পর্ণমোচী
অলভ্য ঘোষ
(তিন)
মিতা আর রুমা হেঁটে-চলেছে । কলেজ থেকে বাড়ির এই পনের মিনিটের রাস্তা গল্প করতে করতে অতিক্রম করে তারা ।গল্পের বিষয়বস্তু সাংসারিক কিংবা পড়াশোনা সংক্রান্ত যাই হয়ে থাকনা কেন;এ জগতের আর দশটা মেয়ের মত তারা সিনেমার নায়ক নায়িকার কুষ্ঠী বিচার কিংবা কোন লাস্যময় ছেলের রূপে আসক্ত প্রেমাক্রান্ত বাক্যালাপ করেনা । এ গ্রহে বসবাস করেও তারা যেন ভিন গ্রহের জীব ।
এখন তাদের আলোচনার বিষয় পূর্বরাগ । চতুর্থ পিরিয়ডে কমপালসারি বাংলা ক্লাসে অধ্যাপিকা সাথীলেখা রায় চৌধুরী যখন পূর্বরাগের অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের চিত্র জয় করছিলেন । মিতার মনে হয়েছে বড় বেশি মানব মানবির প্রেম কে তুলে ধরেছেন অধ্যাপিকা । দিদুনের মুখে চণ্ডীদাসের মুখস্থ কলি গুলোর সরল ব্যাখ্যাতে আজ পর্যন্ত দেহস্থ প্রেমের আভাস খুঁজে পায়নি মিতা । সেগুলো বারবার ভক্তি প্রেমের আধারে ভগবানের প্রতি প্রেমের ইঙ্গিত বহন করেছে ।
"রজকিনী-রূপ কিশোরী স্বরূপ কাম-গন্ধ নাহি তায়
রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম বড়ুচন্ডীদাস গায় ।।"
রজকিনী রামী বাঁশুলি মন্দিরের দেবদাসী । প্রতিদিন সকালে জল তুলে মন্দির ঝাঁট দেয়; বিদ্যুতলতার মত তনুশ্রী অপূর্ব মুখাবয়ব
রজকিনীর। একদিন মন্দিরের ভোগ নিতে এসে চণ্ডীদাসের সাথে আলাপ হয় তার । নানুরের অদূরে তেহাই গ্রামে ছিল এই রজক তনয়ার বাস । চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি ঊষাকালে অজয় নদের পাড়ে যজ্ঞিডুমুর গাছের তলায় নানুর গ্রামের মধ্যবয়স্ক পুরোহিত চণ্ডীদাস বুকে প্রেমনিয়ে বসে থাকতেন পিতৃ-মাতৃহীনা এই রামীণির জন্য । চণ্ডীদাসের আশ মেটেনা কিছুতেই এই রজকিনী রামীকে দেখে ।
এক এক সময় মিতার মনে হয় । আর জন্মে সে চণ্ডীদাসের রজকিনী ছিল । রুপম কি ছিল চণ্ডীদাস ? না ভাবনাটাকে পশ্রয় দেয়না মিতা ।
চণ্ডীদাস ছিলেন গ্রামের এক মন্দিরের পুরোহিত। গ্রামের এক নিচু জাতের অস্পৃশ্য মেয়েকে ভালোবেসে পা ধোয়া জল খেয়েছিল । পুরোহিত থেকে কবিতে পরিণত হয়েছিলেন চণ্ডীদাস ।
কখনো এই নারীমূর্তিকে তাঁর মনে হয় তাঁর বৈষ্ণব কাব্যের শ্রীরাধিকা আবার কখনো তাকে মনে হয় বাঁশুলি দেবীর প্রতিমূর্তি । একদিন রাতে স্বপ্ন দেখে তীব্র কাম-পিপাসা জাগে চণ্ডীদাসের শরীরে । সতীলক্ষ্মী স্ত্রী পদ্মজা মনের দুঃখে চলে গেছে তাকে ছেড়ে । একঘেয়ে নারী সঙ্গ বিবর্জিত জীবন কাটছিল চণ্ডীদাসের । কিন্তু তখন পূর্ণ যৌবন তাকে ছেড়ে যায়নি । স্বপ্নে চণ্ডীদাস একবার দেখেন রামী কে একবার দেখেন দেবী বাঁশুলির মুখাবয়ব । উথলপাথল মন । ভোর হতেই ঝাঁটা হাতে রামীণি আসে । রজকিনীর কাছে আসে চণ্ডীদাস। রামীর রাই-অঙ্গের ছটায় পুলকিত শ্যাম !দুহাত বাড়িয়ে রামীর বাহু ছুঁতে-গেলে কুণ্ঠিত,লজ্জিত রজকিনী দূরে সড়ে যায় ।
-কি করছেন গোঁসাই?
বাঁশুলি দেবীর বেদী স্পর্শের,দেবী-বিগ্রহকে ছোবার,ভোগ নিবেদন করার মন্দিরের সব অধিকার চণ্ডীদাস সফেদিতে চায় পরাজিত সৈনিকের মত নিচু জাতের মেয়ে রামীণিকে ।পাড়ার লোকে যদি একঘরে করে দেয় চণ্ডীদাসকে !দিক । জনঅরণ্যে একা বাঁচার চাইতে অরণ্যে প্রিয় সখ্যতায় বাঁচা অধিক শ্রেয় ।
রুপম ও কি ভালবাসার আগুনে পুরে এই ভেদবমির শ্রেণী বৈষম্য ময় সমাজ টাতে সত্য সুন্দরের প্রাকৃতিক তাড়নায় আজকের চণ্ডীদাস হতে চাইছে । মিতা যত ভাবে প্রশ্রয় দেবেনা ;মিতার ভাবনার জমিন ফুঁড়ে স্থানে অস্থানে ম্যানগোভ অরণ্যের মত মাথা উচুকরে দাঁড়ায় রুপম ।
মিতার মনে হয় রামীণি কি পড়েছিল দোটানায় !পুরুষের চোখে যে কামের আগুন জ্বলে প্রকৃত ভালোবাসা তা নয় । কেবল শরীরের আকর্ষণ । শরীর ফুরলে ভালবাসাও ফুরায় ।
রুমা বলে;
- "এখন কার চন্ডীদাসেদের এখন আর বার বছর ছিপ ফেলে বসে থাকার ধৈর্য নেই ।পাখি উড়ে-যাবে । একটা নয় ভিন্ন ভিন্ন ঘাটে একসাথে ছিপ ফেলে । আর রজকিনীরাও হাজার ঘাটে ঘুরে টোপ গেলে যখন তখন। গেলার সময় ও ভাবে না;ভাবে না উগরোবার ও সময়। দুই তিন মাস প্রেম টিকলে সেঞ্চুরি । টেস্ট-পালটে গেছে টেস্ট-ম্যাচ উঠে-গেছে;সবাই টোয়েনটি টোয়েনটি খেলছে । "
মিতা বলে:
- "আসলে এখন মাল্টিটাস্কিং,মাল্টিথ্রেডিং এর যুগ। তাল মিলায়ে না চলতে পারলে লোকে লজ্জা পায়। "
রুমা পারেনা মিতার অনেক কথা বুঝতে;তাদের দুজনার আলোচনায় অনেক সময় এঁটে ওঠেনা রুমা । হটাৎ উলটো ফুটপাতে চোখে পড়লো রুপম কে । ওপারের ফুটপাত থেকে তাদের ফলো করছে সে । রাস্তার লোকজন গাড়ি ঘোড়া কোন কিছুতেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই । রুমা ফিস ফিস করে কথাটা কানে তোলে মিতার ।
মিতা আড় চোখে দেখে রুপম কে । রুপমের চোখ দুটো এখন করুন ভাবে বর্ষার অপেক্ষমাণ চাতকের মত তাকিয়ে আছে মিতার দিকে । সব টাই কি নাটক !মিতা তলিয়ে দেখেনা ।
মেনরাস্তা ফেলে রুমা আর মিতা প্রবেশ করে পাড়ার গলি রাস্তায় । ছেলেটা এখনো অনুসরণ করে-চলেছে তাদের ।
-"নতুন কোন বদ মতলব আঁটে-নিতো । পাড়া পর্যন্ত চলে এলো বাড়ি টা চিনতে চাইছে বোধয় ।"
-"সব সময় মানুষ কে সন্দেহের চোখে দেখাটা ঠিকনয় মিতা ।"
-"সন্দেহভাজন হলে তাকে সন্দেহ না করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ;এরা সবপারে ..."
-"বিশ্বাস,ভালবাসা এ গুলো কি শুধুই কেতাবি..."
-"টি ভি খুব দেখছিস মনে-হচ্ছে । সিনেমা না সিরিয়ালের ডায়লগ এটা ।জীবন টা সিনেমা নয়;নায়ক নায়িকার দেখাহল অমনি প্রেমে পড়ে গেল ;যেন প্রেমে পড়বে বলেই পা বাড়িয়েছিল ;পরিচালক সুযোগ করে দিলেন । তারপর ধেই ধেই করে নাচো । সিনেমা তিন ঘণ্টার বেশি হয় না । জীবন কয়েক কোটি ঘণ্টার ; মামুলি কিছু ভুলের জন্য এতটা সময় নষ্ট-করবো কেন । চানাচুর ভাজা খেতে খেতে প্রেমে পড়লে চানাচুর শেষ হলে ঢোঙা টাই পড়ে থাকবে ; প্রেম থাকবে না । আমাকে যদি রুপম ভালবাসে;কেন ভালবাসল ?"
-"সব কেনর কোন উত্তর হয়না মিতা । আমি একটা মেয়ে ছেলেদের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে ।"
-"পাঁচ-মিনিটের জন্যেও যার সাথে আমার কোনদিনও কথা হয়নি;আমার ভালমন্দ কোনকিছুয়ই হদিস যে জানেনা । কয়েক দিনের চোখের দেখায় ভাল লাগতে পারে ;ভালবাসা জন্মাতে পারেনা ।Love at first Sight হতেই পারেনা । এক নজরেই ভালো লাগা শারীরিক।এখানে আবেগের চেয়ে শারীরিক আকর্ষণ বেশি কাজ করে। ভালবাসা লাউ কুমড়ো গাছ নয় পুঁতলাম আর ফল ফলল । সত্যিকার ভালবাসা বটবৃক্ষের মত যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে উৎসের সন্ধান হারিয়ে যায় উৎসেচকে । তাছাড়া আমার একটা ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান আছে যা কোন দিনও রুপম দের সাথে মিশ খেতে পারেনা ।"
-"ভালবাসা এত হিসেব নিকেশ করে হয় নাকি !"
-"তোর ফিল্মে হয় না ।"
-" বাস্তবে অহরহ তাই হয় । আকাশের মেঘ পথের ধুলোর সাথে লুকোচুরি খেলতে পারে কিন্তু কখনো আকাশ ছেড়ে নেমে আসেনা পথের ধুলয় ।"
-"কে বলেছে নেমে আসেনা ;তুই শুধু চিনতে পারিস নি মিতা । আকাশে মেঘ জমতে জমতে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে ধুলোর বুকে । ধুলকি তখন পারে বৃষ্টিতে না ভিজে থাকতে ।"
পূর্বরাগের পূর্বানুভূতি এখন মনে-হচ্ছে মিতার চাইতে রুমার অবগত হয়েছে ভাল ।রুমার কাছে পরাভব টা ধরা পরে-গেল মিতার ছলছলে চোখ দুটতে । আর একটাও কথা না বাড়িয়ে সে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো । আজ প্রথম রুমার কাছে মিতার পরাজয় ; অন্তঃকরণে হয়ত এ হার টাই চাইছিল সে নিজে ।
রাত বারটা আলো নিভান । বারান্দার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রুপম । ভবানিপুরের বারে আজ বন্ধুদের ছাড়াই গিয়েছিল সে। মথাটা এখনো চিনচিন করছে তার । গভীর নিস্তব্ধতাকে বার বার ভেঙে চলা দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক আওয়াজটা মাথার ভেতর যেন দুরমুশ পেটাচ্ছে রুপমের । দিনের বেলা ওটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না রাত যত বারে ঘড়িটার বাহাদুরি বারে ততো। মাথার চুলগুলো দুই হাতে মুঠো করে ধরে সে । তার ইচ্ছে করে ওগুলো উপরিয়ে ফেলতে। এই ইট কাট লোহালক্কড়ের পৃথিবীতে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে ;একা মনে হচ্ছে তার ।
সহসা গাড়ীর আওয়াজ ঘড়ির আওয়াজ ঢেকে রুপমের মাথার ভেতর যেন শেল হানলো । কান দুটোকে দুইহাতে মুঠো করে ধরেও কিছুতেই যখন রুখতে পারল না শব্দ ব্রহ্ম । ইজিচেয়ার ছেড়ে রুপম উঠে দাঁড়ালো গাড়ীর হেডলাইট সার্চ লাইটের মতো তার মুখের ওপর থেকে দেওয়ালে মিলিয়ে যাবার পূর্বে ;তিক্ত বিরক্তিতায় কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে সব রাগ উগরে দেয় সময়ের ওপর । দেওয়াল থেকে ঘড়িটা নামিয়ে বারান্দা থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলেদেয় রুপম । কাঁচ ভাঙ্গার ঝনঝনানি আওয়াজের সাথে গাড়ীর ঘরঘরানি বন্ধ হয় ;নেভে হেট লাইট। দরজাটা সজোরে খোলে ; দু জোড়া পা শব্দ করে ছুটে আসে রুপমের দিকে । সুইজ কট করে অন্ হতেই সমস্ত ঘরটা আলোকিত হয়ে ওঠে ।
-" What's happened !"
কথাটা বলতে বলতে পেছন থেকে রুপমের গলা জড়িয়ে ধরে তার মাম । মামের perfume এর ঝাঁজাল গন্ধটা নাকে যেতেই রুপমের সমস্ত গা টা গুলিয়ে ওঠে । মামের হাতটা গলা থেকে ছাড়িয়ে বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় রুপম ।
প্রণব এতক্ষণ কাঁধে ঝোলান কোটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সুইজ বোডের সামনে । কোটটা সোফার ওপর ছুড়ে ফেলে;বে-সামাল পায়ে ধপ করে বসে পড়ে সোফায় । ম্যাক-ডেলের গন্ধে সমস্ত ঘর টা রি রি করে ওঠে ।
-"তুমি রাগ করেছ রুপ।আমরা তোমার জন্য কিন্তু অনেকক্ষণ ওয়েট করেছিলাম । সেল টা সুইচ অফ করে রেখেছিলে কেন । কতবার ট্রাই করলাম....."
মাম ইজিচেয়ার টা ধরে দাঁড়িয়েছিল । আবার এগিয়ে আসে রুপমের কাছে ।
-"আমি ভেবেছিলাম তুমি পরে যাবে;রামঅবতার কে দিয়ে গাড়ী বাড়ি তেও পাঠিয়ে ছিলাম । রাই তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর কেক কাটে । "
-"সুইট গাল্ । দারুণ দেখতে হয়েছে মেয়েটাকে । "
প্রণব দুইহাতে মাথার ওপর তুলে হাই তুলতে তুলতে বলে ফেলে কথাগুলো ।
রুপের কাঁধে হাত রাখে মাম ।
-"আমার ছেলেও কমকিসে ।"
আবার কিছুটা দূরে সোরে যায় রুপম ।
-"Mom ; please leave me alone."
চোখ কপালে ওঠে তনুশ্রীর । হতাশ ভাবে ঘুরে তাকায় প্রণবের দিকে । হাত তুলে ইশারায় তনুশ্রীকে শান্ত হতে বলে ;সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে । মুখের মালবোরা সিগারেট থেকে ফুর ফুর করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাতের লাইটার টা সোফার সামনের টেবিলে ছুঁড়ে রাখে প্রণব । এটা তার একটা অভ্যাস।প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সে আর কোনকিছুর মূল্য-দেয় না । আবার প্রয়োজনে খোঁজে ।
-"মিস্টার সেন-গুপ্ত আজ প্রকাশ্য পাটিতে অ্যানাউন্স করে বসলো রাই এর সাথে তোমার অ্যানগেজম্যান্টের কথাটা । প্রপোজালটা অবশ্য অনেক আগেই আমি প্রপোজ করেছিলাম । "
-"engagement!"
তনুশ্রী তার চড়া মেকআপ স্বত্বেও বিবর্ণ মুখে একটা চেষ্টা-কৃত হাসি ধরে রেখে প্রণবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
-"ভেবেছিলাম আমরা তোমায় সারপ্রাইজ দেব ।"
-"What stupid thinking.প্রতিটা সম্পর্ক তোমাদের কাছে খেলনা না !"
ছেলের এইরকম বিরূপ মন্তব্যে মা বাপের মুখের যেমন জ্যামিতিক অভিব্যক্তি হওয়া সম্ভব ঠিক তেমন কিছু প্রণব তনুশ্রীর মুখে প্রকাশ পেল না । মনে মনে তারা যেন এমন প্রলাপের আসংখ্যা করে বসে আছেন । প্রতিষেধকের আয়োজন করতে চাইছেন রুপমের জন্য । টেবিলের অ্যাস ট্রেতে অবাঞ্ছিত সিগারেটের ছাইটা অবহেলায় ঝাড়তে-গিয়ে মেঝেয় পড়ে যায়; পাখার হাওযায় সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে ঘর নোংরা করে।অন্য সময় তনুশ্রী খেঁচ খেঁচ করে নোংরা বলে প্রণব কে । এখন পাকেচক্রে ভগবান ভূত । প্রণব মুখ খোলে ।
-"ছোট থেকে রাই এর সাথে তোমার ঘনিষ্ঠতা একে অপরকে খুব ভাল করে চেন-জান,পছন্দকর ।"
-"রাই এর সাথে সম্পর্কটা নিছক বন্ধুত্বের । আমি এর অতিরিক্ত কিছু কোনদিন ভাবিওনি ভাবতেও পারবো না ।"
তনুশ্রীর ধৈর্যর বাঁধ ভাঙছিল;
-"জানতে পারি রাই এর মধ্যে কমতি কি আছে ।She is sophisticated girl."
-"মাম আমার জীবন টা বাজার নয় মাপজোপ করে সম্পর্ক...."
তনুশ্রী থামিয়ে দেয় রুপমকে ।
-"Vagabond দের মত কথা বোলনা রুপ ।"
উত্তপ্ত পরিবেশে প্রণব জলপট্টি দেবার চেষ্টা করে ।
-"দেখ রুপ মিস্টার সেন-গুপ্ত আমাদের কোম্পানির ফিপটি পার-সেন্ট শেয়ার হোল্ডার ।এরকম কত কোম্পানি যে ওনার হাতের মুঠয় তার হিসেব নেই । ওনাদের সাথে আত্মীয়তা হলে তোমার স্ট্যাটাস কমে-যাবে না রুপ;বাড়বে । রাই একমাত্র সন্তান মিস্টার সেন-গুপ্তর অবর্তমানে ধরে নিতে পার সমস্ত প্রপাটি তোমার ।"
-"জীবন টাকি Algebra এক্স ধরে মিলিয়ে নেব । আমার জীবন টা নিয়ে প্লিজ বিজনেস করনা ডেড । প্রপাটির সাথে বিয়ে করার কোন রকম ইন্টারেস্ট আমার নেই । আর যদি স্ট্যাটাস এর কথাই বল আমার জানতে ইচ্ছেকরে মামকে বিয়ে করার পর তোমার স্ট্যাটাস কতটা বেড়েছে ।"
তনুশ্রীর মেকআপ করা লাবণ্য ময় মুখ খানাতে ; রুক্ষতার বাতাবরণ ছেয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ । এবার তার ফরসা গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো । রুপম যেন সপাটে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে তার গালে । রুপমের ঔধত্ব তনুশ্রীর ধৈর্যর সীমা লঙ্ঘন করায় রাগে অপমানে থর থর করে কাঁপছিল তনুশ্রী । ভুরু কুচকে চোখ দুটো কপালে তুলে বলে;
-"তোমার ইন্টারেস্ট কোথায় ;কলেজের ঐ গাঁইয়া মেয়েটার ওপর ?সে তো তোমাকে পাত্তাই দেয়না ।"
-"ও তোমরা তাহলে সবি-জান ।"
তনুশ্রী ঝংকার দিয়ে ওঠে;
-"এও জানি সকলের সামনে ওর হাতে তুমি থাপ্পড় খেয়েছ । কলেজ থেকে তোমাকে ঘার ধাক্কা-দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে । তোমার জন্য আমাদের মাথা ধুলয় মিশে-যাচ্ছে । "
রুপমের চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে । কিছুক্ষণ মাথানিচু করে থাকার পর আস্তে আস্তে মাথা তোলে সে।
-"Mom try to understand me ."
-"তোমার বলতে লজ্জা করছেনা রুপ । আমাদের বাড়ির চাকরেরও একটা সম্মান আছে । ওই বস্তির below standard মেয়েটা কোন ভাবেই এ বাড়ির যোগ্য নয় । "
রুপম বাইরের দিকে তাকাল । দিনের আলোয় ঝকঝকে প্রাণবন্ত লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ গুলকে এখন এক একটা কালো বৃহৎ আকার ডায়নোসারের মত দেখাচ্ছে । তার তলায় ছোট ইউক্যালিপটাস চারা গুলো যেন ডায়নোসারের বাচ্চা । জুরাসিক যুগ অতিক্রম করে এ যুগের মাটি স্পর্শ করেছে । রুপমের মনে হয় এ বাড়ির বাহ্যিক গম্ভীরতা তাকে গোগ্রাসে গিলে খেতে আসছে ।
মায়ের কথার জের টেনে আবার মুখ খোলে রুপম ।
-"একবার ভেবে দেখেছ মাম তোমার যোগ্যতা কতটা । রুপমের যোগ্য মা হয়ে উঠতে কোনদিন তুমি পেরেছ কিনা । পাটি,স্ট্যাটাস,ক্লাব,সোসাইটি ছোটবেলা-দিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে কান পচে গেল । আয়া মার হাতে আমাকে দিয়ে তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পরদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়েছ ।
কোন কোন দিন রাতে ফিরে জ্বর ছেলের মাথায় হাত রেখে আয়া-মাকে জিঞ্জেস করেছ টনিক টা ওকে খাইয়ে ছিলে । দেখেছ জ্বরটা কত ? তার পর হয়তো তোমার ভালবাসার প্রাপ্তি স্বরূপ ঘুমতে যাবার আগে এক গালে কিস্ করেছ । কত দিন তোমার কাছে ঘুমতে চেয়েছি তুমি বলেছ কাল ঘুমিও আজ আমি ভীষণ টায়াট ;কাল আর ফিরে আসত না । আমরা বেড়াতে গেলেও তোমায় সম্পূর্ণ ভাবে পেতাম না । আমি থাকতাম আয়া মায়ের ঘরে । জান মাম জ্বরে কাঁতরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া রাত গুলতে ;আমি যখন স্নেহ খুঁজতাম আশ্রয় খুঁজতাম আমার মুখের সামনে ভেসে উঠতো পয়সা দিয়ে কেনা আমার আয়া মায়ের ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো ।"
তনুশ্রী চিৎকার করে ওঠে ।
-"What do you mean ?"
-"আমি আর নতুন করে এই ভালবাসা চাইছিনা মাম । মিতা আমাকে রিফিউজ করার পর বুঝেছি তোমাদের থেকে শেখা ভালবাসা কতটা পোশাকি Formal। Hi; Hello; Bye বললেই
তোমাদের ভালবাসা ; তোমাদের আবেগ উচ্ছ্বাস সম্পর্ক সব কিছু শেষ হয়ে যায় । সোজা সস্তা । রাই খুব ভাল মেয়ে । But she is also part of the damned culture and society. ভালবাসি বলে ওকে আমি ঠকাতে পারবো না ।I hate this culture , society , love & relation ."
কথাগুলো বলা শেষ হতেই রুপ তার বেড রুমে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধকরে দেয় । প্রণব অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুন ছিল মা ছেলের ঝগড়া । সে রুপমের দরজার কাছে এগিয়ে যায় ।
-"রুপ....রুপ....শোন.....দরজা খোল । তুমি ডিনার করেছো । "
দরজার ওপাড় থেকে কোন উত্তর আসেনা ।
প্রণবের বুকে মুখ গুজে রুপমের ধারালো কথা গুলোর হৃদয় অনুরণনে কেঁদে ওঠে তনুশ্রী । প্রণব সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।
-"Upset হয়ে পড় না;সব ঠিক হয়ে যাবে ।"
(তিন)
মিতা আর রুমা হেঁটে-চলেছে । কলেজ থেকে বাড়ির এই পনের মিনিটের রাস্তা গল্প করতে করতে অতিক্রম করে তারা ।গল্পের বিষয়বস্তু সাংসারিক কিংবা পড়াশোনা সংক্রান্ত যাই হয়ে থাকনা কেন;এ জগতের আর দশটা মেয়ের মত তারা সিনেমার নায়ক নায়িকার কুষ্ঠী বিচার কিংবা কোন লাস্যময় ছেলের রূপে আসক্ত প্রেমাক্রান্ত বাক্যালাপ করেনা । এ গ্রহে বসবাস করেও তারা যেন ভিন গ্রহের জীব ।
এখন তাদের আলোচনার বিষয় পূর্বরাগ । চতুর্থ পিরিয়ডে কমপালসারি বাংলা ক্লাসে অধ্যাপিকা সাথীলেখা রায় চৌধুরী যখন পূর্বরাগের অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের চিত্র জয় করছিলেন । মিতার মনে হয়েছে বড় বেশি মানব মানবির প্রেম কে তুলে ধরেছেন অধ্যাপিকা । দিদুনের মুখে চণ্ডীদাসের মুখস্থ কলি গুলোর সরল ব্যাখ্যাতে আজ পর্যন্ত দেহস্থ প্রেমের আভাস খুঁজে পায়নি মিতা । সেগুলো বারবার ভক্তি প্রেমের আধারে ভগবানের প্রতি প্রেমের ইঙ্গিত বহন করেছে ।
"রজকিনী-রূপ কিশোরী স্বরূপ কাম-গন্ধ নাহি তায়
রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম বড়ুচন্ডীদাস গায় ।।"
রজকিনী রামী বাঁশুলি মন্দিরের দেবদাসী । প্রতিদিন সকালে জল তুলে মন্দির ঝাঁট দেয়; বিদ্যুতলতার মত তনুশ্রী অপূর্ব মুখাবয়ব
রজকিনীর। একদিন মন্দিরের ভোগ নিতে এসে চণ্ডীদাসের সাথে আলাপ হয় তার । নানুরের অদূরে তেহাই গ্রামে ছিল এই রজক তনয়ার বাস । চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি ঊষাকালে অজয় নদের পাড়ে যজ্ঞিডুমুর গাছের তলায় নানুর গ্রামের মধ্যবয়স্ক পুরোহিত চণ্ডীদাস বুকে প্রেমনিয়ে বসে থাকতেন পিতৃ-মাতৃহীনা এই রামীণির জন্য । চণ্ডীদাসের আশ মেটেনা কিছুতেই এই রজকিনী রামীকে দেখে ।
এক এক সময় মিতার মনে হয় । আর জন্মে সে চণ্ডীদাসের রজকিনী ছিল । রুপম কি ছিল চণ্ডীদাস ? না ভাবনাটাকে পশ্রয় দেয়না মিতা ।
চণ্ডীদাস ছিলেন গ্রামের এক মন্দিরের পুরোহিত। গ্রামের এক নিচু জাতের অস্পৃশ্য মেয়েকে ভালোবেসে পা ধোয়া জল খেয়েছিল । পুরোহিত থেকে কবিতে পরিণত হয়েছিলেন চণ্ডীদাস ।
কখনো এই নারীমূর্তিকে তাঁর মনে হয় তাঁর বৈষ্ণব কাব্যের শ্রীরাধিকা আবার কখনো তাকে মনে হয় বাঁশুলি দেবীর প্রতিমূর্তি । একদিন রাতে স্বপ্ন দেখে তীব্র কাম-পিপাসা জাগে চণ্ডীদাসের শরীরে । সতীলক্ষ্মী স্ত্রী পদ্মজা মনের দুঃখে চলে গেছে তাকে ছেড়ে । একঘেয়ে নারী সঙ্গ বিবর্জিত জীবন কাটছিল চণ্ডীদাসের । কিন্তু তখন পূর্ণ যৌবন তাকে ছেড়ে যায়নি । স্বপ্নে চণ্ডীদাস একবার দেখেন রামী কে একবার দেখেন দেবী বাঁশুলির মুখাবয়ব । উথলপাথল মন । ভোর হতেই ঝাঁটা হাতে রামীণি আসে । রজকিনীর কাছে আসে চণ্ডীদাস। রামীর রাই-অঙ্গের ছটায় পুলকিত শ্যাম !দুহাত বাড়িয়ে রামীর বাহু ছুঁতে-গেলে কুণ্ঠিত,লজ্জিত রজকিনী দূরে সড়ে যায় ।
-কি করছেন গোঁসাই?
বাঁশুলি দেবীর বেদী স্পর্শের,দেবী-বিগ্রহকে ছোবার,ভোগ নিবেদন করার মন্দিরের সব অধিকার চণ্ডীদাস সফেদিতে চায় পরাজিত সৈনিকের মত নিচু জাতের মেয়ে রামীণিকে ।পাড়ার লোকে যদি একঘরে করে দেয় চণ্ডীদাসকে !দিক । জনঅরণ্যে একা বাঁচার চাইতে অরণ্যে প্রিয় সখ্যতায় বাঁচা অধিক শ্রেয় ।
রুপম ও কি ভালবাসার আগুনে পুরে এই ভেদবমির শ্রেণী বৈষম্য ময় সমাজ টাতে সত্য সুন্দরের প্রাকৃতিক তাড়নায় আজকের চণ্ডীদাস হতে চাইছে । মিতা যত ভাবে প্রশ্রয় দেবেনা ;মিতার ভাবনার জমিন ফুঁড়ে স্থানে অস্থানে ম্যানগোভ অরণ্যের মত মাথা উচুকরে দাঁড়ায় রুপম ।
মিতার মনে হয় রামীণি কি পড়েছিল দোটানায় !পুরুষের চোখে যে কামের আগুন জ্বলে প্রকৃত ভালোবাসা তা নয় । কেবল শরীরের আকর্ষণ । শরীর ফুরলে ভালবাসাও ফুরায় ।
রুমা বলে;
- "এখন কার চন্ডীদাসেদের এখন আর বার বছর ছিপ ফেলে বসে থাকার ধৈর্য নেই ।পাখি উড়ে-যাবে । একটা নয় ভিন্ন ভিন্ন ঘাটে একসাথে ছিপ ফেলে । আর রজকিনীরাও হাজার ঘাটে ঘুরে টোপ গেলে যখন তখন। গেলার সময় ও ভাবে না;ভাবে না উগরোবার ও সময়। দুই তিন মাস প্রেম টিকলে সেঞ্চুরি । টেস্ট-পালটে গেছে টেস্ট-ম্যাচ উঠে-গেছে;সবাই টোয়েনটি টোয়েনটি খেলছে । "
মিতা বলে:
- "আসলে এখন মাল্টিটাস্কিং,মাল্টিথ্রেডিং এর যুগ। তাল মিলায়ে না চলতে পারলে লোকে লজ্জা পায়। "
রুমা পারেনা মিতার অনেক কথা বুঝতে;তাদের দুজনার আলোচনায় অনেক সময় এঁটে ওঠেনা রুমা । হটাৎ উলটো ফুটপাতে চোখে পড়লো রুপম কে । ওপারের ফুটপাত থেকে তাদের ফলো করছে সে । রাস্তার লোকজন গাড়ি ঘোড়া কোন কিছুতেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই । রুমা ফিস ফিস করে কথাটা কানে তোলে মিতার ।
মিতা আড় চোখে দেখে রুপম কে । রুপমের চোখ দুটো এখন করুন ভাবে বর্ষার অপেক্ষমাণ চাতকের মত তাকিয়ে আছে মিতার দিকে । সব টাই কি নাটক !মিতা তলিয়ে দেখেনা ।
মেনরাস্তা ফেলে রুমা আর মিতা প্রবেশ করে পাড়ার গলি রাস্তায় । ছেলেটা এখনো অনুসরণ করে-চলেছে তাদের ।
-"নতুন কোন বদ মতলব আঁটে-নিতো । পাড়া পর্যন্ত চলে এলো বাড়ি টা চিনতে চাইছে বোধয় ।"
-"সব সময় মানুষ কে সন্দেহের চোখে দেখাটা ঠিকনয় মিতা ।"
-"সন্দেহভাজন হলে তাকে সন্দেহ না করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ;এরা সবপারে ..."
-"বিশ্বাস,ভালবাসা এ গুলো কি শুধুই কেতাবি..."
-"টি ভি খুব দেখছিস মনে-হচ্ছে । সিনেমা না সিরিয়ালের ডায়লগ এটা ।জীবন টা সিনেমা নয়;নায়ক নায়িকার দেখাহল অমনি প্রেমে পড়ে গেল ;যেন প্রেমে পড়বে বলেই পা বাড়িয়েছিল ;পরিচালক সুযোগ করে দিলেন । তারপর ধেই ধেই করে নাচো । সিনেমা তিন ঘণ্টার বেশি হয় না । জীবন কয়েক কোটি ঘণ্টার ; মামুলি কিছু ভুলের জন্য এতটা সময় নষ্ট-করবো কেন । চানাচুর ভাজা খেতে খেতে প্রেমে পড়লে চানাচুর শেষ হলে ঢোঙা টাই পড়ে থাকবে ; প্রেম থাকবে না । আমাকে যদি রুপম ভালবাসে;কেন ভালবাসল ?"
-"সব কেনর কোন উত্তর হয়না মিতা । আমি একটা মেয়ে ছেলেদের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে ।"
-"পাঁচ-মিনিটের জন্যেও যার সাথে আমার কোনদিনও কথা হয়নি;আমার ভালমন্দ কোনকিছুয়ই হদিস যে জানেনা । কয়েক দিনের চোখের দেখায় ভাল লাগতে পারে ;ভালবাসা জন্মাতে পারেনা ।Love at first Sight হতেই পারেনা । এক নজরেই ভালো লাগা শারীরিক।এখানে আবেগের চেয়ে শারীরিক আকর্ষণ বেশি কাজ করে। ভালবাসা লাউ কুমড়ো গাছ নয় পুঁতলাম আর ফল ফলল । সত্যিকার ভালবাসা বটবৃক্ষের মত যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে উৎসের সন্ধান হারিয়ে যায় উৎসেচকে । তাছাড়া আমার একটা ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান আছে যা কোন দিনও রুপম দের সাথে মিশ খেতে পারেনা ।"
-"ভালবাসা এত হিসেব নিকেশ করে হয় নাকি !"
-"তোর ফিল্মে হয় না ।"
-" বাস্তবে অহরহ তাই হয় । আকাশের মেঘ পথের ধুলোর সাথে লুকোচুরি খেলতে পারে কিন্তু কখনো আকাশ ছেড়ে নেমে আসেনা পথের ধুলয় ।"
-"কে বলেছে নেমে আসেনা ;তুই শুধু চিনতে পারিস নি মিতা । আকাশে মেঘ জমতে জমতে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে ধুলোর বুকে । ধুলকি তখন পারে বৃষ্টিতে না ভিজে থাকতে ।"
পূর্বরাগের পূর্বানুভূতি এখন মনে-হচ্ছে মিতার চাইতে রুমার অবগত হয়েছে ভাল ।রুমার কাছে পরাভব টা ধরা পরে-গেল মিতার ছলছলে চোখ দুটতে । আর একটাও কথা না বাড়িয়ে সে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো । আজ প্রথম রুমার কাছে মিতার পরাজয় ; অন্তঃকরণে হয়ত এ হার টাই চাইছিল সে নিজে ।
রাত বারটা আলো নিভান । বারান্দার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রুপম । ভবানিপুরের বারে আজ বন্ধুদের ছাড়াই গিয়েছিল সে। মথাটা এখনো চিনচিন করছে তার । গভীর নিস্তব্ধতাকে বার বার ভেঙে চলা দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক আওয়াজটা মাথার ভেতর যেন দুরমুশ পেটাচ্ছে রুপমের । দিনের বেলা ওটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না রাত যত বারে ঘড়িটার বাহাদুরি বারে ততো। মাথার চুলগুলো দুই হাতে মুঠো করে ধরে সে । তার ইচ্ছে করে ওগুলো উপরিয়ে ফেলতে। এই ইট কাট লোহালক্কড়ের পৃথিবীতে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে ;একা মনে হচ্ছে তার ।
সহসা গাড়ীর আওয়াজ ঘড়ির আওয়াজ ঢেকে রুপমের মাথার ভেতর যেন শেল হানলো । কান দুটোকে দুইহাতে মুঠো করে ধরেও কিছুতেই যখন রুখতে পারল না শব্দ ব্রহ্ম । ইজিচেয়ার ছেড়ে রুপম উঠে দাঁড়ালো গাড়ীর হেডলাইট সার্চ লাইটের মতো তার মুখের ওপর থেকে দেওয়ালে মিলিয়ে যাবার পূর্বে ;তিক্ত বিরক্তিতায় কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে সব রাগ উগরে দেয় সময়ের ওপর । দেওয়াল থেকে ঘড়িটা নামিয়ে বারান্দা থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলেদেয় রুপম । কাঁচ ভাঙ্গার ঝনঝনানি আওয়াজের সাথে গাড়ীর ঘরঘরানি বন্ধ হয় ;নেভে হেট লাইট। দরজাটা সজোরে খোলে ; দু জোড়া পা শব্দ করে ছুটে আসে রুপমের দিকে । সুইজ কট করে অন্ হতেই সমস্ত ঘরটা আলোকিত হয়ে ওঠে ।
-" What's happened !"
কথাটা বলতে বলতে পেছন থেকে রুপমের গলা জড়িয়ে ধরে তার মাম । মামের perfume এর ঝাঁজাল গন্ধটা নাকে যেতেই রুপমের সমস্ত গা টা গুলিয়ে ওঠে । মামের হাতটা গলা থেকে ছাড়িয়ে বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় রুপম ।
প্রণব এতক্ষণ কাঁধে ঝোলান কোটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সুইজ বোডের সামনে । কোটটা সোফার ওপর ছুড়ে ফেলে;বে-সামাল পায়ে ধপ করে বসে পড়ে সোফায় । ম্যাক-ডেলের গন্ধে সমস্ত ঘর টা রি রি করে ওঠে ।
-"তুমি রাগ করেছ রুপ।আমরা তোমার জন্য কিন্তু অনেকক্ষণ ওয়েট করেছিলাম । সেল টা সুইচ অফ করে রেখেছিলে কেন । কতবার ট্রাই করলাম....."
মাম ইজিচেয়ার টা ধরে দাঁড়িয়েছিল । আবার এগিয়ে আসে রুপমের কাছে ।
-"আমি ভেবেছিলাম তুমি পরে যাবে;রামঅবতার কে দিয়ে গাড়ী বাড়ি তেও পাঠিয়ে ছিলাম । রাই তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর কেক কাটে । "
-"সুইট গাল্ । দারুণ দেখতে হয়েছে মেয়েটাকে । "
প্রণব দুইহাতে মাথার ওপর তুলে হাই তুলতে তুলতে বলে ফেলে কথাগুলো ।
রুপের কাঁধে হাত রাখে মাম ।
-"আমার ছেলেও কমকিসে ।"
আবার কিছুটা দূরে সোরে যায় রুপম ।
-"Mom ; please leave me alone."
চোখ কপালে ওঠে তনুশ্রীর । হতাশ ভাবে ঘুরে তাকায় প্রণবের দিকে । হাত তুলে ইশারায় তনুশ্রীকে শান্ত হতে বলে ;সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে । মুখের মালবোরা সিগারেট থেকে ফুর ফুর করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাতের লাইটার টা সোফার সামনের টেবিলে ছুঁড়ে রাখে প্রণব । এটা তার একটা অভ্যাস।প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সে আর কোনকিছুর মূল্য-দেয় না । আবার প্রয়োজনে খোঁজে ।
-"মিস্টার সেন-গুপ্ত আজ প্রকাশ্য পাটিতে অ্যানাউন্স করে বসলো রাই এর সাথে তোমার অ্যানগেজম্যান্টের কথাটা । প্রপোজালটা অবশ্য অনেক আগেই আমি প্রপোজ করেছিলাম । "
-"engagement!"
তনুশ্রী তার চড়া মেকআপ স্বত্বেও বিবর্ণ মুখে একটা চেষ্টা-কৃত হাসি ধরে রেখে প্রণবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
-"ভেবেছিলাম আমরা তোমায় সারপ্রাইজ দেব ।"
-"What stupid thinking.প্রতিটা সম্পর্ক তোমাদের কাছে খেলনা না !"
ছেলের এইরকম বিরূপ মন্তব্যে মা বাপের মুখের যেমন জ্যামিতিক অভিব্যক্তি হওয়া সম্ভব ঠিক তেমন কিছু প্রণব তনুশ্রীর মুখে প্রকাশ পেল না । মনে মনে তারা যেন এমন প্রলাপের আসংখ্যা করে বসে আছেন । প্রতিষেধকের আয়োজন করতে চাইছেন রুপমের জন্য । টেবিলের অ্যাস ট্রেতে অবাঞ্ছিত সিগারেটের ছাইটা অবহেলায় ঝাড়তে-গিয়ে মেঝেয় পড়ে যায়; পাখার হাওযায় সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে ঘর নোংরা করে।অন্য সময় তনুশ্রী খেঁচ খেঁচ করে নোংরা বলে প্রণব কে । এখন পাকেচক্রে ভগবান ভূত । প্রণব মুখ খোলে ।
-"ছোট থেকে রাই এর সাথে তোমার ঘনিষ্ঠতা একে অপরকে খুব ভাল করে চেন-জান,পছন্দকর ।"
-"রাই এর সাথে সম্পর্কটা নিছক বন্ধুত্বের । আমি এর অতিরিক্ত কিছু কোনদিন ভাবিওনি ভাবতেও পারবো না ।"
তনুশ্রীর ধৈর্যর বাঁধ ভাঙছিল;
-"জানতে পারি রাই এর মধ্যে কমতি কি আছে ।She is sophisticated girl."
-"মাম আমার জীবন টা বাজার নয় মাপজোপ করে সম্পর্ক...."
তনুশ্রী থামিয়ে দেয় রুপমকে ।
-"Vagabond দের মত কথা বোলনা রুপ ।"
উত্তপ্ত পরিবেশে প্রণব জলপট্টি দেবার চেষ্টা করে ।
-"দেখ রুপ মিস্টার সেন-গুপ্ত আমাদের কোম্পানির ফিপটি পার-সেন্ট শেয়ার হোল্ডার ।এরকম কত কোম্পানি যে ওনার হাতের মুঠয় তার হিসেব নেই । ওনাদের সাথে আত্মীয়তা হলে তোমার স্ট্যাটাস কমে-যাবে না রুপ;বাড়বে । রাই একমাত্র সন্তান মিস্টার সেন-গুপ্তর অবর্তমানে ধরে নিতে পার সমস্ত প্রপাটি তোমার ।"
-"জীবন টাকি Algebra এক্স ধরে মিলিয়ে নেব । আমার জীবন টা নিয়ে প্লিজ বিজনেস করনা ডেড । প্রপাটির সাথে বিয়ে করার কোন রকম ইন্টারেস্ট আমার নেই । আর যদি স্ট্যাটাস এর কথাই বল আমার জানতে ইচ্ছেকরে মামকে বিয়ে করার পর তোমার স্ট্যাটাস কতটা বেড়েছে ।"
তনুশ্রীর মেকআপ করা লাবণ্য ময় মুখ খানাতে ; রুক্ষতার বাতাবরণ ছেয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ । এবার তার ফরসা গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো । রুপম যেন সপাটে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে তার গালে । রুপমের ঔধত্ব তনুশ্রীর ধৈর্যর সীমা লঙ্ঘন করায় রাগে অপমানে থর থর করে কাঁপছিল তনুশ্রী । ভুরু কুচকে চোখ দুটো কপালে তুলে বলে;
-"তোমার ইন্টারেস্ট কোথায় ;কলেজের ঐ গাঁইয়া মেয়েটার ওপর ?সে তো তোমাকে পাত্তাই দেয়না ।"
-"ও তোমরা তাহলে সবি-জান ।"
তনুশ্রী ঝংকার দিয়ে ওঠে;
-"এও জানি সকলের সামনে ওর হাতে তুমি থাপ্পড় খেয়েছ । কলেজ থেকে তোমাকে ঘার ধাক্কা-দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে । তোমার জন্য আমাদের মাথা ধুলয় মিশে-যাচ্ছে । "
রুপমের চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে । কিছুক্ষণ মাথানিচু করে থাকার পর আস্তে আস্তে মাথা তোলে সে।
-"Mom try to understand me ."
-"তোমার বলতে লজ্জা করছেনা রুপ । আমাদের বাড়ির চাকরেরও একটা সম্মান আছে । ওই বস্তির below standard মেয়েটা কোন ভাবেই এ বাড়ির যোগ্য নয় । "
রুপম বাইরের দিকে তাকাল । দিনের আলোয় ঝকঝকে প্রাণবন্ত লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ গুলকে এখন এক একটা কালো বৃহৎ আকার ডায়নোসারের মত দেখাচ্ছে । তার তলায় ছোট ইউক্যালিপটাস চারা গুলো যেন ডায়নোসারের বাচ্চা । জুরাসিক যুগ অতিক্রম করে এ যুগের মাটি স্পর্শ করেছে । রুপমের মনে হয় এ বাড়ির বাহ্যিক গম্ভীরতা তাকে গোগ্রাসে গিলে খেতে আসছে ।
মায়ের কথার জের টেনে আবার মুখ খোলে রুপম ।
-"একবার ভেবে দেখেছ মাম তোমার যোগ্যতা কতটা । রুপমের যোগ্য মা হয়ে উঠতে কোনদিন তুমি পেরেছ কিনা । পাটি,স্ট্যাটাস,ক্লাব,সোসাইটি ছোটবেলা-দিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে কান পচে গেল । আয়া মার হাতে আমাকে দিয়ে তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পরদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়েছ ।
কোন কোন দিন রাতে ফিরে জ্বর ছেলের মাথায় হাত রেখে আয়া-মাকে জিঞ্জেস করেছ টনিক টা ওকে খাইয়ে ছিলে । দেখেছ জ্বরটা কত ? তার পর হয়তো তোমার ভালবাসার প্রাপ্তি স্বরূপ ঘুমতে যাবার আগে এক গালে কিস্ করেছ । কত দিন তোমার কাছে ঘুমতে চেয়েছি তুমি বলেছ কাল ঘুমিও আজ আমি ভীষণ টায়াট ;কাল আর ফিরে আসত না । আমরা বেড়াতে গেলেও তোমায় সম্পূর্ণ ভাবে পেতাম না । আমি থাকতাম আয়া মায়ের ঘরে । জান মাম জ্বরে কাঁতরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া রাত গুলতে ;আমি যখন স্নেহ খুঁজতাম আশ্রয় খুঁজতাম আমার মুখের সামনে ভেসে উঠতো পয়সা দিয়ে কেনা আমার আয়া মায়ের ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো ।"
তনুশ্রী চিৎকার করে ওঠে ।
-"What do you mean ?"
-"আমি আর নতুন করে এই ভালবাসা চাইছিনা মাম । মিতা আমাকে রিফিউজ করার পর বুঝেছি তোমাদের থেকে শেখা ভালবাসা কতটা পোশাকি Formal। Hi; Hello; Bye বললেই
তোমাদের ভালবাসা ; তোমাদের আবেগ উচ্ছ্বাস সম্পর্ক সব কিছু শেষ হয়ে যায় । সোজা সস্তা । রাই খুব ভাল মেয়ে । But she is also part of the damned culture and society. ভালবাসি বলে ওকে আমি ঠকাতে পারবো না ।I hate this culture , society , love & relation ."
কথাগুলো বলা শেষ হতেই রুপ তার বেড রুমে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধকরে দেয় । প্রণব অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুন ছিল মা ছেলের ঝগড়া । সে রুপমের দরজার কাছে এগিয়ে যায় ।
-"রুপ....রুপ....শোন.....দরজা খোল । তুমি ডিনার করেছো । "
দরজার ওপাড় থেকে কোন উত্তর আসেনা ।
প্রণবের বুকে মুখ গুজে রুপমের ধারালো কথা গুলোর হৃদয় অনুরণনে কেঁদে ওঠে তনুশ্রী । প্রণব সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।
-"Upset হয়ে পড় না;সব ঠিক হয়ে যাবে ।"
(চলবে)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন