আর সেই সহাস্য মিষ্টি স্নিগ্ধতা. সব মিলিয়ে স্বর্গের নন্দনকাননে হঠাৎ একটি সন্ধ্যা. অনুপম সত্যিই অনুপম!

কথাবার্তা যা হল সব ওর দাদা আর মায়ের সাথে. ওর দিক থেকে এক আশ্চর্য্য নীরব মাধুর্য্যের আকর্ষণ ঘিরে রাখল আমাকে আগাগোড়া. আমার নিজের পরিচয় দিলাম. প্রায় সব কথাই, কথা প্রসঙ্গে উঠে আসায় বলতে হল. নিজের জীবনের নানান টুকরো সব বিষয়. একথা সেকথায় অনেকটাই সময় কেটে গেল.এবার ওঠার পালা. দেখলাম ওর মুখের রেখায় বিদায়বেলার বিষাদের রঙ. সেই প্রথম মনের মধ্যে খেলে গেল ভালোবাসার অনন্য অনুভবের নির্মল শিহরণ.ওনাদের অনুরোধে আবারো আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাসার পথ ধরলাম সেদিনের মতো. মনে হল যেন পেড়িয়ে এলাম অন্তহীন পথ. নিয়ে এলাম ওদের সাথে প্রথম আলাপের সখ্যতা.

তবু এই আনন্দধারার মাঝে একটাই দুঃখের ছোঁয়া রয়ে গেল, ওদের কাছে নিজের কত কথাই বলে এলাম, অথচ ওর সাথে সরাসরি কোনো কথাই হল না. জানা হল না, ঐ অতল দীঘির কাজল কালো দৃষ্টির গভীরে কি মণিমুক্ত রয়েছে. জানা হল না ওদের সম্বন্ধে কিছুই.পরেরদিন ফিরতি পথে আবার দোতলার বারান্দার সেই অপরুপ হাসির মাধুর্য্যে ঝলমল করে উঠল প্রাণমন. বেশ কদিন পর আবার একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ওদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম. ভদ্রলোক বাড়ি ছিলেন না, দেখা হল ওর মায়ের সাথে.সেদিন ওর সাথে আলাপ করার বাসনা নিয়েই যাওয়া. আমাদের কথার ফাঁকেই ঘর আলো করে সে ঢুকল. ওর মায়ের মতোই বনেদী একটা আভিজাত্যের ছাপ ওর হাঁটাচলায়. আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকালাম ওর দিকে.

আজ বাসন্তী রঙের শাড়িতে ওর ভুবনমোহিনী মৃদু হাসির সাথে সেই গভীর অনন্ত দৃষ্টি যেন আমারই প্রতীক্ষায় ছিল. ওর সাথে আলাপ শুরু করার জন্যে সে কথাই বল্লাম. দেখতে চাইলাম ওর প্রতিক্রিয়া. হয়ত ওর মায়ের সামনে নিজের রূপের প্রশংসায় ঈষৎ লজ্জিত হতেই পারে.কিন্তু অবাক হলাম, ওর মধ্যে কোনো ভাবান্তর না দেখে. সেই একই মৃদু হাসির আলোয় সুন্দর দুই চোখে আমায় দেখতে লাগল. অথচ মুখে কোনো কথা নেই. উত্তরের আশায় জানতে চাইলাম আজও নীরব হাসিতেই বিদায় জানাবে কিনা. কিন্তু তাতেও মুখ ফুটে বল্ল না কিছুই. শুধুই দেখতে লাগল আমায় দু চোখ ভরে. সারা মুখে একটা পরিতৃপ্তির মৃদু আভা ছড়িয়ে. কিছুটা অপ্রতিভ হলাম ওর এই নীরবতায়.

ওর দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ওর মায়ের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম. ভদ্রমহিলার চোখেমুখে বিষাদের ছায়া যেন সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে. নিজেকেই যেন অপরাধী মনে হল, আমার অজান্তে কোনো ব্যাথ্যা দিলাম কিনা কে জানে. ঠিক তখনই ওর দাদা ঢুকলেন. ভদ্রলোক খুবই তীক্ষ্ণধী. ঢুকতেই বুঝলেন সামথিং ইজ রং! এবং ওনার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঘরের পরিবেশটা হালকা করে নিলেন নিমিষেই. হালকা হলেও আমার মনের মধ্যে অজানা কোনো রহস্যের ভার চেপে বসল. হয়ত আমার মুখ দেখেই উনি বুঝতে পারলেন. বল্লেন -আসলে আপনার সাথে দেখা হওয়ার পরপরই আমরা লক্ষ্য করি, ইন ফ্যাক্ট মার-ই এটা প্রথম চোখে পড়ে যে, আমার বোনের মধ্যে ধীরে ধীরে একটি সামান্য পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে.

-পরিবর্তন?
আমি জিজ্ঞাসা করি.
-হ্যাঁ, পরিবর্তন. সেই ঘটনার পর থেকে এই প্রথম ওর মুখে হাসি. মাঝের এতগুলো দিন ওর মুখে আমরা হাসি দেখিনি.
-ঘটনা?
আমার বিস্ময়ের উত্তরে উনি বল্লেন, বছর চারেক আগে, কলেজ থেকে উত্তর ভারতে বেড়াতে গিয়ে কিছু দুর্বৃত্তের হাতে ধর্ষিত হতে হয় তাঁর বোনকে.
-সেকি!
আমি প্রায় আঁৎকে উঠে তাকাই ওর দিকে. এই রকম পাশবিক আক্রমণের স্বীকার হতে হয়েছে পরীর মত সুন্দর এই মেয়েকে. তখনো ওর মুখচোখে কোনো ভাবান্তর নেই. সেই একই রকম মৃদু হাসির নীরব ঝর্ণায় আলোকিত ওর সারা মুখ. যেন আমাদের কোনো কথাই ওর কানে গিয়ে পৌঁছায়নি.
ভদ্রলোক যেন আমার মনের কথা পড়ে ফেল্লেন তখনই, বল্লেন-
-না ভয় নেই, ও আমাদের কথা শুনছে না.

ভয় নয়, আরও বিস্মিত হয়ে তাকালাম ওর দিকে. সেই একই ভাবে স্বহাস্যে দেখে চলেছে আমাকে, অথচ আমাদের কোনো কথার দিকেই খেয়াল নেই ওর. আশ্চর্য্য! তখনো জানতাম না আমার আশ্চর্য্য হওয়ার আরও বাকি ছিল.বল্লেন

- প্রচণ্ড শক পেয়েছিল সেই ঘটনায়.
-সে তো খুবই স্বাভাবিক বলি আমি.

-আর সেই শকেই ওর স্নায়বিক বিকার দেখা যায়.

-সেও স্বাভাবিক. কিন্তু তারও তো এখন চিকিৎসা আছে ভালো. বল্লাম আমি.

-হ্যাঁ সে সবই করিয়েছি জানেন, দেশের সব বড় ডাক্তারদেরই দেখানো হয়ে গিয়েছে. কিন্তু কোনো উপকারই তো হল না.

-উপকার হল না? ওনার কথারই প্রতিধ্বনি করি আমি.

-না, কই আর হল, মাঝে এক বছর নিভান্সেও ছিল.

- -সেকি? সেখানে তো মেন্টাল পেশেন্টদের চিকিৎসা হয়!

-হ্যাঁ সেই তো, ডাক্তারি পরিভাষায় ওযে মেন্টাল পেশেন্ট এখনো! কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হল না, অথচ চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি জানেন! বোনটা সেই ঘটনার পর বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল!

-উন্মাদ? আতঙ্কে শিউরে উঠি আমি! স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে দেখি ঠিক সেই একই ভাবে মধুঝরা হাসি মুখে চেয়ে চেয়ে দেখে যাচ্ছে আমাকে, কোথাও কোনো ভাবান্তর নেই. আর ও মা যেন পাথরের মতো স্থবির হয়ে বসে আছেন বিষাদে ছেয়ে আছে তাঁর সারা মুখ.শুধু ধরা গলায় জানালেন আমার সাথে রোজ বিকেলে এই দেখা হওয়ার সময়টুকু মেয়ের মুখে হাসি ফোটে, গত চার বছরে এই প্রথম.ভদ্রলোক আমার হাতদুটো ধরে বল্লেন ওঁদের ধারণা, আমিই নাকি শেষ ভরসা! যদি ভালো হয়ে ওঠে ওঁর বোন.

ওনাদের সব কথা ঠিক মতো শোনার অবস্থা নয় তখন আমার, মনে পড়ে গেল ছোট বেলার কথা. মামাবাড়িতে মার খুড়তুতো বোন শেফালীমাসিকে দেখেছিলাম বদ্ধ উন্মাদ. আর আমার এই কয়দিনের সব আশা সব স্বপ্ন যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সেও কিনা সেই শেফালীমাসির মতোই বদ্ধ উন্মাদ? ওর এই মিষ্টিঝরা হাসি, পাগলের হাসি? ঐ সুগভীর চোখের অমন অতলান্ত দৃষ্টি, পাগলের দৃষ্টি? তার পিছনে কোনো মানসিক সুস্থতা নেই? আমার যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরতে থাকে. চুড়মাড় হয়ে ভেঙ্গে পড়া ধুলিসাৎ আশা মাড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন আর আমি আমার মধ্যে নেই. সেই বীভৎস রাতের স্মৃতি নিয়েও আবারও ভোর হল, কিন্তু ততক্ষণে আমার যা সর্বনাশ ঘটার, ঘটে গিয়েছে.

এরপর আরও মাস দুয়েক কেটে গিয়েছিল, কিন্তু সেদিনের পর থেকে, আমি আর ঐ পথে বাড়ি ফিরতে পারিনি. মনের দূর্বিষহ কষ্ট সময়ের সাথে অনেকটাই কমে এলেও জীবনের অনেকখানি আশাভরসা যেন চিরদিনের জন্যেই হারিয়ে গিয়েছিল. বিকেল হলেই প্রচণ্ড একটা কষ্ট আমায় পেয়ে বসতো. প্রথম প্রথম বাড়ি ফেরার পথে পা যেন আপনা আপনিই রোজকার শর্টকাট পথে এগিয়ে যেত. কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় বড়বাজারে হঠাৎই ভদ্রলোকের সাথে একেবারে মুখোমুখি দেখা. আমার সারা শরীর যেন হিমশীতল শিহরণে কেঁপে উঠল. পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাবারও কোনো উপায় নেই. উনিই এগিয়ে এসে প্রথমে কুশল সংবাদ নিলেন. বল্লেন, আপনি আর ওপথে যান না বলে আমার কিছুই বলার নেই. কিন্তু ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে.

-অসুস্থ?
-হ্যাঁ সেদিনের পর থেকে রোজই বিকেলে হয়ত আপনার জন্যে অপেক্ষা করত.

সেই ঝুলবারান্দা আর সেই দুই দীঘল কালো চোখ! সব মনে পড়ে যেতে থাকল আবার.ভদ্রলোক আক্ষেপ করেই বল্লেন, কিন্তু আপনাকে আর দেখতে না পেয়েই ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছিল, আমরাও ঠিক সামলাতে পারছিলামও না. আশ্চর্য্যের বিষয় কি জানেন, আর একদিনও ওর মুখে হাসি দেখতে পাইনি আমরা.

-এখন? প্রশ্ন করি আমি.

এখন সারাদিন আর ওর ঘর থেকে বেরোয় না. সারাদিন গুম হয়ে বসে থাকে. কখনো নিরবে কাঁদে...

ওনার গলা ধরে আসে, আমার হাতদুটো ধরে মিনতি করার মতো করেই বল্লেন, আপনাকে শুধু অনুরোধ অন্তত একটিবার আসুন একদিন. জানি আপনাকে জোর করা শোভনীয় নয় আমার, তবু...যদি...

কিন্তু তারপরেও যাব যাব করেও আর যেতে পারিনি. শুধু মনে হত, ওর সেই দৃষ্টি, ওর সেই হাসি, ওর নীরবতা, কোনোটাই সুস্থ মনের পরিচয় তো নয়. মানসিক অসুস্থতারই একটা প্রকাশ. সেখানে আমি গিয়েই বা কি লাভ হবে? এত বড়ো বড়ো ডাক্তাররা যেখানে কিছুই করতে পারননি. বিশেষ করে নিভান্সের মতো ভারতবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে এক বছর থেকেও যেখানে ওর অসুস্থতা কাটেনি. সেখানে আমার ভূমিকা কত অকিঞ্চিৎকর. শুধু মনে পড়ত ওর সাথে সেই কটা দিনের অমলিন স্মৃতি. আর তাড়া করত একটা চাপা গুমরানো কান্না. অফিস আর বাসা, বাসা আর অফিস, আমার প্রতিটিদিন একটা অব্যক্ত কষ্টের মধ্যে কাটতে লাগল. একদিকে এই অস্থিরতা আর সবসময় একটা অশ্রুত চাপা কান্না যেন ঘিরে ধরল আমায়.

মাঝে কেটে গেছে আরও কিছুদিন. অন্তর্দন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আমারও শরীর মন খারাপ গেল কদিন. একটু সুস্থ হতেই রবিবার দেখে একদিন সত্যিই সরাসরি ওদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম. বাড়ির পরিচারিকা আমায় বসার ঘরে বসিয়ে ভিতরে গেল খবর দিতে. মনের মধ্যে উথালপাতাল. প্রথম আসার সেদিনের সাথে কত তফাৎ. সেসবই ভাবছিলাম. খেয়াল করিনি কখন ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছেন.চমক ভাঙ্গল ওনার কথায়,

-আপনি?

কিছুটা অপরাধীর মতোই বলতে যাই,

- শরীরটা কদিন ভালো যাচ্ছিলনা...
আমাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিলেন হাতের ইশারায়. দেখলাম ওনার মাও এসে দাঁড়িয়েছেন ওনার পাশে. চমকে উঠলাম, এযে জীবন্ত মৃতদেহ! মহাকালের সমাধি থেকে সদ্য উঠে দাঁড়ানো! এ কি চেহারা হয়েছে ওনার?

আর তখনই ডুকরে কেঁদে উঠলেন ভদ্রমহিলা. ওনার কান্না ভেজা হাহাকারে জানতে পারলাম বেশ কিছুদিন আগেই আত্মহত্যা করেছে ওনার একমাত্র মেয়ে!

ভদ্রলোক শুধু বল্লেন, -বেঁচেছে!

অনেকক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারিনি. শুধু ভাবছিলাম পাগল কি কখনো আত্মহত্যা করে! এও কি সম্ভব?
ডায়েরীর শেষ পাতায় এসে স্তম্ভিত হয়ে দর্পনের দিকে, মুখ তুলে তাকালাম.
বল্লাম, -সত্যিই আশ্চর্য রে!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দর্পন বল্ল -হ্যাঁ সত্যিই আশ্চর্য্যের.
বল্লাম, -তোর প্রফেশানটা খুব ইন্টারেস্টিং, গল্প লেখার প্লটের ছড়াছড়ি.
হেসে উঠল ও,-হ্যাঁ এক একটা জীবনের বিনিময়ে!
-কিন্তু সেরেও তো ওঠে অনেকে?
-ওঠে, তবে সবাই নয়!

"পাগল কি কখনো আত্মহত্যা করে! এও কি সম্ভব?"দর্পনকে বল্লাম এই কথাটাই মনের মধ্যে ঘুরছে শুধু.
-চল! বলে ওর চেম্বার থেকে আমায় নিয়ে বেড়িয়ে এল. এগোলাম আমরা সামনের দিকে. একটু এগিয়ে ডান হাতের লম্বা করিডর দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে বাঁহাতের শেষ রুমে ঢুকলাম আমরা. পেশেন্টদের জন্যে এই হাসপাতালের বন্দোবস্ত বেশ ভালোই শুনেছি. সেটাই চোখে দেখে তাক লেগে গেল. দর্পন বল্ল

- ভালো করে দেখে নে.
খুবই সুদর্শন সন্দেহ নাই. তবু উদভ্রান্ত দুটি চোখ যেন কিছু একটা খুঁজে চলেছে. আমায় নতুন দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এসে ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞাসা করল,
- "আচ্ছা বলতে পারেন, পাগল কি কখনো আত্মহত্যা করে? এও কি সম্ভব!"

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন