৪ ডিসে, ২০১৩

ছোটগল্প - অভিলাষা

অমলাদিদি ও অমলতাস
অভিলাষা


আজ অনেকদিন পরে পুরানো অ্যালবাম খুলতেই ঘিরে ধরলো ন্যাপথালিনের গন্ধ। সাথে ভুলে যাওয়া দিন, হারিয়ে ফেলা মানুষের স্মৃতি যেন ঝাপিয়ে পড়ল। সাথে মন কেমন করা একটা আদরমাখা ডাক “ভাইটু, ও ভাইটু”। অমলাদিদি, আমার ভাইফোঁটা,রাখী, আমার ঘুড়ি লাটাই,মার্বেল গুলি,গরমের ছুটীর কুলফি মালাই, কাসুন্দী সর্ষেরতেল লঙ্কা দিয়ে কাঁচা আমমাখা, শীতের নতুন ডিজাইনের সোয়েটার, ছাদের পিকনিক,কুলের আচার । মায়ের মার, ঠাকুমার বকা, বাবার কানমলা থেকে বাঁচার ঢাল, সব আবদার রাখার আপনজন, আমাদের পাশের বাড়ীর অমলাদিদি।

আমি তখন ক্লাস থ্রি সবে, অমলাদিদি শাড়ী পরে মেয়েদের হাইস্কুলে যায়। বাড়ী থেকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল সম্বন্ধ করে,ব্যবসায়ী ঘর, বড়লোক শ্বশুরবাড়ী।দিদি আর আমি দুজনেই খুব কেঁদেছিলাম। পরে কানাঘুষোয় জেনেছিলাম অমলাদিদি নাকি কোন এক “বজ্জাত বেজাত ছেলের” খপ্পরে পড়েছে। তাড়াতাড়ি বিয়ে না দিলে বাড়ীর লোকের মুখে চুনকালি মাখাবে। তখন মানে বুঝিনি।মানে বুঝেছি আরো খনিকটা বড় হয়ে। এর মধ্যেই জানা হয়ে গেছে ওর বরটি নাকি স্কিজোফ্রেনিক,বছর পাঁচেক মারধোর, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অপবাদ, আকথা- কুকথা, অনেক কিছু সয়েও মানাতে না পেরে ঘর পালিয়ে দিদি আমার ঘর পেতেছে সেই পুরানো মনের মানুষটির সাথে।বাড়ীর কেউ তাই খোঁজ রাখেনা, নামটাও নেয় না আর।খালি আমার ভালোমানুষ মা নিশিকালীমন্দিরে পূজো দিতে গেলে সবার চোখ কান এড়িয়ে অমলাদিদির খোঁজখবর নিতে যায়।এমনকি, ঠাকুমা বা অমলাদিদির মা সইপিসি জানতে পারলে বকবে ভেবেই বুঝি আমাকেও সাথে নেয় না।অথচ আমি তো জানি মন্দিরপাড়ার বন্ধ গলির শেষ বাড়ীতে অমলাদিদির কবুতরী সংসার। আজ হঠাৎই দিদির জন্য মনটা কেমন করে ওঠায় লুকিয়ে দেখতে গেলাম, দূর থেকেই নজরে এলো, উদাস চোখে আটপৌরে হলুদ শাড়ীর আঁচলে পরিপাটি দিদি আমার আনমনে আকাশের দিকে চেয়ে ছাদে দাঁড়ানো। মনে পড়ে গেল হলুদ শাড়ী,হলুদ ফুল,হলুদ আবির, আসলে হলুদ রংটাই বড় প্রিয় ওর।হাওয়ায় চুল গুলো মুখে ঠোঁটে বিরক্ত করছিল, একটা গাছের আড়ালে মেঘ চোখে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, মনে হচ্ছিলো একছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি আগের মতন , সঙ্কোচে পারি নি।

তারাশংকর অমলতাস গাছের কথা লিখেছেন । অমলাদিদি বলেছিল, অমলতাস এক ফুলগাছের নাম, হলুদ গুচ্ছ ফুলের গাছ ।আজ হলুদ শাড়ীপরা আকাশের দিকে তাকানো অমলাদিদির গোধূলীর আলো রাঙানো সুখী মুখ দেখে কেন জানিনা সেই অমলতাসের কথাই মনে হল, মনে হল আমার অমলাদিদিও এখন সেই অমলতাসের মত জীবনের লাবণ্যে ভরপুর হয়ে শ্বাস নিচ্ছে,বাঁচছে,ভালো আছে।আমাদের বাড়ীর সামনে অমলাদিদির নামে একটা অমলতাসের চারা পুঁতেছি।ঠিক করেছি, প্রথম যেদিন ফুল আসবে সেইদিন হলুদ গুচ্ছফুলের তোড়া নিয়েই দিদির বাড়ী যাবো।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন