৩০ ডিসে, ২০১৩

প্রবন্ধ - রিয়া

ভাষাসন্ধান (প্রথম পর্ব)
রিয়া



পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাবংশগুলির মধ্যে প্রথমেই যেটি উল্লেখ যোগ্য তা হল - ইন্দো ইওরোপীয় বা ইন্দো জার্মানিক বা আর্য ভাষাবংশ। এটা নিয়ে আবার দ্বিমত আছে, এবং দুটো মতই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম মত অনুযায়ী ইন্দো- ইওরোপীয়ান ভাষা ভাষী দের অর্থাৎ আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল মধ্য- ইয়োরোপ , আবার দ্বিতীয় মতে আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশে। এই আর্যজাতি পরবরতী কালে ভারতবর্ষ ও ইয়োরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর থেকে আরও ১০ টি প্রাচীন শাখার জন্ম হয়। শাখাগুলি হলঃ-

১/ ইন্দো- ইরানীয়
২/ বাল্তো- স্লাভিক
৩/ অ্যালবানীয়
৪/ আর্মেনীয়
৫/ গ্রীক
৬/ ইতালিক
৭/ জার্মানিক
৮/ কেন্লটিক
৯/তোখারিয়
১০/ হিত্তিয়।

ভাষাবংশ কি? বৃহত্তর জনসাধারন যখন একটি ভাষায় কথা বলে আর সেই ভাষাটি যখন বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে যখন এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের পারস্পরিক যোগাযোগ কমে যায় তখন তাদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষাগত পার্থক্য গড়ে ওঠে।এবং এই আঞ্চলিক পার্থক্য যখন খুব প্রকট হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই অঞ্চল ভাষা গত স্বাতন্ত্রতা লাভ করে আর স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদাও পায়। এইভাবে স্বতন্ত্র ভাষার জন্ম হয় ।

যদিও ভাষা স্বতন্ত্র্র হয়, কিছু পার্থক্য থাকে তবুও কিছুদিন সাদৃশ্যও থেকে যায়। অর্থাৎ একই উৎস থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলির মূল শব্দভাণ্ডারে যেমন সংখ্যা শব্দে, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শব্দে, গৃহপালিত পশুর নামে এবং দৈনন্দিন কাজ কর্মের সাথে যুক্ত শব্দে একই সাদৃশ্য চোখে পড়ে। অর্থাৎ এই সাদৃশ্য গুলি কিন্তু আসে একই ভাষাগত উৎস থেকে।আর এই আদি ভাষাগুলিকে অর্থাৎ যেখান থেকে বিভিন্ন ভাষার জন্ম হয়েছে তাকেই বলা হয় ভাষাবংশ। ইন্দো-ইয়োরপিয়ান বংশের সমৃদ্ধ প্রাচীন ভাষা হল- গ্রীক, ইন্দো- ইরানীয় শাখার আবেস্তিয় ও সংস্কৃত । ইতালিক শাখার ল্যাটিন আর জার্মানিক শাখার গথিক ভাষা। কারোর মতে এই বংশের প্রাচীন ভাষা বৈদিক সংস্কৃতে লেখা ঋগ্বেদ- সংহিতা যেটা আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টপূর্বে রচিত এবং সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম গ্রন্থ। তাছাড়া এই বংশের কয়েকটি প্রাচীনতম সমৃদ্ধ ভাষা হল- ইন্দো- ইরানীয় শাখার ফার্সি, বাংলা, হিন্দি । বাল্তো- স্লাভিক শাখার রুশীয়। গ্রীক শাখার আধুনিক গ্রীক। ইতালিক শাখার ফরাসী, ইতালিয়, স্পেনীয়। জার্মানিক শাখার ইংরেজি ও জার্মান ।

মূল ইন্দো- ইয়োরোপীয়ানদের একটি শাখা এসে ভারতবর্ষ ও ইরান-পারস্যে প্রবেশ করে। এই শাখার ভাষাকেই বলা হয় ইন্দো-ইরানিয় বা আর্য ভাষা। এই শাখাটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছিলো। একটি শাখা গিয়েছিল ইরান-পারস্যে যার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় পারসিকদের ধর্মগ্রন্থ 'আবেস্তা'য় খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে। আর অন্য শাখাটি আসে ভারতবর্ষে। যে শাখাটি ভারতবর্ষে প্রবেশ করে তাকেই আমরা বলি ভারতীয় আর্যভাষা।

আনুমানিক তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতবর্ষে এই আর্যভাষার প্রবেশ ঘটে। তারপর নানান স্তর পেরিয়ে নব নব রূপে আজও এই ভাষা ভারতে বেঁচে আছে। ভারতবর্ষে প্রবেশের কাল থেকে বিচার করলে আজ পর্যন্ত আর্যভাষার বিস্তৃতি কাল হল প্রায়, পাঁচ হাজার বছরের। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসকে পরিবর্তনের লক্ষণীয় পদক্ষেপ অনুসারে তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা হয়।

১/ প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা
২/ মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা
৩/ নব্য ভারতীয় আর্যভাষা

জীবন্ত ভাষা মাত্রই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে পরিবর্তিত হয়ে চলে, প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষাও লোক মুখে নিজে থেকেই কালে কালে পরিবর্তিত হয়ে আসছিল। কিন্তু বেদের ভাষাকে এদেশের ব্রাহ্মণ, সমাজ নেতারা, মনিষীরা ' দেবভাষা' বলেই বিশ্বাস করতেন। এবং প্রকৃতির অপরিহার্য নিয়মে ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছিল তাকে তারা দেবভাষার বিকৃতি বলেই মনে করতেন। কারন তাদের ধারনা ছিল মূল ভাষার ব্যাকরণ শিখিয়ে দিলে এতে ভাষা বিকৃতি বন্ধ হবে । এর ফলে সেইসব মনিষীগন ব্যাকরনের নিয়ম দিয়ে ভারতীয় আর্যভাষার শুদ্ধ ও মার্জিত রূপের যে আদর্শ রচনা করলেন তারই নাম হল 'সংস্কৃত', আর যারা এই রকম সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ সৃষ্টি করেছিলেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন মহামনিষী পাণিনি।

যাইহোক পাণিনি নিজে ছিলেন উদীচী অর্থাৎ উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলের অধিবাসী। আর সেই সময়ে শিক্ষিত বিদগ্ধ আর্যদের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান ছিল পশ্চিম ভারতের মধ্যপ্রদেশ। এইখানেই শিক্ষিত ব্যাক্তিদের মুখে ব্যবহৃত শুদ্ধ আর্যভাষাকে আদর্শ রূপে গ্রহন করে এবং তার সঙ্গে নিজের মাতৃভাষা উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলের কিছু উপাদান মিশ্রিত করে পাণিনি তাঁর ব্যাকরনে শুদ্ধ সংস্কৃতের রূপ বিধিবদ্ধ করেন। অশ্বঘোষ থেকে শুরু করে কালিদাস, ভবভুতি, ভারবি, মাঘ, বিশাখ দত্ত, শুদ্রক, বানভট্ট, প্রভৃতি কবি ও রচনাকারদের রচনায় এই সংস্কৃত ভাষার প্রভাব রয়েছে। মূলত একই ভারতীয় আর্যভাষা বিভিন্ন যুগে পরিবর্তিত হয়ে পৃথক রূপ লাভ করেছে। এবং প্রত্যেক যুগে তাকে পৃথক নাম দেওয়া হয়েছে।

প্রত্যেক যুগের ভাষাগত নিদর্শন আমরা পাই ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্য রচনায় বা প্রত্ন লিপিতে। তাছাড়া ভারতীয় আর্যভাষার মূল নিদর্শন পাওয়া যায় হিন্দুদের প্রাচীনতম গ্রন্থ ' বেদ' এ। আমরা জানি বেদ হল চারটি। যথা- ঋক, সাম, যজুঃ ও অথর্ব। প্রত্যেক বেদের আবার চারটি অংশ- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, এবং আরণ্যক। এগুলির মধ্যে ঋগ্বেদ- সংহিতাই প্রাচীনতম। এই ঋগ্বেদ সংহিতাই হল আর্যভাষার প্রাচীনতম দলিল। বৈদিক যুগে ভারতীয় আর্যভাষাই হল ভারতীয় প্রাচীন ভাষার অবিমিশ্র অবিকৃত নিদর্শন।

ভাষার সম্মান নির্ভর করে তার প্রকাশক্ষমতার ওপর। যে ভাষা যত বিচিত্র ভাব ও বস্তু এবং যত গভীর অনুভুতিতে প্রকাশ করতে সক্ষম সেই ভাষা ততই উন্নত। ভাষার এই প্রকাশক্ষমতার প্রধান আধার হল ভাষার শব্দসম্পদ।আবার এই শব্দসম্পদ কে তিনটি ভাবে সমৃদ্ধ করা হয়েছে

১/ উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত প্রাচীন শব্দের সাহায্যে,
২/ অন্য,, ভাষাথেকে গৃহীত কৃতঋণ শব্দের সাহায্যে
৩/ নতুন শব্দ সৃষ্টির সাহায্যে।

আজকের উন্নত বাংলা ভাষাও এই তিনটি উপায়ে নিজের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।

(কপিরাইট আইন অনুসারে রিয়া দাশগুপ্তা র রচিত এই লেখা বিনা অনুমতি তে কোথাও প্রকাশ আইনত দন্ডনীয়)

1 কমেন্টস্:

Soumitra Chakraborty বলেছেন...

দীর্ঘ. অভিজ্ঞতার নিরিখে দক্ষ লেখনী র ফসল এই অনবদ্য প্রবন্ধ।

অভিনন্দন প্রাবন্ধিক। আরোও এরকম লেখার প্রত্যাশায় রইলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন