৪ ডিসে, ২০১৩

প্রবন্ধ - মৌ দাশগুপ্তা

এক আত্মপরিক্রমা :
বাংলাসাহিত্যের এক অনন্য নারীবাদী কবি
মল্লিকা সেনগুপ্ত
মৌ দাশগুপ্তা

পর্ব : ১

সাহিত্যে নারী চরিত্র একটি প্রাচীন অনুষঙ্গ। পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে নারীর গুরুত্ব যতই কম হোক না কেন পুরুষের ভাবনায় একটি বড় অংশ জুড়ে আছে নারী। শিল্পের যেকোন শাখায় পুরুষ শিল্পীর কাছে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হলো নারী। বাংলা সাহিত্যেও যুগ যুগ ধরে নারীকে উপজীব্য করে বহু রচনা সৃষ্টি হয়েছে। তথাকথিত অবলা বান্ধব হিসাবে আর্বিভূত হয়েছেন কেউ। নারী জাগরণের মন্ত্র উচ্চারণও করেছেন অনেক মাতাল ঋত্তিক। বাংলা সাহিত্যের অনেক নারী বিরোধী কবি লেখককেও চিহ্নিত করা হয়েছে নারী মুক্তির প্রবক্তা রূপে। এদের মাঝখানেই নারীদের নিজস্ব জগত নিয়ে যখন কবিতা লেখা শুরু করলেন যশস্বিনী কৃষ্ণা বসু,কিংবা কথামানবী মল্লিকা সেনগুপ্তা তখন যেন বাংলা সাহিত্যের নতুন এক ধারার গোলাভরে গেল নতুন ফসলে। তবে তাঁদের এই প্রচেষ্টাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখতে ছাড়েননি অনেকেই। এদের মধ্যে কেঊ কেউ আছেন বিদগ্ধ বা বরেণ্য লেখকও । তাদের ধারণা হল, এই দুই কবি মেয়েদের জন্য লেখনী আদৌ ধরছেন না, বরঞ্চ সস্তায় নাম কেনার মোহে নারীবাদের নামে নতুন করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেই এনারা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন । তবে নারীবাদী রচনা হলেও তাদের সৃষ্টি যে সম্পূর্ণ দুই ধারার এতে কোন সন্দেহর অবকাশ নেই। মল্লিকার নারীবাদী লেখাগুলি মুলত: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নির্ভর। কিন্তু কৃষ্ণাদির লেখা অনেকটাই তাত্ত্বিক । তবে দুজনের রচনা শৈলী যে সুখপাঠ্য এতে কোন সন্দেহ নেই। কবিকে জানতে হলে তার কবিতার কাছে নয় , তার চিন্তা, তাঁর ভাবনা, তাঁর মনের চুপকথার কাছেই ফিরে যেতে হবে বার বার।

কবিতার সংজ্ঞার শেষ নেই। পৃথিবীতে অনন্তকাল রচিত হবে কবিতা, আবৃত্তি হবে, শ্রুত হবে কবিতা। কবিতা-অনুরাগী, কবিতা-স্রষ্টা দিয়ে যেতে থাকবেন নিজেদের বোধ ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ অন্তহীন সংজ্ঞা । কবি না বলে কবিতা-স্রষ্টা বললাম। কারণ, কবিতার বিপরীতে অবস্থান যার, সেই বিজ্ঞানের সাধকরাও কবিতা রচনা করে গেছেন, নতুন সৃষ্টির আনন্দে।কৃষ্ণা বসু, মল্লিকা সেনগুপ্ত, সহ পৃথিবীর তাঁবৎ বাস্তববাদী ও পরাবাস্তববাদী কবি কবিতা নিয়ে তাঁদের হাজারো ভাবনার কথা বলে গেছেন অকপটে, নানা অনুষঙ্গে। আমার স্বল্প বিদ্যায়, স্বল্প পরিসরে আজ তাই নিয়ে একটু ফিরে দেখা, এক অবিস্মরণীয় পরিক্রমা।

মেয়েদের কথা বললাম বটে, তবে এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই শুধু মেয়েদের জন্যই কবিতা লিখেছেন মল্লিকা৷ ১৯৮৩সালে মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘চল্লিশ চাঁদের আয়ু’ শীর্ষক প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই প্রথম বইটিতেই তাঁর কবিতাগুলোর ভাবনা ছিল সামাজিক পটভূমিকায় নরনারীর সম্পর্ক। তাঁর লেখা ছাপার হরফে পাঠক পাঠিকাদের হাতে আসার সাথে সাথেই তুমুল জনপ্রিয়তা পান মল্লিকা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, মল্লিকার প্রথম বই চল্লিশ চাঁদের আয়ুপড়েই তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। মোহের কারণটি বিশদ জানাননি, শুধু লিখেছেন, ‘কোনও কোনও কবির কয়েকটি রচনা পড়লেই বোঝা যায়, এরা হারিয়ে যাবার জন্য আসেনি।’
কী ছিল ১৯৮৩-র সেই চটি বইয়ে? ‘ঘর’ নামের কবিতাটি নেওয়া যাক।

‘বাঁশের মাচান বাঁধো সঙ্গমের আগে, ঘর হবে
পুত্র বেঁধে নেব পিঠে
নদী দৃষদ্বতী আজো বইছে সেখানে, পলি, নতুন উদ্ভিদ।’
আর যাযাবর হয়ে ঘুরতে চায় না এই নারী। পিঠে বাঁশের মাচান নিয়ে কোথায় যাবে সে? ঋগ্বেদের দৃষদ্বতী নদী। সেখানেই আছে পলি, নতুন উদ্ভিদ বা নতুন জীবন। অতীতের নদী আর বর্তমানের পলিমাটির অনুষঙ্গেই লাইনটি ধাক্কা মারে মনে, তৈরি হয় কবিতা।
তাঁর আগুন ঝরানো কবিতায় বার বার কথা বলেছে ‘হাঘরে আর দেবদাসীরা’৷ যদিও মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতা সম্পর্কে একটি লাইনও লেখা হলে মেয়েদের কথাই আগে চলে আসে কারণ যখন কবিতা লিখতে এসেছিলেন মল্লিকা তখন হাঘরেদের নিয়ে কবিতা লেখার কলমের অভাব ছিল না, কম পড়েছিল মেয়েদের কথা বলতে পারে এমন কলম৷ নির্যাতিতা মহিলাদের পাশাপাশি লড়াকু মহিলারাও বার বার বিষয় হয়েছেন মল্লিকার কবিতায়৷ স্কুলবাসে যৌন হেনস্থার শিকার হয় ছোট্ট একটি মেয়ে --- সে মেয়ে জায়গা পায় মল্লিকার কবিতায়৷

২০০১ সালে বালিকাকে যৌনহয়রানির দায়ে বাসের ড্রইভার হেলপারের গ্রেফতার হওয়া নিয়ে তিনি লিখেছেন মর্মস্পর্শী কবিতা। বাচ্চামেয়েটির প্রশ্ন যে কোনো পাঠককেই বিচলিত করে—

দুষ্টু কাকু দুষ্টু চাচা
থাকুক না তার ঘরে
বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে কেন
অসভ্যতা করে !

[বালিকা ও দুষ্টু লোক]
১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় মল্লিকার 'অর্ধেক পৃথিবী'৷ এই গ্রন্থে তার কিছু কিছু কবিতা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে৷' 'অর্ধেক পৃথিবী'তে মল্লিকা আর শুদ্ধ কবিতার বেড়ি পরিয়ে তাঁর কবিতাকে পঙ্গু করে রাখেননি, স্পেডকে তিনি স্পেডই বলেছে , বর্শাফলকের মতো তাঁর কাব্যভাষা ছিন্ন করেছে সাংকেতিক কুয়াশা, আলো ফেলেছে এমন কিছু কিছু বিষয়ের উপর, যে বিষয়গুলি মল্লিকার আগে আর অন্য কোনও কবির কলমে ঠাঁই পায়নি৷ কিন্ত্ত এতখানি স্পষ্ট ভাষায় কবিতা লিখলেন কেন মল্লিকা?

মল্লিকা আসলে একটা বিশ্বাস থেকে কবিতা লিখতেন।ঠিক কী ছিল সেই বিশ্বাস? ‘আকালের মধ্যে সারস’ নামে অনুবাদ-কবিতার বইটি বাদ দিলে মল্লিকার কাব্যগ্রন্থ ১৪টি। গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সব মিলিয়ে ৪৬৫টি কবিতা! সেখানে তিনি বিশ্বাস রাখছেন নারী-পুরুষের সমানাধিকারে, বিশ্বাস রাখছেন ধর্মনিরপেক্ষতায়, আস্থা রাখছেন সমকালে। সেই কারণেই ‘ইনস্যাট ১’ থেকে গুজরাত দাঙ্গা, মেধা পটেকর, খেজুরি, তেখালি ব্রিজ, প্রিয়ঙ্কা-রিজওয়ানুর ইত্যাদি শব্দ ঢুকে পড়ে তাঁর কবিতায়। বছর চারেক আগে রাজ্য যখন উত্তাল, কবি-শিল্পীদের মধ্যে ‘আমরা-ওরা’, মল্লিকাও তখন শিবির বেছে নিয়েছিলেন। কোন শিবির, ‘নিশ্চিন্দিপুর’ কবিতায় আজও তার প্রমাণ,

‘নিশ্চিন্দিপুরের পথে শিল্পায়ন হলে সর্বজয়ার সংসারটা হয়তো বেঁচে যাবে।’

(ক্রমশ)

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন